alt

উপ-সম্পাদকীয়

সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতদের পোস্টমর্টেম প্রসঙ্গে

আব্দুল মান্নান খান

: শনিবার, ২৫ জানুয়ারী ২০২৫

প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষ মারা যাচ্ছে। আহত হয়ে বিকলাঙ্গ হচ্ছে আরো অনেক বেশি। কিন্তু কারও যেন কোনো মাথা ব্যথা নেই এ ব্যাপারে। সড়কে দুর্ঘটনা ঘটতেই পারে এমনই যেন অবস্থা। আজ কতজন নিহত হলো কাল কতজন সেই হিসাবে না গিয়ে একটা বছরের হিসাবে কী এসেছে দেখা যাক।

৫ জানুয়ারি ২০২৫ একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় এসেছে ‘সড়ক দুর্ঘটনায় গত বছর নিহত ৮ হাজার ৫৪৩ জন’ এবং আহত হয়েছেন ১২ হাজার ৬০৮ জন। নিহতদের এই সংখ্যাটিকে ৩৬৫ দিয়ে ভাগ করলে আসে ২৩.৪০। অর্থাৎ গড়ে প্রতিদিন মারা গেছেন ২৩ জনেরও বেশি। বলতে চাচ্ছি, যারা এই প্রতিবেদনটি পরিবেশন করেছেন তারা কি বলতে পারবেন এর মধ্যে কতজনের লাশ দাফনের আগে পোস্টমর্টেম হয়েছে, কতজনের লাশ হাসপাতাল থেকে পোস্টমর্টেম না করে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। এটা জানা দরকার। কেন দরকার তা আমার পরিবারের করুণ কাহিনীটি শুনলে হয়তো কিছুটা পরিষ্কার হতে পারে।

সেদিন বেলা ২-৩টার দিকে খবর পেলাম, ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের ফরিদপুরের কাছে সড়ক দুর্ঘনায় একটি পরিবহন বাসের যাত্রীরা সবাই হতাহত। ওই বাসে আমার বোনের নাতনি, নাতি জামাই ও তাদের দুই ছেলেসহ যশোর থেকে ঢাকায় আসতেছিল। তাদের পরিণতি কী হয়েছে তখনো জানা যায়নি। তারপর ঢাকা থেকে রওনা করতে না করতেই খবর পেলাম ওদের চারজনের তিনজন স্পটেই মারা গেছে। সাড়ে তিন বছর বয়সের বড় ছেলেটা আহত অবস্থায় বেঁচে আছে। সবাইকে ফরিদপুর সদর হাসপাতালে নেয়া হয়েছে।

ঢাকা থেকে ফরিদপুর পৌঁছতে রাত প্রায় ১১টা বেজে গেল সেদিন। ততক্ষণে মরদেহগুলো গাড়িতে তুলে নিয়ে স্বজনরা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। আহত শিশুটিকেও প্রাথমিক চিকিৎসার পর সঙ্গে নিয়ে নিয়েছে তারা। আমরা উপস্থিত হলে যে হৃদয়বিদারক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় হাসপাতালের সামনে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এঅবস্থায় নিহতদের লাশের পোস্টমর্টেম হয়েছে কিনা তা আর কে জানতে চায়। বাড়িতে পৌঁছে জানলাম পোস্টমর্টেম ছাড়াই লাশগুলো হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দিয়েছে। পরিবারের সম্মতিতে হাসপাতাল একাজ করেছে পুলিশের উপস্থিতিতে। ‘আবার কাটাছেঁড়া হবে! দরকার নেই।’

তখন পরিবারের সবারই মনমানসিকতা কেমন থাকতে পারে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। বলা হয়ে থাকে ‘পিতার কাঁধে পুত্রের/সন্তানের লাশ, এর চেয়ে ভারি বিছু দুনিয়াতে নেই।’ অভিভাবকের অনুমতিতে পোস্টমর্টেম ছাড়াই লাশ হস্তান্তর করেছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। নিশ্চয়ই নিয়ম আছে, না হলে করবেন কেন। দুর্বল জায়গাটা আসলে ওইখানে। শোকাহত অবস্থায় একজন অভিভাবকের পক্ষে চাওয়া কি সম্ভব যেখানে তার দরদের সন্তান লাশ হয়ে পড়ে আছে তার আবার কাটাছেড়া হোক। আমি মনে করি সম্ভব না। কথা হলো, অভিভাবকদের কেন বলা হবে ‘আপনারা চাইলে পোস্টমর্টেম ছাড়া লাশ নিয়ে যেতে পারেন’। শোকের মুহূর্তে এমন কথা বলে শোক আরও উসকিয়ে দিয়ে তার সুযোগ নেয়া ছাড়া একে আর কী বলা যাবে।

স্বামী-স্ত্রী দুজনই চাকরিজীবী, ঈদের ছুটি ভোগ করে ঢাকায় ফেরার পথে মুহূর্তে সেদিন তছনছ হয়ে গেল দুটো পরিবার। বৃদ্ধ মা-বাবা ভাই-বোন তারপর আহত শিশুটির চিকিৎসা, কী হবে এদের। এর দায়ভার কার? এখানে পোস্টমর্টেম না করার ব্যাপারে আমার ধারণা পরিবহন তথা যানবাহন খাতের শক্তিশালী মহল এ ব্যাপারে সক্রিয়। তারা পরিবারের দুর্বল মুহূর্তের সুযোগ গ্রহ্রণ করে থাকে। পোস্টমর্টেম হলে মালিক পক্ষের অনেক অসুবিধা। পুলিশেরও অনেক কাজ বেড়ে যায় যদি নিহতের পরিবার কোর্টে যায, তদন্ত হয়। গাড়ির কাগজপত্রে, চালকের কাগজপত্রে যদি কোনো ত্রুটি ধরা পড়ে মালিককে জবাবগিহির আওতায় যেতে হয়। ক্ষতিপূরণও দিতে হতে পারে।

সড়ক দুর্ঘটনায় এই যে এতো মৃত্যু একে রীতিমতো হত্যা করার সামিল বলছেন কেউ কেউ। তা যায়-ই বলা হোক, এসব দুর্ঘটনার যদি তদন্ত হতো বিচার হতো দোষী সাব্যস্ত হলে শাস্তি হতো তাহলে আজ এই ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি বহুলাংশে এড়ানো যেত একথা কে না বলবে। গাড়ির জগতে গাড়ির লাইসেন্স ফিটনেস ইত্যাদি থাকা যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমন গাড়িচালকদের ড্রাইভিং লাইসেন্স সঠিকভাবে থাকাটাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। এমন কি তারও বেশি কারণ গাড়ির স্টিয়ারিং তার হাতে। আমার চাকরিজীবনের একটা ছোট্ট ঘটনা বলি যা আমাকে আজও পীড়া দেয়। তখন মোবাইল ফোন তেমন ছিল না। থাকলেও খুবই সীমিত। অফিসে আমি লক্ষ্য করলাম, প্রায় দিনই পুলিশের পরিচয়ে এক লোক আমার কক্ষে এসে আমার টেবিলের টেলিফোন সেটটা ব্যবহার করতে চাইছেন, করছেনও। তিনি আবার মাঝে মাঝে অফিসের বড় কর্তাদের কক্ষেও ঢোকেন দেখি। আমি কিছু বলতে পারছি না কিন্তু বিরক্ত হচ্ছি খুবই। এ অবস্থায় তাকে কিছু না বলে কান পাতলাম তিনি কী বিষয়ে আলাপ করেন তা জানতে। একদিন শুনলাম তিনি বলছেন, আমি যে লাইসেন্স দেবো তার মধ্যে কোনো দুই নম্বরি নেই, অরিজিনাল সই-স্বাক্ষর, সিল ছাপ্পড়। আরো একটু দেখে-শুনে বুঝলাম তিনি ড্রাইভিং লাইসেন্স বিক্রি করেন। কী মারাত্বক ঘটনা এ তো একেবারে ঠান্ডা মাথার খুনি! তারপর একদিন বললাম, আপনি গুরুতর অন্যায় কাজ করছেন। আপনি এবার দয়া করে আসুন। আর কখনো এই টেলিফোন ব্যবহার করবেন না। তারপর তিনি আর আমার টেবিলে আসেননি; কিন্তু আমার ভেতর একটা অপরাধ বোধ কাজ করতে থাকে যা আজও আমি বয়ে বেড়াচ্ছি। যেমন লোকটা তো আর থেমে থাকেনি। এ অপরাধ সে নিশ্চয়ই করেই গেছে যতদিন পেরেছে। আমার রুম থেকে বের করে দেয়া ছাড়া আমার কি আর কিছুই করার ছিল না! কেন পারিনি সেদিন তাকে আইনের হাতে তুলে দিতে।

সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতের কোনো লাশ পোস্টমর্টেম ছাড়া দাফন করা যাবে না এবং হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও লাশ হস্তান্তর করতে পারবেন না পোস্টমর্টেম ছাড়া। করলে সেটা হবে দ-নীয় অপরাধ। এমন একটা নির্দেশনা খুব জরুরি এখন।

কেউ জবাবদিহির ঊর্ধ্বে নন। একটা পরিবার পথে বসিয়ে দিয়ে যাবে, কারও কোন জবাবগিহি থাকবে না তা হতে পারে না। তদন্ত হতে হবে বিচার হতে হবে এবং এজন্যই প্রয়েপজন পোস্টমর্টেম। বিচারে কারও গাফিলতি না পাওয়া গেলে তখন কারও কিছু বলার থাকবে না।

এই পোস্টমর্টেম না করার পেছনে আরও একটা বিষয় কাজ করে বলে আমার ধারণা। যেমন বহু মানুষকে সেদিন বলতে শুনেছি, ওই পর্যন্তই ওদের হায়াত ছিল, মৃত্যুই ওদের টেনে নিয়ে গেছে ওইখানে। না হলে আগে বা পরের দিনও তো ওরা যেতে পারত, আগের বা পরের বাসেও তো টিকেট করতে পারত, এখানে কারও কিছু করার নেই- সবই আল্লাহ পাকের ইচ্ছা। আল্লার মাল আল্লা নিয়ে গেছে। আরো বলতে শুনেছি, পরিবারের সকলকে নিয়ে পরকালে ওই শিশু বেহেস্তে যাবে। সেদিন এমন কথা কাউকে বলতে শুনিনি, চালকের অদক্ষতার কারণে, ক্রটিপূর্ণ যানবাহনের কারণে, ভুয়া ড্রাইভিং লাইসেন্স বা লাইসেন্স ছাড়াই গাড়ি চালানোর কারণে এ এরকম দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। এর তদন্ত হওয়া দরকার, বিচার হওয়া দরকার, কেউ বলেনি।

তাই অনেক সময় এসব খুনিদের উদ্দেশে মনে মনে বলি, আপনারা নিশ্চিন্তে থাকতে পারেন। এই মৃত্যুর মিছিল কোনদিন আপনাদের সামনে গিয়ে গতিরোধ করে দাঁড়াতে পারবে না। অদৃষ্টবাদের জয়জয়কার ধ্বনির জাঁতাকলের নিচে চাপা পড়ে থাকবে ওদের আর্তনাদ। স্বজন হারিয়ে তারা কেবল আল্লাহকে ডাকবে। নিয়তির দোহাই দিয়ে বলবে, আল্লার মাল আল্লাহ নিয়ে গেছে, সবই কপাল।

আমরা সবাই জানি আমার পরিবারে যা ঘটেছে এমন ঘটনা অহরহই ঘটছে। যেখানে ঘটে সেখানে কিছু ভাঙচুর হয় রাস্তা অবরোধ হয়, পুলিশ যায়, হাসপাতালে একটা স্বাক্ষর রেখে অভিভাবক লাশ নিয়ে বাড়ি ফেরেন। তারপর যা হবার তাই হয়।

নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলন, রাজধানীর শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষাথীর বাসচাপায় নিহতের পর দেশব্যাপী জেগে ওঠা ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলনও ব্যর্থ হতে দেখেছি আমরা। দেখেছি সেদিন দায়িত্বশীল ক্ষমতাবান ব্যক্তির হাসিও, যে হাসিতে পুরো দেশবাসী মর্মাহত হয়েছিল। ‘রোম নগরী যখন পুড়ছে, নিরো তখন বাঁশি বাজাচ্ছে’ এমনটি আমরা আর দেখতে চাই না। আমরা চাই কেউ যেন দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে না পারে। তারই একটা অংশ হিসেবে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতদের লাশের পোস্টমর্টেম বাধ্যতামূলক করা হোক।

[লেখক : প্রাবন্ধিক]

আলো, অন্ধকার ও চরিত্রবান জীবন

শিক্ষকরা কেন বারবার মার খাবে?

মনোবিশ্লেষক নাট্যক্রিয়া অনুশীলনের ক্ষেত্র হোক সহজতর

প্রসঙ্গ জেনারেশন জেড

বাড়ছে বেকারত্ব : প্রতিকারে জরুরি পদক্ষেপ নিন

প্রকৃতির প্রতি সদয় হতে হবে

ছবি

আভিজাত্যের বাঁধ এবং প্রান্তিক মানুষ

বিশ্ব কুষ্ঠ দিবস

অর্থনীতি কোনদিকে যাচ্ছে?

বৈষম্যবিরোধী সংস্কার দরকার

রাজনীতির লালসালু ও ময়না দ্বীপ : জনগণের আস্থার সংকট

প্রদেশ গঠনের প্রস্তাব কি বাস্তবসম্মত

‘ভিলেজ পলিটিক্স’ ও সাধারণ গ্রামবাসী

রম্যগদ্য : ‘ধেয়ে আসছে বুলেট’

রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের জন্য পেনশন ও গ্র্যাচুইটি সময়ের দাবি

ফসলের দাম ও কৃষক

রূপাইয়া, ডন, অনন্ত কিংবা রেংদের মনের ক্ষত কে সারাবে?

পরিবেশ বিপর্যয় : শিক্ষার্থীদের করণীয়

বায়ুদূষণ রোধে প্রয়োজন জনসচেতনতা

কিশোর অপরাধ ও কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন

চাই জীবনমুখী যুগোপযোগী উচ্চশিক্ষা

খেজুর গুড়ের বাণিজ্যিক গুরুত্ব

হামাস-ইসরাইলের অস্ত্র বিরতি

ঝিমিয়ে পড়া অর্থনীতি

আদিবাসীদের প্রাণের স্পন্দন

ছবি

ট্রাম্পের বিস্ফোরক মন্তব্য ও যুক্তরাষ্ট্র-কানাডা সম্পর্ক

কৃতিত্ব অস্বীকারের অপসংস্কৃতি

পশ্চিমবঙ্গ : স্যালাইনে ফাঙ্গাস, অসহায় মানুষ

ছবি

আত্মপরিচয় ও জাতিসত্তার অঙ্গীকার : বৈচিত্র্যের মাঝে ঐক্য

এইচএমপিভি ভাইরাস : প্রয়োজন জনসচেতনতা

সিভিল সার্ভিস ক্যাডারে কেন সংস্কার জরুরি

কেন দ্যাখাও মিথ্যে স্বপ্ন

অনিয়ন্ত্রিত অটোরিকশা ও সড়ক দুর্ঘটনা

অপরিকল্পিত ভ্যাট ও কর বৃদ্ধি

ছবি

‘বেগমপাড়া’ হইতে খোলা চিঠি

সড়ক দুর্ঘটনার লাগাম টানবে কে

tab

উপ-সম্পাদকীয়

সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতদের পোস্টমর্টেম প্রসঙ্গে

আব্দুল মান্নান খান

শনিবার, ২৫ জানুয়ারী ২০২৫

প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষ মারা যাচ্ছে। আহত হয়ে বিকলাঙ্গ হচ্ছে আরো অনেক বেশি। কিন্তু কারও যেন কোনো মাথা ব্যথা নেই এ ব্যাপারে। সড়কে দুর্ঘটনা ঘটতেই পারে এমনই যেন অবস্থা। আজ কতজন নিহত হলো কাল কতজন সেই হিসাবে না গিয়ে একটা বছরের হিসাবে কী এসেছে দেখা যাক।

৫ জানুয়ারি ২০২৫ একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় এসেছে ‘সড়ক দুর্ঘটনায় গত বছর নিহত ৮ হাজার ৫৪৩ জন’ এবং আহত হয়েছেন ১২ হাজার ৬০৮ জন। নিহতদের এই সংখ্যাটিকে ৩৬৫ দিয়ে ভাগ করলে আসে ২৩.৪০। অর্থাৎ গড়ে প্রতিদিন মারা গেছেন ২৩ জনেরও বেশি। বলতে চাচ্ছি, যারা এই প্রতিবেদনটি পরিবেশন করেছেন তারা কি বলতে পারবেন এর মধ্যে কতজনের লাশ দাফনের আগে পোস্টমর্টেম হয়েছে, কতজনের লাশ হাসপাতাল থেকে পোস্টমর্টেম না করে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। এটা জানা দরকার। কেন দরকার তা আমার পরিবারের করুণ কাহিনীটি শুনলে হয়তো কিছুটা পরিষ্কার হতে পারে।

সেদিন বেলা ২-৩টার দিকে খবর পেলাম, ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের ফরিদপুরের কাছে সড়ক দুর্ঘনায় একটি পরিবহন বাসের যাত্রীরা সবাই হতাহত। ওই বাসে আমার বোনের নাতনি, নাতি জামাই ও তাদের দুই ছেলেসহ যশোর থেকে ঢাকায় আসতেছিল। তাদের পরিণতি কী হয়েছে তখনো জানা যায়নি। তারপর ঢাকা থেকে রওনা করতে না করতেই খবর পেলাম ওদের চারজনের তিনজন স্পটেই মারা গেছে। সাড়ে তিন বছর বয়সের বড় ছেলেটা আহত অবস্থায় বেঁচে আছে। সবাইকে ফরিদপুর সদর হাসপাতালে নেয়া হয়েছে।

ঢাকা থেকে ফরিদপুর পৌঁছতে রাত প্রায় ১১টা বেজে গেল সেদিন। ততক্ষণে মরদেহগুলো গাড়িতে তুলে নিয়ে স্বজনরা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। আহত শিশুটিকেও প্রাথমিক চিকিৎসার পর সঙ্গে নিয়ে নিয়েছে তারা। আমরা উপস্থিত হলে যে হৃদয়বিদারক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় হাসপাতালের সামনে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এঅবস্থায় নিহতদের লাশের পোস্টমর্টেম হয়েছে কিনা তা আর কে জানতে চায়। বাড়িতে পৌঁছে জানলাম পোস্টমর্টেম ছাড়াই লাশগুলো হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দিয়েছে। পরিবারের সম্মতিতে হাসপাতাল একাজ করেছে পুলিশের উপস্থিতিতে। ‘আবার কাটাছেঁড়া হবে! দরকার নেই।’

তখন পরিবারের সবারই মনমানসিকতা কেমন থাকতে পারে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। বলা হয়ে থাকে ‘পিতার কাঁধে পুত্রের/সন্তানের লাশ, এর চেয়ে ভারি বিছু দুনিয়াতে নেই।’ অভিভাবকের অনুমতিতে পোস্টমর্টেম ছাড়াই লাশ হস্তান্তর করেছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। নিশ্চয়ই নিয়ম আছে, না হলে করবেন কেন। দুর্বল জায়গাটা আসলে ওইখানে। শোকাহত অবস্থায় একজন অভিভাবকের পক্ষে চাওয়া কি সম্ভব যেখানে তার দরদের সন্তান লাশ হয়ে পড়ে আছে তার আবার কাটাছেড়া হোক। আমি মনে করি সম্ভব না। কথা হলো, অভিভাবকদের কেন বলা হবে ‘আপনারা চাইলে পোস্টমর্টেম ছাড়া লাশ নিয়ে যেতে পারেন’। শোকের মুহূর্তে এমন কথা বলে শোক আরও উসকিয়ে দিয়ে তার সুযোগ নেয়া ছাড়া একে আর কী বলা যাবে।

স্বামী-স্ত্রী দুজনই চাকরিজীবী, ঈদের ছুটি ভোগ করে ঢাকায় ফেরার পথে মুহূর্তে সেদিন তছনছ হয়ে গেল দুটো পরিবার। বৃদ্ধ মা-বাবা ভাই-বোন তারপর আহত শিশুটির চিকিৎসা, কী হবে এদের। এর দায়ভার কার? এখানে পোস্টমর্টেম না করার ব্যাপারে আমার ধারণা পরিবহন তথা যানবাহন খাতের শক্তিশালী মহল এ ব্যাপারে সক্রিয়। তারা পরিবারের দুর্বল মুহূর্তের সুযোগ গ্রহ্রণ করে থাকে। পোস্টমর্টেম হলে মালিক পক্ষের অনেক অসুবিধা। পুলিশেরও অনেক কাজ বেড়ে যায় যদি নিহতের পরিবার কোর্টে যায, তদন্ত হয়। গাড়ির কাগজপত্রে, চালকের কাগজপত্রে যদি কোনো ত্রুটি ধরা পড়ে মালিককে জবাবগিহির আওতায় যেতে হয়। ক্ষতিপূরণও দিতে হতে পারে।

সড়ক দুর্ঘটনায় এই যে এতো মৃত্যু একে রীতিমতো হত্যা করার সামিল বলছেন কেউ কেউ। তা যায়-ই বলা হোক, এসব দুর্ঘটনার যদি তদন্ত হতো বিচার হতো দোষী সাব্যস্ত হলে শাস্তি হতো তাহলে আজ এই ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি বহুলাংশে এড়ানো যেত একথা কে না বলবে। গাড়ির জগতে গাড়ির লাইসেন্স ফিটনেস ইত্যাদি থাকা যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমন গাড়িচালকদের ড্রাইভিং লাইসেন্স সঠিকভাবে থাকাটাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। এমন কি তারও বেশি কারণ গাড়ির স্টিয়ারিং তার হাতে। আমার চাকরিজীবনের একটা ছোট্ট ঘটনা বলি যা আমাকে আজও পীড়া দেয়। তখন মোবাইল ফোন তেমন ছিল না। থাকলেও খুবই সীমিত। অফিসে আমি লক্ষ্য করলাম, প্রায় দিনই পুলিশের পরিচয়ে এক লোক আমার কক্ষে এসে আমার টেবিলের টেলিফোন সেটটা ব্যবহার করতে চাইছেন, করছেনও। তিনি আবার মাঝে মাঝে অফিসের বড় কর্তাদের কক্ষেও ঢোকেন দেখি। আমি কিছু বলতে পারছি না কিন্তু বিরক্ত হচ্ছি খুবই। এ অবস্থায় তাকে কিছু না বলে কান পাতলাম তিনি কী বিষয়ে আলাপ করেন তা জানতে। একদিন শুনলাম তিনি বলছেন, আমি যে লাইসেন্স দেবো তার মধ্যে কোনো দুই নম্বরি নেই, অরিজিনাল সই-স্বাক্ষর, সিল ছাপ্পড়। আরো একটু দেখে-শুনে বুঝলাম তিনি ড্রাইভিং লাইসেন্স বিক্রি করেন। কী মারাত্বক ঘটনা এ তো একেবারে ঠান্ডা মাথার খুনি! তারপর একদিন বললাম, আপনি গুরুতর অন্যায় কাজ করছেন। আপনি এবার দয়া করে আসুন। আর কখনো এই টেলিফোন ব্যবহার করবেন না। তারপর তিনি আর আমার টেবিলে আসেননি; কিন্তু আমার ভেতর একটা অপরাধ বোধ কাজ করতে থাকে যা আজও আমি বয়ে বেড়াচ্ছি। যেমন লোকটা তো আর থেমে থাকেনি। এ অপরাধ সে নিশ্চয়ই করেই গেছে যতদিন পেরেছে। আমার রুম থেকে বের করে দেয়া ছাড়া আমার কি আর কিছুই করার ছিল না! কেন পারিনি সেদিন তাকে আইনের হাতে তুলে দিতে।

সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতের কোনো লাশ পোস্টমর্টেম ছাড়া দাফন করা যাবে না এবং হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও লাশ হস্তান্তর করতে পারবেন না পোস্টমর্টেম ছাড়া। করলে সেটা হবে দ-নীয় অপরাধ। এমন একটা নির্দেশনা খুব জরুরি এখন।

কেউ জবাবদিহির ঊর্ধ্বে নন। একটা পরিবার পথে বসিয়ে দিয়ে যাবে, কারও কোন জবাবগিহি থাকবে না তা হতে পারে না। তদন্ত হতে হবে বিচার হতে হবে এবং এজন্যই প্রয়েপজন পোস্টমর্টেম। বিচারে কারও গাফিলতি না পাওয়া গেলে তখন কারও কিছু বলার থাকবে না।

এই পোস্টমর্টেম না করার পেছনে আরও একটা বিষয় কাজ করে বলে আমার ধারণা। যেমন বহু মানুষকে সেদিন বলতে শুনেছি, ওই পর্যন্তই ওদের হায়াত ছিল, মৃত্যুই ওদের টেনে নিয়ে গেছে ওইখানে। না হলে আগে বা পরের দিনও তো ওরা যেতে পারত, আগের বা পরের বাসেও তো টিকেট করতে পারত, এখানে কারও কিছু করার নেই- সবই আল্লাহ পাকের ইচ্ছা। আল্লার মাল আল্লা নিয়ে গেছে। আরো বলতে শুনেছি, পরিবারের সকলকে নিয়ে পরকালে ওই শিশু বেহেস্তে যাবে। সেদিন এমন কথা কাউকে বলতে শুনিনি, চালকের অদক্ষতার কারণে, ক্রটিপূর্ণ যানবাহনের কারণে, ভুয়া ড্রাইভিং লাইসেন্স বা লাইসেন্স ছাড়াই গাড়ি চালানোর কারণে এ এরকম দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। এর তদন্ত হওয়া দরকার, বিচার হওয়া দরকার, কেউ বলেনি।

তাই অনেক সময় এসব খুনিদের উদ্দেশে মনে মনে বলি, আপনারা নিশ্চিন্তে থাকতে পারেন। এই মৃত্যুর মিছিল কোনদিন আপনাদের সামনে গিয়ে গতিরোধ করে দাঁড়াতে পারবে না। অদৃষ্টবাদের জয়জয়কার ধ্বনির জাঁতাকলের নিচে চাপা পড়ে থাকবে ওদের আর্তনাদ। স্বজন হারিয়ে তারা কেবল আল্লাহকে ডাকবে। নিয়তির দোহাই দিয়ে বলবে, আল্লার মাল আল্লাহ নিয়ে গেছে, সবই কপাল।

আমরা সবাই জানি আমার পরিবারে যা ঘটেছে এমন ঘটনা অহরহই ঘটছে। যেখানে ঘটে সেখানে কিছু ভাঙচুর হয় রাস্তা অবরোধ হয়, পুলিশ যায়, হাসপাতালে একটা স্বাক্ষর রেখে অভিভাবক লাশ নিয়ে বাড়ি ফেরেন। তারপর যা হবার তাই হয়।

নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলন, রাজধানীর শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষাথীর বাসচাপায় নিহতের পর দেশব্যাপী জেগে ওঠা ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলনও ব্যর্থ হতে দেখেছি আমরা। দেখেছি সেদিন দায়িত্বশীল ক্ষমতাবান ব্যক্তির হাসিও, যে হাসিতে পুরো দেশবাসী মর্মাহত হয়েছিল। ‘রোম নগরী যখন পুড়ছে, নিরো তখন বাঁশি বাজাচ্ছে’ এমনটি আমরা আর দেখতে চাই না। আমরা চাই কেউ যেন দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে না পারে। তারই একটা অংশ হিসেবে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতদের লাশের পোস্টমর্টেম বাধ্যতামূলক করা হোক।

[লেখক : প্রাবন্ধিক]

back to top