গৌতম রায়
নির্বাচনী রাজনীতিতে দীর্ঘদিন পশ্চিমবঙ্গে সিপিআই (এম) কার্যত কোনো ফলাফলের সাফল্য দেখাতে পারছে না। কেন পারছে না, এই প্রশ্ন যদি তোলা হয়, তার উত্তরে দুটি কথা প্রথমে বলতে হয়।
একটি হলোÑ পশ্চিমবঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষমতায় আসবার পরে এখানকার নাগরিকদের স্বাধীনভাবে ভোট দেওয়ার ক্ষমতায় কার্যত নেই। ভোটের আগে সাধারণ নাগরিকদের শাসকদলের পক্ষ থেকে পুলিশ- প্রশাসন ইত্যাদি দিয়ে ভয় দেখানো হয়। আর ভোটের দিন ভোট কেন্দ্র থেকে, ইভিএম মেশিন-শাসন দলের ‘দুষ্টু ছেলেদের’ করায়ত্ব হয়ে যায়। ফলে সাধারণ মানুষ, এমনকি শাসকদলেরও গোঁড়া সমর্থকও নির্ভয়ে ভোট দিতে পারেন না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তারা ভোট কেন্দ্রমুখী ও হন না। অথচ তাদের ভোটটা পড়ে যায়।
আর দ্বিতীয় বিষয় হলোÑ প্রধান বিরোধী দল সিপিআইর (এম) মধ্যে একটা অংশের মানুষ আছেন যারা, গত ১২-১৩ বছর ধরেও বামপন্থি দলে অবস্থান করেন। সভা সমিতিতে ভিড় করেন। নিজেদের আগ মার্কা বামপন্থি হিসেবে দেখানো সত্ত্বেও, ভোট দেবার ক্ষেত্রে কতটা বামপন্থি শিবিরে আস্থা রাখেন, সেটি গভীর সন্দেহের বিষয়। বহু ক্ষেত্রে দলের বিভিন্ন কমিটিতে তাদের অবস্থান থাকা সত্ত্বেও নানা ধরনের স্থানীয় অংকের নিরিখে একটা বড় অংশের লোক, শাসক শিবিরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সংযোগ রাখেন। দলের গোপন কথাবার্তা শাসক শিবির, পুলিশ আর সংবাদ মাধ্যমের কাছে বের করে দেন। যেভাবে দলটির জেলা এবং রাজ্যস্তরের সম্পাদকমন্ডলীতে আলোচিত বিষয়, বিশেষ বিশেষ সংবাদ মাধ্যম জেনে যায়, তা থেকে খুব স্পষ্টভাবেই বলতে হয় যে, ঘরের শত্রু বিভীষণ ছাড়া এসব খবর সংবাদমাধ্যমের পক্ষে শতবার মাথাকুটেও সংগ্রহ করা সম্ভব নয়।
তবে শেষপর্যন্ত কিন্তু ছবিটা হতাশাজনক নয়। একজন দুজন লোক দলের খবর শত্রু শিবিরে চালান করছে বলেই, গোটা সিপিআই (এম) দলের সর্বস্তরের কর্মী-সমর্থকেরা ওই অবস্থায় পৌঁছে গেছেন- এমনটা মনে করবার কোন কারণ নেই। কিছু লোক, দলের সভা সমিতিতে ভিড় করছেন, এমনকি নির্বাচনী সংগ্রামেও রীতিমতো অংশগ্রহণ করছেন। কিন্তু শেষপর্যন্ত ভোটটা শত্রু শিবিরকে দিচ্ছেন। তার মানে এই নয় যে, সিপিআই (এম) দলের প্রত্যেকটি সদস্য, কর্মী, সমর্থকÑ তারাই ভাবে দলের সঙ্গে গাদ্দারি করছেন। এখনো লক্ষ লক্ষ মানুষ এই দলের সাধারণ সমর্থক আছেন, যারা জান কবুল লড়াই করছেন দলটির জন্য।
সিপিআই (এম) দলটি দীর্ঘদিন পশ্চিমবঙ্গ থেকে লোকসভায় বা রাজ্য বিধানসভায় কোনো সদস্য পাঠাতে পারেনি। তার মানে এই নয় যে, এই রাজনৈতিক দলটির রাজনৈতিক গ্রহণযোগ্যতা সাধারণ মানুষের কাছে কমে গেছে। কারণ কেন্দ্রের শাসক বিজেপি বা রাজ্যের শাসক তৃণমূল কংগ্রেস, তারা পরস্পর পরস্পরকে শত্রু বলে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা করেন; কিন্তু এই দুটি রাজনৈতিক দলই তাদের প্রকৃত রাজনৈতিক শত্রু হিসেবে মানে সিপিআই (এম) কেই।
মমতা ক্ষমতায় এসে ‘সিপিআইকে (এম) দূরবীন দিয়েও দেখা যায় না’- এরকম একটি মন্তব্য করেছিলেন। কিন্তু তিনি তার প্রশাসনিক কাজকর্ম বা রাজনৈতিক কাজকর্ম- সবকিছুকেই পরিচালিত করেন, যাতে সিপিআই (এম)। আবার শাসন ক্ষমতায় ফিরে না আসতে পারে। সিপিআই (এম) দলের নেতাকর্মী, সমর্থকদের নানা ধরনের মিথ্যা মামলা দিয়ে, পুলিশি হেনস্তার মধ্য দিয়ে, দলের সর্বস্তরের মানুষজনদের নৈতিক মূল্যবোধ, সাহস, সমস্ত কিছু ভেঙে দেওয়ার বহু চেষ্টা করেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তার দীর্ঘ ১৩ বছরের শাসনকালে, আজ পর্যন্ত সামগ্রিকভাবে সিপিআই (এম) দলটির মধ্যে কোনও ভাঙ্গন ধরাতে পারেননি।
মমতাকে এ কাজটি করবার জন্য আড়কাঠি হিসেবে ব্যবহার করে বিজেপি। নানাভাবে ধর্মভিত্তিক-জাতপাতভিত্তিক-ভাষাভিত্তিক, লিঙ্গভিত্তিক বিভাজনের অক্ষরেখা তৈরি করে, পশ্চিমবঙ্গে এমন একটা অবস্থা মমতার সাহায্যে তৈরি করেন, যাতে সিপিআইর (এম) তাদের রাজনৈতিক সংগ্রামের জায়গায় এলোমেলো হয়ে পড়ে।
সিপিআইর (এম) ২৭তম রাজ্য সম্মেলন শেষ হলো। স্বাভাবিকভাবেই বিদায়ী রাজ্য সম্পাদক মোহাম্মদ সেলিম পুনর্নির্বাচিত হয়েছেন। গত ২৬তম রাজ্য সম্মেলন থেকে ২৭তম রাজ্যে সম্মেলনে উপনীত হওয়া- এই সময়কালটা সিপিআই (এম) দলের পক্ষে আদৌ কুসুমাকীর্ণ ছিল না। ২৬তম রাজ্য সম্মেলনের আগে এক ধরনের সংবাদমাধ্যম, এক ভিন্ন ব্যক্তিকে প্রায় দলের রাজ্য সম্পাদক করেই দিয়েছিল। সমস্ত হিসেব-নিকেশ কে উল্টে দিয়ে সেলিম যখন সর্বসম্মত ভাবে তিন বছর আগে তার দলের রাজ্য সম্পাদকের পদে অভিষিক্ত হন, তখনই বুঝতে পারে গিয়েছিল, দলকে সময়োপযোগী করবার ক্ষেত্রে সেলিমের ভূমিকা বিশেষ রকমের ইঙ্গিত বাহি হবে।
তত্ত্ব সর্বস্বতা থেকে দলকে বাস্তবের মাটিতে দাঁড় করানোর ক্ষেত্রে সেলিমের ভূমিকা ঐতিহাসিক। যে বাস্তবতা জ্যোতি বসুর ছিল এবং সেই বাস্তবতার ওপর ভিত্তি করেই একটানা দীর্ঘদিন কেবলমাত্র সরকার পরিচালনা নয়, দলকেও জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতির ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক করে রাখতে পেরেছিলেন কমিউনিস্টরা, সেই পরিপ্রেক্ষিতে মূল ভিত্তি ছিল বাংলা এবং দেশের মাটিকে সঠিকভাবে অনুভব করবার শক্তি। এ শক্তিটি সেলিমের মধ্যে, জ্যোতিবাবুর পর একমাত্র প্রখর আমরা দেখতে পাচ্ছি।
তাই আমরা দেখতে পাচ্ছি, সদ্য সমাপ্ত দলের ২৭তম রাজ্য সম্মেলনে হুগলি জেলার বিশিষ্ট মনীষীদের মধ্যে সমন্বয়ী সাধনার অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবও আছেন।
এটা কিন্তু সিপিআই (এম) দলের কাছে আজ থেকে তিন বছর আগেও ভাবতেই পারা যেত না। ভারতের মতো বহুভাষী, বহু ধর্ম, বহু জনগোষ্ঠীর মানুষের মধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের যে মরমিয়া সাধনার ধারা, তা যে কোনও অবস্থাতেই ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক ধরার সঙ্গে সমতুল্য নয়- এই বোধে কমিউনিস্টদের প্রতিষ্ঠিত করবার ক্ষেত্রে প্রথম উদ্যোগী ভূমিকা নিয়েছিলেন ইএমএস নম্বরদ্রিপাদ। বিবেকানন্দ সম্পর্কে তার বক্তৃতা এবং রচনা সংকলন, ভারতীয় দর্শনের সমন্বয়ী ধারার একটি আকর গ্রন্থ।
বেশ অনেকটা সময় ধরে সিপিআইর (এম) একটা অংশের লোকেদের মধ্যে, তাদেরই দলের কর্মী সমর্থকেরা, যারা প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মে বিশ্বাস করেন, কিন্তু কোনো অবস্থাতেই সাম্প্রদায়িক নন, পরধর্ম বিদ্বেষী নন- তাদের ঘিরে মশকরা করা, টিটকারি করা- এটা একটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল। অথচ অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, ওইসব টিটকারিকারি লোকেরা কোমরের ঘুনসিতে মাদুলি পড়ে থাকেন। নিজের বাড়িতে নানা ধরনের ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের সঙ্গেও যুক্ত থাকেন।
প্রচলিত হিন্দু ধর্মের যে শ্রাদ্ধানুষ্ঠান, সেটা তারা পালন করেন; কিন্তু পাছে বাইরের লোকে কিছু বলতে পারে, এই কারণে, মস্তক মুন্দন করে না। অশৌচ অবস্থায় নির্ধারিত পোশাক ব্যবহার করে না। এরাই আবার প্রকাশ্যে স্মরণসভার মধ্য দিয়ে আত্মীয়-পরিজনদের স্মরণ করে।
এই ভাবের ঘরে চুরি- এটা কিন্তু সিপিআই (এম) দলটিকে অনেক জায়গায় বাংলার প্রচলিত সামাজিক ব্যবস্থা, প্রবাহমানতা থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। এ ধরনের মানুষদের একটা বড় অংশের মধ্যে প্রবল মুসলমান বিরোধিতা রয়েছে। মুসলমানদের ক্ষেত্রে- ‘আমরা’ ‘ওরা’, ‘বাঙালি এবং মুসলমান’- এসব শব্দাবলীর ব্যবহার রয়েছে। আর আচার-আচরণ সিপিআই (এম) দলের একটা ছোট অংশের মধ্যে, বিশেষ করে যারা কোনো না কোনো সময় পূর্ববঙ্গ বা আজকের বাংলাদেশ থেকে এসেছেন, তাদের মধ্যে খুব সক্রিয়ভাবে দেখতে পাওয়া যায় এই মুসলমান বিদ্বেষ দেখা যায়।
ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িকতা এবং প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতার সঙ্গে লড়াই করবার প্রশ্নে, ভারতের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, হিন্দু মুসলমানের সৌহার্দ্য, বৈচিত্র্যপূর্ণ সমন্বয়ী সংস্কৃতি- এগুলোর চর্চা যে একান্তভাবে জরুরিÑ আজকে সেই জায়গাটি নিজের দলে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরে সেলিম শুধু তার নিজের দলের ক্ষেত্রে একটি ইতিবাচক প্রেক্ষিত তৈরি করলেন না। এই প্রচেষ্টা কে ফলপ্রসূ করে তুলতে পারলে, সামগ্রিকভাবে বাংলা তথা ভারতের বুকে ধর্মের নামে, জাত-পাতের নামে, ভাষার নামে, লিঙ্গের নামে যে রক্তের হোলি খেলাÑ তাকে প্রতিহত করবার ক্ষেত্রে। সাধারণ মানুষ একটি জোরদার হাতিয়ার নিজের হাতে তুলে নিতে পারবেন।
[লেখক : ভারতীয় ইতিহাসবিদ]
গৌতম রায়
শনিবার, ০১ মার্চ ২০২৫
নির্বাচনী রাজনীতিতে দীর্ঘদিন পশ্চিমবঙ্গে সিপিআই (এম) কার্যত কোনো ফলাফলের সাফল্য দেখাতে পারছে না। কেন পারছে না, এই প্রশ্ন যদি তোলা হয়, তার উত্তরে দুটি কথা প্রথমে বলতে হয়।
একটি হলোÑ পশ্চিমবঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষমতায় আসবার পরে এখানকার নাগরিকদের স্বাধীনভাবে ভোট দেওয়ার ক্ষমতায় কার্যত নেই। ভোটের আগে সাধারণ নাগরিকদের শাসকদলের পক্ষ থেকে পুলিশ- প্রশাসন ইত্যাদি দিয়ে ভয় দেখানো হয়। আর ভোটের দিন ভোট কেন্দ্র থেকে, ইভিএম মেশিন-শাসন দলের ‘দুষ্টু ছেলেদের’ করায়ত্ব হয়ে যায়। ফলে সাধারণ মানুষ, এমনকি শাসকদলেরও গোঁড়া সমর্থকও নির্ভয়ে ভোট দিতে পারেন না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তারা ভোট কেন্দ্রমুখী ও হন না। অথচ তাদের ভোটটা পড়ে যায়।
আর দ্বিতীয় বিষয় হলোÑ প্রধান বিরোধী দল সিপিআইর (এম) মধ্যে একটা অংশের মানুষ আছেন যারা, গত ১২-১৩ বছর ধরেও বামপন্থি দলে অবস্থান করেন। সভা সমিতিতে ভিড় করেন। নিজেদের আগ মার্কা বামপন্থি হিসেবে দেখানো সত্ত্বেও, ভোট দেবার ক্ষেত্রে কতটা বামপন্থি শিবিরে আস্থা রাখেন, সেটি গভীর সন্দেহের বিষয়। বহু ক্ষেত্রে দলের বিভিন্ন কমিটিতে তাদের অবস্থান থাকা সত্ত্বেও নানা ধরনের স্থানীয় অংকের নিরিখে একটা বড় অংশের লোক, শাসক শিবিরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সংযোগ রাখেন। দলের গোপন কথাবার্তা শাসক শিবির, পুলিশ আর সংবাদ মাধ্যমের কাছে বের করে দেন। যেভাবে দলটির জেলা এবং রাজ্যস্তরের সম্পাদকমন্ডলীতে আলোচিত বিষয়, বিশেষ বিশেষ সংবাদ মাধ্যম জেনে যায়, তা থেকে খুব স্পষ্টভাবেই বলতে হয় যে, ঘরের শত্রু বিভীষণ ছাড়া এসব খবর সংবাদমাধ্যমের পক্ষে শতবার মাথাকুটেও সংগ্রহ করা সম্ভব নয়।
তবে শেষপর্যন্ত কিন্তু ছবিটা হতাশাজনক নয়। একজন দুজন লোক দলের খবর শত্রু শিবিরে চালান করছে বলেই, গোটা সিপিআই (এম) দলের সর্বস্তরের কর্মী-সমর্থকেরা ওই অবস্থায় পৌঁছে গেছেন- এমনটা মনে করবার কোন কারণ নেই। কিছু লোক, দলের সভা সমিতিতে ভিড় করছেন, এমনকি নির্বাচনী সংগ্রামেও রীতিমতো অংশগ্রহণ করছেন। কিন্তু শেষপর্যন্ত ভোটটা শত্রু শিবিরকে দিচ্ছেন। তার মানে এই নয় যে, সিপিআই (এম) দলের প্রত্যেকটি সদস্য, কর্মী, সমর্থকÑ তারাই ভাবে দলের সঙ্গে গাদ্দারি করছেন। এখনো লক্ষ লক্ষ মানুষ এই দলের সাধারণ সমর্থক আছেন, যারা জান কবুল লড়াই করছেন দলটির জন্য।
সিপিআই (এম) দলটি দীর্ঘদিন পশ্চিমবঙ্গ থেকে লোকসভায় বা রাজ্য বিধানসভায় কোনো সদস্য পাঠাতে পারেনি। তার মানে এই নয় যে, এই রাজনৈতিক দলটির রাজনৈতিক গ্রহণযোগ্যতা সাধারণ মানুষের কাছে কমে গেছে। কারণ কেন্দ্রের শাসক বিজেপি বা রাজ্যের শাসক তৃণমূল কংগ্রেস, তারা পরস্পর পরস্পরকে শত্রু বলে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা করেন; কিন্তু এই দুটি রাজনৈতিক দলই তাদের প্রকৃত রাজনৈতিক শত্রু হিসেবে মানে সিপিআই (এম) কেই।
মমতা ক্ষমতায় এসে ‘সিপিআইকে (এম) দূরবীন দিয়েও দেখা যায় না’- এরকম একটি মন্তব্য করেছিলেন। কিন্তু তিনি তার প্রশাসনিক কাজকর্ম বা রাজনৈতিক কাজকর্ম- সবকিছুকেই পরিচালিত করেন, যাতে সিপিআই (এম)। আবার শাসন ক্ষমতায় ফিরে না আসতে পারে। সিপিআই (এম) দলের নেতাকর্মী, সমর্থকদের নানা ধরনের মিথ্যা মামলা দিয়ে, পুলিশি হেনস্তার মধ্য দিয়ে, দলের সর্বস্তরের মানুষজনদের নৈতিক মূল্যবোধ, সাহস, সমস্ত কিছু ভেঙে দেওয়ার বহু চেষ্টা করেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তার দীর্ঘ ১৩ বছরের শাসনকালে, আজ পর্যন্ত সামগ্রিকভাবে সিপিআই (এম) দলটির মধ্যে কোনও ভাঙ্গন ধরাতে পারেননি।
মমতাকে এ কাজটি করবার জন্য আড়কাঠি হিসেবে ব্যবহার করে বিজেপি। নানাভাবে ধর্মভিত্তিক-জাতপাতভিত্তিক-ভাষাভিত্তিক, লিঙ্গভিত্তিক বিভাজনের অক্ষরেখা তৈরি করে, পশ্চিমবঙ্গে এমন একটা অবস্থা মমতার সাহায্যে তৈরি করেন, যাতে সিপিআইর (এম) তাদের রাজনৈতিক সংগ্রামের জায়গায় এলোমেলো হয়ে পড়ে।
সিপিআইর (এম) ২৭তম রাজ্য সম্মেলন শেষ হলো। স্বাভাবিকভাবেই বিদায়ী রাজ্য সম্পাদক মোহাম্মদ সেলিম পুনর্নির্বাচিত হয়েছেন। গত ২৬তম রাজ্য সম্মেলন থেকে ২৭তম রাজ্যে সম্মেলনে উপনীত হওয়া- এই সময়কালটা সিপিআই (এম) দলের পক্ষে আদৌ কুসুমাকীর্ণ ছিল না। ২৬তম রাজ্য সম্মেলনের আগে এক ধরনের সংবাদমাধ্যম, এক ভিন্ন ব্যক্তিকে প্রায় দলের রাজ্য সম্পাদক করেই দিয়েছিল। সমস্ত হিসেব-নিকেশ কে উল্টে দিয়ে সেলিম যখন সর্বসম্মত ভাবে তিন বছর আগে তার দলের রাজ্য সম্পাদকের পদে অভিষিক্ত হন, তখনই বুঝতে পারে গিয়েছিল, দলকে সময়োপযোগী করবার ক্ষেত্রে সেলিমের ভূমিকা বিশেষ রকমের ইঙ্গিত বাহি হবে।
তত্ত্ব সর্বস্বতা থেকে দলকে বাস্তবের মাটিতে দাঁড় করানোর ক্ষেত্রে সেলিমের ভূমিকা ঐতিহাসিক। যে বাস্তবতা জ্যোতি বসুর ছিল এবং সেই বাস্তবতার ওপর ভিত্তি করেই একটানা দীর্ঘদিন কেবলমাত্র সরকার পরিচালনা নয়, দলকেও জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতির ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক করে রাখতে পেরেছিলেন কমিউনিস্টরা, সেই পরিপ্রেক্ষিতে মূল ভিত্তি ছিল বাংলা এবং দেশের মাটিকে সঠিকভাবে অনুভব করবার শক্তি। এ শক্তিটি সেলিমের মধ্যে, জ্যোতিবাবুর পর একমাত্র প্রখর আমরা দেখতে পাচ্ছি।
তাই আমরা দেখতে পাচ্ছি, সদ্য সমাপ্ত দলের ২৭তম রাজ্য সম্মেলনে হুগলি জেলার বিশিষ্ট মনীষীদের মধ্যে সমন্বয়ী সাধনার অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবও আছেন।
এটা কিন্তু সিপিআই (এম) দলের কাছে আজ থেকে তিন বছর আগেও ভাবতেই পারা যেত না। ভারতের মতো বহুভাষী, বহু ধর্ম, বহু জনগোষ্ঠীর মানুষের মধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের যে মরমিয়া সাধনার ধারা, তা যে কোনও অবস্থাতেই ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক ধরার সঙ্গে সমতুল্য নয়- এই বোধে কমিউনিস্টদের প্রতিষ্ঠিত করবার ক্ষেত্রে প্রথম উদ্যোগী ভূমিকা নিয়েছিলেন ইএমএস নম্বরদ্রিপাদ। বিবেকানন্দ সম্পর্কে তার বক্তৃতা এবং রচনা সংকলন, ভারতীয় দর্শনের সমন্বয়ী ধারার একটি আকর গ্রন্থ।
বেশ অনেকটা সময় ধরে সিপিআইর (এম) একটা অংশের লোকেদের মধ্যে, তাদেরই দলের কর্মী সমর্থকেরা, যারা প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মে বিশ্বাস করেন, কিন্তু কোনো অবস্থাতেই সাম্প্রদায়িক নন, পরধর্ম বিদ্বেষী নন- তাদের ঘিরে মশকরা করা, টিটকারি করা- এটা একটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল। অথচ অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, ওইসব টিটকারিকারি লোকেরা কোমরের ঘুনসিতে মাদুলি পড়ে থাকেন। নিজের বাড়িতে নানা ধরনের ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের সঙ্গেও যুক্ত থাকেন।
প্রচলিত হিন্দু ধর্মের যে শ্রাদ্ধানুষ্ঠান, সেটা তারা পালন করেন; কিন্তু পাছে বাইরের লোকে কিছু বলতে পারে, এই কারণে, মস্তক মুন্দন করে না। অশৌচ অবস্থায় নির্ধারিত পোশাক ব্যবহার করে না। এরাই আবার প্রকাশ্যে স্মরণসভার মধ্য দিয়ে আত্মীয়-পরিজনদের স্মরণ করে।
এই ভাবের ঘরে চুরি- এটা কিন্তু সিপিআই (এম) দলটিকে অনেক জায়গায় বাংলার প্রচলিত সামাজিক ব্যবস্থা, প্রবাহমানতা থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। এ ধরনের মানুষদের একটা বড় অংশের মধ্যে প্রবল মুসলমান বিরোধিতা রয়েছে। মুসলমানদের ক্ষেত্রে- ‘আমরা’ ‘ওরা’, ‘বাঙালি এবং মুসলমান’- এসব শব্দাবলীর ব্যবহার রয়েছে। আর আচার-আচরণ সিপিআই (এম) দলের একটা ছোট অংশের মধ্যে, বিশেষ করে যারা কোনো না কোনো সময় পূর্ববঙ্গ বা আজকের বাংলাদেশ থেকে এসেছেন, তাদের মধ্যে খুব সক্রিয়ভাবে দেখতে পাওয়া যায় এই মুসলমান বিদ্বেষ দেখা যায়।
ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িকতা এবং প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতার সঙ্গে লড়াই করবার প্রশ্নে, ভারতের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, হিন্দু মুসলমানের সৌহার্দ্য, বৈচিত্র্যপূর্ণ সমন্বয়ী সংস্কৃতি- এগুলোর চর্চা যে একান্তভাবে জরুরিÑ আজকে সেই জায়গাটি নিজের দলে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরে সেলিম শুধু তার নিজের দলের ক্ষেত্রে একটি ইতিবাচক প্রেক্ষিত তৈরি করলেন না। এই প্রচেষ্টা কে ফলপ্রসূ করে তুলতে পারলে, সামগ্রিকভাবে বাংলা তথা ভারতের বুকে ধর্মের নামে, জাত-পাতের নামে, ভাষার নামে, লিঙ্গের নামে যে রক্তের হোলি খেলাÑ তাকে প্রতিহত করবার ক্ষেত্রে। সাধারণ মানুষ একটি জোরদার হাতিয়ার নিজের হাতে তুলে নিতে পারবেন।
[লেখক : ভারতীয় ইতিহাসবিদ]