alt

opinion » post-editorial

আমাদের বন, আমাদের পানি : প্রকৃতির সংকট ও আমাদের করণীয়

সাঈদ চৌধুরী

: সোমবার, ২৪ মার্চ ২০২৫

বন আর পানিÑ প্রকৃতির এই দুটি অমূল্য সম্পদ আমাদের জীবনের ভিত্তি। আজ বিশ্ব বন দিবস এবং আগামীকাল বিশ্ব পানি দিবস পালনের মধ্য দিয়ে আমরা এই দুটি উপাদানের গুরুত্বকে স্মরণ করছি। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, গাজীপুরে এই দুটি সম্পদে পরিপূর্ণ থাকার পরও আমরা নিজেদের কর্মকা-ের মাধ্যমে সেগুলোকে সংকটের মুখে ঠেলে দিচ্ছি।

আরডিআরসির গবেষণা গ্রন্থ “স্ট্যাটাস অব এনভায়রনমেন্ট গাজীপুর” অনুযায়ী, ২০০০ সালে গাজীপুরের বনভূমি ছিল ২৩.৪৪%, যা ২০২৩ সালে এসে কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৯.৪৯%-এ। পানির ক্ষেত্রেও চিত্র একই রকম ভয়াবহ। ২০০০ সালে জলভূমি ছিল ৬.৭৩%, যা ২০২৩ সালে নেমে এসেছে ৩.২৭%-এ। ২০২৫ সালে এসে এই হ্রাসের গতি আরও তীব্র হওয়া স্বাভাবিক। গাজীপুরে প্রাকৃতিক সম্পদের এই অবনমনের পাশাপাশি ঢাকার বাতাস ও পানির দূষণ যে কতটা ভয়ঙ্কর রূপ নিতে পারে, তা অনুমেয়। শ্রীপুরের ক্ষেত্রে এই সংকট আরও উদ্বেগজনক।

লবলং নদীর উৎস ক্ষিরু নদী হলেও ভূ-প্রকৃতিগত কারণে এটি এখন মাওনার নিম্নাঞ্চল থেকে শুরু বলে গণ্য করা হয়। কিন্তু মাওনার নয়নপুরে গেলে যে দৃশ্য চোখে পড়ে, তা হতাশার। সেখানে স্বচ্ছ পানির ধারার সঙ্গে দূষিত পানির মিশ্রণ এমন এক ভয়াবহ চিত্র তৈরি করেছে, যা আমাদের পরিবেশের করুণ অবস্থার প্রতিচ্ছবি। নয়নপুরে সিরামিক, টেক্সটাইল ও এসিড উৎপাদনকারী কারখানার বর্জ্য পানির পিএইচ মান ৬-এর নিচে নেমে যায়। শুকনো মৌসুমে এটি ৫-৫.৯-এর মধ্যে থাকে, যা অন্যান্য পরামিতি যেমন কালার (৪০০ প্লাটিনাম কোবাল্টের নিচে) ও টিডিএস (৩০০০-এর উপরে)-এর জন্যও হুমকি। এই দূষিত পানি থেকে উৎপন্ন গ্যাসীয় পদার্থ বায়ুদূষণকেও ত্বরান্বিত করছে।

লবলং নদীকে কালভার্ট দিয়ে সংকুচিত করা, শালদহে কারখানার বর্জ্য ও মুরগির ফার্মের দূষণ এবং ভালুকা থেকে বানার হয়ে শীতলক্ষ্যায় দূষণের বিস্তারÑ এসবই আমাদের জলাশয়গুলোর জন্য মৃত্যুঘণ্টা। লবলংয়ের পানি এখন চাষের অযোগ্য, শালদহ ও বানার বিপর্যয়ের দ্বারপ্রান্তে, আর পারুলীও শ্বাসরুদ্ধ। ভূগর্ভস্থ পানির ভবিষ্যৎও অনিশ্চিত।

বনের অবস্থা আরও করুণ। প্রতিদিন বনে আগুন লাগানো হচ্ছে, গজারি গাছ আর কিছু অবশিষ্ট উদ্ভিদ ছাড়া এটিকে আর বন বলা যায় না। আগুনের কারণে কাঠবিড়ালিসহ অনেক প্রাণী বিলুপ্তির পথে। বনের ভেতর দূষিত পানির নর্দমা, পাকা রাস্তা, বিদ্যুৎÑ এসব প্রাণীর অভয়ারণ্যকে ধ্বংস করেছে। দখল, আগুন আর কাটছাঁটের মাধ্যমে বন ক্রমশ সংকুচিত হচ্ছে। পাঁচ আগস্টের পরও দখল অপসারণে অভিযান অপ্রতুল।

এই সংকটের মূলে রয়েছে আমাদের অপরিকল্পিত উন্নয়ন ও সচেতনতার অভাব। পরিবেশ এখন আমাদের প্রথম চিন্তার বিষয় হওয়া উচিত, কিন্তু আমরা এমন সমস্যায় জর্জরিত যে পরিবেশ নিয়ে ভাবার সুযোগই পাই না। কেউ কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে বনে আগুন দিয়ে এই সম্পদ ধ্বংস করছে।

তবে কী করা যায়? অনেক কিছুই সম্ভব। সরকার বর্তমানে এ বিষয়ে কাজ করার চেষ্টা করছে এবং পরিবেশ উপদেষ্টাসহ সংশ্লিষ্টরা সমস্যা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। পরিকল্পিতভাবে এগোলে সমাধান সম্ভব। তবে কিছু পদক্ষেপ জরুরি :

দায়িত্বশীলদের নিয়োগ : পরিবেশ অধিদপ্তরে সৎ ও যোগ্য জনবল নিয়োগ করতে হবে। তাদের দায়িত্ব পালনের সক্ষমতা ও ব্যর্থতার কারণ স্পষ্ট করা দরকার।

নদী ও বন রক্ষা : নদী ও বনের পাড়ের মানুষদের কাজে লাগিয়ে, প্রতিটি খাল ও ড্রেনে কেন্দ্রীয় ইটিপি স্থাপন করতে হবে।

বর্জ্য ব্যবস্থাপনা : সলিড ওয়েস্ট ডাম্পিং স্টেশন, বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ ও গ্যাস উৎপাদনের ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।

আইনের প্রয়োগ : পরিবেশ দূষণকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে।

এখন আর বসে থাকার সময় নেই। খাদ্যে, মাংসে ভারী ধাতু ও ক্ষতিকর বিষের উপস্থিতি আমাদের ভবিষ্যৎকে হুমকির মুখে ফেলছে। বিজ্ঞানভিত্তিক চিন্তা ও সমন্বিত প্রচেষ্টা ছাড়া এই সংকট থেকে উত্তরণ অসম্ভব। আমাদের সবাইকে সচেতন হতে হবে, আর সংশ্লিষ্টদের কাছে এই বার্তা পৌঁছাতে হবে।

[লেখক : রসায়নবিদ]

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: অবক্ষয়ের চোরাবালিতে আলোর দিশারী

অটোমেশন ও দেশের যুব কর্মসংস্থানের ভবিষ্যৎ

দুর্যোগে ভয় নয়, প্রস্তুতিই শক্তি

বৈষম্যহীন সমাজের স্বপ্ন

ছবি

‘আল্লাহ তুই দেহিস’: এ কোন ঘৃণার আগুন, ছড়িয়ে গেল সবখানে!

চেকের মামলায় আসামী যেসব ডিফেন্স নিয়ে খালাস পেতে পারেন

খেলনাশিল্প: সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ

ছবি

প্রান্তিক মানুষের হৃদয়ে ফিরে আসা কালো মেঘ

গীর্জায় হামলার নেপথ্যে কী?

সংঘের শতবর্ষের রাজনৈতিক তাৎপর্য

দুর্নীতি আর চাঁদাবাজি রাজনৈতিক-সংস্কৃতির অংশ

বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস

বাংলার সংস্কৃতি : উৎস, বিবর্তন ও বর্তমান সমাজ-মনন

রম্যগদ্য: শিক্ষা সহজ, বিদ্যা কঠিন

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় জনগণের ভূমিকা উপেক্ষিত

শ্রমজীবী মানুষের শোভন কর্মসংস্থান

মূল্যস্ফীতি মোকাবেলায় বাংলাদেশের বাস্তবতা

প্রবারণার আলোয় আলোকিত হোক মানবজাতি

অস্ত্র নিয়ন্ত্রণে ওয়াশিংটনের শেষ সুযোগ?

পাহাড় থেকে সমতল: আদিবাসী নারীর নিরাপত্তা

সোশ্যাল মিডিয়ার ‘লাইক’ সংস্কৃতি: আসক্তি নাকি নতুন যোগাযোগ?

জাতিসংঘে রোহিঙ্গা ইস্যু

মালয়েশিয়ার অর্থনৈতিক পরিবর্তন: আমরা কী শিক্ষা নিতে পারি

রম্যগদ্য: “কেশ ফ্যালায় ভাই, কেশ ফ্যালায়...”

লোকপ্রশাসন বিভাগের শিক্ষার্থীর অধিকার: বিসিএস ও শিক্ষা ক্যাডারের বৈষম্য

ন্যাশনাল গ্যালারি : রঙতুলির মহাসমুদ্রে একদিন

যুব শক্তি বনাম বেকারত্ব

প্রযুক্তি, আর্থিক পরিকল্পনা ও গণিতের ব্যবহার

ফরাসি বিপ্লব: বৈষম্য নিরসনে সামগ্রিক মুক্তির প্রেরণা

অন্তর্বর্তী সরকারের নিউইয়র্ক সফর

প্রবীণদের যত্ন: নৈতিক দায়িত্ব থেকে সামাজিক শক্তি নির্মাণ

জনস্বাস্থ্য রক্ষায় তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধনের অপরিহার্যতা

জনমিতিক সুবিধা: স্বপ্নের দশক ও নীতিগত সংস্কারের অপরিহার্যতা

বিদ্যালয় ও মাঠ দখলের বিরুদ্ধে আদিবাসীদের সংগ্রাম

শিক্ষাসংস্কারে চাই সুস্পষ্ট লক্ষ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা

ভারতে এসআইআর বিতর্ক

tab

opinion » post-editorial

আমাদের বন, আমাদের পানি : প্রকৃতির সংকট ও আমাদের করণীয়

সাঈদ চৌধুরী

সোমবার, ২৪ মার্চ ২০২৫

বন আর পানিÑ প্রকৃতির এই দুটি অমূল্য সম্পদ আমাদের জীবনের ভিত্তি। আজ বিশ্ব বন দিবস এবং আগামীকাল বিশ্ব পানি দিবস পালনের মধ্য দিয়ে আমরা এই দুটি উপাদানের গুরুত্বকে স্মরণ করছি। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, গাজীপুরে এই দুটি সম্পদে পরিপূর্ণ থাকার পরও আমরা নিজেদের কর্মকা-ের মাধ্যমে সেগুলোকে সংকটের মুখে ঠেলে দিচ্ছি।

আরডিআরসির গবেষণা গ্রন্থ “স্ট্যাটাস অব এনভায়রনমেন্ট গাজীপুর” অনুযায়ী, ২০০০ সালে গাজীপুরের বনভূমি ছিল ২৩.৪৪%, যা ২০২৩ সালে এসে কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৯.৪৯%-এ। পানির ক্ষেত্রেও চিত্র একই রকম ভয়াবহ। ২০০০ সালে জলভূমি ছিল ৬.৭৩%, যা ২০২৩ সালে নেমে এসেছে ৩.২৭%-এ। ২০২৫ সালে এসে এই হ্রাসের গতি আরও তীব্র হওয়া স্বাভাবিক। গাজীপুরে প্রাকৃতিক সম্পদের এই অবনমনের পাশাপাশি ঢাকার বাতাস ও পানির দূষণ যে কতটা ভয়ঙ্কর রূপ নিতে পারে, তা অনুমেয়। শ্রীপুরের ক্ষেত্রে এই সংকট আরও উদ্বেগজনক।

লবলং নদীর উৎস ক্ষিরু নদী হলেও ভূ-প্রকৃতিগত কারণে এটি এখন মাওনার নিম্নাঞ্চল থেকে শুরু বলে গণ্য করা হয়। কিন্তু মাওনার নয়নপুরে গেলে যে দৃশ্য চোখে পড়ে, তা হতাশার। সেখানে স্বচ্ছ পানির ধারার সঙ্গে দূষিত পানির মিশ্রণ এমন এক ভয়াবহ চিত্র তৈরি করেছে, যা আমাদের পরিবেশের করুণ অবস্থার প্রতিচ্ছবি। নয়নপুরে সিরামিক, টেক্সটাইল ও এসিড উৎপাদনকারী কারখানার বর্জ্য পানির পিএইচ মান ৬-এর নিচে নেমে যায়। শুকনো মৌসুমে এটি ৫-৫.৯-এর মধ্যে থাকে, যা অন্যান্য পরামিতি যেমন কালার (৪০০ প্লাটিনাম কোবাল্টের নিচে) ও টিডিএস (৩০০০-এর উপরে)-এর জন্যও হুমকি। এই দূষিত পানি থেকে উৎপন্ন গ্যাসীয় পদার্থ বায়ুদূষণকেও ত্বরান্বিত করছে।

লবলং নদীকে কালভার্ট দিয়ে সংকুচিত করা, শালদহে কারখানার বর্জ্য ও মুরগির ফার্মের দূষণ এবং ভালুকা থেকে বানার হয়ে শীতলক্ষ্যায় দূষণের বিস্তারÑ এসবই আমাদের জলাশয়গুলোর জন্য মৃত্যুঘণ্টা। লবলংয়ের পানি এখন চাষের অযোগ্য, শালদহ ও বানার বিপর্যয়ের দ্বারপ্রান্তে, আর পারুলীও শ্বাসরুদ্ধ। ভূগর্ভস্থ পানির ভবিষ্যৎও অনিশ্চিত।

বনের অবস্থা আরও করুণ। প্রতিদিন বনে আগুন লাগানো হচ্ছে, গজারি গাছ আর কিছু অবশিষ্ট উদ্ভিদ ছাড়া এটিকে আর বন বলা যায় না। আগুনের কারণে কাঠবিড়ালিসহ অনেক প্রাণী বিলুপ্তির পথে। বনের ভেতর দূষিত পানির নর্দমা, পাকা রাস্তা, বিদ্যুৎÑ এসব প্রাণীর অভয়ারণ্যকে ধ্বংস করেছে। দখল, আগুন আর কাটছাঁটের মাধ্যমে বন ক্রমশ সংকুচিত হচ্ছে। পাঁচ আগস্টের পরও দখল অপসারণে অভিযান অপ্রতুল।

এই সংকটের মূলে রয়েছে আমাদের অপরিকল্পিত উন্নয়ন ও সচেতনতার অভাব। পরিবেশ এখন আমাদের প্রথম চিন্তার বিষয় হওয়া উচিত, কিন্তু আমরা এমন সমস্যায় জর্জরিত যে পরিবেশ নিয়ে ভাবার সুযোগই পাই না। কেউ কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে বনে আগুন দিয়ে এই সম্পদ ধ্বংস করছে।

তবে কী করা যায়? অনেক কিছুই সম্ভব। সরকার বর্তমানে এ বিষয়ে কাজ করার চেষ্টা করছে এবং পরিবেশ উপদেষ্টাসহ সংশ্লিষ্টরা সমস্যা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। পরিকল্পিতভাবে এগোলে সমাধান সম্ভব। তবে কিছু পদক্ষেপ জরুরি :

দায়িত্বশীলদের নিয়োগ : পরিবেশ অধিদপ্তরে সৎ ও যোগ্য জনবল নিয়োগ করতে হবে। তাদের দায়িত্ব পালনের সক্ষমতা ও ব্যর্থতার কারণ স্পষ্ট করা দরকার।

নদী ও বন রক্ষা : নদী ও বনের পাড়ের মানুষদের কাজে লাগিয়ে, প্রতিটি খাল ও ড্রেনে কেন্দ্রীয় ইটিপি স্থাপন করতে হবে।

বর্জ্য ব্যবস্থাপনা : সলিড ওয়েস্ট ডাম্পিং স্টেশন, বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ ও গ্যাস উৎপাদনের ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।

আইনের প্রয়োগ : পরিবেশ দূষণকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে।

এখন আর বসে থাকার সময় নেই। খাদ্যে, মাংসে ভারী ধাতু ও ক্ষতিকর বিষের উপস্থিতি আমাদের ভবিষ্যৎকে হুমকির মুখে ফেলছে। বিজ্ঞানভিত্তিক চিন্তা ও সমন্বিত প্রচেষ্টা ছাড়া এই সংকট থেকে উত্তরণ অসম্ভব। আমাদের সবাইকে সচেতন হতে হবে, আর সংশ্লিষ্টদের কাছে এই বার্তা পৌঁছাতে হবে।

[লেখক : রসায়নবিদ]

back to top