শুভাশিস ব্যানার্জি শুভ
মাটি শুধু একটি প্রাকৃতিক সম্পদ নয়, এটি জীবনের মূল উৎস। প্রতিটি প্রাণী ও জীবের খাদ্যের ভিত্তি এই স্বাস্থ্যকর মাটিÑএকটি জীবন্ত যৌগ, যা অতি ধীরে পরিবর্তিত হয়। জীবতত্ত্বের দৃষ্টিকোণ থেকে মাটির টিকে থাকার জন্য অক্সিজেন ও পানি অপরিহার্য। এটি ক্ষুদ্র জীব থেকে মানবগোষ্ঠী পর্যন্ত সকলের জন্য প্রয়োজনীয় উপাদান সরবরাহ করে। মাটি উদ্ভিদকে পুষ্টি দেয়, যা আমাদের খাদ্যের উৎস; পানিকে পরিশোধন করে পানযোগ্য করে, বন্যা থেকে রক্ষা করে, জীবের আশ্রয়স্থল হয়ে ওঠে এবং এমনকি অ্যান্টিবায়োটিকের মতো জীবনরক্ষাকারী উপাদানও জোগান দেয়। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্তÑখাদ্য নিরাপত্তা, বসবাস, যাতায়াত, চাষাবাদ, ফসল উৎপাদনÑসবকিছুই মাটির ওপর নির্ভরশীল।
কিন্তু অপরিকল্পিত ব্যবহারে মাটি তার স্বকীয়তা, গুণাগুণ ও শক্তি হারাচ্ছে। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে না শুধু মাটি, প্রকারান্তরে ক্ষতির মুখে পড়ছে মানুষও। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে শিল্পায়ন, নগরায়ণ, বাড়িঘর ও অবকাঠামো নির্মাণে চাষের জমি কমছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের নতুন চ্যালেঞ্জ।
মাটি রাতারাতি তৈরি হয়নি। লক্ষ-কোটি বছর ধরে শিলা ও পাথর জলস্রোতে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে ক্ষুদ্র মাটিকণায় রূপ নিয়েছে। মাটি কেবল মাটিকণা নয়Ñএর প্রায় অর্ধেক মাটিকণা, এক-চতুর্থাংশ পানি ও এক-চতুর্থাংশ বায়ু। পরিবেশ ও অবস্থাভেদে এই অনুপাত কম-বেশি হতে পারে, তবে এই তিন উপাদান মাটির গঠনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই ফাঁকা স্থানে বাস করে অণুজীব, যারা চোখে দেখা যায় না, কিন্তু মাটির জৈব পদার্থ পচিয়ে গাছের খাদ্য তৈরি করে, বর্জ্য থেকে পৃথিবীকে মুক্ত রাখে। ছত্রাক পুষ্টি এক গাছ থেকে অন্য গাছের শিকড়ে পৌঁছে দেয়; শিমগোত্রীয় গাছ বাতাসের নাইট্রোজেন মাটিতে সঞ্চয় করে উর্বরতা বাড়ায়। এভাবে মাটির ভেতর চলে জীবনের অদৃশ্য খেলা, যার ওপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে আছে আমাদের বাস্তুতন্ত্র।
দেশের আবাদি জমির পরিস্থিতি ভয়াবহ। সাম্প্রতিক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ৭২.৫ শতাংশ জমিতে জৈব পদার্থের ঘাটতি মারাত্মক। সুষম মাটিতে ৫ শতাংশ জৈব পদার্থ থাকা প্রয়োজন, কিন্তু বেশিরভাগ এলাকায় এটি ১ শতাংশেরও নিচে। আদর্শ জমিতে জৈব পদার্থের মাত্রা ৩.৫ শতাংশ হওয়া উচিত, অথচ গড়ে এটি ১.১৭ শতাংশ, কোথাও কোথাও ১ শতাংশেরও কম। ফসফরাস, পটাশিয়াম, গন্ধক, দস্তা, বোরন, ক্যালসিয়াম ও ম্যাগনেসিয়ামের অভাবে জমির উর্বরতা ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। জাতিসংঘের তথ্য বলছে, মাটির সঠিক ব্যবস্থাপনায় খাদ্য উৎপাদন ৫৮ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো সম্ভব।
মাটি জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধেও লড়াই করে। বায়ুম-লে নির্গত কার্বন ডাই-অক্সাইডের ৩০ শতাংশ ভূপৃষ্ঠ শোষণ করে। উদ্ভিদের সালোকসংশ্লেষণের মাধ্যমে এই কার্বন জৈবভরে রূপান্তরিত হয়। কিন্তু অপরিকল্পিত ব্যবহার, রাসায়নিক সারের অতি-প্রয়োগ, ভূমিক্ষয়, নদীভাঙন, লবণাক্ততা ও ভারী ধাতু দূষণ মাটির অবক্ষয় ঘটাচ্ছে। ভূগর্ভস্থ পানির অতিরিক্ত উত্তোলন ভূমিধস ও ক্ষয়কে ত্বরান্বিত করছে।
“জার্নাল অব এক্সপেরিমেন্টাল এগ্রিকালচার ইন্টারন্যাশনাল” প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জৈব চাষ টেকসই উন্নয়নের পথে মাটির ক্ষয় ও পরিবেশগত ক্ষতি কমাতে পারে। রাসায়নিক সার ও কীটনাশক এড়িয়ে জৈব পদার্থের ব্যবহার মাটির স্বাস্থ্য ও খাদ্যের মান উন্নত করে। আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে জৈব চাষের সমন্বয় কৃষি ব্যবস্থাকে টেকসই করে, গ্রামীণ জীবনযাত্রার মান বাড়ায়।
২০৫০ সালের মধ্যে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে খাদ্য উৎপাদন ৬০ শতাংশ বাড়াতে হবে। কিন্তু মাটির বাস্তুতন্ত্র ধ্বংস হলে প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হবে, কৃষি উৎপাদন হুমকির মুখে পড়বে। মাটিকে নদীর মতো জীবন্ত সত্তা হিসেবে দেখতে হবে। এর স্বাস্থ্য রক্ষায় যুগোপযোগী নীতি, গবেষণা ও সুব্যবস্থাপনা জরুরি। বিজ্ঞানীদের মতে, এক মিলিমিটার মাটি তৈরিতে শতাব্দী লাগে। এই অ-নবায়নযোগ্য সম্পদের স্বাস্থ্য না রক্ষা করলে টেকসই কৃষি অসম্ভব।
মাটির জীববৈচিত্র্যÑঅণুজীব, ছত্রাক, প্রটোজোয়াÑএর স্বাস্থ্যের জন্য অপরিহার্য। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) বলছে, “মাটির ব্যবস্থাপনা এমন হতে হবে যা বর্তমান চাহিদা মেটায়, কিন্তু ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ক্ষমতাকে ক্ষতিগ্রস্ত না করে।” মাটি প্রকৃতির বিস্ময়কর সৃষ্টি। আমাদের স্বার্থেই এর যথাযথ পরিচর্যা ও মূল্যায়ন অপরিহার্য।
[ লেখক : সংবাদকর্মী ]
শুভাশিস ব্যানার্জি শুভ
সোমবার, ২৪ মার্চ ২০২৫
মাটি শুধু একটি প্রাকৃতিক সম্পদ নয়, এটি জীবনের মূল উৎস। প্রতিটি প্রাণী ও জীবের খাদ্যের ভিত্তি এই স্বাস্থ্যকর মাটিÑএকটি জীবন্ত যৌগ, যা অতি ধীরে পরিবর্তিত হয়। জীবতত্ত্বের দৃষ্টিকোণ থেকে মাটির টিকে থাকার জন্য অক্সিজেন ও পানি অপরিহার্য। এটি ক্ষুদ্র জীব থেকে মানবগোষ্ঠী পর্যন্ত সকলের জন্য প্রয়োজনীয় উপাদান সরবরাহ করে। মাটি উদ্ভিদকে পুষ্টি দেয়, যা আমাদের খাদ্যের উৎস; পানিকে পরিশোধন করে পানযোগ্য করে, বন্যা থেকে রক্ষা করে, জীবের আশ্রয়স্থল হয়ে ওঠে এবং এমনকি অ্যান্টিবায়োটিকের মতো জীবনরক্ষাকারী উপাদানও জোগান দেয়। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্তÑখাদ্য নিরাপত্তা, বসবাস, যাতায়াত, চাষাবাদ, ফসল উৎপাদনÑসবকিছুই মাটির ওপর নির্ভরশীল।
কিন্তু অপরিকল্পিত ব্যবহারে মাটি তার স্বকীয়তা, গুণাগুণ ও শক্তি হারাচ্ছে। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে না শুধু মাটি, প্রকারান্তরে ক্ষতির মুখে পড়ছে মানুষও। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে শিল্পায়ন, নগরায়ণ, বাড়িঘর ও অবকাঠামো নির্মাণে চাষের জমি কমছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের নতুন চ্যালেঞ্জ।
মাটি রাতারাতি তৈরি হয়নি। লক্ষ-কোটি বছর ধরে শিলা ও পাথর জলস্রোতে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে ক্ষুদ্র মাটিকণায় রূপ নিয়েছে। মাটি কেবল মাটিকণা নয়Ñএর প্রায় অর্ধেক মাটিকণা, এক-চতুর্থাংশ পানি ও এক-চতুর্থাংশ বায়ু। পরিবেশ ও অবস্থাভেদে এই অনুপাত কম-বেশি হতে পারে, তবে এই তিন উপাদান মাটির গঠনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই ফাঁকা স্থানে বাস করে অণুজীব, যারা চোখে দেখা যায় না, কিন্তু মাটির জৈব পদার্থ পচিয়ে গাছের খাদ্য তৈরি করে, বর্জ্য থেকে পৃথিবীকে মুক্ত রাখে। ছত্রাক পুষ্টি এক গাছ থেকে অন্য গাছের শিকড়ে পৌঁছে দেয়; শিমগোত্রীয় গাছ বাতাসের নাইট্রোজেন মাটিতে সঞ্চয় করে উর্বরতা বাড়ায়। এভাবে মাটির ভেতর চলে জীবনের অদৃশ্য খেলা, যার ওপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে আছে আমাদের বাস্তুতন্ত্র।
দেশের আবাদি জমির পরিস্থিতি ভয়াবহ। সাম্প্রতিক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ৭২.৫ শতাংশ জমিতে জৈব পদার্থের ঘাটতি মারাত্মক। সুষম মাটিতে ৫ শতাংশ জৈব পদার্থ থাকা প্রয়োজন, কিন্তু বেশিরভাগ এলাকায় এটি ১ শতাংশেরও নিচে। আদর্শ জমিতে জৈব পদার্থের মাত্রা ৩.৫ শতাংশ হওয়া উচিত, অথচ গড়ে এটি ১.১৭ শতাংশ, কোথাও কোথাও ১ শতাংশেরও কম। ফসফরাস, পটাশিয়াম, গন্ধক, দস্তা, বোরন, ক্যালসিয়াম ও ম্যাগনেসিয়ামের অভাবে জমির উর্বরতা ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। জাতিসংঘের তথ্য বলছে, মাটির সঠিক ব্যবস্থাপনায় খাদ্য উৎপাদন ৫৮ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো সম্ভব।
মাটি জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধেও লড়াই করে। বায়ুম-লে নির্গত কার্বন ডাই-অক্সাইডের ৩০ শতাংশ ভূপৃষ্ঠ শোষণ করে। উদ্ভিদের সালোকসংশ্লেষণের মাধ্যমে এই কার্বন জৈবভরে রূপান্তরিত হয়। কিন্তু অপরিকল্পিত ব্যবহার, রাসায়নিক সারের অতি-প্রয়োগ, ভূমিক্ষয়, নদীভাঙন, লবণাক্ততা ও ভারী ধাতু দূষণ মাটির অবক্ষয় ঘটাচ্ছে। ভূগর্ভস্থ পানির অতিরিক্ত উত্তোলন ভূমিধস ও ক্ষয়কে ত্বরান্বিত করছে।
“জার্নাল অব এক্সপেরিমেন্টাল এগ্রিকালচার ইন্টারন্যাশনাল” প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জৈব চাষ টেকসই উন্নয়নের পথে মাটির ক্ষয় ও পরিবেশগত ক্ষতি কমাতে পারে। রাসায়নিক সার ও কীটনাশক এড়িয়ে জৈব পদার্থের ব্যবহার মাটির স্বাস্থ্য ও খাদ্যের মান উন্নত করে। আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে জৈব চাষের সমন্বয় কৃষি ব্যবস্থাকে টেকসই করে, গ্রামীণ জীবনযাত্রার মান বাড়ায়।
২০৫০ সালের মধ্যে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে খাদ্য উৎপাদন ৬০ শতাংশ বাড়াতে হবে। কিন্তু মাটির বাস্তুতন্ত্র ধ্বংস হলে প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হবে, কৃষি উৎপাদন হুমকির মুখে পড়বে। মাটিকে নদীর মতো জীবন্ত সত্তা হিসেবে দেখতে হবে। এর স্বাস্থ্য রক্ষায় যুগোপযোগী নীতি, গবেষণা ও সুব্যবস্থাপনা জরুরি। বিজ্ঞানীদের মতে, এক মিলিমিটার মাটি তৈরিতে শতাব্দী লাগে। এই অ-নবায়নযোগ্য সম্পদের স্বাস্থ্য না রক্ষা করলে টেকসই কৃষি অসম্ভব।
মাটির জীববৈচিত্র্যÑঅণুজীব, ছত্রাক, প্রটোজোয়াÑএর স্বাস্থ্যের জন্য অপরিহার্য। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) বলছে, “মাটির ব্যবস্থাপনা এমন হতে হবে যা বর্তমান চাহিদা মেটায়, কিন্তু ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ক্ষমতাকে ক্ষতিগ্রস্ত না করে।” মাটি প্রকৃতির বিস্ময়কর সৃষ্টি। আমাদের স্বার্থেই এর যথাযথ পরিচর্যা ও মূল্যায়ন অপরিহার্য।
[ লেখক : সংবাদকর্মী ]