alt

উপ-সম্পাদকীয়

রাজনৈতিক রূপান্তরের এক সতর্কবার্তা

রহমান মৃধা

: রোববার, ০৬ এপ্রিল ২০২৫

আমি মেলা থেকে তাল পাতার এক বাঁশি কিনে এনেছি। কিন্তু সেই বাঁশি আর আগের মতো বাজে না। মন আমার কেমন যেন সাজে না। তবে কি সত্যিই ছেলেবেলা, অর্থাৎ আমাদের জাতির আদর্শিক শৈশব, আমরা বহু দূরে ফেলে এসেছি?

মনে পড়ে, উদাস করা নকশীকাঁথার মাঠ, বিকেলের রোদ, হঠাৎ হাওয়ায় ভেসে আসা বাঁশির সুরÑ সব মিলিয়ে একটি দেশীয় সত্তা, একটি স্বপ্নজাগানিয়া শৈশব। সেই কিশোর বয়সের রঙিন কল্পনা, সংগ্রামের গল্প আর সততার চেতনা আজ আর চোখে ভাসে না।

হঠাৎ দেখি, অনেকটা পথ আমরা হেঁটে এসেছি। কিন্তু পেছনে ফেলে এসেছি আদর্শ, সংগ্রাম, আত্মত্যাগের গান। আজকের আরামের রাজনীতিতে সেই বাঁশির সুর আর নেইÑ শুধু একধরনের অস্বস্তিকর নিঃসঙ্গতা চারদিকে ছড়িয়ে আছে।

‘আরাম পার্টি’: এক অঘোষিত রাজনৈতিক শক্তি

বাংলাদেশের সংবিধানে স্বীকৃত দলগুলোর বাইরেও সমাজে একটি অদৃশ্য, অথচ প্রভাবশালী দল সক্রিয়Ñ ‘আরাম পার্টি’। এই দলের সদস্যরা কিছু করে না, কিছু বলে না, শুধু চায় অন্যরা সব করুক। অন্যরা মরুক, খাটুক, লড়–কÑ আর এরা ভোগ করুক।

তাদের আছে অর্থ, ক্ষমতা, প্রতিপত্তি। কিন্তু দেশের সংকটের মুহূর্তে তারা দৃশ্যমান হয় না। স্বাধীনতা সংগ্রামে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদে বা গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তারা থাকে না। কিন্তু যখন ভোগের পালা আসে, তখন তারাই সবচেয়ে সক্রিয়।

রাজনীতির শাপলা ফুল ও আরামের ভাসমানতা

শাপলা ফুল বাংলাদেশের জাতীয় ফুল। পানির উপর ভাসে বলেই তার সৌন্দর্য। একে তুলে আনলে তার রূপ নষ্ট হয়ে যায়।

আরাম পার্টিও অনেকটা তেমনÑ তারা সমাজের উপরিভাগে ভেসে থাকতে পছন্দ করে, নিচে নামতে চায় না। দুধের উপর ভেসে থাকা মাখনের মতো তারা নিজেদের দায়িত্বহীন অস্তিত্বে অভ্যস্ত। কিন্তু তারা ভুলে যায়, মাখন একসময় গলেই যায়, বা ঘি হয়ে অন্য রূপ নেয়।

রাজনীতির রাসায়নিক রূপান্তর: দুধ, মাখন ও ঘি

বাংলাদেশের রাজনীতি একধরনের রাসায়নিক প্রক্রিয়া। এখানে দুধ প্রতীক আদর্শিক স্বপ্নের, মাখন প্রতীক সুবিধাভোগী আরামের, আর ঘি প্রতীক আত্মত্যাগী পরিণতির।

আমাদের রাজনীতি দুধ থেকে মাখনে এসে থেমে গেছে। ঘি হওয়ার জন্য যে উত্তাপ, দায়বদ্ধতা আর ত্যাগ দরকার, তা নেই। নির্বাচনের আগে প্রতিটি দল দুর্নীতি রুখবে, সুশাসন আনবে বলে প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু বারবার দেখা যায়Ñ সবকিছু মুখের মাখন হয়েই থেকে যায়। কাজের জায়গায় শুধু শূন্যতা।

‘আমি না করিলে কে করিবে?’: আজ আর কেউ জিজ্ঞাসা করে না

নন্দলাল বলেছিলেন, ‘আমি না করিলে কে করিবে?’ আজ সেই প্রশ্ন করার লোক নেই। আরাম পার্টির সদস্যরা মনে করেন, অন্য কেউ করবে, আমি শুধু নিজের আরাম নিয়ে ভাবব। এই মনোভাব আমাদের জাতিকে নেতৃত্বশূন্য করে ফেলছে।

একটি নতুন রাজনৈতিক চেতনার দরকার

দেশকে সত্যিকারের পরিবর্তনের পথে নিতে হলে, আমাদের দুধ-মাখন-ঘি রূপান্তরের প্রতিটি ধাপ সঠিকভাবে অতিক্রম করতে হবে।

প্রয়োজন সেইসব মানুষ যারা নেতৃত্ব দেবেন, যারা লড়াই করবেন, যারা ঝুঁকি নেবেন এবং নিজেদের স্বার্থ ত্যাগ করে জাতির জন্য কাজ করবেন।

আজকের রাজনীতি যদি শুধু আরামনির্ভর হয়ে যায়, তবে ভবিষ্যতের বাংলাদেশ এক আত্মবিস্মৃত, দিশেহারা দেশ হয়ে উঠবে।

আমরা যদি এখনই না জাগি, যদি সত্যিকার অর্থে সংগ্রামী রাজনৈতিক চেতনায় না ফিরি, তবে সেই তাল পাতার বাঁশির মতো আমাদের রাজনীতিও চিরকাল নিঃশব্দ হয়ে থাকবে।

শত আঁধারেও সকাল আসে, শিশির ঝলমল করে, নতুন দিনের আশাবাদী বার্তা নিয়ে। রাজনীতির জটিল পথে হয়তো আমরা পথভ্রষ্ট, কিন্তু সীমা ছাড়িয়ে, বাধা ভেঙে সামনে এগিয়ে যাওয়ার শক্তি এখনও আমাদের মধ্যেই রয়েছে।

বাধা আর সীমারেখা ভুলে, মন ছুটে চলে এক নতুন মুক্তির দিকে, যেখানে আলোর জোয়ারে হতাশার দেয়াল ভেঙে যায়। পুরনো ক্লান্তি হারিয়ে যায়, নতুন দিনের সূচনা হয়।

যায় যদি যায়, যাক পুরনো ক্লান্তি, হতাশার মেঘ। দেশের মানুষের আশা একদিন সত্যি হবেÑ নতুন ভোর আসবে, যেখানে সত্যিকারের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে, যেখানে আত্মত্যাগের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হবে ন্যায়, উন্নয়ন, আর নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন।

[লেখক : সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন]

ডেঙ্গু প্রতিরোধে করণীয়

প্রযুক্তির ফাঁদে শৈশব : স্ক্রিন টাইম গিলে খাচ্ছে খেলার মাঠ

রমগদ্য : সিরাজগঞ্জে ‘ব্রিটিশ প্রেতাত্মা’

বামপন্থা : নীতির সঙ্গে নেতৃত্বের ভূমিকা

দাবি আদায়ে জনদুর্ভোগ : জনশিক্ষা ও সুশাসনের পথ

ইমাম রইস উদ্দিন হত্যাকাণ্ড : সুবিচার নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব

কারাগার, সংশোধনাগার ও ভবঘুরে কেন্দ্রগুলোর সংস্কার কি হবে

জ্বালানির বদল, জীবিকার ঝুঁকি

প্রসঙ্গ : রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনী ও চট্টগ্রামে এস্কর্ট ডিউটি

দেশটা কারো বাপের নয়!

বুদ্ধের বাণীতে বিশ্বশান্তির প্রার্থনা

আর কত ধর্ষণের খবর শুনতে হবে?

সংস্কারের স্বপ্ন বনাম বাস্তবতার রাজনীতি

মধুমাসের স্মৃতি ও দেশীয় ফলের রসাল সমারোহ

মুর্শিদাবাদে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট

লিঙ্গের রাজনীতি বা বিবাদ নয়, চাই মানবিকতার নিবিড় বন্ধন

বাজেট : বাস্তবতা, চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা

যুক্তরাষ্ট্র-ইরান পারমাণবিক আলোচনার স্থবিরতা

রম্যগদ্য: “বাঙালি আমরা, নহি তো মেষ...”

সর্বজনীন শিক্ষার বলয়ের বাইরে আদিবাসীরা : অন্তর্ভুক্তির লড়াইয়ে বৈষম্যের দেয়াল

শোনার গান, দেখার টান : অনুভূতির ভোঁতা সময়

ছবি

ছিন্নপত্রে বাংলাদেশের প্রকৃতি ও রবীন্দ্র চেতনা

ভেতরের অদৃশ্য অপরাধ : সমাজের বিপন্ন মানসিকতা

দারিদ্র্য ও বৈষম্য নিরসনে খাসজমি ও জলার গুরুত্ব

অবহেলিত কৃষক ও বাজার ব্যবস্থার বৈষম্য

রাক্ষুসে মাছের দাপটে বিপন্ন দেশীয় মাছ : করণীয় কী?

বজ্রপাতের আতঙ্কে জনজীবন

তাহলে কি ঘৃণায় ছেয়ে যাবে দেশ, মানবজমিন রইবে পতিত

কর্পোরেট ও ব্যক্তিগত সামাজিক দায়বদ্ধতা

‘রাখাইন করিডর’ : একটি ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষণ

ভিন্নমতের ভয়, নির্বাচনের দোলাচল ও অন্তর্বর্তী সরকারের কৌশলী অবস্থান

সমুদ্রসম্পদ সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা

কৃষি শিক্ষা হোক উদ্যোক্তা গড়ার মাধ্যম

রঙ্গব্যঙ্গ : কোটের কেবল রং বদলায়

মে দিবসের চেতনা বনাম বাস্তবতা

শ্রম আইন ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় চাই আন্তরিকতা

tab

উপ-সম্পাদকীয়

রাজনৈতিক রূপান্তরের এক সতর্কবার্তা

রহমান মৃধা

রোববার, ০৬ এপ্রিল ২০২৫

আমি মেলা থেকে তাল পাতার এক বাঁশি কিনে এনেছি। কিন্তু সেই বাঁশি আর আগের মতো বাজে না। মন আমার কেমন যেন সাজে না। তবে কি সত্যিই ছেলেবেলা, অর্থাৎ আমাদের জাতির আদর্শিক শৈশব, আমরা বহু দূরে ফেলে এসেছি?

মনে পড়ে, উদাস করা নকশীকাঁথার মাঠ, বিকেলের রোদ, হঠাৎ হাওয়ায় ভেসে আসা বাঁশির সুরÑ সব মিলিয়ে একটি দেশীয় সত্তা, একটি স্বপ্নজাগানিয়া শৈশব। সেই কিশোর বয়সের রঙিন কল্পনা, সংগ্রামের গল্প আর সততার চেতনা আজ আর চোখে ভাসে না।

হঠাৎ দেখি, অনেকটা পথ আমরা হেঁটে এসেছি। কিন্তু পেছনে ফেলে এসেছি আদর্শ, সংগ্রাম, আত্মত্যাগের গান। আজকের আরামের রাজনীতিতে সেই বাঁশির সুর আর নেইÑ শুধু একধরনের অস্বস্তিকর নিঃসঙ্গতা চারদিকে ছড়িয়ে আছে।

‘আরাম পার্টি’: এক অঘোষিত রাজনৈতিক শক্তি

বাংলাদেশের সংবিধানে স্বীকৃত দলগুলোর বাইরেও সমাজে একটি অদৃশ্য, অথচ প্রভাবশালী দল সক্রিয়Ñ ‘আরাম পার্টি’। এই দলের সদস্যরা কিছু করে না, কিছু বলে না, শুধু চায় অন্যরা সব করুক। অন্যরা মরুক, খাটুক, লড়–কÑ আর এরা ভোগ করুক।

তাদের আছে অর্থ, ক্ষমতা, প্রতিপত্তি। কিন্তু দেশের সংকটের মুহূর্তে তারা দৃশ্যমান হয় না। স্বাধীনতা সংগ্রামে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদে বা গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তারা থাকে না। কিন্তু যখন ভোগের পালা আসে, তখন তারাই সবচেয়ে সক্রিয়।

রাজনীতির শাপলা ফুল ও আরামের ভাসমানতা

শাপলা ফুল বাংলাদেশের জাতীয় ফুল। পানির উপর ভাসে বলেই তার সৌন্দর্য। একে তুলে আনলে তার রূপ নষ্ট হয়ে যায়।

আরাম পার্টিও অনেকটা তেমনÑ তারা সমাজের উপরিভাগে ভেসে থাকতে পছন্দ করে, নিচে নামতে চায় না। দুধের উপর ভেসে থাকা মাখনের মতো তারা নিজেদের দায়িত্বহীন অস্তিত্বে অভ্যস্ত। কিন্তু তারা ভুলে যায়, মাখন একসময় গলেই যায়, বা ঘি হয়ে অন্য রূপ নেয়।

রাজনীতির রাসায়নিক রূপান্তর: দুধ, মাখন ও ঘি

বাংলাদেশের রাজনীতি একধরনের রাসায়নিক প্রক্রিয়া। এখানে দুধ প্রতীক আদর্শিক স্বপ্নের, মাখন প্রতীক সুবিধাভোগী আরামের, আর ঘি প্রতীক আত্মত্যাগী পরিণতির।

আমাদের রাজনীতি দুধ থেকে মাখনে এসে থেমে গেছে। ঘি হওয়ার জন্য যে উত্তাপ, দায়বদ্ধতা আর ত্যাগ দরকার, তা নেই। নির্বাচনের আগে প্রতিটি দল দুর্নীতি রুখবে, সুশাসন আনবে বলে প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু বারবার দেখা যায়Ñ সবকিছু মুখের মাখন হয়েই থেকে যায়। কাজের জায়গায় শুধু শূন্যতা।

‘আমি না করিলে কে করিবে?’: আজ আর কেউ জিজ্ঞাসা করে না

নন্দলাল বলেছিলেন, ‘আমি না করিলে কে করিবে?’ আজ সেই প্রশ্ন করার লোক নেই। আরাম পার্টির সদস্যরা মনে করেন, অন্য কেউ করবে, আমি শুধু নিজের আরাম নিয়ে ভাবব। এই মনোভাব আমাদের জাতিকে নেতৃত্বশূন্য করে ফেলছে।

একটি নতুন রাজনৈতিক চেতনার দরকার

দেশকে সত্যিকারের পরিবর্তনের পথে নিতে হলে, আমাদের দুধ-মাখন-ঘি রূপান্তরের প্রতিটি ধাপ সঠিকভাবে অতিক্রম করতে হবে।

প্রয়োজন সেইসব মানুষ যারা নেতৃত্ব দেবেন, যারা লড়াই করবেন, যারা ঝুঁকি নেবেন এবং নিজেদের স্বার্থ ত্যাগ করে জাতির জন্য কাজ করবেন।

আজকের রাজনীতি যদি শুধু আরামনির্ভর হয়ে যায়, তবে ভবিষ্যতের বাংলাদেশ এক আত্মবিস্মৃত, দিশেহারা দেশ হয়ে উঠবে।

আমরা যদি এখনই না জাগি, যদি সত্যিকার অর্থে সংগ্রামী রাজনৈতিক চেতনায় না ফিরি, তবে সেই তাল পাতার বাঁশির মতো আমাদের রাজনীতিও চিরকাল নিঃশব্দ হয়ে থাকবে।

শত আঁধারেও সকাল আসে, শিশির ঝলমল করে, নতুন দিনের আশাবাদী বার্তা নিয়ে। রাজনীতির জটিল পথে হয়তো আমরা পথভ্রষ্ট, কিন্তু সীমা ছাড়িয়ে, বাধা ভেঙে সামনে এগিয়ে যাওয়ার শক্তি এখনও আমাদের মধ্যেই রয়েছে।

বাধা আর সীমারেখা ভুলে, মন ছুটে চলে এক নতুন মুক্তির দিকে, যেখানে আলোর জোয়ারে হতাশার দেয়াল ভেঙে যায়। পুরনো ক্লান্তি হারিয়ে যায়, নতুন দিনের সূচনা হয়।

যায় যদি যায়, যাক পুরনো ক্লান্তি, হতাশার মেঘ। দেশের মানুষের আশা একদিন সত্যি হবেÑ নতুন ভোর আসবে, যেখানে সত্যিকারের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে, যেখানে আত্মত্যাগের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হবে ন্যায়, উন্নয়ন, আর নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন।

[লেখক : সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন]

back to top