alt

মতামত » উপ-সম্পাদকীয়

রূপকথার মতো মনে হলেও তিনি ছিলেন বাস্তবেরই নায়ক

আনোয়ারুল হক

: সোমবার, ১৭ মার্চ ২০২৫

গত ২৪ ফেব্রুয়ারি খুলনা থেকে গাড়িতে ঢাকায় ফিরছিলাম। সঙ্গে আমার স্ত্রীও ছিলেন। মোল্লার হাট পার হওয়ার পর মনে হলো হাতে যেহেতু সময় আছে একবার দেখেই যাই-না বঙ্গবন্ধুর সমাধি সৌধের অবস্থা। বুলডোজার বাহিনী আবার কখন হানা দেয়! ঐতিহাসিক ৭ মার্চ বা মুজিবের জন্মদিন ১৭ মার্চকে কেন্দ্র করে আবার কোনো পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় কিনা। মুজিবকন্যাও আবার তাতে ঘি ঢালেন কিনা! এসব চিন্তা মনে আসছিল।

খুলনা যাওয়া-আসার পথে স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতার সমাধি সৌধে মাঝে মধ্যে যাওয়ার অভ্যাস আগে থেকেই ছিল। তবে আওয়ামী লীগ সরকারে থাকা অবস্থায় অর্থাৎ গত ১৬ বছরে মাত্র একবার গিয়েছি। তখন সমাধিস্থল ঘিরে আওয়ামী লীগ বা তার নেত্রীর তোষামোদকারীদের মুজিব বন্দনার হাস্যকর সব কায়কারবার দেখে খুব একটা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতাম না।

আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে থাকার সময় ২০০১ থেকে ২০০৮ সন পর্যন্ত অনেকবার গিয়েছি। ওই সময়ে বরং সমাধিস্থলে একটা ভাব গম্ভীর পরিবেশ পেতাম। আশপাশের এলাকা অনেকটাই পাড়াগাঁও মনে হতো। সমাধিসৌধের কর্মচারীদের সরকারি বেতন বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরেও তারা তাদের কর্তব্যে অনেক আন্তরিক ছিলেন।

এবারের পরিস্থিতিটা একেবারেই ভিন্নতর। চারদিকে সুনসান নীরবতা। সমাধিসৌধের আশপাশে মুজিব পরিবারের আত্মীয়স্বজনদের যত ঘরবাড়ি রয়েছে সবই তালাবদ্ধ। কেউ সেখানে অবস্থান করছেন না। শুধু তাই নয় যাওয়া-আসার পথে মনে হলো সমাধিসৌধের আশপাশে ১-২ কিলোমিটার এলাকাই অনেকটা বিরাণভূমি। রাস্তায় কোনও জনমানব চোখে পড়ল না। সৌধে ঢোকার ছোট গেট খোলা পেলাম।

ঢোকার পরে এক প্রতিবন্ধী কিশোরকে দেখলাম দুজন পুলিশের সঙ্গে বসে কথা বলছে। আমাদের কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করল না। আমি এলোমেলো হাঁটাহাঁটি করছি, এবং আমার স্ত্রী কবরে ঢোকার গেটে দাঁড়িয়ে মোনাজাত করছেন এমন সময় মসজিদের ইমাম সাহেব আসেন। তার সঙ্গে কথা বলে জানতে পারলাম কমপ্লেক্সে ৬২ জন কর্মচারী ছিলেন। এখন একজনও নেই। গত আগস্ট মাস থেকে বেতন বন্ধ হয়ে যাওয়া ও নিরাপত্তাহীনতা বোধ করায় সবাই চলে গেছেন। কোনো পুলিশও ছিল না। এক সপ্তাহ যাবত দুইজন করে পুলিশ পালাক্রমে ডিউটি করছেন। তাদের চোখেমুখেও কেমন একটা বিষণœতার ছাপ। ইমাম সাহেব মসজিদ নিয়ে আছেন। তবে অধিকাংশ ওয়াক্তে তিনি ছাড়া নামাজ পড়ার মতো কেউ থাকে না। আলাপচারিতায় ইমাম সাহেবও আক্ষেপ করে বললেন, ‘কেনো যে শেখ হাসিনা সব বিষয়ে এত বাড়াবাড়ি করলেন!’ আমার মনে হলো শেখ পরিবারের গ-ির মধ্যে থেকেও ইমাম সাহেব যা বুঝেছেন আওয়ামী লীগের নেতারা এবং তাদের নেত্রী কি তার কিছুই বুঝতে পারছেন না। আছে কি তাদের কোনো অনুতাপ, অনুশোচনা কিংবা অপরাধবোধ। বরং তারা এখনো পলাতক অবস্থায় হুমকিধামকি দিয়ে যাচ্ছেন।

শেখ হাসিনার নিজের করা অপরাধগুলোর ছায়ায় তারই পিতা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের অবিসংবাদিত নেতার স্মৃতি এখন ঢাকা পড়ে গেছে। শেখ মুজিবুর রহমানকে নিজের ও আওয়ামী লীগের নিজস্ব সম্পত্তি বানিয়ে তিনি মুজিবের প্রতি অবিচার করেছেন; নিজেকে তার একমাত্র উত্তরাধিকারী বানিয়ে ও সারা দেশকে তার কাছ থেকে দূরে ঠেলে দিয়ে তিনি মুজিবের প্রতি অবিচার করেছেন।মুজিবের স্মৃতিকে আজ তারই কন্যার অপরাধের মূল্য দিতে হচ্ছে।

অন্যদিকে যারাই মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি, আকাক্সক্ষা, আবেগ ইত্যাদি নিয়ে কিছু বলছেন সরকারের উপদেষ্টাসহ বিশেষ একটি গোষ্ঠী কতৃক তাদের সবাইকে ‘আওয়ামী লীগ পুনর্বাসনের’ অথবা ‘মুজিববাদী’ তকমা দিয়ে দেয়া হচ্ছে। মুজিববাদ বলতে ওনারা কী বুঝাতে চাইছেন সেটা খুব পরিষ্কার নয়। আওয়ামী লীগ তো তার নীতি-আদর্শে মুজিববাদ হিসেবে কিছু উল্লেখ করেনি। তবে ওনারা যখন বলেন মুজিববাদী সংবিধান বাতিল করতে হবে, তখন বোঝা যায় সংবিধানকে ‘কামালবাদী’ না বলে মুজিববাদী বলছেন কেন। সংবিধান সংস্কার প্রশ্নে, বারবার কাটাছেঁড়া করে যুক্ত অগণতান্ত্রিক ধারাসমূহ বিলোপের প্রশ্নে কেউই আপত্তি করছেন না। কিন্তু তারা চান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত সংবিধানের মূলনীতি-আদর্শের বিলোপ। অর্থাৎ ঘুরেফিরে তাদের লক্ষ্য মুক্তিযুদ্ধকে আক্রমণ করা।

তারপরেও অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা আসিফ নজরুলের একটা লেখনী মনে অনেক সাহস জুগিয়েছে বর্তমান পরিস্থিতিতে মুজিব সমাধিসৌধে যেতে। তিনি লিখেছিলেন, “প্রিয় বঙ্গবন্ধু,/ আমি আপনাকে ভালোবাসি/ আপনাকে ভালোবাসতে হলে আওয়ামী লীগ হতে হয় না... / আপনাকে ভালোবাসতে হলে লাগে কিছুটা বিবেক/ কিছুটা যুক্তিবোধ, নিজের মানচিত্র চেনা/ আর সামান্য একটু মনুষ্যত্ববোধ...”

স্বাধীন বাংলা দেশে রাষ্ট্র পরিচালনায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নানা পদক্ষেপ এবং এক পর্যায়ে গণতন্ত্রকে সংকুচিত করে আনা, বাকশাল গঠন ইত্যাদি কারণে তিনি সমালোচিত হন এবং তার বিশাল ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এসব ভিন্ন আলোচনা। সেসব আলোচনায় না গিয়ে তিনি যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতা ছিলেন এ বিষয়ে কোনো বিতর্ক সাধারণভাবে নেই। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে শেখ মুজিবের ভূমিকা ছিল অনেকটা সর্বপ্লাবী।

তবে স্বাধীনতা সংগ্রামে যেমন আরো অনেক পার্শ্বচরিত্র আছে তেমনি আছে বৈচিত্র্যময় নানা পর্ব ও উপাদান। আছে বাংলাদেশের মানুষের অকুতোভয় লড়াই আর সীমাহীন আত্মত্যাগের ইতিহাস। সবকিছু বাদ দিয়ে গোটা সংগ্রামকে এবং পরবর্তীতে গোটা দেশকে শুধুই মুজিবময় করে তোলার প্রয়াস মানুষ ভালোভাবে নেয়নি। সেটাকে কাজে লাগিয়ে আজকের পরিস্থিতিতে একটি গোষ্ঠী যাদের কতৃত্ববাদী হাসিনা বা আওয়ামী দুঃশাসন অপেক্ষা ’৭১ বা মুক্তিযুদ্ধের ওপর আক্রোশ বেশি; কিন্তু মুখ ফুটে বলতে পারছেন নাÑ তারাই মুক্তিযুদ্ধের নায়ক মুজিবকে নিয়ে টানাহেঁচড়া করে মনের ঝাল মেটাচ্ছেন!

১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ কিংবা যুদ্ধের নায়ককে পাশ কাটিয়ে যেমন ইতিহাসকে অগ্রসর করা যাবে না তেমনি বাংলাদেশের ইতিহাসকে এককেন্দ্রিক না করে এর বহুমাত্রিক বিশ্লেষণও জরুরি এবং ইতিহাসবিদরা তা নিশ্চয়ই করবেন। এখনকার টুঙ্গিপাড়া দেখলেও আঁচ করা যায় শত বছর আগে কোন এক অজো গ্রামের সাধারণ এক পরিবারে জন্ম নিয়েছিলেন মুজিব।

সেখান থেকে উঠে এসে রূপকথার নায়কের মতো ইতিহাসের নানা পথপরিক্রমা পার করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে এমন এক বিশাল গগণচুম্বি ভূমিকায় অবতীর্ণ হন যে তার ভূমিকা কেন্দ্রীয় ও চূড়ান্ত হয়ে ওঠে। ১৭ মার্চ তার জন্মদিনে রইল শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।

[লেখক : সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন]

প্রাণিসম্পদ: দেশীয় জাত, আধুনিক প্রযুক্তি

জমির জরিপ: ন্যায়বিচার প্রসঙ্গ

বুদ্ধিজীবী হত্যা ও এর স্বরূপ সন্ধানে

উন্নয়নের আড়ালে রোগীর ভোগান্তি: আস্থা সংকটে স্বাস্থ্যসেবা

ছবি

শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস: অমিত শক্তির উৎস

ছবি

বেগম রোকেয়া এখনো জাগ্রত

পশ্চিমবঙ্গ: বামপন্থীদের ‘বাংলা বাঁচাও’-এর ডাক

সবার বাংলাদেশ কবে প্রতিষ্ঠিত হবে?

বিদেশি বিনিয়োগ : প্রয়োজন আইনের শাসন ও সামাজিক স্থিতি

চিকিৎসা যখন অসহনীয় ব্যয়, তখন প্রতিবাদই ন্যায়

মস্কোর কৌশলগত পুনর্গঠন

“সব শিয়ালের এক রা’ মারা গেল কুমিরের ছা”

ছবি

বিচূর্ণ দর্পণের মুখ

নিজের চেতনায় নিজেরই ঘা দেয়া জরুরি

ঋণ অবলোপনের প্রভাব

ভেজাল গুড়ের মরণফাঁদ: বাঙালির ঐতিহ্য, জনস্বাস্থ্য ও আস্থার নীরব বিপর্যয়

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস

জোটের ভোট নাকি ভোটের জোট, কৌশলটা কী?

প্রমাণ তো করতে হবে আমরা হাসিনার চেয়ে ভালো

ছবি

কৃষি ডেটা ব্যবস্থাপনা

যুক্তরাজ্যে ভর্তি স্থগিতের কুয়াশা: তালা লাগলেও চাবি আমাদের হাতে

শিক্ষকদের কর্মবিরতি: পেশাগত নৈতিকতা ও দায়িত্ববোধ

জাতীয় রক্তগ্রুপ নির্ণয় দিবস

জাল সনদপত্রে শিক্ষকতা

সাধারণ চুক্তিগুলোও গোপনীয় কেন

ছবি

শিশুখাদ্যের নিরাপত্তা: জাতির ভবিষ্যৎ সুরক্ষার প্রথম শর্ত

ছবি

ফিনল্যান্ড কেন সুখী দেশ

ছবি

কৃষকের সংকট ও অর্থনীতির ভবিষ্যৎ

আলু চাষের আধুনিক প্রযুক্তি

ই-বর্জ্য: নীরব বিষে দগ্ধ আমাদের ভবিষ্যৎ

ঢাকার জনপরিসর: আর্ভিং গফম্যানের সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ

আলু চাষের আধুনিক প্রযুক্তি

কলি ফুটিতে চাহে ফোটে না!

কৃষিতে স্মার্ট প্রযুক্তি

রোহিঙ্গা সংকটের টেকসই সমাধানে লোকালাইজেশন অপরিহার্য

আইসিইউ থেকে বাড়ি ফেরা ও খাদের কিনারায় থাকা দেশ

tab

মতামত » উপ-সম্পাদকীয়

রূপকথার মতো মনে হলেও তিনি ছিলেন বাস্তবেরই নায়ক

আনোয়ারুল হক

সোমবার, ১৭ মার্চ ২০২৫

গত ২৪ ফেব্রুয়ারি খুলনা থেকে গাড়িতে ঢাকায় ফিরছিলাম। সঙ্গে আমার স্ত্রীও ছিলেন। মোল্লার হাট পার হওয়ার পর মনে হলো হাতে যেহেতু সময় আছে একবার দেখেই যাই-না বঙ্গবন্ধুর সমাধি সৌধের অবস্থা। বুলডোজার বাহিনী আবার কখন হানা দেয়! ঐতিহাসিক ৭ মার্চ বা মুজিবের জন্মদিন ১৭ মার্চকে কেন্দ্র করে আবার কোনো পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় কিনা। মুজিবকন্যাও আবার তাতে ঘি ঢালেন কিনা! এসব চিন্তা মনে আসছিল।

খুলনা যাওয়া-আসার পথে স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতার সমাধি সৌধে মাঝে মধ্যে যাওয়ার অভ্যাস আগে থেকেই ছিল। তবে আওয়ামী লীগ সরকারে থাকা অবস্থায় অর্থাৎ গত ১৬ বছরে মাত্র একবার গিয়েছি। তখন সমাধিস্থল ঘিরে আওয়ামী লীগ বা তার নেত্রীর তোষামোদকারীদের মুজিব বন্দনার হাস্যকর সব কায়কারবার দেখে খুব একটা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতাম না।

আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে থাকার সময় ২০০১ থেকে ২০০৮ সন পর্যন্ত অনেকবার গিয়েছি। ওই সময়ে বরং সমাধিস্থলে একটা ভাব গম্ভীর পরিবেশ পেতাম। আশপাশের এলাকা অনেকটাই পাড়াগাঁও মনে হতো। সমাধিসৌধের কর্মচারীদের সরকারি বেতন বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরেও তারা তাদের কর্তব্যে অনেক আন্তরিক ছিলেন।

এবারের পরিস্থিতিটা একেবারেই ভিন্নতর। চারদিকে সুনসান নীরবতা। সমাধিসৌধের আশপাশে মুজিব পরিবারের আত্মীয়স্বজনদের যত ঘরবাড়ি রয়েছে সবই তালাবদ্ধ। কেউ সেখানে অবস্থান করছেন না। শুধু তাই নয় যাওয়া-আসার পথে মনে হলো সমাধিসৌধের আশপাশে ১-২ কিলোমিটার এলাকাই অনেকটা বিরাণভূমি। রাস্তায় কোনও জনমানব চোখে পড়ল না। সৌধে ঢোকার ছোট গেট খোলা পেলাম।

ঢোকার পরে এক প্রতিবন্ধী কিশোরকে দেখলাম দুজন পুলিশের সঙ্গে বসে কথা বলছে। আমাদের কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করল না। আমি এলোমেলো হাঁটাহাঁটি করছি, এবং আমার স্ত্রী কবরে ঢোকার গেটে দাঁড়িয়ে মোনাজাত করছেন এমন সময় মসজিদের ইমাম সাহেব আসেন। তার সঙ্গে কথা বলে জানতে পারলাম কমপ্লেক্সে ৬২ জন কর্মচারী ছিলেন। এখন একজনও নেই। গত আগস্ট মাস থেকে বেতন বন্ধ হয়ে যাওয়া ও নিরাপত্তাহীনতা বোধ করায় সবাই চলে গেছেন। কোনো পুলিশও ছিল না। এক সপ্তাহ যাবত দুইজন করে পুলিশ পালাক্রমে ডিউটি করছেন। তাদের চোখেমুখেও কেমন একটা বিষণœতার ছাপ। ইমাম সাহেব মসজিদ নিয়ে আছেন। তবে অধিকাংশ ওয়াক্তে তিনি ছাড়া নামাজ পড়ার মতো কেউ থাকে না। আলাপচারিতায় ইমাম সাহেবও আক্ষেপ করে বললেন, ‘কেনো যে শেখ হাসিনা সব বিষয়ে এত বাড়াবাড়ি করলেন!’ আমার মনে হলো শেখ পরিবারের গ-ির মধ্যে থেকেও ইমাম সাহেব যা বুঝেছেন আওয়ামী লীগের নেতারা এবং তাদের নেত্রী কি তার কিছুই বুঝতে পারছেন না। আছে কি তাদের কোনো অনুতাপ, অনুশোচনা কিংবা অপরাধবোধ। বরং তারা এখনো পলাতক অবস্থায় হুমকিধামকি দিয়ে যাচ্ছেন।

শেখ হাসিনার নিজের করা অপরাধগুলোর ছায়ায় তারই পিতা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের অবিসংবাদিত নেতার স্মৃতি এখন ঢাকা পড়ে গেছে। শেখ মুজিবুর রহমানকে নিজের ও আওয়ামী লীগের নিজস্ব সম্পত্তি বানিয়ে তিনি মুজিবের প্রতি অবিচার করেছেন; নিজেকে তার একমাত্র উত্তরাধিকারী বানিয়ে ও সারা দেশকে তার কাছ থেকে দূরে ঠেলে দিয়ে তিনি মুজিবের প্রতি অবিচার করেছেন।মুজিবের স্মৃতিকে আজ তারই কন্যার অপরাধের মূল্য দিতে হচ্ছে।

অন্যদিকে যারাই মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি, আকাক্সক্ষা, আবেগ ইত্যাদি নিয়ে কিছু বলছেন সরকারের উপদেষ্টাসহ বিশেষ একটি গোষ্ঠী কতৃক তাদের সবাইকে ‘আওয়ামী লীগ পুনর্বাসনের’ অথবা ‘মুজিববাদী’ তকমা দিয়ে দেয়া হচ্ছে। মুজিববাদ বলতে ওনারা কী বুঝাতে চাইছেন সেটা খুব পরিষ্কার নয়। আওয়ামী লীগ তো তার নীতি-আদর্শে মুজিববাদ হিসেবে কিছু উল্লেখ করেনি। তবে ওনারা যখন বলেন মুজিববাদী সংবিধান বাতিল করতে হবে, তখন বোঝা যায় সংবিধানকে ‘কামালবাদী’ না বলে মুজিববাদী বলছেন কেন। সংবিধান সংস্কার প্রশ্নে, বারবার কাটাছেঁড়া করে যুক্ত অগণতান্ত্রিক ধারাসমূহ বিলোপের প্রশ্নে কেউই আপত্তি করছেন না। কিন্তু তারা চান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত সংবিধানের মূলনীতি-আদর্শের বিলোপ। অর্থাৎ ঘুরেফিরে তাদের লক্ষ্য মুক্তিযুদ্ধকে আক্রমণ করা।

তারপরেও অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা আসিফ নজরুলের একটা লেখনী মনে অনেক সাহস জুগিয়েছে বর্তমান পরিস্থিতিতে মুজিব সমাধিসৌধে যেতে। তিনি লিখেছিলেন, “প্রিয় বঙ্গবন্ধু,/ আমি আপনাকে ভালোবাসি/ আপনাকে ভালোবাসতে হলে আওয়ামী লীগ হতে হয় না... / আপনাকে ভালোবাসতে হলে লাগে কিছুটা বিবেক/ কিছুটা যুক্তিবোধ, নিজের মানচিত্র চেনা/ আর সামান্য একটু মনুষ্যত্ববোধ...”

স্বাধীন বাংলা দেশে রাষ্ট্র পরিচালনায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নানা পদক্ষেপ এবং এক পর্যায়ে গণতন্ত্রকে সংকুচিত করে আনা, বাকশাল গঠন ইত্যাদি কারণে তিনি সমালোচিত হন এবং তার বিশাল ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এসব ভিন্ন আলোচনা। সেসব আলোচনায় না গিয়ে তিনি যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতা ছিলেন এ বিষয়ে কোনো বিতর্ক সাধারণভাবে নেই। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে শেখ মুজিবের ভূমিকা ছিল অনেকটা সর্বপ্লাবী।

তবে স্বাধীনতা সংগ্রামে যেমন আরো অনেক পার্শ্বচরিত্র আছে তেমনি আছে বৈচিত্র্যময় নানা পর্ব ও উপাদান। আছে বাংলাদেশের মানুষের অকুতোভয় লড়াই আর সীমাহীন আত্মত্যাগের ইতিহাস। সবকিছু বাদ দিয়ে গোটা সংগ্রামকে এবং পরবর্তীতে গোটা দেশকে শুধুই মুজিবময় করে তোলার প্রয়াস মানুষ ভালোভাবে নেয়নি। সেটাকে কাজে লাগিয়ে আজকের পরিস্থিতিতে একটি গোষ্ঠী যাদের কতৃত্ববাদী হাসিনা বা আওয়ামী দুঃশাসন অপেক্ষা ’৭১ বা মুক্তিযুদ্ধের ওপর আক্রোশ বেশি; কিন্তু মুখ ফুটে বলতে পারছেন নাÑ তারাই মুক্তিযুদ্ধের নায়ক মুজিবকে নিয়ে টানাহেঁচড়া করে মনের ঝাল মেটাচ্ছেন!

১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ কিংবা যুদ্ধের নায়ককে পাশ কাটিয়ে যেমন ইতিহাসকে অগ্রসর করা যাবে না তেমনি বাংলাদেশের ইতিহাসকে এককেন্দ্রিক না করে এর বহুমাত্রিক বিশ্লেষণও জরুরি এবং ইতিহাসবিদরা তা নিশ্চয়ই করবেন। এখনকার টুঙ্গিপাড়া দেখলেও আঁচ করা যায় শত বছর আগে কোন এক অজো গ্রামের সাধারণ এক পরিবারে জন্ম নিয়েছিলেন মুজিব।

সেখান থেকে উঠে এসে রূপকথার নায়কের মতো ইতিহাসের নানা পথপরিক্রমা পার করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে এমন এক বিশাল গগণচুম্বি ভূমিকায় অবতীর্ণ হন যে তার ভূমিকা কেন্দ্রীয় ও চূড়ান্ত হয়ে ওঠে। ১৭ মার্চ তার জন্মদিনে রইল শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।

[লেখক : সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন]

back to top