alt

উপ-সম্পাদকীয়

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় : শিক্ষামন্ত্রীর গাড়ির নিচে ছাত্র

গৌতম রায়

: রোববার, ০৯ মার্চ ২০২৫

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় আবার এখন পশ্চিমবঙ্গের সংবাদ শিরোনামে। গত ১ মার্চ ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছুটির দিন। সেদিন তৃণমূল কংগ্রেস প্রভাবিত শিক্ষক সংগঠনের একটা সভা এই বিশ্ববিদ্যালয় একটি হলে আয়োজন করা হয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গে বিগত ২০১৭ সাল থেকে কোনো কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের নির্বাচন হয় না। ছাত্র সংসদের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে টাকা বরাদ্দ করা হয়; কিন্তু সেই টাকা ব্যবহার করে শাসক মনোনীত একদল লোক। বলা বাহুল্য সেই টাকা কখনো কোনো অবস্থাতেই ছাত্র কল্যাণে ব্যবহৃত হয় না। নানাভাবে শাসক ঘনিষ্ঠ ছাত্রদের ফুর্তিতে সেই টাকা ব্যবহার করা হয়।

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে শাসক ঘনিষ্ঠ শিক্ষক সংগঠনের সভা উপলক্ষে পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু উপস্থিত ছিলেন। বিভিন্ন স্তরের বামপন্থি ছাত্রছাত্রীরা সেখানে সমবেত হন। তারা ছাত্র সংসদের নির্বাচনের দাবিতে শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বাবুর কাছে স্মারকলিপি দিতে চান। প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রথমে শিক্ষামন্ত্রীকে কোনোরকম স্মারকলিপি দেওয়া যাবে নাÑ এ কথা বলা হলেও শেষ পর্যন্ত একটি ছাত্র সংগঠনকে ডাকা হয় শিক্ষামন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপি দেওয়ার জন্য। এরপর শিক্ষামন্ত্রী যখন দলীয় কর্মসূচি শেষ করে বেরিয়ে আসেন তখন বিভিন্ন স্তরের বামপন্থি ছাত্র-ছাত্রীরা শিক্ষামন্ত্রীকে ঘিরে বিক্ষোভ দেখাতে থাকেন। শিক্ষামন্ত্রী কোনো অবস্থাতেই ছাত্র-ছাত্রীদের দাবি-দাওয়ার প্রতি ন্যূনতম কর্ণপাত করবার লক্ষণ দেখান না। ছাত্রদের কথা শোনবার জন্য যে নূন্যতম ধৈর্যের প্রয়োজন সেটাও তিনি দেখান না। ছাত্র বিক্ষোভ চলতে থাকে। এই বিক্ষোভ যেমন বিভিন্ন স্তরের বামপন্থি ছাত্র-ছাত্রীরা ছিলেন, ঠিক তেমনি শাসক-শিবিরের শিক্ষক সংগঠনের যে সম্মেলন হয়, তাকে ঘিরে কলকাতা সংলগ্ন বিভিন্ন এলাকার শাসক শিবিরের বিভিন্ন নেতা সমর্থকেরা, যারা কোনো অবস্থাতেই শিক্ষা সংক্রান্ত কোনো বিষয়ের সঙ্গে সংযুক্ত নন, তারাও সেখানে সমবেত হয়েছিলেন।

বামপন্থি ছাত্ররা যখন বিক্ষোভ দেখাতে থাকে তখন বহিরাগত তৃণমূলীরা নানাভাবে বিক্ষোভরত বামপন্থি ছাত্রদের প্রতি উস্কানিমূলক আচরণ করতে থাকে। বামপন্থি ছাত্র, যারা ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত এবং নিজেরা ছাত্র কোন অবস্থাতেই তারা অছাত্র নয়, শিক্ষামন্ত্রীর গাড়ি ঘিরে বিক্ষোভ দেখাতে থাকেন। কোনো কোনো ছাত্রনেতা-কর্মী, তারা শিক্ষামন্ত্রীর গাড়িতেও উঠে পড়ে বিক্ষোভ দেখাতে থাকেন। তাদের একটিই দাবিÑ অবিলম্বে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের নির্বাচন করতে হবে। এ সম্পর্কে তারা শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনার মুহুর্মুহু দাবি জানাতে থাকে।

এ অবস্থায় শিক্ষামন্ত্রীর গাড়ি অত্যন্ত দ্রুতগতিতে চালু করে দেওয়া হয়। যার জেরে একাধিক ছাত্র গাড়ি থেকে পড়ে যায় এবং ইন্দ্রাণুজ রায় নামক একটি ছাত্র একেবারে শিক্ষামন্ত্রীর গাড়ির চাকার তলায় ঢুকে যায়। আরো একটি ছাত্র, অভিনব, গুরুতরভাবে আহত হয়।

এ ঘটনার কিছুক্ষণ আগেই আহত ইন্দ্রাণুজ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটে কিভাবে একই সঙ্গে তৃণমূল এবং আরএসএসের কর্মী, সমর্থকেরা অবরোধ তৈরি করেছে, সে সম্পর্কে একটি সমাজ মাধ্যমে পোস্টও দিয়েছিলেন। ইন্দ্রাণুজ এবং আরেকটি ছাত্র অভিনব গুরুতরভাবে আহত হন। ইন্দ্রাণুজ গুরুতরভাবে আঘাত পান চোখে। অভিনব আঘাত পান পায়ে।

ব্রাত্য বসুর পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে যাননি। তিনি গিয়েছিলেন, তার দলের শিক্ষক সংগঠনের নেতা হিসেবে। তাহলে যদি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি শিক্ষক সংগঠনের নেতা হিসেবেই গিয়ে থাকেন, তাহলে কেন একদল ছাত্রের স্মারকলিপি তিনি গ্রহণ করলেন? এক ব্যক্তি, তিনি যদি একাধারে রাজ্যের মন্ত্রী এবং দলীয় নেতা হন, তাহলে তার এক একটা জায়গায়, এক একটা সত্তা বিকশিত হবে?

ইন্দ্রাণুজ একদা বুদ্ধবাবুর প্রতি রাজনৈতিক সমর্থন জানায়নি বলে কি তাকে হত্যার চেষ্টার ছাড়পত্র পেয়ে যায় রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী? প্রসঙ্গত একটা কথা বলতে হয়; একটা সময় বামফ্রন্ট সরকারকে উৎখাত করতে বিজেপি- আরএসএসের সহযোগিতা নিয়ে বহু ঘোষিত, স্বঘোষিত অতি বামেদের তৃণমূল কংগ্রেস কাজে লাগিয়েছিল। সেইসব স্বঘোষিত অতিবামেরা এখন শাসক শিবিরের কোলে দোল খাচ্ছেন। বহু ক্ষেত্রে শাসক শিবিরের অনুগ্রহ পেয়ে তারা শাঁসে-জলে ফুলে-ফেপে উঠছেন।

তা সত্ত্বেও মানবিকতার খাতিরে বলতে হয়; আমার শত্রু শিবিরের একজন মানুষও যদি শাসকের ষড়যন্ত্রে মৃত্যুর মুখোমুখি হয়, আমি কি সেই মানুষটির প্রতি আমার সহমর্মিতার হাত, ভালোবাসার হাত, শুশ্রƒষার হাত বাড়িয়ে দেব না?

শাসক শিবির থেকে অভিযোগ তোলা হচ্ছে, শিক্ষামন্ত্রী সময়ের কি দাম নেই? হঠাৎ করে একদল ছাত্র গিয়ে পড়লো, আর শিক্ষামন্ত্রীকে তাদের সঙ্গে কথা বলতে হবে? দেখা করতে হবে?

আসলে শাসক তৃণমূল কংগ্রেস, নিজেরা কিভাবে নিজেদের মিথ্যাচারের জালে আটকে পড়ে তা বুঝতে পারা যায় তাদের কর্মপদ্ধতির মধ্যে দিয়েই। জ্যোতি বসু তখন মুখ্যমন্ত্রী, রাজ্য প্রশাসনের সদর দপ্তর রাইটার্স বিল্ডিংসে, তৎকালীন কংগ্রেস নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, এক রমণীকে নিয়ে গিয়ে হঠাৎ করে দাবি করে বসলেন; তিনি মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর সঙ্গে দেখা করতে চান।

কখনো কোন অবস্থাতেই একজন শীর্ষ প্রশাসনিক ব্যক্তি তার পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচি বাতিল করে দেখা করতে পারেন না প্রশাসনের সদর দপ্তরে। অথচ এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে সেই সময় প্রচন্ড রাজনৈতিক মাইলেজ পাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এই ঘটনার কথা তিনি এখনো তার রাজনৈতিক জীবনে একটি সাফল্য বলে উল্লেখ করে থাকেন।

তাহলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যদি সেদিন কোনোরকম পূর্বনির্ধারিত সময় স্থির না করে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে থাকতে পারেন, আর আজ মুখ্যমন্ত্রী নন, তার শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্ররা দেখা করতে গেলেই মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে গেল?

তৃণমূল কংগ্রেসের ভয়াবহ দুর্নীতি স্বজনপোষণ এবং ভ্রান্ত শিক্ষানীতির দরুন আজ পশ্চিমবঙ্গে সরকার পোষিত স্কুলগুলো কার্যত অচল। স্কুল বাড়িগুলো পড়ে আছে। বহু ক্ষেত্রে স্থানীয় লোকজনেরা সেসব স্কুল বাড়িকে নিজেদের ঘরবাড়ি হিসেবে ব্যবহার করছে। অথচ সরকারি কোষাগার থেকে মাস্টারমশাইরা বেতন পাচ্ছেন। নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন কিন্তু পঠন-পাঠন সেখানে কার্যত হচ্ছেই না।

প্রাথমিক স্তরের স্কুলগুলো পশ্চিমবঙ্গে এখন প্রায় জাদুঘরে ঠাঁই নিয়েছে। অথচ প্রাথমিকে নিয়োগ হচ্ছে। নিয়োগে কোটি কোটি টাকা দুর্নীতি হচ্ছে। আর সেই দুর্নীতিতে একইসঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেস আর বিজেপি নেতাদের মধ্যে টাকা ভাগাভাগির খবর ইডি সিবিআইয়ের বিভিন্ন চার্জশিটে উঠে আসছে। খবরের কাগজে তা নিয়ে লেখা-লেখি হচ্ছে; কিন্তু কার্যত একটি ব্যক্তিরও শাস্তি হচ্ছে না।

শহরতলীর কলেজগুলো এখন হয়ে গিয়েছে শাসক তৃণমূলের এক একেকটি রাজনৈতিক অফিস। অছাত্রতে ভরে গেছে বেশিরভাগ কলেজে। একটা সময় সাতের দশকে যেরকম ভাবে ডিগ্রি বিতরণ ঘিরে নানা ধরনের বিতর্ক উঠত, বিশেষ করে এলএলবি পরীক্ষা ঘিরে নানা ধরনের বিতর্ক সাতের দশকের শুরুর দিকে শুনতে পাওয়া যেতো, ঠিক সেই পরিস্থিতি আবার পশ্চিমবঙ্গের বুকে উঠে আসতে শুরু করেছে।

[লেখক : ভারতীয় ইতিহাসবিদ]

ছবি

উন্নত বিশ্বের নাগরিকত্ব ও দুর্নীতি

নারীর অধিকার, সমতা, ক্ষমতায়ন

আদালতের ভেতরে ভিডিও ধারণের আইনি দিক

আইনের শাসন না গণপিটুনি?

নারীর ভূমি ও কৃষি অধিকার : ন্যায়বিচারের পথে কতদূর?

রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের হালচাল

জনতুষ্টিবাদীরা এগিয়ে আছে যেদিক থেকে

ভিক্ষাবৃত্তি : প্রয়োজন নাকি পেশা?

ছবি

বিনিময় কৌশল নাকি বাণিজ্য যুদ্ধ?

শিশু আদালতের বিচার-প্রক্রিয়ার আইনি ও বাস্তবিক দিক

জনদুর্ভোগের অপসংস্কৃতি ও জনশিক্ষা : আগামীর দিকনির্দেশনা

প্রসঙ্গ : নেপাল থেকে বিদ্যুৎ আমদানি

হরিজনদের পদবি : ঐক্যের পথে বাধা

এল নিনো : দেশের কৃষির চ্যালেঞ্জ ও করণীয়

আর কীভাবে আর্জি জানালে নিরাপত্তা পাওয়া যায়?

স্বপ্ন ভাঙল সাঁওতাল মুংলু বেসরার

কোনো স্কুলই খারাপ না

ঢাকার যানজটের টেকসই সমাধান কী

বই কেন পড়বেন

ডায়াবেটিসের জটিলতা বাড়ায় তামাক ও ধূমপান

জাতীয় বিমা দিবস

পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থা

ভাষা আন্দোলনে অংশ নেয়া ভুল হয়ে থাকলে মুক্তিযুদ্ধে জামায়াতের ভূমিকা সঠিক ছিল!

শিক্ষার গুণগত মান পরিবর্তনে শিক্ষকের মূল্যায়ন

দেশে প্রোগ্রামিংয়ের চ্যালেঞ্জ ও বাস্তবতা

তর্কে সময়, সামর্থ্য এবং শক্তির অপচয় রোধ করুন

পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও দেশপ্রেমে জাতীয় অগ্রগতি

শিক্ষার মানোন্নয়নে প্রাথমিকের লেখাপড়ায় সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে

ভোটাধিকার পুনরুদ্ধারের সংস্কার

বই পড়ে কী হবে

জনস্বাস্থ্যের আরেক আতঙ্কের নাম ডিমেনশিয়া

ভারতে সঙ্ঘের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য

রম্যগদ্য : “বঙ্গ হবে কলিঙ্গ”

আদিবাসী ভাষা সংরক্ষণে উদ্যোগ নিন

ছবি

ভাষা আন্দোলনের পটভূমি ও চেতনার অন্বেষণে

প্রযুক্তি, জলবায়ু ও জনসংখ্যার মোকাবিলায় উন্নয়নশীল অর্থনীতির

tab

উপ-সম্পাদকীয়

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় : শিক্ষামন্ত্রীর গাড়ির নিচে ছাত্র

গৌতম রায়

রোববার, ০৯ মার্চ ২০২৫

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় আবার এখন পশ্চিমবঙ্গের সংবাদ শিরোনামে। গত ১ মার্চ ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছুটির দিন। সেদিন তৃণমূল কংগ্রেস প্রভাবিত শিক্ষক সংগঠনের একটা সভা এই বিশ্ববিদ্যালয় একটি হলে আয়োজন করা হয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গে বিগত ২০১৭ সাল থেকে কোনো কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের নির্বাচন হয় না। ছাত্র সংসদের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে টাকা বরাদ্দ করা হয়; কিন্তু সেই টাকা ব্যবহার করে শাসক মনোনীত একদল লোক। বলা বাহুল্য সেই টাকা কখনো কোনো অবস্থাতেই ছাত্র কল্যাণে ব্যবহৃত হয় না। নানাভাবে শাসক ঘনিষ্ঠ ছাত্রদের ফুর্তিতে সেই টাকা ব্যবহার করা হয়।

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে শাসক ঘনিষ্ঠ শিক্ষক সংগঠনের সভা উপলক্ষে পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু উপস্থিত ছিলেন। বিভিন্ন স্তরের বামপন্থি ছাত্রছাত্রীরা সেখানে সমবেত হন। তারা ছাত্র সংসদের নির্বাচনের দাবিতে শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বাবুর কাছে স্মারকলিপি দিতে চান। প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রথমে শিক্ষামন্ত্রীকে কোনোরকম স্মারকলিপি দেওয়া যাবে নাÑ এ কথা বলা হলেও শেষ পর্যন্ত একটি ছাত্র সংগঠনকে ডাকা হয় শিক্ষামন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপি দেওয়ার জন্য। এরপর শিক্ষামন্ত্রী যখন দলীয় কর্মসূচি শেষ করে বেরিয়ে আসেন তখন বিভিন্ন স্তরের বামপন্থি ছাত্র-ছাত্রীরা শিক্ষামন্ত্রীকে ঘিরে বিক্ষোভ দেখাতে থাকেন। শিক্ষামন্ত্রী কোনো অবস্থাতেই ছাত্র-ছাত্রীদের দাবি-দাওয়ার প্রতি ন্যূনতম কর্ণপাত করবার লক্ষণ দেখান না। ছাত্রদের কথা শোনবার জন্য যে নূন্যতম ধৈর্যের প্রয়োজন সেটাও তিনি দেখান না। ছাত্র বিক্ষোভ চলতে থাকে। এই বিক্ষোভ যেমন বিভিন্ন স্তরের বামপন্থি ছাত্র-ছাত্রীরা ছিলেন, ঠিক তেমনি শাসক-শিবিরের শিক্ষক সংগঠনের যে সম্মেলন হয়, তাকে ঘিরে কলকাতা সংলগ্ন বিভিন্ন এলাকার শাসক শিবিরের বিভিন্ন নেতা সমর্থকেরা, যারা কোনো অবস্থাতেই শিক্ষা সংক্রান্ত কোনো বিষয়ের সঙ্গে সংযুক্ত নন, তারাও সেখানে সমবেত হয়েছিলেন।

বামপন্থি ছাত্ররা যখন বিক্ষোভ দেখাতে থাকে তখন বহিরাগত তৃণমূলীরা নানাভাবে বিক্ষোভরত বামপন্থি ছাত্রদের প্রতি উস্কানিমূলক আচরণ করতে থাকে। বামপন্থি ছাত্র, যারা ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত এবং নিজেরা ছাত্র কোন অবস্থাতেই তারা অছাত্র নয়, শিক্ষামন্ত্রীর গাড়ি ঘিরে বিক্ষোভ দেখাতে থাকেন। কোনো কোনো ছাত্রনেতা-কর্মী, তারা শিক্ষামন্ত্রীর গাড়িতেও উঠে পড়ে বিক্ষোভ দেখাতে থাকেন। তাদের একটিই দাবিÑ অবিলম্বে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের নির্বাচন করতে হবে। এ সম্পর্কে তারা শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনার মুহুর্মুহু দাবি জানাতে থাকে।

এ অবস্থায় শিক্ষামন্ত্রীর গাড়ি অত্যন্ত দ্রুতগতিতে চালু করে দেওয়া হয়। যার জেরে একাধিক ছাত্র গাড়ি থেকে পড়ে যায় এবং ইন্দ্রাণুজ রায় নামক একটি ছাত্র একেবারে শিক্ষামন্ত্রীর গাড়ির চাকার তলায় ঢুকে যায়। আরো একটি ছাত্র, অভিনব, গুরুতরভাবে আহত হয়।

এ ঘটনার কিছুক্ষণ আগেই আহত ইন্দ্রাণুজ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটে কিভাবে একই সঙ্গে তৃণমূল এবং আরএসএসের কর্মী, সমর্থকেরা অবরোধ তৈরি করেছে, সে সম্পর্কে একটি সমাজ মাধ্যমে পোস্টও দিয়েছিলেন। ইন্দ্রাণুজ এবং আরেকটি ছাত্র অভিনব গুরুতরভাবে আহত হন। ইন্দ্রাণুজ গুরুতরভাবে আঘাত পান চোখে। অভিনব আঘাত পান পায়ে।

ব্রাত্য বসুর পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে যাননি। তিনি গিয়েছিলেন, তার দলের শিক্ষক সংগঠনের নেতা হিসেবে। তাহলে যদি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি শিক্ষক সংগঠনের নেতা হিসেবেই গিয়ে থাকেন, তাহলে কেন একদল ছাত্রের স্মারকলিপি তিনি গ্রহণ করলেন? এক ব্যক্তি, তিনি যদি একাধারে রাজ্যের মন্ত্রী এবং দলীয় নেতা হন, তাহলে তার এক একটা জায়গায়, এক একটা সত্তা বিকশিত হবে?

ইন্দ্রাণুজ একদা বুদ্ধবাবুর প্রতি রাজনৈতিক সমর্থন জানায়নি বলে কি তাকে হত্যার চেষ্টার ছাড়পত্র পেয়ে যায় রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী? প্রসঙ্গত একটা কথা বলতে হয়; একটা সময় বামফ্রন্ট সরকারকে উৎখাত করতে বিজেপি- আরএসএসের সহযোগিতা নিয়ে বহু ঘোষিত, স্বঘোষিত অতি বামেদের তৃণমূল কংগ্রেস কাজে লাগিয়েছিল। সেইসব স্বঘোষিত অতিবামেরা এখন শাসক শিবিরের কোলে দোল খাচ্ছেন। বহু ক্ষেত্রে শাসক শিবিরের অনুগ্রহ পেয়ে তারা শাঁসে-জলে ফুলে-ফেপে উঠছেন।

তা সত্ত্বেও মানবিকতার খাতিরে বলতে হয়; আমার শত্রু শিবিরের একজন মানুষও যদি শাসকের ষড়যন্ত্রে মৃত্যুর মুখোমুখি হয়, আমি কি সেই মানুষটির প্রতি আমার সহমর্মিতার হাত, ভালোবাসার হাত, শুশ্রƒষার হাত বাড়িয়ে দেব না?

শাসক শিবির থেকে অভিযোগ তোলা হচ্ছে, শিক্ষামন্ত্রী সময়ের কি দাম নেই? হঠাৎ করে একদল ছাত্র গিয়ে পড়লো, আর শিক্ষামন্ত্রীকে তাদের সঙ্গে কথা বলতে হবে? দেখা করতে হবে?

আসলে শাসক তৃণমূল কংগ্রেস, নিজেরা কিভাবে নিজেদের মিথ্যাচারের জালে আটকে পড়ে তা বুঝতে পারা যায় তাদের কর্মপদ্ধতির মধ্যে দিয়েই। জ্যোতি বসু তখন মুখ্যমন্ত্রী, রাজ্য প্রশাসনের সদর দপ্তর রাইটার্স বিল্ডিংসে, তৎকালীন কংগ্রেস নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, এক রমণীকে নিয়ে গিয়ে হঠাৎ করে দাবি করে বসলেন; তিনি মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর সঙ্গে দেখা করতে চান।

কখনো কোন অবস্থাতেই একজন শীর্ষ প্রশাসনিক ব্যক্তি তার পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচি বাতিল করে দেখা করতে পারেন না প্রশাসনের সদর দপ্তরে। অথচ এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে সেই সময় প্রচন্ড রাজনৈতিক মাইলেজ পাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এই ঘটনার কথা তিনি এখনো তার রাজনৈতিক জীবনে একটি সাফল্য বলে উল্লেখ করে থাকেন।

তাহলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যদি সেদিন কোনোরকম পূর্বনির্ধারিত সময় স্থির না করে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে থাকতে পারেন, আর আজ মুখ্যমন্ত্রী নন, তার শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্ররা দেখা করতে গেলেই মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে গেল?

তৃণমূল কংগ্রেসের ভয়াবহ দুর্নীতি স্বজনপোষণ এবং ভ্রান্ত শিক্ষানীতির দরুন আজ পশ্চিমবঙ্গে সরকার পোষিত স্কুলগুলো কার্যত অচল। স্কুল বাড়িগুলো পড়ে আছে। বহু ক্ষেত্রে স্থানীয় লোকজনেরা সেসব স্কুল বাড়িকে নিজেদের ঘরবাড়ি হিসেবে ব্যবহার করছে। অথচ সরকারি কোষাগার থেকে মাস্টারমশাইরা বেতন পাচ্ছেন। নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন কিন্তু পঠন-পাঠন সেখানে কার্যত হচ্ছেই না।

প্রাথমিক স্তরের স্কুলগুলো পশ্চিমবঙ্গে এখন প্রায় জাদুঘরে ঠাঁই নিয়েছে। অথচ প্রাথমিকে নিয়োগ হচ্ছে। নিয়োগে কোটি কোটি টাকা দুর্নীতি হচ্ছে। আর সেই দুর্নীতিতে একইসঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেস আর বিজেপি নেতাদের মধ্যে টাকা ভাগাভাগির খবর ইডি সিবিআইয়ের বিভিন্ন চার্জশিটে উঠে আসছে। খবরের কাগজে তা নিয়ে লেখা-লেখি হচ্ছে; কিন্তু কার্যত একটি ব্যক্তিরও শাস্তি হচ্ছে না।

শহরতলীর কলেজগুলো এখন হয়ে গিয়েছে শাসক তৃণমূলের এক একেকটি রাজনৈতিক অফিস। অছাত্রতে ভরে গেছে বেশিরভাগ কলেজে। একটা সময় সাতের দশকে যেরকম ভাবে ডিগ্রি বিতরণ ঘিরে নানা ধরনের বিতর্ক উঠত, বিশেষ করে এলএলবি পরীক্ষা ঘিরে নানা ধরনের বিতর্ক সাতের দশকের শুরুর দিকে শুনতে পাওয়া যেতো, ঠিক সেই পরিস্থিতি আবার পশ্চিমবঙ্গের বুকে উঠে আসতে শুরু করেছে।

[লেখক : ভারতীয় ইতিহাসবিদ]

back to top