আনোয়ারুল হক
জুলাই অভ্যুত্থানের পরপরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচার থিয়েটার হলে ‘জুলাই গণপরিসর’ শীর্ষক কয়েকটি আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকারের বর্তমান উপদেষ্টা মাহফুজ আলম, বাংলা একাডেমির বর্তমান মহাপরিচালক ড. মোহাম্মদ আজম, প্রথিতযশা চিন্তাবিদ ও লেখক অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খানসহ অনেকে তাদের বক্তব্য রাখেন। আলোচনাগুলোর অংশবিশেষ ইউটিউবে প্রচারিত হওয়ায় শোনার সুযোগ হয়। একটি আলোচনায় মাদ্রাসা উত্তীর্ণ আলেম ও লেখক মনযুরুল হক আবেগময় এক বক্তব্য রাখেন। সব বিষয়ে একমত না হলেও তার বক্তব্য মন ছুঁয়ে যায়, আমি মনোযোগের সাথে শুনি। বক্তব্যের মূলকথা ছিল মাদ্রাসা শিক্ষা ও মাদ্রাসা ছাত্রদের সমাজের মূলধারায় বা গ্রোতে জায়গা না পাওয়া নিয়ে। লেখার কলেবর বৃদ্ধি পেলেও আমি তার বক্তব্যের কিছু অংশ এখানে তুলে ধরতে চাই।
তিনি বলেছেনÑ ‘মাদ্রাসা শিক্ষার অভ্যন্তরীণ সমস্যা হচ্ছে, সেখানে ২১ ফেব্রুয়ারি নাই, ২৬ মার্চ নাই, ১৬ ডিসেম্বর নাই, জাতীয় পতাকা উত্তোলন নাই। আবহটা এমন ছিলো যে এ দেশের স্বাধীনতার সাথে মাদ্রাসা ছাত্রদের কোনো সম্পৃক্ততা নাই। তাদের সম্পৃক্ততা শুধুমাত্র ’৪৭-এর দেশভাগের সাথে। তারপরেও দেশের প্রতি একটা টান আমরা অনুভব করতাম। একবার ১৬ ডিসেম্বর কয়েকজন মিলে ঠিক করলাম মাদ্রাসায় যখন কোনভাবেই সম্ভব নয় তো হুজুরের ডেস্কে একটা জাতীয় পতাকা সেট করবো এবং করলাম। আমাদের শিক্ষক এসে পতাকাটা ছিঁড়ে ফেলে দিলেন। তিনি যে রাষ্ট্রদ্রেহী তা নয়। তিনি এমনটাই তার শিক্ষকের কাছ থেকে শিখেছেন যে, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস এগুলো ফালতু জিনিস।
আর বহির্মুখী সমস্যা হচ্ছে এমনটা যে একবার ১৬ ডিসেম্বর আমরা কয়েকজন মিলে ফার্মগেটের কাছে কুচকাওয়াজ দেখতে যাই। সেখানে বিউগল বাজছিলো। দাড়ি টুপি পরিহিত আমাদের দেখে সেখানকার লোকজন অবাক। হুজুররা এখানে কেন! আমি বাসে উঠবো, উঠার সুবিধার জন্য কাউকে যদি বলতাম ব্যাগটা ধরেন। কেউ ধরে না, বলে এটার মধ্যে কোন বোমা আছে কিনা? এ সব কারণে এক যন্ত্রণা ও বেদনাবোধ আমাদের তাড়িত করতো। নিজেদেরকে ‘আউট সাইডার’ মনে হতো। ক্রিকেট খেলায় বাংলাদেশ জিতলে মাদ্রাসা পড়–য়াদেরও গর্ব হয়; কিন্তু তা প্রকাশের সুযোগ ছিলো না। ‘মুক্তিযোদ্ধা আলেম সন্ধানে’- এ বিষয় নিয়ে লেখালেখি করায় পত্রিকা অফিস থেকে আমার বন্ধুর চাকরি চলে যায়। ভাবখানা এই আলেমরা আবার মুক্তিযোদ্ধা হয় নাকি?’ তার বক্তব্য শোনার সময় আমিও আবেগ তাড়িত হয়ে পড়েছিলাম।
কিন্তু এই যে বিভাজন এর দায় কার। এ বিভাজন টুপি দাড়ির নয়। মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীর তো টুপি দাড়ি ছিলো। কখনও তা নিয়ে রাজনীতিতে বিভাজন হয়নি। আমাদের বাপ-দাদা ভাই ব্রাদার, আত্মীয়স্বজন, অফিস সহকর্মী অনেকেরই তো টুপি দাড়ি ছিলো বা আছে। তা নিয়ে তো সমাজে কোন বিভাজন হচ্ছে না। এখানে কেন হচ্ছে? উত্তর কিন্তু তার বক্তব্যেই রয়েছে। তিনি বলেছেন মাদ্রাসায় একুশে ফেব্রুয়ারি, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস পালিত হয় না। জাতীয় দিবসে পতাকা উত্তোলিত হয় না। বাংলাদেশের কোনো বিজয়ে উল্লাস বা উচ্ছাস প্রকাশ করা যায় না। বিভাজন তো এখান থেকেই। এবং তা আরো অনেক আগে থেকে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় যারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছেন, যুদ্ধ অপরাধের সহযোগী ছিলেন তাদের মূল নেতৃত্বের অধিকাংশই দাড়ি রাখতেন ও টুপি পরতেন। যেমন গোলাম আযম। তিনি এবং তার দল মনে করেন ‘মুসলমানদের তমুদ্দীন ও ধর্মীয় জ্ঞানের ভান্ডার উর্দু ভাষায় সংরক্ষিত রহিয়াছে এবং উর্দু পাক ভারত উপমহাদেশের মুসলিমদের সাধারণ ভাষা। তাই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দৃষ্টিকোণ হইতে বাংলা ভাষা আন্দোলন সঠিক ছিলো না।’
তা হলে বিভাজনটা সৃষ্টি করলো কারা? বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় পাক হানাদার বাহিনীর হত্যাযজ্ঞ, নারী নির্যাতন, সংখ্যালঘু নিধন, মুক্তিযোদ্ধাদের আটক করতে সহায়তা করা এ সব কিছুতেই জামায়াত নেতৃত্ব সহায়তা করেছে। খুলনার মাওলানা ইউসুফ আলী রাজাকার বাহিনী গড়ে তোলেন। তিনিও দাড়ি রাখতেন। রাজাকার বাহিনীতে যাদের রিক্রুট করা হতো তাদেরও দাড়ি রাখতে হতো। জামায়াত ইসলাম, নেজামে ইসলাম দাড়ি টুপিকে ব্যবহার করেছে বাঙালি নিধনের কাজে। যখন সমগ্রজাতি মুক্তিযুদ্ধের মরন পরন লড়াইয়ে তখন জামাতে ইসলাম ও নেজামে ইসলামের নেতৃবৃন্দ দাড়ি টুপি আচকান সমেত মন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছেন হানাদার বাহিনীর পূর্ব পাকিস্তান মন্ত্রিসভায়। ২৫ মার্চ রাত থেকে পাকিস্তানি বাহিনীর গনহত্যা শুরুর পর প্রথম যিনি টিক্কা খানের সাথে দেখা করে অভিনন্দন জানান তিনি গোলাম আযম। এমনকি বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে যাওয়ার পরেও গোলাম আযম পাকিস্তানে বসে ‘পূর্বপাকিস্তান পুনরুদ্ধার কমিটি গঠন’ করে মধ্যপ্রাচ্য এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করে স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দেওয়ার জন্য তদবির করেছিলেন। তাহলে দাড়ি টুপির আড়ালে বিভাজনটা সৃষ্টি করলো কারা?
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫৪ বছর পার হলেও আজ পর্যন্ত জামায়াত- নেজামে ইসলাম গোষ্ঠীর তাদের অপরাধের জন্য বিন্দুমাত্র অনুশোচনা নেই। বরং তারা এবং তাদের উষ্কানিতে তথাকথিত ইনসাফওয়ালারা মাঠে নেমেছেন ‘শাহবাগ’ ইস্যু সৃষ্টি করে। ২০১৩ সালে যুদ্ধ অপরাধীদের বিচার এবং দৃষ্টান্তমূলক সর্বোচ্চ শাস্তির দাবীতে শাহবাগে অবস্থান নিয়ে ছাত্র তরুনরা এক অবিস্মরণীয় আন্দোলন গড়ে তোলে। শান্তিপূর্ণ সেই সংগ্রামে প্রতিদিন লাখো জনতার সমাবেশ ঘটতো। দেশজুড়েই ছড়িয়ে পড়ে এ আন্দোলন। যুদ্ধ অপরাধীদের সাজা প্রদান করেছে বিচারালয়। ছাত্র তরুন ও মুক্তিযোদ্ধারা বিচারের দাবীতে শুধু মাত্র শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করেছে। অথচ গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন চলাকালীন এবং পরবর্তীতে ব্লগার হিসেবে টার্গেট করে জামায়াত খেলাফত ও যুদ্ধাপরাধীদের দোসররা বিভিন্ন স্থানে চোরাগোপ্তা হামলা চালিয়ে ৬ জনকে হত্যা করে। তাহলে বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- ঘটালো কারা?
ঐ সময়ে ঢাকা শহর ছিলো গনজাগরন মঞ্চের নিয়ন্ত্রনে। তারা চাইলে নির্মম প্রতিশোধ নিতে পারত; কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা শান্তিপূর্ণ থেকেছে। এক পর্যায়ে সরকার গন জাগরন মঞ্চে ভাংগন সৃষ্টি করে তাকে নিস্তেজ করে ফেলে। জামায়ত এবং তার সহযোগীরা কেন শান্তিপূর্ন শাহবাগ আন্দোলনের দিকে আঙুল তুলছে। শাহবাগ তো বিচারের দাবি তুলেছে, বিচার করেছে আদালত। তাদের কোন কথা থাকলে তারা বিচারালয়ে যাক। তাদের তো এটা বোঝা উচিত স্বয়ং উপদেষ্টা মাহফুজ আলমও বলছেন ‘জামায়াত যুদ্ধাপরাধের সহযোগী ছিলো’। শাহবাগী শাহবাগী বলে মাতম না করে হেডম থাকলে মাহফুজ আলমের বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করেন।
শাপলা চত্বরে হেফাজতের জমায়েতের সময় শাহবাগ আন্দোলন তো শেষ পর্যায়ে। তারা বিভিন্ন সামাজিক ইস্যু নিয়ে আন্দোলন করা যায় কিনা এসব নিয়ে ভাবছে এবং সরকারই তখন গনজাগরন মঞ্চের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। হেফাজতের জমায়েত নিয়ে গনজাগরন মঞ্চের কিছুই করার ছিলো না। হেফাজত সরকারের সাথে বোঝাপড়া করে শাপলা চত্বরে সমাবেশ করে। বোঝা পড়ার শর্ত ভেঙে শাপলা চত্বর এলাকার বাইরে প্রায় দুই কিলোমিটার এলাকা জুড়ে ব্যাপক ভাংচুর ও তান্ডব সৃষ্টি করে। সিপিবি অফিস আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। সমাবেশ করে সন্ধ্যার মধ্যে চলে যাওয়ার শর্তে তারা নাকি সমাবেশের অনুমতি পায়। সে শর্ত ভঙ্গ করায় যা ব্যবস্থা নেয়ার তা সরকারই নিয়েছে। এর সাথে গনজাগরন মঞ্চের সম্পর্ক কোথায়?
এরপর গোটা দেশবাসী তো দেখেছে বিভিন্ন সময়ে সরকারের মন্ত্রীদের দূতিয়ালিতে হেফাজতের আমিরসহ হেফাজতিদের সাথে সরকারের কি ধরনের সখ্য গড়ে উঠেছিল। কারা শেখ হাসিনাকে কওমি জননী উপাধি দিয়েছিল? শাপলা সমাবেশের ক্ষেত্রে সরকার যে শক্তিপ্রয়োগমূলক ব্যবস্থা নিয়েছে তার দায় তৎকালীন সরকারের এবং শেখ হাসিনাকে কওমি জননীতে ভূষিত করার দায় হেফাজতের। উদ্দেশ্যমূলকভাবে পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করতে শাহবাগ বা গণজাগরণ মঞ্চেকে নিয়ে টানাটানি করা হচ্ছে। গণজাগরণ মঞ্চের কেউ তো শাপলা সমাবেশে হামলা করতে যাননি। বরং ওই সমাবেশের দিনেই গণজাগরণ মঞ্চে হামলা করার জন্য রমনা পার্কের মধ্য দিয়ে হেফাজতিরা অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। আর ইতোমধ্যে হেফাজতের শাপলা সমাবেশ নিয়ে উপদেষ্টা মাহফুজ আলম তো বলেই দিয়েছেন ঐ দিন জামায়াত সফলভাবেই হেফাজতকে প্রক্সি হিসেবে ব্যবহার করতে পেরেছে।
মাহফুজ আলম আরো লিখেছেন, ‘আমি যে মাদ্রাসায় পড়েছি, সেখানে জামায়াত নেতাদের ভ্রান্ত আকিদার অনুসারী হিসেবে গণ্য করা হতো। আর জামায়াত নেতাদের ফাঁসিকে দেখা হতো তাদের আলেম ও সহি ইসলাম বিরোধিতার ফসল হিসেবে। জামায়াতকে আমরা ছোটবেলা থেকে আলেম-ওলামাবিরোধী হিসেবেই জেনে এসেছি।’ কি জবাব জামায়াত নেতৃত্বের! অবশ্য মাহফুজ আলম জুলাই অভ্যুত্থানে জামাতের ভূমিকার প্রশংসা করে বলেছেন জামায়াতের যারা বাংলাদেশপন্থী, তারা এ দেশে রাজনীতি করার অধিকার রাখেন। তবে কারা বাংলাদেশপন্থী তার কোনো উদাহরণ কি আছে? জামায়াতে ইসলামীতে আছেন কি এমন কেউ যিনি বলেছেন ’৭১-এ বাংলাদেশের অভু্যুদয়ের বিরোধিতা করে ভুল করেছি?’
জামায়াত এবং তার সহযোগীদের মুক্তিযুদ্ধ বিরোধিতা, মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করা এবং এখনও তাদের সে সময়ের ভূমিকাকে সঠিক মনে করাই বিভাজনের মূল কারণ। এ বিভাজন থেকে বেরিয়ে আসতে হলে বিভাজন সৃষ্টিকারীদেরই সংশোধিত হতে হবে। জামায়াত এবং তার সহযোগীরা যদি প্রকৃতই বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধকে সম্মান করে থাকে তবে অতীতের ভুল শুধরে দলগতভাবে তারা সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে গিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাক এবং কন্ঠে তুলে নিক জাতীয় সংগীত। বিভাজন অনেকটাই কমে যাবে।
দ্বিতীয়তো নারী স্বাধীনতার প্রশ্নে সুস্পষ্ট ঘোষণা থাকতে হবে। নারীকে ঘরে আর পর্দার অন্তরালে বন্দী করার মানসিকতা থেকে মুক্ত হতে হবে। এই যে এত বড় গণঅভ্যুত্থানে মাদ্রাসার টুপি আচকান পরিহিত ছাত্রের পাশে জিনস টি-শার্ট পরিহিত ছাত্রী লড়াই করলেন, পুলিশের আক্রমণের হাত থেকে ছাত্র ভাইদের রক্ষা করার জন্য ঢাল হয়ে দাঁড়ালেন তখন তো তাদের পোশাক নিয়ে, খাদ্য বা পানাহারের অভ্যাস নিয়ে কোন কথা হয়নি। আজ কারা কোনো নারীর পোষাক বা অভ্যাস পছন্দ না হলে ধর্মীয় উস্কানি দিয়ে মব সৃষ্টি করছেন। ধর্মভিত্তিক দলগুলো কি নারী স্বাধীনতার প্রশ্নে মধ্যযুগীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সরে আসবে না? এই যে সারা দেশে অসংখ্য ওয়াজ মাহফিল অনুষ্ঠিত হয় তার বয়ানগুলো যদি ইউটিউবে বা সরাসরি শোনেন মনে হবে ইসলাম নারীর আঁচলে বাধা পড়ে গেছে, এখান থেকে তার মুক্তি নেই! ওয়াজকারীর কাজ জাতি(উম্মাহ) গঠন নয়, নারী গঠন! তাহলে বিভাজন সৃষ্টি করছেন কারা? বিভাজন সৃষ্টি কারীদেরই বিভাজনের পথ পরিত্যাগ করতে হবে।
আবার মাওলানা মনযুরুল হকের কাছে ফিরে যাই। ওই আলোচনা সভায় আবেগতাড়িত হয়ে তিনি বলেন, যে ‘রাজাকারের নাতি’ উক্তির কারণে বাংলাদেশে এত বড় ঘটনা ঘটে গেল সেই ধরনের উক্তি তিনি ৬ বছর বয়সে যখন মাদ্রাসায় ভর্তি হন তখন থেকেই শুনে আসছেন।
নিশ্চয়ই আমাদের জন্যও এটা বড়ই বেদনার। শুধু এ ধরনের উক্তি নয়, সাধারণভাবে অনেকেই মনে করেন তারা অন্ধ, কুসংস্কারাচ্ছন্ন; কিন্তু আজ আমার তো মনে হয় অন্ধ তারা নয়, অন্ধ আমরা। অন্ধ আমাদের রাজনীতিবিদ ও সমাজপতিরা, রাষ্ট্র নায়করা। তা না হলে কিভাবে এটা হতে পারে যে স্বাধীনতা লাভের অর্ধ শতাব্দীরও বেশি সময় পার হওয়ার পরেও মাদ্রাসাকে অন্ধকারে রেখে দেওয়া হয়েছে। যেখানে ২১ ফেব্রুয়ারি নাই, ২৬ মার্চ নাই, ১৬ ডিসেম্বর নাই, জাতীয় পতাকা নাই। সেখানে ক্রিকেট নাই, ফুটবল নাই, বিনোদন নাই। সেখানকার ছাত্রদের শুরু থেকেই মানসিকভাবে ‘আউট সাইডার’ বা অনেকটা পংগু করে রাখা হয়েছে। এ দীর্ঘ সময়ে রাষ্ট্রের কি এ সব বিষয়ে কোনই দায়িত্ব ছিলো না? এ ব্যর্থতার দায় রাষ্ট্রকে নিতে হবে এবং এক্ষেত্রে অংশীজনকে সাথে নিয়ে প্রয়োজনীয় সংস্কার করতে হবে।
সংস্কার বিষয়ে মনযুরুল হক যা বলতে চেয়েছেন তা হলোÑ পত্র-পত্রিকার লেখনিতে বা যে কোনো আলোচনায় স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়াদের বলা হয় ‘ছাত্র’ আর মাদ্রাসা পড়ুয়াদের বলা হয় ‘মাদ্রাসা ছাত্র’। এই পৃথকীকরণ বন্ধ করে সবাইকে ছাত্র হিসেবে সম্বোধন করতে পারলে বিভাজন কমবে। ছাত্র হিসেবে সবাই সম মর্যাদার হবে। শিক্ষা ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে হবে। তবে এজন্য হুট করে মাদ্রাসার সিলেবাস পরিবর্তন করা যাবে না। প্রথমত, পাঠ্যক্রম বর্হিভূত কার্যক্রম একমুখীন করতে হবে। আন্তঃস্কুল কলেজ প্রতিযোগিতা সমূহ এক ছাতার নীচে নিয়ে আসতে হবে। খেলাধুলা, বিতর্ক, সামঞ্জস্যপূর্ণ সাংস্কৃতিক কর্মকা- সব এক সাথে সম্পন্ন করতে হবে। এভাবে তাদের সমাজের মূল স্রোতধারায় নিয়ে এসে আস্থার জায়গা তৈরি করতে পারলে পরবর্তীতে ধর্মীয় শিক্ষার মৌলিক বিষয় ঠিক রেখে পর্যায়ক্রমে অন্যান্য বিভাগ সাধারণ শিক্ষার সাথে মিল করে আধুনিকায়ন করা যাবে। আমাদের ধর্মীয় নেতারা এবং ধর্মীয় রাজনৈতিক দলগুলো কি এ সব মানতে প্রস্তুত আছেন? না মানলে তারাই বিভাজনের শক্তি হিসেবে থেকে যাবেন।
আর যদি প্রকৃতই তারা এ সব সংস্কারে প্রস্তুত থাকেন বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক শক্তি সমূহকেও যথেষ্ট নমনীয়তা ও সহনশীলতার সাথে তাদের পাশে এ কাজে সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে নিয়ে দাঁড়াতে হবে। ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি যেমন সমাজে ক্ষতি ও ক্ষত সৃষ্টি করেছে, তেমনি ধর্ম নিয়ে উন্নাসিকতাও কিন্তু ক্ষতি করেছে। ‘শাহবাগ’ ২০১৩ সালেই বুঝেছে সমাজে তাদের চিন্তাধারার বাইরেও আরো অনেক শক্তি আছে- তাদের তো সমাজের বাইরে ফেলে দেওয়া যাবে না। ‘একোমোডেট’ করতে হবে; কিন্ত ‘শাপলা’ কি বুঝতে পারছে মুক্তিযুদ্ধ মানেই বাংলাদেশ। মুক্তিযুদ্ধের পেছনে বাংলাদেশ নামক বিশাল দেয়াল। এর পেছনে যাওয়ার সুযোগ নেই। মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশকে নিয়ে সামনে অগ্রসর হবে নতুবা মৃত্যু। এর বিকল্প তো কিছু নেই। মাওলানা মনযুরুল হকের বক্তব্য শুনে মনে হয়, হ্যাঁ তারাও মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশের সন্তান। মুক্তিযুদ্ধকে বরণ করে নিয়েই তারা সমাজের মূল স্রোতধারায় অগ্রসর হতে চান। আর সেটা হলে ‘২৪’-এর গণঅভ্যুত্থানও সফল হবে। ‘২৪’-কে দিয়ে ‘৭১’-কে ঢেকে দেওয়ার প্রয়াস ব্যর্থ হবে। তেমনি ‘৭১’-এর বিশালতায় ‘২৪’ ঢাকা পড়বে না। মুক্তিযুদ্ধের বিশাল ক্যানভাসে ‘২৪’ ও তার মহিমা নিয়ে জায়গা করে নেবে।
[লেখক : সাবেক সভাপতি, ছাত্র ইউনিয়ন]
আনোয়ারুল হক
শনিবার, ২২ মার্চ ২০২৫
জুলাই অভ্যুত্থানের পরপরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচার থিয়েটার হলে ‘জুলাই গণপরিসর’ শীর্ষক কয়েকটি আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকারের বর্তমান উপদেষ্টা মাহফুজ আলম, বাংলা একাডেমির বর্তমান মহাপরিচালক ড. মোহাম্মদ আজম, প্রথিতযশা চিন্তাবিদ ও লেখক অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খানসহ অনেকে তাদের বক্তব্য রাখেন। আলোচনাগুলোর অংশবিশেষ ইউটিউবে প্রচারিত হওয়ায় শোনার সুযোগ হয়। একটি আলোচনায় মাদ্রাসা উত্তীর্ণ আলেম ও লেখক মনযুরুল হক আবেগময় এক বক্তব্য রাখেন। সব বিষয়ে একমত না হলেও তার বক্তব্য মন ছুঁয়ে যায়, আমি মনোযোগের সাথে শুনি। বক্তব্যের মূলকথা ছিল মাদ্রাসা শিক্ষা ও মাদ্রাসা ছাত্রদের সমাজের মূলধারায় বা গ্রোতে জায়গা না পাওয়া নিয়ে। লেখার কলেবর বৃদ্ধি পেলেও আমি তার বক্তব্যের কিছু অংশ এখানে তুলে ধরতে চাই।
তিনি বলেছেনÑ ‘মাদ্রাসা শিক্ষার অভ্যন্তরীণ সমস্যা হচ্ছে, সেখানে ২১ ফেব্রুয়ারি নাই, ২৬ মার্চ নাই, ১৬ ডিসেম্বর নাই, জাতীয় পতাকা উত্তোলন নাই। আবহটা এমন ছিলো যে এ দেশের স্বাধীনতার সাথে মাদ্রাসা ছাত্রদের কোনো সম্পৃক্ততা নাই। তাদের সম্পৃক্ততা শুধুমাত্র ’৪৭-এর দেশভাগের সাথে। তারপরেও দেশের প্রতি একটা টান আমরা অনুভব করতাম। একবার ১৬ ডিসেম্বর কয়েকজন মিলে ঠিক করলাম মাদ্রাসায় যখন কোনভাবেই সম্ভব নয় তো হুজুরের ডেস্কে একটা জাতীয় পতাকা সেট করবো এবং করলাম। আমাদের শিক্ষক এসে পতাকাটা ছিঁড়ে ফেলে দিলেন। তিনি যে রাষ্ট্রদ্রেহী তা নয়। তিনি এমনটাই তার শিক্ষকের কাছ থেকে শিখেছেন যে, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস এগুলো ফালতু জিনিস।
আর বহির্মুখী সমস্যা হচ্ছে এমনটা যে একবার ১৬ ডিসেম্বর আমরা কয়েকজন মিলে ফার্মগেটের কাছে কুচকাওয়াজ দেখতে যাই। সেখানে বিউগল বাজছিলো। দাড়ি টুপি পরিহিত আমাদের দেখে সেখানকার লোকজন অবাক। হুজুররা এখানে কেন! আমি বাসে উঠবো, উঠার সুবিধার জন্য কাউকে যদি বলতাম ব্যাগটা ধরেন। কেউ ধরে না, বলে এটার মধ্যে কোন বোমা আছে কিনা? এ সব কারণে এক যন্ত্রণা ও বেদনাবোধ আমাদের তাড়িত করতো। নিজেদেরকে ‘আউট সাইডার’ মনে হতো। ক্রিকেট খেলায় বাংলাদেশ জিতলে মাদ্রাসা পড়–য়াদেরও গর্ব হয়; কিন্তু তা প্রকাশের সুযোগ ছিলো না। ‘মুক্তিযোদ্ধা আলেম সন্ধানে’- এ বিষয় নিয়ে লেখালেখি করায় পত্রিকা অফিস থেকে আমার বন্ধুর চাকরি চলে যায়। ভাবখানা এই আলেমরা আবার মুক্তিযোদ্ধা হয় নাকি?’ তার বক্তব্য শোনার সময় আমিও আবেগ তাড়িত হয়ে পড়েছিলাম।
কিন্তু এই যে বিভাজন এর দায় কার। এ বিভাজন টুপি দাড়ির নয়। মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীর তো টুপি দাড়ি ছিলো। কখনও তা নিয়ে রাজনীতিতে বিভাজন হয়নি। আমাদের বাপ-দাদা ভাই ব্রাদার, আত্মীয়স্বজন, অফিস সহকর্মী অনেকেরই তো টুপি দাড়ি ছিলো বা আছে। তা নিয়ে তো সমাজে কোন বিভাজন হচ্ছে না। এখানে কেন হচ্ছে? উত্তর কিন্তু তার বক্তব্যেই রয়েছে। তিনি বলেছেন মাদ্রাসায় একুশে ফেব্রুয়ারি, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস পালিত হয় না। জাতীয় দিবসে পতাকা উত্তোলিত হয় না। বাংলাদেশের কোনো বিজয়ে উল্লাস বা উচ্ছাস প্রকাশ করা যায় না। বিভাজন তো এখান থেকেই। এবং তা আরো অনেক আগে থেকে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় যারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছেন, যুদ্ধ অপরাধের সহযোগী ছিলেন তাদের মূল নেতৃত্বের অধিকাংশই দাড়ি রাখতেন ও টুপি পরতেন। যেমন গোলাম আযম। তিনি এবং তার দল মনে করেন ‘মুসলমানদের তমুদ্দীন ও ধর্মীয় জ্ঞানের ভান্ডার উর্দু ভাষায় সংরক্ষিত রহিয়াছে এবং উর্দু পাক ভারত উপমহাদেশের মুসলিমদের সাধারণ ভাষা। তাই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দৃষ্টিকোণ হইতে বাংলা ভাষা আন্দোলন সঠিক ছিলো না।’
তা হলে বিভাজনটা সৃষ্টি করলো কারা? বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় পাক হানাদার বাহিনীর হত্যাযজ্ঞ, নারী নির্যাতন, সংখ্যালঘু নিধন, মুক্তিযোদ্ধাদের আটক করতে সহায়তা করা এ সব কিছুতেই জামায়াত নেতৃত্ব সহায়তা করেছে। খুলনার মাওলানা ইউসুফ আলী রাজাকার বাহিনী গড়ে তোলেন। তিনিও দাড়ি রাখতেন। রাজাকার বাহিনীতে যাদের রিক্রুট করা হতো তাদেরও দাড়ি রাখতে হতো। জামায়াত ইসলাম, নেজামে ইসলাম দাড়ি টুপিকে ব্যবহার করেছে বাঙালি নিধনের কাজে। যখন সমগ্রজাতি মুক্তিযুদ্ধের মরন পরন লড়াইয়ে তখন জামাতে ইসলাম ও নেজামে ইসলামের নেতৃবৃন্দ দাড়ি টুপি আচকান সমেত মন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছেন হানাদার বাহিনীর পূর্ব পাকিস্তান মন্ত্রিসভায়। ২৫ মার্চ রাত থেকে পাকিস্তানি বাহিনীর গনহত্যা শুরুর পর প্রথম যিনি টিক্কা খানের সাথে দেখা করে অভিনন্দন জানান তিনি গোলাম আযম। এমনকি বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে যাওয়ার পরেও গোলাম আযম পাকিস্তানে বসে ‘পূর্বপাকিস্তান পুনরুদ্ধার কমিটি গঠন’ করে মধ্যপ্রাচ্য এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করে স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দেওয়ার জন্য তদবির করেছিলেন। তাহলে দাড়ি টুপির আড়ালে বিভাজনটা সৃষ্টি করলো কারা?
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫৪ বছর পার হলেও আজ পর্যন্ত জামায়াত- নেজামে ইসলাম গোষ্ঠীর তাদের অপরাধের জন্য বিন্দুমাত্র অনুশোচনা নেই। বরং তারা এবং তাদের উষ্কানিতে তথাকথিত ইনসাফওয়ালারা মাঠে নেমেছেন ‘শাহবাগ’ ইস্যু সৃষ্টি করে। ২০১৩ সালে যুদ্ধ অপরাধীদের বিচার এবং দৃষ্টান্তমূলক সর্বোচ্চ শাস্তির দাবীতে শাহবাগে অবস্থান নিয়ে ছাত্র তরুনরা এক অবিস্মরণীয় আন্দোলন গড়ে তোলে। শান্তিপূর্ণ সেই সংগ্রামে প্রতিদিন লাখো জনতার সমাবেশ ঘটতো। দেশজুড়েই ছড়িয়ে পড়ে এ আন্দোলন। যুদ্ধ অপরাধীদের সাজা প্রদান করেছে বিচারালয়। ছাত্র তরুন ও মুক্তিযোদ্ধারা বিচারের দাবীতে শুধু মাত্র শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করেছে। অথচ গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন চলাকালীন এবং পরবর্তীতে ব্লগার হিসেবে টার্গেট করে জামায়াত খেলাফত ও যুদ্ধাপরাধীদের দোসররা বিভিন্ন স্থানে চোরাগোপ্তা হামলা চালিয়ে ৬ জনকে হত্যা করে। তাহলে বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- ঘটালো কারা?
ঐ সময়ে ঢাকা শহর ছিলো গনজাগরন মঞ্চের নিয়ন্ত্রনে। তারা চাইলে নির্মম প্রতিশোধ নিতে পারত; কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা শান্তিপূর্ণ থেকেছে। এক পর্যায়ে সরকার গন জাগরন মঞ্চে ভাংগন সৃষ্টি করে তাকে নিস্তেজ করে ফেলে। জামায়ত এবং তার সহযোগীরা কেন শান্তিপূর্ন শাহবাগ আন্দোলনের দিকে আঙুল তুলছে। শাহবাগ তো বিচারের দাবি তুলেছে, বিচার করেছে আদালত। তাদের কোন কথা থাকলে তারা বিচারালয়ে যাক। তাদের তো এটা বোঝা উচিত স্বয়ং উপদেষ্টা মাহফুজ আলমও বলছেন ‘জামায়াত যুদ্ধাপরাধের সহযোগী ছিলো’। শাহবাগী শাহবাগী বলে মাতম না করে হেডম থাকলে মাহফুজ আলমের বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করেন।
শাপলা চত্বরে হেফাজতের জমায়েতের সময় শাহবাগ আন্দোলন তো শেষ পর্যায়ে। তারা বিভিন্ন সামাজিক ইস্যু নিয়ে আন্দোলন করা যায় কিনা এসব নিয়ে ভাবছে এবং সরকারই তখন গনজাগরন মঞ্চের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। হেফাজতের জমায়েত নিয়ে গনজাগরন মঞ্চের কিছুই করার ছিলো না। হেফাজত সরকারের সাথে বোঝাপড়া করে শাপলা চত্বরে সমাবেশ করে। বোঝা পড়ার শর্ত ভেঙে শাপলা চত্বর এলাকার বাইরে প্রায় দুই কিলোমিটার এলাকা জুড়ে ব্যাপক ভাংচুর ও তান্ডব সৃষ্টি করে। সিপিবি অফিস আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। সমাবেশ করে সন্ধ্যার মধ্যে চলে যাওয়ার শর্তে তারা নাকি সমাবেশের অনুমতি পায়। সে শর্ত ভঙ্গ করায় যা ব্যবস্থা নেয়ার তা সরকারই নিয়েছে। এর সাথে গনজাগরন মঞ্চের সম্পর্ক কোথায়?
এরপর গোটা দেশবাসী তো দেখেছে বিভিন্ন সময়ে সরকারের মন্ত্রীদের দূতিয়ালিতে হেফাজতের আমিরসহ হেফাজতিদের সাথে সরকারের কি ধরনের সখ্য গড়ে উঠেছিল। কারা শেখ হাসিনাকে কওমি জননী উপাধি দিয়েছিল? শাপলা সমাবেশের ক্ষেত্রে সরকার যে শক্তিপ্রয়োগমূলক ব্যবস্থা নিয়েছে তার দায় তৎকালীন সরকারের এবং শেখ হাসিনাকে কওমি জননীতে ভূষিত করার দায় হেফাজতের। উদ্দেশ্যমূলকভাবে পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করতে শাহবাগ বা গণজাগরণ মঞ্চেকে নিয়ে টানাটানি করা হচ্ছে। গণজাগরণ মঞ্চের কেউ তো শাপলা সমাবেশে হামলা করতে যাননি। বরং ওই সমাবেশের দিনেই গণজাগরণ মঞ্চে হামলা করার জন্য রমনা পার্কের মধ্য দিয়ে হেফাজতিরা অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। আর ইতোমধ্যে হেফাজতের শাপলা সমাবেশ নিয়ে উপদেষ্টা মাহফুজ আলম তো বলেই দিয়েছেন ঐ দিন জামায়াত সফলভাবেই হেফাজতকে প্রক্সি হিসেবে ব্যবহার করতে পেরেছে।
মাহফুজ আলম আরো লিখেছেন, ‘আমি যে মাদ্রাসায় পড়েছি, সেখানে জামায়াত নেতাদের ভ্রান্ত আকিদার অনুসারী হিসেবে গণ্য করা হতো। আর জামায়াত নেতাদের ফাঁসিকে দেখা হতো তাদের আলেম ও সহি ইসলাম বিরোধিতার ফসল হিসেবে। জামায়াতকে আমরা ছোটবেলা থেকে আলেম-ওলামাবিরোধী হিসেবেই জেনে এসেছি।’ কি জবাব জামায়াত নেতৃত্বের! অবশ্য মাহফুজ আলম জুলাই অভ্যুত্থানে জামাতের ভূমিকার প্রশংসা করে বলেছেন জামায়াতের যারা বাংলাদেশপন্থী, তারা এ দেশে রাজনীতি করার অধিকার রাখেন। তবে কারা বাংলাদেশপন্থী তার কোনো উদাহরণ কি আছে? জামায়াতে ইসলামীতে আছেন কি এমন কেউ যিনি বলেছেন ’৭১-এ বাংলাদেশের অভু্যুদয়ের বিরোধিতা করে ভুল করেছি?’
জামায়াত এবং তার সহযোগীদের মুক্তিযুদ্ধ বিরোধিতা, মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করা এবং এখনও তাদের সে সময়ের ভূমিকাকে সঠিক মনে করাই বিভাজনের মূল কারণ। এ বিভাজন থেকে বেরিয়ে আসতে হলে বিভাজন সৃষ্টিকারীদেরই সংশোধিত হতে হবে। জামায়াত এবং তার সহযোগীরা যদি প্রকৃতই বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধকে সম্মান করে থাকে তবে অতীতের ভুল শুধরে দলগতভাবে তারা সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে গিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাক এবং কন্ঠে তুলে নিক জাতীয় সংগীত। বিভাজন অনেকটাই কমে যাবে।
দ্বিতীয়তো নারী স্বাধীনতার প্রশ্নে সুস্পষ্ট ঘোষণা থাকতে হবে। নারীকে ঘরে আর পর্দার অন্তরালে বন্দী করার মানসিকতা থেকে মুক্ত হতে হবে। এই যে এত বড় গণঅভ্যুত্থানে মাদ্রাসার টুপি আচকান পরিহিত ছাত্রের পাশে জিনস টি-শার্ট পরিহিত ছাত্রী লড়াই করলেন, পুলিশের আক্রমণের হাত থেকে ছাত্র ভাইদের রক্ষা করার জন্য ঢাল হয়ে দাঁড়ালেন তখন তো তাদের পোশাক নিয়ে, খাদ্য বা পানাহারের অভ্যাস নিয়ে কোন কথা হয়নি। আজ কারা কোনো নারীর পোষাক বা অভ্যাস পছন্দ না হলে ধর্মীয় উস্কানি দিয়ে মব সৃষ্টি করছেন। ধর্মভিত্তিক দলগুলো কি নারী স্বাধীনতার প্রশ্নে মধ্যযুগীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সরে আসবে না? এই যে সারা দেশে অসংখ্য ওয়াজ মাহফিল অনুষ্ঠিত হয় তার বয়ানগুলো যদি ইউটিউবে বা সরাসরি শোনেন মনে হবে ইসলাম নারীর আঁচলে বাধা পড়ে গেছে, এখান থেকে তার মুক্তি নেই! ওয়াজকারীর কাজ জাতি(উম্মাহ) গঠন নয়, নারী গঠন! তাহলে বিভাজন সৃষ্টি করছেন কারা? বিভাজন সৃষ্টি কারীদেরই বিভাজনের পথ পরিত্যাগ করতে হবে।
আবার মাওলানা মনযুরুল হকের কাছে ফিরে যাই। ওই আলোচনা সভায় আবেগতাড়িত হয়ে তিনি বলেন, যে ‘রাজাকারের নাতি’ উক্তির কারণে বাংলাদেশে এত বড় ঘটনা ঘটে গেল সেই ধরনের উক্তি তিনি ৬ বছর বয়সে যখন মাদ্রাসায় ভর্তি হন তখন থেকেই শুনে আসছেন।
নিশ্চয়ই আমাদের জন্যও এটা বড়ই বেদনার। শুধু এ ধরনের উক্তি নয়, সাধারণভাবে অনেকেই মনে করেন তারা অন্ধ, কুসংস্কারাচ্ছন্ন; কিন্তু আজ আমার তো মনে হয় অন্ধ তারা নয়, অন্ধ আমরা। অন্ধ আমাদের রাজনীতিবিদ ও সমাজপতিরা, রাষ্ট্র নায়করা। তা না হলে কিভাবে এটা হতে পারে যে স্বাধীনতা লাভের অর্ধ শতাব্দীরও বেশি সময় পার হওয়ার পরেও মাদ্রাসাকে অন্ধকারে রেখে দেওয়া হয়েছে। যেখানে ২১ ফেব্রুয়ারি নাই, ২৬ মার্চ নাই, ১৬ ডিসেম্বর নাই, জাতীয় পতাকা নাই। সেখানে ক্রিকেট নাই, ফুটবল নাই, বিনোদন নাই। সেখানকার ছাত্রদের শুরু থেকেই মানসিকভাবে ‘আউট সাইডার’ বা অনেকটা পংগু করে রাখা হয়েছে। এ দীর্ঘ সময়ে রাষ্ট্রের কি এ সব বিষয়ে কোনই দায়িত্ব ছিলো না? এ ব্যর্থতার দায় রাষ্ট্রকে নিতে হবে এবং এক্ষেত্রে অংশীজনকে সাথে নিয়ে প্রয়োজনীয় সংস্কার করতে হবে।
সংস্কার বিষয়ে মনযুরুল হক যা বলতে চেয়েছেন তা হলোÑ পত্র-পত্রিকার লেখনিতে বা যে কোনো আলোচনায় স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়াদের বলা হয় ‘ছাত্র’ আর মাদ্রাসা পড়ুয়াদের বলা হয় ‘মাদ্রাসা ছাত্র’। এই পৃথকীকরণ বন্ধ করে সবাইকে ছাত্র হিসেবে সম্বোধন করতে পারলে বিভাজন কমবে। ছাত্র হিসেবে সবাই সম মর্যাদার হবে। শিক্ষা ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে হবে। তবে এজন্য হুট করে মাদ্রাসার সিলেবাস পরিবর্তন করা যাবে না। প্রথমত, পাঠ্যক্রম বর্হিভূত কার্যক্রম একমুখীন করতে হবে। আন্তঃস্কুল কলেজ প্রতিযোগিতা সমূহ এক ছাতার নীচে নিয়ে আসতে হবে। খেলাধুলা, বিতর্ক, সামঞ্জস্যপূর্ণ সাংস্কৃতিক কর্মকা- সব এক সাথে সম্পন্ন করতে হবে। এভাবে তাদের সমাজের মূল স্রোতধারায় নিয়ে এসে আস্থার জায়গা তৈরি করতে পারলে পরবর্তীতে ধর্মীয় শিক্ষার মৌলিক বিষয় ঠিক রেখে পর্যায়ক্রমে অন্যান্য বিভাগ সাধারণ শিক্ষার সাথে মিল করে আধুনিকায়ন করা যাবে। আমাদের ধর্মীয় নেতারা এবং ধর্মীয় রাজনৈতিক দলগুলো কি এ সব মানতে প্রস্তুত আছেন? না মানলে তারাই বিভাজনের শক্তি হিসেবে থেকে যাবেন।
আর যদি প্রকৃতই তারা এ সব সংস্কারে প্রস্তুত থাকেন বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক শক্তি সমূহকেও যথেষ্ট নমনীয়তা ও সহনশীলতার সাথে তাদের পাশে এ কাজে সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে নিয়ে দাঁড়াতে হবে। ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি যেমন সমাজে ক্ষতি ও ক্ষত সৃষ্টি করেছে, তেমনি ধর্ম নিয়ে উন্নাসিকতাও কিন্তু ক্ষতি করেছে। ‘শাহবাগ’ ২০১৩ সালেই বুঝেছে সমাজে তাদের চিন্তাধারার বাইরেও আরো অনেক শক্তি আছে- তাদের তো সমাজের বাইরে ফেলে দেওয়া যাবে না। ‘একোমোডেট’ করতে হবে; কিন্ত ‘শাপলা’ কি বুঝতে পারছে মুক্তিযুদ্ধ মানেই বাংলাদেশ। মুক্তিযুদ্ধের পেছনে বাংলাদেশ নামক বিশাল দেয়াল। এর পেছনে যাওয়ার সুযোগ নেই। মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশকে নিয়ে সামনে অগ্রসর হবে নতুবা মৃত্যু। এর বিকল্প তো কিছু নেই। মাওলানা মনযুরুল হকের বক্তব্য শুনে মনে হয়, হ্যাঁ তারাও মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশের সন্তান। মুক্তিযুদ্ধকে বরণ করে নিয়েই তারা সমাজের মূল স্রোতধারায় অগ্রসর হতে চান। আর সেটা হলে ‘২৪’-এর গণঅভ্যুত্থানও সফল হবে। ‘২৪’-কে দিয়ে ‘৭১’-কে ঢেকে দেওয়ার প্রয়াস ব্যর্থ হবে। তেমনি ‘৭১’-এর বিশালতায় ‘২৪’ ঢাকা পড়বে না। মুক্তিযুদ্ধের বিশাল ক্যানভাসে ‘২৪’ ও তার মহিমা নিয়ে জায়গা করে নেবে।
[লেখক : সাবেক সভাপতি, ছাত্র ইউনিয়ন]