ছৈয়দুল আলম
আজ ১ মার্চ জাতীয় বিমা দিবস। বাংলাদেশে অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হলো বিমা ব্যবস্থা। আধুনিক বিশ্বে বিমা শুধু একটি আর্থিক সুরক্ষা ব্যবস্থা নয়, বরং এটি ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজের জন্য দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে এবং নাগরিকদের ঝুঁকিমুক্ত ভবিষ্যৎ গড়তে বিমা অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা রাখে। তবে বাংলাদেশে বিমার প্রচলন অনেক পুরনো হলেও এখনো সাধারণ মানুষের মধ্যে এর গ্রহণযোগ্যতা এবং সচেতনতার অভাব রয়েছে।
বাংলাদেশে বিমা কোম্পানির অভাব নেই, তবে বিমা গ্রাহকের অভাব একটি বাস্তবতা। এর পেছনে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ রয়েছেÑ
সচেতনতার অভাব : অনেক মানুষ বিমার গুরুত্ব ও সুবিধা সম্পর্কে পুরোপুরি অবগত নয়। বিমার বিষয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা কম হওয়ায় তারা এটি প্রয়োজনীয় বলে মনে করেন না।
আর্থিক সক্ষমতা : অনেক মানুষের কাছে বিমার প্রিমিয়াম পরিশোধ করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতার কারণে সাধারণ মানুষ বিমা নেওয়ার প্রতি আগ্রহ হারান।
বিশ্বাসের অভাব : কিছু মানুষ মনে করেন, বিমা কোম্পানিগুলো তাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে না এবং সময়মতো ক্ষতিপূরণ প্রদান করতে ব্যর্থ হয়। এ কারণে তারা বিমায় বিনিয়োগ করতে অনাগ্রহী।
সংস্কৃতি ও মানসিকতা : বাংলাদেশে অনেক মানুষ এখনও ভবিষ্যতের সুরক্ষা বা পরিকল্পনা নিয়ে ভাবেন না। অধিকাংশ মানুষ বর্তমানেই সুখী থাকতে চান, যার ফলে বিমার প্রতি আগ্রহ কম।
বিমার বিকল্প অভ্যস্ততা : অনেক মানুষ পরিবার বা বন্ধুবান্ধবের কাছে আর্থিক সহায়তা পাওয়ার আশা রাখে, যদি কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি ঘটে। তাদের কাছে বিমা অতিরিক্ত মনে হয়।
বিমার প্রকারের প্রতি অনাগ্রহ : জীবন বিমা বা স্বাস্থ্য বিমার মতো কিছু প্রকারের বিমা সম্পর্কে অনেক মানুষ তেমন আগ্রহী নন। তারা মনে করেন, এসব বিমা শুধু ‘ধনী’ মানুষদের জন্য উপযোগী।
পূর্ববর্তী বিমা কোম্পানির উধাও হওয়া : কিছু বিমা কোম্পানি অতীতে তাদের গ্রাহকদের অর্থ নিয়ে উধাও হয়ে গিয়েছে, যার ফলে মানুষের মধ্যে বিমা কোম্পানির প্রতি অনাস্থা তৈরি হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ২০০৯ সালে পিপলস ইনস্যুরেন্স কোম্পানি এবং ইউনাইটেড ইনস্যুরেন্সের মতো কোম্পানিগুলো তাদের গ্রাহকদের অর্থ নিয়ে অপ্রত্যাশিতভাবে কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়। এ ধরনের ঘটনা গ্রাহকদের মধ্যে একধরনের ভয় ও সন্দেহ সৃষ্টি করেছে, যার ফলে বিমার প্রতি তাদের আস্থা কমে গিয়েছে।
উপরোক্ত কারণে বাংলাদেশে বিমা গ্রাহকের সংখ্যা এখনও তুলনামূলকভাবে কম। তবে সচেতনতা বৃদ্ধি, মানসিকতা পরিবর্তন এবং সরকারের উদ্যোগের মাধ্যমে এ সমস্যা সমাধান হতে পারে।
বিমা দিবসের পটভূমি : জাতীয় বিমা দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ২০২০ সালে, যা বাংলাদেশ সরকারের নির্দেশে আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়। বিমা খাতের দীর্ঘদিনের ইতিহাস ও আর্থিক ব্যবস্থায় এর গুরুত্ব বিবেচনা করে এ দিবসটি নির্ধারণ করা হয়। মূলত, বিমা সেক্টরের উন্নয়ন ও জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে এই দিবস পালিত হয়, যাতে দেশের অর্থনৈতিক ভিত্তি আরও সুদৃঢ় হয়।
বিমা খাতের চ্যালেঞ্জ ও উন্নয়নের সম্ভাবনা : জাতীয় বিমা দিবস কেবল আনুষ্ঠানিকতা পালনের জন্য নয়, বরং এই খাতের প্রতি জনগণের আস্থা বাড়ানোর জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ।
বিমা সেবা সহজলভ্য করা : প্রযুক্তিনির্ভর সেবা নিশ্চিত করে গ্রাহকদের জন্য বিমা গ্রহণ ও দাবি নিষ্পত্তি প্রক্রিয়া সহজতর করতে হবে।
স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বৃদ্ধি : বিমা কোম্পানিগুলোকে তাদের নীতিমালা ও কার্যক্রমে আরও স্বচ্ছতা আনতে হবে, যাতে গ্রাহকরা নিশ্চিন্তে বিমা নিতে পারেন।
আইনগত কাঠামো শক্তিশালী করা : প্রতারণামূলক বিমা কার্যক্রম রোধ করতে সরকারকে আরও কঠোর আইন প্রয়োগ করতে হবে।
জনসচেতনতা বৃদ্ধি : স্কুল, কলেজ ও গণমাধ্যমের মাধ্যমে বিমার উপকারিতা সম্পর্কে প্রচারণা চালাতে হবে।
সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীকে অন্তর্ভুক্ত করা : বিশেষ করে কৃষক, শ্রমিক ও নিম্নআয়ের মানুষের জন্য সহজ শর্তে বিমা সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে।
বিমা নীতিমালার আধুনিকায়ন : বর্তমান সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নীতিমালা সংস্কার করতে হবে, যাতে সাধারণ জনগণ সহজেই বিমার সুযোগ নিতে পারে।
বিমায় মানুষের কল্যাণ : বিমা খাত মানুষের জীবন ও সম্পদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার মাধ্যমে একটি নিরাপদ ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে সহায়তা করে। এটি শুধুমাত্র আর্থিক ক্ষতির বিরুদ্ধে সুরক্ষা দেয় না, বরং জাতীয় অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাও নিশ্চিত করে।
স্বাস্থ্য বিমা মানুষকে চিকিৎসা ব্যয়ের ভারমুক্ত রাখে, কৃষি বিমা কৃষকদের দুর্যোগকালীন সুরক্ষা দেয় এবং জীবন বিমা পরিবারকে আর্থিক নিশ্চয়তা প্রদান করে। উন্নত দেশগুলোর মতো বাংলাদেশেও এই খাতকে বিস্তৃত করার মাধ্যমে মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত করা সম্ভব।
[লেখক : সংবাদকর্মী]
ছৈয়দুল আলম
শনিবার, ০১ মার্চ ২০২৫
আজ ১ মার্চ জাতীয় বিমা দিবস। বাংলাদেশে অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হলো বিমা ব্যবস্থা। আধুনিক বিশ্বে বিমা শুধু একটি আর্থিক সুরক্ষা ব্যবস্থা নয়, বরং এটি ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজের জন্য দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে এবং নাগরিকদের ঝুঁকিমুক্ত ভবিষ্যৎ গড়তে বিমা অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা রাখে। তবে বাংলাদেশে বিমার প্রচলন অনেক পুরনো হলেও এখনো সাধারণ মানুষের মধ্যে এর গ্রহণযোগ্যতা এবং সচেতনতার অভাব রয়েছে।
বাংলাদেশে বিমা কোম্পানির অভাব নেই, তবে বিমা গ্রাহকের অভাব একটি বাস্তবতা। এর পেছনে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ রয়েছেÑ
সচেতনতার অভাব : অনেক মানুষ বিমার গুরুত্ব ও সুবিধা সম্পর্কে পুরোপুরি অবগত নয়। বিমার বিষয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা কম হওয়ায় তারা এটি প্রয়োজনীয় বলে মনে করেন না।
আর্থিক সক্ষমতা : অনেক মানুষের কাছে বিমার প্রিমিয়াম পরিশোধ করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতার কারণে সাধারণ মানুষ বিমা নেওয়ার প্রতি আগ্রহ হারান।
বিশ্বাসের অভাব : কিছু মানুষ মনে করেন, বিমা কোম্পানিগুলো তাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে না এবং সময়মতো ক্ষতিপূরণ প্রদান করতে ব্যর্থ হয়। এ কারণে তারা বিমায় বিনিয়োগ করতে অনাগ্রহী।
সংস্কৃতি ও মানসিকতা : বাংলাদেশে অনেক মানুষ এখনও ভবিষ্যতের সুরক্ষা বা পরিকল্পনা নিয়ে ভাবেন না। অধিকাংশ মানুষ বর্তমানেই সুখী থাকতে চান, যার ফলে বিমার প্রতি আগ্রহ কম।
বিমার বিকল্প অভ্যস্ততা : অনেক মানুষ পরিবার বা বন্ধুবান্ধবের কাছে আর্থিক সহায়তা পাওয়ার আশা রাখে, যদি কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি ঘটে। তাদের কাছে বিমা অতিরিক্ত মনে হয়।
বিমার প্রকারের প্রতি অনাগ্রহ : জীবন বিমা বা স্বাস্থ্য বিমার মতো কিছু প্রকারের বিমা সম্পর্কে অনেক মানুষ তেমন আগ্রহী নন। তারা মনে করেন, এসব বিমা শুধু ‘ধনী’ মানুষদের জন্য উপযোগী।
পূর্ববর্তী বিমা কোম্পানির উধাও হওয়া : কিছু বিমা কোম্পানি অতীতে তাদের গ্রাহকদের অর্থ নিয়ে উধাও হয়ে গিয়েছে, যার ফলে মানুষের মধ্যে বিমা কোম্পানির প্রতি অনাস্থা তৈরি হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ২০০৯ সালে পিপলস ইনস্যুরেন্স কোম্পানি এবং ইউনাইটেড ইনস্যুরেন্সের মতো কোম্পানিগুলো তাদের গ্রাহকদের অর্থ নিয়ে অপ্রত্যাশিতভাবে কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়। এ ধরনের ঘটনা গ্রাহকদের মধ্যে একধরনের ভয় ও সন্দেহ সৃষ্টি করেছে, যার ফলে বিমার প্রতি তাদের আস্থা কমে গিয়েছে।
উপরোক্ত কারণে বাংলাদেশে বিমা গ্রাহকের সংখ্যা এখনও তুলনামূলকভাবে কম। তবে সচেতনতা বৃদ্ধি, মানসিকতা পরিবর্তন এবং সরকারের উদ্যোগের মাধ্যমে এ সমস্যা সমাধান হতে পারে।
বিমা দিবসের পটভূমি : জাতীয় বিমা দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ২০২০ সালে, যা বাংলাদেশ সরকারের নির্দেশে আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়। বিমা খাতের দীর্ঘদিনের ইতিহাস ও আর্থিক ব্যবস্থায় এর গুরুত্ব বিবেচনা করে এ দিবসটি নির্ধারণ করা হয়। মূলত, বিমা সেক্টরের উন্নয়ন ও জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে এই দিবস পালিত হয়, যাতে দেশের অর্থনৈতিক ভিত্তি আরও সুদৃঢ় হয়।
বিমা খাতের চ্যালেঞ্জ ও উন্নয়নের সম্ভাবনা : জাতীয় বিমা দিবস কেবল আনুষ্ঠানিকতা পালনের জন্য নয়, বরং এই খাতের প্রতি জনগণের আস্থা বাড়ানোর জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ।
বিমা সেবা সহজলভ্য করা : প্রযুক্তিনির্ভর সেবা নিশ্চিত করে গ্রাহকদের জন্য বিমা গ্রহণ ও দাবি নিষ্পত্তি প্রক্রিয়া সহজতর করতে হবে।
স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বৃদ্ধি : বিমা কোম্পানিগুলোকে তাদের নীতিমালা ও কার্যক্রমে আরও স্বচ্ছতা আনতে হবে, যাতে গ্রাহকরা নিশ্চিন্তে বিমা নিতে পারেন।
আইনগত কাঠামো শক্তিশালী করা : প্রতারণামূলক বিমা কার্যক্রম রোধ করতে সরকারকে আরও কঠোর আইন প্রয়োগ করতে হবে।
জনসচেতনতা বৃদ্ধি : স্কুল, কলেজ ও গণমাধ্যমের মাধ্যমে বিমার উপকারিতা সম্পর্কে প্রচারণা চালাতে হবে।
সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীকে অন্তর্ভুক্ত করা : বিশেষ করে কৃষক, শ্রমিক ও নিম্নআয়ের মানুষের জন্য সহজ শর্তে বিমা সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে।
বিমা নীতিমালার আধুনিকায়ন : বর্তমান সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নীতিমালা সংস্কার করতে হবে, যাতে সাধারণ জনগণ সহজেই বিমার সুযোগ নিতে পারে।
বিমায় মানুষের কল্যাণ : বিমা খাত মানুষের জীবন ও সম্পদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার মাধ্যমে একটি নিরাপদ ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে সহায়তা করে। এটি শুধুমাত্র আর্থিক ক্ষতির বিরুদ্ধে সুরক্ষা দেয় না, বরং জাতীয় অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাও নিশ্চিত করে।
স্বাস্থ্য বিমা মানুষকে চিকিৎসা ব্যয়ের ভারমুক্ত রাখে, কৃষি বিমা কৃষকদের দুর্যোগকালীন সুরক্ষা দেয় এবং জীবন বিমা পরিবারকে আর্থিক নিশ্চয়তা প্রদান করে। উন্নত দেশগুলোর মতো বাংলাদেশেও এই খাতকে বিস্তৃত করার মাধ্যমে মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত করা সম্ভব।
[লেখক : সংবাদকর্মী]