গাজী তারেক আজিজ
একটি দেশ। অর্জনের পেছনে রয়েছে এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পটভূমি। দীর্ঘ লড়াইয়ের ফলে বহুল কাক্সিক্ষত এক অর্জন। যার আছে একটি ভূখ-, একটি পতাকা, একটি মানচিত্র, একটি জাতীয় সঙ্গীত। প্রাণ বিসর্জন দিতে হয়েছে ৩০ লক্ষ মানুষের। সম্ভ্রমহানি ঘটেছে ২ লক্ষ মা-বোনের। যার নেতৃত্বে অবিচল আস্থায় মানুষ সশস্ত্র লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল এই দেশের মুক্তিকামী জনতা, তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সেই বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জন্মলগ্নে জড়িয়ে রয়েছে তৎকালীন পাকিস্তান নামক একটি বর্বর রাষ্ট্র কর্তৃক নারকীয় ধ্বংসযজ্ঞের রক্তাক্ত এক উপাখ্যান।
তৎকালীন পাকিস্তানের আগ্রাসী হওয়ার একটি নজিরবিহীন ঘটনার কাল ছিল সেই দিন। ১৯৭১ সালে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর নির্বিচার হত্যাযজ্ঞের দিন এই কালরাত। সংঘটিত হয়েছিল ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে; যার সাংকেতিক বা ছদ্মনাম দেয়া হয়েছিল অপারেশন সার্চলাইট। তৎকালীন পূর্বপাকিস্তান তথা বর্তমান বাংলাদেশের মানুষের কাছে এই দিনটি ঘৃণ্য, বর্বরোচিত, পৈশাচিক উন্মত্ততায় ভরা, নারকীয় তা-বলীলার উল্লম্ফ মঞ্চায়নের দিন। আজও মানুষ ভয়ে কুঁকড়ে ওঠে সেই সেদিনের কথা মনে করে। বাংলাদেশ দিনটিকে পালন করে আসছে গণহত্যা দিবস হিসেবে। ইতিহাসের পাতায় দিনটি ঠাঁই পেয়েছে ভয়াল কালরাত হিসেবে। সেই রাতে হামলার উদ্দেশ্য ছিল স্বাধিকার আন্দোলন দমিয়ে রাখা। স্বাধীনতার দাবিকে স্তিমিত করে দেয়ার পরিপূর্ণ নীলনকশার বাস্তবায়ন; যা ছিল নিন্দনীয়, ন্যক্কারজনক, নজিরবিহীন! বিশ্বের ইতিহাসে বিরল রক্তক্ষরণের ইতিহাস।
একটি উদ্ভট রাষ্ট্রতত্ত্ব থেকে দুই মেরুর দুই ভূখ- দিয়ে গড়ে তোলা হয়েছিল একই শাসন ক্ষমতায় পরিচালিত একটি দেশ! অবাস্তব, অবৈজ্ঞানি, কাল্পনিক আর হঠকারী চালের কারণে অভ্যুদয় থেকেই বঞ্চিত, নিগৃহীত, নিষ্পেষিত হয়ে আসতে থাকা একটি দেশের জনগণের। যাদের ভাষাগত, সংস্কৃতিগত, ঐতিহ্যগত, চিন্তাগত, ভৌগোলিক দৃষ্টিভঙ্গিসহ প্রাত্যহিক কত-শত অমিল নিয়ে গঠিত হওয়া কাল্পনিক কাঠামোর বাস্তব রূপ দানকারী একটি দেশের শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েই একের পর এক একপেশে মনোভাবের প্রতিফলন ঘটাতে শুরু করে আধিপত্য বিস্তারে দমন-পীড়ন; যা বাংলাদেশের মানুষজন কখনই মেনে নেয়নি। ফলশ্রুতিতে ৪৭ সালে উদ্ভট তত্ত্বের দেশভাগ। বাংলাদেশ নামক একটি রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের সূতিকাগার মূলতঃ ৫২ সালের মাতৃভাষা আন্দোলন। যখন বাংলা নয় উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। এমন ঘোষণায় বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। আন্দোলন আর রক্ত ঝরিয়ে সে দাবি বাস্তবায়নে বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে পিছু হটিয়ে দিয়েছিল উর্দুভাষী শাসকের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে যাবার দিন! তারপরও পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠী বাংলাদেশকে শাসনের নামে শোষণ করেই যাচ্ছিল। তারই ধারাবাহিকতায় ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে আইয়ুব খান পদত্যাগে বাধ্য হয়। ৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের পরও রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন হতে না দেয়া। ধারাবাহিকতায় তীব্রতর হতে থাকে পাকিস্তান বিরোধী আন্দোলন। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের দাবি তখন জোরালো হয়ে ওঠে। এরই প্রেক্ষিতে নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর পেশিশক্তির নির্মম প্রদর্শনে ঝাঁপিয়ে পড়ে পাকিস্তানি হানাদার আর তাদের এদেশীয় মিত্র রাজাকার, আলবদর, আলশামস নিয়ে গঠিত দোসররা; যার একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণে থাকে জামায়াতে ইসলামী নামক দলটির নেতারা। স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরও যুদ্ধাপরাধী দল হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া দলটি ১৯৭১ সালে তাদের কৃতকর্মের জন্য অনুশোচনা কিংবা দায় স্বীকার করে ক্ষমা পর্যন্ত চায়নি। উপরন্তু তারা দম্ভ করে বলে বেড়িয়েছে, দেশে কোন মুক্তিযুদ্ধ হয়নি, হয়েছে গৃহযুদ্ধ! এই আস্ফালনও জাতিকে চেয়ে দেখতে হয়েছে। তারচেয়েও তামাশার বিষয় হচ্ছে, স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরোধিতা করেও স্বাধীন বাংলাদেশের বুকে জাতীয় পতাকা লাগানো গাড়িতে ঘুরে বেড়িয়েছে।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে ব্যাপক গণহত্যা চালিয়ে বাঙালি জাতিকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী যে সশস্ত্র অভিযান পরিচালনা করে, তারই নাম অপারেশন সার্চলাইট। এই অভিযানের নির্দেশনামা তৈরি করে পাকিস্তানের দুই সামরিক কর্মকর্তা মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজা ও মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী। এই নির্দেশনামার কোনো লিখিত নথি রাখা হয়নি। গণহত্যার সেই পুরো নির্দেশ মুখে মুখে ফরমেশন কমান্ডার বা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের জানানো হয়। অথচ এই গণহত্যার একক, একতরফা ও একচেটিয়া দায় তৎকালীন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর; কিন্তু এই হত্যাযজ্ঞ নিয়ে তাদের কোন ধরণের বিচারের মুখোমুখি হতে হয়নি! জাতিসংঘও ২৫ মার্চের তথা সারা ৭১ সাল জুড়ে সংঘটিত হত্যাকা-ের জন্য কোনরূপ বিচারের উদ্যোগ নিয়ে আন্তর্জাতিক আদালতে অভিযোগ উত্থাপিত করা কিংবা বিচার কিংবা বিধিনিষেধ আরোপ করার কথা আজও শোনা যায়নি। তার মানে কী দাঁড়ায়? তৎকালীন সময়ে আমেরিকা পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠীর পক্ষে থাকায় জাতিসংঘ নির্বিকার ছিল বলে ধরে নিতে পারি!
১৯৭১ সালে একতরফা সেনা অভিযান শুরু করে। সেই রাতের ঘটনাটি খোদ পাকিস্তানের সেনা অফিসার নিজের লেখা আত্মজৈবনিক বইয়ে বর্ণনা করেন, ২০১২ সালে, মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজা এ স্ট্রেঞ্জার ইন মাই ওন কান্ট্রি নামে আত্মজীবনী প্রকাশ করেন। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস প্রকাশিত সে আত্মজীবনীতে প্রথমবারের মতো অপারেশন সার্চলাইট সম্পর্কে কিছু তথ্য প্রকাশিত হয়। অপারেশন সার্চলাইট কীভাবে পরিকল্পিত হয়, ১৯৭১ সালের সেই স্মৃতিচারণ করে রাজা লিখেছেন- ১৭ মার্চ, সকাল প্রায় ১০টা বাজে। টিক্কা খান আমাকে ও মেজর জেনারেল ফরমানকে কমান্ড হাউসে গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করতে খবর পাঠান। খবর পেয়ে আমরা দুজন টিক্কা খানের সঙ্গে দেখা করি। গিয়ে দেখি, সেখানে জেনারেল আবদুল হামিদ খানও রয়েছেন। টিক্কা খান আমাদের বলেন, প্রেসিডেন্টের সঙ্গে শেখ মুজিবের সমঝোতা আলোচনা ইতিবাচক দিকে এগোচ্ছে না। প্রেসিডেন্ট চান আমরা যেন সামরিক অভিযানের প্রস্তুতি গ্রহণ করি এবং সে অনুযায়ী একটা পরিকল্পনা তৈরি করি। এছাড়া আর কোনো মৌখিক বা লিখিত নির্দেশনা আমরা পাইনি। আমাদের বলা হয়, পরদিন ১৮ মার্চ বিকেলে আমরা দুজন যেন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে ওই পরিকল্পনা চূড়ান্ত করি। পরদিন সকালেই খাদিম হোসেন রাজা তার কার্যালয়ে রাও ফরমান আলীকে নিয়ে বসেন। তারাই গণহত্যার এ অভিযানের নাম দেন অপারেশন সার্চলাইট। যদিও অপারেশনটিতে ঠিক কতজনকে হত্যা করা হয়েছে সেই কথা তিনি উল্লেখ করেননি; যাতে তার সম্পৃক্ততার কথা স্পষ্ট করলেও কোন দায় নেয়ার কথা তিনি স্বীকার করেননি; কিন্তু মার্কিন সাংবাদিক রবার্ট পেইন ২৫ মার্চ রাত সম্পর্কে লিখেছেন, সেই রাতে ৭০০০ মানুষকে হত্যা করা হয়, গ্রেফতার করা হল আরও ৩ হাজার লোক। ঢাকায় ঘটনার শুরু মাত্র হয়েছিল। সমস্ত পূর্ব পাকিস্তান জুড়ে সৈন্যরা বাড়িয়ে চললো মৃতের সংখ্যা। জ্বালাতে শুরু করলো ঘর-বাড়ি, দোকান-পাট। লুট আর ধ্বংস যেন তাদের নেশায় পরিণত হলো। রাস্তায় রাস্তায় পড়ে থাকা মৃতদেহগুলো কাক-শেয়ালের খাবারে পরিণত হল। সমস্ত বাংলাদেশ হয়ে উঠলো শ্মশান ভূমি। লাশগুলো হয়ে উঠলো শকুনের খাবার। এত এত লাশ দেখে শকুনও যেন বিলাসী হয়ে উঠেছিল। তারা যেনে বেছে বেছে খেতে চাইলো! সংখ্যার বিচারে একরাতেই ঢাকায় ১০ হাজারের অধিক নিরীহ বেসামরিক লোক হত্যার দৃষ্টান্ত বিশ্বের ইতিহাসে এতই বিরল যে, অবলীলায় এটিকে গণহত্যা হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। সারাদেশের সঠিক হিসেব পাওয়াটা ছিল একটু কঠিনই। তবে ক্ষমতার পালাবদল না ঘটিয়ে চালানো হয়েছিল নির্মম হত্যাযজ্ঞ। আর এতে করেই বাঙালীদের মন বিষিয়ে ওঠে।
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান অপারেশন সার্চ লাইট পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সব পদক্ষেপ চূড়ান্ত করে গোপনে ঢাকা ত্যাগ করে করাচি চলে যায়; যা ছিল অত্যাচারী শাসকের শেষ অস্ত্র! বাঙালীরা সেদিন দুর্বৃত্ত সেই শাসকের ওপর আস্থা হারিয়েছিল। সেনা অভিযানের শুরুতেই হানাদার বাহিনী বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তার ধানমন্ডির বাসভবন থেকে গ্রেপ্তার করে। আর এতে করেই দাবানলের মতো মানবস্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে পড়ে দেশের আনাচে-কানাচে। গ্রেফতারের আগে ২৬ মার্চ (২৫ মার্চ মধ্যরাতে) বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং যে কোন মূল্যে শত্রুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানান।
বঙ্গবন্ধুর এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে বীর বাঙালিরা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং দীর্ঘ ৯ মাস সশস্ত্র লড়াই শেষে একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর পূর্ণ বিজয় অর্জন করে। অভ্যুদয় ঘটে নতুন রাষ্ট্রের; যার বলে বলীয়ান হয়ে, যে মন্ত্রে উদ্দীপিত হয়েÑ লড়াই আর সংগ্রামে অর্জিত হয় বিশ্ব মানচিত্রে নতুন একটি দেশ।
[লেখক : অ্যাডভোকেট, জেলা ও দায়রা জজ আদালত, ফেনী]
গাজী তারেক আজিজ
মঙ্গলবার, ২৫ মার্চ ২০২৫
একটি দেশ। অর্জনের পেছনে রয়েছে এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পটভূমি। দীর্ঘ লড়াইয়ের ফলে বহুল কাক্সিক্ষত এক অর্জন। যার আছে একটি ভূখ-, একটি পতাকা, একটি মানচিত্র, একটি জাতীয় সঙ্গীত। প্রাণ বিসর্জন দিতে হয়েছে ৩০ লক্ষ মানুষের। সম্ভ্রমহানি ঘটেছে ২ লক্ষ মা-বোনের। যার নেতৃত্বে অবিচল আস্থায় মানুষ সশস্ত্র লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল এই দেশের মুক্তিকামী জনতা, তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সেই বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জন্মলগ্নে জড়িয়ে রয়েছে তৎকালীন পাকিস্তান নামক একটি বর্বর রাষ্ট্র কর্তৃক নারকীয় ধ্বংসযজ্ঞের রক্তাক্ত এক উপাখ্যান।
তৎকালীন পাকিস্তানের আগ্রাসী হওয়ার একটি নজিরবিহীন ঘটনার কাল ছিল সেই দিন। ১৯৭১ সালে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর নির্বিচার হত্যাযজ্ঞের দিন এই কালরাত। সংঘটিত হয়েছিল ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে; যার সাংকেতিক বা ছদ্মনাম দেয়া হয়েছিল অপারেশন সার্চলাইট। তৎকালীন পূর্বপাকিস্তান তথা বর্তমান বাংলাদেশের মানুষের কাছে এই দিনটি ঘৃণ্য, বর্বরোচিত, পৈশাচিক উন্মত্ততায় ভরা, নারকীয় তা-বলীলার উল্লম্ফ মঞ্চায়নের দিন। আজও মানুষ ভয়ে কুঁকড়ে ওঠে সেই সেদিনের কথা মনে করে। বাংলাদেশ দিনটিকে পালন করে আসছে গণহত্যা দিবস হিসেবে। ইতিহাসের পাতায় দিনটি ঠাঁই পেয়েছে ভয়াল কালরাত হিসেবে। সেই রাতে হামলার উদ্দেশ্য ছিল স্বাধিকার আন্দোলন দমিয়ে রাখা। স্বাধীনতার দাবিকে স্তিমিত করে দেয়ার পরিপূর্ণ নীলনকশার বাস্তবায়ন; যা ছিল নিন্দনীয়, ন্যক্কারজনক, নজিরবিহীন! বিশ্বের ইতিহাসে বিরল রক্তক্ষরণের ইতিহাস।
একটি উদ্ভট রাষ্ট্রতত্ত্ব থেকে দুই মেরুর দুই ভূখ- দিয়ে গড়ে তোলা হয়েছিল একই শাসন ক্ষমতায় পরিচালিত একটি দেশ! অবাস্তব, অবৈজ্ঞানি, কাল্পনিক আর হঠকারী চালের কারণে অভ্যুদয় থেকেই বঞ্চিত, নিগৃহীত, নিষ্পেষিত হয়ে আসতে থাকা একটি দেশের জনগণের। যাদের ভাষাগত, সংস্কৃতিগত, ঐতিহ্যগত, চিন্তাগত, ভৌগোলিক দৃষ্টিভঙ্গিসহ প্রাত্যহিক কত-শত অমিল নিয়ে গঠিত হওয়া কাল্পনিক কাঠামোর বাস্তব রূপ দানকারী একটি দেশের শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েই একের পর এক একপেশে মনোভাবের প্রতিফলন ঘটাতে শুরু করে আধিপত্য বিস্তারে দমন-পীড়ন; যা বাংলাদেশের মানুষজন কখনই মেনে নেয়নি। ফলশ্রুতিতে ৪৭ সালে উদ্ভট তত্ত্বের দেশভাগ। বাংলাদেশ নামক একটি রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের সূতিকাগার মূলতঃ ৫২ সালের মাতৃভাষা আন্দোলন। যখন বাংলা নয় উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। এমন ঘোষণায় বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। আন্দোলন আর রক্ত ঝরিয়ে সে দাবি বাস্তবায়নে বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে পিছু হটিয়ে দিয়েছিল উর্দুভাষী শাসকের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে যাবার দিন! তারপরও পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠী বাংলাদেশকে শাসনের নামে শোষণ করেই যাচ্ছিল। তারই ধারাবাহিকতায় ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে আইয়ুব খান পদত্যাগে বাধ্য হয়। ৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের পরও রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন হতে না দেয়া। ধারাবাহিকতায় তীব্রতর হতে থাকে পাকিস্তান বিরোধী আন্দোলন। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের দাবি তখন জোরালো হয়ে ওঠে। এরই প্রেক্ষিতে নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর পেশিশক্তির নির্মম প্রদর্শনে ঝাঁপিয়ে পড়ে পাকিস্তানি হানাদার আর তাদের এদেশীয় মিত্র রাজাকার, আলবদর, আলশামস নিয়ে গঠিত দোসররা; যার একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণে থাকে জামায়াতে ইসলামী নামক দলটির নেতারা। স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরও যুদ্ধাপরাধী দল হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া দলটি ১৯৭১ সালে তাদের কৃতকর্মের জন্য অনুশোচনা কিংবা দায় স্বীকার করে ক্ষমা পর্যন্ত চায়নি। উপরন্তু তারা দম্ভ করে বলে বেড়িয়েছে, দেশে কোন মুক্তিযুদ্ধ হয়নি, হয়েছে গৃহযুদ্ধ! এই আস্ফালনও জাতিকে চেয়ে দেখতে হয়েছে। তারচেয়েও তামাশার বিষয় হচ্ছে, স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরোধিতা করেও স্বাধীন বাংলাদেশের বুকে জাতীয় পতাকা লাগানো গাড়িতে ঘুরে বেড়িয়েছে।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে ব্যাপক গণহত্যা চালিয়ে বাঙালি জাতিকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী যে সশস্ত্র অভিযান পরিচালনা করে, তারই নাম অপারেশন সার্চলাইট। এই অভিযানের নির্দেশনামা তৈরি করে পাকিস্তানের দুই সামরিক কর্মকর্তা মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজা ও মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী। এই নির্দেশনামার কোনো লিখিত নথি রাখা হয়নি। গণহত্যার সেই পুরো নির্দেশ মুখে মুখে ফরমেশন কমান্ডার বা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের জানানো হয়। অথচ এই গণহত্যার একক, একতরফা ও একচেটিয়া দায় তৎকালীন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর; কিন্তু এই হত্যাযজ্ঞ নিয়ে তাদের কোন ধরণের বিচারের মুখোমুখি হতে হয়নি! জাতিসংঘও ২৫ মার্চের তথা সারা ৭১ সাল জুড়ে সংঘটিত হত্যাকা-ের জন্য কোনরূপ বিচারের উদ্যোগ নিয়ে আন্তর্জাতিক আদালতে অভিযোগ উত্থাপিত করা কিংবা বিচার কিংবা বিধিনিষেধ আরোপ করার কথা আজও শোনা যায়নি। তার মানে কী দাঁড়ায়? তৎকালীন সময়ে আমেরিকা পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠীর পক্ষে থাকায় জাতিসংঘ নির্বিকার ছিল বলে ধরে নিতে পারি!
১৯৭১ সালে একতরফা সেনা অভিযান শুরু করে। সেই রাতের ঘটনাটি খোদ পাকিস্তানের সেনা অফিসার নিজের লেখা আত্মজৈবনিক বইয়ে বর্ণনা করেন, ২০১২ সালে, মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজা এ স্ট্রেঞ্জার ইন মাই ওন কান্ট্রি নামে আত্মজীবনী প্রকাশ করেন। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস প্রকাশিত সে আত্মজীবনীতে প্রথমবারের মতো অপারেশন সার্চলাইট সম্পর্কে কিছু তথ্য প্রকাশিত হয়। অপারেশন সার্চলাইট কীভাবে পরিকল্পিত হয়, ১৯৭১ সালের সেই স্মৃতিচারণ করে রাজা লিখেছেন- ১৭ মার্চ, সকাল প্রায় ১০টা বাজে। টিক্কা খান আমাকে ও মেজর জেনারেল ফরমানকে কমান্ড হাউসে গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করতে খবর পাঠান। খবর পেয়ে আমরা দুজন টিক্কা খানের সঙ্গে দেখা করি। গিয়ে দেখি, সেখানে জেনারেল আবদুল হামিদ খানও রয়েছেন। টিক্কা খান আমাদের বলেন, প্রেসিডেন্টের সঙ্গে শেখ মুজিবের সমঝোতা আলোচনা ইতিবাচক দিকে এগোচ্ছে না। প্রেসিডেন্ট চান আমরা যেন সামরিক অভিযানের প্রস্তুতি গ্রহণ করি এবং সে অনুযায়ী একটা পরিকল্পনা তৈরি করি। এছাড়া আর কোনো মৌখিক বা লিখিত নির্দেশনা আমরা পাইনি। আমাদের বলা হয়, পরদিন ১৮ মার্চ বিকেলে আমরা দুজন যেন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে ওই পরিকল্পনা চূড়ান্ত করি। পরদিন সকালেই খাদিম হোসেন রাজা তার কার্যালয়ে রাও ফরমান আলীকে নিয়ে বসেন। তারাই গণহত্যার এ অভিযানের নাম দেন অপারেশন সার্চলাইট। যদিও অপারেশনটিতে ঠিক কতজনকে হত্যা করা হয়েছে সেই কথা তিনি উল্লেখ করেননি; যাতে তার সম্পৃক্ততার কথা স্পষ্ট করলেও কোন দায় নেয়ার কথা তিনি স্বীকার করেননি; কিন্তু মার্কিন সাংবাদিক রবার্ট পেইন ২৫ মার্চ রাত সম্পর্কে লিখেছেন, সেই রাতে ৭০০০ মানুষকে হত্যা করা হয়, গ্রেফতার করা হল আরও ৩ হাজার লোক। ঢাকায় ঘটনার শুরু মাত্র হয়েছিল। সমস্ত পূর্ব পাকিস্তান জুড়ে সৈন্যরা বাড়িয়ে চললো মৃতের সংখ্যা। জ্বালাতে শুরু করলো ঘর-বাড়ি, দোকান-পাট। লুট আর ধ্বংস যেন তাদের নেশায় পরিণত হলো। রাস্তায় রাস্তায় পড়ে থাকা মৃতদেহগুলো কাক-শেয়ালের খাবারে পরিণত হল। সমস্ত বাংলাদেশ হয়ে উঠলো শ্মশান ভূমি। লাশগুলো হয়ে উঠলো শকুনের খাবার। এত এত লাশ দেখে শকুনও যেন বিলাসী হয়ে উঠেছিল। তারা যেনে বেছে বেছে খেতে চাইলো! সংখ্যার বিচারে একরাতেই ঢাকায় ১০ হাজারের অধিক নিরীহ বেসামরিক লোক হত্যার দৃষ্টান্ত বিশ্বের ইতিহাসে এতই বিরল যে, অবলীলায় এটিকে গণহত্যা হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। সারাদেশের সঠিক হিসেব পাওয়াটা ছিল একটু কঠিনই। তবে ক্ষমতার পালাবদল না ঘটিয়ে চালানো হয়েছিল নির্মম হত্যাযজ্ঞ। আর এতে করেই বাঙালীদের মন বিষিয়ে ওঠে।
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান অপারেশন সার্চ লাইট পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সব পদক্ষেপ চূড়ান্ত করে গোপনে ঢাকা ত্যাগ করে করাচি চলে যায়; যা ছিল অত্যাচারী শাসকের শেষ অস্ত্র! বাঙালীরা সেদিন দুর্বৃত্ত সেই শাসকের ওপর আস্থা হারিয়েছিল। সেনা অভিযানের শুরুতেই হানাদার বাহিনী বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তার ধানমন্ডির বাসভবন থেকে গ্রেপ্তার করে। আর এতে করেই দাবানলের মতো মানবস্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে পড়ে দেশের আনাচে-কানাচে। গ্রেফতারের আগে ২৬ মার্চ (২৫ মার্চ মধ্যরাতে) বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং যে কোন মূল্যে শত্রুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানান।
বঙ্গবন্ধুর এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে বীর বাঙালিরা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং দীর্ঘ ৯ মাস সশস্ত্র লড়াই শেষে একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর পূর্ণ বিজয় অর্জন করে। অভ্যুদয় ঘটে নতুন রাষ্ট্রের; যার বলে বলীয়ান হয়ে, যে মন্ত্রে উদ্দীপিত হয়েÑ লড়াই আর সংগ্রামে অর্জিত হয় বিশ্ব মানচিত্রে নতুন একটি দেশ।
[লেখক : অ্যাডভোকেট, জেলা ও দায়রা জজ আদালত, ফেনী]