alt

উপ-সম্পাদকীয়

প্রসঙ্গ : নেপাল থেকে বিদ্যুৎ আমদানি

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

: রোববার, ০২ মার্চ ২০২৫

প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল ও ভুটান নিয়ে একটি যৌথ অর্থনীতি গড়ে তোলার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তার মতে বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণেই চীন এবং ভারতের কাছে বাংলাদেশের গুরুত্ব একটু বেশি। অবস্থানগত কারণ ছাড়াও বাংলাদেশের রয়েছে বিপুল জনগোষ্ঠী, এই জনগোষ্ঠীকে তিনি এখন আর বোঝা মনে করেন না। তার অভিমত হচ্ছে জুলাই-আগস্ট মাসে বাংলাদেশের তরুণরা যা দেখিয়েছে তার প্রেষণায় বিশ্ব জয়ের জন্য তাদের দরজা খুলে দিতে হবে। আন্তর্জাতিক ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে নেপাল, ভুটান এবং ভারতের পূর্বাঞ্চল সেভেন সিস্টারের সমুদ্রবন্দর না থাকায় তারা বাংলাদেশের সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করে উপকৃত হতে পারে, একইভাবে বাংলাদেশও নেপাল থেকে জলবিদ্যুৎ আমদানি করে লাভবান হতে পারে। হিমালয় পর্বতে জমে থাকা পানি থেকে উৎপাদিত জলবিদ্যুৎ আমদানি করে বাংলাদেশের বর্তমান এবং ভবিষ্যত চাহিদা পূরণ করার বাসনা ব্যক্ত করেছেন প্রধান উপদেষ্টা। নেপালও নাকি জলবিদ্যুৎ দেওয়ার জন্য এক পায়ে দাঁড়া। ড. ইউনূস এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে আগ্রহী।

প্রধান উপদেষ্টার এই আগ্রহের বাস্তবায়নে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হবে, কারণ ভারতের মধ্যে দিয়ে নেপাল যেতে হলে ৫৪ কিলোমিটার অতিক্রম করতে হবে, অবশ্য পাহাড়ি এলাকার মধ্য দিয়ে রাস্তা বের করতে গেলে দূরত্ব অনেক বেড়ে যাবে। চিকেন নেক হয়ে বাংলাদেশ থেকে নেপাল-ভুটান পর্যন্ত দূরত্ব মাত্র ২০ কিলোমিটার।নেপালের সাথে স্থলপথে বাণিজ্য করার লক্ষ্যে আওয়ামী লীগ সরকারও ভারতের সাথে অনেক দরবারি বৈঠক করেছে, কিন্তু ভারতের সম্মতি পাওয়া যায়নি। না পাওয়ার প্রধান কারণ উক্ত ট্রানজিট পথে চীন থেকে ভারতের থ্রেট আছে; কারণ এই পথ শুধু নেপাল, ভুটান ও বাংলাদেশের একসেস পয়েন্ট নয়, এটা স্ট্র‍্যাটেজিক সিক্যুরিটি থ্রেট পয়েন্টও এবং ভারতীয় বাহিনীর চোখে এটি কাশ্মীরের থেকেও বেশি স্পর্শকাতর জায়গা।

নেপাল থেকে বিদ্যুৎ আমদানির জন্য ২০১৮ সনে বাংলাদেশ এবং নেপালের মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হয়; সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের ছয় বছর পর ভারতের গ্রিড ব্যবহার করে গত নভেম্বর মাস থেকে ৪০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ বাংলাদেশে সরবরাহ হচ্ছে। অন্তর্বর্তী সরকার নেপাল থেকে আরও বেশি বিদ্যুৎ আনার প্রচেষ্টা নিচ্ছে। এই বিদ্যুৎ বাংলাদেশের জন্য অনুকূল, কারণ এই জলবিদ্যুতের দর তুলনামূলকভাবে কম, ইউনিট প্রতি সাত টাকার মতো। অপরদিকে বাংলাদেশের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের গড় মূল্য পড়ে ১১.০২ টাকা, আদানি ছাড়া ভারতের অন্যান্য বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে আমদানি করা বিদ্যুতের ইউনিট প্রতি দর ৮.৭৪ টাকা। বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত জ্বালানির ভিত্তিতে প্রতি ইউনিটের উৎপাদন ব্যয় নির্ভর করে; আমাদের নিজের প্রাকৃতিক গ্যাস দিয়ে উৎপাদিত প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের মূল্য হয় ৫ টাকার মতো, অন্যদিকে জ্বালানি তেল দিয়ে উৎপাদিত প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের খরচ দাঁড়ায় প্রায় ২০ টাকা।

দুই বিলিয়ন ডলার খরচ করে তৈরি ভারতের ঝাড়খ- রাজ্যের গোড্ডায় ৪২৫ হেক্টর জায়গার উপর স্থাপিত আদানির কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের দুটি ইউনিট থেকে প্রতিদিন ১৪০০ থেকে ১৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ হচ্ছিল এবং তা ২৫ বছর ধরে সরবরাহ করার কথা; কিন্তু বকেয়া অর্থ ১০ হাজার কোটি না পেয়ে আদানি একটি ইউনিটের বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ করে দেয়। ভারত থেকে বিদ্যুৎ আনার ক্ষেত্রে প্রথম প্রথম এমনতর আপত্তিও উত্থাপন করা হয়েছিল যে, ভারতের হাতে সুইচ রেখে ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি বাংলাদেশের জন্য আত্মঘাতি হবে। কিন্তু ভারতের মাটিতে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপিত হওয়ায় বাংলাদেশ পোড়া কয়লার দূষণ থেকে মুক্ত থাকছে। এছাড়া বাংলাদেশে পর্যাপ্ত পতিত জমি নেই, সুন্দরবন ধ্বংস হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে কত বিরোধিতা, মহেশখালীতে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে বাধা দিতে গিয়ে অনেকে জীবন দিলেন।

অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর আদানির সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তি পর্যালাচনা ও পুনর্মূল্যায়ের জন্য উচ্চ আদালতের নির্দেশে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যবহৃত কয়লার অতিরিক্ত দর দেওয়া হবে না মর্মে বিদ্যুৎ উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান ঘোষণা দিলেন। তিনি আরও বললেন, কোনো বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের হাতে বাংলাদেশকে জিম্মি হতে বা কোনো বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানকে ব্ল্যাকমেইল করতে দেয়া হবে না। শুধু তাই নয়, অন্তর্বর্তী সরকার বিদ্যুৎ সংগ্রহের বিকল্প ব্যবস্থার কথা ভাবছেন বলেও তিনি উল্লেখ করেন। আদানির বিরুদ্ধে জ্বালানি উপদেষ্টার এভাবে সোচ্চার হতে দেখে আমরা খুশিতে গদগদ হয়ে উঠলাম, কিন্তু সব খুশি কিছুদিনের মধ্যে ম্লান হয়ে গেল। আমরা আম জনতা গর্জনের পর আর বর্ষণ হতে দেখলাম না।

বিদ্যুৎ বিভাগের হিসাব মতে বর্তমানে গ্রীষ্মকালে সর্বোচ্চ চাহিদা ১৭ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট। আমরা উৎপাদন করতে পারি সর্বোচ্চ ১৬ হাজার ৪৭৭ মেগাওয়াট। তবে বাংলাদেশের উৎপাদন সক্ষমতা ৩১ হাজার ১৪৫ মেগাওয়াট। আওয়ামী লীগ সরকার বিগত পনের বছরে দেশে একের পর এক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করেছে। অনেকের ধারণা কমিশন বাণিজ্যের জন্য রাজনীতিবিদ ও আমলারা এসব অপরিকল্পিত ও অপ্রয়োজনীয় বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে অনুমোদন দিয়েছেন। কথাটি ভুল মনে হচ্ছে।ভুল না হলে এখন প্রধান উপদেষ্টা আবার নেপাল থেকে বেশি বেশি বিদ্যুৎ আনার পক্ষে কথা বলছেন কেন? দুঃখের বিষয়, উৎপাদন সক্ষমতা এত বেশি থাকা সত্ত্বেও শীতকালেও এখন লোডশেডিং হচ্ছে।এটা কি অন্তর্বর্তী সরকারের ব্যর্থতা? আমাদের মতো কারিগরি জ্ঞান শূন্য লোকের পক্ষে এই সব বিষয় অনুধাবন করা কঠিন। অন্তর্বর্তী সরকারের জ্বালানি উপদেষ্টা বললেন, আদানির বিদ্যুৎ না পেলেও আমাদের কোন সমস্যা হবে না; তবে কয়লার অভাবে আমাদের কেন্দ্রগুলো উৎপাদন করতে পারছে না। কয়লার ঘাটতি কেন হলো তা জানা গেল না।আদানির বিদ্যুতের প্রয়োজন না হলে জ্বালানি উপদেষ্টা ভারতে গিয়ে আদানির সঙ্গে কথা বলার প্রয়োজন অনুভব করলেন কেন তাও বোধগম্য নয়। ভারত থেকে এসে বললেন আদানির সংশ্লিষ্ট বিদুৎকেন্দ্রের সব বিদ্যুৎ আমরা নেবো। আদানির বিদ্যুৎ যদি অপরিহার্য হয় তাহলে জল এত ঘোলা করার দরকার কী? মূল্য ও করছাড় দিতে রাজি না হওয়া সত্বেও আদানির উক্ত কেন্দ্রের সব বিদ্যুৎ নিতে আমরা এখন সম্মত হয়েছি।

আমাদের দেশে যে কোন কাজের বিরোধিতা করার একটা রেওয়াজ আছে, এদের মধ্যে বিশেষজ্ঞ বুদ্দিজীবীও জড়িত। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র করা যাবে না, কারণ কয়লা পরিবেশ দুষণ করে; পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র করা যাবে না, কারণ তা ঝুঁকিপূর্ণ। বিশেষজ্ঞ বুদ্ধিজীবীদের দাবী নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে হবে।কিন্তু বাংলাদেশে বায়ু বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় গতির বাতাস সব জায়গায় নেই, কুতুবদিয়ায় বায়ু বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রচেষ্টা নেয়া হয়েছিল, কিন্তু সফলতা আসেনি। এক মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রয়োজন হয় ২.২৫ একর জায়গা এবং এক মেগাওয়াটের সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরিতে খরচ পড়ে আট কোটি টাকার মতো।রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য যতটা জায়গা ব্যবহার করা হয়েছে ততটা জায়গায় প্যানেল বসিয়ে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন করতে গেলে বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে মাত্র আট মেগাওয়াট।অন্যদিকে কর্ণফুলি জলবিদ্যুৎ করে হাজার হাজার জনবসতি পানির নিচে ডুবিয়ে রাখা হয়েছে।

বাংলাদেশ হচ্ছে পৃথিবীর অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ দেশ; এখানে বিরাণভূমির বড়ই অভাব। তাই বুদ্ধিজীবী বিশেষজ্ঞদের কথা শুনলে মনে হবে আদিম গুহাই বসবাসের জন্য সর্বোত্তম জায়গা।

স্বাধীন বাংলাদেশে বিদ্যুৎ খাতটি বেশি অবহেলিত ছিল বিএনপির শাসনামল ২০০১ থেকে ২০০৬ সন পর্যন্ত- এই ৫ বছরে মাত্র ৮০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রীডে সংযোজন হয়। ওই সময় চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাটে বিদ্যুতের জন্য মানুষ জীবন দিয়েছে, ঢাকা শহরের শনির আঁখড়ায় পানি ও বিদ্যুতের জন্য মানুষের বিক্ষোভের মারমুখী অবস্থানে বিএনপির সাংসদ সালাউদ্দিন আহমেদকে দৌড়ে পালাতে হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় বসেই বিদ্যুৎ উৎপাদনে মনোযোগী হয় এবং আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে শুধু বিদ্যুৎ নয়, সার্বিক অর্থনীতির অভাবনীয় উন্নয়ন হয়েছে। বিএনপিও তা স্বীকার করে, এক্ষেত্রে তাদের অভিযোগ হচ্ছে মেগা প্রকল্পে মেগা দুর্নীতি হয়েছে।সম্প্রসারিত অর্থনীতির প্রয়োজনেই বিদ্যুতের বর্ধিত উৎপাদন অপরিহার্য। আওয়ামী লীগ সরকার দেশে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তুলছিল, এই সকল অঞ্চলে দেশি, বিদেশি অসংখ্য কলকারখানা গড়ে উঠছে, তাই বিদ্যুতের চাহিদা দিন দিন বাড়তেই থাকবে।

প্রযুক্তির চরম উৎকর্ষের এই মাহেন্দ্রক্ষণে চলৎশক্তির প্রধান উপকরণ হচ্ছে বিদ্যুৎ। সভ্যতার বিকাশে বিদ্যুৎ ছাড়া জীবন অচল। নেপাল থাকে বিদ্যুৎ আনতে হলে বিদ্যুতের সুইচ ভারতের হাতে থাকবেই। তাই ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলার অপরিহার্যতায় আমাদের মনস্তাত্ত্বিক বিরোধিতা পরিহার করতে হবে। সব দলের সব লোকই কথাটি জানে, কিন্তু মানে না। না মানার প্রধান কারণ কিছু মানুষের ভাবাবেগ তাড়িত ভোট পাওয়ার কৌশল। ড. ইউনূস এই অচলাবস্থা ভাঙার জন্য উপযুক্ত ব্যক্তি, কারণ যারা অকারণে ভারত বিরোধিতা করেন তাদের আস্থা রয়েছে তার উপর।

[লেখক : সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক]

জনতুষ্টিবাদীরা এগিয়ে আছে যেদিক থেকে

ভিক্ষাবৃত্তি : প্রয়োজন নাকি পেশা?

ছবি

বিনিময় কৌশল নাকি বাণিজ্য যুদ্ধ?

শিশু আদালতের বিচার-প্রক্রিয়ার আইনি ও বাস্তবিক দিক

জনদুর্ভোগের অপসংস্কৃতি ও জনশিক্ষা : আগামীর দিকনির্দেশনা

হরিজনদের পদবি : ঐক্যের পথে বাধা

এল নিনো : দেশের কৃষির চ্যালেঞ্জ ও করণীয়

আর কীভাবে আর্জি জানালে নিরাপত্তা পাওয়া যায়?

স্বপ্ন ভাঙল সাঁওতাল মুংলু বেসরার

কোনো স্কুলই খারাপ না

ঢাকার যানজটের টেকসই সমাধান কী

বই কেন পড়বেন

ডায়াবেটিসের জটিলতা বাড়ায় তামাক ও ধূমপান

জাতীয় বিমা দিবস

পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থা

ভাষা আন্দোলনে অংশ নেয়া ভুল হয়ে থাকলে মুক্তিযুদ্ধে জামায়াতের ভূমিকা সঠিক ছিল!

শিক্ষার গুণগত মান পরিবর্তনে শিক্ষকের মূল্যায়ন

দেশে প্রোগ্রামিংয়ের চ্যালেঞ্জ ও বাস্তবতা

তর্কে সময়, সামর্থ্য এবং শক্তির অপচয় রোধ করুন

পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও দেশপ্রেমে জাতীয় অগ্রগতি

শিক্ষার মানোন্নয়নে প্রাথমিকের লেখাপড়ায় সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে

ভোটাধিকার পুনরুদ্ধারের সংস্কার

বই পড়ে কী হবে

জনস্বাস্থ্যের আরেক আতঙ্কের নাম ডিমেনশিয়া

ভারতে সঙ্ঘের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য

রম্যগদ্য : “বঙ্গ হবে কলিঙ্গ”

আদিবাসী ভাষা সংরক্ষণে উদ্যোগ নিন

ছবি

ভাষা আন্দোলনের পটভূমি ও চেতনার অন্বেষণে

প্রযুক্তি, জলবায়ু ও জনসংখ্যার মোকাবিলায় উন্নয়নশীল অর্থনীতির

চাই একটি জাতীয় ভাষানীতি

অস্বাভাবিকের চেয়ে অস্বাভাবিক বায়ুদূষণ

আদিবাসীদের কাঁটাতারে বন্দি জীবন

জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে অভিযোজন : বাংলাদেশের কৌশল

শিক্ষক আন্দোলন প্রসঙ্গে

আর জি কর ঘিরে শাসক কৌশল প্রসঙ্গে

নিজের পথে ইউরোপ

tab

উপ-সম্পাদকীয়

প্রসঙ্গ : নেপাল থেকে বিদ্যুৎ আমদানি

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

রোববার, ০২ মার্চ ২০২৫

প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল ও ভুটান নিয়ে একটি যৌথ অর্থনীতি গড়ে তোলার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তার মতে বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণেই চীন এবং ভারতের কাছে বাংলাদেশের গুরুত্ব একটু বেশি। অবস্থানগত কারণ ছাড়াও বাংলাদেশের রয়েছে বিপুল জনগোষ্ঠী, এই জনগোষ্ঠীকে তিনি এখন আর বোঝা মনে করেন না। তার অভিমত হচ্ছে জুলাই-আগস্ট মাসে বাংলাদেশের তরুণরা যা দেখিয়েছে তার প্রেষণায় বিশ্ব জয়ের জন্য তাদের দরজা খুলে দিতে হবে। আন্তর্জাতিক ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে নেপাল, ভুটান এবং ভারতের পূর্বাঞ্চল সেভেন সিস্টারের সমুদ্রবন্দর না থাকায় তারা বাংলাদেশের সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করে উপকৃত হতে পারে, একইভাবে বাংলাদেশও নেপাল থেকে জলবিদ্যুৎ আমদানি করে লাভবান হতে পারে। হিমালয় পর্বতে জমে থাকা পানি থেকে উৎপাদিত জলবিদ্যুৎ আমদানি করে বাংলাদেশের বর্তমান এবং ভবিষ্যত চাহিদা পূরণ করার বাসনা ব্যক্ত করেছেন প্রধান উপদেষ্টা। নেপালও নাকি জলবিদ্যুৎ দেওয়ার জন্য এক পায়ে দাঁড়া। ড. ইউনূস এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে আগ্রহী।

প্রধান উপদেষ্টার এই আগ্রহের বাস্তবায়নে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হবে, কারণ ভারতের মধ্যে দিয়ে নেপাল যেতে হলে ৫৪ কিলোমিটার অতিক্রম করতে হবে, অবশ্য পাহাড়ি এলাকার মধ্য দিয়ে রাস্তা বের করতে গেলে দূরত্ব অনেক বেড়ে যাবে। চিকেন নেক হয়ে বাংলাদেশ থেকে নেপাল-ভুটান পর্যন্ত দূরত্ব মাত্র ২০ কিলোমিটার।নেপালের সাথে স্থলপথে বাণিজ্য করার লক্ষ্যে আওয়ামী লীগ সরকারও ভারতের সাথে অনেক দরবারি বৈঠক করেছে, কিন্তু ভারতের সম্মতি পাওয়া যায়নি। না পাওয়ার প্রধান কারণ উক্ত ট্রানজিট পথে চীন থেকে ভারতের থ্রেট আছে; কারণ এই পথ শুধু নেপাল, ভুটান ও বাংলাদেশের একসেস পয়েন্ট নয়, এটা স্ট্র‍্যাটেজিক সিক্যুরিটি থ্রেট পয়েন্টও এবং ভারতীয় বাহিনীর চোখে এটি কাশ্মীরের থেকেও বেশি স্পর্শকাতর জায়গা।

নেপাল থেকে বিদ্যুৎ আমদানির জন্য ২০১৮ সনে বাংলাদেশ এবং নেপালের মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হয়; সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের ছয় বছর পর ভারতের গ্রিড ব্যবহার করে গত নভেম্বর মাস থেকে ৪০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ বাংলাদেশে সরবরাহ হচ্ছে। অন্তর্বর্তী সরকার নেপাল থেকে আরও বেশি বিদ্যুৎ আনার প্রচেষ্টা নিচ্ছে। এই বিদ্যুৎ বাংলাদেশের জন্য অনুকূল, কারণ এই জলবিদ্যুতের দর তুলনামূলকভাবে কম, ইউনিট প্রতি সাত টাকার মতো। অপরদিকে বাংলাদেশের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের গড় মূল্য পড়ে ১১.০২ টাকা, আদানি ছাড়া ভারতের অন্যান্য বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে আমদানি করা বিদ্যুতের ইউনিট প্রতি দর ৮.৭৪ টাকা। বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত জ্বালানির ভিত্তিতে প্রতি ইউনিটের উৎপাদন ব্যয় নির্ভর করে; আমাদের নিজের প্রাকৃতিক গ্যাস দিয়ে উৎপাদিত প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের মূল্য হয় ৫ টাকার মতো, অন্যদিকে জ্বালানি তেল দিয়ে উৎপাদিত প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের খরচ দাঁড়ায় প্রায় ২০ টাকা।

দুই বিলিয়ন ডলার খরচ করে তৈরি ভারতের ঝাড়খ- রাজ্যের গোড্ডায় ৪২৫ হেক্টর জায়গার উপর স্থাপিত আদানির কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের দুটি ইউনিট থেকে প্রতিদিন ১৪০০ থেকে ১৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ হচ্ছিল এবং তা ২৫ বছর ধরে সরবরাহ করার কথা; কিন্তু বকেয়া অর্থ ১০ হাজার কোটি না পেয়ে আদানি একটি ইউনিটের বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ করে দেয়। ভারত থেকে বিদ্যুৎ আনার ক্ষেত্রে প্রথম প্রথম এমনতর আপত্তিও উত্থাপন করা হয়েছিল যে, ভারতের হাতে সুইচ রেখে ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি বাংলাদেশের জন্য আত্মঘাতি হবে। কিন্তু ভারতের মাটিতে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপিত হওয়ায় বাংলাদেশ পোড়া কয়লার দূষণ থেকে মুক্ত থাকছে। এছাড়া বাংলাদেশে পর্যাপ্ত পতিত জমি নেই, সুন্দরবন ধ্বংস হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে কত বিরোধিতা, মহেশখালীতে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে বাধা দিতে গিয়ে অনেকে জীবন দিলেন।

অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর আদানির সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তি পর্যালাচনা ও পুনর্মূল্যায়ের জন্য উচ্চ আদালতের নির্দেশে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যবহৃত কয়লার অতিরিক্ত দর দেওয়া হবে না মর্মে বিদ্যুৎ উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান ঘোষণা দিলেন। তিনি আরও বললেন, কোনো বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের হাতে বাংলাদেশকে জিম্মি হতে বা কোনো বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানকে ব্ল্যাকমেইল করতে দেয়া হবে না। শুধু তাই নয়, অন্তর্বর্তী সরকার বিদ্যুৎ সংগ্রহের বিকল্প ব্যবস্থার কথা ভাবছেন বলেও তিনি উল্লেখ করেন। আদানির বিরুদ্ধে জ্বালানি উপদেষ্টার এভাবে সোচ্চার হতে দেখে আমরা খুশিতে গদগদ হয়ে উঠলাম, কিন্তু সব খুশি কিছুদিনের মধ্যে ম্লান হয়ে গেল। আমরা আম জনতা গর্জনের পর আর বর্ষণ হতে দেখলাম না।

বিদ্যুৎ বিভাগের হিসাব মতে বর্তমানে গ্রীষ্মকালে সর্বোচ্চ চাহিদা ১৭ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট। আমরা উৎপাদন করতে পারি সর্বোচ্চ ১৬ হাজার ৪৭৭ মেগাওয়াট। তবে বাংলাদেশের উৎপাদন সক্ষমতা ৩১ হাজার ১৪৫ মেগাওয়াট। আওয়ামী লীগ সরকার বিগত পনের বছরে দেশে একের পর এক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করেছে। অনেকের ধারণা কমিশন বাণিজ্যের জন্য রাজনীতিবিদ ও আমলারা এসব অপরিকল্পিত ও অপ্রয়োজনীয় বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে অনুমোদন দিয়েছেন। কথাটি ভুল মনে হচ্ছে।ভুল না হলে এখন প্রধান উপদেষ্টা আবার নেপাল থেকে বেশি বেশি বিদ্যুৎ আনার পক্ষে কথা বলছেন কেন? দুঃখের বিষয়, উৎপাদন সক্ষমতা এত বেশি থাকা সত্ত্বেও শীতকালেও এখন লোডশেডিং হচ্ছে।এটা কি অন্তর্বর্তী সরকারের ব্যর্থতা? আমাদের মতো কারিগরি জ্ঞান শূন্য লোকের পক্ষে এই সব বিষয় অনুধাবন করা কঠিন। অন্তর্বর্তী সরকারের জ্বালানি উপদেষ্টা বললেন, আদানির বিদ্যুৎ না পেলেও আমাদের কোন সমস্যা হবে না; তবে কয়লার অভাবে আমাদের কেন্দ্রগুলো উৎপাদন করতে পারছে না। কয়লার ঘাটতি কেন হলো তা জানা গেল না।আদানির বিদ্যুতের প্রয়োজন না হলে জ্বালানি উপদেষ্টা ভারতে গিয়ে আদানির সঙ্গে কথা বলার প্রয়োজন অনুভব করলেন কেন তাও বোধগম্য নয়। ভারত থেকে এসে বললেন আদানির সংশ্লিষ্ট বিদুৎকেন্দ্রের সব বিদ্যুৎ আমরা নেবো। আদানির বিদ্যুৎ যদি অপরিহার্য হয় তাহলে জল এত ঘোলা করার দরকার কী? মূল্য ও করছাড় দিতে রাজি না হওয়া সত্বেও আদানির উক্ত কেন্দ্রের সব বিদ্যুৎ নিতে আমরা এখন সম্মত হয়েছি।

আমাদের দেশে যে কোন কাজের বিরোধিতা করার একটা রেওয়াজ আছে, এদের মধ্যে বিশেষজ্ঞ বুদ্দিজীবীও জড়িত। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র করা যাবে না, কারণ কয়লা পরিবেশ দুষণ করে; পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র করা যাবে না, কারণ তা ঝুঁকিপূর্ণ। বিশেষজ্ঞ বুদ্ধিজীবীদের দাবী নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে হবে।কিন্তু বাংলাদেশে বায়ু বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় গতির বাতাস সব জায়গায় নেই, কুতুবদিয়ায় বায়ু বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রচেষ্টা নেয়া হয়েছিল, কিন্তু সফলতা আসেনি। এক মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রয়োজন হয় ২.২৫ একর জায়গা এবং এক মেগাওয়াটের সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরিতে খরচ পড়ে আট কোটি টাকার মতো।রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য যতটা জায়গা ব্যবহার করা হয়েছে ততটা জায়গায় প্যানেল বসিয়ে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন করতে গেলে বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে মাত্র আট মেগাওয়াট।অন্যদিকে কর্ণফুলি জলবিদ্যুৎ করে হাজার হাজার জনবসতি পানির নিচে ডুবিয়ে রাখা হয়েছে।

বাংলাদেশ হচ্ছে পৃথিবীর অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ দেশ; এখানে বিরাণভূমির বড়ই অভাব। তাই বুদ্ধিজীবী বিশেষজ্ঞদের কথা শুনলে মনে হবে আদিম গুহাই বসবাসের জন্য সর্বোত্তম জায়গা।

স্বাধীন বাংলাদেশে বিদ্যুৎ খাতটি বেশি অবহেলিত ছিল বিএনপির শাসনামল ২০০১ থেকে ২০০৬ সন পর্যন্ত- এই ৫ বছরে মাত্র ৮০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রীডে সংযোজন হয়। ওই সময় চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাটে বিদ্যুতের জন্য মানুষ জীবন দিয়েছে, ঢাকা শহরের শনির আঁখড়ায় পানি ও বিদ্যুতের জন্য মানুষের বিক্ষোভের মারমুখী অবস্থানে বিএনপির সাংসদ সালাউদ্দিন আহমেদকে দৌড়ে পালাতে হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় বসেই বিদ্যুৎ উৎপাদনে মনোযোগী হয় এবং আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে শুধু বিদ্যুৎ নয়, সার্বিক অর্থনীতির অভাবনীয় উন্নয়ন হয়েছে। বিএনপিও তা স্বীকার করে, এক্ষেত্রে তাদের অভিযোগ হচ্ছে মেগা প্রকল্পে মেগা দুর্নীতি হয়েছে।সম্প্রসারিত অর্থনীতির প্রয়োজনেই বিদ্যুতের বর্ধিত উৎপাদন অপরিহার্য। আওয়ামী লীগ সরকার দেশে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তুলছিল, এই সকল অঞ্চলে দেশি, বিদেশি অসংখ্য কলকারখানা গড়ে উঠছে, তাই বিদ্যুতের চাহিদা দিন দিন বাড়তেই থাকবে।

প্রযুক্তির চরম উৎকর্ষের এই মাহেন্দ্রক্ষণে চলৎশক্তির প্রধান উপকরণ হচ্ছে বিদ্যুৎ। সভ্যতার বিকাশে বিদ্যুৎ ছাড়া জীবন অচল। নেপাল থাকে বিদ্যুৎ আনতে হলে বিদ্যুতের সুইচ ভারতের হাতে থাকবেই। তাই ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলার অপরিহার্যতায় আমাদের মনস্তাত্ত্বিক বিরোধিতা পরিহার করতে হবে। সব দলের সব লোকই কথাটি জানে, কিন্তু মানে না। না মানার প্রধান কারণ কিছু মানুষের ভাবাবেগ তাড়িত ভোট পাওয়ার কৌশল। ড. ইউনূস এই অচলাবস্থা ভাঙার জন্য উপযুক্ত ব্যক্তি, কারণ যারা অকারণে ভারত বিরোধিতা করেন তাদের আস্থা রয়েছে তার উপর।

[লেখক : সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক]

back to top