alt

উপ-সম্পাদকীয়

আদিবাসী ভাষা সংরক্ষণে উদ্যোগ নিন

মিথুশিলাক মুরমু

: শনিবার, ২২ ফেব্রুয়ারী ২০২৫

বাংলাদেশে আদিবাসীদের মাতৃভাষায় প্রাক-প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষাদান কর্মসূচি চড়াই-উতরাই পেরিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এগিয়ে চলেছে। দেশের বৃহত্তম আদিবাসী জাতিগোষ্ঠী সাঁওতালদের মাতৃভাষায় আদৌ কোনো উদ্যোগ নেওয়া সম্ভবপর হয়নি। সরকারের নীতি-নির্ধারক ও ভাষাবিদরা সাঁওতাল জাতিগোষ্ঠীর ওপর সিদ্ধান্তের দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছিলেন কিন্তু চূড়ান্ত ফয়সালা করতে গিয়েই ভাষাটি রাজনৈতিক ক্রীড়ানকে পরিণত হয়েছে। সাঁওতালদের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মতামতকে উপেক্ষা না করে এবং রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে না দেখে সত্যিকার অর্থে ভাষার বর্ণমালায় উপযোগিতা নির্ধারণে সরকারকে দৃঢ় ভূমিকা গ্রহণ করতে হতো। কিন্তু সেই দৃঢ়তা দেখাতে পারেনি।

সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ীÑ গারো, চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, উরাঁওদের প্রাক-প্রাথমিক পর্যায়ে শুরু হলেও পদে পদে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। দ্বিতীয় পর্যায়ে ¤্রাে, মণিপুরী, (বিষ্ণুপ্রিয়া), মণিপুরী (মৈতৈ), তঞ্চঙ্গ্যা, খাসি ও বম; তৃতীয় পর্যায়েÑ কোচ, কুড়–ক (উরাঁও), হাজং, রাখাইন, খুমি ও খিয়াং ভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং পর্যায়ক্রমে অন্যান্য ভাষাগুলোও প্রাথমিক শিক্ষায় ব্যবহার করা হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছিলো কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি।

দারিদ্র্য বিমোচন কৌশলপত্রে (২০০৫) আদিবাসী ও জাতিগত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর শিশুদের জন্য তাদের নিজস্ব মাতৃভাষায় শিক্ষা লাভের সুযোগ সম্বলিত পাঠ্যসূচি প্রবর্তনের প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করা হয়েছে (পিআরএসপি, পৃষ্ঠা ১৫২-৫৩)। দ্বিতীয়তÑ প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচির অধীনে ‘ট্রাইবাল শিশুদের জন্য প্রাথমিক শিক্ষার পরিস্থিতি বিশ্লেষণ, কৌশল ও কর্মপরিকল্পনা’ অধীনে ২০১১ খ্রিস্টাব্দে তৃতীয় পর্যায়ের পরিকল্পনায় ‘জেন্ডার অ্যান্ড ইনক্লুসিভ এডুকেশন অ্যাকশন প্ল্যান’ নামে প্রণীত বিশেষ পরিকল্পনায় আদিবাসী শিশুদের মাতৃভাষায় শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য সুনির্দিষ্ট কিছু কর্মসূচি বাস্তবায়নের কথা বলা হয়েছে।

জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এর ২৩নং উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য ছিলোÑ ১. দেশের আদিবাসীসহ সকল ক্ষুদ্র জাতিসত্তার সংস্কৃতি ও ভাষার বিকাশ ঘটানো (পৃষ্ঠা-২)। এই নীতি অনুসারে বিদ্যালয় প্রস্তুতির লক্ষ্যে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার কথা বলা হয়েছে।

২. প্রাথমিক শিক্ষার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য প্রসঙ্গে আদিবাসী শিশুর প্রাথমিক শিক্ষার বিষয়ে যা বলা হয়েছে তা হলোÑ প্রাথমিক শিক্ষা স্তরে আদিবাসীসহ সকল ক্ষুদ্র জাতিসত্তার জন্য স্ব স্ব মাতৃভাষা শিক্ষার ব্যবস্থা করা (পৃষ্ঠা-৪) প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন প্রকল্প দুই (পিইডিপি-২) এর আওতায় আদিবাসী শিশুর শিক্ষার উন্নয়নে ২০০৬ সালে পরিস্থিতি বিশ্লেষণ, কৌশল ও কর্ম- পরিকল্পনায় আদিবাসী শিশুদের শিক্ষাদানের জন্য স্থানীয় এবং আদিবাসী ভাষা জানেন এমন আদিবাসী শিক্ষক নিয়োগসহ পাঠ্যসূচিতে আদিবাসী সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ সংযুক্ত করার কথা বলা হয়েছে। ষষ্ঠ পঞ্চবাষির্কী পরিকল্পনা বাস্তবায়নের অন্যতম কৌশল হিসেবে সুবিধাবঞ্চিত স্বল্প প্রাধিকারপ্রাপ্ত জনগোষ্ঠীর সামাজিক সুরক্ষা প্রদানের কথা বলা হয়েছে, যার আওতায় বিদ্যমান কর্মসূচিগুলোকে পর্যালোচনা ও পুনর্বিন্যস্ত করে প্রতিবন্ধী, বয়স্ক, আদিবাসী, নারী ও শিশুদের মতো স্বল্প প্রাধিকারপ্রাপ্ত জনগোষ্ঠীসমূহ যাতে সুবিধা বণ্টনকালে অগ্রাধিকার পায়, তার জন্য সামাজিক নিরাপত্তাজাল কর্মসূচি গ্রহণের অভিপ্রায় ব্যক্ত করা হয়।

প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর ও এনসিটিবির উদ্যোগে ২০১২ খ্রিস্টাব্দ থেকে মূলত মাতৃভাষাভিত্তিক বহুভাষিক শিক্ষা কার্যক্রম বাস্তবায়নের উদ্যোগ শুরু হয়। এ কার্যক্রম বাস্তবায়নের জন্য সম্ভবত প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয় ৩১ অক্টোবর ২০১২ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিবের সভাপতিত্বে। সেই সভাতেই জনসংখ্যার পরিমাণ বিবেচনায় চাকমা, মারমা, গারো, ত্রিপুরা, উরাঁও (সাদরি) ও সাঁওতাল আদিবাসীদের জন্য প্রাথমিক পর্যায়ে এই কর্মসূচি গ্রহণের সিদ্ধান্ত হয় এবং এ কার্যক্রম সার্বিকভাবে দেখাশোনা করার জন্য প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিবের (উন্নয়ন) সভাপতিত্বে সংশ্লিষ্ট আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধি, সংশ্লিষ্ট সরকারি-বেসরকারি সংস্থার প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির প্রথম সভা অনুষ্ঠিত ৩ ডিসেম্বর ২০১২ খ্রিস্টাব্দে।

এনসিটিবির একাধিক শিক্ষা বিশেষজ্ঞ বলেছেন, শিশুকে শিক্ষার জন্য প্রস্তুত করতে প্রাক- প্রাথমিক পর্যায়ে মাতৃভাষায় শিক্ষা দেওয়া জরুরি। এরপর সে ধীরে ধীরে মাতৃভাষার সঙ্গে অন্য ভাষায় (বাংলাদেশের জন্য বাংলা) শিক্ষা নেবে। এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সময় সাত বছর। এই সময়টাকে বলে ব্রিজিং পিরিয়ড। ২০১৪ জানুয়ারি থেকে ৫টি ভাষায় প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা চালু করার কথা থাকলেও সময় মতো চূড়ান্ত করতে পারেনি। ২০১৭ খ্রিস্টাব্দে ৫টি ভাষায় ২৪ হাজার শিশুর হাতে বই প্রদানে সমর্থ হয়েছিলো সরকার। ঢাকাস্থ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে মাতৃভাষাভিত্তিক বহুভাষিক শিক্ষা (এমএলই) ফোরাম-এর সভা অনুষ্ঠিত হয় ২৭ এপ্রিল ২০১৭ খ্রিস্টাব্দে।

আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকায় বেশির ভাগ শিশু বাড়িতে এক ভাষায় কথা বলে যা তাদের বিদ্যালয়ের ভাষার সঙ্গে এক হয় না। এতে করে তারা বড় ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হয়ে থাকে। গবেষণায় দেখা গেছে, শিশুরা মাতৃভাষায় শিক্ষা গ্রহণ করলে পরীক্ষায় ভালো ফলাফল অর্জন করে ও লেখাপড়ার মানও থাকে সন্তোষজনক। প্রমাণিত হয়েছেÑ যদি প্রথম ভাষা কেউ ভালোভাবে রপ্ত করতে পারে, তাহলে দ্বিতীয় ভাষাতেও সে ভালো করতে পারবে। আমরা এ দেশের আদিবাসীরা উদ্বিগ্ন যে, সরকার আদিবাসীদের মাতৃভাষা রক্ষায় কার্যকারী পদক্ষেপ গ্রহণে দ্বিধান্বিত! সময়ের স্রোতে আদিবাসীদের ভাষাগুলোর সীমানা সীমিত হয়ে আসছে। ভাষা শহীদের দেশে আদিবাসীদের মাতৃভাষা বিলুপ্তির ঘটনা আমাদের লজ্জিত করবে, নিন্দিত হবো বৈচিত্র্যময় ভাষার পৃথিবীতে।

[লেখক : কলামিস্ট]

বই পড়ে কী হবে

জনস্বাস্থ্যের আরেক আতঙ্কের নাম ডিমেনশিয়া

ভারতে সঙ্ঘের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য

রম্যগদ্য : “বঙ্গ হবে কলিঙ্গ”

ছবি

ভাষা আন্দোলনের পটভূমি ও চেতনার অন্বেষণে

প্রযুক্তি, জলবায়ু ও জনসংখ্যার মোকাবিলায় উন্নয়নশীল অর্থনীতির

চাই একটি জাতীয় ভাষানীতি

অস্বাভাবিকের চেয়ে অস্বাভাবিক বায়ুদূষণ

আদিবাসীদের কাঁটাতারে বন্দি জীবন

জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে অভিযোজন : বাংলাদেশের কৌশল

শিক্ষক আন্দোলন প্রসঙ্গে

আর জি কর ঘিরে শাসক কৌশল প্রসঙ্গে

নিজের পথে ইউরোপ

ছবি

এই দাহ্য আগুন কি বিপ্লবী হতাশার বাহ্য রূপ

ভূমিজ বাঁওড় মৎস্যজীবীদের সমাজভিত্তিক সমবায় মালিকানা

মব থামাবে কে?

ভোটাধিকার পুনরুদ্ধারের সংস্কার

ফিরে দেখা বসন্ত উৎসব

এক যে ছিল স্বৈরাচারের আশির দশক!

রম্যগদ্য : কানামাছির রাজনীতি

চেকের মামলায় জেল খাটলেও টাকা আদায়ের আইনি প্রক্রিয়া

প্রতিক্রিয়াশীলতার ছায়াতলে কেবলই অন্ধকার

স্মরণ : গুরু রবিদাস জী

মাঘী পূর্ণিমা : সম্প্রীতির মধুময় স্মৃতি

ট্রাম্পের গাজা পরিকল্পনার বিপজ্জনক বাস্তবতা

পুলিশে কেমন সংস্কার চাই?

সত্যিই কি ইউএসএআইডি বন্ধ হয়ে যাবে

রম্যগদ্য: “গো টু দ্য ডেভিল”

এত ক্রোধ, প্রতিহিংসা আর অস্থিরতাÑ সবই কি স্বৈরাচারের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া!

কীভাবে আইন মেনে চলার সংস্কৃতি গড়ে তোলা যায়?

কেন এই ধ্বংস?

প্রসঙ্গ: সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশ

পশ্চিমবঙ্গ : রাজনৈতিক হিন্দুত্বের নয়া গবেষণাগার

দাবি আদায়ে জনদুর্ভোগ : উত্তরণের উপায়

কুষ্ঠ : স্বাস্থ্য খাতের সংস্কারে ইস্যুটি কেন গুরুত্বপূর্ণ

ঔপনিবেশিকতা নাকি মানবতার অবমূল্যায়ন?

tab

উপ-সম্পাদকীয়

আদিবাসী ভাষা সংরক্ষণে উদ্যোগ নিন

মিথুশিলাক মুরমু

শনিবার, ২২ ফেব্রুয়ারী ২০২৫

বাংলাদেশে আদিবাসীদের মাতৃভাষায় প্রাক-প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষাদান কর্মসূচি চড়াই-উতরাই পেরিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এগিয়ে চলেছে। দেশের বৃহত্তম আদিবাসী জাতিগোষ্ঠী সাঁওতালদের মাতৃভাষায় আদৌ কোনো উদ্যোগ নেওয়া সম্ভবপর হয়নি। সরকারের নীতি-নির্ধারক ও ভাষাবিদরা সাঁওতাল জাতিগোষ্ঠীর ওপর সিদ্ধান্তের দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছিলেন কিন্তু চূড়ান্ত ফয়সালা করতে গিয়েই ভাষাটি রাজনৈতিক ক্রীড়ানকে পরিণত হয়েছে। সাঁওতালদের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মতামতকে উপেক্ষা না করে এবং রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে না দেখে সত্যিকার অর্থে ভাষার বর্ণমালায় উপযোগিতা নির্ধারণে সরকারকে দৃঢ় ভূমিকা গ্রহণ করতে হতো। কিন্তু সেই দৃঢ়তা দেখাতে পারেনি।

সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ীÑ গারো, চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, উরাঁওদের প্রাক-প্রাথমিক পর্যায়ে শুরু হলেও পদে পদে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। দ্বিতীয় পর্যায়ে ¤্রাে, মণিপুরী, (বিষ্ণুপ্রিয়া), মণিপুরী (মৈতৈ), তঞ্চঙ্গ্যা, খাসি ও বম; তৃতীয় পর্যায়েÑ কোচ, কুড়–ক (উরাঁও), হাজং, রাখাইন, খুমি ও খিয়াং ভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং পর্যায়ক্রমে অন্যান্য ভাষাগুলোও প্রাথমিক শিক্ষায় ব্যবহার করা হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছিলো কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি।

দারিদ্র্য বিমোচন কৌশলপত্রে (২০০৫) আদিবাসী ও জাতিগত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর শিশুদের জন্য তাদের নিজস্ব মাতৃভাষায় শিক্ষা লাভের সুযোগ সম্বলিত পাঠ্যসূচি প্রবর্তনের প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করা হয়েছে (পিআরএসপি, পৃষ্ঠা ১৫২-৫৩)। দ্বিতীয়তÑ প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচির অধীনে ‘ট্রাইবাল শিশুদের জন্য প্রাথমিক শিক্ষার পরিস্থিতি বিশ্লেষণ, কৌশল ও কর্মপরিকল্পনা’ অধীনে ২০১১ খ্রিস্টাব্দে তৃতীয় পর্যায়ের পরিকল্পনায় ‘জেন্ডার অ্যান্ড ইনক্লুসিভ এডুকেশন অ্যাকশন প্ল্যান’ নামে প্রণীত বিশেষ পরিকল্পনায় আদিবাসী শিশুদের মাতৃভাষায় শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য সুনির্দিষ্ট কিছু কর্মসূচি বাস্তবায়নের কথা বলা হয়েছে।

জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এর ২৩নং উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য ছিলোÑ ১. দেশের আদিবাসীসহ সকল ক্ষুদ্র জাতিসত্তার সংস্কৃতি ও ভাষার বিকাশ ঘটানো (পৃষ্ঠা-২)। এই নীতি অনুসারে বিদ্যালয় প্রস্তুতির লক্ষ্যে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার কথা বলা হয়েছে।

২. প্রাথমিক শিক্ষার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য প্রসঙ্গে আদিবাসী শিশুর প্রাথমিক শিক্ষার বিষয়ে যা বলা হয়েছে তা হলোÑ প্রাথমিক শিক্ষা স্তরে আদিবাসীসহ সকল ক্ষুদ্র জাতিসত্তার জন্য স্ব স্ব মাতৃভাষা শিক্ষার ব্যবস্থা করা (পৃষ্ঠা-৪) প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন প্রকল্প দুই (পিইডিপি-২) এর আওতায় আদিবাসী শিশুর শিক্ষার উন্নয়নে ২০০৬ সালে পরিস্থিতি বিশ্লেষণ, কৌশল ও কর্ম- পরিকল্পনায় আদিবাসী শিশুদের শিক্ষাদানের জন্য স্থানীয় এবং আদিবাসী ভাষা জানেন এমন আদিবাসী শিক্ষক নিয়োগসহ পাঠ্যসূচিতে আদিবাসী সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ সংযুক্ত করার কথা বলা হয়েছে। ষষ্ঠ পঞ্চবাষির্কী পরিকল্পনা বাস্তবায়নের অন্যতম কৌশল হিসেবে সুবিধাবঞ্চিত স্বল্প প্রাধিকারপ্রাপ্ত জনগোষ্ঠীর সামাজিক সুরক্ষা প্রদানের কথা বলা হয়েছে, যার আওতায় বিদ্যমান কর্মসূচিগুলোকে পর্যালোচনা ও পুনর্বিন্যস্ত করে প্রতিবন্ধী, বয়স্ক, আদিবাসী, নারী ও শিশুদের মতো স্বল্প প্রাধিকারপ্রাপ্ত জনগোষ্ঠীসমূহ যাতে সুবিধা বণ্টনকালে অগ্রাধিকার পায়, তার জন্য সামাজিক নিরাপত্তাজাল কর্মসূচি গ্রহণের অভিপ্রায় ব্যক্ত করা হয়।

প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর ও এনসিটিবির উদ্যোগে ২০১২ খ্রিস্টাব্দ থেকে মূলত মাতৃভাষাভিত্তিক বহুভাষিক শিক্ষা কার্যক্রম বাস্তবায়নের উদ্যোগ শুরু হয়। এ কার্যক্রম বাস্তবায়নের জন্য সম্ভবত প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয় ৩১ অক্টোবর ২০১২ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিবের সভাপতিত্বে। সেই সভাতেই জনসংখ্যার পরিমাণ বিবেচনায় চাকমা, মারমা, গারো, ত্রিপুরা, উরাঁও (সাদরি) ও সাঁওতাল আদিবাসীদের জন্য প্রাথমিক পর্যায়ে এই কর্মসূচি গ্রহণের সিদ্ধান্ত হয় এবং এ কার্যক্রম সার্বিকভাবে দেখাশোনা করার জন্য প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিবের (উন্নয়ন) সভাপতিত্বে সংশ্লিষ্ট আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধি, সংশ্লিষ্ট সরকারি-বেসরকারি সংস্থার প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির প্রথম সভা অনুষ্ঠিত ৩ ডিসেম্বর ২০১২ খ্রিস্টাব্দে।

এনসিটিবির একাধিক শিক্ষা বিশেষজ্ঞ বলেছেন, শিশুকে শিক্ষার জন্য প্রস্তুত করতে প্রাক- প্রাথমিক পর্যায়ে মাতৃভাষায় শিক্ষা দেওয়া জরুরি। এরপর সে ধীরে ধীরে মাতৃভাষার সঙ্গে অন্য ভাষায় (বাংলাদেশের জন্য বাংলা) শিক্ষা নেবে। এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সময় সাত বছর। এই সময়টাকে বলে ব্রিজিং পিরিয়ড। ২০১৪ জানুয়ারি থেকে ৫টি ভাষায় প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা চালু করার কথা থাকলেও সময় মতো চূড়ান্ত করতে পারেনি। ২০১৭ খ্রিস্টাব্দে ৫টি ভাষায় ২৪ হাজার শিশুর হাতে বই প্রদানে সমর্থ হয়েছিলো সরকার। ঢাকাস্থ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে মাতৃভাষাভিত্তিক বহুভাষিক শিক্ষা (এমএলই) ফোরাম-এর সভা অনুষ্ঠিত হয় ২৭ এপ্রিল ২০১৭ খ্রিস্টাব্দে।

আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকায় বেশির ভাগ শিশু বাড়িতে এক ভাষায় কথা বলে যা তাদের বিদ্যালয়ের ভাষার সঙ্গে এক হয় না। এতে করে তারা বড় ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হয়ে থাকে। গবেষণায় দেখা গেছে, শিশুরা মাতৃভাষায় শিক্ষা গ্রহণ করলে পরীক্ষায় ভালো ফলাফল অর্জন করে ও লেখাপড়ার মানও থাকে সন্তোষজনক। প্রমাণিত হয়েছেÑ যদি প্রথম ভাষা কেউ ভালোভাবে রপ্ত করতে পারে, তাহলে দ্বিতীয় ভাষাতেও সে ভালো করতে পারবে। আমরা এ দেশের আদিবাসীরা উদ্বিগ্ন যে, সরকার আদিবাসীদের মাতৃভাষা রক্ষায় কার্যকারী পদক্ষেপ গ্রহণে দ্বিধান্বিত! সময়ের স্রোতে আদিবাসীদের ভাষাগুলোর সীমানা সীমিত হয়ে আসছে। ভাষা শহীদের দেশে আদিবাসীদের মাতৃভাষা বিলুপ্তির ঘটনা আমাদের লজ্জিত করবে, নিন্দিত হবো বৈচিত্র্যময় ভাষার পৃথিবীতে।

[লেখক : কলামিস্ট]

back to top