শেখর ভট্টাচার্য
ব্যক্তিত্ব নিয়ে আমাদের দেশে বেশ কিছু মজার ও ভ্রান্ত ধারণা প্রচলিত আছে। ব্যক্তিত্ববান মানুষ কারা? ধরেন মানুষটি একটি নামকরা কর্পোরেট অফিসের ম্যানেজিং ডিরেক্টর। দশ কথা বললেও একবারও হ্যাঁ, হু করেন না। করলে ও এক শব্দে হ্যাঁ অথবা না বলেন। মুখে গাম্ভীর্য। বসেন অফিসের ভেতরের একটি বড় কক্ষে। তার কথার অর্থ সব সময় দ্ব্যর্থবোধক হয়ে থাকে। অধস্তনদের সঙ্গে কথা শেষ করে জিজ্ঞেস করেন, বুঝেছো? উত্তর যেটি দেয়া হবে তিনি সেটিকে তুড়ি মেরে নাকচ করে দেবেন। তার মনের ভেতরে রাখা উত্তরটি অপ্রাসঙ্গিক হলেও সেটিই যে যথার্থ, তা তিনি প্রমান করবেন। অধস্তনকে এমন ভাবে অপদস্ত করবেন যে পরের বার যেন সামনে এসে মুর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকেন। অফিসের সবাইকে তিনি আসলে রোবোটিক মানুষ হিসেবে দেখতে চান। অধিকাংশ সময় এ ধরনের মানুষরা হাসেন না। চোখে চশমা থাকলে সোনায় সোহাগা। এই অবয়বের, এই আচরণের মানুষরা হলেন দেশীয় স্ট্যান্ডার্ডে ব্যক্তিত্ববান। অনেকের মতে তিনি শুধু ব্যক্তিত্ববানই নন জ্ঞানীও বটে। এই ব্যক্তিত্ববান ও জ্ঞানী মানুষ সব সময় সাধারণের থেকে নিজেকে আড়াল করে রাখেন নানাভাবে। সাধারণ আত্মীয়, সাধারণ বন্ধুবান্ধব, সাধারণ চাকরিজীবীর সঙ্গে তিনি সম্পর্ক রাখেন না। রাখলেও তার মন ও শরীর দয়ায় টুইটুম্বুর এ কথা প্রমাণ করার জন্য দু-তিনজন ভাগ্যবান সাধারণের সঙ্গে খুব হিসাব করে করুণামিশ্রিত সম্পর্ক বজায় রাখেন।
ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে এরকম ধারণা আমরা কোথায় পেলাম জানি না। কথা পরিমিত আকারে বলা অবশ্যই সবার কাছে গ্রহণীয় কিন্তু অতি সাধারণ মানুষ, অধস্তন কিংবা তার সংজ্ঞা অনুযায়ী নিম্নশ্রেণীর মানুষের সঙ্গে কথা না বলা, মুখকে প্যাঁচার মতো অন্ধকার করে রাখা, সব সময় চরম মেজাজ দেখানোকে ব্যক্তিত্বের সংজ্ঞায় ফেলা হলো কীভাবে আমরা জানি না। মনোবিজ্ঞানে ব্যক্তিত্ব বিষয়ে যতরকম ব্যাখ্যা আছে, সংজ্ঞা আছে তার কোনটার সঙ্গেই আমাদের দেশে প্রচলিত ব্যক্তিত্বের ধারণার কোন সামঞ্জস্য নেই। চাকরির সুবাদে গত পঁয়ত্রিশ বছর ধরে পৃথিবীর বিভিন্ন মহাদেশের অজস্র জ্ঞানী, গুণী মানুষের সান্নিধ্যে আসার সুযোগ হয়েছে। সবাইকে কাজের সময় খুব মনোযোগী মনে হয়েছে কিন্তু কাজ শেষে কাজের সঙ্গে যুক্ত সবাইকে নিয়ে হাস্য, কৌতুক, প্রয়োজনে, অপ্রয়োজনে প্রাণ খুলে কথা বলতে দেখেই আমি অভ্যস্ত। মানুষকে কাছে না টানলে ভালো কাজ হয় না, এটাই হলো উন্নত বিশ্বের মানুষদের কর্ম কৌশল এবং ধারণা। আমাদের দেশে কাজটা সব সময় মুখ্য নয়। কাজের চেয়ে অন্য অনেক কিছুই প্রধান, এ কারণে ব্যক্তিত্বকে অদ্ভুতুড়ে উপায়ে উপস্থাপন করা হয়। কৃত্রিম ব্যক্তিত্বকে আসলে উদ্দেশ্য হাসিলের উপায় হিসেবে ব্যবহার করা হয়। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এমনকি পারিবারিক পরিম-লেও ব্যক্তিত্ববান, জ্ঞানী, বিচক্ষণ মানুষ বলতে, প্রাণহীন, নিজেকে ঊর্ধ্বতনভাবে উপস্থাপন করা , প্রকৃত রূপকে আড়াল করে কপট গাম্ভীর্য মিশ্রিত আচরণসংবলিত মানুষকেই বোঝানো হয়ে থাকে।
আমাদের নবনিযুক্ত আমলাদের নাকি একসময় সাধারণের থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দেয়া হতো। যদিও তারা সাধারণের ভৃত্য বা সিভিল সার্ভেন্ট কিন্তু প্রতিটি প্রশিক্ষণে তাদের সাধারণের প্রভু হওয়ার কৌশল শেখানোর ব্যবস্থা ছিল। সাধারণ থেকে দূরে থাকাই আভিজাত্য, ঊর্ধ্বতন হওয়ার সহজ উপায়। আমাদের সংস্কৃতিকেও এভাবেই গড়ে তোলা হয়েছে। যারা সাধারণ থেকে দূরে থাকেন, সেই সমস্ত আমলা, জনপ্রতিনিধি, শিল্পপতি থেকে শুরু করে অভিজাত ক্লাবের সব সদস্যই অসাধারণ। অভিজাত হওয়ার এই প্রশিক্ষণ ঔপনিবেশিক আমলে আমরা যাদের কাছ থেকে পেয়েছি, তারা কিন্তু নিজেদের বদলে নিয়েছেন। তারা নিজেদের নাগরিকদের ভৃত্যে রূপান্তরিত করতে পেরেছেন। তাদের কাছে সেবা নিতে আসা মানুষদের বসার জন্য প্রয়োজনে নিজেদের বসার চেয়ার ছেড়ে দিতে দ্বিধাবোধ করেন না। আমাদের আমলারা এরকম দৃশ্য স্বপ্নে দেখতেও ভয় পান। আহা চেয়ার, সোনার চেয়ার তাকে ছেড়ে দিলে সর্বহারা হয়ে যাওয়া যায়।
বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে, ‘অভিজাত’ শ্রেণীর মধ্যে আমলাদের সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি। অভিজাতদের একটি সিন্ডিকেট আছে; যেমনÑ আমলারা কোন কোন ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের থেকে কম লেখাপড়া জানেন কিন্তু আমলারা শিক্ষকদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখেন দয়া করে। আবার অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন কোন শিক্ষক ক্ষমতার কাছাকাছি যেতে আমলাদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখার জন্য নিজের জ্ঞান গম্যি ত্যাগ করে মরিয়া হয়ে ওঠেন। অভিজাত সিন্ডিকেটে কারা থাকেন? শিল্পপতি, বড় বড় কর্পোরেট হাউসের মালিক, সংসদ সদস্য, মন্ত্রী, অবসরপ্রাপ্ত সামরিক আমলা কখনো বেসামরিক আমলা, কর্মরত আমলা, শিল্প সংস্কৃতির জাতীয় তারকা, উপচে পড়া অর্থনীতির স্বাদ পেতে মরিয়া বুদ্ধিজীবী দল, বিদেশে থাকেন কিন্তু দেশে প্রায়ই আসেন প্রচুর অর্থ সম্পদের মালিক তারা প্রত্যেকেই প্রত্যেকের ভাই, তাই অভিজাত শ্রেণীর সদস্য। ইদানীং ব্যাংকঋণ অনুমোদনকারীরাও অভিজাত শ্রেণীর সিন্ডিকেটের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। আর কিছু মধ্যবিত্ত শিক্ষিত শ্রেণীর মানুষ আছেন, তারা আপ্রাণ এবং কিছুটা বেহায়ার মতো চেষ্টা করে যান এই শ্রেণীতে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করার জন্য।
অভিজাত ক্লাবের সদস্য যারা আছেন তাদের বেগম সাহেবারা সব সময় সমাজসেবার কাজ করে থাকেন। উদ্দেশ্য মনোনীত নারী সংসদ সদস্যের পদ পাওয়া অথবা স্বামীর আভিজাত্যের গায়ে নতুন পালক যুক্ত করে দেয়া। তারা উন্মুখ থাকেন, ইউরোপ, আমেরিকায় শর্ট কিংবা লং ট্রিপ দেয়ার জন্য। সাধারণত এই অভিজাত শ্রেণীর ছেলেমেয়েরা অর্থ দিয়ে বিদেশের নাম গোত্রহীন ‘পাড়ার ইউনিভার্সিটিতে’ বিপুল ব্যয় করে পড়াশোনা করে থাকে। বেগম সাহেবরা যখন একত্রিত হন তখন বাংলাদেশ যে বসবাসের জন্য কত নিকৃষ্ট শ্রেণীর একটি দেশ, সে বিষয় নিয়ে আলোচনা করে সময় কাটান। স্বামীদের ব্যবসাবাণিজ্য অথবা আমলা হিসেবে সরকারের বড় পদ অলঙ্কৃত করতে না হলে, অনেক আগেই যে তারা পোড়ার এ দেশ ছেড়ে চলে যেতেন এ কথা তারা সব সময় বলে থাকেন।
অভিজাত পুরুষরা সাধারণত যে ক্লাব গঠন করে থাকেন সে ক্লাবটি ‘মেম্বারস ক্লাব অনলি’। এই ক্লাবে যাতে অপাংক্তেয়, আন কালচারড, নিম্ন ও মধ্যবিত্ত, লোলুপ শ্রেণী প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য ক্লাবগুলোকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে ‘মেম্বারস ক্লাব’ হিসেবে তৈরি করা হয়ে থাকে। এই ক্লাবে সমাজের সব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার মতো স্টেকহোল্ডাররা একসঙ্গে মিলিত হয়ে থাকেন। তাই ক্লাবটি হলো অত্যন্ত মূল্যবান একটি প্ল্যাটফর্ম। ক্লাবে বসে আন্তর্জাতিক ও দেশীয় টেন্ডারের বিষয় ফয়সালা হয়ে থাকে। স্থানীয় চাঁদাবাজির টাকা নিয়ে সমস্যা হলে আলোচনা হয়ে থাকে। আইন, শৃঙ্খলা অথবা বেসামাল তরুণ, সাংবাদিকদের বেয়াদবি কীভাবে মোকাবিলা করা যায় সেসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত এখান থেকেই হয়ে থাকে। ফয়সালার জন্য লেনদেনের প্রয়োজন হয়ে থাকে, তা-ও এই ‘পবিত্র’ ক্লাবেই হয়ে থাকে। ফয়সালা শেষে পার্টি হয়। লাল, নীল পানি পান করা হয়ে থাকে। মধ্যরাতের পর নিয়মিত বাড়ি ফেরা কোনো বিষয়ই নয়। খানিকটা মাতাল হওয়াকে স্বাভাবিকভাবে মেনে নেয়া হয়ে থাকে। যে মানুষটি সারাদিন অফিসে পাঁচটি কথা বলেন না কিংবা তার নিজস্ব ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে মেপে চলেন সেই মানুষটিই মেম্বারস ক্লাবে বেসামাল। এখানের প্রাইভেসি খুব কঠিন। সিআইএর গোপন কথা বের হওয়া হয়তো খুব সহজ কিন্তু অভিজাত শ্রেণীর মেম্বারস ক্লাবের গোপন কথা কোন দিন বের হয়েছে বলে কেউ শোনেনি।
আধুনিক বাংলা ভাষার প্রধান কবি শামসুর রাহমানের অমর এবং চিরন্তন উক্তিটি সব সময়ের জন্য প্রাসঙ্গিক, উক্তির পরিপ্রেক্ষিত যদি ও ভিন্ন, কিন্তু দিনে দিনে স্ফীত হওয়া ক্ষমতার সংস্কৃতি, ভ্রান্ত ব্যক্তিত্বের বিকাশ দেখে মনে পড়ে যায় তার বিখ্যাত সেই কবিতার পঙক্তি, ‘উদ্ভট উটের পিঠে চলছে স্বদেশ’। এভাবেই কি চলবে প্রিয় স্বদেশ? এরকম উদ্ভট একটি সমাজ ও লুটেরা রাজনীতি কি আমাদের কৃত্রিমভাবে এগিয়ে নিয়ে যাবে? মাত্র কিছুসংখ্যক মানুষ কি আবারও আমাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করবে? বাংলাদেশের ইতিহাস কিন্তু তা বলে না। একটা ঘোরলাগা, অন্ধকার সময় কিছুদিনের জন্য আসে আমাদের এই জনপদে। মুখোশ পরা কিছু মানুষ, কালো চশমা পরে অদ্ভুত সংস্কৃতি তৈরি করতে চেষ্টা করে, তারপর আফিম দিয়ে ঘুম পাড়ানো সাধারণ মানুষগুলো জেগে ওঠে। ভোর হয়। সূর্য ওঠে । আলোর প্লাবন বয়ে যায়। সে আলো হয় সর্বজনীন, আলোর জন্য কোন কোটা থাকে না, কোটারি গোষ্ঠীও থাকে না। ভুবন ভরা আলো আসে। একাত্তরে এসেছে এরপর অনেকবার এসেছে। আমরা ধরে রাখতে পারিনি, এবার হয়তো আমরা আর ভুল করব না। তেরশ নদীর বিস্তীর্ণ প্রান্তর এবার আলোয় প্লাবিত হবে।
[লেখক : প্রাবন্ধিক ও উন্নয়ন গবেষক]
শেখর ভট্টাচার্য
সোমবার, ২৭ জানুয়ারী ২০২৫
ব্যক্তিত্ব নিয়ে আমাদের দেশে বেশ কিছু মজার ও ভ্রান্ত ধারণা প্রচলিত আছে। ব্যক্তিত্ববান মানুষ কারা? ধরেন মানুষটি একটি নামকরা কর্পোরেট অফিসের ম্যানেজিং ডিরেক্টর। দশ কথা বললেও একবারও হ্যাঁ, হু করেন না। করলে ও এক শব্দে হ্যাঁ অথবা না বলেন। মুখে গাম্ভীর্য। বসেন অফিসের ভেতরের একটি বড় কক্ষে। তার কথার অর্থ সব সময় দ্ব্যর্থবোধক হয়ে থাকে। অধস্তনদের সঙ্গে কথা শেষ করে জিজ্ঞেস করেন, বুঝেছো? উত্তর যেটি দেয়া হবে তিনি সেটিকে তুড়ি মেরে নাকচ করে দেবেন। তার মনের ভেতরে রাখা উত্তরটি অপ্রাসঙ্গিক হলেও সেটিই যে যথার্থ, তা তিনি প্রমান করবেন। অধস্তনকে এমন ভাবে অপদস্ত করবেন যে পরের বার যেন সামনে এসে মুর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকেন। অফিসের সবাইকে তিনি আসলে রোবোটিক মানুষ হিসেবে দেখতে চান। অধিকাংশ সময় এ ধরনের মানুষরা হাসেন না। চোখে চশমা থাকলে সোনায় সোহাগা। এই অবয়বের, এই আচরণের মানুষরা হলেন দেশীয় স্ট্যান্ডার্ডে ব্যক্তিত্ববান। অনেকের মতে তিনি শুধু ব্যক্তিত্ববানই নন জ্ঞানীও বটে। এই ব্যক্তিত্ববান ও জ্ঞানী মানুষ সব সময় সাধারণের থেকে নিজেকে আড়াল করে রাখেন নানাভাবে। সাধারণ আত্মীয়, সাধারণ বন্ধুবান্ধব, সাধারণ চাকরিজীবীর সঙ্গে তিনি সম্পর্ক রাখেন না। রাখলেও তার মন ও শরীর দয়ায় টুইটুম্বুর এ কথা প্রমাণ করার জন্য দু-তিনজন ভাগ্যবান সাধারণের সঙ্গে খুব হিসাব করে করুণামিশ্রিত সম্পর্ক বজায় রাখেন।
ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে এরকম ধারণা আমরা কোথায় পেলাম জানি না। কথা পরিমিত আকারে বলা অবশ্যই সবার কাছে গ্রহণীয় কিন্তু অতি সাধারণ মানুষ, অধস্তন কিংবা তার সংজ্ঞা অনুযায়ী নিম্নশ্রেণীর মানুষের সঙ্গে কথা না বলা, মুখকে প্যাঁচার মতো অন্ধকার করে রাখা, সব সময় চরম মেজাজ দেখানোকে ব্যক্তিত্বের সংজ্ঞায় ফেলা হলো কীভাবে আমরা জানি না। মনোবিজ্ঞানে ব্যক্তিত্ব বিষয়ে যতরকম ব্যাখ্যা আছে, সংজ্ঞা আছে তার কোনটার সঙ্গেই আমাদের দেশে প্রচলিত ব্যক্তিত্বের ধারণার কোন সামঞ্জস্য নেই। চাকরির সুবাদে গত পঁয়ত্রিশ বছর ধরে পৃথিবীর বিভিন্ন মহাদেশের অজস্র জ্ঞানী, গুণী মানুষের সান্নিধ্যে আসার সুযোগ হয়েছে। সবাইকে কাজের সময় খুব মনোযোগী মনে হয়েছে কিন্তু কাজ শেষে কাজের সঙ্গে যুক্ত সবাইকে নিয়ে হাস্য, কৌতুক, প্রয়োজনে, অপ্রয়োজনে প্রাণ খুলে কথা বলতে দেখেই আমি অভ্যস্ত। মানুষকে কাছে না টানলে ভালো কাজ হয় না, এটাই হলো উন্নত বিশ্বের মানুষদের কর্ম কৌশল এবং ধারণা। আমাদের দেশে কাজটা সব সময় মুখ্য নয়। কাজের চেয়ে অন্য অনেক কিছুই প্রধান, এ কারণে ব্যক্তিত্বকে অদ্ভুতুড়ে উপায়ে উপস্থাপন করা হয়। কৃত্রিম ব্যক্তিত্বকে আসলে উদ্দেশ্য হাসিলের উপায় হিসেবে ব্যবহার করা হয়। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এমনকি পারিবারিক পরিম-লেও ব্যক্তিত্ববান, জ্ঞানী, বিচক্ষণ মানুষ বলতে, প্রাণহীন, নিজেকে ঊর্ধ্বতনভাবে উপস্থাপন করা , প্রকৃত রূপকে আড়াল করে কপট গাম্ভীর্য মিশ্রিত আচরণসংবলিত মানুষকেই বোঝানো হয়ে থাকে।
আমাদের নবনিযুক্ত আমলাদের নাকি একসময় সাধারণের থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দেয়া হতো। যদিও তারা সাধারণের ভৃত্য বা সিভিল সার্ভেন্ট কিন্তু প্রতিটি প্রশিক্ষণে তাদের সাধারণের প্রভু হওয়ার কৌশল শেখানোর ব্যবস্থা ছিল। সাধারণ থেকে দূরে থাকাই আভিজাত্য, ঊর্ধ্বতন হওয়ার সহজ উপায়। আমাদের সংস্কৃতিকেও এভাবেই গড়ে তোলা হয়েছে। যারা সাধারণ থেকে দূরে থাকেন, সেই সমস্ত আমলা, জনপ্রতিনিধি, শিল্পপতি থেকে শুরু করে অভিজাত ক্লাবের সব সদস্যই অসাধারণ। অভিজাত হওয়ার এই প্রশিক্ষণ ঔপনিবেশিক আমলে আমরা যাদের কাছ থেকে পেয়েছি, তারা কিন্তু নিজেদের বদলে নিয়েছেন। তারা নিজেদের নাগরিকদের ভৃত্যে রূপান্তরিত করতে পেরেছেন। তাদের কাছে সেবা নিতে আসা মানুষদের বসার জন্য প্রয়োজনে নিজেদের বসার চেয়ার ছেড়ে দিতে দ্বিধাবোধ করেন না। আমাদের আমলারা এরকম দৃশ্য স্বপ্নে দেখতেও ভয় পান। আহা চেয়ার, সোনার চেয়ার তাকে ছেড়ে দিলে সর্বহারা হয়ে যাওয়া যায়।
বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে, ‘অভিজাত’ শ্রেণীর মধ্যে আমলাদের সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি। অভিজাতদের একটি সিন্ডিকেট আছে; যেমনÑ আমলারা কোন কোন ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের থেকে কম লেখাপড়া জানেন কিন্তু আমলারা শিক্ষকদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখেন দয়া করে। আবার অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন কোন শিক্ষক ক্ষমতার কাছাকাছি যেতে আমলাদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখার জন্য নিজের জ্ঞান গম্যি ত্যাগ করে মরিয়া হয়ে ওঠেন। অভিজাত সিন্ডিকেটে কারা থাকেন? শিল্পপতি, বড় বড় কর্পোরেট হাউসের মালিক, সংসদ সদস্য, মন্ত্রী, অবসরপ্রাপ্ত সামরিক আমলা কখনো বেসামরিক আমলা, কর্মরত আমলা, শিল্প সংস্কৃতির জাতীয় তারকা, উপচে পড়া অর্থনীতির স্বাদ পেতে মরিয়া বুদ্ধিজীবী দল, বিদেশে থাকেন কিন্তু দেশে প্রায়ই আসেন প্রচুর অর্থ সম্পদের মালিক তারা প্রত্যেকেই প্রত্যেকের ভাই, তাই অভিজাত শ্রেণীর সদস্য। ইদানীং ব্যাংকঋণ অনুমোদনকারীরাও অভিজাত শ্রেণীর সিন্ডিকেটের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। আর কিছু মধ্যবিত্ত শিক্ষিত শ্রেণীর মানুষ আছেন, তারা আপ্রাণ এবং কিছুটা বেহায়ার মতো চেষ্টা করে যান এই শ্রেণীতে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করার জন্য।
অভিজাত ক্লাবের সদস্য যারা আছেন তাদের বেগম সাহেবারা সব সময় সমাজসেবার কাজ করে থাকেন। উদ্দেশ্য মনোনীত নারী সংসদ সদস্যের পদ পাওয়া অথবা স্বামীর আভিজাত্যের গায়ে নতুন পালক যুক্ত করে দেয়া। তারা উন্মুখ থাকেন, ইউরোপ, আমেরিকায় শর্ট কিংবা লং ট্রিপ দেয়ার জন্য। সাধারণত এই অভিজাত শ্রেণীর ছেলেমেয়েরা অর্থ দিয়ে বিদেশের নাম গোত্রহীন ‘পাড়ার ইউনিভার্সিটিতে’ বিপুল ব্যয় করে পড়াশোনা করে থাকে। বেগম সাহেবরা যখন একত্রিত হন তখন বাংলাদেশ যে বসবাসের জন্য কত নিকৃষ্ট শ্রেণীর একটি দেশ, সে বিষয় নিয়ে আলোচনা করে সময় কাটান। স্বামীদের ব্যবসাবাণিজ্য অথবা আমলা হিসেবে সরকারের বড় পদ অলঙ্কৃত করতে না হলে, অনেক আগেই যে তারা পোড়ার এ দেশ ছেড়ে চলে যেতেন এ কথা তারা সব সময় বলে থাকেন।
অভিজাত পুরুষরা সাধারণত যে ক্লাব গঠন করে থাকেন সে ক্লাবটি ‘মেম্বারস ক্লাব অনলি’। এই ক্লাবে যাতে অপাংক্তেয়, আন কালচারড, নিম্ন ও মধ্যবিত্ত, লোলুপ শ্রেণী প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য ক্লাবগুলোকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে ‘মেম্বারস ক্লাব’ হিসেবে তৈরি করা হয়ে থাকে। এই ক্লাবে সমাজের সব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার মতো স্টেকহোল্ডাররা একসঙ্গে মিলিত হয়ে থাকেন। তাই ক্লাবটি হলো অত্যন্ত মূল্যবান একটি প্ল্যাটফর্ম। ক্লাবে বসে আন্তর্জাতিক ও দেশীয় টেন্ডারের বিষয় ফয়সালা হয়ে থাকে। স্থানীয় চাঁদাবাজির টাকা নিয়ে সমস্যা হলে আলোচনা হয়ে থাকে। আইন, শৃঙ্খলা অথবা বেসামাল তরুণ, সাংবাদিকদের বেয়াদবি কীভাবে মোকাবিলা করা যায় সেসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত এখান থেকেই হয়ে থাকে। ফয়সালার জন্য লেনদেনের প্রয়োজন হয়ে থাকে, তা-ও এই ‘পবিত্র’ ক্লাবেই হয়ে থাকে। ফয়সালা শেষে পার্টি হয়। লাল, নীল পানি পান করা হয়ে থাকে। মধ্যরাতের পর নিয়মিত বাড়ি ফেরা কোনো বিষয়ই নয়। খানিকটা মাতাল হওয়াকে স্বাভাবিকভাবে মেনে নেয়া হয়ে থাকে। যে মানুষটি সারাদিন অফিসে পাঁচটি কথা বলেন না কিংবা তার নিজস্ব ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে মেপে চলেন সেই মানুষটিই মেম্বারস ক্লাবে বেসামাল। এখানের প্রাইভেসি খুব কঠিন। সিআইএর গোপন কথা বের হওয়া হয়তো খুব সহজ কিন্তু অভিজাত শ্রেণীর মেম্বারস ক্লাবের গোপন কথা কোন দিন বের হয়েছে বলে কেউ শোনেনি।
আধুনিক বাংলা ভাষার প্রধান কবি শামসুর রাহমানের অমর এবং চিরন্তন উক্তিটি সব সময়ের জন্য প্রাসঙ্গিক, উক্তির পরিপ্রেক্ষিত যদি ও ভিন্ন, কিন্তু দিনে দিনে স্ফীত হওয়া ক্ষমতার সংস্কৃতি, ভ্রান্ত ব্যক্তিত্বের বিকাশ দেখে মনে পড়ে যায় তার বিখ্যাত সেই কবিতার পঙক্তি, ‘উদ্ভট উটের পিঠে চলছে স্বদেশ’। এভাবেই কি চলবে প্রিয় স্বদেশ? এরকম উদ্ভট একটি সমাজ ও লুটেরা রাজনীতি কি আমাদের কৃত্রিমভাবে এগিয়ে নিয়ে যাবে? মাত্র কিছুসংখ্যক মানুষ কি আবারও আমাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করবে? বাংলাদেশের ইতিহাস কিন্তু তা বলে না। একটা ঘোরলাগা, অন্ধকার সময় কিছুদিনের জন্য আসে আমাদের এই জনপদে। মুখোশ পরা কিছু মানুষ, কালো চশমা পরে অদ্ভুত সংস্কৃতি তৈরি করতে চেষ্টা করে, তারপর আফিম দিয়ে ঘুম পাড়ানো সাধারণ মানুষগুলো জেগে ওঠে। ভোর হয়। সূর্য ওঠে । আলোর প্লাবন বয়ে যায়। সে আলো হয় সর্বজনীন, আলোর জন্য কোন কোটা থাকে না, কোটারি গোষ্ঠীও থাকে না। ভুবন ভরা আলো আসে। একাত্তরে এসেছে এরপর অনেকবার এসেছে। আমরা ধরে রাখতে পারিনি, এবার হয়তো আমরা আর ভুল করব না। তেরশ নদীর বিস্তীর্ণ প্রান্তর এবার আলোয় প্লাবিত হবে।
[লেখক : প্রাবন্ধিক ও উন্নয়ন গবেষক]