alt

উপ-সম্পাদকীয়

প্রসঙ্গ : পুরুষ ধর্ষণ

গাজী তারেক আজিজ

: শনিবার, ২২ মার্চ ২০২৫

বলাৎকারকে ‘পুরুষ ধর্ষণ’ গণ্য করতে উচ্চ আদালতে রিট করার খবর খবরের কাগজে ফলাও করে ছাপা হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার তাপস কান্তি বল হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় সম্প্রতি রিটটি করেন। মানবাধিকার কর্মী তাসমিয়া নূহাইয়া আহমেদ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের শিক্ষক ড. মাসুম বিল্লাহ এবং সমাজকর্মী ড. সৌমেন ভৌমিকের পক্ষে তিনি রিটটি দায়ের করেন।

রিটকারীদের ভাষ্যমতে- দ-বিধির ৩৭৫ ধারায় নারী ধর্ষণের অপরাধের পাশাপাশি ‘পুরুষ ধর্ষণকেও’ অপরাধ হিসেবে সংযুক্ত করতে এ ধারাটির সংশোধন চেয়েছেন। রিটের বিষয়টি নিশ্চিত করে ব্যারিস্টার তাপস কান্তি বল বলেন, ‘সম্প্রতি দেশে ছেলে শিশু তথা পুরুষকে যৌন নির্যাতন ও বলাৎকারের ঘটনা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে; কিন্তু এ ধরনের নির্যাতনকে ধর্ষণের অপরাধ হিসেবে বিচার করা যাচ্ছে না। তাই দ-বিধির ৩৭৫ ধারায় সংশোধন এনে ‘নারী ধর্ষণ’ এর অপরাধের পাশাপাশি অপরাধ হিসেবে ‘পুরুষ ধর্ষণ’ বিষয়টিকে যুক্ত করার আবেদন করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, রিটে দ-বিধির ৩৭৫ ধারায়, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের সংশ্লিষ্ট ধারায় প্রয়োজনীয় পরিবর্তন করে পুরুষ কর্তৃক শিশুদের বলাৎকারকে ধর্ষণ হিসেবে গণ্য করে এ ধরনের অপরাধ ধর্ষণের মতোই শাস্তিযোগ্য যাতে করা হয়Ñ সেটি আমরা চাই। তাহলে একটি বিষয় খুব পরিষ্কার, অহরহ ঘটে যাওয়া ঘটনা থেকে দুয়েকটা হয়তো পাদপ্রদীপের আলোয় আসে। অন্যটা আসে না। অথবা আসতে দেয়া হয় না। কেউ সামাজিক পারিবারিক সম্ভ্রমের কথা চিন্তা করে, অন্যরা গ্রামের মাতবরদের কথিত শালিস(নেপথ্যে বাণিজ্য) এর কারণে ধামাচাপা দিতে বাধ্য হয় পরিবার। না হলে নেমে আসে একঘরে করে রাখার অতিপরিচিত শাস্তির খড়্গ! আর এতেই দমে গিয়ে ভুক্তভোগী পরিবার চাইতে পারে না বিচার। দিতে পারে না নালিশ। গুমরে কেঁদে মরে আরও কেউ কেউ!

এদিকে প্রতিবেশী কর্তৃক ২০ বছরের যুবক ধর্ষিত মর্মে গত ১২ মার্চ কালের কন্ঠ পত্রিকায় সংবাদ করেছে। যার বিবরণ থেকে জানা যায়, রাস্তা থেকে ডেকে নিয়ে ২০ বছরের এক যুবককে ধর্ষণের অভিযোগ পাওয়া গেছে। ৮ ফেব্রুয়ারি নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার শাহী মসজিদ পল্লী বিদ্যুৎ রোড এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। ধর্ষণের শিকার ওই যুবকের মা বাদী হয়ে সোমবার (১০ মার্চ) রাতে বন্দর থানায় মামলা করেছেন। এ ধরনের কয়টা ঘটনা নিয়ে ঠিক মামলা হয়? নারী কর্তৃক পুরুষ ধর্ষণের বিচারের দাবিতে ঢাবিতে মানববন্ধন করেছে ‘এইড ফর মেন ফাউন্ডেশন’। তেমনই খবর প্রকাশ করেছে দৈনিক সংবাদ নামক প্রাচীন পত্রিকাটি; যা গত ৮ জানুয়ারি ২০২২ তারিখে। খবরটির শিরোনাম দেখলে চোখ তো কপালে উঠবেই সাথে বিশদ পড়লে শিউরে উঠবে যে কেউ! জেনে নেয়া যাক কি সেই খবরের বৃত্তান্তÑ

গাজীপুরের ভাওয়াল মাদকাসক্ত পুনর্বাসন কেন্দ্রে চিকিৎসাধীন একাধিক কিশোর ও যুবককে যৌন নির্যাতন ও ধর্ষণের ঘটনার প্রতিবাদে ‘ধর্ষক’ ফিরোজা নাজনীন বাঁধনের (৩৫) দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি, আইনে ধর্ষণের লিঙ্গ-নিরপেক্ষ সংজ্ঞা এবং দ-বিধি ৩৭৫ ধারার লিঙ্গ নিরপেক্ষ সংস্কার চেয়ে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছে ‘এইড ফর মেন ফাউন্ডেশন’ নামের একটি সংগঠন। মানববন্ধনে বক্তারা নারী কর্তৃক পুরুষ ধর্ষণ এবং যৌন নির্যাতনের বিচার দাবি করেন। স্পষ্টতই এ ঘটনার ভিকটিম এক বা একাধিক পুরুষ! আর যিনি ঘটিয়েছেন তিনি একজন নারী! তাহলে প্রশ্ন করার যথেষ্ট সুযোগ থাকছে, নারীরাও যৌন নিপীড়ন করে থাকতে পারে বা করেও। আর এটা বাস্তবতা। ভুক্তভোগীদের মানববন্ধনটি রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে করা হয়েছিল; যা জনাকীর্ণ এলাকায়। তাহলে এমনটা ভাবার অবকাশ নেই যে, গোপনে কিংবা কোন গোপন স্থানে মানববন্ধন করে কাউকে অপবাদ তথা ভিকটিমাইজ করার সুযোগও কম থাকে। জানা যায়নি সেই ঘটনাসমূহের জন্য যাকে দায়ী করা হয়েছিল, তিনি কি কোন প্রতিকারপ্রার্থী কিংবা প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন কি-না!

এইড ফর মেন ফাউন্ডেশনের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আহ্বায়ক মাহিন মূর্তজা বলেন, একাধিক গণমাধ্যমের প্রতিবেদন থেকে আমরা জানতে পারি যে, গাজীপুরের ‘ভাওয়াল মাদকাসক্ত পুনর্বাসন কেন্দ্রে’ আশ্রিত অপ্রাপ্তবয়স্ক কিশোরদের ওপর পাশবিক যৌন নির্যাতন করেছেন প্রতিষ্ঠানটির মালিক ফিরোজা নাজনীন ওরফে বাঁধন (৩৫)। এছাড়াও চিকিৎসা দেওয়ার নামে, পছন্দের পুরুষ রোগীদের ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালিয়ে তাদের সাথে জোরপূর্বক যৌন সম্পর্ক স্থাপন করতেন বলে গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। তার এই বিকৃত আচরণ ও জঘন্য অপরাধকে ‘ধর্ষণ’ ব্যতীত অন্যকিছু বলার সুযোগ নেই। একজন ধর্ষক, ধর্ষণের অপরাধের জন্য যেই শাস্তি পান, ফিরোজা নাজনীন বাঁধনকেও একই শাস্তি প্রদান করার দাবি জানাচ্ছি।’

ব্রিটেনের ল্যাংক্যাস্টার ইউনিভার্সিটির প্রফেসর ডক্টর সিওভান উইয়ার একটি গবেষণায় দেখান নারী কর্তৃক পুরুষ ধর্ষণ সম্ভব। বরং অসম্ভব মনে করাটাই একটা মিথ বা কাল্পনিক উপকথা। উক্ত গবেষণাটি ২০১৭ সালে প্রতিবেদন আকারে বিবিসিতে প্রকাশিতও হয়েছে। এ সংক্রান্তে বিবিসি নিউজ বাংলা একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তাতে উঠে এসেছে আরও কিছু তথ্য।

প্রতিবেদনটিতে বিবিসি উল্লেখ করেছে, বাংলাদেশে এরকম ছেলেশিশুর ওপর যৌন র্নিযাতনের ঘটনা বিভিন্ন সময়ই শোনা যায়। বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের হিসেবে, চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে ১১ জন ছেলেশিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। ২০১৮ সালে সংখ্যাটি ছিলো ৯ জন। আর ২০১৭ সালে ১৫ জন। কিন্তু বাস্তব চিত্র আরো ভয়াবহ বলেই মনে করে শিশু অধিকার সংগঠনগুলো।

বেসরকারি শিশু সংগঠন ব্রেকিং দ্য সাইলেন্সের নির্বাহী পরিচালক রোকসানা সুলতানা মনে করেন, বাংলাদেশে সামাজিকভাবেই ছেলে শিশুদের যৌন নির্যাতন বা ধর্ষণের বিষয়ে একধরণের নিরবতা কিংবা এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা আছে। ছেলেশিশু ধর্ষণের মামলা কোন আইনে? নিপীড়নের শিকার হওয়া শিশুর বাবা তার ছেলেশিশুর ধর্ষণের ঘটনায় থানায় যে মামলাটি করেছিলেন সে মামলাটি দায়ের হয়েছিলো দ-বিধির-৩৭৭ ধারায়। অথচ মামলাটি হওয়ার কথা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে। কারণ ৩৭৭ ধারায় শিশুর উপর যৌন নির্যাতনের বিষয়ে কোন বক্তব্য নেই।

ধারাটি মূলত প্রাকৃতিক নিয়মের বাইরে স্বেচ্ছায় যৌন সঙ্গম বা সমকামিতার অপরাধ বিষয়ে; কিন্তু নারী কর্তৃক পুরুষের প্রতি ধর্ষণের বিষয়টি কোন আইনেই সুনির্দিষ্ট করে বলা নেই। তার মানে কি এসব অপরাধ ঘটছে না? নিশ্চয়ই ঘটছে! উপরের আলোচনার সাথে সামঞ্জস্য রেখে বলা যায় মূলতঃ বহুবিধ কারণে বিষয়টিকে একজন পুরুষ এড়িয়ে যেতে চান। যা কাম্য নয়। ইচ্ছার বিরুদ্ধে যা-ই কিছু ঘটুক না কেন তা-ই অপরাধ। আর এ ধরনের অপরাধের প্রতিকার না চাইতে থাকলে মহামারী আকারে ছড়িয়ে যেতে পারে! তা-ই সবাইকে সোচ্চার থাকতে হবে। শাস্তি দিয়েই অপরাধ থেকে নিবৃত করা যায় না। সামাজিক পারিবারিক সচেতনতা বাড়াতে এবং যাদের মধ্যে এ ধরনের অপরাধ প্রবণতা পরিলক্ষিত হতে দেখা যাবে তাদের শুরুতেই প্রতিহত করার ব্যবস্থা করে এর বিরোধী বলয় তৈরি করতে হবে, যাতে করে অপরাধী মাত্রই বুঝতে পারে যে, অপরাধ করে হয়তো আইনের ফাঁকফোকর গলে বেরিয়ে যেতে পারে কিন্তু সমাজের মানুষজন তাকে ঠিকই চিহ্নিত করেছেÑ সে নিপীড়নকারী, যৌন হেনস্তাকারী, সে ধর্ষক, সে বলাৎকারকারী, সে ইভটিজার। এতে অপরাধ করতে যাওয়া লোকটির মনের ভেতর হয়তো প্রতিক্রিয়া তৈরি হবে। আর এতে সে ভালো পথে ফিরেও আসতে পারে। তবে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তিই কাম্য, কিন্তু তড়িঘড়ি বিচার-প্রক্রিয়ার কারণে অভিযুক্ত ব্যক্তিও যাতে ন্যায়বিচার বঞ্চিত না হয়। চাঞ্চল্যকর মামলায় মিডিয়া ট্রায়ালের ঝুঁকিতে যেন নিরপরাধ কাউকে শাস্তির খ—গ পোহাতে না হয়।

সর্বোপরি রাষ্ট্রে স্থিতিশীলতা কাম্য। অন্যথায় অপরাধ পরিক্রমার কারণে মানুষের ভেতর আক্রোশ জমে নিজেই বিচার করার প্রবণতায় আইন নিজের হাতে তুলে নিতে পারে। এতে বিচারহীনতার সংস্কৃতি তৈরি হতে পারে; যা সুখকর নয়।

[লেখক : অ্যাডভোকেট, জেলা ও দায়রা জজ আদালত, ফেনী]

শাহবাগ শাপলা বিভাজন : দায় যাদের তাদেরই করতে হবে নিরসন

বিশ্ব বর্ণবৈষম্য বিলোপ দিবস

নতুন রাজনৈতিক দল কি প্রত্যাশা পূরণ করতে পারবে?

ছবি

ভারতীয় চলচ্চিত্র ‘ছাভা’ : ইতিহাস বিকৃতির অভিযোগ

রম্যগদ্য : বোধ যখন ক্রোধ

গাছে পেরেক ঠোকা

মানুষ ও বন্য হাতি

আলুর চাষ, বীজ উৎপাদন ও সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ

অখণ্ড বাংলা তত্ত্ব : বাইনারিজম থেকে মুক্তির পথ

রূপকথার মতো মনে হলেও তিনি ছিলেন বাস্তবেরই নায়ক

গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আইন প্রতিষ্ঠার জন্য মুক্ত মত প্রকাশের গুরুত্ব

নিরাপদ অভিবাসন ও রেমিট্যান্স প্রবাহ

ভারতব্যাপী সংঘ : বিজেপির নয়া কৌশল

আর্থিক খাত নিয়ে অবিমৃষ্যকারী বক্তব্য

ভূমিকম্পের আগেই ব্যবস্থা নিতে হবে

নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধ করতেই হবে

মনে কী দ্বিধা রেখে নতুন প্রত্যাশায় নতুন দল!

ছবি

উন্নত বিশ্বের নাগরিকত্ব ও দুর্নীতি

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় : শিক্ষামন্ত্রীর গাড়ির নিচে ছাত্র

নারীর অধিকার, সমতা, ক্ষমতায়ন

আদালতের ভেতরে ভিডিও ধারণের আইনি দিক

আইনের শাসন না গণপিটুনি?

নারীর ভূমি ও কৃষি অধিকার : ন্যায়বিচারের পথে কতদূর?

রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের হালচাল

জনতুষ্টিবাদীরা এগিয়ে আছে যেদিক থেকে

ভিক্ষাবৃত্তি : প্রয়োজন নাকি পেশা?

ছবি

বিনিময় কৌশল নাকি বাণিজ্য যুদ্ধ?

শিশু আদালতের বিচার-প্রক্রিয়ার আইনি ও বাস্তবিক দিক

জনদুর্ভোগের অপসংস্কৃতি ও জনশিক্ষা : আগামীর দিকনির্দেশনা

প্রসঙ্গ : নেপাল থেকে বিদ্যুৎ আমদানি

হরিজনদের পদবি : ঐক্যের পথে বাধা

এল নিনো : দেশের কৃষির চ্যালেঞ্জ ও করণীয়

আর কীভাবে আর্জি জানালে নিরাপত্তা পাওয়া যায়?

স্বপ্ন ভাঙল সাঁওতাল মুংলু বেসরার

কোনো স্কুলই খারাপ না

ঢাকার যানজটের টেকসই সমাধান কী

tab

উপ-সম্পাদকীয়

প্রসঙ্গ : পুরুষ ধর্ষণ

গাজী তারেক আজিজ

শনিবার, ২২ মার্চ ২০২৫

বলাৎকারকে ‘পুরুষ ধর্ষণ’ গণ্য করতে উচ্চ আদালতে রিট করার খবর খবরের কাগজে ফলাও করে ছাপা হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার তাপস কান্তি বল হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় সম্প্রতি রিটটি করেন। মানবাধিকার কর্মী তাসমিয়া নূহাইয়া আহমেদ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের শিক্ষক ড. মাসুম বিল্লাহ এবং সমাজকর্মী ড. সৌমেন ভৌমিকের পক্ষে তিনি রিটটি দায়ের করেন।

রিটকারীদের ভাষ্যমতে- দ-বিধির ৩৭৫ ধারায় নারী ধর্ষণের অপরাধের পাশাপাশি ‘পুরুষ ধর্ষণকেও’ অপরাধ হিসেবে সংযুক্ত করতে এ ধারাটির সংশোধন চেয়েছেন। রিটের বিষয়টি নিশ্চিত করে ব্যারিস্টার তাপস কান্তি বল বলেন, ‘সম্প্রতি দেশে ছেলে শিশু তথা পুরুষকে যৌন নির্যাতন ও বলাৎকারের ঘটনা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে; কিন্তু এ ধরনের নির্যাতনকে ধর্ষণের অপরাধ হিসেবে বিচার করা যাচ্ছে না। তাই দ-বিধির ৩৭৫ ধারায় সংশোধন এনে ‘নারী ধর্ষণ’ এর অপরাধের পাশাপাশি অপরাধ হিসেবে ‘পুরুষ ধর্ষণ’ বিষয়টিকে যুক্ত করার আবেদন করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, রিটে দ-বিধির ৩৭৫ ধারায়, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের সংশ্লিষ্ট ধারায় প্রয়োজনীয় পরিবর্তন করে পুরুষ কর্তৃক শিশুদের বলাৎকারকে ধর্ষণ হিসেবে গণ্য করে এ ধরনের অপরাধ ধর্ষণের মতোই শাস্তিযোগ্য যাতে করা হয়Ñ সেটি আমরা চাই। তাহলে একটি বিষয় খুব পরিষ্কার, অহরহ ঘটে যাওয়া ঘটনা থেকে দুয়েকটা হয়তো পাদপ্রদীপের আলোয় আসে। অন্যটা আসে না। অথবা আসতে দেয়া হয় না। কেউ সামাজিক পারিবারিক সম্ভ্রমের কথা চিন্তা করে, অন্যরা গ্রামের মাতবরদের কথিত শালিস(নেপথ্যে বাণিজ্য) এর কারণে ধামাচাপা দিতে বাধ্য হয় পরিবার। না হলে নেমে আসে একঘরে করে রাখার অতিপরিচিত শাস্তির খড়্গ! আর এতেই দমে গিয়ে ভুক্তভোগী পরিবার চাইতে পারে না বিচার। দিতে পারে না নালিশ। গুমরে কেঁদে মরে আরও কেউ কেউ!

এদিকে প্রতিবেশী কর্তৃক ২০ বছরের যুবক ধর্ষিত মর্মে গত ১২ মার্চ কালের কন্ঠ পত্রিকায় সংবাদ করেছে। যার বিবরণ থেকে জানা যায়, রাস্তা থেকে ডেকে নিয়ে ২০ বছরের এক যুবককে ধর্ষণের অভিযোগ পাওয়া গেছে। ৮ ফেব্রুয়ারি নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার শাহী মসজিদ পল্লী বিদ্যুৎ রোড এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। ধর্ষণের শিকার ওই যুবকের মা বাদী হয়ে সোমবার (১০ মার্চ) রাতে বন্দর থানায় মামলা করেছেন। এ ধরনের কয়টা ঘটনা নিয়ে ঠিক মামলা হয়? নারী কর্তৃক পুরুষ ধর্ষণের বিচারের দাবিতে ঢাবিতে মানববন্ধন করেছে ‘এইড ফর মেন ফাউন্ডেশন’। তেমনই খবর প্রকাশ করেছে দৈনিক সংবাদ নামক প্রাচীন পত্রিকাটি; যা গত ৮ জানুয়ারি ২০২২ তারিখে। খবরটির শিরোনাম দেখলে চোখ তো কপালে উঠবেই সাথে বিশদ পড়লে শিউরে উঠবে যে কেউ! জেনে নেয়া যাক কি সেই খবরের বৃত্তান্তÑ

গাজীপুরের ভাওয়াল মাদকাসক্ত পুনর্বাসন কেন্দ্রে চিকিৎসাধীন একাধিক কিশোর ও যুবককে যৌন নির্যাতন ও ধর্ষণের ঘটনার প্রতিবাদে ‘ধর্ষক’ ফিরোজা নাজনীন বাঁধনের (৩৫) দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি, আইনে ধর্ষণের লিঙ্গ-নিরপেক্ষ সংজ্ঞা এবং দ-বিধি ৩৭৫ ধারার লিঙ্গ নিরপেক্ষ সংস্কার চেয়ে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছে ‘এইড ফর মেন ফাউন্ডেশন’ নামের একটি সংগঠন। মানববন্ধনে বক্তারা নারী কর্তৃক পুরুষ ধর্ষণ এবং যৌন নির্যাতনের বিচার দাবি করেন। স্পষ্টতই এ ঘটনার ভিকটিম এক বা একাধিক পুরুষ! আর যিনি ঘটিয়েছেন তিনি একজন নারী! তাহলে প্রশ্ন করার যথেষ্ট সুযোগ থাকছে, নারীরাও যৌন নিপীড়ন করে থাকতে পারে বা করেও। আর এটা বাস্তবতা। ভুক্তভোগীদের মানববন্ধনটি রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে করা হয়েছিল; যা জনাকীর্ণ এলাকায়। তাহলে এমনটা ভাবার অবকাশ নেই যে, গোপনে কিংবা কোন গোপন স্থানে মানববন্ধন করে কাউকে অপবাদ তথা ভিকটিমাইজ করার সুযোগও কম থাকে। জানা যায়নি সেই ঘটনাসমূহের জন্য যাকে দায়ী করা হয়েছিল, তিনি কি কোন প্রতিকারপ্রার্থী কিংবা প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন কি-না!

এইড ফর মেন ফাউন্ডেশনের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আহ্বায়ক মাহিন মূর্তজা বলেন, একাধিক গণমাধ্যমের প্রতিবেদন থেকে আমরা জানতে পারি যে, গাজীপুরের ‘ভাওয়াল মাদকাসক্ত পুনর্বাসন কেন্দ্রে’ আশ্রিত অপ্রাপ্তবয়স্ক কিশোরদের ওপর পাশবিক যৌন নির্যাতন করেছেন প্রতিষ্ঠানটির মালিক ফিরোজা নাজনীন ওরফে বাঁধন (৩৫)। এছাড়াও চিকিৎসা দেওয়ার নামে, পছন্দের পুরুষ রোগীদের ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালিয়ে তাদের সাথে জোরপূর্বক যৌন সম্পর্ক স্থাপন করতেন বলে গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। তার এই বিকৃত আচরণ ও জঘন্য অপরাধকে ‘ধর্ষণ’ ব্যতীত অন্যকিছু বলার সুযোগ নেই। একজন ধর্ষক, ধর্ষণের অপরাধের জন্য যেই শাস্তি পান, ফিরোজা নাজনীন বাঁধনকেও একই শাস্তি প্রদান করার দাবি জানাচ্ছি।’

ব্রিটেনের ল্যাংক্যাস্টার ইউনিভার্সিটির প্রফেসর ডক্টর সিওভান উইয়ার একটি গবেষণায় দেখান নারী কর্তৃক পুরুষ ধর্ষণ সম্ভব। বরং অসম্ভব মনে করাটাই একটা মিথ বা কাল্পনিক উপকথা। উক্ত গবেষণাটি ২০১৭ সালে প্রতিবেদন আকারে বিবিসিতে প্রকাশিতও হয়েছে। এ সংক্রান্তে বিবিসি নিউজ বাংলা একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তাতে উঠে এসেছে আরও কিছু তথ্য।

প্রতিবেদনটিতে বিবিসি উল্লেখ করেছে, বাংলাদেশে এরকম ছেলেশিশুর ওপর যৌন র্নিযাতনের ঘটনা বিভিন্ন সময়ই শোনা যায়। বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের হিসেবে, চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে ১১ জন ছেলেশিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। ২০১৮ সালে সংখ্যাটি ছিলো ৯ জন। আর ২০১৭ সালে ১৫ জন। কিন্তু বাস্তব চিত্র আরো ভয়াবহ বলেই মনে করে শিশু অধিকার সংগঠনগুলো।

বেসরকারি শিশু সংগঠন ব্রেকিং দ্য সাইলেন্সের নির্বাহী পরিচালক রোকসানা সুলতানা মনে করেন, বাংলাদেশে সামাজিকভাবেই ছেলে শিশুদের যৌন নির্যাতন বা ধর্ষণের বিষয়ে একধরণের নিরবতা কিংবা এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা আছে। ছেলেশিশু ধর্ষণের মামলা কোন আইনে? নিপীড়নের শিকার হওয়া শিশুর বাবা তার ছেলেশিশুর ধর্ষণের ঘটনায় থানায় যে মামলাটি করেছিলেন সে মামলাটি দায়ের হয়েছিলো দ-বিধির-৩৭৭ ধারায়। অথচ মামলাটি হওয়ার কথা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে। কারণ ৩৭৭ ধারায় শিশুর উপর যৌন নির্যাতনের বিষয়ে কোন বক্তব্য নেই।

ধারাটি মূলত প্রাকৃতিক নিয়মের বাইরে স্বেচ্ছায় যৌন সঙ্গম বা সমকামিতার অপরাধ বিষয়ে; কিন্তু নারী কর্তৃক পুরুষের প্রতি ধর্ষণের বিষয়টি কোন আইনেই সুনির্দিষ্ট করে বলা নেই। তার মানে কি এসব অপরাধ ঘটছে না? নিশ্চয়ই ঘটছে! উপরের আলোচনার সাথে সামঞ্জস্য রেখে বলা যায় মূলতঃ বহুবিধ কারণে বিষয়টিকে একজন পুরুষ এড়িয়ে যেতে চান। যা কাম্য নয়। ইচ্ছার বিরুদ্ধে যা-ই কিছু ঘটুক না কেন তা-ই অপরাধ। আর এ ধরনের অপরাধের প্রতিকার না চাইতে থাকলে মহামারী আকারে ছড়িয়ে যেতে পারে! তা-ই সবাইকে সোচ্চার থাকতে হবে। শাস্তি দিয়েই অপরাধ থেকে নিবৃত করা যায় না। সামাজিক পারিবারিক সচেতনতা বাড়াতে এবং যাদের মধ্যে এ ধরনের অপরাধ প্রবণতা পরিলক্ষিত হতে দেখা যাবে তাদের শুরুতেই প্রতিহত করার ব্যবস্থা করে এর বিরোধী বলয় তৈরি করতে হবে, যাতে করে অপরাধী মাত্রই বুঝতে পারে যে, অপরাধ করে হয়তো আইনের ফাঁকফোকর গলে বেরিয়ে যেতে পারে কিন্তু সমাজের মানুষজন তাকে ঠিকই চিহ্নিত করেছেÑ সে নিপীড়নকারী, যৌন হেনস্তাকারী, সে ধর্ষক, সে বলাৎকারকারী, সে ইভটিজার। এতে অপরাধ করতে যাওয়া লোকটির মনের ভেতর হয়তো প্রতিক্রিয়া তৈরি হবে। আর এতে সে ভালো পথে ফিরেও আসতে পারে। তবে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তিই কাম্য, কিন্তু তড়িঘড়ি বিচার-প্রক্রিয়ার কারণে অভিযুক্ত ব্যক্তিও যাতে ন্যায়বিচার বঞ্চিত না হয়। চাঞ্চল্যকর মামলায় মিডিয়া ট্রায়ালের ঝুঁকিতে যেন নিরপরাধ কাউকে শাস্তির খ—গ পোহাতে না হয়।

সর্বোপরি রাষ্ট্রে স্থিতিশীলতা কাম্য। অন্যথায় অপরাধ পরিক্রমার কারণে মানুষের ভেতর আক্রোশ জমে নিজেই বিচার করার প্রবণতায় আইন নিজের হাতে তুলে নিতে পারে। এতে বিচারহীনতার সংস্কৃতি তৈরি হতে পারে; যা সুখকর নয়।

[লেখক : অ্যাডভোকেট, জেলা ও দায়রা জজ আদালত, ফেনী]

back to top