alt

উপ-সম্পাদকীয়

আর্থিক খাত নিয়ে অবিমৃষ্যকারী বক্তব্য

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

: রোববার, ১৬ মার্চ ২০২৫

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুরের সরল উক্তি, জোর প্রচেষ্টা সত্ত্বেও কিছু ব্যাংক বাঁচানো যাবে না। কেন বাঁচানো যাবে না? তার উত্তর হচ্ছেÑ কোনো কোনো ব্যাংক থেকে ঋণের ৮৭ শতাংশই নিয়ে গেছে একটি পরিবার, যা আর ফেরত আসবে না। এই ধরনের বক্তব্য নতুন নয়, তিনি গভর্নর হয়েই বলা শুরু করে দিলেন যে, কয়েকটি ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে গেছে। শুরু হলো অস্থিরতা, গ্রাহকদের আমানত তোলার হিড়িক। শাখা ব্যবস্থাপকরা ব্যাংক শাখার দরজা বন্ধ করে গ্রাহকদের চাপ সামাল দেয়ার চেষ্টা করলেন, যারা কোমল হৃদয়ের তারা কান্নাকাটি করে গ্রাহকদের শান্ত রাখার চেষ্টা করলেন।

গভর্নর বললেন উদ্ভূত সমস্যার সমাধানে তিনি কোন ব্যাংককে এক টাকাও দেবেন না। আমানতকারীরা আরও বেশি হতাশ ও আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ল। পরে বাস্তবতা উপলব্ধি করে দুর্বল ব্যাংকগুলোতে টাকা ঢালতে লাগলেন, কিন্তু কাজ হলো না। কারণ আতঙ্ক দূর করা এবং আস্থা ফিরিয়ে আনা সহজ নয়। কীভাবে ব্যাংক থেকে একটি পরিবার টাকা নিয়ে গেল, কারা সহযোগিতা করলÑ এইসব কথা কেউ বলে না। এস আলম পরিবার ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে গেলেও পিস্তল ধরে লুট তো করেনি, নামে-বেনামে ঋণ নিয়েছে। ঋণ প্রদানে অনিয়ম হলেও জামানত থাকার কথা; না থাকলে কেন নেই, অফসাইট-অনসাইট পরিদর্শনে বাংলাদেশ ব্যাংকের অবহেলা ছিল কিনাÑ তা নিয়ে কারো মুখে কোন কথা নেই। সম্প্রতি বলেছেন, দুর্বল ব্যাংকগুলোর ঘুরে দাঁড়াতে পাঁচ থেকে দশ বছর লাগবে।

গভর্নর কথাবার্তায় সুস্থির না হলে ব্যাংকিং জগতে অস্থিরতা লেগেই থাকবে। তফশিলী বা বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর অভিভাবক হচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বিশ্বাসের হেরফের হলে আমানতকারীরা আমানত হারানোর ভয়ে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে। গভর্নর এভাবে কথা বলে ব্যাংকগুলোর ধ্বংসে ইন্ধন জোগাচ্ছেন কেন তা বোঝা যাচ্ছে না। অনেকের ধারণা, গভর্নর সত্য বলছেন। কিন্তু সব সত্য বলা যায় না এবং যায় না বলেই গুরুত্বপূর্ণ পদধারীদের কিছু সত্য গোপন রাখার শপথ পড়ানো হয়।

ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইর সাবেক সভাপতি আবদুল আউয়াল মিন্টু গভর্নরের উপস্থিতিতে যথার্থই বলেছেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক একটু বেশি কথা কয়’। এটা দুর্বল ব্যাংক, ওটা নিচে নেমে গেছেÑ গভর্নরকে এই ধরনের কথা বলা বন্ধ করতেও তিনি অনুরোধ করেছেন।

গত ডিসেম্বর মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ১০.৮৯ শতাংশ। করোনার সময়ও মূল্যস্ফীতি আরও কম ছিল। গভর্নর হয়েই ড. আহসান এইচ মনসুর জোর গলায় বলেছিলেন, ছয় মাসের মধ্যে মূল্যস্ফীতি ৩ বা ৪ শতাংশে কমিয়ে আনা হবে। শ্রীলঙ্কার মূল্যস্ফীতি ৪ শতাংশে নেমে আসায় তিনিও মনে করেছিলেন, মূল্যস্ফীতি কমানো এমন কী বড় কাজ। আওয়ামী লীগ আমলে বড় বড় অর্থীনীতিবিদের মতো তিনিও বিভিন্ন মিডিয়ায় মূল্যস্ফীতি কমানোর নানা প্রক্রিয়া-পদ্ধতির সবক দিতেন।

আওয়ামী লীগের আমলে মূল্যস্ফীতি হ্রাসে অর্থমন্ত্রী ও গভর্নরের ব্যর্থতা সিপিডি প্রতিনিয়ত তুলে ধরত। করোনা-উত্তর বিশ্বে ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের মধ্যেও বহু দেশ তাদের মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনতে সমর্থ হলেও বাংলাদেশ তা পারেনি এবং এর জন্য দেশের প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদরা দায়ী করেছেন আওয়ামী লীগ সরকারের অজ্ঞতাকে। কিন্তু তারা এখন আর আগের মতো সোচ্চার নন।

অন্তর্বর্তী সরকার এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর কেন মূল্যস্ফীতি কমাতে পারছেন না তার ব্যাখ্যা হচ্ছে- আওয়ামী লীগ সব ধ্বংস করে দিয়ে গেছে। প্রশ্ন হচ্ছে, ধ্বংস করে দিলে সারা বিশ্ব তখন বাংলাদেশের উন্নয়ন নিয়ে এত প্রশংসা করত কেন? কেন ধ্বংসের লীলায় মত্ত আওয়ামী লীগ সরকারকে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ঋণ দিতে কার্পণ্য করত না? কেন আওয়ামী লীগ আমলের অনুমোদিত ঋণের চতুর্থ কিস্তি সুশাসন সমৃদ্ধ অন্তর্বর্তী সরকারকে আইএমএফ দিচ্ছে না? অবশ্য এর ব্যাখ্যা অর্থ উপদেষ্টা দিয়েছেনÑ চতুর্থ এবং পঞ্চম কিস্তি একবারেই নেয়া হবে। বর্তমান নীতিনির্ধারকদের আরও একটি অজুহাত রয়েছে, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রকৃত মূল্যস্ফীতি চেপে রাখা হয়েছিল। কিন্তু এখনও যে চেপে রাখা হচ্ছে না তার নিশ্চয়তা দেবে কে? তবে বর্তমান অর্থ উপদেষ্টা একজন প্রাজ্ঞ ব্যক্তি, তিনি জানেন এবং বলেছেনও, বহির্বিশ্বে পণ্যের দাম না কমলে আমদানিনির্ভর কোন দেশে মূল্যস্ফীতি কমানো কঠিন।

বাংলাদেশ ব্যাংক মূল্যস্ফীতি কমানোর নতুন সময়সূচী নির্ধারণ করেছে, এখন বলছে আগামী জুনের মধ্যে মূল্যস্ফীতি ৭ শতাংশে নামিয়ে আনা হবে। মূল্যস্ফীতি হ্রাসে বাংলাদেশ ব্যাংক এত বেশি মনোযোগী হয়েছে যে, জিডিপি প্রবৃদ্ধির গুরুত্ব একেবারেই গৌণ হয়ে গেছে। প্রথম প্রথম বাংলাদেশ ব্যাংক ধারণা করেছিল যে, নীতি সুদহার যত বৃদ্ধি করা হবে মূল্যস্ফীতি তত কমবে। কিন্তু যে দেশে সুঁইটাও বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয় সেই দেশে শুধু নীতি সুদহার দিয়ে মূল্যস্ফীতি কমানোর নিশ্চিত আশ্বাস ফলপ্রসূ হতে পারে না। ৬০ হাজার কোটি টাকা ছাপিয়ে বাজারে ছাড়ার কারণে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে বলে প্রধান উপদেষ্টা ও গভর্নর একসময় এক সুরে কথা বলেছেন। কিন্তু তারাই আবার ছাপানো টাকা দিয়ে গভর্নরের নিরূপিত ‘দেউলিয়া’ ব্যাংকগুলোকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছেন।

মূল্যস্ফীতি কমাতে গিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক দেশের অর্থনীতির অগ্রগতির গলা চেপে ধরছে। বিনিয়োগ নেই, কর্মসংস্থান সৃষ্টির কোন প্রয়াস নেই, ক্রমবর্ধমান কর্মহীন লোকের আহারের ব্যবস্থা নেইÑ একটাই লক্ষ্য বাজার থেকে টাকা কমাতে হবে, মানুষের হাতে টাকা রাখা যাবে না, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমিয়ে জিনিসপত্রের দাম কমাতে হবে। এর ফলে দেশ হবে আফগানিস্তানের মতো, যেখানে অঢেল পণ্য থাকলেও কারো কেনার সামর্থ নেই। আফগানিস্তানে মুদ্রার বিনিময় মূল্য বেড়েছে, দুর্নীতি কমেছে, কর সংগ্রহ বেড়েছে; কিন্তু তারপরও প্রায় ৪০ লাখ মানুষ শুধু রুটি ও চা খেয়ে বেঁচে আছে। ওখানে বেকারত্ব প্রকট। বিগত কয়েক বছরে ধরে দেশটির কোনো প্রবৃদ্ধি নেই। আফগানিস্তানেও ব্যাংক থেকে নগদ অর্থ উত্তোলনের সীমা বেঁধে দেয়া হয়েছে, ব্যাংকগুলোর সামনে লম্বা লাইন।

শীতকালে শাকসবজি অঢেল, সস্তা। মানুষ কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস নিচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংককে বুঝতে হবে, স্থবির অর্থনীতিতে কর্মহীন মানুষের জন্য বাজারে টাকা থাকা, না থাকার মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। কর্ম না থাকলে প্রান্তিক মানুষগুলোর হাতে টাকা আসবে কী করে? বর্তমান গভর্নর বিনিয়োগ চান না, অর্থনীতির সম্প্রসারণ চান না, জিডিপির প্রবৃদ্ধি চান না, শুধু জিনিসপত্রের দাম কমাতে চান। তাই তিনি অনুসরণ করছেন অতি সংকোচনমূলক ঋণনীতি ও বর্ধিত সুদহার। দেশের অরাজকতা ও অতিরিক্ত সুদের কারণে শিল্পে কোন বিনিয়োগ নেই, বন্ধ হচ্ছে কলকারখানা, উন্নয়ন কর্মকা-ে নেমে এসেছে স্থবিরতা। আওয়ামী লীগ আমলের অধিকাংশ প্রকল্পের কাজ মাঝপথে বন্ধ হয়ে আছে। অর্থনৈতিক কর্মকা- এভাবে সংকুচিত হতে থাকলে দেশের জিডিপি করোনাকালের চেয়েও খারাপ হবে। করোনার সময়ও বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছিল ৩.৪৮ শতাংশ, আর চলতি অর্থ বছরে অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে হবে ৪.০ শতাংশ। ‘স্বৈরাচার’ আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রতি বছর ৬ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি হয়েছে। তাই আওয়ামী লীগ সরকারের ধ্বংসপ্রাপ্ত অর্থনীতির কথা কম বলাই বুদ্ধিমানের পরিচায়ক।

সরকার এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের কঠোর মনোভাবের কারণে বেক্সিমকো শিল্প পার্কের আওতায় থাকা ৩১ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১৪টি প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ব্যাংক থেকে অনুমোদিত ঋণছাড় না করায় প্রতিষ্ঠানগুলো তহবিল সংকটে পতিত হয়। শুধু তহবিল সংকট নয়, কাঁচামাল আমদানির ঋণপত্র খোলার সুযোগও ব্যাংকগুলো দেয়নি। ব্যাংকিং ও এলসি সুবিধা ছাড়া দেশি-বিদেশি কোনো ব্যবসা পরিচালনা করা যায় না। ব্যাংকিং কার্যক্রম বন্ধ থাকার কারণে তারা নতুন কোন কার্যাদেশ পায়নি, পুরাতন কার্যাদেশের পণ্য সরবরাহ করতে পারেনি।

শুধু তাই নয়, বাংলাদেশ ফিনান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট বেক্সিমকো গ্রুপ ও তার মালিকদের ব্যক্তিগত ব্যাংক একাউন্টও জব্দ করে রেখেছে। অর্থাৎ কারখানাগুলো বন্ধ করার জন্য যা যা করা দরকার অন্তর্বর্তী সরকার ও ব্যাংক মিলে তাই তাই করেছে। সালমান এফ রহমানকে শাস্তি দিতে গিয়ে ৪০ হাজার শ্রমিক ও তাদের পরিবারের সদস্যদের শাস্তি দেয়া হয়েছে। কিন্তু উৎপাদন আর ব্যবসা না থাকলে বেক্সিমকোর গৃহীত ঋণ পরিশোধ হবে কী করে? ব্যবসা অব্যাহত রাখার জন্য বসুন্ধরা গ্রুপকে যে সব সুযোগ-সুবিধা দেয়া হয়েছে সেই সব সুযোগ-সুবিধা বেক্সিমকোকে দেয়া হলে এতগুলো কারখানা বন্ধ হতো না। মনে রাখা দরকার, ব্যবসায়ী হওয়া সহজ, শিল্পপতি হওয়া সহজ নয়। শিল্পকারখানায় প্রচুর ঝুঁকি আছে, ঝুঁকি আছে বলেই বাংলাদেশে কার্যরত বিদেশি ব্যাংকগুলো শিল্পকারখানা প্রতিষ্ঠায় ঋণ দেয় না।

ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ নিয়ে পাচার করা অর্থ ফেরত আনার চেষ্টা অন্তর্বর্তী সরকার করে যাচ্ছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বহুবার পাচার করা অর্থ ফেরত আনার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। কিন্তু অর্থ ফেরত আনার অগ্রগতি সম্পর্কে নতুন কোন তথ্য বহুদিন শোনা যাচ্ছে না। অর্থ ফেরত আনার বিপ্লব একসময় থেমেও যেতে পারে। পাচার করা অর্থ দ্রুত ফেরত আনা দরকার, কিন্তু অর্থ পাচারের কথা বলে কারো প্রতিষ্ঠিত শিল্পকারখানা ধ্বংসের নীতি জাতীয় স্বার্থের অনুকূল নয়। অর্থ পাচার শুধু এস আলম এবং সালমান এফ রহমান করেননিÑ পাচার করেছেন হাজার হাজার ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, আমলা, ব্যাংকার, রাজনীতিবিদ, শিল্পী, সাংবাদিক, আইনজীবী, শিক্ষক, ডাক্তার, প্রকৌশলী। আরও আছে, যাদের পেশার নাম আর উল্লেখ করলাম না।

যারা ব্যাংকের ঋণের টাকা পাচার করেছেন তাদের তবুও দায় আছে, ব্যাংকের বালাম বইতে তাদের নাম ও গৃহীত ঋণের পরিমাণ উল্লেখ করা আছে। কিন্তু যারা ঘুষ আর দুর্নীতির অর্থ পাচার করেছেন তাদের কোন দায় নেই, কী পরিমাণ টাকা পাচার করা হয়েছে তার কোন হিসাবও নেই। তাই এস আলম বা সালমান এফ রহমানের চেয়ে ঘুষখোর আর দুর্নীতিবাজদের পাচার করা অর্থের অনুসন্ধান করা বেশি জরুরি। তবে অর্থ পাচার এখনো হচ্ছে, ভবিষ্যতেও হবে। ঘুষ-দুর্নীতি এখনও আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। বড় বড় রাজনৈতিক কর্মসূচির জন্য টাকা লাগে, এই টাকার জোগান দেয় ব্যবসায়ী আর শিল্পপতি, তাই প্রত্যেকটি গণতান্ত্রিক সরকার ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজ ও অর্থ পাচারকারী ব্যবসায়ী এবং শিল্পপতির আশ্রয়দাতা। রাজনৈতিক দলের ঘুষ আর দুর্নীতি বন্ধ না হলে আমলার ঘুষ, দুর্নীতি আর অর্থ পাচার বন্ধ হবে না।

খেলাপি ঋণ আদায়ে ব্যাংক এত বেশি মনোযোগী হয়ে উঠেছে যে, ব্র্যাক ব্যাংকের দায়ের করা মামলায় মৃত স্বামীর ঋণের দায়ে তিন এতিম শিশুসন্তানের মাকে কারাগারে যেতে হয়েছে। একসময় সার্টিফিকেট কেসে কৃষকদের রশি দিয়ে বেঁধে থানায় নিয়ে আসা হতো, এখন দেখছি ব্র্যাক ব্যাংক তাই করল। ফজলে হাসান আবেদ আজীবন গরিবদের জীবনমান উন্নয়নে কাজ করে গেছেন, এখন তার গড়া প্রতিষ্ঠান নিরপরাধ নারীদের নিপীড়ন করছে।

ব্যাংক এবং খেলাপি ঋণ নিয়ে মিডিয়ায় যেভাবে অপ্রয়োজনীয় আতঙ্ক তৈরি করা হয়েছে তাতে ব্যাংকগুলোর সৎ কর্মকর্তারা ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের ঋণ প্রদানে আর আগ্রহান্বিত হবে না। তাই বোধ হয় তপশীলি ব্যাংকগুলো ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের ঋণ না দিয়ে বেশি সুদের ট্রেজারি বন্ড কিনে সরকারকে ঋণ দিচ্ছে। বিস্ময় লাগে, অন্তর্বর্তী সরকার ১২ শতাংশের বেশি সুদে ট্রেজারি বন্ড বিক্রি করে ঋণ নিচ্ছে! মনে হচ্ছে বিকল্প নেই, রাজস্ব আদায় বাড়ছে না, বরং কমে গেছে। সরকারকে দেউলিয়া হওয়া চলবে না, তাই ঋণ নিতেই হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক ঠিকই জানে, আমানতের সুদহার বেশি হওয়ায় শেয়ারবাজারে ধস নেমেছে। তাই রপ্তানি এবং রেমিট্যান্সের বৃদ্ধি সত্ত্বেও দেশে ভিক্ষুক বাড়ছে, ক্ষুধা বাড়ছে, যতই দিন যাচ্ছে টিসিবির কম মূল্যের পণ্যের জন্য নি¤œ ও মধ্যবিত্তের মানুষের লাইন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে, সেনাবাহিনীর উপস্থিতিতে পুলিশের রেশনের স্টোর লুট হচ্ছে, যৌনকর্মীর সংখ্যাও বাড়ছে। দেশের অর্থনীতির যেভাবে কণ্ঠরোধ হচ্ছে তাতে হয়তো কিছুদিন পর অন্তর্বর্তী সরকারের মুখ্য কাজ হবে চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষের পুনরাবৃত্তি ঠেকানো।

বাংলাদেশের সার্বিক অর্থনীতি ভালো নয়, মাত্রাতিরিক্ত সংকোচনমূলক অর্থনীতি বিদ্যমান সংকটকে আরও তীব্রতর করে তুলবে। বিগত পনের বছরে সব ধ্বংস করে দেয়া হয়েছেÑ এই কথা দীর্ঘদিন চালানো যাবে বলে মনে হয় না। কারণ বিচারক শুধু বই পড়া অর্থনীতিবিদ নন, বিচারক শ্রমজীবী সাধারণ মানুষও বটে।

[লেখক: সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক]

রূপকথার মতো মনে হলেও তিনি ছিলেন বাস্তবেরই নায়ক

গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আইন প্রতিষ্ঠার জন্য মুক্ত মত প্রকাশের গুরুত্ব

নিরাপদ অভিবাসন ও রেমিট্যান্স প্রবাহ

ভারতব্যাপী সংঘ : বিজেপির নয়া কৌশল

ভূমিকম্পের আগেই ব্যবস্থা নিতে হবে

নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধ করতেই হবে

মনে কী দ্বিধা রেখে নতুন প্রত্যাশায় নতুন দল!

ছবি

উন্নত বিশ্বের নাগরিকত্ব ও দুর্নীতি

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় : শিক্ষামন্ত্রীর গাড়ির নিচে ছাত্র

নারীর অধিকার, সমতা, ক্ষমতায়ন

আদালতের ভেতরে ভিডিও ধারণের আইনি দিক

আইনের শাসন না গণপিটুনি?

নারীর ভূমি ও কৃষি অধিকার : ন্যায়বিচারের পথে কতদূর?

রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের হালচাল

জনতুষ্টিবাদীরা এগিয়ে আছে যেদিক থেকে

ভিক্ষাবৃত্তি : প্রয়োজন নাকি পেশা?

ছবি

বিনিময় কৌশল নাকি বাণিজ্য যুদ্ধ?

শিশু আদালতের বিচার-প্রক্রিয়ার আইনি ও বাস্তবিক দিক

জনদুর্ভোগের অপসংস্কৃতি ও জনশিক্ষা : আগামীর দিকনির্দেশনা

প্রসঙ্গ : নেপাল থেকে বিদ্যুৎ আমদানি

হরিজনদের পদবি : ঐক্যের পথে বাধা

এল নিনো : দেশের কৃষির চ্যালেঞ্জ ও করণীয়

আর কীভাবে আর্জি জানালে নিরাপত্তা পাওয়া যায়?

স্বপ্ন ভাঙল সাঁওতাল মুংলু বেসরার

কোনো স্কুলই খারাপ না

ঢাকার যানজটের টেকসই সমাধান কী

বই কেন পড়বেন

ডায়াবেটিসের জটিলতা বাড়ায় তামাক ও ধূমপান

জাতীয় বিমা দিবস

পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থা

ভাষা আন্দোলনে অংশ নেয়া ভুল হয়ে থাকলে মুক্তিযুদ্ধে জামায়াতের ভূমিকা সঠিক ছিল!

শিক্ষার গুণগত মান পরিবর্তনে শিক্ষকের মূল্যায়ন

দেশে প্রোগ্রামিংয়ের চ্যালেঞ্জ ও বাস্তবতা

তর্কে সময়, সামর্থ্য এবং শক্তির অপচয় রোধ করুন

পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও দেশপ্রেমে জাতীয় অগ্রগতি

শিক্ষার মানোন্নয়নে প্রাথমিকের লেখাপড়ায় সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে

tab

উপ-সম্পাদকীয়

আর্থিক খাত নিয়ে অবিমৃষ্যকারী বক্তব্য

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

রোববার, ১৬ মার্চ ২০২৫

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুরের সরল উক্তি, জোর প্রচেষ্টা সত্ত্বেও কিছু ব্যাংক বাঁচানো যাবে না। কেন বাঁচানো যাবে না? তার উত্তর হচ্ছেÑ কোনো কোনো ব্যাংক থেকে ঋণের ৮৭ শতাংশই নিয়ে গেছে একটি পরিবার, যা আর ফেরত আসবে না। এই ধরনের বক্তব্য নতুন নয়, তিনি গভর্নর হয়েই বলা শুরু করে দিলেন যে, কয়েকটি ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে গেছে। শুরু হলো অস্থিরতা, গ্রাহকদের আমানত তোলার হিড়িক। শাখা ব্যবস্থাপকরা ব্যাংক শাখার দরজা বন্ধ করে গ্রাহকদের চাপ সামাল দেয়ার চেষ্টা করলেন, যারা কোমল হৃদয়ের তারা কান্নাকাটি করে গ্রাহকদের শান্ত রাখার চেষ্টা করলেন।

গভর্নর বললেন উদ্ভূত সমস্যার সমাধানে তিনি কোন ব্যাংককে এক টাকাও দেবেন না। আমানতকারীরা আরও বেশি হতাশ ও আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ল। পরে বাস্তবতা উপলব্ধি করে দুর্বল ব্যাংকগুলোতে টাকা ঢালতে লাগলেন, কিন্তু কাজ হলো না। কারণ আতঙ্ক দূর করা এবং আস্থা ফিরিয়ে আনা সহজ নয়। কীভাবে ব্যাংক থেকে একটি পরিবার টাকা নিয়ে গেল, কারা সহযোগিতা করলÑ এইসব কথা কেউ বলে না। এস আলম পরিবার ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে গেলেও পিস্তল ধরে লুট তো করেনি, নামে-বেনামে ঋণ নিয়েছে। ঋণ প্রদানে অনিয়ম হলেও জামানত থাকার কথা; না থাকলে কেন নেই, অফসাইট-অনসাইট পরিদর্শনে বাংলাদেশ ব্যাংকের অবহেলা ছিল কিনাÑ তা নিয়ে কারো মুখে কোন কথা নেই। সম্প্রতি বলেছেন, দুর্বল ব্যাংকগুলোর ঘুরে দাঁড়াতে পাঁচ থেকে দশ বছর লাগবে।

গভর্নর কথাবার্তায় সুস্থির না হলে ব্যাংকিং জগতে অস্থিরতা লেগেই থাকবে। তফশিলী বা বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর অভিভাবক হচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বিশ্বাসের হেরফের হলে আমানতকারীরা আমানত হারানোর ভয়ে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে। গভর্নর এভাবে কথা বলে ব্যাংকগুলোর ধ্বংসে ইন্ধন জোগাচ্ছেন কেন তা বোঝা যাচ্ছে না। অনেকের ধারণা, গভর্নর সত্য বলছেন। কিন্তু সব সত্য বলা যায় না এবং যায় না বলেই গুরুত্বপূর্ণ পদধারীদের কিছু সত্য গোপন রাখার শপথ পড়ানো হয়।

ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইর সাবেক সভাপতি আবদুল আউয়াল মিন্টু গভর্নরের উপস্থিতিতে যথার্থই বলেছেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক একটু বেশি কথা কয়’। এটা দুর্বল ব্যাংক, ওটা নিচে নেমে গেছেÑ গভর্নরকে এই ধরনের কথা বলা বন্ধ করতেও তিনি অনুরোধ করেছেন।

গত ডিসেম্বর মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ১০.৮৯ শতাংশ। করোনার সময়ও মূল্যস্ফীতি আরও কম ছিল। গভর্নর হয়েই ড. আহসান এইচ মনসুর জোর গলায় বলেছিলেন, ছয় মাসের মধ্যে মূল্যস্ফীতি ৩ বা ৪ শতাংশে কমিয়ে আনা হবে। শ্রীলঙ্কার মূল্যস্ফীতি ৪ শতাংশে নেমে আসায় তিনিও মনে করেছিলেন, মূল্যস্ফীতি কমানো এমন কী বড় কাজ। আওয়ামী লীগ আমলে বড় বড় অর্থীনীতিবিদের মতো তিনিও বিভিন্ন মিডিয়ায় মূল্যস্ফীতি কমানোর নানা প্রক্রিয়া-পদ্ধতির সবক দিতেন।

আওয়ামী লীগের আমলে মূল্যস্ফীতি হ্রাসে অর্থমন্ত্রী ও গভর্নরের ব্যর্থতা সিপিডি প্রতিনিয়ত তুলে ধরত। করোনা-উত্তর বিশ্বে ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের মধ্যেও বহু দেশ তাদের মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনতে সমর্থ হলেও বাংলাদেশ তা পারেনি এবং এর জন্য দেশের প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদরা দায়ী করেছেন আওয়ামী লীগ সরকারের অজ্ঞতাকে। কিন্তু তারা এখন আর আগের মতো সোচ্চার নন।

অন্তর্বর্তী সরকার এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর কেন মূল্যস্ফীতি কমাতে পারছেন না তার ব্যাখ্যা হচ্ছে- আওয়ামী লীগ সব ধ্বংস করে দিয়ে গেছে। প্রশ্ন হচ্ছে, ধ্বংস করে দিলে সারা বিশ্ব তখন বাংলাদেশের উন্নয়ন নিয়ে এত প্রশংসা করত কেন? কেন ধ্বংসের লীলায় মত্ত আওয়ামী লীগ সরকারকে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ঋণ দিতে কার্পণ্য করত না? কেন আওয়ামী লীগ আমলের অনুমোদিত ঋণের চতুর্থ কিস্তি সুশাসন সমৃদ্ধ অন্তর্বর্তী সরকারকে আইএমএফ দিচ্ছে না? অবশ্য এর ব্যাখ্যা অর্থ উপদেষ্টা দিয়েছেনÑ চতুর্থ এবং পঞ্চম কিস্তি একবারেই নেয়া হবে। বর্তমান নীতিনির্ধারকদের আরও একটি অজুহাত রয়েছে, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রকৃত মূল্যস্ফীতি চেপে রাখা হয়েছিল। কিন্তু এখনও যে চেপে রাখা হচ্ছে না তার নিশ্চয়তা দেবে কে? তবে বর্তমান অর্থ উপদেষ্টা একজন প্রাজ্ঞ ব্যক্তি, তিনি জানেন এবং বলেছেনও, বহির্বিশ্বে পণ্যের দাম না কমলে আমদানিনির্ভর কোন দেশে মূল্যস্ফীতি কমানো কঠিন।

বাংলাদেশ ব্যাংক মূল্যস্ফীতি কমানোর নতুন সময়সূচী নির্ধারণ করেছে, এখন বলছে আগামী জুনের মধ্যে মূল্যস্ফীতি ৭ শতাংশে নামিয়ে আনা হবে। মূল্যস্ফীতি হ্রাসে বাংলাদেশ ব্যাংক এত বেশি মনোযোগী হয়েছে যে, জিডিপি প্রবৃদ্ধির গুরুত্ব একেবারেই গৌণ হয়ে গেছে। প্রথম প্রথম বাংলাদেশ ব্যাংক ধারণা করেছিল যে, নীতি সুদহার যত বৃদ্ধি করা হবে মূল্যস্ফীতি তত কমবে। কিন্তু যে দেশে সুঁইটাও বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয় সেই দেশে শুধু নীতি সুদহার দিয়ে মূল্যস্ফীতি কমানোর নিশ্চিত আশ্বাস ফলপ্রসূ হতে পারে না। ৬০ হাজার কোটি টাকা ছাপিয়ে বাজারে ছাড়ার কারণে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে বলে প্রধান উপদেষ্টা ও গভর্নর একসময় এক সুরে কথা বলেছেন। কিন্তু তারাই আবার ছাপানো টাকা দিয়ে গভর্নরের নিরূপিত ‘দেউলিয়া’ ব্যাংকগুলোকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছেন।

মূল্যস্ফীতি কমাতে গিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক দেশের অর্থনীতির অগ্রগতির গলা চেপে ধরছে। বিনিয়োগ নেই, কর্মসংস্থান সৃষ্টির কোন প্রয়াস নেই, ক্রমবর্ধমান কর্মহীন লোকের আহারের ব্যবস্থা নেইÑ একটাই লক্ষ্য বাজার থেকে টাকা কমাতে হবে, মানুষের হাতে টাকা রাখা যাবে না, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমিয়ে জিনিসপত্রের দাম কমাতে হবে। এর ফলে দেশ হবে আফগানিস্তানের মতো, যেখানে অঢেল পণ্য থাকলেও কারো কেনার সামর্থ নেই। আফগানিস্তানে মুদ্রার বিনিময় মূল্য বেড়েছে, দুর্নীতি কমেছে, কর সংগ্রহ বেড়েছে; কিন্তু তারপরও প্রায় ৪০ লাখ মানুষ শুধু রুটি ও চা খেয়ে বেঁচে আছে। ওখানে বেকারত্ব প্রকট। বিগত কয়েক বছরে ধরে দেশটির কোনো প্রবৃদ্ধি নেই। আফগানিস্তানেও ব্যাংক থেকে নগদ অর্থ উত্তোলনের সীমা বেঁধে দেয়া হয়েছে, ব্যাংকগুলোর সামনে লম্বা লাইন।

শীতকালে শাকসবজি অঢেল, সস্তা। মানুষ কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস নিচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংককে বুঝতে হবে, স্থবির অর্থনীতিতে কর্মহীন মানুষের জন্য বাজারে টাকা থাকা, না থাকার মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। কর্ম না থাকলে প্রান্তিক মানুষগুলোর হাতে টাকা আসবে কী করে? বর্তমান গভর্নর বিনিয়োগ চান না, অর্থনীতির সম্প্রসারণ চান না, জিডিপির প্রবৃদ্ধি চান না, শুধু জিনিসপত্রের দাম কমাতে চান। তাই তিনি অনুসরণ করছেন অতি সংকোচনমূলক ঋণনীতি ও বর্ধিত সুদহার। দেশের অরাজকতা ও অতিরিক্ত সুদের কারণে শিল্পে কোন বিনিয়োগ নেই, বন্ধ হচ্ছে কলকারখানা, উন্নয়ন কর্মকা-ে নেমে এসেছে স্থবিরতা। আওয়ামী লীগ আমলের অধিকাংশ প্রকল্পের কাজ মাঝপথে বন্ধ হয়ে আছে। অর্থনৈতিক কর্মকা- এভাবে সংকুচিত হতে থাকলে দেশের জিডিপি করোনাকালের চেয়েও খারাপ হবে। করোনার সময়ও বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছিল ৩.৪৮ শতাংশ, আর চলতি অর্থ বছরে অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে হবে ৪.০ শতাংশ। ‘স্বৈরাচার’ আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রতি বছর ৬ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি হয়েছে। তাই আওয়ামী লীগ সরকারের ধ্বংসপ্রাপ্ত অর্থনীতির কথা কম বলাই বুদ্ধিমানের পরিচায়ক।

সরকার এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের কঠোর মনোভাবের কারণে বেক্সিমকো শিল্প পার্কের আওতায় থাকা ৩১ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১৪টি প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ব্যাংক থেকে অনুমোদিত ঋণছাড় না করায় প্রতিষ্ঠানগুলো তহবিল সংকটে পতিত হয়। শুধু তহবিল সংকট নয়, কাঁচামাল আমদানির ঋণপত্র খোলার সুযোগও ব্যাংকগুলো দেয়নি। ব্যাংকিং ও এলসি সুবিধা ছাড়া দেশি-বিদেশি কোনো ব্যবসা পরিচালনা করা যায় না। ব্যাংকিং কার্যক্রম বন্ধ থাকার কারণে তারা নতুন কোন কার্যাদেশ পায়নি, পুরাতন কার্যাদেশের পণ্য সরবরাহ করতে পারেনি।

শুধু তাই নয়, বাংলাদেশ ফিনান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট বেক্সিমকো গ্রুপ ও তার মালিকদের ব্যক্তিগত ব্যাংক একাউন্টও জব্দ করে রেখেছে। অর্থাৎ কারখানাগুলো বন্ধ করার জন্য যা যা করা দরকার অন্তর্বর্তী সরকার ও ব্যাংক মিলে তাই তাই করেছে। সালমান এফ রহমানকে শাস্তি দিতে গিয়ে ৪০ হাজার শ্রমিক ও তাদের পরিবারের সদস্যদের শাস্তি দেয়া হয়েছে। কিন্তু উৎপাদন আর ব্যবসা না থাকলে বেক্সিমকোর গৃহীত ঋণ পরিশোধ হবে কী করে? ব্যবসা অব্যাহত রাখার জন্য বসুন্ধরা গ্রুপকে যে সব সুযোগ-সুবিধা দেয়া হয়েছে সেই সব সুযোগ-সুবিধা বেক্সিমকোকে দেয়া হলে এতগুলো কারখানা বন্ধ হতো না। মনে রাখা দরকার, ব্যবসায়ী হওয়া সহজ, শিল্পপতি হওয়া সহজ নয়। শিল্পকারখানায় প্রচুর ঝুঁকি আছে, ঝুঁকি আছে বলেই বাংলাদেশে কার্যরত বিদেশি ব্যাংকগুলো শিল্পকারখানা প্রতিষ্ঠায় ঋণ দেয় না।

ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ নিয়ে পাচার করা অর্থ ফেরত আনার চেষ্টা অন্তর্বর্তী সরকার করে যাচ্ছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বহুবার পাচার করা অর্থ ফেরত আনার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। কিন্তু অর্থ ফেরত আনার অগ্রগতি সম্পর্কে নতুন কোন তথ্য বহুদিন শোনা যাচ্ছে না। অর্থ ফেরত আনার বিপ্লব একসময় থেমেও যেতে পারে। পাচার করা অর্থ দ্রুত ফেরত আনা দরকার, কিন্তু অর্থ পাচারের কথা বলে কারো প্রতিষ্ঠিত শিল্পকারখানা ধ্বংসের নীতি জাতীয় স্বার্থের অনুকূল নয়। অর্থ পাচার শুধু এস আলম এবং সালমান এফ রহমান করেননিÑ পাচার করেছেন হাজার হাজার ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, আমলা, ব্যাংকার, রাজনীতিবিদ, শিল্পী, সাংবাদিক, আইনজীবী, শিক্ষক, ডাক্তার, প্রকৌশলী। আরও আছে, যাদের পেশার নাম আর উল্লেখ করলাম না।

যারা ব্যাংকের ঋণের টাকা পাচার করেছেন তাদের তবুও দায় আছে, ব্যাংকের বালাম বইতে তাদের নাম ও গৃহীত ঋণের পরিমাণ উল্লেখ করা আছে। কিন্তু যারা ঘুষ আর দুর্নীতির অর্থ পাচার করেছেন তাদের কোন দায় নেই, কী পরিমাণ টাকা পাচার করা হয়েছে তার কোন হিসাবও নেই। তাই এস আলম বা সালমান এফ রহমানের চেয়ে ঘুষখোর আর দুর্নীতিবাজদের পাচার করা অর্থের অনুসন্ধান করা বেশি জরুরি। তবে অর্থ পাচার এখনো হচ্ছে, ভবিষ্যতেও হবে। ঘুষ-দুর্নীতি এখনও আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। বড় বড় রাজনৈতিক কর্মসূচির জন্য টাকা লাগে, এই টাকার জোগান দেয় ব্যবসায়ী আর শিল্পপতি, তাই প্রত্যেকটি গণতান্ত্রিক সরকার ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজ ও অর্থ পাচারকারী ব্যবসায়ী এবং শিল্পপতির আশ্রয়দাতা। রাজনৈতিক দলের ঘুষ আর দুর্নীতি বন্ধ না হলে আমলার ঘুষ, দুর্নীতি আর অর্থ পাচার বন্ধ হবে না।

খেলাপি ঋণ আদায়ে ব্যাংক এত বেশি মনোযোগী হয়ে উঠেছে যে, ব্র্যাক ব্যাংকের দায়ের করা মামলায় মৃত স্বামীর ঋণের দায়ে তিন এতিম শিশুসন্তানের মাকে কারাগারে যেতে হয়েছে। একসময় সার্টিফিকেট কেসে কৃষকদের রশি দিয়ে বেঁধে থানায় নিয়ে আসা হতো, এখন দেখছি ব্র্যাক ব্যাংক তাই করল। ফজলে হাসান আবেদ আজীবন গরিবদের জীবনমান উন্নয়নে কাজ করে গেছেন, এখন তার গড়া প্রতিষ্ঠান নিরপরাধ নারীদের নিপীড়ন করছে।

ব্যাংক এবং খেলাপি ঋণ নিয়ে মিডিয়ায় যেভাবে অপ্রয়োজনীয় আতঙ্ক তৈরি করা হয়েছে তাতে ব্যাংকগুলোর সৎ কর্মকর্তারা ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের ঋণ প্রদানে আর আগ্রহান্বিত হবে না। তাই বোধ হয় তপশীলি ব্যাংকগুলো ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের ঋণ না দিয়ে বেশি সুদের ট্রেজারি বন্ড কিনে সরকারকে ঋণ দিচ্ছে। বিস্ময় লাগে, অন্তর্বর্তী সরকার ১২ শতাংশের বেশি সুদে ট্রেজারি বন্ড বিক্রি করে ঋণ নিচ্ছে! মনে হচ্ছে বিকল্প নেই, রাজস্ব আদায় বাড়ছে না, বরং কমে গেছে। সরকারকে দেউলিয়া হওয়া চলবে না, তাই ঋণ নিতেই হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক ঠিকই জানে, আমানতের সুদহার বেশি হওয়ায় শেয়ারবাজারে ধস নেমেছে। তাই রপ্তানি এবং রেমিট্যান্সের বৃদ্ধি সত্ত্বেও দেশে ভিক্ষুক বাড়ছে, ক্ষুধা বাড়ছে, যতই দিন যাচ্ছে টিসিবির কম মূল্যের পণ্যের জন্য নি¤œ ও মধ্যবিত্তের মানুষের লাইন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে, সেনাবাহিনীর উপস্থিতিতে পুলিশের রেশনের স্টোর লুট হচ্ছে, যৌনকর্মীর সংখ্যাও বাড়ছে। দেশের অর্থনীতির যেভাবে কণ্ঠরোধ হচ্ছে তাতে হয়তো কিছুদিন পর অন্তর্বর্তী সরকারের মুখ্য কাজ হবে চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষের পুনরাবৃত্তি ঠেকানো।

বাংলাদেশের সার্বিক অর্থনীতি ভালো নয়, মাত্রাতিরিক্ত সংকোচনমূলক অর্থনীতি বিদ্যমান সংকটকে আরও তীব্রতর করে তুলবে। বিগত পনের বছরে সব ধ্বংস করে দেয়া হয়েছেÑ এই কথা দীর্ঘদিন চালানো যাবে বলে মনে হয় না। কারণ বিচারক শুধু বই পড়া অর্থনীতিবিদ নন, বিচারক শ্রমজীবী সাধারণ মানুষও বটে।

[লেখক: সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক]

back to top