alt

উপ-সম্পাদকীয়

মনোবিশ্লেষক নাট্যক্রিয়া অনুশীলনের ক্ষেত্র হোক সহজতর

মোস্তফা কামাল যাত্রা

: মঙ্গলবার, ২৮ জানুয়ারী ২০২৫

স্বাস্থ্যবান মানব আত্মাই পারে মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে; যার পূর্বশর্ত হচ্ছে এমন এক সমাজ বাস্তবতা, যেখানে প্রতিটি মানুষ পারস্পরিক সহনশীলতার মধ্য দিয়ে ভোগ করতে সমর্থ হবে জাতিসংঘ কর্তৃক ঘোষিত সব মানবাধিকার। কিন্তু বাস্তবিক অর্থে সেই প্রশ্নের প্রত্যাশিত নিবাস সুদূর পরাহত। তবে স্বপ্নের সেই পৃথিবী গড়ে তুলতে দুনিয়াময় চলছে নানামুখী প্রচেষ্টা। বিশেষত শারীরিক স্বাস্থ্যের পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় দেশে দেশে নেয়া হচ্ছে বহুমুখী উদ্যোগ। মন ও মননের সু-সামঞ্জস্যতা আনয়নে এবং চাপমুক্ত মানস গঠনে চিকিৎসাবিজ্ঞান করছে বহুবিধ গবেষণা। মনোবিশ্লেষক জেকব লেভি মোরেনো চিকিৎসাবিজ্ঞানের এই পথ পরিক্রমায় নাট্যবিজ্ঞানের ক্রিয়াত্মক কলাকৌশলের সংযোজন ঘটিয়েছেন। উদ্ভাবন করেছেন এমন এক মনোচিকিৎসা বা প্রতিবিধানমূলক তথা থেরাপিউটিক নাট্যশৈলীর, যা মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় রাখছে যুগান্তকারী উদাহরণ। উন্নয়নমূলক মনোবিজ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গি বিনির্মাণে ‘স্বতঃস্ফূর্ততা বা ইমপ্রম্পটু’কে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে জেকব লেভি মোরেনো তার অন্যতম রচনা থিয়েটার অব স্পনট্যানেইটি গ্রন্থে বলেছেনÑ ‘জীবন হলো আত্মার নিশ্বাস, স্বতঃস্ফূর্ততা হলো তার প্রশ্বাস, নিশ্বাসের মাধ্যমে বিষের (সংঘাতের) জন্ম হয়, প্রশ্বাসের মাধ্যমে তা হয় অবমুক্ত।’

এ পর্যায়ে স্বতঃস্ফূর্ততা অবচেতনকে (চেতনার সাহায্যে) নিরাপদে বেরোতে দেয়। বাইরের কোন হস্তক্ষেপ ছাড়াই সংগঠিত হয় এই প্রক্রিয়া। চিকিৎসা হিসেবে তার গুরুত্ব এখানেই। মানুষের মধ্যে সৃষ্টিশীল সক্রিয়তা পুনঃআবিষ্কারের প্রত্যয়ে মোরেনো নাট্যবিজ্ঞানের শক্তিকে ব্যবহারের যে প্রচেষ্টা ১৯২১ সালে ভিয়েনায় সূচনা করেছিলেন, তা বর্তমান সময়ে বিশ্বের ১০০টিরও বেশি দেশে চর্চিত হচ্ছে সফল ও কার্যকরভাবে। এই প্রক্রিয়ার মূল কথা হলো ‘ক্যাথার্সিস।’ ‘ক্যাথার্সিস’কে মোরেনো এরিষ্টটলীয় ধারণার বাইরে এসে যেভাবে ব্যাখ্যা করতে চেয়েছিলেন, তা হলো যাপিত জীবনে প্রাপ্ত অভিজ্ঞতা থেকে মানুষের মধ্যে অনুভূতির জন্ম হয়, সেই অনুভূতি যার কারণে ব্যক্তিক ও সামষ্টিক উপলব্ধির মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা অর্থাৎ জমাট বেঁধে অচল হয়ে যাওয়া সামাজিক কাঠামোগুলোকে করে তুলে সজীব। এক্ষেত্রে স্থবির হয়ে যাওয়া অনুভূতিকে জাগ্রত করতে ‘ক্যাথার্সিস’ রাখে প্রধানতম নিয়ামকের ভূমিকা। মোরেনো ক্যাথার্সিসকে প্রধান তিনটি পর্যায়ে বিশ্লেষণ করেছেন।

প্রথমত- ‘অ্যাকশন ক্যাথার্সিস।’ এই পর্যায়ে চিকিৎসাপ্রত্যাশী ব্যক্তি বা সমষ্টি মূল ভূমিকায় অভিনয় করার সময় তার বা তাদের সৃষ্ট অ্যাকশনের মাধ্যমে গভীর আত্মজ্ঞানে অভিজ্ঞ হয়ে ওঠে। ফলে আবেগজনিত বাধাগুলো বিলীন হয়ে তার বা তাদের ভূমিকা গ্রহণ পূর্ববর্তী সময়ের মূল আচরণ ক্ষমতা পুনঃপ্রাপ্ত হয়। ফলশ্রুতিতে তার বা তাদের মধ্যে উন্মোচিত হয় সম্ভাবনাময় ও ইতিবাচক সক্রিয়তার।

দ্বিতীয়তÑ ‘দর্শক ক্যাথার্সিস।’ এই পর্যায়কে তিনি অবলোকনকারী বা অবলোকনকারীদের ক্যাথার্সিস হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। অর্থাৎ নাট্যক্রিয়া পর্যবেক্ষণকারী হিসেবে দর্শকও লাভ করেন এমন এক অভিজ্ঞতা যার মধ্য দিয়ে তিনি বা তারা অর্জন করে অভিন্ন প্রশান্তি।

তৃতীয়তÑ ‘নান্দনিক ক্যাথার্সিস।’ এ পর্যায়ে থেরাপিউটিক থিয়েটার সেশনে অংশগ্রহণকারী প্রোটাগনিস্ট বা মূল ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ এবং অবলোকনকারী পর্যবেক্ষক (দর্শক) সর্বপরী সেশন সঞ্চালকসহ পার্শ্ব চরিত্রে রূপদানকারী থিয়েটার থেরাপিস্ট এবং অংশগ্রহণকারী অভ্যাগত দর্শক যে নান্দনিক অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে সেশন সময়কাল পূর্ণ করে, তা অংশগ্রহণকারী সব পক্ষের সামগ্রিক সৃজনশীলতার উন্মেষ ঘটায়।

থেরাপিউটিক থিয়েটার সেশনে পরিচালিত সাইকোড্রামা (ব্যক্তি পর্যায়ে) এবং সোসিওড্রামা (সামগ্রিক বা সামাজিক পর্যায়ে) থেকে অবহিত অতীত আনন্দ-বেদনার উপলব্ধী যে শিক্ষা দিয়ে থাকে, তা প্রত্যাশিত বা অপ্রত্যাশিত ছিল সেটা বিবেচনায় আসলেই ক্যাথার্সিসের ইতিবাচক ও নেতিবাচক মাত্রা বিশ্লেষণ করা সম্ভবপর হয়। অর্থাৎ এখানে ভূমিকা গ্রহণ ও দৃশ্যের আন্তঃপ্রক্রিয়ায় সমন্বিত অভিনয়ের মাধ্যমে ব্যক্তি বা সমষ্টির প্রাপ্তি বা অপ্রাপ্তির হিসাব কষা হয়। যে প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গড়ে উঠবে একমুখী আত্মউপলব্ধী বা বিশ্বাস বা সমন্বিত মুক্তির পথ কথা গড়ে উঠবে ‘থেরাপিউটিক সমাজ।’ থেরাপিউটিক বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তুলে মানবিক ও সুসামঞ্জস্যপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠা তখনি সম্ভব হবে, যখন আন্তঃব্যক্তিক ও আন্তঃসামাজিক সম্পর্কগুলো সন্তোষজনক পর্যায়ে উপনীত হবে। যার মাধ্যমে জমাট বাঁধা সম্পর্কের কাঠামোগুলো উপনীত হবে এমন এক স্তরে যেখানে পরিশুদ্ধ হবে ব্যক্তিগত, দলীয় বা সামাজিক ক্যাথার্সিস। মোরেনো বিশ্বাস করতেন চিকিৎসা এবং সামাজিক সক্রিয়তার আন্তঃপ্রক্রিয়াগত সম্ভাবনাগুলো সীমাহীন। তার অনুশীলন যত বেশি করা যাবে, সমাজ হবে তত বেশি মানবিক। থিয়েটার থেরাপিতে সৃষ্ট সামি রিয়েলিটি বা সারপ্লাস রিয়েলিটি অতীত, বর্তমান বা ভবিষ্যতের যে কোন সংঘাতময় অবস্থা ও অবস্থানকে উপস্থাপনের মাধ্যমে অভিনেতা, দর্শক ও সঞ্চালকদের প্রচলিত ধ্যান-ধারণার স্তরকে ইতিবাচক স্তরে উপনীত করে- উন্মেষ ঘটায় এমন এক দৃষ্টিভঙ্গি, যে দৃষ্টিভঙ্গি নির্মাণ করে স্বতঃস্ফূর্ত ও সৃজনশীল মানব আত্মার। মূলত, যা হলো মোরেনোর উদ্ভাবিত স্বতঃস্ফূর্ততার চিকিৎসাগত প্রধান বৈশিষ্ট্য। যাকে তিনি একাত্মতার বিশুদ্ধীকরণ অভিদায় অবিহিত করেছেন। বিশ্বব্যাপী মানুষে মানুষে এমন এক আন্তঃসম্পর্ক প্রয়োজন, যার কারণে জাগতিক স্বার্থের (ব্যক্তিক, সামাজিক, রাজনৈতিক) ঊর্ধ্বে উঠে মানুষ হয়ে উঠবে একান্ত ও এক ঈশ্বরবাদী, যার জন্য প্রয়োজন আত্মার পরিশুদ্ধি। মোরেনোর ভাষায় একাত্মতার সমাজ বা থেরাপিউটিক সমাজ হলোÑ এমন, যে সমাজে প্রতিটি মানুষ মানবিক মর্যাদা নিয়ে চাপমুক্ত মানসে সুসংগঠিত মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সামাজিক জীবনাচার অতিবাহিত করতে হবে সক্ষম। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) কর্তৃক প্রদত্ত ২০০১ সালে মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক পরিসংখ্যানে উল্লেখ করা হয়েছিল, উন্নত বিশ্বের শতকরা ৫০ শতাংশ মানুষ মানসিক স্বাস্থ্যসেবা পেয়ে থাকে। যেখানে উন্নয়নশীল দেশে বসবাসকারী মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তির হার যে হতাশাব্যঞ্জক হবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এই প্রতিবেদনে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে বেশ কিছু সুপারিশ রাখা হয়েছিল।

২০০৮ সালে সেই সুপারিশগুলোর অগ্রগতি মূল্যায়ন করতে গিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (হু) প্রতিবেদক উল্লেখ করেছেন, স্বাস্থ্য খাতে রাষ্ট্রীয় নীতিমালার দুর্বলতা, দক্ষ জনবলের অভাব ও অর্থ বরাদ্দ না থাকা হচ্ছে অন্যতম কারণ। দীর্ঘ ২৮ বছর পরও যদি দাতা সংস্থাদের সেই সীমাবদ্ধতা অতিক্রম না হয়, তবে মানুষের মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা হবে বিপর্যস্ত। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সময়ে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে মানসিকভাবে শান্তিতে থাকা তথা ব্যক্তিগত মনো-সামাজিক বিপর্যয় প্রতিরোধে মনোবিশ্লেষক নাট্যক্রিয়া অনুশীলনে সবাইকেই অভ্যস্ত হওয়া অতিব জরুরি। কারণ সহিংসতাপূর্ণ চলমান পরিস্থিতিতে পেশাদারি সেবা পাওয়ার সুযোগ হয়ে পড়ে সীমিত। এই সময়কালে ব্যক্তিগত মানসিক সমস্যা ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে না পারলে সৃষ্ট ট্রমা থেকে উত্তরণ ঘটাতে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি হবেন ব্যর্থ। ফলশ্রুতিতে এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে মানসিক সমস্যা মোকাবিলা করতে অসমর্থ ব্যক্তি বা ক্ষতিগ্রস্তজন নানা মানসিক উপসর্গ থেকে নিজের সুরক্ষার সুযোগবঞ্চিত হয়ে স্থায়ী মনোরোগীতে পরিণত হবেন, যা কোনভাবেই আমাদের কাম্য নয়। তাই সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনায় বৃহত্তর স্বার্থে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি বা তার পরিবার-পরিজনের জন্য মনোবিশ্লেষক নাট্যক্রিয়া অনুশীলনের ক্ষেত্রকে সহজতর ও প্রশস্ত করতে হবে। অন্যথায় পরিবারে নতুন করে একজন মনোরোগীর সংযোজন ঘটবে। সহিংসতাপূর্ণ উদ্ভূত পরিস্থিতি পর্যালোচনা ও মূল্যায়নের পরিপ্রেক্ষিতে এই ক্রান্তিকালে মনোবিশ্লেষক নাট্যক্রিয়া অনুশীলনের নাট্যধারার বিকাশে সবার মনযোগ আকর্ষণ করছি। অর্থাৎ সহিংসতাপূর্ণ পরিস্থিতিতে সৃষ্ট ট্রমা মোকাবিলায় মনোবিশ্লেষক ধর্মী চর্চার উন্মেষ ঘটাতে পারলে নিশ্চিত হবে সহিংসতাপূর্ণ পরিস্থিতিতে থাকা মানুষের বিপর্যস্ত মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার অধিকার।

মানবসৃষ্ট দুর্যোগে অদ্ভুত পরিস্থিতি; মন ও মননের ওপর যে নেতিবাচক পরিবর্তন আনেÑ তাকে মনোবৈজ্ঞানিকভাবে ব্যবস্থাপনা করা অতিব জরুরি। কারণ মনোপিড়া ও মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ করতে পারার সক্ষমতা সব মানুষের সমান নয়। ফলে মানুষের মধ্যে এমতঅবস্থায় গড়ে ওঠা ট্রমা, যা দৈনন্দিন জীবন ও জীবনাচারে নিয়ে আসেÑ মানসিক যন্ত্রণার নানা ধরনের পরিপ্রেক্ষিত। কমিয়ে ফেলে উদ্ভূত পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়ার সক্ষমতা। এই সময় ব্যক্তিগত মনো-সামাজিক বিপর্যয় এবং নতুন পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়ার মনস্তত্ত্ব গড়ে তুলতে প্রয়োজন নিজেকে ভালো রাখার উপায় খুঁজে নেয়া। এক্ষেত্রে সৃজনশীল ক্রিয়া-কর্মের অনুশীলন ও চর্চা ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির মানসিক শক্তি উন্নতকরণে রাখতে পারে মনোবৈজ্ঞানীক ভূমিকা; কারণ সৃজনশীল ক্রিয়া-কলাপ ব্যক্তির ব্যক্তিগত মানস গঠনের পাশাপাশি মনোদৈহিক অবস্থার মধ্যে সমন্বয় গড়ে তোলে। এতে করে সে/তিনি ওই ভঙ্গুর পরিস্থিতিতে নিজেকে স্বতঃস্ফূর্ত ও সৃজনশীল রাখতে সক্ষম হন। ফলে নেতিবাচক মনস্তত্ত্বকে ইতিবাচক খাতে প্রবাহিত করার পথ প্রশস্ত হয়। বিপর্যস্ত পরিস্থিতিতে ভূমিকাভিনয় অনুশীলন খুবই কার্যকর একটি পদক্ষেপ। এককভাবে বা দলীয়ভাবে তা চর্চা করা ইতিবাচক পরিবর্তনে অত্যাবশ্যক একটি কর্মকৌশল। পারিবারিকভাবে এই কর্মকৌশল অনুশীলন সময়ের দাবি। স্মরণীয় যে, অভিনয় কলা হচ্ছেÑ সব সৃজনশীল ক্রিয়ার একটি সুসংগঠিত রূপ।

যার মধ্যে নাচ, গান, চিত্রাঙ্কন এবং সুসামঞ্জস্যতাপূর্ণ অঙ্গভঙ্গি একীভূত হয়ে থাকে। অর্থাৎ শিল্পকলার বিভিন্ন মাধ্যমের একক ও বহুমাত্রিক অনুশীলন বিশেষত: ভূমিকাভিনয় তত্ত্ব একটি মানসিক প্রশান্তিময় অবস্থা ও অবস্থান গড়ে তুলতে রাখে সহায়ক অবদান। মনো-সমস্যা বিদ্যার সর্বাধুনিক প্রয়োগ প্রক্রিয়া তাকে (ভূমিকাভিনয় তত্ত্ব) গুরুত্বপূর্ণ একটি কর্মকৌশল হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে, যা মনোবিশ্লেষক নাট্যক্রিয়া হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়ে থাকে। মানসিক প্রশান্তি আনতে সহায়ক এই মনোস্বাস্থ্য সুরক্ষা পদ্ধতি বিশ্লেষকদের কাছে মনোবিশ্লেষক নাট্যক্রিয়া হিসেবে মূল্যায়িত হয়ে থাকে। আসুন যে যার অবস্থান থেকে সচেষ্ট হই প্রতিষ্ঠা করতে তেমন এক থেরাপিউটিক সমাজ ব্যবস্থা যেখানে বিশ্ব নামের গ্রামে সব বাসিন্দা সুসমন্বিত মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে আমৃত্যু বেঁচে থাকবে। অর্থাৎ সম্মিলিতভাবে নেতিবাচক প্রভাবগুলো মানবিক সমাজের কাঠামোকে করে ক্ষতিগ্রস্ত। আর সমাজের নিয়ামক শক্তি হিসেবে মানুষের মধ্যে সৃষ্টি করে অমানবিকতার উন্মেষ। ফলে সমাজ কাঠামো ভেঙে হয় চুরমার। তাই মনোবিশ্লেষক নাট্যক্রিয়ার অনুশীলনের পরিমাণ বাড়ানোর পরিকল্পনাই কেবল পারে, উদ্ভূত পরিস্থিতি থেকে দিতে পারে পরিত্রাণ। মানবিক সমাজ তথা থেরাপিউটিক সোসাইটি প্রতিষ্ঠার মানসে মনোবিশ্লেষক নাট্যবিজ্ঞানের নিয়মিত চর্চার সুযোগ সৃষ্টি করে সামাজিক অরাজকতার হার কমানোর উদ্যোগ এখন সময়ের প্রয়োজন। আশা করছি, সামগ্রীক বিপর্যয়ের চিত্র বিবেচনায় নিয়ে নীতিনির্ধারক মহল এই ক্ষেত্রে মনোবিশ্লেষক নাট্যক্রিয়া অনুশীলনের কার্যকর পদক্ষেপ নেবেন মানবিক কারণে।

[লেখক: নির্বাহী পরিচালক, উৎস]

বায়ুদূষণ মনিটরিংয়ে প্রযুক্তির ব্যবহার

ছবি

যোগেন ম-লের ‘বহুজনবাদী’ রাজনীতির প্রাসঙ্গিকতা

একটি দেয়ালচিত্র ও কিছু কথা

আলো, অন্ধকার ও চরিত্রবান জীবন

শিক্ষকরা কেন বারবার মার খাবে?

প্রসঙ্গ জেনারেশন জেড

বাড়ছে বেকারত্ব : প্রতিকারে জরুরি পদক্ষেপ নিন

প্রকৃতির প্রতি সদয় হতে হবে

ছবি

আভিজাত্যের বাঁধ এবং প্রান্তিক মানুষ

বিশ্ব কুষ্ঠ দিবস

অর্থনীতি কোনদিকে যাচ্ছে?

বৈষম্যবিরোধী সংস্কার দরকার

সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতদের পোস্টমর্টেম প্রসঙ্গে

রাজনীতির লালসালু ও ময়না দ্বীপ : জনগণের আস্থার সংকট

প্রদেশ গঠনের প্রস্তাব কি বাস্তবসম্মত

‘ভিলেজ পলিটিক্স’ ও সাধারণ গ্রামবাসী

রম্যগদ্য : ‘ধেয়ে আসছে বুলেট’

রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের জন্য পেনশন ও গ্র্যাচুইটি সময়ের দাবি

ফসলের দাম ও কৃষক

রূপাইয়া, ডন, অনন্ত কিংবা রেংদের মনের ক্ষত কে সারাবে?

পরিবেশ বিপর্যয় : শিক্ষার্থীদের করণীয়

বায়ুদূষণ রোধে প্রয়োজন জনসচেতনতা

কিশোর অপরাধ ও কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন

চাই জীবনমুখী যুগোপযোগী উচ্চশিক্ষা

খেজুর গুড়ের বাণিজ্যিক গুরুত্ব

হামাস-ইসরাইলের অস্ত্র বিরতি

ঝিমিয়ে পড়া অর্থনীতি

আদিবাসীদের প্রাণের স্পন্দন

ছবি

ট্রাম্পের বিস্ফোরক মন্তব্য ও যুক্তরাষ্ট্র-কানাডা সম্পর্ক

কৃতিত্ব অস্বীকারের অপসংস্কৃতি

পশ্চিমবঙ্গ : স্যালাইনে ফাঙ্গাস, অসহায় মানুষ

ছবি

আত্মপরিচয় ও জাতিসত্তার অঙ্গীকার : বৈচিত্র্যের মাঝে ঐক্য

এইচএমপিভি ভাইরাস : প্রয়োজন জনসচেতনতা

সিভিল সার্ভিস ক্যাডারে কেন সংস্কার জরুরি

কেন দ্যাখাও মিথ্যে স্বপ্ন

অনিয়ন্ত্রিত অটোরিকশা ও সড়ক দুর্ঘটনা

tab

উপ-সম্পাদকীয়

মনোবিশ্লেষক নাট্যক্রিয়া অনুশীলনের ক্ষেত্র হোক সহজতর

মোস্তফা কামাল যাত্রা

মঙ্গলবার, ২৮ জানুয়ারী ২০২৫

স্বাস্থ্যবান মানব আত্মাই পারে মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে; যার পূর্বশর্ত হচ্ছে এমন এক সমাজ বাস্তবতা, যেখানে প্রতিটি মানুষ পারস্পরিক সহনশীলতার মধ্য দিয়ে ভোগ করতে সমর্থ হবে জাতিসংঘ কর্তৃক ঘোষিত সব মানবাধিকার। কিন্তু বাস্তবিক অর্থে সেই প্রশ্নের প্রত্যাশিত নিবাস সুদূর পরাহত। তবে স্বপ্নের সেই পৃথিবী গড়ে তুলতে দুনিয়াময় চলছে নানামুখী প্রচেষ্টা। বিশেষত শারীরিক স্বাস্থ্যের পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় দেশে দেশে নেয়া হচ্ছে বহুমুখী উদ্যোগ। মন ও মননের সু-সামঞ্জস্যতা আনয়নে এবং চাপমুক্ত মানস গঠনে চিকিৎসাবিজ্ঞান করছে বহুবিধ গবেষণা। মনোবিশ্লেষক জেকব লেভি মোরেনো চিকিৎসাবিজ্ঞানের এই পথ পরিক্রমায় নাট্যবিজ্ঞানের ক্রিয়াত্মক কলাকৌশলের সংযোজন ঘটিয়েছেন। উদ্ভাবন করেছেন এমন এক মনোচিকিৎসা বা প্রতিবিধানমূলক তথা থেরাপিউটিক নাট্যশৈলীর, যা মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় রাখছে যুগান্তকারী উদাহরণ। উন্নয়নমূলক মনোবিজ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গি বিনির্মাণে ‘স্বতঃস্ফূর্ততা বা ইমপ্রম্পটু’কে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে জেকব লেভি মোরেনো তার অন্যতম রচনা থিয়েটার অব স্পনট্যানেইটি গ্রন্থে বলেছেনÑ ‘জীবন হলো আত্মার নিশ্বাস, স্বতঃস্ফূর্ততা হলো তার প্রশ্বাস, নিশ্বাসের মাধ্যমে বিষের (সংঘাতের) জন্ম হয়, প্রশ্বাসের মাধ্যমে তা হয় অবমুক্ত।’

এ পর্যায়ে স্বতঃস্ফূর্ততা অবচেতনকে (চেতনার সাহায্যে) নিরাপদে বেরোতে দেয়। বাইরের কোন হস্তক্ষেপ ছাড়াই সংগঠিত হয় এই প্রক্রিয়া। চিকিৎসা হিসেবে তার গুরুত্ব এখানেই। মানুষের মধ্যে সৃষ্টিশীল সক্রিয়তা পুনঃআবিষ্কারের প্রত্যয়ে মোরেনো নাট্যবিজ্ঞানের শক্তিকে ব্যবহারের যে প্রচেষ্টা ১৯২১ সালে ভিয়েনায় সূচনা করেছিলেন, তা বর্তমান সময়ে বিশ্বের ১০০টিরও বেশি দেশে চর্চিত হচ্ছে সফল ও কার্যকরভাবে। এই প্রক্রিয়ার মূল কথা হলো ‘ক্যাথার্সিস।’ ‘ক্যাথার্সিস’কে মোরেনো এরিষ্টটলীয় ধারণার বাইরে এসে যেভাবে ব্যাখ্যা করতে চেয়েছিলেন, তা হলো যাপিত জীবনে প্রাপ্ত অভিজ্ঞতা থেকে মানুষের মধ্যে অনুভূতির জন্ম হয়, সেই অনুভূতি যার কারণে ব্যক্তিক ও সামষ্টিক উপলব্ধির মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা অর্থাৎ জমাট বেঁধে অচল হয়ে যাওয়া সামাজিক কাঠামোগুলোকে করে তুলে সজীব। এক্ষেত্রে স্থবির হয়ে যাওয়া অনুভূতিকে জাগ্রত করতে ‘ক্যাথার্সিস’ রাখে প্রধানতম নিয়ামকের ভূমিকা। মোরেনো ক্যাথার্সিসকে প্রধান তিনটি পর্যায়ে বিশ্লেষণ করেছেন।

প্রথমত- ‘অ্যাকশন ক্যাথার্সিস।’ এই পর্যায়ে চিকিৎসাপ্রত্যাশী ব্যক্তি বা সমষ্টি মূল ভূমিকায় অভিনয় করার সময় তার বা তাদের সৃষ্ট অ্যাকশনের মাধ্যমে গভীর আত্মজ্ঞানে অভিজ্ঞ হয়ে ওঠে। ফলে আবেগজনিত বাধাগুলো বিলীন হয়ে তার বা তাদের ভূমিকা গ্রহণ পূর্ববর্তী সময়ের মূল আচরণ ক্ষমতা পুনঃপ্রাপ্ত হয়। ফলশ্রুতিতে তার বা তাদের মধ্যে উন্মোচিত হয় সম্ভাবনাময় ও ইতিবাচক সক্রিয়তার।

দ্বিতীয়তÑ ‘দর্শক ক্যাথার্সিস।’ এই পর্যায়কে তিনি অবলোকনকারী বা অবলোকনকারীদের ক্যাথার্সিস হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। অর্থাৎ নাট্যক্রিয়া পর্যবেক্ষণকারী হিসেবে দর্শকও লাভ করেন এমন এক অভিজ্ঞতা যার মধ্য দিয়ে তিনি বা তারা অর্জন করে অভিন্ন প্রশান্তি।

তৃতীয়তÑ ‘নান্দনিক ক্যাথার্সিস।’ এ পর্যায়ে থেরাপিউটিক থিয়েটার সেশনে অংশগ্রহণকারী প্রোটাগনিস্ট বা মূল ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ এবং অবলোকনকারী পর্যবেক্ষক (দর্শক) সর্বপরী সেশন সঞ্চালকসহ পার্শ্ব চরিত্রে রূপদানকারী থিয়েটার থেরাপিস্ট এবং অংশগ্রহণকারী অভ্যাগত দর্শক যে নান্দনিক অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে সেশন সময়কাল পূর্ণ করে, তা অংশগ্রহণকারী সব পক্ষের সামগ্রিক সৃজনশীলতার উন্মেষ ঘটায়।

থেরাপিউটিক থিয়েটার সেশনে পরিচালিত সাইকোড্রামা (ব্যক্তি পর্যায়ে) এবং সোসিওড্রামা (সামগ্রিক বা সামাজিক পর্যায়ে) থেকে অবহিত অতীত আনন্দ-বেদনার উপলব্ধী যে শিক্ষা দিয়ে থাকে, তা প্রত্যাশিত বা অপ্রত্যাশিত ছিল সেটা বিবেচনায় আসলেই ক্যাথার্সিসের ইতিবাচক ও নেতিবাচক মাত্রা বিশ্লেষণ করা সম্ভবপর হয়। অর্থাৎ এখানে ভূমিকা গ্রহণ ও দৃশ্যের আন্তঃপ্রক্রিয়ায় সমন্বিত অভিনয়ের মাধ্যমে ব্যক্তি বা সমষ্টির প্রাপ্তি বা অপ্রাপ্তির হিসাব কষা হয়। যে প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গড়ে উঠবে একমুখী আত্মউপলব্ধী বা বিশ্বাস বা সমন্বিত মুক্তির পথ কথা গড়ে উঠবে ‘থেরাপিউটিক সমাজ।’ থেরাপিউটিক বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তুলে মানবিক ও সুসামঞ্জস্যপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠা তখনি সম্ভব হবে, যখন আন্তঃব্যক্তিক ও আন্তঃসামাজিক সম্পর্কগুলো সন্তোষজনক পর্যায়ে উপনীত হবে। যার মাধ্যমে জমাট বাঁধা সম্পর্কের কাঠামোগুলো উপনীত হবে এমন এক স্তরে যেখানে পরিশুদ্ধ হবে ব্যক্তিগত, দলীয় বা সামাজিক ক্যাথার্সিস। মোরেনো বিশ্বাস করতেন চিকিৎসা এবং সামাজিক সক্রিয়তার আন্তঃপ্রক্রিয়াগত সম্ভাবনাগুলো সীমাহীন। তার অনুশীলন যত বেশি করা যাবে, সমাজ হবে তত বেশি মানবিক। থিয়েটার থেরাপিতে সৃষ্ট সামি রিয়েলিটি বা সারপ্লাস রিয়েলিটি অতীত, বর্তমান বা ভবিষ্যতের যে কোন সংঘাতময় অবস্থা ও অবস্থানকে উপস্থাপনের মাধ্যমে অভিনেতা, দর্শক ও সঞ্চালকদের প্রচলিত ধ্যান-ধারণার স্তরকে ইতিবাচক স্তরে উপনীত করে- উন্মেষ ঘটায় এমন এক দৃষ্টিভঙ্গি, যে দৃষ্টিভঙ্গি নির্মাণ করে স্বতঃস্ফূর্ত ও সৃজনশীল মানব আত্মার। মূলত, যা হলো মোরেনোর উদ্ভাবিত স্বতঃস্ফূর্ততার চিকিৎসাগত প্রধান বৈশিষ্ট্য। যাকে তিনি একাত্মতার বিশুদ্ধীকরণ অভিদায় অবিহিত করেছেন। বিশ্বব্যাপী মানুষে মানুষে এমন এক আন্তঃসম্পর্ক প্রয়োজন, যার কারণে জাগতিক স্বার্থের (ব্যক্তিক, সামাজিক, রাজনৈতিক) ঊর্ধ্বে উঠে মানুষ হয়ে উঠবে একান্ত ও এক ঈশ্বরবাদী, যার জন্য প্রয়োজন আত্মার পরিশুদ্ধি। মোরেনোর ভাষায় একাত্মতার সমাজ বা থেরাপিউটিক সমাজ হলোÑ এমন, যে সমাজে প্রতিটি মানুষ মানবিক মর্যাদা নিয়ে চাপমুক্ত মানসে সুসংগঠিত মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সামাজিক জীবনাচার অতিবাহিত করতে হবে সক্ষম। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) কর্তৃক প্রদত্ত ২০০১ সালে মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক পরিসংখ্যানে উল্লেখ করা হয়েছিল, উন্নত বিশ্বের শতকরা ৫০ শতাংশ মানুষ মানসিক স্বাস্থ্যসেবা পেয়ে থাকে। যেখানে উন্নয়নশীল দেশে বসবাসকারী মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তির হার যে হতাশাব্যঞ্জক হবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এই প্রতিবেদনে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে বেশ কিছু সুপারিশ রাখা হয়েছিল।

২০০৮ সালে সেই সুপারিশগুলোর অগ্রগতি মূল্যায়ন করতে গিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (হু) প্রতিবেদক উল্লেখ করেছেন, স্বাস্থ্য খাতে রাষ্ট্রীয় নীতিমালার দুর্বলতা, দক্ষ জনবলের অভাব ও অর্থ বরাদ্দ না থাকা হচ্ছে অন্যতম কারণ। দীর্ঘ ২৮ বছর পরও যদি দাতা সংস্থাদের সেই সীমাবদ্ধতা অতিক্রম না হয়, তবে মানুষের মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা হবে বিপর্যস্ত। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সময়ে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে মানসিকভাবে শান্তিতে থাকা তথা ব্যক্তিগত মনো-সামাজিক বিপর্যয় প্রতিরোধে মনোবিশ্লেষক নাট্যক্রিয়া অনুশীলনে সবাইকেই অভ্যস্ত হওয়া অতিব জরুরি। কারণ সহিংসতাপূর্ণ চলমান পরিস্থিতিতে পেশাদারি সেবা পাওয়ার সুযোগ হয়ে পড়ে সীমিত। এই সময়কালে ব্যক্তিগত মানসিক সমস্যা ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে না পারলে সৃষ্ট ট্রমা থেকে উত্তরণ ঘটাতে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি হবেন ব্যর্থ। ফলশ্রুতিতে এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে মানসিক সমস্যা মোকাবিলা করতে অসমর্থ ব্যক্তি বা ক্ষতিগ্রস্তজন নানা মানসিক উপসর্গ থেকে নিজের সুরক্ষার সুযোগবঞ্চিত হয়ে স্থায়ী মনোরোগীতে পরিণত হবেন, যা কোনভাবেই আমাদের কাম্য নয়। তাই সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনায় বৃহত্তর স্বার্থে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি বা তার পরিবার-পরিজনের জন্য মনোবিশ্লেষক নাট্যক্রিয়া অনুশীলনের ক্ষেত্রকে সহজতর ও প্রশস্ত করতে হবে। অন্যথায় পরিবারে নতুন করে একজন মনোরোগীর সংযোজন ঘটবে। সহিংসতাপূর্ণ উদ্ভূত পরিস্থিতি পর্যালোচনা ও মূল্যায়নের পরিপ্রেক্ষিতে এই ক্রান্তিকালে মনোবিশ্লেষক নাট্যক্রিয়া অনুশীলনের নাট্যধারার বিকাশে সবার মনযোগ আকর্ষণ করছি। অর্থাৎ সহিংসতাপূর্ণ পরিস্থিতিতে সৃষ্ট ট্রমা মোকাবিলায় মনোবিশ্লেষক ধর্মী চর্চার উন্মেষ ঘটাতে পারলে নিশ্চিত হবে সহিংসতাপূর্ণ পরিস্থিতিতে থাকা মানুষের বিপর্যস্ত মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার অধিকার।

মানবসৃষ্ট দুর্যোগে অদ্ভুত পরিস্থিতি; মন ও মননের ওপর যে নেতিবাচক পরিবর্তন আনেÑ তাকে মনোবৈজ্ঞানিকভাবে ব্যবস্থাপনা করা অতিব জরুরি। কারণ মনোপিড়া ও মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ করতে পারার সক্ষমতা সব মানুষের সমান নয়। ফলে মানুষের মধ্যে এমতঅবস্থায় গড়ে ওঠা ট্রমা, যা দৈনন্দিন জীবন ও জীবনাচারে নিয়ে আসেÑ মানসিক যন্ত্রণার নানা ধরনের পরিপ্রেক্ষিত। কমিয়ে ফেলে উদ্ভূত পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়ার সক্ষমতা। এই সময় ব্যক্তিগত মনো-সামাজিক বিপর্যয় এবং নতুন পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়ার মনস্তত্ত্ব গড়ে তুলতে প্রয়োজন নিজেকে ভালো রাখার উপায় খুঁজে নেয়া। এক্ষেত্রে সৃজনশীল ক্রিয়া-কর্মের অনুশীলন ও চর্চা ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির মানসিক শক্তি উন্নতকরণে রাখতে পারে মনোবৈজ্ঞানীক ভূমিকা; কারণ সৃজনশীল ক্রিয়া-কলাপ ব্যক্তির ব্যক্তিগত মানস গঠনের পাশাপাশি মনোদৈহিক অবস্থার মধ্যে সমন্বয় গড়ে তোলে। এতে করে সে/তিনি ওই ভঙ্গুর পরিস্থিতিতে নিজেকে স্বতঃস্ফূর্ত ও সৃজনশীল রাখতে সক্ষম হন। ফলে নেতিবাচক মনস্তত্ত্বকে ইতিবাচক খাতে প্রবাহিত করার পথ প্রশস্ত হয়। বিপর্যস্ত পরিস্থিতিতে ভূমিকাভিনয় অনুশীলন খুবই কার্যকর একটি পদক্ষেপ। এককভাবে বা দলীয়ভাবে তা চর্চা করা ইতিবাচক পরিবর্তনে অত্যাবশ্যক একটি কর্মকৌশল। পারিবারিকভাবে এই কর্মকৌশল অনুশীলন সময়ের দাবি। স্মরণীয় যে, অভিনয় কলা হচ্ছেÑ সব সৃজনশীল ক্রিয়ার একটি সুসংগঠিত রূপ।

যার মধ্যে নাচ, গান, চিত্রাঙ্কন এবং সুসামঞ্জস্যতাপূর্ণ অঙ্গভঙ্গি একীভূত হয়ে থাকে। অর্থাৎ শিল্পকলার বিভিন্ন মাধ্যমের একক ও বহুমাত্রিক অনুশীলন বিশেষত: ভূমিকাভিনয় তত্ত্ব একটি মানসিক প্রশান্তিময় অবস্থা ও অবস্থান গড়ে তুলতে রাখে সহায়ক অবদান। মনো-সমস্যা বিদ্যার সর্বাধুনিক প্রয়োগ প্রক্রিয়া তাকে (ভূমিকাভিনয় তত্ত্ব) গুরুত্বপূর্ণ একটি কর্মকৌশল হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে, যা মনোবিশ্লেষক নাট্যক্রিয়া হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়ে থাকে। মানসিক প্রশান্তি আনতে সহায়ক এই মনোস্বাস্থ্য সুরক্ষা পদ্ধতি বিশ্লেষকদের কাছে মনোবিশ্লেষক নাট্যক্রিয়া হিসেবে মূল্যায়িত হয়ে থাকে। আসুন যে যার অবস্থান থেকে সচেষ্ট হই প্রতিষ্ঠা করতে তেমন এক থেরাপিউটিক সমাজ ব্যবস্থা যেখানে বিশ্ব নামের গ্রামে সব বাসিন্দা সুসমন্বিত মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে আমৃত্যু বেঁচে থাকবে। অর্থাৎ সম্মিলিতভাবে নেতিবাচক প্রভাবগুলো মানবিক সমাজের কাঠামোকে করে ক্ষতিগ্রস্ত। আর সমাজের নিয়ামক শক্তি হিসেবে মানুষের মধ্যে সৃষ্টি করে অমানবিকতার উন্মেষ। ফলে সমাজ কাঠামো ভেঙে হয় চুরমার। তাই মনোবিশ্লেষক নাট্যক্রিয়ার অনুশীলনের পরিমাণ বাড়ানোর পরিকল্পনাই কেবল পারে, উদ্ভূত পরিস্থিতি থেকে দিতে পারে পরিত্রাণ। মানবিক সমাজ তথা থেরাপিউটিক সোসাইটি প্রতিষ্ঠার মানসে মনোবিশ্লেষক নাট্যবিজ্ঞানের নিয়মিত চর্চার সুযোগ সৃষ্টি করে সামাজিক অরাজকতার হার কমানোর উদ্যোগ এখন সময়ের প্রয়োজন। আশা করছি, সামগ্রীক বিপর্যয়ের চিত্র বিবেচনায় নিয়ে নীতিনির্ধারক মহল এই ক্ষেত্রে মনোবিশ্লেষক নাট্যক্রিয়া অনুশীলনের কার্যকর পদক্ষেপ নেবেন মানবিক কারণে।

[লেখক: নির্বাহী পরিচালক, উৎস]

back to top