alt

উপ-সম্পাদকীয়

ভারতীয় চলচ্চিত্র ‘ছাভা’ : ইতিহাস বিকৃতির অভিযোগ

এম এ হোসাইন

: শনিবার, ২২ মার্চ ২০২৫
image

ভারতে মুক্তিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র ‘ছাভা’

সম্প্রতি ভারতে মুক্তিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র ‘ছাভা’ মারাঠা নেতা ছত্রপতি সম্ভাজী মহারাজকে বীরোচিত চরিত্রে এবং মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবকে একমাত্রিক খলনায়ক হিসেবে উপস্থাপন করে ব্যাপক বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। চলচ্চিত্রের সৃজনশীল স্বাধীনতা একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতিবাক্য হলেও ইতিহাসের ইচ্ছাকৃত বিকৃতি এবং এক পক্ষকে মহিমান্বিত করার মাধ্যমে অন্য পক্ষকে কালিমালিপ্ত করা ইতিহাসের প্রতি এক অবিচার। এই চলচ্চিত্র, অনেক অন্যান্য প্রোপাগান্ডা প্রচেষ্টার মতোই, ইতিহাসকে রাজনৈতিক এজেন্ডার সেবায় ব্যবহার করার একটি কৌশলমাত্র। এমন বিকৃত উপস্থাপনা কেবল অতীতকে ভুলভাবে চিত্রিত করে না, বরং বহুধর্মী ও বহুজাতিক ভারতীয় সমাজে সাম্প্রদায়িক বিভাজনকে আরও গভীর করে তোলে।

সম্ভাজী মহারাজের প্রকৃত চরিত্র

চলচ্চিত্রে সম্ভাজী মহারাজকে এক অসীম সাহসী নায়ক হিসেবে তুলে ধরা হলেও ঐতিহাসিক দলিলপত্র তার শাসন সম্পর্কে আরও জটিল ও বহুস্তর বিশিষ্ট চিত্র পাওয়া যায়। সম্ভাজী, শিবাজীর জ্যেষ্ঠপুত্র হিসেবে মারাঠা সাম্রাজ্যের এক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব হলেও, তার শাসনকাল নিষ্ঠুরতা, বিশৃঙ্খলা এবং অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে পরিপূর্ণ ছিল। তিনি শুধু মোগলদের সঙ্গেই লড়েননি, বরং নিজ সাম্রাজ্যের ভেতরেও মারাঠা অভিজাতদের বিরোধিতার মুখোমুখি হন।

সম্ভাজীর শাসনকালের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল লাগাতার আক্রমণ ও লুণ্ঠন, যা শুধু মোগল অধিকৃত অঞ্চলেই সীমাবদ্ধ ছিল না বরং দাক্ষিণাত্যের অন্যান্য রাজ্যেও বিস্তৃত হয়েছিল। তার বাহিনী নির্বিচারে লুটপাট করত, যা হিন্দু ও মুসলমান নির্বিশেষে সাধারণ জনগণের ওপর ভয়াবহ প্রভাব ফেলত। সম্ভবত তার সবচেয়ে বিতর্কিত কাজগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল হাজযাত্রীদের ওপর জলদস্যুতা। আরব সাগরে সম্ভাজী এক শক্তিশালী নৌবাহিনী গড়ে তোলেন, যা মক্কা ও মদিনাগামী হাজযাত্রীদের জাহাজ আক্রমণ করত। এই আক্রমণ শুধু মোগলদের নয়, বরং সমগ্র মুসলিম বিশ্বের রোষের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

যেখানে ছাভা চলচ্চিত্র সম্ভাজীকে মোগল শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের প্রতীক হিসেবে তুলে ধরে, সেখানে তার শাসনের এই অন্ধকার অধ্যায়গুলোকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করা হয়েছে। ফলে তার প্রকৃত ঐতিহাসিক চরিত্রের জটিলতা চলচ্চিত্রে সম্পূর্ণরূপে অনুপস্থিত।

আওরঙ্গজেব : এক ভুল বোঝা শাসক?

সম্ভাজীর গৌরব গাঁথার বিপরীতে, ছাভা আওরঙ্গজেবকে একপাক্ষিকভাবে নিষ্ঠুর ও ধর্মান্ধ শাসক হিসেবে চিত্রিত করেছে। কিন্তু এই উপস্থাপনা একজন অত্যন্ত দক্ষ ও প্রভাবশালী সম্রাটের ইতিহাসকে মাত্রাতিরিক্ত সরলীকৃত করে। আওরঙ্গজেব ছিলেন কঠোর প্রশাসক, কিন্তু তিনি ন্যায়বিচার ও সুদক্ষ শাসনব্যবস্থার জন্যও পরিচিত ছিলেন। তার শাসনামলে মোগল সাম্রাজ্য ভৌগোলিকভাবে সর্বোচ্চ বিস্তৃতি লাভ করে, যা নিছক একনায়কের পক্ষে সম্ভব হতো না।

আওরঙ্গজেবের নীতিগুলো অনেক সময় ধর্মীয় কারণের চেয়ে বাস্তববাদী ছিল বেশি। উদাহরণস্বরূপ, তিনি হিন্দুদের উচ্চপদে নিয়োগ দিয়েছিলেন, যেমন রাজা জয় সিং এবং রাজা মান সিং, যা ধর্মীয় সম্প্রীতির প্রতি তার দৃষ্টিভঙ্গির পরিচায়ক। এছাড়াও, ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন অত্যন্ত মিতব্যয়ী; তিনি কোরআন লিখে এবং টুপি সেলাই করে জীবিকা নির্বাহ করতেন, যা সাধারণত একনায়কদের বিলাসী জীবনযাত্রার সঙ্গে মেলে না।

ছাভা চলচ্চিত্রে আওরঙ্গজেবকে শুধু এক নিষ্ঠুর শাসক হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে, যা তার শাসনামলের জটিল রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে অগ্রাহ্য করেছে। এইরকম ইতিহাসের বিকৃতি শুধু অতীতকে ভ্রান্তভাবে উপস্থাপন করে না, বরং বর্তমানেও সাম্প্রদায়িক বিভাজনকে উসকে দেয়।

সম্ভাজীর পরাজয় এবং মোগল সাম্রাজ্যের বিস্তার

চলচ্চিত্রটি সম্ভাজীকে আওরঙ্গজেবের একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে চিত্রিত করেছে, যা প্রকৃত ইতিহাসের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। মোগলদের বিরুদ্ধে সম্ভাজীর বিদ্রোহ মারাঠা অভ্যন্তরীণ কলহের দ্বারা দুর্বল হয়ে পড়ে। ১৬৮৯ সালে সম্ভাজী মোগলদের হাতে বন্দি হন এবং আওরঙ্গজেবের আদেশে মৃত্যুদ- পান। এটি শুধু একটি ব্যক্তিগত প্রতিশোধের ঘটনা ছিল না; বরং সম্ভাজীর লাগাতার বিদ্রোহ ও লুটতরাজ বন্ধ করার একটি কৌশলগত সিদ্ধান্ত ছিল।

সম্ভাজীর মৃত্যুর পর তার সৎভাই রাজারাম এবং পরে তার স্ত্রী তারাবাই মারাঠা প্রতিরোধের নেতৃত্ব নেন। কিন্তু তাদের সকল প্রচেষ্টা সত্ত্বেও, ১৭০৫ সালে আওরঙ্গজেবের সেনাবাহিনী মারাঠাদের পরাজিত করে। অথচ ‘ছাভা’ সম্ভাজীকে এক অজেয় বীর হিসেবে উপস্থাপন করে, যা ইতিহাসের সঙ্গে বেমানান।

ছাভা চলচ্চিত্রের প্রচারমূলক এজেন্ডা

ছাভা চলচ্চিত্রের ঐতিহাসিক বিকৃতি থেকে স্পষ্ট যে এটি ইতিহাস শিক্ষার চেয়ে নির্দিষ্ট রাজনৈতিক আদর্শ প্রচারের উদ্দেশ্যে নির্মিত হয়েছে। সম্ভাজীকে মহানায়ক ও আওরঙ্গজেবকে খলনায়ক বানিয়ে এটি এক বিশেষ বর্ণনাকে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়, যা সাম্প্রতিককালে আওরঙ্গাবাদের নাম পরিবর্তন করে সম্ভাজীনগর করা এবং আওরঙ্গজেবের সমাধি ধ্বংসের মতো ঘটনাগুলোর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।

চলচ্চিত্রটি মারাঠাদের কেবলমাত্র মহান যোদ্ধা হিসেবে তুলে ধরে, কিন্তু তাদের লুণ্ঠন নীতির ভয়াবহ দিকগুলো এড়িয়ে যায়। বিশেষত, ১৭৪১-১৭৫১ সালের মধ্যে বাংলায় মারাঠা আক্রমণ ছিল এক ভয়াবহ অধ্যায়। সেই সময় বর্গী নামে পরিচিত মারাঠা বাহিনী নির্বিচারে লুটপাট ও হত্যাযজ্ঞ চালায়। তাদের ধ্বংসযজ্ঞ এতাই ভয়াবহ ছিল যে এটি বাংলার লোকসাহিত্যে চিরস্থায়ী হয়ে গেছেÑ

“খোকা ঘুমালো, পাড়া জুড়ালো, বর্গী এলো দেশে...”

এই ছড়াটি বাংলার মানুষের মনে বর্গীদের অত্যাচারের গভীর ক্ষতচিহ্ন বহন করে। অথচ ছাভা চলচ্চিত্র মারাঠাদের এই ইতিহাস সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে।

ইতিহাস বিকৃতির বিপদ

চলচ্চিত্র শুধু বিনোদনের মাধ্যম নয়, এটি জনসাধারণের চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ছাভা যে ধরনের ইতিহাস বিকৃত করছে, তা কেবল অতীতের ভুল ব্যাখ্যা নয়, বরং বর্তমান সমাজেও বিভাজন সৃষ্টি করছে। ইতিহাসকে কখনোই রাজনৈতিক স্বার্থের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা উচিত নয়। এটি এক বহুমাত্রিক ঘটনা প্রবাহ, যেখানে ব্যক্তিত্ব, মতাদর্শ ও রাজনৈতিক কৌশল একসঙ্গে মিশে থাকে। অতএব, শুধু নায়ক-খলনায়কের ছকে ইতিহাসকে সাজানো সত্যের প্রতি অবিচার।

ভারতের মতো বৈচিত্র্যময় দেশে, যেখানে ইতিহাস বিতর্কিত একটি বিষয়, সেখানে ইতিহাসকে যথাযথভাবে উপস্থাপনের দায়িত্ব আরও বেশি। ‘ছাভা’ হয়তো আবেগ জাগাতে পারবে, কিন্তু ইতিহাসকে বিকৃত করে জনসাধারণকে বিভ্রান্ত করার দায়িত্ব এড়াতে পারবে না। আমাদের প্রয়োজন সত্য, সততা ও ইতিহাসের প্রতি শ্রদ্ধাশীল দৃষ্টিভঙ্গিÑ শুধু তাতেই আমরা একটি জ্ঞাত, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং সুবিচারমূলক সমাজ গঠন করতে পারব।

ঐতিহাসিক সত্যের গুরুত্ব ও চলচ্চিত্রের দায়িত্ব

ইতিহাসের বিকৃতি শুধু অতীতের ঘটনাগুলোকে ভুলভাবে উপস্থাপন করে না, বরং এটি বর্তমান ও ভবিষ্যতের সমাজের ওপর গভীর প্রভাব ফেলে। ইতিহাসের সঠিক উপস্থাপনা একটি জাতির পরিচয় ও সংস্কৃতির ভিত্তি গড়ে তোলে। যখন ইতিহাসকে বিকৃত করা হয়, তখন তা সমাজের মধ্যে বিভ্রান্তি ও বিভাজন সৃষ্টি করে। এটি বিশেষ করে ভারতের মতো বহুধর্মী ও বহুজাতিক সমাজে অত্যন্ত বিপজ্জনক হতে পারে।

চলচ্চিত্র নির্মাতাদের একটি সামাজিক দায়িত্ব রয়েছে। তারা শুধু বিনোদনের জন্য চলচ্চিত্র তৈরি করেন না, বরং তারা সমাজের চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তাই, চলচ্চিত্র নির্মাতাদের উচিত ইতিহাসের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া এবং সত্যকে যথাযথভাবে উপস্থাপন করা। ইতিহাসের বিকৃতি শুধু অতীতের প্রতি অবিচার নয়, বরং এটি বর্তমান ও ভবিষ্যতের সমাজের জন্য একটি বড় হুমকি।

উপসংহার

ছাভা চলচ্চিত্রের মতো ঐতিহাসিক চলচ্চিত্রগুলোর মাধ্যমে ইতিহাসের বিকৃতি একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই ধরনের চলচ্চিত্র শুধু অতীতের ঘটনাগুলোকে ভুলভাবে উপস্থাপন করে না, বরং এটি বর্তমান সমাজে বিভাজন ও সংঘাত সৃষ্টি করে। আমাদের উচিত ইতিহাসের সত্যকে সম্মান করা এবং ইতিহাসের বিকৃতি রোধ করা। শুধু সত্য ও সততার মাধ্যমেই আমরা একটি সুস্থ ও ন্যায়বিচার ভিত্তিক সমাজ গঠন করতে পারব।

[লেখক : ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক]

প্রসঙ্গ : পুরুষ ধর্ষণ

শাহবাগ শাপলা বিভাজন : দায় যাদের তাদেরই করতে হবে নিরসন

বিশ্ব বর্ণবৈষম্য বিলোপ দিবস

নতুন রাজনৈতিক দল কি প্রত্যাশা পূরণ করতে পারবে?

রম্যগদ্য : বোধ যখন ক্রোধ

গাছে পেরেক ঠোকা

মানুষ ও বন্য হাতি

আলুর চাষ, বীজ উৎপাদন ও সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ

অখণ্ড বাংলা তত্ত্ব : বাইনারিজম থেকে মুক্তির পথ

রূপকথার মতো মনে হলেও তিনি ছিলেন বাস্তবেরই নায়ক

গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আইন প্রতিষ্ঠার জন্য মুক্ত মত প্রকাশের গুরুত্ব

নিরাপদ অভিবাসন ও রেমিট্যান্স প্রবাহ

ভারতব্যাপী সংঘ : বিজেপির নয়া কৌশল

আর্থিক খাত নিয়ে অবিমৃষ্যকারী বক্তব্য

ভূমিকম্পের আগেই ব্যবস্থা নিতে হবে

নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধ করতেই হবে

মনে কী দ্বিধা রেখে নতুন প্রত্যাশায় নতুন দল!

ছবি

উন্নত বিশ্বের নাগরিকত্ব ও দুর্নীতি

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় : শিক্ষামন্ত্রীর গাড়ির নিচে ছাত্র

নারীর অধিকার, সমতা, ক্ষমতায়ন

আদালতের ভেতরে ভিডিও ধারণের আইনি দিক

আইনের শাসন না গণপিটুনি?

নারীর ভূমি ও কৃষি অধিকার : ন্যায়বিচারের পথে কতদূর?

রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের হালচাল

জনতুষ্টিবাদীরা এগিয়ে আছে যেদিক থেকে

ভিক্ষাবৃত্তি : প্রয়োজন নাকি পেশা?

ছবি

বিনিময় কৌশল নাকি বাণিজ্য যুদ্ধ?

শিশু আদালতের বিচার-প্রক্রিয়ার আইনি ও বাস্তবিক দিক

জনদুর্ভোগের অপসংস্কৃতি ও জনশিক্ষা : আগামীর দিকনির্দেশনা

প্রসঙ্গ : নেপাল থেকে বিদ্যুৎ আমদানি

হরিজনদের পদবি : ঐক্যের পথে বাধা

এল নিনো : দেশের কৃষির চ্যালেঞ্জ ও করণীয়

আর কীভাবে আর্জি জানালে নিরাপত্তা পাওয়া যায়?

স্বপ্ন ভাঙল সাঁওতাল মুংলু বেসরার

কোনো স্কুলই খারাপ না

ঢাকার যানজটের টেকসই সমাধান কী

tab

উপ-সম্পাদকীয়

ভারতীয় চলচ্চিত্র ‘ছাভা’ : ইতিহাস বিকৃতির অভিযোগ

এম এ হোসাইন

image

ভারতে মুক্তিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র ‘ছাভা’

শনিবার, ২২ মার্চ ২০২৫

সম্প্রতি ভারতে মুক্তিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র ‘ছাভা’ মারাঠা নেতা ছত্রপতি সম্ভাজী মহারাজকে বীরোচিত চরিত্রে এবং মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবকে একমাত্রিক খলনায়ক হিসেবে উপস্থাপন করে ব্যাপক বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। চলচ্চিত্রের সৃজনশীল স্বাধীনতা একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতিবাক্য হলেও ইতিহাসের ইচ্ছাকৃত বিকৃতি এবং এক পক্ষকে মহিমান্বিত করার মাধ্যমে অন্য পক্ষকে কালিমালিপ্ত করা ইতিহাসের প্রতি এক অবিচার। এই চলচ্চিত্র, অনেক অন্যান্য প্রোপাগান্ডা প্রচেষ্টার মতোই, ইতিহাসকে রাজনৈতিক এজেন্ডার সেবায় ব্যবহার করার একটি কৌশলমাত্র। এমন বিকৃত উপস্থাপনা কেবল অতীতকে ভুলভাবে চিত্রিত করে না, বরং বহুধর্মী ও বহুজাতিক ভারতীয় সমাজে সাম্প্রদায়িক বিভাজনকে আরও গভীর করে তোলে।

সম্ভাজী মহারাজের প্রকৃত চরিত্র

চলচ্চিত্রে সম্ভাজী মহারাজকে এক অসীম সাহসী নায়ক হিসেবে তুলে ধরা হলেও ঐতিহাসিক দলিলপত্র তার শাসন সম্পর্কে আরও জটিল ও বহুস্তর বিশিষ্ট চিত্র পাওয়া যায়। সম্ভাজী, শিবাজীর জ্যেষ্ঠপুত্র হিসেবে মারাঠা সাম্রাজ্যের এক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব হলেও, তার শাসনকাল নিষ্ঠুরতা, বিশৃঙ্খলা এবং অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে পরিপূর্ণ ছিল। তিনি শুধু মোগলদের সঙ্গেই লড়েননি, বরং নিজ সাম্রাজ্যের ভেতরেও মারাঠা অভিজাতদের বিরোধিতার মুখোমুখি হন।

সম্ভাজীর শাসনকালের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল লাগাতার আক্রমণ ও লুণ্ঠন, যা শুধু মোগল অধিকৃত অঞ্চলেই সীমাবদ্ধ ছিল না বরং দাক্ষিণাত্যের অন্যান্য রাজ্যেও বিস্তৃত হয়েছিল। তার বাহিনী নির্বিচারে লুটপাট করত, যা হিন্দু ও মুসলমান নির্বিশেষে সাধারণ জনগণের ওপর ভয়াবহ প্রভাব ফেলত। সম্ভবত তার সবচেয়ে বিতর্কিত কাজগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল হাজযাত্রীদের ওপর জলদস্যুতা। আরব সাগরে সম্ভাজী এক শক্তিশালী নৌবাহিনী গড়ে তোলেন, যা মক্কা ও মদিনাগামী হাজযাত্রীদের জাহাজ আক্রমণ করত। এই আক্রমণ শুধু মোগলদের নয়, বরং সমগ্র মুসলিম বিশ্বের রোষের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

যেখানে ছাভা চলচ্চিত্র সম্ভাজীকে মোগল শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের প্রতীক হিসেবে তুলে ধরে, সেখানে তার শাসনের এই অন্ধকার অধ্যায়গুলোকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করা হয়েছে। ফলে তার প্রকৃত ঐতিহাসিক চরিত্রের জটিলতা চলচ্চিত্রে সম্পূর্ণরূপে অনুপস্থিত।

আওরঙ্গজেব : এক ভুল বোঝা শাসক?

সম্ভাজীর গৌরব গাঁথার বিপরীতে, ছাভা আওরঙ্গজেবকে একপাক্ষিকভাবে নিষ্ঠুর ও ধর্মান্ধ শাসক হিসেবে চিত্রিত করেছে। কিন্তু এই উপস্থাপনা একজন অত্যন্ত দক্ষ ও প্রভাবশালী সম্রাটের ইতিহাসকে মাত্রাতিরিক্ত সরলীকৃত করে। আওরঙ্গজেব ছিলেন কঠোর প্রশাসক, কিন্তু তিনি ন্যায়বিচার ও সুদক্ষ শাসনব্যবস্থার জন্যও পরিচিত ছিলেন। তার শাসনামলে মোগল সাম্রাজ্য ভৌগোলিকভাবে সর্বোচ্চ বিস্তৃতি লাভ করে, যা নিছক একনায়কের পক্ষে সম্ভব হতো না।

আওরঙ্গজেবের নীতিগুলো অনেক সময় ধর্মীয় কারণের চেয়ে বাস্তববাদী ছিল বেশি। উদাহরণস্বরূপ, তিনি হিন্দুদের উচ্চপদে নিয়োগ দিয়েছিলেন, যেমন রাজা জয় সিং এবং রাজা মান সিং, যা ধর্মীয় সম্প্রীতির প্রতি তার দৃষ্টিভঙ্গির পরিচায়ক। এছাড়াও, ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন অত্যন্ত মিতব্যয়ী; তিনি কোরআন লিখে এবং টুপি সেলাই করে জীবিকা নির্বাহ করতেন, যা সাধারণত একনায়কদের বিলাসী জীবনযাত্রার সঙ্গে মেলে না।

ছাভা চলচ্চিত্রে আওরঙ্গজেবকে শুধু এক নিষ্ঠুর শাসক হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে, যা তার শাসনামলের জটিল রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে অগ্রাহ্য করেছে। এইরকম ইতিহাসের বিকৃতি শুধু অতীতকে ভ্রান্তভাবে উপস্থাপন করে না, বরং বর্তমানেও সাম্প্রদায়িক বিভাজনকে উসকে দেয়।

সম্ভাজীর পরাজয় এবং মোগল সাম্রাজ্যের বিস্তার

চলচ্চিত্রটি সম্ভাজীকে আওরঙ্গজেবের একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে চিত্রিত করেছে, যা প্রকৃত ইতিহাসের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। মোগলদের বিরুদ্ধে সম্ভাজীর বিদ্রোহ মারাঠা অভ্যন্তরীণ কলহের দ্বারা দুর্বল হয়ে পড়ে। ১৬৮৯ সালে সম্ভাজী মোগলদের হাতে বন্দি হন এবং আওরঙ্গজেবের আদেশে মৃত্যুদ- পান। এটি শুধু একটি ব্যক্তিগত প্রতিশোধের ঘটনা ছিল না; বরং সম্ভাজীর লাগাতার বিদ্রোহ ও লুটতরাজ বন্ধ করার একটি কৌশলগত সিদ্ধান্ত ছিল।

সম্ভাজীর মৃত্যুর পর তার সৎভাই রাজারাম এবং পরে তার স্ত্রী তারাবাই মারাঠা প্রতিরোধের নেতৃত্ব নেন। কিন্তু তাদের সকল প্রচেষ্টা সত্ত্বেও, ১৭০৫ সালে আওরঙ্গজেবের সেনাবাহিনী মারাঠাদের পরাজিত করে। অথচ ‘ছাভা’ সম্ভাজীকে এক অজেয় বীর হিসেবে উপস্থাপন করে, যা ইতিহাসের সঙ্গে বেমানান।

ছাভা চলচ্চিত্রের প্রচারমূলক এজেন্ডা

ছাভা চলচ্চিত্রের ঐতিহাসিক বিকৃতি থেকে স্পষ্ট যে এটি ইতিহাস শিক্ষার চেয়ে নির্দিষ্ট রাজনৈতিক আদর্শ প্রচারের উদ্দেশ্যে নির্মিত হয়েছে। সম্ভাজীকে মহানায়ক ও আওরঙ্গজেবকে খলনায়ক বানিয়ে এটি এক বিশেষ বর্ণনাকে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়, যা সাম্প্রতিককালে আওরঙ্গাবাদের নাম পরিবর্তন করে সম্ভাজীনগর করা এবং আওরঙ্গজেবের সমাধি ধ্বংসের মতো ঘটনাগুলোর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।

চলচ্চিত্রটি মারাঠাদের কেবলমাত্র মহান যোদ্ধা হিসেবে তুলে ধরে, কিন্তু তাদের লুণ্ঠন নীতির ভয়াবহ দিকগুলো এড়িয়ে যায়। বিশেষত, ১৭৪১-১৭৫১ সালের মধ্যে বাংলায় মারাঠা আক্রমণ ছিল এক ভয়াবহ অধ্যায়। সেই সময় বর্গী নামে পরিচিত মারাঠা বাহিনী নির্বিচারে লুটপাট ও হত্যাযজ্ঞ চালায়। তাদের ধ্বংসযজ্ঞ এতাই ভয়াবহ ছিল যে এটি বাংলার লোকসাহিত্যে চিরস্থায়ী হয়ে গেছেÑ

“খোকা ঘুমালো, পাড়া জুড়ালো, বর্গী এলো দেশে...”

এই ছড়াটি বাংলার মানুষের মনে বর্গীদের অত্যাচারের গভীর ক্ষতচিহ্ন বহন করে। অথচ ছাভা চলচ্চিত্র মারাঠাদের এই ইতিহাস সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে।

ইতিহাস বিকৃতির বিপদ

চলচ্চিত্র শুধু বিনোদনের মাধ্যম নয়, এটি জনসাধারণের চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ছাভা যে ধরনের ইতিহাস বিকৃত করছে, তা কেবল অতীতের ভুল ব্যাখ্যা নয়, বরং বর্তমান সমাজেও বিভাজন সৃষ্টি করছে। ইতিহাসকে কখনোই রাজনৈতিক স্বার্থের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা উচিত নয়। এটি এক বহুমাত্রিক ঘটনা প্রবাহ, যেখানে ব্যক্তিত্ব, মতাদর্শ ও রাজনৈতিক কৌশল একসঙ্গে মিশে থাকে। অতএব, শুধু নায়ক-খলনায়কের ছকে ইতিহাসকে সাজানো সত্যের প্রতি অবিচার।

ভারতের মতো বৈচিত্র্যময় দেশে, যেখানে ইতিহাস বিতর্কিত একটি বিষয়, সেখানে ইতিহাসকে যথাযথভাবে উপস্থাপনের দায়িত্ব আরও বেশি। ‘ছাভা’ হয়তো আবেগ জাগাতে পারবে, কিন্তু ইতিহাসকে বিকৃত করে জনসাধারণকে বিভ্রান্ত করার দায়িত্ব এড়াতে পারবে না। আমাদের প্রয়োজন সত্য, সততা ও ইতিহাসের প্রতি শ্রদ্ধাশীল দৃষ্টিভঙ্গিÑ শুধু তাতেই আমরা একটি জ্ঞাত, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং সুবিচারমূলক সমাজ গঠন করতে পারব।

ঐতিহাসিক সত্যের গুরুত্ব ও চলচ্চিত্রের দায়িত্ব

ইতিহাসের বিকৃতি শুধু অতীতের ঘটনাগুলোকে ভুলভাবে উপস্থাপন করে না, বরং এটি বর্তমান ও ভবিষ্যতের সমাজের ওপর গভীর প্রভাব ফেলে। ইতিহাসের সঠিক উপস্থাপনা একটি জাতির পরিচয় ও সংস্কৃতির ভিত্তি গড়ে তোলে। যখন ইতিহাসকে বিকৃত করা হয়, তখন তা সমাজের মধ্যে বিভ্রান্তি ও বিভাজন সৃষ্টি করে। এটি বিশেষ করে ভারতের মতো বহুধর্মী ও বহুজাতিক সমাজে অত্যন্ত বিপজ্জনক হতে পারে।

চলচ্চিত্র নির্মাতাদের একটি সামাজিক দায়িত্ব রয়েছে। তারা শুধু বিনোদনের জন্য চলচ্চিত্র তৈরি করেন না, বরং তারা সমাজের চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তাই, চলচ্চিত্র নির্মাতাদের উচিত ইতিহাসের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া এবং সত্যকে যথাযথভাবে উপস্থাপন করা। ইতিহাসের বিকৃতি শুধু অতীতের প্রতি অবিচার নয়, বরং এটি বর্তমান ও ভবিষ্যতের সমাজের জন্য একটি বড় হুমকি।

উপসংহার

ছাভা চলচ্চিত্রের মতো ঐতিহাসিক চলচ্চিত্রগুলোর মাধ্যমে ইতিহাসের বিকৃতি একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই ধরনের চলচ্চিত্র শুধু অতীতের ঘটনাগুলোকে ভুলভাবে উপস্থাপন করে না, বরং এটি বর্তমান সমাজে বিভাজন ও সংঘাত সৃষ্টি করে। আমাদের উচিত ইতিহাসের সত্যকে সম্মান করা এবং ইতিহাসের বিকৃতি রোধ করা। শুধু সত্য ও সততার মাধ্যমেই আমরা একটি সুস্থ ও ন্যায়বিচার ভিত্তিক সমাজ গঠন করতে পারব।

[লেখক : ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক]

back to top