এম এ হোসাইন
সম্প্রতি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকর্তৃক শতাধিক পণ্যের ওপর কর বৃদ্ধি করার সিদ্ধান্তটি সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। এমন এক সময়ে সিদ্ধান্তটি নেওয়া হলো যখন মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে চলেছে এবং অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ক্রমশ খারাপ হচ্ছে। এই কর বৃদ্ধি সাধারণ মানুষের আর্থিক সক্ষমতাকে আরও সংকটাপন্ন করে তুলেছে। ভ্যাট ও কর বৃদ্ধি মূলত প্রয়োজনীয় পণ্য ও সেবার ওপর প্রভাব ফেলেবে, বাজারমূল্য বাড়িয়ে দেবে এবং গরিব ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর জন্য জীবনযাত্রা আরও কঠিন করে তুলবে। রাজস্ব আয়ের মূল উৎস হিসেবে পরোক্ষ করের ওপর সরকারের নির্ভরশীলতা একটি উদ্বেগজনক প্রবণতা, কারণ এ ধরনের কর সরাসরি পণ্য ও সেবার মূল্যের সঙ্গে সম্পর্কিত এবং জনগণের ওপর অপ্রত্যক্ষভাবে বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি করে।
বর্তমানে ক্রমক্ষীয়মান ক্রয়ক্ষমতার অর্থনীতিতে এই কর বৃদ্ধির সিদ্ধান্তটি সরকারের অগ্রাধিকারভিত্তিক নির্বাচন নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তোলে। সাধারণ মানুষের ওপর করের বোঝা চাপিয়ে দিয়ে ধনী শ্রেণীকে শিথিলতা দেখানো একটি অন্যায্য নীতি। ধনী ব্যক্তি ও বড় বড় কর্পোরেট কোম্পানিগুলো প্রায়শই কর ফাঁকি দেয় বা বিভিন্ন কর ছাড় সুবিধা উপভোগ করে, যদিও তারা প্রচুর আয় করে এবং বিশাল সম্পদ সঞ্চয় করে। কর সংগ্রহে এ বৈষম্য দেশের সামাজিক ন্যায়বিচার ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাকে দুর্বল করে ফেলেছে। তাই সরকারকে কর ফাঁকি রোধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে এবং ধনী শ্রেণিকে জাতীয় কোষাগারে তাদের ন্যায্য অবদান রাখতে বাধ্য করতে হবে। এটি করলে এরূপ কঠোর পরোক্ষ করের প্রয়োজন কমে যাবে এবং সাধারণ মানুষের ওপর চাপ হ্রাস পাবে।
টিসিবির মাধ্যমে নিত্যপণ্য দ্রব্য বিক্রির কার্যক্রম স্থগিত করার সিদ্ধান্তটি গরিব শ্রেণীর সমস্যাকে আরও জটিল করে তুলেছে। এই কার্যক্রম যা কম দামে প্রয়োজনীয় পণ্য সরবরাহ করতো, এতে নিম্নআয়ের পরিবারগুলোর জন্য কিছুটা স্বস্তির ছিল। উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি ও অনিরাপদ আয়ের প্রেক্ষাপটে এর স্থগিতাদেশ সরকারের অর্থনৈতিক নীতির সঙ্গে বাস্তবতার গরমিলকে প্রতিফলিত করে। জীবনযাত্রার উচ্চ ব্যয়ের সাথে সংগ্রামরত গরিব ও মধ্যবিত্ত শ্রেণী এখন আরও কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হচ্ছে। এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ সহায়তা প্রক্রিয়া না থাকায় জনআস্থা কমছে এবং সামাজিক বৈষম্য বাড়ছে।
এ সিদ্ধান্তগুলো সরকারের আর্থিক, রাজস্ব ও বাজার নীতির মধ্যে সমন্বয়ের অভাবকে প্রতিফলিত করে। বাজার স্থিতিশীল করতে এবং মুদ্রাস্ফীতির দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত জনগণের জন্য সহায়তা প্রদানের পরিবর্তে, সরকার এমন পদক্ষেপ নিয়েছে যা অর্থনৈতিক বৈষম্য বাড়িয়ে তুলছে। বর্তমান সরকারের উচিত, ধনীদের ওপর সরাসরি করের ওপর বেশি জোর দিয়ে রাজস্ব নীতি পুনর্বিবেচনা করা, পরোক্ষ করের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনা। এমন পরিবর্তন হলে অর্থনীতিকে ভারসাম্যপূর্ণ করবে এবং সামাজিক ন্যায়বিচার ও জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধারে সাহায্য করতে পারে।
অর্থবছরের মাঝামাঝি সময়ে প্রেসিডেন্সিয়াল অধ্যাদেশের মাধ্যমে নতুন কর আরোপ পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। প্রায় ১০০ পণ্য ও সেবার ওপর বাড়তি মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) এবং পরিপূরক শুল্ক (এসডি), যার মধ্যে খাদ্য, পোশাক, টেলিযোগাযোগ এবং পরিবহন অন্তর্ভুক্ত, জনমনে ব্যাপক অসন্তোষ সৃষ্টি করেছে। এই পদক্ষেপগুলো এমন সময়ে নেওয়া হয়েছে যখন অর্থনীতি ক্রমাগত দুই সংখ্যার মুদ্রাস্ফীতি মোকাবিলা করছে এবং প্রবৃদ্ধি দুই শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। কর বৃদ্ধির এই আকস্মিক সিদ্ধান্ত এর প্রয়োজনীয়তা ও সম্ভাব্য প্রভাব সম্পর্কে ইউনূস সরকারের মধ্যে সমন্বয়হীনতার সম্পর্কে যথেষ্ট প্রমাণ তোলে ধরে।
এ সিদ্ধান্তের অন্যতম প্রধান চালক মনে হচ্ছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) চাপ, যা নির্দিষ্ট আর্থিক সংস্কারের সঙ্গে ৪.৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ ছাড়ের শর্ত জুড়ে দিয়েছে। এর মধ্যে একটি শর্ত হলো ২০২৫-২৬ অর্থবছরের মধ্যে কর-জিডিপি অনুপাত ০.২ শতাংশ বাড়ানো, যা অতিরিক্ত ১২,০০০ কোটি টাকার কর আহরণ করতে হবে। এটিই প্রথমবার নয় যে আইএমএফ এ ধরনের শর্ত আরোপ করেছে।
সরকারি কর্মকর্তারা দাবি করেছেন যে, এই বাড়তি কর মুদ্রাস্ফীতি বাড়াবে না, কারণ আওতাভুক্ত পণ্যের অনেকগুলোই ভোক্তা মূল্য সূচক (সিপিআই) খাতে অন্তর্ভুক্ত নয়। তবে এই যুক্তি বৃহত্তর অর্থনৈতিক বাস্তবতাকে যথেষ্ট প্রতিফলিত করে না। উদাহরণস্বরূপ, পোশাকে ভ্যাট ৭.৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করার ফলে গরিব ও মধ্যবিত্ত শ্রেণী বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে, যাদের আয়ের একটি বড় অংশ এ ধরনের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রে ব্যয় হয়। তদ্রƒপ মিষ্টি, টেলিযোগাযোগ এবং অন্যান্য সাধারণ সেবার ওপর বেশি কর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করবে, যা পরিবারের বাজেট সংকুচিত করবে এবং অর্থনৈতিক সমস্যাগুলোকে আরও গভীর করবে।
এ পদক্ষেপগুলোর বিরূপ প্রভাব কেবল ভোক্তাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বিশেষত ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ও প্রভাব ফেলবে। অনেক ব্যবসায়ী উচ্চ করের কারণে তাদের কার্যক্রমের ওপর প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। টেলিযোগাযোগের ওপর নির্ভরশীল ক্ষুদ্র ব্যবসাগুলো মোবাইল ফোন এবং ইন্টারনেট সেবার বাড়তি করের কারণে বেশি ব্যয় বহন করতে হবে। পূর্বের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, নির্দিষ্ট পণ্য ও সেবার ওপর ভ্যাট কমানো হলে ভোক্তা চাহিদা বাড়ায় এবং রাজস্ব বৃদ্ধি পায়। মূল্য সংবেদনশীল পণ্য ও সেবার ওপর ভ্যাট দ্বিগুণ করার ফলে চাহিদা কমার ঝুঁকি রয়েছে, যা রাজস্বের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে ব্যর্থ হতে পারে এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে আরও দুর্বল করে তুলতে পারে।
যদিও সরকার দাবি করেছে যে চাল, পেঁয়াজ এবং আলুর মতো প্রয়োজনীয় পণ্যের শুল্ক কমানোর মাধ্যমে কর বৃদ্ধির প্রভাব লাঘব করা হবে, কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন চিত্র উপস্থাপন করে। এ পণ্যগুলোর ওপর শুল্ক মওকুফ করা সত্ত্বেও দাম উল্লেখযোগ্যভাবে কমেনি। এর পাশাপাশি, টিসিবি কর্তৃক পণ্য বিক্রয় কার্যক্রম স্থগিত এবং লক্ষাধিক পরিবারের কার্ড বাতিল হওয়ায় নিম্নআয়ের পরিবারগুলো গুরুত্বপূর্ণ সহায়তা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। ঐতিহ্যগতভাবেই রমজান মাসে প্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি ঘটে। তাই আসন্ন রমজানে ভোক্তাদের ওপর অর্থনৈতিক চাপ আরও বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বাংলাদেশের কর কাঠামো সংস্কারের খুবই প্রয়োজন। দেশের কর-জিডিপি অনুপাত দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বনিম্নগুলোর একটি। এই বৈষম্য সরাসরি করের পরিধি সম্প্রসারণের জরুরি প্রয়োজনীয়তাকে তুলে ধরে। বর্তমানে প্রায় ৬৮ শতাংশ উপযুক্ত করদাতা আয়কর প্রদান করেন না, যা একটি বিশাল ত্রুটি এবং সমাধান করা আবশ্যক। করের আওতা বৃদ্ধি এবং প্রত্যক্ষ করের ওপর বেশি গুরুত্বারোপ করে সরকারকে আরও ন্যায়সঙ্গত ও কার্যকর রাজস্ব ব্যবস্থা গড়ে তুলা আবশ্যক।
বাস্তবে বাংলাদেশ ব্যাপকভাবে পরোক্ষ করের ওপর নির্ভর করেছে, যা গরিবদের ওপর বেশি প্রভাব ফেলে। এর বিপরীতে, ভারত যেমন দেশগুলোর কর রাজস্বের একটি বড় অংশ প্রত্যক্ষ কর থেকে আসে, যা একটি আরও ভারসাম্যপূর্ণ এবং ন্যায়সঙ্গত ব্যবস্থা তৈরি করে। প্রত্যক্ষ করের ওপর গুরুত্বারোপ করলে রাজস্ব বৃদ্ধি পাওয়ার পাশাপাশি অর্থনৈতিক বৈষম্যও হ্রাস পাবে। কর ফাঁকি রোধ এবং কর প্রশাসন উন্নত করা এই প্রক্রিয়ার জন্য অপরিহার্য। অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, কর ফাঁকির কারণে বাংলাদেশ প্রতি বছর ৫৬,০০০ কোটি থেকে ৩,০০,০০০ কোটি টাকা হারায়। প্রযুক্তির সুষ্ঠু ব্যবহার এবং কার্যকরী আইন প্রয়োগের পদ্ধতির মাধ্যমে এই হারানো রাজস্ব পুনরুদ্ধার করা যেতে পারে এবং পশ্চাৎমুখী কর নীতির প্রয়োজন কমাতে পারে।
বর্তমান কর বৃদ্ধির ফলে ভোক্তা এবং ব্যবসার ওপর অর্থনৈতিক চাপ নিঃসন্দেহে বেড়ে যাবে। এ চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায়, সরকারকে কর কাঠামো এবং সংগ্রহ পদ্ধতির ব্যাপক সংস্কার করতে হবে। প্রত্যক্ষ করের ওপর অগ্রাধিকার দেয়া, করের পরিধি সম্প্রসারণ করা এবং আইনের প্রয়োগ শক্তিশালী করে একটি টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন এবং সামাজিক বৈষম্য হ্রাস করতে হবে।
পরিশেষে, রাজস্ব সংগ্রহে পরোক্ষ করের ওপর সরকারের নির্ভরশীলতা এবং প্রাতিষ্ঠানিক সমস্যাগুলো সমাধানে ব্যর্থতা সাধারণ জনগণের জন্য অর্থনৈতিক সংকট আরও বাড়িয়ে তোলার ঝুঁকি সৃষ্টি করছে। কর নীতি সংস্কার করে এবং রাজস্ব আহরণে আরও ন্যায়সঙ্গত পদ্ধতি গ্রহণের মাধ্যমে সরকার আরও একটি ন্যায়সঙ্গত এবং স্থিতিশীল অর্থনীতি গড়ে তুলতে পারে। তবে তাৎক্ষণিক ও সিদ্ধান্তমূলক পদক্ষেপ ছাড়া বর্তমান কর ব্যবস্থা নীতির সঙ্গে বাস্তবতার ফারাক আরও বাড়াবে, যার ফলে গরিব ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনার প্রধান বোঝা বইতে হবে।
[লেখক : রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক]
এম এ হোসাইন
বৃহস্পতিবার, ১৬ জানুয়ারী ২০২৫
সম্প্রতি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকর্তৃক শতাধিক পণ্যের ওপর কর বৃদ্ধি করার সিদ্ধান্তটি সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। এমন এক সময়ে সিদ্ধান্তটি নেওয়া হলো যখন মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে চলেছে এবং অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ক্রমশ খারাপ হচ্ছে। এই কর বৃদ্ধি সাধারণ মানুষের আর্থিক সক্ষমতাকে আরও সংকটাপন্ন করে তুলেছে। ভ্যাট ও কর বৃদ্ধি মূলত প্রয়োজনীয় পণ্য ও সেবার ওপর প্রভাব ফেলেবে, বাজারমূল্য বাড়িয়ে দেবে এবং গরিব ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর জন্য জীবনযাত্রা আরও কঠিন করে তুলবে। রাজস্ব আয়ের মূল উৎস হিসেবে পরোক্ষ করের ওপর সরকারের নির্ভরশীলতা একটি উদ্বেগজনক প্রবণতা, কারণ এ ধরনের কর সরাসরি পণ্য ও সেবার মূল্যের সঙ্গে সম্পর্কিত এবং জনগণের ওপর অপ্রত্যক্ষভাবে বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি করে।
বর্তমানে ক্রমক্ষীয়মান ক্রয়ক্ষমতার অর্থনীতিতে এই কর বৃদ্ধির সিদ্ধান্তটি সরকারের অগ্রাধিকারভিত্তিক নির্বাচন নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তোলে। সাধারণ মানুষের ওপর করের বোঝা চাপিয়ে দিয়ে ধনী শ্রেণীকে শিথিলতা দেখানো একটি অন্যায্য নীতি। ধনী ব্যক্তি ও বড় বড় কর্পোরেট কোম্পানিগুলো প্রায়শই কর ফাঁকি দেয় বা বিভিন্ন কর ছাড় সুবিধা উপভোগ করে, যদিও তারা প্রচুর আয় করে এবং বিশাল সম্পদ সঞ্চয় করে। কর সংগ্রহে এ বৈষম্য দেশের সামাজিক ন্যায়বিচার ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাকে দুর্বল করে ফেলেছে। তাই সরকারকে কর ফাঁকি রোধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে এবং ধনী শ্রেণিকে জাতীয় কোষাগারে তাদের ন্যায্য অবদান রাখতে বাধ্য করতে হবে। এটি করলে এরূপ কঠোর পরোক্ষ করের প্রয়োজন কমে যাবে এবং সাধারণ মানুষের ওপর চাপ হ্রাস পাবে।
টিসিবির মাধ্যমে নিত্যপণ্য দ্রব্য বিক্রির কার্যক্রম স্থগিত করার সিদ্ধান্তটি গরিব শ্রেণীর সমস্যাকে আরও জটিল করে তুলেছে। এই কার্যক্রম যা কম দামে প্রয়োজনীয় পণ্য সরবরাহ করতো, এতে নিম্নআয়ের পরিবারগুলোর জন্য কিছুটা স্বস্তির ছিল। উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি ও অনিরাপদ আয়ের প্রেক্ষাপটে এর স্থগিতাদেশ সরকারের অর্থনৈতিক নীতির সঙ্গে বাস্তবতার গরমিলকে প্রতিফলিত করে। জীবনযাত্রার উচ্চ ব্যয়ের সাথে সংগ্রামরত গরিব ও মধ্যবিত্ত শ্রেণী এখন আরও কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হচ্ছে। এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ সহায়তা প্রক্রিয়া না থাকায় জনআস্থা কমছে এবং সামাজিক বৈষম্য বাড়ছে।
এ সিদ্ধান্তগুলো সরকারের আর্থিক, রাজস্ব ও বাজার নীতির মধ্যে সমন্বয়ের অভাবকে প্রতিফলিত করে। বাজার স্থিতিশীল করতে এবং মুদ্রাস্ফীতির দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত জনগণের জন্য সহায়তা প্রদানের পরিবর্তে, সরকার এমন পদক্ষেপ নিয়েছে যা অর্থনৈতিক বৈষম্য বাড়িয়ে তুলছে। বর্তমান সরকারের উচিত, ধনীদের ওপর সরাসরি করের ওপর বেশি জোর দিয়ে রাজস্ব নীতি পুনর্বিবেচনা করা, পরোক্ষ করের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনা। এমন পরিবর্তন হলে অর্থনীতিকে ভারসাম্যপূর্ণ করবে এবং সামাজিক ন্যায়বিচার ও জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধারে সাহায্য করতে পারে।
অর্থবছরের মাঝামাঝি সময়ে প্রেসিডেন্সিয়াল অধ্যাদেশের মাধ্যমে নতুন কর আরোপ পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। প্রায় ১০০ পণ্য ও সেবার ওপর বাড়তি মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) এবং পরিপূরক শুল্ক (এসডি), যার মধ্যে খাদ্য, পোশাক, টেলিযোগাযোগ এবং পরিবহন অন্তর্ভুক্ত, জনমনে ব্যাপক অসন্তোষ সৃষ্টি করেছে। এই পদক্ষেপগুলো এমন সময়ে নেওয়া হয়েছে যখন অর্থনীতি ক্রমাগত দুই সংখ্যার মুদ্রাস্ফীতি মোকাবিলা করছে এবং প্রবৃদ্ধি দুই শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। কর বৃদ্ধির এই আকস্মিক সিদ্ধান্ত এর প্রয়োজনীয়তা ও সম্ভাব্য প্রভাব সম্পর্কে ইউনূস সরকারের মধ্যে সমন্বয়হীনতার সম্পর্কে যথেষ্ট প্রমাণ তোলে ধরে।
এ সিদ্ধান্তের অন্যতম প্রধান চালক মনে হচ্ছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) চাপ, যা নির্দিষ্ট আর্থিক সংস্কারের সঙ্গে ৪.৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ ছাড়ের শর্ত জুড়ে দিয়েছে। এর মধ্যে একটি শর্ত হলো ২০২৫-২৬ অর্থবছরের মধ্যে কর-জিডিপি অনুপাত ০.২ শতাংশ বাড়ানো, যা অতিরিক্ত ১২,০০০ কোটি টাকার কর আহরণ করতে হবে। এটিই প্রথমবার নয় যে আইএমএফ এ ধরনের শর্ত আরোপ করেছে।
সরকারি কর্মকর্তারা দাবি করেছেন যে, এই বাড়তি কর মুদ্রাস্ফীতি বাড়াবে না, কারণ আওতাভুক্ত পণ্যের অনেকগুলোই ভোক্তা মূল্য সূচক (সিপিআই) খাতে অন্তর্ভুক্ত নয়। তবে এই যুক্তি বৃহত্তর অর্থনৈতিক বাস্তবতাকে যথেষ্ট প্রতিফলিত করে না। উদাহরণস্বরূপ, পোশাকে ভ্যাট ৭.৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করার ফলে গরিব ও মধ্যবিত্ত শ্রেণী বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে, যাদের আয়ের একটি বড় অংশ এ ধরনের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রে ব্যয় হয়। তদ্রƒপ মিষ্টি, টেলিযোগাযোগ এবং অন্যান্য সাধারণ সেবার ওপর বেশি কর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করবে, যা পরিবারের বাজেট সংকুচিত করবে এবং অর্থনৈতিক সমস্যাগুলোকে আরও গভীর করবে।
এ পদক্ষেপগুলোর বিরূপ প্রভাব কেবল ভোক্তাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বিশেষত ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ও প্রভাব ফেলবে। অনেক ব্যবসায়ী উচ্চ করের কারণে তাদের কার্যক্রমের ওপর প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। টেলিযোগাযোগের ওপর নির্ভরশীল ক্ষুদ্র ব্যবসাগুলো মোবাইল ফোন এবং ইন্টারনেট সেবার বাড়তি করের কারণে বেশি ব্যয় বহন করতে হবে। পূর্বের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, নির্দিষ্ট পণ্য ও সেবার ওপর ভ্যাট কমানো হলে ভোক্তা চাহিদা বাড়ায় এবং রাজস্ব বৃদ্ধি পায়। মূল্য সংবেদনশীল পণ্য ও সেবার ওপর ভ্যাট দ্বিগুণ করার ফলে চাহিদা কমার ঝুঁকি রয়েছে, যা রাজস্বের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে ব্যর্থ হতে পারে এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে আরও দুর্বল করে তুলতে পারে।
যদিও সরকার দাবি করেছে যে চাল, পেঁয়াজ এবং আলুর মতো প্রয়োজনীয় পণ্যের শুল্ক কমানোর মাধ্যমে কর বৃদ্ধির প্রভাব লাঘব করা হবে, কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন চিত্র উপস্থাপন করে। এ পণ্যগুলোর ওপর শুল্ক মওকুফ করা সত্ত্বেও দাম উল্লেখযোগ্যভাবে কমেনি। এর পাশাপাশি, টিসিবি কর্তৃক পণ্য বিক্রয় কার্যক্রম স্থগিত এবং লক্ষাধিক পরিবারের কার্ড বাতিল হওয়ায় নিম্নআয়ের পরিবারগুলো গুরুত্বপূর্ণ সহায়তা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। ঐতিহ্যগতভাবেই রমজান মাসে প্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি ঘটে। তাই আসন্ন রমজানে ভোক্তাদের ওপর অর্থনৈতিক চাপ আরও বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বাংলাদেশের কর কাঠামো সংস্কারের খুবই প্রয়োজন। দেশের কর-জিডিপি অনুপাত দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বনিম্নগুলোর একটি। এই বৈষম্য সরাসরি করের পরিধি সম্প্রসারণের জরুরি প্রয়োজনীয়তাকে তুলে ধরে। বর্তমানে প্রায় ৬৮ শতাংশ উপযুক্ত করদাতা আয়কর প্রদান করেন না, যা একটি বিশাল ত্রুটি এবং সমাধান করা আবশ্যক। করের আওতা বৃদ্ধি এবং প্রত্যক্ষ করের ওপর বেশি গুরুত্বারোপ করে সরকারকে আরও ন্যায়সঙ্গত ও কার্যকর রাজস্ব ব্যবস্থা গড়ে তুলা আবশ্যক।
বাস্তবে বাংলাদেশ ব্যাপকভাবে পরোক্ষ করের ওপর নির্ভর করেছে, যা গরিবদের ওপর বেশি প্রভাব ফেলে। এর বিপরীতে, ভারত যেমন দেশগুলোর কর রাজস্বের একটি বড় অংশ প্রত্যক্ষ কর থেকে আসে, যা একটি আরও ভারসাম্যপূর্ণ এবং ন্যায়সঙ্গত ব্যবস্থা তৈরি করে। প্রত্যক্ষ করের ওপর গুরুত্বারোপ করলে রাজস্ব বৃদ্ধি পাওয়ার পাশাপাশি অর্থনৈতিক বৈষম্যও হ্রাস পাবে। কর ফাঁকি রোধ এবং কর প্রশাসন উন্নত করা এই প্রক্রিয়ার জন্য অপরিহার্য। অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, কর ফাঁকির কারণে বাংলাদেশ প্রতি বছর ৫৬,০০০ কোটি থেকে ৩,০০,০০০ কোটি টাকা হারায়। প্রযুক্তির সুষ্ঠু ব্যবহার এবং কার্যকরী আইন প্রয়োগের পদ্ধতির মাধ্যমে এই হারানো রাজস্ব পুনরুদ্ধার করা যেতে পারে এবং পশ্চাৎমুখী কর নীতির প্রয়োজন কমাতে পারে।
বর্তমান কর বৃদ্ধির ফলে ভোক্তা এবং ব্যবসার ওপর অর্থনৈতিক চাপ নিঃসন্দেহে বেড়ে যাবে। এ চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায়, সরকারকে কর কাঠামো এবং সংগ্রহ পদ্ধতির ব্যাপক সংস্কার করতে হবে। প্রত্যক্ষ করের ওপর অগ্রাধিকার দেয়া, করের পরিধি সম্প্রসারণ করা এবং আইনের প্রয়োগ শক্তিশালী করে একটি টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন এবং সামাজিক বৈষম্য হ্রাস করতে হবে।
পরিশেষে, রাজস্ব সংগ্রহে পরোক্ষ করের ওপর সরকারের নির্ভরশীলতা এবং প্রাতিষ্ঠানিক সমস্যাগুলো সমাধানে ব্যর্থতা সাধারণ জনগণের জন্য অর্থনৈতিক সংকট আরও বাড়িয়ে তোলার ঝুঁকি সৃষ্টি করছে। কর নীতি সংস্কার করে এবং রাজস্ব আহরণে আরও ন্যায়সঙ্গত পদ্ধতি গ্রহণের মাধ্যমে সরকার আরও একটি ন্যায়সঙ্গত এবং স্থিতিশীল অর্থনীতি গড়ে তুলতে পারে। তবে তাৎক্ষণিক ও সিদ্ধান্তমূলক পদক্ষেপ ছাড়া বর্তমান কর ব্যবস্থা নীতির সঙ্গে বাস্তবতার ফারাক আরও বাড়াবে, যার ফলে গরিব ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনার প্রধান বোঝা বইতে হবে।
[লেখক : রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক]