alt

উপ-সম্পাদকীয়

অর্থনীতি কোনদিকে যাচ্ছে?

রেজাউল করিম খোকন

: রোববার, ২৬ জানুয়ারী ২০২৫

চলতি বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতির গতি কমবে। এর কারণ, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং বিনিয়োগ ও শিল্প খাতে ভাটার টান। বিপরীতে মূল্যস্ফীতি থাকবে চড়া। সরকারের মূল্যস্ফীতি কমানোর লক্ষ্য পূরণ হবে না। বিশ্বব্যাংক ‘ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক প্রসপেক্টস’ (বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সম্ভাবনা) শীর্ষক প্রতিবেদনের জানুয়ারি, ২০২৫ সংস্করণে চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছর নিয়ে এসব পূর্বাভাস তুলে ধরা হয়েছে। তারা বলছে, চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ৪ দশমিক ১ শতাংশে নামতে পারে, যা গত জুনের পূর্বাভাসের চেয়ে ১ দশমিক ৬ শতাংশীয় বিন্দু কম।

দেশের অর্থনীতির গতি করোনাকাল থেকেই মন্থর হয়ে গিয়েছিল। সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি আরেকটু মন্থর করেছে। এখন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নতি দরকার, জ্বালানি ও বিদ্যুতের দাম স্থিতিশীল রাখতে হবে এবং ব্যাংকঋণের সুদের হারে নিয়ন্ত্রণ করা দরকার। সরকারের উচিত বেসরকারি খাতের সঙ্গে আরও আলোচনা করা। এর পাশাপাশি ব্যবসা-অর্থনৈতিক খাতে প্রয়োজনীয় সংস্কারগুলো এখন করে ফেলা।

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দক্ষিণ এশিয়ায় মূল্যস্ফীতি চূড়ায় উঠেছিল ২০২২ সালের মাঝামাঝিতে। এর পর থেকে তা ধাপ ধাপে কমছে। ভারতে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর থেকে মূল্যস্ফীতি দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে রয়েছে (শুধু গত অক্টোবর ছাড়া)। নেপাল ও শ্রীলঙ্কা মূল্যস্ফীতি লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে নামিয়ে আনতে পেরেছে। পাকিস্তানে গত আগস্টে মূল্যস্ফীতি ২০২১ সালের পর প্রথমবারের মতো এক অঙ্কে নেমে আসে। বিপরীতে বাংলাদেশেই মূল্যস্ফীতি এখনো চড়া।

ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার তথ্য অনুযায়ী, ভারতে খাদ্যের দাম কমায় ডিসেম্বরে মূল্যস্ফীতি নেমেছে ৫ দশমিক ২২ শতাংশে। শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওয়েবসাইটে দেয়া প্রতিবেদন বলছে, ডিসেম্বরে দেশটিতে মূল্যস্ফীতি হয়নি; বরং মূল্য সংকোচন হয়েছে ১ দশমিক ৭ শতাংশ। অন্যদিকে পাকিস্তানে ডিসেস্বরে মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৪ দশমিক ১ শতাংশ। বিবিএসের হিসাবে, বাংলাদেশে ডিসেম্বর শেষে দেশে মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়িয়েছে ১০ দশমিক ৮৯ শতাংশ, অর্থাৎ হারটি এক অঙ্কে নামেনি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর গত বছর ১৪ আগস্ট আশা প্রকাশ করেছিলেন, পাঁচ থেকে ছয় মাসে মূল্যস্ফীতি সহনীয় হবে। প্রতিবেশী দেশগুলো মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ নিয়ে তার সুফল পেয়েছে। বাংলাদেশ যথাসময়ে যথাযথ পদক্ষেপ নেয়নি। নতুন সরকারকেও খুব ভিন্ন কিছু করতে দেখা যাচ্ছে না। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে মুদ্রা ও রাজস্ব নীতি এবং বাজার ব্যবস্থাপনায় সমন্বিত পদক্ষেপ দরকার। গোষ্ঠীস্বার্থ উপেক্ষা করে বর্তমান সরকার তা করতে পারত। কিন্তু দেখা যাচ্ছে সমন্বয় নেই। বাংলাদেশ ব্যাংক সুদের হার বাড়াচ্ছে মূল্যস্ফীতি কমাতে। অন্যদিকে সরকার কর বাড়িয়ে দিচ্ছে, যা মূল্যস্ফীতি বাড়াবে। এক মন্ত্রণালয় ডিম আমদানির অনুমতি দিচ্ছে, আরেক মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থা তা আটকে দিচ্ছে। মূল্যস্ফীতি কমবে, সে আশা করা যায় না। কারণ, বাজারে চালের দাম বাড়ছে। সবজির দাম কমেছে। তবে তা স্থায়ী না-ও হতে পারে। বাংলাদেশ নিম্নমুখী জিডিপি প্রবৃদ্ধি ও উচ্চ মূল্যস্ফীতির মতো দুটি ক্ষতিকর দিকের মধ্যে পড়ে গেছে। একদিকে মানুষের কর্মসংস্থান ও আয়ের সুযোগ কম, অন্যদিকে ব্যয় বাড়ছেই।

উত্তরাধিকার সূত্রেই একটি ভঙ্গুর অর্থনীতি পেয়েছে অন্তর্র্বর্তী সরকার। এই অর্থনীতি রাতারাতি ঠিক করা সহজ নয়। তবে অর্থনীতিকে সঠিক পথে নিতে সরকার কী করছে, সেই চিত্র জানাটা জরুরি। রাজস্ব আয় বাড়ানোর সহজ পথ আছে, কঠিন পথও আছে। সহজ পথ হলো আমদানি শুল্ক বা মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) বাড়ানো। আর কঠিন পথ আয়কর আদায়। সহজ পথেই গেছে অন্তর্র্বর্তী সরকার। তবে প্রশ্ন হলো, অর্থবছরের মাঝপথে এসে শতাধিক পণ্যে ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বাড়াতে হলো কেন, সরকার সহজ পথেই-বা কেন গেল, বিকল্প কিছু ছিল কিনা?

আইএমএফের ঋণ ও ঋণের শর্ত উত্তরাধিকার হিসেবেই পেয়েছে অন্তর্র্বর্তী সরকার। পাশাপাশি সরকার আইএমএফের কাছ থেকে আরও ১০০ কোটি বা ১ বিলিয়ন ডলার ঋণ চেয়েছে। অর্থনৈতিক পরিস্থিতি যদি ভালো না হয়, মূল্যস্ফীতির চাপ না কমে, কর্মসংস্থান ও আয় না বাড়ে, তাহলে সংস্কার নিয়েও মানুষের আগ্রহ থাকবে না। সাম্প্রতিক সময়ের মধ্যে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বড় সংকট শুরু হয়েছিল ২০২২ সালে ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে। লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে ডলারের দাম, বৃদ্ধি পায় মূল্যস্ফীতির চাপ। এরকম এক পরিস্থিতিতে ২০২২ সালের ৫ আগস্ট একলাফে জ্বালানি তেলের দাম ৫১ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ায় সরকার। সেটাই ছিল উচ্চ মূল্যস্ফীতি ডেকে আনার প্রথম সরকারি পদক্ষেপ। সেই যে মূল্যস্ফীতির চাপ শুরু, তা এখনো রয়ে গেছে।

৫৪ বছর ধরেই কর-জিডিপি অনুপাতের দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বের সর্বনিম্ন দেশগুলোর একটি। সুতরাং রাজস্ব আয় বাড়াতেই হবে। একটা সময় ছিল, যখন আমদানি শুল্ক ছিল রাজস্ব আয়ের বড় উৎস। এখন সেই স্থান দখল করেছে ভ্যাট। ভ্যাট পরোক্ষ কর, এর দায় চাপে ভোক্তার ওপর। আর রাজস্ব বাড়ানোর জন্য আদর্শ পথ হচ্ছে প্রত্যক্ষ কর বা আয়কর। বাংলাদেশের সমস্যা এখানেই। ক্ষমতাশালী ও বিত্তবানদের কাছ থেকে আয়কর আদায় করতে পারে না বলেই পরোক্ষ কর আদায়ের সহজ পথ বেছে নেয় সরকার। একই পথ অবলম্বন করল অন্তর্র্বর্তী সরকারও। রাজস্ব খাতসংক্রান্ত পরামর্শক কমিটি সরকারকে একটি বাস্তবায়নযোগ্য সংস্কার প্রস্তাব দিয়েছেন। আমাদের একটি সংস্কারের ধারায় যেতে হবে। এমন কোনো প্রস্তাব করা হবে না, যা বাস্তবায়নযোগ্য নয়। এটা ঠিক, বৈপ্লবিক কিছু করা যাবে না। আমাদের সমাজে সেই অবস্থা নেই। তবে তারা সবার সঙ্গে আলোচনা করে সংস্কারের প্রস্তাবগুলো তৈরি করেছেন। সবার মধ্যে সংস্কার নিয়ে একধরনের চেতনা তৈরি হোক, আমরা এটাই চাই।

গত পাঁচ মাসে সরকার অর্থনীতির ক্ষেত্রে অনেকগুলো ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে সরকারের নেয়া পদক্ষেপের ওপর যদি সাধারণ মানুষ ও বিনিয়োগকারীদের আস্থা না থাকে, তাহলে কখনোই মূল্যস্ফীতি কমবে না, বিনিয়োগও বাড়বে না। এটা পরিষ্কার যে একদিকে উচ্চ মূল্যস্ফীতি, অন্যদিকে ভ্যাট বাড়ানোÑ এ পথে অন্তত মানুষের আস্থা ফিরবে না।

অন্তর্র্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয় গত ৮ আগস্ট, চলতি অর্থবছর শুরুর মাত্র এক মাস সাত দিন পর, সুতরাং চলতি অর্থবছরের বাজেট বাস্তবায়নের সময় প্রায় পুরোটাই পাচ্ছে সরকার। তবে যে অর্থনীতি সরকার পেয়েছে, তাতে এই বাজেট বাস্তবায়ন কঠিন কাজ, সুতরাং অনেকেরই প্রত্যাশা ছিল, অর্থ মন্ত্রণালয় অন্তত ডিসেম্বর শেষে দেশের অর্থনীতির, বাজেট বাস্তবায়ন পরিস্থিতির একটি পর্যালোচনা করে তা জনগণকে জানাবে।

শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রধান অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যও অর্থনীতির মধ্যমেয়াদি পর্যালোচনার সুপারিশ করেছেন। তাতে অন্তত জানা গেছে, অর্থনীতির বর্তমান চিত্রটা কেমন, কী কী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে, এর প্রভাব কতটা পড়ছে এবং অর্থবছরের বাকি সময়ে কী করতে হবে। সাবেক স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে বড় অভিযোগ ছিল অর্থনীতির চরম অব্যবস্থাপনা এবং খেয়ালখুশিমতো অর্থনীতি পরিচালনা করা। অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা বা পরামর্শের কোনো কাঠামোই ছিল না। আশা করা হয়েছিল, অর্থনীতি নিয়ে বর্তমান সরকার অন্তত বিশেষজ্ঞ ও বিনিয়োগকারীদের নিয়ে একটি পরামর্শ গ্রুপ গঠন করবেন। যারা আগের সরকারের সময় এসব বিষয় নিয়ে সমালোচনা করতেন, তারাই তো এখন দায়িত্বে।

রাজস্ব বাড়াতে ভ্যাট বাড়ানো সঠিক পথ নাকি অন্য কোনো উপায় আছে; মহার্ঘ ভাতার অর্থ কোথা থেকে আসবে; আইএমএফের সঙ্গে দর-কষাকষি করে ভ্যাট বাড়ানো ছয় মাস পিছিয়ে দেয়া যায় কিনা; সুদহার নীতি কেমন হওয়া উচিত; যারা কর্মসংস্থান হারাচ্ছেন, তাদের পুনর্বাসন কী হবেÑ এসব বিষয় আলোচনার মাধ্যমে ঠিক হলেই বরং সরকারের কাজের স্বচ্ছতা বাড়ত। মানুষও জানতে পারত সরকারের লক্ষ্য কী।

স্বচ্ছতার সঙ্গেই আস্থার একটি গভীর সম্পর্ক আছে। নির্বাচনের রূপরেখা বা সংস্কারের রূপরেখা নিয়ে অনেক আলোচনা হচ্ছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে অর্থনীতির একটি রূপরেখা জানাও জরুরি। অন্তত আগামী জুন পর্যন্ত সরকারের অর্থনৈতিক পরিকল্পনা কী, সেটা জানা দরকার। কেননা, অর্থনৈতিক পরিস্থিতি যদি ভালো না হয়, মূল্যস্ফীতির চাপ না কমে, কর্মসংস্থান ও আয় না বাড়ে, তাহলে সংস্কার নিয়েও মানুষের আগ্রহ থাকবে না।

[লেখক: অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার]

আলো, অন্ধকার ও চরিত্রবান জীবন

শিক্ষকরা কেন বারবার মার খাবে?

মনোবিশ্লেষক নাট্যক্রিয়া অনুশীলনের ক্ষেত্র হোক সহজতর

প্রসঙ্গ জেনারেশন জেড

বাড়ছে বেকারত্ব : প্রতিকারে জরুরি পদক্ষেপ নিন

প্রকৃতির প্রতি সদয় হতে হবে

ছবি

আভিজাত্যের বাঁধ এবং প্রান্তিক মানুষ

বিশ্ব কুষ্ঠ দিবস

বৈষম্যবিরোধী সংস্কার দরকার

সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতদের পোস্টমর্টেম প্রসঙ্গে

রাজনীতির লালসালু ও ময়না দ্বীপ : জনগণের আস্থার সংকট

প্রদেশ গঠনের প্রস্তাব কি বাস্তবসম্মত

‘ভিলেজ পলিটিক্স’ ও সাধারণ গ্রামবাসী

রম্যগদ্য : ‘ধেয়ে আসছে বুলেট’

রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের জন্য পেনশন ও গ্র্যাচুইটি সময়ের দাবি

ফসলের দাম ও কৃষক

রূপাইয়া, ডন, অনন্ত কিংবা রেংদের মনের ক্ষত কে সারাবে?

পরিবেশ বিপর্যয় : শিক্ষার্থীদের করণীয়

বায়ুদূষণ রোধে প্রয়োজন জনসচেতনতা

কিশোর অপরাধ ও কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন

চাই জীবনমুখী যুগোপযোগী উচ্চশিক্ষা

খেজুর গুড়ের বাণিজ্যিক গুরুত্ব

হামাস-ইসরাইলের অস্ত্র বিরতি

ঝিমিয়ে পড়া অর্থনীতি

আদিবাসীদের প্রাণের স্পন্দন

ছবি

ট্রাম্পের বিস্ফোরক মন্তব্য ও যুক্তরাষ্ট্র-কানাডা সম্পর্ক

কৃতিত্ব অস্বীকারের অপসংস্কৃতি

পশ্চিমবঙ্গ : স্যালাইনে ফাঙ্গাস, অসহায় মানুষ

ছবি

আত্মপরিচয় ও জাতিসত্তার অঙ্গীকার : বৈচিত্র্যের মাঝে ঐক্য

এইচএমপিভি ভাইরাস : প্রয়োজন জনসচেতনতা

সিভিল সার্ভিস ক্যাডারে কেন সংস্কার জরুরি

কেন দ্যাখাও মিথ্যে স্বপ্ন

অনিয়ন্ত্রিত অটোরিকশা ও সড়ক দুর্ঘটনা

অপরিকল্পিত ভ্যাট ও কর বৃদ্ধি

ছবি

‘বেগমপাড়া’ হইতে খোলা চিঠি

সড়ক দুর্ঘটনার লাগাম টানবে কে

tab

উপ-সম্পাদকীয়

অর্থনীতি কোনদিকে যাচ্ছে?

রেজাউল করিম খোকন

রোববার, ২৬ জানুয়ারী ২০২৫

চলতি বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতির গতি কমবে। এর কারণ, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং বিনিয়োগ ও শিল্প খাতে ভাটার টান। বিপরীতে মূল্যস্ফীতি থাকবে চড়া। সরকারের মূল্যস্ফীতি কমানোর লক্ষ্য পূরণ হবে না। বিশ্বব্যাংক ‘ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক প্রসপেক্টস’ (বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সম্ভাবনা) শীর্ষক প্রতিবেদনের জানুয়ারি, ২০২৫ সংস্করণে চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছর নিয়ে এসব পূর্বাভাস তুলে ধরা হয়েছে। তারা বলছে, চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ৪ দশমিক ১ শতাংশে নামতে পারে, যা গত জুনের পূর্বাভাসের চেয়ে ১ দশমিক ৬ শতাংশীয় বিন্দু কম।

দেশের অর্থনীতির গতি করোনাকাল থেকেই মন্থর হয়ে গিয়েছিল। সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি আরেকটু মন্থর করেছে। এখন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নতি দরকার, জ্বালানি ও বিদ্যুতের দাম স্থিতিশীল রাখতে হবে এবং ব্যাংকঋণের সুদের হারে নিয়ন্ত্রণ করা দরকার। সরকারের উচিত বেসরকারি খাতের সঙ্গে আরও আলোচনা করা। এর পাশাপাশি ব্যবসা-অর্থনৈতিক খাতে প্রয়োজনীয় সংস্কারগুলো এখন করে ফেলা।

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দক্ষিণ এশিয়ায় মূল্যস্ফীতি চূড়ায় উঠেছিল ২০২২ সালের মাঝামাঝিতে। এর পর থেকে তা ধাপ ধাপে কমছে। ভারতে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর থেকে মূল্যস্ফীতি দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে রয়েছে (শুধু গত অক্টোবর ছাড়া)। নেপাল ও শ্রীলঙ্কা মূল্যস্ফীতি লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে নামিয়ে আনতে পেরেছে। পাকিস্তানে গত আগস্টে মূল্যস্ফীতি ২০২১ সালের পর প্রথমবারের মতো এক অঙ্কে নেমে আসে। বিপরীতে বাংলাদেশেই মূল্যস্ফীতি এখনো চড়া।

ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার তথ্য অনুযায়ী, ভারতে খাদ্যের দাম কমায় ডিসেম্বরে মূল্যস্ফীতি নেমেছে ৫ দশমিক ২২ শতাংশে। শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওয়েবসাইটে দেয়া প্রতিবেদন বলছে, ডিসেম্বরে দেশটিতে মূল্যস্ফীতি হয়নি; বরং মূল্য সংকোচন হয়েছে ১ দশমিক ৭ শতাংশ। অন্যদিকে পাকিস্তানে ডিসেস্বরে মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৪ দশমিক ১ শতাংশ। বিবিএসের হিসাবে, বাংলাদেশে ডিসেম্বর শেষে দেশে মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়িয়েছে ১০ দশমিক ৮৯ শতাংশ, অর্থাৎ হারটি এক অঙ্কে নামেনি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর গত বছর ১৪ আগস্ট আশা প্রকাশ করেছিলেন, পাঁচ থেকে ছয় মাসে মূল্যস্ফীতি সহনীয় হবে। প্রতিবেশী দেশগুলো মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ নিয়ে তার সুফল পেয়েছে। বাংলাদেশ যথাসময়ে যথাযথ পদক্ষেপ নেয়নি। নতুন সরকারকেও খুব ভিন্ন কিছু করতে দেখা যাচ্ছে না। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে মুদ্রা ও রাজস্ব নীতি এবং বাজার ব্যবস্থাপনায় সমন্বিত পদক্ষেপ দরকার। গোষ্ঠীস্বার্থ উপেক্ষা করে বর্তমান সরকার তা করতে পারত। কিন্তু দেখা যাচ্ছে সমন্বয় নেই। বাংলাদেশ ব্যাংক সুদের হার বাড়াচ্ছে মূল্যস্ফীতি কমাতে। অন্যদিকে সরকার কর বাড়িয়ে দিচ্ছে, যা মূল্যস্ফীতি বাড়াবে। এক মন্ত্রণালয় ডিম আমদানির অনুমতি দিচ্ছে, আরেক মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থা তা আটকে দিচ্ছে। মূল্যস্ফীতি কমবে, সে আশা করা যায় না। কারণ, বাজারে চালের দাম বাড়ছে। সবজির দাম কমেছে। তবে তা স্থায়ী না-ও হতে পারে। বাংলাদেশ নিম্নমুখী জিডিপি প্রবৃদ্ধি ও উচ্চ মূল্যস্ফীতির মতো দুটি ক্ষতিকর দিকের মধ্যে পড়ে গেছে। একদিকে মানুষের কর্মসংস্থান ও আয়ের সুযোগ কম, অন্যদিকে ব্যয় বাড়ছেই।

উত্তরাধিকার সূত্রেই একটি ভঙ্গুর অর্থনীতি পেয়েছে অন্তর্র্বর্তী সরকার। এই অর্থনীতি রাতারাতি ঠিক করা সহজ নয়। তবে অর্থনীতিকে সঠিক পথে নিতে সরকার কী করছে, সেই চিত্র জানাটা জরুরি। রাজস্ব আয় বাড়ানোর সহজ পথ আছে, কঠিন পথও আছে। সহজ পথ হলো আমদানি শুল্ক বা মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) বাড়ানো। আর কঠিন পথ আয়কর আদায়। সহজ পথেই গেছে অন্তর্র্বর্তী সরকার। তবে প্রশ্ন হলো, অর্থবছরের মাঝপথে এসে শতাধিক পণ্যে ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বাড়াতে হলো কেন, সরকার সহজ পথেই-বা কেন গেল, বিকল্প কিছু ছিল কিনা?

আইএমএফের ঋণ ও ঋণের শর্ত উত্তরাধিকার হিসেবেই পেয়েছে অন্তর্র্বর্তী সরকার। পাশাপাশি সরকার আইএমএফের কাছ থেকে আরও ১০০ কোটি বা ১ বিলিয়ন ডলার ঋণ চেয়েছে। অর্থনৈতিক পরিস্থিতি যদি ভালো না হয়, মূল্যস্ফীতির চাপ না কমে, কর্মসংস্থান ও আয় না বাড়ে, তাহলে সংস্কার নিয়েও মানুষের আগ্রহ থাকবে না। সাম্প্রতিক সময়ের মধ্যে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বড় সংকট শুরু হয়েছিল ২০২২ সালে ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে। লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে ডলারের দাম, বৃদ্ধি পায় মূল্যস্ফীতির চাপ। এরকম এক পরিস্থিতিতে ২০২২ সালের ৫ আগস্ট একলাফে জ্বালানি তেলের দাম ৫১ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ায় সরকার। সেটাই ছিল উচ্চ মূল্যস্ফীতি ডেকে আনার প্রথম সরকারি পদক্ষেপ। সেই যে মূল্যস্ফীতির চাপ শুরু, তা এখনো রয়ে গেছে।

৫৪ বছর ধরেই কর-জিডিপি অনুপাতের দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বের সর্বনিম্ন দেশগুলোর একটি। সুতরাং রাজস্ব আয় বাড়াতেই হবে। একটা সময় ছিল, যখন আমদানি শুল্ক ছিল রাজস্ব আয়ের বড় উৎস। এখন সেই স্থান দখল করেছে ভ্যাট। ভ্যাট পরোক্ষ কর, এর দায় চাপে ভোক্তার ওপর। আর রাজস্ব বাড়ানোর জন্য আদর্শ পথ হচ্ছে প্রত্যক্ষ কর বা আয়কর। বাংলাদেশের সমস্যা এখানেই। ক্ষমতাশালী ও বিত্তবানদের কাছ থেকে আয়কর আদায় করতে পারে না বলেই পরোক্ষ কর আদায়ের সহজ পথ বেছে নেয় সরকার। একই পথ অবলম্বন করল অন্তর্র্বর্তী সরকারও। রাজস্ব খাতসংক্রান্ত পরামর্শক কমিটি সরকারকে একটি বাস্তবায়নযোগ্য সংস্কার প্রস্তাব দিয়েছেন। আমাদের একটি সংস্কারের ধারায় যেতে হবে। এমন কোনো প্রস্তাব করা হবে না, যা বাস্তবায়নযোগ্য নয়। এটা ঠিক, বৈপ্লবিক কিছু করা যাবে না। আমাদের সমাজে সেই অবস্থা নেই। তবে তারা সবার সঙ্গে আলোচনা করে সংস্কারের প্রস্তাবগুলো তৈরি করেছেন। সবার মধ্যে সংস্কার নিয়ে একধরনের চেতনা তৈরি হোক, আমরা এটাই চাই।

গত পাঁচ মাসে সরকার অর্থনীতির ক্ষেত্রে অনেকগুলো ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে সরকারের নেয়া পদক্ষেপের ওপর যদি সাধারণ মানুষ ও বিনিয়োগকারীদের আস্থা না থাকে, তাহলে কখনোই মূল্যস্ফীতি কমবে না, বিনিয়োগও বাড়বে না। এটা পরিষ্কার যে একদিকে উচ্চ মূল্যস্ফীতি, অন্যদিকে ভ্যাট বাড়ানোÑ এ পথে অন্তত মানুষের আস্থা ফিরবে না।

অন্তর্র্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয় গত ৮ আগস্ট, চলতি অর্থবছর শুরুর মাত্র এক মাস সাত দিন পর, সুতরাং চলতি অর্থবছরের বাজেট বাস্তবায়নের সময় প্রায় পুরোটাই পাচ্ছে সরকার। তবে যে অর্থনীতি সরকার পেয়েছে, তাতে এই বাজেট বাস্তবায়ন কঠিন কাজ, সুতরাং অনেকেরই প্রত্যাশা ছিল, অর্থ মন্ত্রণালয় অন্তত ডিসেম্বর শেষে দেশের অর্থনীতির, বাজেট বাস্তবায়ন পরিস্থিতির একটি পর্যালোচনা করে তা জনগণকে জানাবে।

শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রধান অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যও অর্থনীতির মধ্যমেয়াদি পর্যালোচনার সুপারিশ করেছেন। তাতে অন্তত জানা গেছে, অর্থনীতির বর্তমান চিত্রটা কেমন, কী কী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে, এর প্রভাব কতটা পড়ছে এবং অর্থবছরের বাকি সময়ে কী করতে হবে। সাবেক স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে বড় অভিযোগ ছিল অর্থনীতির চরম অব্যবস্থাপনা এবং খেয়ালখুশিমতো অর্থনীতি পরিচালনা করা। অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা বা পরামর্শের কোনো কাঠামোই ছিল না। আশা করা হয়েছিল, অর্থনীতি নিয়ে বর্তমান সরকার অন্তত বিশেষজ্ঞ ও বিনিয়োগকারীদের নিয়ে একটি পরামর্শ গ্রুপ গঠন করবেন। যারা আগের সরকারের সময় এসব বিষয় নিয়ে সমালোচনা করতেন, তারাই তো এখন দায়িত্বে।

রাজস্ব বাড়াতে ভ্যাট বাড়ানো সঠিক পথ নাকি অন্য কোনো উপায় আছে; মহার্ঘ ভাতার অর্থ কোথা থেকে আসবে; আইএমএফের সঙ্গে দর-কষাকষি করে ভ্যাট বাড়ানো ছয় মাস পিছিয়ে দেয়া যায় কিনা; সুদহার নীতি কেমন হওয়া উচিত; যারা কর্মসংস্থান হারাচ্ছেন, তাদের পুনর্বাসন কী হবেÑ এসব বিষয় আলোচনার মাধ্যমে ঠিক হলেই বরং সরকারের কাজের স্বচ্ছতা বাড়ত। মানুষও জানতে পারত সরকারের লক্ষ্য কী।

স্বচ্ছতার সঙ্গেই আস্থার একটি গভীর সম্পর্ক আছে। নির্বাচনের রূপরেখা বা সংস্কারের রূপরেখা নিয়ে অনেক আলোচনা হচ্ছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে অর্থনীতির একটি রূপরেখা জানাও জরুরি। অন্তত আগামী জুন পর্যন্ত সরকারের অর্থনৈতিক পরিকল্পনা কী, সেটা জানা দরকার। কেননা, অর্থনৈতিক পরিস্থিতি যদি ভালো না হয়, মূল্যস্ফীতির চাপ না কমে, কর্মসংস্থান ও আয় না বাড়ে, তাহলে সংস্কার নিয়েও মানুষের আগ্রহ থাকবে না।

[লেখক: অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার]

back to top