alt

উপ-সম্পাদকীয়

ভারতে সঙ্ঘের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য

গৌতম রায়

: শনিবার, ২২ ফেব্রুয়ারী ২০২৫

মোহন ভাগবত আরএসএস প্রধান, ভারতের স্বাধীনতা দিবস বদলের জিগির তুলেছেন। ১৫ আগস্ট ১৯৪৭ সাল তার মতে নাকি ভারতের স্বাধীনতা দিবস নয়। ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদের ধ্বংসস্তূপের উপরে বিতর্কিত রাম মন্দির তৈরি হওয়ার পর, সেটির উদ্বোধনের দিনটিকে তিনি ভারতের স্বাধীনতা দিবস হিসেবে পালনের আহ্বান জানিয়েছেন। আরএসএস প্রধানের এই আহ্বানের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সম্পর্কে অনেক পাল্টা জবাবের অবতারণা করা যায়। প্রথম যে জবাব, সেটি হলো; তাহলে অটলবিহারী বাজপেয়ী নেতৃত্বে যে তিন দফায় সরকার তৈরি হয়েছিল, সেই সরকার গুলি কি স্বাধীন ভারতে তৈরি হয়নি? প্রথম নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে একক গরিষ্ঠতা নিয়ে বিজেপি যে কেন্দ্রে সরকার গঠন করে এটি কি স্বাধীন ভারতে হয়নি?

সরসঙ্ঘপ্রধান যে দাবি জানিয়েছেন, সে দাবিগুলো কিন্তু এ ধরনের কোন রাজনৈতিক প্রাসঙ্গিকতার নিরিখে নয়। তার দাবির মূল বক্তব্যই হচ্ছে; স্বাধীনতার সময় কাল থেকে গোটা হিন্দুত্ববাদী শক্তি যেভাবে ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের সমালোচনায় মুখর থেকেছে, এই দাবি, হিন্দুত্ববাদীদের সেদিনের সেই সমালোচনাকে একটা প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেওয়ার উদ্যোগ। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনের গোটা সময়কাল হিন্দুত্ববাদী শক্তি, ভারতীয় জাতীয়তাবাদকে দেখেছে হিন্দু জাতীয়তাবাদ হিসেবে। তাদের সেদিনের সেই ভিত্তির ওপর নির্ভর করে স্বাধীন ভারতের সংবিধানকে আরএসএস বা তাদের সেই সময়ের সমস্ত ধরনের রাজনৈতিক এবং সহযোগী সংগঠনগুলি কোনও অবস্থাতেই সমর্থন জানায়নি।

স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে হিন্দুত্ববাদীদের হাতে মহাত্মা গান্ধীর নিহত হওয়ার ঘটনা, এই পরিচয়টাকে তারা সেদিনও গৌরবান্বিত করেছে। আজও ঠিক সেভাবেই গৌরবান্বিত করে চলেছে। স্বাধীনতার সময়কাল থেকেই আরএসএস বা তাদের রাজনৈতিক সামাজিক সহযোগীরা তখনও সহ-নাগরিক মুসলমান বা খ্রিস্টানদের সন্দেহের তালিকা থেকে অব্যাহতি দেয়নি, আজও দেয় না। বহুকাল ধরে আরএসএসের একদা রাজনৈতিক সংগঠন হিন্দু মহাসভা, দিল্লি থেকে ৭০ কিলোমিটার দূরে পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের মিরাটে স্বাধীনতা দিবসকে ‘কালা দিবস’ হিসেবে পালন করে থাকে। বহুকাল আরএসএসের বিভিন্ন শাখা সংগঠন ১৫ আগস্ট ভারতের স্বাধীনতার দিনটিকে ‘কালা দিবস’ হিসেবে পালন করে। কালো পতাকা উত্তোলন করে। ভারতের স্বাধীনতা দিবসের বিপক্ষে সেই সমস্ত সমাবেশ থেকে হিন্দুত্ববাদী শিবির নানা ধরনের ভারতীয় সংবিধান ধর্মনিরপেক্ষতা, হিন্দু মুসলমান সম্প্রীতির বিরোধী সেøাগান দিয়ে এসেছে নিয়মিত। সমাবেশগুলো থেকে দীর্ঘদিন গোটা হিন্দুত্ববাদী শিবির, ভারতীয় সংবিধানের সম্পর্কে অত্যন্ত অশ্রদ্ধা সূচক বক্তব্য রেখেছে। ভারতীয় সংবিধান যেহেতু ধর্মনিরপেক্ষ, সেই কারণে ভারতীয় সংবিধানের বাপ বাপান্ত করতে এইসব সমাবেশকে বিশেষভাবে ব্যবহার করে গোটা হিন্দুত্ববাদী শক্তি। সেই সব সমাবেশ থেকে তারা নিয়মিত দাবি জানিয়ে এসেছে ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করবার।

কেবলমাত্র এখানেই শেষ নয়। আরএসএস সহ গোটা হিন্দুত্ববাদী শিবিরের নেতারা একইসঙ্গে ২৬ জানুয়ারি, প্রজাতন্ত্র দিবস টিও অত্যন্ত নেতিবাচকভাবে বহুকাল ধরে পালন করেছে। এই দিনটিকে তারা কালা দিবস হিসেবে পালন করে এসেছে। উত্তর ভারতের বহু জায়গায় ২৬ জানুয়ারি কালা দিবস হিসেবে পালন করলেও ৩০ জানুয়ারি মহাত্মা গান্ধীর আত্মবলিদান দিবস, হিন্দু সম্প্রদায়িক শক্তি। আনন্দ প্রকাশের একটা দিন হিসেবে ব্যবহার করে। নানা ধরনের আনন্দ সূচক নাচ-গান ড্রাম বাজানো ইত্যাদির মধ্যে দিয়ে তারা নাথুরাম বিনায়ক গডসর কর্তৃক মহাত্মা গান্ধী হত্যাকে ইতিবাচক ভাবে উদযাপন করে।

২০১৪ সালের ডিসেম্বর মাস, নরেন্দ্র মোদি তখন সদ্য প্রথম দফায় দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। এই সময়ে হিন্দু মহাসভা উদ্যোগ নিয়েছিল গান্ধীজি হত্যাকারী নাথুরাম গডসে স্মরণে কিছু কর্মসূচি নেওয়ার। গডসের মূর্তি স্থাপনেরও কর্মসূচি তারা নেয়। এই সময় হিন্দু মহাসভার সর্বভারতীয় সহ-সভাপতি অশোক শর্মা প্রকাশ্যে জানিয়েছিলেন, স্বাধীনতা দিবস এবং প্রজাতন্ত্র দিবসকে কালা দিবস হিসেবে তারা পালন করবে। বিগত ৬৯ বছর স্বাধীনতা দিবস হিসেবে যে ১৫ আগস্টকে পালন করা হয়েছে। ৬৬ বছর ধরে যে ২৬ জানুয়ারিকে প্রজাতন্ত্র দিবস হিসেবে পালন করা হয়েছে, সেই দুটো দিনকেই তারা কালা দিবস হিসেবে পালন করবে। অশোক শর্মা সেদিন আরো বলেছিলেন; এই ১৫ আগস্ট এবং ২৬ জানুয়ারি কে তারা তাদের মতাদর্শ অনুযায়ী কালা দিবস হিসেবে পালন করতে চাইলে, ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত তাদের পুলিশ এবং কোর্টের নানা ধরনের হেনস্থার স্বীকার হতে হতো। তিনি দেশভাগের জন্য মহাত্মা গান্ধী এবং জওহরলাল নেহেরুকে অন্যতম দায়ী বলে অভিযোগ করে বলেন ; পুলিশের ভূমিকার যে পরিবর্তন ঘটেছে তা দেখে তিনি আনন্দিত।

এ ধরনের অপদাবি ঘিরে গোটা হিন্দুত্ববাদী শিবিরের মধ্যে চিরদিন একটা দ্বিচারিতার মনোভাব আমরা দেখে এসেছি। তাদের শিবির মুক্ত মানুষজন অপদাবি তুললে তারা নিশ্চুপ থাকে। কিন্তু বিপক্ষ শিবিরের কেউ এমন দাবি তুললে তারা শুধু সমালোচনা নয়, এমন ধরনের একটা বিশৃঙ্খলা তৈরি করে, যার পরিণতি একটা বিভাজনের রাজনীতিকে উসকে দেয়। উদাহরণ হিসেবে আটের দশকের শেষ ভাগে সেই সময়ের জনতা পার্টির বিতর্কিত নেতা তথা সংসদ সৈয়দ সাহাবুদ্দিনের ১৯৮৬ সালে ডিসেম্বর মাসে, পরের বছর, অর্থাৎ ১৯৮৭ সালের ২৬ ডিসেম্বর প্রজাতন্ত্র দিবস বয়কটের যে ডাক, আর তা ঘিরে তৎকালীন বিজেপি নেতা লালকৃষ্ণ আডবানীর যে প্রতিক্রিয়া, তা সাধারণ মানুষকে মনে করিয়ে দিতে চাইছি।

সেই সময় বিজেপি নেতা লালকৃষ্ণ আডবানি দাবি তুলেছিলেন; জনতা পার্টির সংসদ সাহাবুদ্দিনকে ওর পার্টি থেকে বহিষ্কৃত করতে হবে এবং সাহাবুদ্দিনকে তিনি সমসাময়িক কালের মহম্মদ আলী জিন্নাহ বলেও অভিহিত করেছিলেন। অথচ মজার কথা হলো, আরএসএসের অন্যতম রাজনৈতিক সংগঠন হিন্দু মহাসভা কিন্তু ঠিক একই সময়ে তৎকালীন জনতা পার্টির নেতা তথা সংসদ সৈয়দ সাহাবুদ্দিনের সুরে কথা বলেছিল। তারা ১৫ আগস্ট স্বাধীনতা দিবস বর্জনের ডাক দিয়েছিল এবং ২৬ জানুয়ারির ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবস কেও বর্জনের ডাক দিয়েছিল।

এখানেই অবশ্য অখিল ভারতীয় হিন্দু মহাসভা থেমে যায়নি। তারা ৩০ জানুয়ারি, গান্ধী হত্যা দিবস কে, গান্ধী হত্যাকারী নাথুরাম গডসের কৃতিত্বের স্মারক হিসেবে উদযাপনের ডাক দিয়েছিল। হিন্দু মহাসাগর এই দাবী সম্পর্কে কিন্তু লালকৃষ্ণ আডবানি বা বিজেপির কোনও নেতা সেদিন একটা শব্দ উচ্চারণ করেনি। অথচ সাহাবুদ্দিনের অন্যায়, অন্যার্য বক্তব্য সম্পর্কে তারা নিজেদের অভিমত ব্যক্ত করেছিল।

সৈয়দ সাহাবুদ্দিনের ক্ষেত্রে এক ধরনের অবস্থান নিচ্ছেন সেই সময়ের শীর্ষ বিজেপি নেতা লালকৃষ্ণ আডবানী। আবার সাহাবুদ্দিন যে সুরে কথা বলেছিলেন, তারই কার্যত পুনরুক্তি করছেন ২০২৪ সালে এসে সরসঙ্ঘচালক মোহন ভাগবত। কিন্তু বিজেপির শীর্ষস্তরের নেতাদের ভাগবতের বক্তব্য সম্বন্ধে কোনও প্রতিক্রিয়া নেই। বামপন্থিরা, কংগ্রেস বা অন্যান্য বিরোধী দল ভাগবতের বক্তব্যের তীব্র নিন্দা জানালেও বিজেপি নিশ্চুপ। এটাই হল বিজেপির মূল্যবোধের ফাঁকা আওয়াজের একটা প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

বিজেপি যে ভারতীয় সংস্কৃতির কথা বলে। সেই সংস্কৃতিতে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন বা স্বাধীনতা সংগ্রামীদের আত্মত্যাগের এতটুকু ভূমিকা নেই। গোটা হিন্দুত্ববাদী শিবির যেহেতু ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেনি, বরঞ্চ কিভাবে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ, তাদের শাসন তথা শোষণ যন্ত্রটিকে আরো পোক্ত করতে পারে, তার জন্য জাতীয় আন্দোলনের সময়, হিন্দু সম্প্রদায়িক শক্তি, মৌলবাদী শক্তি-মুসলিম সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী শক্তির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ব্রিটিশকে সহযোগিতা করে গেছে। ভারতীয় সংস্কৃতির নামে আরএসএস বিশ্বাস করে বিভাজনের সংস্কৃতিকে। ভারতের বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্যের যে প্রবহমান সংস্কৃতি হাজার হাজার বছর ধরে চলে আসছে, তাতে বিশ্বাসী নয় হিন্দুত্ববাদীরা। হিন্দু মুসলমানের সম্প্রীতির প্রশ্নেই শুধু নয়। প্রাতিষ্ঠানিক হিন্দু ধর্মের মধ্যে যে ধারা উপধারা গুলি আছে, বিশেষ করে গৌণ ধর্মের নানা শাখা-প্রশাখাকে যেভাবে পরবর্তীকালে প্রাতিষ্ঠানিক হিন্দু ধর্মে স্বীকৃতি জানানো হয়েছে, আরএসএস- বিজেপির রাজনৈতিক হিন্দু মানসিকতা কখনো তাকে সমর্থন করে না।

মুসলিম বা বৌদ্ধ সংস্কৃতির সংমিশ্রণে হিন্দু ধর্মের লোকায়তধারার যে বিভিন্ন পর্যায়ে দীর্ঘকাল ধরে বিশ্বাসী মানুষের মধ্যে একটা জায়গা করে নিয়েছে, রাজনৈতিক হিন্দুরা তাকে কখনো স্বীকার করে না। প্রবহমান ভারতের প্রায় প্রতিটি জনপদেই দেখতে পাওয়া যায় মিশ্র সংস্কৃতির কোন না কোন ঐতিহ্য সাধারণ মানুষের লোকবিশ্বাস এবং দৈনন্দিন জীবনযাপনের সঙ্গে একাত্ম হয়ে আছে। এক অদ্ভুত মরমীয়া স্রোত সেখানে প্রবাহিত হচ্ছে। এই স্রোতকে ধ্বংস করে দেওয়াই যে হিন্দুত্ববাদীদের লক্ষ্য, সেই উদ্দেশ্যেই তারা আমাদের দেশের স্বাধীনতা দিবসকে স্বীকার করতে চায় না, প্রজাতন্ত্র দিবসকে স্বীকার করতে চায় না, ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানকে স্বীকার করতে চায় না, ভারতীয় সংস্কৃতির বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যকে স্বীকার করতে চায় নাÑ এগুলো হলো তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ।

হিন্দুত্ববাদীরা তাদের রাজনৈতিক ভাবনা থেকে হিন্দু জাতীয়তাবাদকে কিভাবে উপস্থাপিত করবে তা উপলব্ধি করেই ভারতীয় সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতার বিষয়টিকে আম্বেদকর, নেহরু প্রমুখরা বিশেষ রকমের গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। ভারত রাষ্ট্রের মূল চরিত্র যে ধর্মনিরপেক্ষ, এই উপস্থাপনা প্রতিষ্ঠিত করবার ক্ষেত্রে হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের যে কর্মকা- গোটা জাতীয় আন্দোলনের সময় ছিল, তার প্রেক্ষিত সংবিধান প্রণেতা গণের একটা বড় অংশের বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছিল। তাই তারা আগামী দিনের ভারতে হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা বড় বিপদের কারণ যাতে না হয়ে উঠতে পারে, তার জন্যই ভারতীয় সংবিধানের অন্যতম প্রধান স্তম্ভ হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষ থেকে মর্যাদা দিয়েছিলেন।

মোহন ভাগবত আজ স্বাধীনতা দিবস বদলের যে রাজনৈতিক আহ্বান জানিয়েছেন, তার ভিত্তিতে রয়েছে সাভারকার এবং গোটা আরএসএসীয় হিন্দুত্বের, ভারতকে পূণ্যভূমি হিসেবে দেখা রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ। তাদের সেই পূর্ণভূমিতে মুসলমান এবং খ্রিস্টানের কোন ভূমিকাই তারা স্বীকার করে না হিন্দুত্ববাদীরা। ভারতকে ‘পুন্যভূমি’ বলতে অভ্যস্ত রাজনৈতিক হিন্দুরা। তাদের সেই পুণ্যভূমিতে মুসলমান এবং খ্রিস্টানদের কোন স্থান নেই।

দেশভাগে হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তির যে ভূমিকা, তার থেকে মানুষের দৃষ্টিকে আরো ঘুরিয়ে দেওয়ার লক্ষ্যেই একটা রাজনৈতিক কার্যক্রম হিসেবেই মোহন ভাগবত, স্বাধীনতা দিবস ঘিরে এই ধরনের কথা বলেছেন। আরএসএসের একদা রাজনৈতিক সংগঠন হিন্দু মহাসভা চিরদিনই দেশভাগের জন্য গান্ধীজি ও প-িত নেহরুকে দায়ী করে থাকে। নিজেদের ভূমিকা কে ভুলিয়ে দিতে ১৯৬৯ সালে ভারতীয় জনসঙ্ঘের প্রথম রাজনৈতিক ইতিকথা লিখেছিলেন করিগ বাক্সটার। সেখানে তিনি লিখছেন ’৪৭ সালের ১৫ আগস্ট যখন স্বাধীনতা এলো, আদেশের সেই ভোরকে মনে করলো, ভারতমাতার হৃদয়ে যেন একটা চরম আঘাত করা হলো। ১৯৫৬ সালে আরএসএসের তৎকালীন প্রধান এম এস গোলওয়ালকার প্রকাশ্যে বলেছিলেন; অখন্ড ভারত তাদের লক্ষ্য। ১৯৬৫ সালে ১৭ আগস্ট ভারতীয় জনসঙ্ঘের দলীয় সিদ্ধান্তে বলা হয়; মুসলমানদের আমাদের জাতীয় জীবনের অংশ হতে হবে। অখন্ড ভারত হল একটা বাস্তবতা। এই বাস্তবতাকে প্রতিষ্ঠিত করবার জন্য ভারত এবং পাকিস্তানকে যুক্ত করতে হবে। সেই অখন্ড ভারতের মধ্যে দিয়েই মুসলমানদের পৃথক রাজনীতি বন্ধ হওয়া সম্ভব।

ভুলে গেলে চলবে না, আজকের প্রধানমন্ত্রী, নরেন্দ্র মোদি, গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন ২০১২ সালে, শাহিদ সিদ্দিকী নামক এক উর্দু সাংবাদিকের কাছে দেওয়ার সাক্ষাৎকারে সেই একই অখন্ড ভারতের কথা বলেছিলেন (ঐ, পৃষ্ঠা-৪২)। আজকের বাংলাদেশের পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতির নিরিখে গোটা ভারতীয় উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িক শক্তি, মৌলবাদী শক্তিকে আরো বলবান করে, আরএসএস, তাদের যে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম বিরোধী, স্বাধীনতা আন্দোলনের বীর যোদ্ধাদের আত্মত্যাগের বিরোধী রাজনীতি করে, তাকেই নতুন করে উপস্থাপিত করতে চায়। ভারতীয় উপমহাদেশজুড়ে একটা অশান্তির বাতাবরণ তৈরি করতেই ভারতের স্বাধীনতা দিবস ঘিরে নতুন করে বিতর্কের সূচনা করেছেন মোহন ভাগবত।

[লেখক : ভারতীয় ইতিহাসবিদ]

বই পড়ে কী হবে

জনস্বাস্থ্যের আরেক আতঙ্কের নাম ডিমেনশিয়া

রম্যগদ্য : “বঙ্গ হবে কলিঙ্গ”

আদিবাসী ভাষা সংরক্ষণে উদ্যোগ নিন

ছবি

ভাষা আন্দোলনের পটভূমি ও চেতনার অন্বেষণে

প্রযুক্তি, জলবায়ু ও জনসংখ্যার মোকাবিলায় উন্নয়নশীল অর্থনীতির

চাই একটি জাতীয় ভাষানীতি

অস্বাভাবিকের চেয়ে অস্বাভাবিক বায়ুদূষণ

আদিবাসীদের কাঁটাতারে বন্দি জীবন

জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে অভিযোজন : বাংলাদেশের কৌশল

শিক্ষক আন্দোলন প্রসঙ্গে

আর জি কর ঘিরে শাসক কৌশল প্রসঙ্গে

নিজের পথে ইউরোপ

ছবি

এই দাহ্য আগুন কি বিপ্লবী হতাশার বাহ্য রূপ

ভূমিজ বাঁওড় মৎস্যজীবীদের সমাজভিত্তিক সমবায় মালিকানা

মব থামাবে কে?

ভোটাধিকার পুনরুদ্ধারের সংস্কার

ফিরে দেখা বসন্ত উৎসব

এক যে ছিল স্বৈরাচারের আশির দশক!

রম্যগদ্য : কানামাছির রাজনীতি

চেকের মামলায় জেল খাটলেও টাকা আদায়ের আইনি প্রক্রিয়া

প্রতিক্রিয়াশীলতার ছায়াতলে কেবলই অন্ধকার

স্মরণ : গুরু রবিদাস জী

মাঘী পূর্ণিমা : সম্প্রীতির মধুময় স্মৃতি

ট্রাম্পের গাজা পরিকল্পনার বিপজ্জনক বাস্তবতা

পুলিশে কেমন সংস্কার চাই?

সত্যিই কি ইউএসএআইডি বন্ধ হয়ে যাবে

রম্যগদ্য: “গো টু দ্য ডেভিল”

এত ক্রোধ, প্রতিহিংসা আর অস্থিরতাÑ সবই কি স্বৈরাচারের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া!

কীভাবে আইন মেনে চলার সংস্কৃতি গড়ে তোলা যায়?

কেন এই ধ্বংস?

প্রসঙ্গ: সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশ

পশ্চিমবঙ্গ : রাজনৈতিক হিন্দুত্বের নয়া গবেষণাগার

দাবি আদায়ে জনদুর্ভোগ : উত্তরণের উপায়

কুষ্ঠ : স্বাস্থ্য খাতের সংস্কারে ইস্যুটি কেন গুরুত্বপূর্ণ

ঔপনিবেশিকতা নাকি মানবতার অবমূল্যায়ন?

tab

উপ-সম্পাদকীয়

ভারতে সঙ্ঘের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য

গৌতম রায়

শনিবার, ২২ ফেব্রুয়ারী ২০২৫

মোহন ভাগবত আরএসএস প্রধান, ভারতের স্বাধীনতা দিবস বদলের জিগির তুলেছেন। ১৫ আগস্ট ১৯৪৭ সাল তার মতে নাকি ভারতের স্বাধীনতা দিবস নয়। ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদের ধ্বংসস্তূপের উপরে বিতর্কিত রাম মন্দির তৈরি হওয়ার পর, সেটির উদ্বোধনের দিনটিকে তিনি ভারতের স্বাধীনতা দিবস হিসেবে পালনের আহ্বান জানিয়েছেন। আরএসএস প্রধানের এই আহ্বানের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সম্পর্কে অনেক পাল্টা জবাবের অবতারণা করা যায়। প্রথম যে জবাব, সেটি হলো; তাহলে অটলবিহারী বাজপেয়ী নেতৃত্বে যে তিন দফায় সরকার তৈরি হয়েছিল, সেই সরকার গুলি কি স্বাধীন ভারতে তৈরি হয়নি? প্রথম নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে একক গরিষ্ঠতা নিয়ে বিজেপি যে কেন্দ্রে সরকার গঠন করে এটি কি স্বাধীন ভারতে হয়নি?

সরসঙ্ঘপ্রধান যে দাবি জানিয়েছেন, সে দাবিগুলো কিন্তু এ ধরনের কোন রাজনৈতিক প্রাসঙ্গিকতার নিরিখে নয়। তার দাবির মূল বক্তব্যই হচ্ছে; স্বাধীনতার সময় কাল থেকে গোটা হিন্দুত্ববাদী শক্তি যেভাবে ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের সমালোচনায় মুখর থেকেছে, এই দাবি, হিন্দুত্ববাদীদের সেদিনের সেই সমালোচনাকে একটা প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেওয়ার উদ্যোগ। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনের গোটা সময়কাল হিন্দুত্ববাদী শক্তি, ভারতীয় জাতীয়তাবাদকে দেখেছে হিন্দু জাতীয়তাবাদ হিসেবে। তাদের সেদিনের সেই ভিত্তির ওপর নির্ভর করে স্বাধীন ভারতের সংবিধানকে আরএসএস বা তাদের সেই সময়ের সমস্ত ধরনের রাজনৈতিক এবং সহযোগী সংগঠনগুলি কোনও অবস্থাতেই সমর্থন জানায়নি।

স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে হিন্দুত্ববাদীদের হাতে মহাত্মা গান্ধীর নিহত হওয়ার ঘটনা, এই পরিচয়টাকে তারা সেদিনও গৌরবান্বিত করেছে। আজও ঠিক সেভাবেই গৌরবান্বিত করে চলেছে। স্বাধীনতার সময়কাল থেকেই আরএসএস বা তাদের রাজনৈতিক সামাজিক সহযোগীরা তখনও সহ-নাগরিক মুসলমান বা খ্রিস্টানদের সন্দেহের তালিকা থেকে অব্যাহতি দেয়নি, আজও দেয় না। বহুকাল ধরে আরএসএসের একদা রাজনৈতিক সংগঠন হিন্দু মহাসভা, দিল্লি থেকে ৭০ কিলোমিটার দূরে পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের মিরাটে স্বাধীনতা দিবসকে ‘কালা দিবস’ হিসেবে পালন করে থাকে। বহুকাল আরএসএসের বিভিন্ন শাখা সংগঠন ১৫ আগস্ট ভারতের স্বাধীনতার দিনটিকে ‘কালা দিবস’ হিসেবে পালন করে। কালো পতাকা উত্তোলন করে। ভারতের স্বাধীনতা দিবসের বিপক্ষে সেই সমস্ত সমাবেশ থেকে হিন্দুত্ববাদী শিবির নানা ধরনের ভারতীয় সংবিধান ধর্মনিরপেক্ষতা, হিন্দু মুসলমান সম্প্রীতির বিরোধী সেøাগান দিয়ে এসেছে নিয়মিত। সমাবেশগুলো থেকে দীর্ঘদিন গোটা হিন্দুত্ববাদী শিবির, ভারতীয় সংবিধানের সম্পর্কে অত্যন্ত অশ্রদ্ধা সূচক বক্তব্য রেখেছে। ভারতীয় সংবিধান যেহেতু ধর্মনিরপেক্ষ, সেই কারণে ভারতীয় সংবিধানের বাপ বাপান্ত করতে এইসব সমাবেশকে বিশেষভাবে ব্যবহার করে গোটা হিন্দুত্ববাদী শক্তি। সেই সব সমাবেশ থেকে তারা নিয়মিত দাবি জানিয়ে এসেছে ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করবার।

কেবলমাত্র এখানেই শেষ নয়। আরএসএস সহ গোটা হিন্দুত্ববাদী শিবিরের নেতারা একইসঙ্গে ২৬ জানুয়ারি, প্রজাতন্ত্র দিবস টিও অত্যন্ত নেতিবাচকভাবে বহুকাল ধরে পালন করেছে। এই দিনটিকে তারা কালা দিবস হিসেবে পালন করে এসেছে। উত্তর ভারতের বহু জায়গায় ২৬ জানুয়ারি কালা দিবস হিসেবে পালন করলেও ৩০ জানুয়ারি মহাত্মা গান্ধীর আত্মবলিদান দিবস, হিন্দু সম্প্রদায়িক শক্তি। আনন্দ প্রকাশের একটা দিন হিসেবে ব্যবহার করে। নানা ধরনের আনন্দ সূচক নাচ-গান ড্রাম বাজানো ইত্যাদির মধ্যে দিয়ে তারা নাথুরাম বিনায়ক গডসর কর্তৃক মহাত্মা গান্ধী হত্যাকে ইতিবাচক ভাবে উদযাপন করে।

২০১৪ সালের ডিসেম্বর মাস, নরেন্দ্র মোদি তখন সদ্য প্রথম দফায় দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। এই সময়ে হিন্দু মহাসভা উদ্যোগ নিয়েছিল গান্ধীজি হত্যাকারী নাথুরাম গডসে স্মরণে কিছু কর্মসূচি নেওয়ার। গডসের মূর্তি স্থাপনেরও কর্মসূচি তারা নেয়। এই সময় হিন্দু মহাসভার সর্বভারতীয় সহ-সভাপতি অশোক শর্মা প্রকাশ্যে জানিয়েছিলেন, স্বাধীনতা দিবস এবং প্রজাতন্ত্র দিবসকে কালা দিবস হিসেবে তারা পালন করবে। বিগত ৬৯ বছর স্বাধীনতা দিবস হিসেবে যে ১৫ আগস্টকে পালন করা হয়েছে। ৬৬ বছর ধরে যে ২৬ জানুয়ারিকে প্রজাতন্ত্র দিবস হিসেবে পালন করা হয়েছে, সেই দুটো দিনকেই তারা কালা দিবস হিসেবে পালন করবে। অশোক শর্মা সেদিন আরো বলেছিলেন; এই ১৫ আগস্ট এবং ২৬ জানুয়ারি কে তারা তাদের মতাদর্শ অনুযায়ী কালা দিবস হিসেবে পালন করতে চাইলে, ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত তাদের পুলিশ এবং কোর্টের নানা ধরনের হেনস্থার স্বীকার হতে হতো। তিনি দেশভাগের জন্য মহাত্মা গান্ধী এবং জওহরলাল নেহেরুকে অন্যতম দায়ী বলে অভিযোগ করে বলেন ; পুলিশের ভূমিকার যে পরিবর্তন ঘটেছে তা দেখে তিনি আনন্দিত।

এ ধরনের অপদাবি ঘিরে গোটা হিন্দুত্ববাদী শিবিরের মধ্যে চিরদিন একটা দ্বিচারিতার মনোভাব আমরা দেখে এসেছি। তাদের শিবির মুক্ত মানুষজন অপদাবি তুললে তারা নিশ্চুপ থাকে। কিন্তু বিপক্ষ শিবিরের কেউ এমন দাবি তুললে তারা শুধু সমালোচনা নয়, এমন ধরনের একটা বিশৃঙ্খলা তৈরি করে, যার পরিণতি একটা বিভাজনের রাজনীতিকে উসকে দেয়। উদাহরণ হিসেবে আটের দশকের শেষ ভাগে সেই সময়ের জনতা পার্টির বিতর্কিত নেতা তথা সংসদ সৈয়দ সাহাবুদ্দিনের ১৯৮৬ সালে ডিসেম্বর মাসে, পরের বছর, অর্থাৎ ১৯৮৭ সালের ২৬ ডিসেম্বর প্রজাতন্ত্র দিবস বয়কটের যে ডাক, আর তা ঘিরে তৎকালীন বিজেপি নেতা লালকৃষ্ণ আডবানীর যে প্রতিক্রিয়া, তা সাধারণ মানুষকে মনে করিয়ে দিতে চাইছি।

সেই সময় বিজেপি নেতা লালকৃষ্ণ আডবানি দাবি তুলেছিলেন; জনতা পার্টির সংসদ সাহাবুদ্দিনকে ওর পার্টি থেকে বহিষ্কৃত করতে হবে এবং সাহাবুদ্দিনকে তিনি সমসাময়িক কালের মহম্মদ আলী জিন্নাহ বলেও অভিহিত করেছিলেন। অথচ মজার কথা হলো, আরএসএসের অন্যতম রাজনৈতিক সংগঠন হিন্দু মহাসভা কিন্তু ঠিক একই সময়ে তৎকালীন জনতা পার্টির নেতা তথা সংসদ সৈয়দ সাহাবুদ্দিনের সুরে কথা বলেছিল। তারা ১৫ আগস্ট স্বাধীনতা দিবস বর্জনের ডাক দিয়েছিল এবং ২৬ জানুয়ারির ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবস কেও বর্জনের ডাক দিয়েছিল।

এখানেই অবশ্য অখিল ভারতীয় হিন্দু মহাসভা থেমে যায়নি। তারা ৩০ জানুয়ারি, গান্ধী হত্যা দিবস কে, গান্ধী হত্যাকারী নাথুরাম গডসের কৃতিত্বের স্মারক হিসেবে উদযাপনের ডাক দিয়েছিল। হিন্দু মহাসাগর এই দাবী সম্পর্কে কিন্তু লালকৃষ্ণ আডবানি বা বিজেপির কোনও নেতা সেদিন একটা শব্দ উচ্চারণ করেনি। অথচ সাহাবুদ্দিনের অন্যায়, অন্যার্য বক্তব্য সম্পর্কে তারা নিজেদের অভিমত ব্যক্ত করেছিল।

সৈয়দ সাহাবুদ্দিনের ক্ষেত্রে এক ধরনের অবস্থান নিচ্ছেন সেই সময়ের শীর্ষ বিজেপি নেতা লালকৃষ্ণ আডবানী। আবার সাহাবুদ্দিন যে সুরে কথা বলেছিলেন, তারই কার্যত পুনরুক্তি করছেন ২০২৪ সালে এসে সরসঙ্ঘচালক মোহন ভাগবত। কিন্তু বিজেপির শীর্ষস্তরের নেতাদের ভাগবতের বক্তব্য সম্বন্ধে কোনও প্রতিক্রিয়া নেই। বামপন্থিরা, কংগ্রেস বা অন্যান্য বিরোধী দল ভাগবতের বক্তব্যের তীব্র নিন্দা জানালেও বিজেপি নিশ্চুপ। এটাই হল বিজেপির মূল্যবোধের ফাঁকা আওয়াজের একটা প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

বিজেপি যে ভারতীয় সংস্কৃতির কথা বলে। সেই সংস্কৃতিতে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন বা স্বাধীনতা সংগ্রামীদের আত্মত্যাগের এতটুকু ভূমিকা নেই। গোটা হিন্দুত্ববাদী শিবির যেহেতু ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেনি, বরঞ্চ কিভাবে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ, তাদের শাসন তথা শোষণ যন্ত্রটিকে আরো পোক্ত করতে পারে, তার জন্য জাতীয় আন্দোলনের সময়, হিন্দু সম্প্রদায়িক শক্তি, মৌলবাদী শক্তি-মুসলিম সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী শক্তির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ব্রিটিশকে সহযোগিতা করে গেছে। ভারতীয় সংস্কৃতির নামে আরএসএস বিশ্বাস করে বিভাজনের সংস্কৃতিকে। ভারতের বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্যের যে প্রবহমান সংস্কৃতি হাজার হাজার বছর ধরে চলে আসছে, তাতে বিশ্বাসী নয় হিন্দুত্ববাদীরা। হিন্দু মুসলমানের সম্প্রীতির প্রশ্নেই শুধু নয়। প্রাতিষ্ঠানিক হিন্দু ধর্মের মধ্যে যে ধারা উপধারা গুলি আছে, বিশেষ করে গৌণ ধর্মের নানা শাখা-প্রশাখাকে যেভাবে পরবর্তীকালে প্রাতিষ্ঠানিক হিন্দু ধর্মে স্বীকৃতি জানানো হয়েছে, আরএসএস- বিজেপির রাজনৈতিক হিন্দু মানসিকতা কখনো তাকে সমর্থন করে না।

মুসলিম বা বৌদ্ধ সংস্কৃতির সংমিশ্রণে হিন্দু ধর্মের লোকায়তধারার যে বিভিন্ন পর্যায়ে দীর্ঘকাল ধরে বিশ্বাসী মানুষের মধ্যে একটা জায়গা করে নিয়েছে, রাজনৈতিক হিন্দুরা তাকে কখনো স্বীকার করে না। প্রবহমান ভারতের প্রায় প্রতিটি জনপদেই দেখতে পাওয়া যায় মিশ্র সংস্কৃতির কোন না কোন ঐতিহ্য সাধারণ মানুষের লোকবিশ্বাস এবং দৈনন্দিন জীবনযাপনের সঙ্গে একাত্ম হয়ে আছে। এক অদ্ভুত মরমীয়া স্রোত সেখানে প্রবাহিত হচ্ছে। এই স্রোতকে ধ্বংস করে দেওয়াই যে হিন্দুত্ববাদীদের লক্ষ্য, সেই উদ্দেশ্যেই তারা আমাদের দেশের স্বাধীনতা দিবসকে স্বীকার করতে চায় না, প্রজাতন্ত্র দিবসকে স্বীকার করতে চায় না, ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানকে স্বীকার করতে চায় না, ভারতীয় সংস্কৃতির বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যকে স্বীকার করতে চায় নাÑ এগুলো হলো তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ।

হিন্দুত্ববাদীরা তাদের রাজনৈতিক ভাবনা থেকে হিন্দু জাতীয়তাবাদকে কিভাবে উপস্থাপিত করবে তা উপলব্ধি করেই ভারতীয় সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতার বিষয়টিকে আম্বেদকর, নেহরু প্রমুখরা বিশেষ রকমের গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। ভারত রাষ্ট্রের মূল চরিত্র যে ধর্মনিরপেক্ষ, এই উপস্থাপনা প্রতিষ্ঠিত করবার ক্ষেত্রে হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের যে কর্মকা- গোটা জাতীয় আন্দোলনের সময় ছিল, তার প্রেক্ষিত সংবিধান প্রণেতা গণের একটা বড় অংশের বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছিল। তাই তারা আগামী দিনের ভারতে হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা বড় বিপদের কারণ যাতে না হয়ে উঠতে পারে, তার জন্যই ভারতীয় সংবিধানের অন্যতম প্রধান স্তম্ভ হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষ থেকে মর্যাদা দিয়েছিলেন।

মোহন ভাগবত আজ স্বাধীনতা দিবস বদলের যে রাজনৈতিক আহ্বান জানিয়েছেন, তার ভিত্তিতে রয়েছে সাভারকার এবং গোটা আরএসএসীয় হিন্দুত্বের, ভারতকে পূণ্যভূমি হিসেবে দেখা রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ। তাদের সেই পূর্ণভূমিতে মুসলমান এবং খ্রিস্টানের কোন ভূমিকাই তারা স্বীকার করে না হিন্দুত্ববাদীরা। ভারতকে ‘পুন্যভূমি’ বলতে অভ্যস্ত রাজনৈতিক হিন্দুরা। তাদের সেই পুণ্যভূমিতে মুসলমান এবং খ্রিস্টানদের কোন স্থান নেই।

দেশভাগে হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তির যে ভূমিকা, তার থেকে মানুষের দৃষ্টিকে আরো ঘুরিয়ে দেওয়ার লক্ষ্যেই একটা রাজনৈতিক কার্যক্রম হিসেবেই মোহন ভাগবত, স্বাধীনতা দিবস ঘিরে এই ধরনের কথা বলেছেন। আরএসএসের একদা রাজনৈতিক সংগঠন হিন্দু মহাসভা চিরদিনই দেশভাগের জন্য গান্ধীজি ও প-িত নেহরুকে দায়ী করে থাকে। নিজেদের ভূমিকা কে ভুলিয়ে দিতে ১৯৬৯ সালে ভারতীয় জনসঙ্ঘের প্রথম রাজনৈতিক ইতিকথা লিখেছিলেন করিগ বাক্সটার। সেখানে তিনি লিখছেন ’৪৭ সালের ১৫ আগস্ট যখন স্বাধীনতা এলো, আদেশের সেই ভোরকে মনে করলো, ভারতমাতার হৃদয়ে যেন একটা চরম আঘাত করা হলো। ১৯৫৬ সালে আরএসএসের তৎকালীন প্রধান এম এস গোলওয়ালকার প্রকাশ্যে বলেছিলেন; অখন্ড ভারত তাদের লক্ষ্য। ১৯৬৫ সালে ১৭ আগস্ট ভারতীয় জনসঙ্ঘের দলীয় সিদ্ধান্তে বলা হয়; মুসলমানদের আমাদের জাতীয় জীবনের অংশ হতে হবে। অখন্ড ভারত হল একটা বাস্তবতা। এই বাস্তবতাকে প্রতিষ্ঠিত করবার জন্য ভারত এবং পাকিস্তানকে যুক্ত করতে হবে। সেই অখন্ড ভারতের মধ্যে দিয়েই মুসলমানদের পৃথক রাজনীতি বন্ধ হওয়া সম্ভব।

ভুলে গেলে চলবে না, আজকের প্রধানমন্ত্রী, নরেন্দ্র মোদি, গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন ২০১২ সালে, শাহিদ সিদ্দিকী নামক এক উর্দু সাংবাদিকের কাছে দেওয়ার সাক্ষাৎকারে সেই একই অখন্ড ভারতের কথা বলেছিলেন (ঐ, পৃষ্ঠা-৪২)। আজকের বাংলাদেশের পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতির নিরিখে গোটা ভারতীয় উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িক শক্তি, মৌলবাদী শক্তিকে আরো বলবান করে, আরএসএস, তাদের যে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম বিরোধী, স্বাধীনতা আন্দোলনের বীর যোদ্ধাদের আত্মত্যাগের বিরোধী রাজনীতি করে, তাকেই নতুন করে উপস্থাপিত করতে চায়। ভারতীয় উপমহাদেশজুড়ে একটা অশান্তির বাতাবরণ তৈরি করতেই ভারতের স্বাধীনতা দিবস ঘিরে নতুন করে বিতর্কের সূচনা করেছেন মোহন ভাগবত।

[লেখক : ভারতীয় ইতিহাসবিদ]

back to top