আনোয়ারুল হক
এক নতুন পরিস্থিতিতে ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালিত হলো। একদিকে তারুণ্যের জাগরণে স্বৈরাচারমুক্ত এক নতুন পরিবেশ অন্যদিকে এবারের গণসংগ্রামের এক ‘বাই প্রোডাক্ট’ ধর্মীয় মৌলবাদী শক্তির আস্ফালন এবং ‘মব জাস্টিস’। তারুণ্যের শক্তির পাশাপাশি দেশবাসীও স্বপ্ন দেখেছিল বিজয়ী অভ্যুত্থান ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠা করবে এবং নির্বাচনে বিজয়ীরাসহ রাজনৈতিক শক্তিসমূহ অভ্যুত্থানের আকাক্সক্ষাকে সম্মান করে বহুত্ববাদ ও অসাম্প্রদায়িকতার ওপর ভিত্তি করে নতুন উদ্যমে দেশ পুনর্গঠনের কাজে নামবে। বৈষম্য অবসানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রব্যবস্থা ও সমাজ কাঠামোর পরিবর্তনে অগ্রসর হবে। এবারের গণসংগ্রামের মধ্য দিয়ে নতুন প্রজন্মসহ দেশবাসীর মধ্যে এমন আকাক্সক্ষাও সৃষ্টি হয় যে, দেশে এক ব্যক্তি ও পারিবারিক কেন্দ্রিকতার বদলে রাজনৈতিক দলসমূহে আরো গণতন্ত্রায়ন হবে এবং লুটেরা রাজনৈতিক সংস্কৃতির বদল হবে।
কিন্তু শুরুতেই ধর্মীয় মৌলবাদী শক্তি এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী গোষ্ঠীসমূহের বিভাজন তৎপরতা এবং মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত সকল স্থান ও স্থাপনায় হামলা, ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ, ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু নির্যাতন, মন্দির মাজারে আক্রমণ ইত্যাদি ঘটনায় দেশবাসীর একটা বড় অংশ নিজেদের গুটিয়ে নেয়। দেশে নানা তরিকার মৌলবাদী শক্তি নানা কিসিমের বয়ান নিয়ে তৎপর রয়েছে। তবে সংগঠন শক্তি এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর সহযোগি শক্তি হিসাবে নৃশংস ভূমিকা রাখায় দেশের মানুষের কাছে বেশি পরিচিত জামায়াতে ইসলামী এবং তাদের বক্তব্যকেও মানুষ অধিকতর গুরুত্ব দেয়। জনসাধারণের একটি অংশ এবং খুব সম্ভবত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারও ভেবেছিলেন জামায়াত যুদ্ধাপরাধের ঐতিহাসিক দায়ভার আর ফ্যাসিবাদী প্রবণতার রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসবে; তা কিন্তু ঘটেনি।
বরং তারা বলছেন ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরোধিতা করে সঠিক কাজটি করেছেন। যুক্তি হিসেবে তারা ভারতবর্ষের বর্তমান শাসকদের এবং ভারতে আশ্রয় নিয়ে পতিত সরকারের প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশের জনগণের আকাক্সক্ষাবিরোধী বক্তব্যকে তুলে ধরছেন; কিন্তু এটা কে না বুঝে আজকের হিন্দুত্ববাদী মোদির ভারতবর্ষ আর ১৯৭১ সালের ইন্দিরা গান্ধীর ভারতবর্ষ এক ভারতবর্ষ নয়। আর ভারতবর্ষ নিয়ে ভেবে কি হবে? ভারত নয় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীই তো বাংলাদেশের মানুষের ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছিল এবং ইতিহাসের এক বর্বর গণহত্যা সংঘটিত করেছিল।
মুক্তিযুদ্ধের সময়ে জামায়াতে ইসলামী পূর্ব পাকিস্তান মন্ত্রিসভায় চারজন মন্ত্রী নিয়ে সরকারে থেকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সেই বর্বর গণহত্যার সহযোগী ছিল। আলবদর, আলশামস ও রাজাকার বাহিনী গঠন করে গণহত্যা, বুদ্ধিজীবী হত্যা, নারী নির্যাতন কোনটায় তারা অংশ নেয় নি? আর এখনও নির্লজ্জের মতো বলছে তাদের ভূমিকা সঠিকই ছিল। তবে যদি কোন ভুল হয়ে থাকে তার দায় তাদের প্রাক্তন নেতৃত্বের। দল হিসাবে যদি দায় না থেকে থাকে তবে সেই প্রাক্তন নেতাদের ব্যক্তিগত উদ্যোগে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে দলগত বক্তব্য দিচ্ছেন কেন?
প্রতি বছর একুশে ফেব্রুয়ারি এলেই জামায়াত নেতারা বয়ান শুরু করেন তাদের নেতা গোলাম আযমের নাকি ভাষা সংগ্রামে বিশাল ভূমিকা ছিল। এ বছরেও সেই একই বয়ান দিয়ে তারা প্রশ্ন তুলেছেন গোলাম আযমকে কেন একুশে পদক দেয়া হয় না! যতদূর জানা যায়, ভাষা আন্দোলনের সময়ে একটি অনুষ্ঠানে মানপত্র পড়া ছাড়া সভা সমাবেশ ১৪৪ ধারা ভঙ্গ- এ ধরনের কোনো কর্মসূচিতে তাকে দেখা যায়নি। আর মজার ব্যাপার হচ্ছে শুধুমাত্র মানপত্র পড়ার ভূমিকাটুকুর জন্যও তিনি ক্ষমা চেয়েছেন।
১৯৭০ সালের ১৮ জুন পশ্চিম পাকিস্তানের শকুর শহরে এক সভায় তিনি বলেছিলেন, ‘উর্দু পাক ভারত উপমহাদেশের মুসলিমদের সাধারণ ভাষা। মুসলমানদের তমুদ্দীন ও ধর্মীয় জ্ঞানের ভা-ার উর্দু ভাষায় সংরক্ষিত রহিয়াছে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দৃষ্টিকোণ হইতে ভাষা আন্দোলনে যুক্ত হওয়া সঠিক হয় নাই।’ পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের মাতৃভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবীতে গড়ে ওঠা বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতি সত্তার স্ফুরন। বাঙালির আত্ম-অম্বেষায় যে ভাষাচেতনার উন্মেষ ঘটে, পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী তা অবদমন করতে যেয়ে আমাদের অগ্রসর করে নিয়ে যায় স্বাধিকার, স্বায়ত্তশাসন এবং স্বাধীনতায়। তাই মরহুম গোলাম আযম ভাষা সংগ্রামকে সমর্থন করে যদি ভুল করে থাকেন তবে অবশ্যই বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রামের বিরোধিতা করে এবং পাক হানাদার বাহিনীর তাবেদারি করে ‘সঠিক কাজটি’ করেছেন! বর্তমান জামায়াত নেতৃত্বও ১৯৭১ সালের সেই দিনগুলোতে তাদের নেতৃবৃন্দের ও দলের অপরাধের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা এমনকি দুঃখপ্রকাশ না করে বরং নানা কৌশলে যুদ্ধাপরাধ থেকে দায়মুক্তি চাইছে। এ দাবিতে কখনো স্বেচ্ছায় কারাবরণ, কখনো প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন ঘেরাওয়ের হুমকি দেয়া হচ্ছে। জামায়াতে ইসলামের এ ভূমিকা শুধুমাত্র বহুত্ববাদ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক এক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পুনঃনির্মানের পথে অন্তরায় সৃষ্টি করছে।
জামায়াতে ইসলামীর বর্তমান আমির খুব হিসাব করে কথা বলেন বা বক্তব্য দেন। অনেক বক্তব্য আপাত নিরীহ বলে মনে হলেও তার মধ্যে গভীর প্যাঁচ থাকে। যেমন তিনি বলে থাকেন ‘জামায়াত ক্ষমতায় আসলে সকল নারীদের জন্য ‘পর্দা প্রথা’ বাধ্যতামূলক করা হবে না। কেননা দেশে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীরাও বসবাস করেন। তাদের ওপর তো এটা চাপিয়ে দেওয়া যায় না।’ এর অর্থ দাঁড়ায় ভিন্ন ধর্মের নারী ছাড়া মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের জন্য বাধ্যতামূলক হবে। একইভাবে তিনি বলেছেন ‘সকলেই স্বাধীনভাবে যার যার ধর্ম পালন করবেন। তবে ভিন্ন ধর্মের কেউ যদি দ্বীনের সঙ্গে আসতে চান, আমরা স্বাগত জানাবো!’ ১৯৭১ সালের দখলদার পাক বাহিনীর গণহত্যা, সংখ্যালঘু হত্যা, ধর্মান্তরিত করা এবং ধর্ষণÑনির্যাতনের সহযোগী রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে প্রকাশ্যে যখন এ ধরনের বক্তব্য রাখা হয় এবং সরকার বা সমন্বয়কদের একাংশকে তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল মনে হয় তখন জনগোষ্ঠীর বড় অংশ বিশেষত নারী এবং জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের মধ্যে এক ধরনের অনিশ্চয়তা ও অসহায়ত্বের সৃষ্টি হয়। তাদের মনে প্রশ্ন জাগে বিভাজনের বাংলাদেশকে পেছনে রেখে অন্তর্ভুক্তিমূলক অসাম্প্রদায়িক এক সমাজের যে স্বপ্ন জুলাই অভ্যুত্থানের সময় আমাদের নতুন প্রজন্ম একেছিলো দেয়ালে দেয়ালে, সেøাগানে সেøাগানে, গানের সুরে সুরে তারা কি হারিয়ে গেছে?
অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গড়ার নামে জামায়াত বা ধর্মান্ধ যে কোনো গোষ্ঠী সমাজ ও রাজনীতির মূল স্রোতধারায় আসতে চাইলে তাদেরও পরিবর্তিত হতে হবে। তারা নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন প্যান্ট, টি-শার্ট পরিহিত হাজার হাজার ছাত্রী এবারের আন্দোলনে সামনের কাতারে থেকে অংশগ্রহণ করেছেন। আবার তাদের সঙ্গে শত শত হিজাব পরিহিত ছাত্রীও ছিলেন। কে কী পোশাক পরবেন, কে কী খাবেন, কে কোন ধর্ম পালন করবেন, কে কাকে বিয়ে করবেন, কে শহীদের কবরে ফুল দেবেন, নীরবতা পালন করবেন আর কে মোনাজাত করবেনÑ এসব যার যার ব্যক্তিগত বিশ্বাস ও পছন্দের বিষয়। এটাকে মেনে নিতে পারলেই বহুত্ববাদ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব। ভাষা আন্দোলনে অংশ নেওয়া কে ভুল এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরোধিতা করে পাক হানাদার বাহিনীকে সহযোগিতা করা সঠিক মনে করলে কি রাজনীতির মূলস্রোতে বেশি দিন থাকা যাবে?
[লেখক : সাবেক সভাপতি, ছাত্র ইউনিয়ন]
আনোয়ারুল হক
শনিবার, ০১ মার্চ ২০২৫
এক নতুন পরিস্থিতিতে ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালিত হলো। একদিকে তারুণ্যের জাগরণে স্বৈরাচারমুক্ত এক নতুন পরিবেশ অন্যদিকে এবারের গণসংগ্রামের এক ‘বাই প্রোডাক্ট’ ধর্মীয় মৌলবাদী শক্তির আস্ফালন এবং ‘মব জাস্টিস’। তারুণ্যের শক্তির পাশাপাশি দেশবাসীও স্বপ্ন দেখেছিল বিজয়ী অভ্যুত্থান ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠা করবে এবং নির্বাচনে বিজয়ীরাসহ রাজনৈতিক শক্তিসমূহ অভ্যুত্থানের আকাক্সক্ষাকে সম্মান করে বহুত্ববাদ ও অসাম্প্রদায়িকতার ওপর ভিত্তি করে নতুন উদ্যমে দেশ পুনর্গঠনের কাজে নামবে। বৈষম্য অবসানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রব্যবস্থা ও সমাজ কাঠামোর পরিবর্তনে অগ্রসর হবে। এবারের গণসংগ্রামের মধ্য দিয়ে নতুন প্রজন্মসহ দেশবাসীর মধ্যে এমন আকাক্সক্ষাও সৃষ্টি হয় যে, দেশে এক ব্যক্তি ও পারিবারিক কেন্দ্রিকতার বদলে রাজনৈতিক দলসমূহে আরো গণতন্ত্রায়ন হবে এবং লুটেরা রাজনৈতিক সংস্কৃতির বদল হবে।
কিন্তু শুরুতেই ধর্মীয় মৌলবাদী শক্তি এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী গোষ্ঠীসমূহের বিভাজন তৎপরতা এবং মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত সকল স্থান ও স্থাপনায় হামলা, ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ, ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু নির্যাতন, মন্দির মাজারে আক্রমণ ইত্যাদি ঘটনায় দেশবাসীর একটা বড় অংশ নিজেদের গুটিয়ে নেয়। দেশে নানা তরিকার মৌলবাদী শক্তি নানা কিসিমের বয়ান নিয়ে তৎপর রয়েছে। তবে সংগঠন শক্তি এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর সহযোগি শক্তি হিসাবে নৃশংস ভূমিকা রাখায় দেশের মানুষের কাছে বেশি পরিচিত জামায়াতে ইসলামী এবং তাদের বক্তব্যকেও মানুষ অধিকতর গুরুত্ব দেয়। জনসাধারণের একটি অংশ এবং খুব সম্ভবত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারও ভেবেছিলেন জামায়াত যুদ্ধাপরাধের ঐতিহাসিক দায়ভার আর ফ্যাসিবাদী প্রবণতার রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসবে; তা কিন্তু ঘটেনি।
বরং তারা বলছেন ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরোধিতা করে সঠিক কাজটি করেছেন। যুক্তি হিসেবে তারা ভারতবর্ষের বর্তমান শাসকদের এবং ভারতে আশ্রয় নিয়ে পতিত সরকারের প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশের জনগণের আকাক্সক্ষাবিরোধী বক্তব্যকে তুলে ধরছেন; কিন্তু এটা কে না বুঝে আজকের হিন্দুত্ববাদী মোদির ভারতবর্ষ আর ১৯৭১ সালের ইন্দিরা গান্ধীর ভারতবর্ষ এক ভারতবর্ষ নয়। আর ভারতবর্ষ নিয়ে ভেবে কি হবে? ভারত নয় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীই তো বাংলাদেশের মানুষের ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছিল এবং ইতিহাসের এক বর্বর গণহত্যা সংঘটিত করেছিল।
মুক্তিযুদ্ধের সময়ে জামায়াতে ইসলামী পূর্ব পাকিস্তান মন্ত্রিসভায় চারজন মন্ত্রী নিয়ে সরকারে থেকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সেই বর্বর গণহত্যার সহযোগী ছিল। আলবদর, আলশামস ও রাজাকার বাহিনী গঠন করে গণহত্যা, বুদ্ধিজীবী হত্যা, নারী নির্যাতন কোনটায় তারা অংশ নেয় নি? আর এখনও নির্লজ্জের মতো বলছে তাদের ভূমিকা সঠিকই ছিল। তবে যদি কোন ভুল হয়ে থাকে তার দায় তাদের প্রাক্তন নেতৃত্বের। দল হিসাবে যদি দায় না থেকে থাকে তবে সেই প্রাক্তন নেতাদের ব্যক্তিগত উদ্যোগে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে দলগত বক্তব্য দিচ্ছেন কেন?
প্রতি বছর একুশে ফেব্রুয়ারি এলেই জামায়াত নেতারা বয়ান শুরু করেন তাদের নেতা গোলাম আযমের নাকি ভাষা সংগ্রামে বিশাল ভূমিকা ছিল। এ বছরেও সেই একই বয়ান দিয়ে তারা প্রশ্ন তুলেছেন গোলাম আযমকে কেন একুশে পদক দেয়া হয় না! যতদূর জানা যায়, ভাষা আন্দোলনের সময়ে একটি অনুষ্ঠানে মানপত্র পড়া ছাড়া সভা সমাবেশ ১৪৪ ধারা ভঙ্গ- এ ধরনের কোনো কর্মসূচিতে তাকে দেখা যায়নি। আর মজার ব্যাপার হচ্ছে শুধুমাত্র মানপত্র পড়ার ভূমিকাটুকুর জন্যও তিনি ক্ষমা চেয়েছেন।
১৯৭০ সালের ১৮ জুন পশ্চিম পাকিস্তানের শকুর শহরে এক সভায় তিনি বলেছিলেন, ‘উর্দু পাক ভারত উপমহাদেশের মুসলিমদের সাধারণ ভাষা। মুসলমানদের তমুদ্দীন ও ধর্মীয় জ্ঞানের ভা-ার উর্দু ভাষায় সংরক্ষিত রহিয়াছে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দৃষ্টিকোণ হইতে ভাষা আন্দোলনে যুক্ত হওয়া সঠিক হয় নাই।’ পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের মাতৃভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবীতে গড়ে ওঠা বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতি সত্তার স্ফুরন। বাঙালির আত্ম-অম্বেষায় যে ভাষাচেতনার উন্মেষ ঘটে, পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী তা অবদমন করতে যেয়ে আমাদের অগ্রসর করে নিয়ে যায় স্বাধিকার, স্বায়ত্তশাসন এবং স্বাধীনতায়। তাই মরহুম গোলাম আযম ভাষা সংগ্রামকে সমর্থন করে যদি ভুল করে থাকেন তবে অবশ্যই বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রামের বিরোধিতা করে এবং পাক হানাদার বাহিনীর তাবেদারি করে ‘সঠিক কাজটি’ করেছেন! বর্তমান জামায়াত নেতৃত্বও ১৯৭১ সালের সেই দিনগুলোতে তাদের নেতৃবৃন্দের ও দলের অপরাধের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা এমনকি দুঃখপ্রকাশ না করে বরং নানা কৌশলে যুদ্ধাপরাধ থেকে দায়মুক্তি চাইছে। এ দাবিতে কখনো স্বেচ্ছায় কারাবরণ, কখনো প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন ঘেরাওয়ের হুমকি দেয়া হচ্ছে। জামায়াতে ইসলামের এ ভূমিকা শুধুমাত্র বহুত্ববাদ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক এক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পুনঃনির্মানের পথে অন্তরায় সৃষ্টি করছে।
জামায়াতে ইসলামীর বর্তমান আমির খুব হিসাব করে কথা বলেন বা বক্তব্য দেন। অনেক বক্তব্য আপাত নিরীহ বলে মনে হলেও তার মধ্যে গভীর প্যাঁচ থাকে। যেমন তিনি বলে থাকেন ‘জামায়াত ক্ষমতায় আসলে সকল নারীদের জন্য ‘পর্দা প্রথা’ বাধ্যতামূলক করা হবে না। কেননা দেশে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীরাও বসবাস করেন। তাদের ওপর তো এটা চাপিয়ে দেওয়া যায় না।’ এর অর্থ দাঁড়ায় ভিন্ন ধর্মের নারী ছাড়া মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের জন্য বাধ্যতামূলক হবে। একইভাবে তিনি বলেছেন ‘সকলেই স্বাধীনভাবে যার যার ধর্ম পালন করবেন। তবে ভিন্ন ধর্মের কেউ যদি দ্বীনের সঙ্গে আসতে চান, আমরা স্বাগত জানাবো!’ ১৯৭১ সালের দখলদার পাক বাহিনীর গণহত্যা, সংখ্যালঘু হত্যা, ধর্মান্তরিত করা এবং ধর্ষণÑনির্যাতনের সহযোগী রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে প্রকাশ্যে যখন এ ধরনের বক্তব্য রাখা হয় এবং সরকার বা সমন্বয়কদের একাংশকে তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল মনে হয় তখন জনগোষ্ঠীর বড় অংশ বিশেষত নারী এবং জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের মধ্যে এক ধরনের অনিশ্চয়তা ও অসহায়ত্বের সৃষ্টি হয়। তাদের মনে প্রশ্ন জাগে বিভাজনের বাংলাদেশকে পেছনে রেখে অন্তর্ভুক্তিমূলক অসাম্প্রদায়িক এক সমাজের যে স্বপ্ন জুলাই অভ্যুত্থানের সময় আমাদের নতুন প্রজন্ম একেছিলো দেয়ালে দেয়ালে, সেøাগানে সেøাগানে, গানের সুরে সুরে তারা কি হারিয়ে গেছে?
অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গড়ার নামে জামায়াত বা ধর্মান্ধ যে কোনো গোষ্ঠী সমাজ ও রাজনীতির মূল স্রোতধারায় আসতে চাইলে তাদেরও পরিবর্তিত হতে হবে। তারা নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন প্যান্ট, টি-শার্ট পরিহিত হাজার হাজার ছাত্রী এবারের আন্দোলনে সামনের কাতারে থেকে অংশগ্রহণ করেছেন। আবার তাদের সঙ্গে শত শত হিজাব পরিহিত ছাত্রীও ছিলেন। কে কী পোশাক পরবেন, কে কী খাবেন, কে কোন ধর্ম পালন করবেন, কে কাকে বিয়ে করবেন, কে শহীদের কবরে ফুল দেবেন, নীরবতা পালন করবেন আর কে মোনাজাত করবেনÑ এসব যার যার ব্যক্তিগত বিশ্বাস ও পছন্দের বিষয়। এটাকে মেনে নিতে পারলেই বহুত্ববাদ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব। ভাষা আন্দোলনে অংশ নেওয়া কে ভুল এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরোধিতা করে পাক হানাদার বাহিনীকে সহযোগিতা করা সঠিক মনে করলে কি রাজনীতির মূলস্রোতে বেশি দিন থাকা যাবে?
[লেখক : সাবেক সভাপতি, ছাত্র ইউনিয়ন]