alt

উপ-সম্পাদকীয়

আইনস্টাইনের দেশে

শঙ্কর প্রসাদ দে

: শনিবার, ২৯ মার্চ ২০২৫

জার্মানি দেখার প্রবল ইচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে তাড়িত করেছে কৈশোর থেকে। তিনটি কারনে তথা আর্যজাতি, হিটলার ও আইনস্টাইনের জন্মভূমি বলে এই কৌতূহল গ্রাস করেছে সময় পরিক্রমায়। ভারতবর্ষের ইতিহাস পড়তে গিয়ে দেখলাম, বেশিরভাগ প-িত মনে করেন উত্তর সাগরের শৈত্যপ্রবাহ জর্জরিত জার্মানির মানুষ অপেক্ষাকৃত একটি সহনশীল আবহাওয়ার ভূখ- খুঁজছিল। সৌভাগ্যক্রমে বেশিরভাগ নাতিশীতোষ্ণ ঋতু বৈচিত্র্যের ভারতে শুরু হয় সাদা চামড়ার এক বিশাল জনগোষ্ঠীর অভিবাসন। বৌদ্ধ, খ্রিস্ট এবং ইসলামের মতো শক্তিশালী ধর্মের তখনো আবির্ভাব হয়নি। আর্যদের আদিভূমি জার্মানি ও মধ্য এশিয়ায় ধর্ম বিশ^াস বলে যা ছিল তাকে এক কথায় বলা যায় প্রকৃতি বন্দনা।

আর্য জনগোষ্ঠীর মূল প্রবণতাই ছিল খাদ্য ও পশুপালনের প্রয়োজনে স্থান পরিবর্তন। স্থান পরিবর্তন বা গমনশীলতার এই প্রবণতা থেকে ‘আর্য’ শব্দের উৎপত্তি। আর্যদের বিশাল একটি অংশ আজ থেকে মোটামুটি ৪/৫ হাজার বছর আগে বসতি গড়েছিল মধ্য এশিয়ায়। এরা স্থলপথে ভারতবর্ষের পথ আবিষ্কারের পর দলে দলে আসতে থাকে আজকের নদীবিধৌত পাঞ্জাব অঞ্চলে। এরপর যেখানে কর্ষণযোগ্য ভূমি পেয়েছে সেখানেই ছড়িয়ে পড়েছে। আর্যরা আসার আগে থেকেই ভারতবর্ষে কৃষির অগ্রগতি হয়েছিল। অনার্য বা দ্রাবিড়রা তখন জীবন যাপনে বহুল পরিমাণে কৃষির ওপর নির্ভরশীল ছিল। সিন্ধু সভ্যতা তার প্রকৃষ্ঠ প্রমাণ।

প্রাপ্ত প্রতœসামগ্রী থেকে বোঝা যাচ্ছে সনাতন ধর্ম তখন আদিম পর্যায় অতিক্রম করছিল। এজন্য একদল বিশেষজ্ঞের ধারণা আর্যদের আগমনের বক্তব্য সঠিক নয়। এ কথায় পরে আসছি।

গবেষকদের বড় অংশ মনে করেন প্রথমে আজকের জার্মানি অতঃপর মধ্য এশিয়া থেকে আর্যরা ভারতে আসার পর শতাব্দী থেকে শতাব্দী ধরে ভারতের সনাতন ধর্মীয় দর্শনগুলোকে গ্রহণ করে নিজেদের মতো করে। ভারতীয় দর্শন এবং ইউরোপীয় দর্শনের যুগলবন্দী হয়ে দেব দেবী অধ্যুষিত আজকের সনাতন ধর্মের বিকাশ ঘটে। তবে এটি অবশ্যই রামায়ন মহাভারত পরবর্তী সময়কাল। আর্যরা যে এসেছিল তার স্বপক্ষে জোড়ালো যুক্তি হল, এরা দ্রাবিড়দের সাথে বিবাহ সহ সামাজিক অন্যান্য বন্ধনে আবদ্ধ হয়নি। মহাভারত পড়লে বুঝা যায় ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় সৃষ্টির কারিগর আর্যরা। বৈশ্য ও শুদ্রদের গায়ের রং দেখলেই বুঝা যায় এরা অনার্য বা দ্রাবিড়দের উত্তর পুরুষ। বেশিরভাগ বৈশ্য আর প্রায় শতভাগ শুদ্রদের গায়ের রং ইঙ্গিত করে এরা ভারতবর্ষের আদিবাসিন্দা।

অন্যদিকে আর্যরা যে এদেশের ভূমিপুত্র তার বড় প্রমাণের প্রথমটি সিন্ধুসভ্যতা। একটি অভিজাত শ্রেণী এসব নগর সভ্যতার শাসক ছিল। প্রতœ নিদর্শনে মন্দির, মূর্তিসহ বহু ধরনের তৈজষপত্র থেকে বোঝা যাচ্ছে পূর্জার্চনার জন্য ব্রাহ্মণদের সৃষ্টি এই ভূখ- থেকেই। বলা হচ্ছে কাশ্মীরের মতো ফর্সা মানুষ অধ্যুষিত এলাকা ভারতবর্ষে আরো অনেক ছিল। ঐসব মানুষগুলো পেশা হিসেবে পৌরহিত্যকে গ্রহণ করেছিল। অর্থাৎ শীতপ্রধান শে^তবর্ণের ভারতীয়রা একদল হয়েছে ব্রাহ্মণ আরেকদল ক্ষত্রিয়। আবার অনেকে ভারতবর্ষের বিভিন্ন এলাকায় ব্যবসা বাণিজ্য সহ বিভিন্ন কারণে থিতু হয়। বিভিন্ন গোত্র ও পেশাজীবীদের সাথে এসব ফর্সা মানুষদের সামাজিকতা ও বিবাহ সম্পর্ক ক্রমশ; বেড়েই চলেছিল। এ কারণে বৈশ্যদের মধ্যে সংখ্যায় কম হলেও দীর্ঘ দৈহিক গঠন ও ফর্সা গায়ের রংয়ের এক অভিজাত শ্রেণীর অস্তিত্ব হয়েছে বিকশিত। আজকের সেনগুপ্ত দাশগুপ্ত উঁচু শ্রেণীর এই বৈশ্যদের সর্বশেষ উত্তরাধিকার।

রামায়ণ ও মহাভারত দুটো পড়লে বোঝা যায় হিন্দুদের স্বর্গনরক হিমালয়ের অপর পাশে। সমুদ্র মন্থন মহাপাপ। শিবসহ অনেক দেবতার সাধনস্থল তুষার ধবল হিমালয় শৃঙ্গে। মহাভারত পর্বে আর্যরা এ-ভূখ-ে আসলে এসব আজগুবি অন্ধ বিশ^াস জায়গা করার যুক্তি খুঁজে পাওয়া যায় না। বরং বলা যায় হিন্দুদের অভিজাত শ্রেনীর সৃষ্টি হয়েছে এই ভারতভূমি থেকে। সিন্ধু সভ্যতা পন্থীদের মতে আর্য বলে কোন জনগোষ্ঠী কথিত মতে ভারতবর্ষে আসেনি। তবুও আর্যদের আদি নিবাস জার্মানি দেখার সাধ তাড়িত করেছে হামবুর্গ পদার্পণ পর্যন্ত।

ছোটবেলা থেকেই ইতিহাস এবং বিজ্ঞান তাড়িত করেছে নিরন্তর। জীবনভর দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধের উপর পড়তে গিয়ে স্তম্ভিত হয়েছি এডলফ হিটলারের চিন্তা, ঔদ্ধত্য ও সাংগঠনিক দক্ষতা দেখে। অষ্ট্রিয়ান বংশোদ্ভূত হিটলার শিল্পী হতে চেয়েছিলেন। প্রথম বিশ^যুদ্ধ তাকে সৈনিক জীবনে টেনে নিয়ে যায়। বীরত্বের জন্য দুটো মেডেল প্রাপ্ত হলেও একরকম মৃত্যুর হাত থেকে ফিরে এসেছিলেন। প্রথম বিশ^যুদ্ধ শেষ, অতঃপর মিত্র শক্তি ইতিহাস খ্যাত ভার্সাইচুক্তি সম্পাদনে জার্মানিকে বাধ্য করে। ভার্সাই চুক্তি এতোই অপমানজনক ছিল যে মিত্র শক্তির অনুমোদন ছাড়া একটি বিমানও কেনা যাচ্ছিল না।

হিটলার ওয়ারকার্স পার্টিতে জ¦ালাময়ী বক্তৃতা দিয়ে বলতে লাগলেন এই অপমানজনক চুক্তি মানা যায় না। মধ্যপন্থী ওয়াকার্স পার্টি, ক্রমশ উগ্র জাতীয়তাবাদী ধারায় প্রবাহিত হলো। হিটলার নেতৃত্বে উঠে আসার অব্যবহিত পরই দলটির নাম রাখা হল ‘নাৎসি পার্টি’। এর পরেরটা শুধুই ইতিহাস। ১৯৩৩ সালে নির্বাচিত ‘ফিউরার’ হয়েই ভার্সাই চুক্তি মানেন না বলে ঘোষণা দিলেন। তার মতে নীল রক্তের জার্মানরাই একমাত্র এরিয়ান বা আর্য নৃগোষ্ঠী এবং পৃথিবীর সব’চে অভিজাত জনগোষ্ঠী। অবশিষ্ট পৃথিবী শাসনের অধিকার একমাত্র জার্মানদের। কট্টর ক্যাথলিকপন্থী হিটলার এও ঘোষণা করলেন জার্মান বা মানবজাতির প্রধানশত্রু ইহুদীরা। এরাই যিশুখৃষ্টকে ক্রুশবিদ্ধ করার জন্য দায়ী।

হিটলারের আদর্শিক অবস্থানের সাথে কখনোই একমত ছিলাম না। তিনি জার্মানির ক্ষমতা নিয়েছিলেন ১৯৩৩ সালে। মাত্র ৬ বছরের ব্যবধানে জার্মান অর্থনীতিকে পরিণত করেছিলেন বিশ^সেরা। সমরাস্ত্র ও বিমান উৎপাদনে টেক্কা দিয়েছিলেন ব্রিটেন ফ্রান্সকে। পৃথিবী শাসনের উদগ্র আকাঙ্খা নিয়ে ১ সেপ্টেম্বর ১৯৩৯ দখলে নিলেন পোল্যান্ড। এরপর ইউরোপ, আফ্রিকা ও এশিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চল পদানত করে হাত বাড়ালেন রাশিয়ার দিকে। এটিই ছিল হিটলারের সর্বশেষ মরণভুল।

ধারণা করা হয় রাশিয়ার তীব্র শীতে দশ লাখ জার্মান সৈন্যের বরফ মৃত্যু ঘটেছিল। রুশ সৈন্যদের হাতে বন্দী হওয়ার আগে ৩০ এপ্রিল ১৯৪৫ খ্রি: ইভা ব্রাউনসহ হিটলার আত্মহত্যা করেন। ইতিহাসে মহাবীর অর্জুন, আলেকজান্ডার, চেঙ্গিস খান, নেপোলিয়েনের কাহিনী পড়েছি। বীরত্বের জন্য ‘দ্য আলেকজান্ডার’ ‘দ্য নেপোলিয়েন’ প্রত্যয় ব্যবহৃত হয়। মাত্র ১২ বছরের শাসনকালে রাষ্ট্রনায়ক হিটলার বীরত্বের যে কাহিনী সৃষ্টি করেছেন ‘দ্য হিটলার’ প্রত্যয় ব্যবহৃত হওয়ার জোরালো যুক্তি থাকে। হামবুর্গ থেকে ফ্রাঙ্কফুট ওডার পর্যন্ত হাজার কিলোমিটার ঘুরেছি বাস আর ট্রেনে। হিটলারের প্রিয় ‘রাইখস্ট্যাগ’ (সংসদ ভবন) এখনো দাঁড়িয়ে আছে। ভবনটি দেখে নয়ন ভরে দেখলাম আর ভাবলাম এই ভবন থেকে হিটলার বিশ^ শাসনের ঔদ্বত্যপূর্ণ ভাষণ দিয়েছিলেন।

নবম শ্রেণীতে বিজ্ঞানের শিক্ষক রাখাল স্যার ক্লাস লেকচারে প্রশ্ন করেছিলেন আলোর গতিপথ কেমন? বলেছিলাম, আলো সরল রেখায় চলে। স্যার বলেছেন না- আইনস্টাইনের মতে আলো অনেক সময় বেঁকে যায়। বড় হলে আলো কখন এবং কেন বেঁকে যায় তা বুঝতে পারবে। যতই বড় হয়েছি ততই আইনস্টাইনের ভক্ত হতে থাকলাম। প্রবল ইচ্ছে জাগল পৃথিবীর আর কোথাও না যাই অন্তত আইনস্টাইনের মৃত্যুভূমি জার্মানি যাব। কৈশোরে দুটো বিষয় আইনস্টাইনকে ধাঁধায় ফেলেছিল। প্রথমটি হলো, আলোর গতি যেহেতু সেকেন্ড প্রায় ৩ লক্ষ কিলোমিটার এবং আমি যদি ৩ লক্ষ কিলোমিটার গতিতে দৌড়াতে পারি তবে আলোর তরঙ্গ গতিহীন স্থির হয়ে যাওয়ার কথা।

এই ধাঁধার উত্তর খুঁজতে গিয়ে আবিষ্কার করে ফেললেন সাধারণ আপেক্ষিকতা (১৯০৫) ও বিশেষ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব (১৯১৫)। এতদিন মনে করা হতো সময় একক সত্তার অধিকারী। পৃথিবীর ১ ঘণ্টা মঙ্গল গ্রহেও ১ ঘণ্টা। আইনস্টাইন প্রমাণ করলেন পৃথিবীতে ঘণ্টায় ১০০ কিমি. গতিতে গাড়ি চালালে আমার লাগবে ১ ঘণ্টা। কিন্তু মঙ্গল গ্রহের মাধ্যাকর্ষণ পৃথিবীর তুলনায় মাত্র ৩৮%। সুতরাং মঙ্গলে ১০০ কিমি. পার হতে গাড়িতে ১ ঘণ্টার চেয়ে কম সময় লাগবে।

পদার্থবিজ্ঞানের নিত্য নতুন সব তথ্যের ব্যাখ্যা মিলে আইনস্টাইনের তত্ত্বে। ইনিই প্রথম দাবি করলেন ঈশ^রের ইচ্ছে বা অনিচ্ছায় নয় বরং পদার্থবিদ্যার নিজস্ব নিয়মে বিশ^ ব্রহ্মা-ের সৃষ্টি। এই তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে ‘ল্যা মাত্রে’ ‘বিগ ব্যাং’ তত্ত্বের প্রস্তাব করলেন। এডুইন হাবল প্রমাণ করলেন সিঙ্গুলারিটিতে প্রচ- বিস্ফোরণ থেকে ব্রহ্মা-ের সৃষ্টি ও বিকাশ। যদিও বিগ ব্যাং পরবর্তী মুহূর্তে প্রকাশিত রাসায়নিক অনুপাতে দেখা যায়, ৭৬ ভাগ হাইড্রোজেন ২৪ ভাগের কিছু কম হিলিয়াম গ্রহণযোগ্য হলেও মাত্র ০০০০০৭ ভাগ লিথিয়ামের উপস্থিতি নিতান্তই কম। এই সামান্য লিথিয়াম উপস্থিতির কারণে ব্রহ্মা- অনবরত সম্প্রসারণের যথাযথ ব্যাখ্যা পাওয়া যাচ্ছে না।

যাইহোক আইনস্টাইনের মৃত্যুভূমি দেখব না এটা কি হয়? এই অতৃপ্ত বাসনার ক্ষুধা মিটাতে সপ্তাহ ধরে জার্মানি ঘুরে বুঝলাম জার্মানরা আসলেই আভিজাত্যের ধারক বাহক। ঐ ভূ-খ-েই প্রকৃতির নিয়মে হিটলার ও আইনস্টাইনের মতো প্রতিভার জন্ম নেয়াটাই স্বাভাবিক।

[লেখক : আইনজীবী, আপিল বিভাগ]

জমি-জমার রেকর্ড সংশোধনে নতুন পরিপত্র ও প্রাসঙ্গিক আইন

র্অথনতৈকি উন্নয়নে জাকাতরে ভূমকিা

কবে মিলবে নতুন নোট

আওয়ামী লীগ থেকে অন্য দলগুলো কি শিক্ষা গ্রহণ করবে?

আজি নূতন রতনে ভূষণে যতনে...

ঈদে বাড়ি ফেরা নিরাপদ হোক

পেঁয়াজের আদ্যোপান্ত

রঙ্গব্যঙ্গ : ‘প্রতিধ্বনি শুনি আমি, প্রতিধ্বনি শুনি...’

মালাকারটোলা গণহত্যা

‘বৈষম্যহীন বাংলায়’ দলিতদের প্রতি সীমাহীন বৈষম্য

বাংলাদেশের রাজনীতি এক কঠিন সন্ধিক্ষণে

স্বাধীনতার ৫৪ বছর

একাত্তরের মার্চে কেমন ছিল শ্রীমঙ্গল

ছবি

মুক্তিযুদ্ধে ভাটি বাংলা

ছবি

‘বীরের রক্তস্রোত, মায়ের অশ্রুধারায়’ প্রাপ্ত স্বাধীনতা

ছবি

সুন্দরবন : দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় জনপদের ভরসার স্থল

কখন বসন্ত গেল, এবার হল না গান

সেই কালরাত

মাটির যথার্থ পরিচর্যা : জীবনের ভিত রক্ষার আহ্বান

আমাদের বন, আমাদের পানি : প্রকৃতির সংকট ও আমাদের করণীয়

আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার কোনো বিকল্প নেই

রামনবমী ঘিরে সাম্প্রদায়িক কৌশল

ঈদে মিলবে না নতুন নোট

প্রসঙ্গ : পুরুষ ধর্ষণ

শাহবাগ শাপলা বিভাজন : দায় যাদের তাদেরই করতে হবে নিরসন

বিশ্ব বর্ণবৈষম্য বিলোপ দিবস

নতুন রাজনৈতিক দল কি প্রত্যাশা পূরণ করতে পারবে?

ছবি

ভারতীয় চলচ্চিত্র ‘ছাভা’ : ইতিহাস বিকৃতির অভিযোগ

রম্যগদ্য : বোধ যখন ক্রোধ

গাছে পেরেক ঠোকা

মানুষ ও বন্য হাতি

আলুর চাষ, বীজ উৎপাদন ও সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ

অখণ্ড বাংলা তত্ত্ব : বাইনারিজম থেকে মুক্তির পথ

রূপকথার মতো মনে হলেও তিনি ছিলেন বাস্তবেরই নায়ক

গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আইন প্রতিষ্ঠার জন্য মুক্ত মত প্রকাশের গুরুত্ব

নিরাপদ অভিবাসন ও রেমিট্যান্স প্রবাহ

tab

উপ-সম্পাদকীয়

আইনস্টাইনের দেশে

শঙ্কর প্রসাদ দে

শনিবার, ২৯ মার্চ ২০২৫

জার্মানি দেখার প্রবল ইচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে তাড়িত করেছে কৈশোর থেকে। তিনটি কারনে তথা আর্যজাতি, হিটলার ও আইনস্টাইনের জন্মভূমি বলে এই কৌতূহল গ্রাস করেছে সময় পরিক্রমায়। ভারতবর্ষের ইতিহাস পড়তে গিয়ে দেখলাম, বেশিরভাগ প-িত মনে করেন উত্তর সাগরের শৈত্যপ্রবাহ জর্জরিত জার্মানির মানুষ অপেক্ষাকৃত একটি সহনশীল আবহাওয়ার ভূখ- খুঁজছিল। সৌভাগ্যক্রমে বেশিরভাগ নাতিশীতোষ্ণ ঋতু বৈচিত্র্যের ভারতে শুরু হয় সাদা চামড়ার এক বিশাল জনগোষ্ঠীর অভিবাসন। বৌদ্ধ, খ্রিস্ট এবং ইসলামের মতো শক্তিশালী ধর্মের তখনো আবির্ভাব হয়নি। আর্যদের আদিভূমি জার্মানি ও মধ্য এশিয়ায় ধর্ম বিশ^াস বলে যা ছিল তাকে এক কথায় বলা যায় প্রকৃতি বন্দনা।

আর্য জনগোষ্ঠীর মূল প্রবণতাই ছিল খাদ্য ও পশুপালনের প্রয়োজনে স্থান পরিবর্তন। স্থান পরিবর্তন বা গমনশীলতার এই প্রবণতা থেকে ‘আর্য’ শব্দের উৎপত্তি। আর্যদের বিশাল একটি অংশ আজ থেকে মোটামুটি ৪/৫ হাজার বছর আগে বসতি গড়েছিল মধ্য এশিয়ায়। এরা স্থলপথে ভারতবর্ষের পথ আবিষ্কারের পর দলে দলে আসতে থাকে আজকের নদীবিধৌত পাঞ্জাব অঞ্চলে। এরপর যেখানে কর্ষণযোগ্য ভূমি পেয়েছে সেখানেই ছড়িয়ে পড়েছে। আর্যরা আসার আগে থেকেই ভারতবর্ষে কৃষির অগ্রগতি হয়েছিল। অনার্য বা দ্রাবিড়রা তখন জীবন যাপনে বহুল পরিমাণে কৃষির ওপর নির্ভরশীল ছিল। সিন্ধু সভ্যতা তার প্রকৃষ্ঠ প্রমাণ।

প্রাপ্ত প্রতœসামগ্রী থেকে বোঝা যাচ্ছে সনাতন ধর্ম তখন আদিম পর্যায় অতিক্রম করছিল। এজন্য একদল বিশেষজ্ঞের ধারণা আর্যদের আগমনের বক্তব্য সঠিক নয়। এ কথায় পরে আসছি।

গবেষকদের বড় অংশ মনে করেন প্রথমে আজকের জার্মানি অতঃপর মধ্য এশিয়া থেকে আর্যরা ভারতে আসার পর শতাব্দী থেকে শতাব্দী ধরে ভারতের সনাতন ধর্মীয় দর্শনগুলোকে গ্রহণ করে নিজেদের মতো করে। ভারতীয় দর্শন এবং ইউরোপীয় দর্শনের যুগলবন্দী হয়ে দেব দেবী অধ্যুষিত আজকের সনাতন ধর্মের বিকাশ ঘটে। তবে এটি অবশ্যই রামায়ন মহাভারত পরবর্তী সময়কাল। আর্যরা যে এসেছিল তার স্বপক্ষে জোড়ালো যুক্তি হল, এরা দ্রাবিড়দের সাথে বিবাহ সহ সামাজিক অন্যান্য বন্ধনে আবদ্ধ হয়নি। মহাভারত পড়লে বুঝা যায় ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় সৃষ্টির কারিগর আর্যরা। বৈশ্য ও শুদ্রদের গায়ের রং দেখলেই বুঝা যায় এরা অনার্য বা দ্রাবিড়দের উত্তর পুরুষ। বেশিরভাগ বৈশ্য আর প্রায় শতভাগ শুদ্রদের গায়ের রং ইঙ্গিত করে এরা ভারতবর্ষের আদিবাসিন্দা।

অন্যদিকে আর্যরা যে এদেশের ভূমিপুত্র তার বড় প্রমাণের প্রথমটি সিন্ধুসভ্যতা। একটি অভিজাত শ্রেণী এসব নগর সভ্যতার শাসক ছিল। প্রতœ নিদর্শনে মন্দির, মূর্তিসহ বহু ধরনের তৈজষপত্র থেকে বোঝা যাচ্ছে পূর্জার্চনার জন্য ব্রাহ্মণদের সৃষ্টি এই ভূখ- থেকেই। বলা হচ্ছে কাশ্মীরের মতো ফর্সা মানুষ অধ্যুষিত এলাকা ভারতবর্ষে আরো অনেক ছিল। ঐসব মানুষগুলো পেশা হিসেবে পৌরহিত্যকে গ্রহণ করেছিল। অর্থাৎ শীতপ্রধান শে^তবর্ণের ভারতীয়রা একদল হয়েছে ব্রাহ্মণ আরেকদল ক্ষত্রিয়। আবার অনেকে ভারতবর্ষের বিভিন্ন এলাকায় ব্যবসা বাণিজ্য সহ বিভিন্ন কারণে থিতু হয়। বিভিন্ন গোত্র ও পেশাজীবীদের সাথে এসব ফর্সা মানুষদের সামাজিকতা ও বিবাহ সম্পর্ক ক্রমশ; বেড়েই চলেছিল। এ কারণে বৈশ্যদের মধ্যে সংখ্যায় কম হলেও দীর্ঘ দৈহিক গঠন ও ফর্সা গায়ের রংয়ের এক অভিজাত শ্রেণীর অস্তিত্ব হয়েছে বিকশিত। আজকের সেনগুপ্ত দাশগুপ্ত উঁচু শ্রেণীর এই বৈশ্যদের সর্বশেষ উত্তরাধিকার।

রামায়ণ ও মহাভারত দুটো পড়লে বোঝা যায় হিন্দুদের স্বর্গনরক হিমালয়ের অপর পাশে। সমুদ্র মন্থন মহাপাপ। শিবসহ অনেক দেবতার সাধনস্থল তুষার ধবল হিমালয় শৃঙ্গে। মহাভারত পর্বে আর্যরা এ-ভূখ-ে আসলে এসব আজগুবি অন্ধ বিশ^াস জায়গা করার যুক্তি খুঁজে পাওয়া যায় না। বরং বলা যায় হিন্দুদের অভিজাত শ্রেনীর সৃষ্টি হয়েছে এই ভারতভূমি থেকে। সিন্ধু সভ্যতা পন্থীদের মতে আর্য বলে কোন জনগোষ্ঠী কথিত মতে ভারতবর্ষে আসেনি। তবুও আর্যদের আদি নিবাস জার্মানি দেখার সাধ তাড়িত করেছে হামবুর্গ পদার্পণ পর্যন্ত।

ছোটবেলা থেকেই ইতিহাস এবং বিজ্ঞান তাড়িত করেছে নিরন্তর। জীবনভর দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধের উপর পড়তে গিয়ে স্তম্ভিত হয়েছি এডলফ হিটলারের চিন্তা, ঔদ্ধত্য ও সাংগঠনিক দক্ষতা দেখে। অষ্ট্রিয়ান বংশোদ্ভূত হিটলার শিল্পী হতে চেয়েছিলেন। প্রথম বিশ^যুদ্ধ তাকে সৈনিক জীবনে টেনে নিয়ে যায়। বীরত্বের জন্য দুটো মেডেল প্রাপ্ত হলেও একরকম মৃত্যুর হাত থেকে ফিরে এসেছিলেন। প্রথম বিশ^যুদ্ধ শেষ, অতঃপর মিত্র শক্তি ইতিহাস খ্যাত ভার্সাইচুক্তি সম্পাদনে জার্মানিকে বাধ্য করে। ভার্সাই চুক্তি এতোই অপমানজনক ছিল যে মিত্র শক্তির অনুমোদন ছাড়া একটি বিমানও কেনা যাচ্ছিল না।

হিটলার ওয়ারকার্স পার্টিতে জ¦ালাময়ী বক্তৃতা দিয়ে বলতে লাগলেন এই অপমানজনক চুক্তি মানা যায় না। মধ্যপন্থী ওয়াকার্স পার্টি, ক্রমশ উগ্র জাতীয়তাবাদী ধারায় প্রবাহিত হলো। হিটলার নেতৃত্বে উঠে আসার অব্যবহিত পরই দলটির নাম রাখা হল ‘নাৎসি পার্টি’। এর পরেরটা শুধুই ইতিহাস। ১৯৩৩ সালে নির্বাচিত ‘ফিউরার’ হয়েই ভার্সাই চুক্তি মানেন না বলে ঘোষণা দিলেন। তার মতে নীল রক্তের জার্মানরাই একমাত্র এরিয়ান বা আর্য নৃগোষ্ঠী এবং পৃথিবীর সব’চে অভিজাত জনগোষ্ঠী। অবশিষ্ট পৃথিবী শাসনের অধিকার একমাত্র জার্মানদের। কট্টর ক্যাথলিকপন্থী হিটলার এও ঘোষণা করলেন জার্মান বা মানবজাতির প্রধানশত্রু ইহুদীরা। এরাই যিশুখৃষ্টকে ক্রুশবিদ্ধ করার জন্য দায়ী।

হিটলারের আদর্শিক অবস্থানের সাথে কখনোই একমত ছিলাম না। তিনি জার্মানির ক্ষমতা নিয়েছিলেন ১৯৩৩ সালে। মাত্র ৬ বছরের ব্যবধানে জার্মান অর্থনীতিকে পরিণত করেছিলেন বিশ^সেরা। সমরাস্ত্র ও বিমান উৎপাদনে টেক্কা দিয়েছিলেন ব্রিটেন ফ্রান্সকে। পৃথিবী শাসনের উদগ্র আকাঙ্খা নিয়ে ১ সেপ্টেম্বর ১৯৩৯ দখলে নিলেন পোল্যান্ড। এরপর ইউরোপ, আফ্রিকা ও এশিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চল পদানত করে হাত বাড়ালেন রাশিয়ার দিকে। এটিই ছিল হিটলারের সর্বশেষ মরণভুল।

ধারণা করা হয় রাশিয়ার তীব্র শীতে দশ লাখ জার্মান সৈন্যের বরফ মৃত্যু ঘটেছিল। রুশ সৈন্যদের হাতে বন্দী হওয়ার আগে ৩০ এপ্রিল ১৯৪৫ খ্রি: ইভা ব্রাউনসহ হিটলার আত্মহত্যা করেন। ইতিহাসে মহাবীর অর্জুন, আলেকজান্ডার, চেঙ্গিস খান, নেপোলিয়েনের কাহিনী পড়েছি। বীরত্বের জন্য ‘দ্য আলেকজান্ডার’ ‘দ্য নেপোলিয়েন’ প্রত্যয় ব্যবহৃত হয়। মাত্র ১২ বছরের শাসনকালে রাষ্ট্রনায়ক হিটলার বীরত্বের যে কাহিনী সৃষ্টি করেছেন ‘দ্য হিটলার’ প্রত্যয় ব্যবহৃত হওয়ার জোরালো যুক্তি থাকে। হামবুর্গ থেকে ফ্রাঙ্কফুট ওডার পর্যন্ত হাজার কিলোমিটার ঘুরেছি বাস আর ট্রেনে। হিটলারের প্রিয় ‘রাইখস্ট্যাগ’ (সংসদ ভবন) এখনো দাঁড়িয়ে আছে। ভবনটি দেখে নয়ন ভরে দেখলাম আর ভাবলাম এই ভবন থেকে হিটলার বিশ^ শাসনের ঔদ্বত্যপূর্ণ ভাষণ দিয়েছিলেন।

নবম শ্রেণীতে বিজ্ঞানের শিক্ষক রাখাল স্যার ক্লাস লেকচারে প্রশ্ন করেছিলেন আলোর গতিপথ কেমন? বলেছিলাম, আলো সরল রেখায় চলে। স্যার বলেছেন না- আইনস্টাইনের মতে আলো অনেক সময় বেঁকে যায়। বড় হলে আলো কখন এবং কেন বেঁকে যায় তা বুঝতে পারবে। যতই বড় হয়েছি ততই আইনস্টাইনের ভক্ত হতে থাকলাম। প্রবল ইচ্ছে জাগল পৃথিবীর আর কোথাও না যাই অন্তত আইনস্টাইনের মৃত্যুভূমি জার্মানি যাব। কৈশোরে দুটো বিষয় আইনস্টাইনকে ধাঁধায় ফেলেছিল। প্রথমটি হলো, আলোর গতি যেহেতু সেকেন্ড প্রায় ৩ লক্ষ কিলোমিটার এবং আমি যদি ৩ লক্ষ কিলোমিটার গতিতে দৌড়াতে পারি তবে আলোর তরঙ্গ গতিহীন স্থির হয়ে যাওয়ার কথা।

এই ধাঁধার উত্তর খুঁজতে গিয়ে আবিষ্কার করে ফেললেন সাধারণ আপেক্ষিকতা (১৯০৫) ও বিশেষ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব (১৯১৫)। এতদিন মনে করা হতো সময় একক সত্তার অধিকারী। পৃথিবীর ১ ঘণ্টা মঙ্গল গ্রহেও ১ ঘণ্টা। আইনস্টাইন প্রমাণ করলেন পৃথিবীতে ঘণ্টায় ১০০ কিমি. গতিতে গাড়ি চালালে আমার লাগবে ১ ঘণ্টা। কিন্তু মঙ্গল গ্রহের মাধ্যাকর্ষণ পৃথিবীর তুলনায় মাত্র ৩৮%। সুতরাং মঙ্গলে ১০০ কিমি. পার হতে গাড়িতে ১ ঘণ্টার চেয়ে কম সময় লাগবে।

পদার্থবিজ্ঞানের নিত্য নতুন সব তথ্যের ব্যাখ্যা মিলে আইনস্টাইনের তত্ত্বে। ইনিই প্রথম দাবি করলেন ঈশ^রের ইচ্ছে বা অনিচ্ছায় নয় বরং পদার্থবিদ্যার নিজস্ব নিয়মে বিশ^ ব্রহ্মা-ের সৃষ্টি। এই তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে ‘ল্যা মাত্রে’ ‘বিগ ব্যাং’ তত্ত্বের প্রস্তাব করলেন। এডুইন হাবল প্রমাণ করলেন সিঙ্গুলারিটিতে প্রচ- বিস্ফোরণ থেকে ব্রহ্মা-ের সৃষ্টি ও বিকাশ। যদিও বিগ ব্যাং পরবর্তী মুহূর্তে প্রকাশিত রাসায়নিক অনুপাতে দেখা যায়, ৭৬ ভাগ হাইড্রোজেন ২৪ ভাগের কিছু কম হিলিয়াম গ্রহণযোগ্য হলেও মাত্র ০০০০০৭ ভাগ লিথিয়ামের উপস্থিতি নিতান্তই কম। এই সামান্য লিথিয়াম উপস্থিতির কারণে ব্রহ্মা- অনবরত সম্প্রসারণের যথাযথ ব্যাখ্যা পাওয়া যাচ্ছে না।

যাইহোক আইনস্টাইনের মৃত্যুভূমি দেখব না এটা কি হয়? এই অতৃপ্ত বাসনার ক্ষুধা মিটাতে সপ্তাহ ধরে জার্মানি ঘুরে বুঝলাম জার্মানরা আসলেই আভিজাত্যের ধারক বাহক। ঐ ভূ-খ-েই প্রকৃতির নিয়মে হিটলার ও আইনস্টাইনের মতো প্রতিভার জন্ম নেয়াটাই স্বাভাবিক।

[লেখক : আইনজীবী, আপিল বিভাগ]

back to top