আনোয়ারুল হক
২০২৪ সালের বিরোধী দলবিহীন একতরফা বা আমি-ডামি নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করে বিএনপির আন্দোলন সমাবেশে শিল্পী ইথুন বাবুর গাওয়াÑ ‘দেশটি তোমার বাপের নাকি, করছো ছলাকলা’ গানটি বিএনপি কর্মীদের উদ্দীপ্ত করলেও দলীয় রাজনীতির ইঙ্গিতবহ এবং ব্যক্তিগত আক্রমণ ও বিদ্বেষমূলক হওয়ার কারণে সাধারণের মধ্যে বিশেষ দাগ কাটতে পারেনি। আবার দলীয় রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে জুলাই অভ্যুত্থানের সময়ে ছাত্র-তরুণরা যখন সেøাগান তুললো ‘দেশটা কারো বাপের নয়’Ñ তা সার্বজনীনতা পেলো। অভ্যুত্থানও সফল হলো; কিন্তু ওই সেøাগান উচ্চারণের মধ্য দিয়ে ছাত্র-তরুণরা শাসকের স্বেচ্ছাচারিতা, একনায়কতন্ত্র ও পরিবারতন্ত্রের বিপরীতে যে বৈষম্যহীন, উদার, মানবিক এক গণতান্ত্রিক সমাজের স্বপ্নে বিভোর ছিল তা আজ অনেকটাই ম্লান হয়ে গেছে।
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের প্রধান কারণ ছিলো দুইটিÑ ‘ইলেকশন’ ও ‘করাপশন’। এ দুই ইস্যুতে মানুষের পুঞ্জীভূত ক্ষোভে ‘কোটা’ বা ‘রাজাকারের নাতি’ ইস্যু আগুনে ঘি ঢেলেছে মাত্র। কোটা ইস্যু ঠিক ঠিকভাবে ‘হ্যান্ডেল’ করতে পারলেও এ পতন দুই দিন পরে হলেও অনিবার্য ছিলো। সরকার বদলের সব নিয়মতান্ত্রিক পন্থা বন্ধ করে দেয়া হলে দল, প্রশাসন, রাষ্ট্র লাগামহীনভাবে দুর্নীতি, অন্যায়, অবিচারে মত্ত হয়ে এক হিংস্র নিপীড়কে পরিণত হয় এবং শেষপর্যন্ত একপর্যায়ে নিজেদের জন্য করুণ পরিণতি ডেকে আনে। দেশে দেশে তার অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে। এসব পরিবর্তনের ঘটনার সাথে ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং দুনিয়ার মোড়লদেরও ভূমিকা থাকে; কিন্তু পরিবর্তনের জন্য আন্দোলনের জমিনকে উর্বর করে তোলেন ক্ষমতাসীনরা তাদের কর্মফলের মাধ্যমে। আর শাসক পরিবর্তনে সৃষ্ট শূন্যতা পূরণে গণতান্ত্রিক শক্তি অক্ষম হলে সৃষ্টি হয় নৈরাজ্য এবং অসাংবিধানিক শাসন। আমাদের দেশেও সেই নৈরাজ্য আমরা দেখতে পাচ্ছি।
কোটাবিরোধী বা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ব্যাপক ছাত্রসমাজ সম্পৃক্ত হলেও খুবই পরিকল্পিতভাবে ও চাতুরতার সাথে একটি গোষ্ঠী বামপন্থি বা গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল ছাত্রকর্মীদের আন্দোলনের সামনের কাতারে বা সমন্বয়ক হিসাবে যুক্ত হতে দেয় নাই। তারা আন্দোলনের অরাজনৈতিক চেহারা স্পষ্ট রাখার যুক্তি তুলে ধরে ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতৃস্থানীয়দের সম্মুখসারিতে থাকা থেকে বিরত রাখতে সক্ষম হয়। একমাত্র উমামা ফাতেমার ৫টি ছাত্রী হলেই ব্যাপক জনপ্রিয়তা থাকায় তাকে হয়তো বাদ রাখা সম্ভব হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংগঠন সমূহের নেতৃত্ব সম্পর্কে আমার তেমন ধারনা নেই; কিন্তু একটা বিষয় তো আন্দোলনের দিন গুলোতে স্পষ্ট ছিলো বামপন্থী ছাত্র নেতা মেঘ মল্লার বসু সমন্বয়কদের থেকে যোগ্যতায় কারো থেকে কম ছিলেন না। হয়তো আরো অনেকে এমনটি ছিলেন। ছাত্র ইউনিয়ন, সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট, ছাত্রদল প্রভৃতি সংগঠনের অনেকেই ছিলেন যারা সমন্বয়কের দায়িত্ব পালনে যোগ্যতা রাখেন; কিন্তু তাদের ছাত্র সংগঠনের নেতা বলে নেতৃত্ব থেকে বাদ রাখা হয়েছে; কিন্তু যারা সাধারণ ছাত্র হিসেবে সমন্বয়ক হলেন তারা কিন্তু তলে তলে ছাত্র সংগঠনের বিশেষত অনেকেই ধর্মাশ্রয়ী ছাত্র সংগঠনের নেতৃত্বে ছিলেন। কোনো সংগঠনের কার্যক্রম গোপনে এমনকি ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে থেকে হতো, আবার কোনো সংগঠনের কার্যক্রম পাঠচক্র ভিত্তিক হওয়ায় সাধারণ ছাত্রদের কাছে তারা ছাত্র রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে পরিচিত ছিলেন না। এ সুযোগের সদ্ব্যবহার করে তারা সবাই সমন্বয়ক হয়েছেন। আন্দোলনে তারা যেমন সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন আবার সরকারি চাপের কাছে নতিস্বীকার করে আন্দোলন স্থগিত, প্রত্যাহার ইত্যাদি বিবৃতি দিয়ে বন্দিদশা থেকে মুক্ত হওয়ার ‘কৌশল’ অবলম্বন করেছেন। অতীতে ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের চাপের মুখে এমনকি সামরিক হেফাজতে নিয়ে নির্যাতন করেও কাবু করা যায় নাই এবং বন্দিদশা থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য তারা কখনও এমন কৌশল করেছেন বলে জানা নেই।
শুধু তাই নয়, তাদের আর একটি কৌশলের কাছেও ছাত্র সংগঠনগুলো হেরে যায়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে কোনো ছাত্র সংগঠন ক্যাম্পাসে পৃথকভাবে সভা সমাবেশ করতে পারবে না এই প্রস্তাবে সংগঠনসমূহের সম্মতি আদায়ে তারা সমর্থ হয়। ছাত্রদল, ছাত্র ইউনিয়ন, সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টসহ অন্যান্য ছাত্র সংগঠনের নেতাদের সামনের কাতারে কৌশলে না থাকতে দেয়ায় ওইসব সংগঠনের কর্মীদের লড়াইয়ে অংশগ্রহণও উপযুক্তভাবে দৃশ্যমান হয়নি। এমনকি ছাত্রশিবিরকে সাথে নিয়ে তারা আওয়াজ তোলে ভবিষ্যতে ক্যাম্পাস ছাত্র রাজনীতি মুক্ত থাকবে এবং নির্বাচিত ছাত্র সংসদ ছাড়া ক্যাম্পাসে কোনো ছাত্র সংগঠনের কার্যক্রম চলবে না। ছাত্রদের একটা অংশকেও ওই সময়ে তারা এই বক্তব্যের সমর্থনে আনতে সমর্থ হয়। অথচ অভ্যুত্থান পরবর্তীতে সবার আগে ক্যাম্পাসকে কেন্দ্র করে তারাই রাজনৈতিক দল এনসিপি এবং ছাত্র সংগঠন গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ গড়ে তোলেন। অথচ অভ্যুত্থান পরবর্তীতে সবার আগে ক্যাম্পাসকে কেন্দ্র করে তারাই রাজনৈতিক দল এনসিপি এবং ছাত্র সংগঠন গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ গড়ে তোলেন। এর চেয়ে বড় দ্বিচারিতা আর কী হতে পারে।
এসব সমন্বয়কবৃন্দ এবং পরবর্তীতে যারা রাজনৈতিক দলের নেতা হয়েছেন তারা কিন্তু নয় মাস ধরে মানুষের পর্যবেক্ষণে আছেন। জুলাই অভ্যুত্থানের সাথে সাথেই আন্দোলনমুখী ছাত্র সমন্বয়কদের একাংশ হয়ে ওঠেন সচিবালয়মুখী। সরকারি কর্মকর্তাদের নিয়োগ, বদলি, পদায়ন, পদোন্নতি, পদচ্যুতি সব কিছুই করতে হয়েছে তাদের মর্জিমাফিক এবং অভিযোগ আছে অনেক কিছুই হয়েছে মোটা অংকের বিনিময়ে। ‘দেশটা বাপের’ না হলে কি সচিবালয়কে এভাবে নিয়ন্ত্রণে নেয়া যায়?
জুলাই অভ্যুত্থানের পরপরই কুমিল্লা ও ফেনীর বিস্তৃত এলাকায় বড় ধরনের বন্যা হয়। ছাত্র আন্দোলনের ভাবমূর্তি তখন তুঙ্গে। সমন্বয়কদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে মানুষ তাদের রিলিফ ফান্ডে কোটি কোটি টাকা জমা দেয়ার পরেও ওই টাকা তারা রিলিফ তৎপরতায় ব্যবহার না করে ব্যাংকে জমা রেখে দেওয়ায় ব্যাপক সমালোচনার মুখে অন্তর্বর্তী সরকার ছাত্র নেতাদের ওই টাকা সরকারি রিলিফ ফান্ডে জমা দেয়ার নির্দেশ দেয়। রিলিফের টাকা নিয়ে এ ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ায় সমন্বয়কদের ভাবমূর্তি যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়। একই অভিযোগ উঠতে থাকে ‘জুলাই ফাউন্ডেশনের তহবিল সংগ্রহে ও তা বিতরণে এবং এজন্য দল থেকে বহিষ্কারের ঘটনাও ঘটেছে।
অন্যদিকে রাজনৈতিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশের পর থেকেই জাতীয় নাগরিক পার্টির শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন নেতার বিরুদ্ধে নানা ধরনের অভিযোগ উঠেছে। পাঠ্যবই ছাপানোর কাজে দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ ওঠে জাতীয় নাগরিক পার্টির যুগ্ম সদস্য সচিব গাজী সালাউদ্দিন তানভীরের বিরুদ্ধে। এ নিয়ে তখন গণমাধ্যমে খবরও প্রকাশিত হয়। গত মার্চ মাসে জেলা প্রশাসক নিয়োগে অবৈধ হস্তক্ষেপের অভিযোগ ওঠে তানভীরের বিরুদ্ধে। তবে তানভীর তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ অস্বীকার করে আসছিলেন। অবশেষে তানভীরকে দল থেকে সাময়িক অব্যাহতি দিতে বাধ্য হয় দলটির নেতৃত্ব।
জাতীয় নাগরিক পার্টির দুই শীর্ষ নেতা উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম ও দক্ষিণের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আব্দুল্লাহ। জুলাই-আগস্টে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় প্রথমসারির সমন্বয়ক ছিলেন তারা দুজনই। গত মার্চে ঈদের আগে বিশাল গাড়িবহর নিয়ে নিজ এলাকা পঞ্চগড়ে শোডাউন দেন সারজিস আলম। তার এই গাড়িবহরের বিশাল শোডাউন নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানা সমালোচনা তৈরি হয়। এমনকি তখন দলের কেন্দ্রীয় নেত্রী তাসনিম জারা বিষয়টির সমালোচনা করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্টও করেন। গত ৯ এপ্রিল হাসনাত আব্দুল্লাহ ও সারজিস আলম দুর্নীতি দমন কমিশনে যান। এ বিষয়টি নিয়ে তখন নানা ধরনের আলোচনা পত্রপত্রিকায় ও সামাজিক মাধ্যমে দেখা যায়। দক্ষিণাঞ্চলের আহ্বায়ক দক্ষিণে না যেয়ে গাজীপুরে যেয়ে আক্রান্ত হওয়া নিয়েও নানা ধরনের মন্তব্য আসছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। গত কয়েক মাস ধরেই এই দুই নেতার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগে দলটির কেন্দ্রীয় কমিটির অনেকেই এক ধরনের অস্বস্তিতে রয়েছেন বলে জানা যায়।
সাবেক সমন্বয়ক এবং এখন নতুন দলের নেতা আব্দুল হান্নান মাসউদের হাতিয়া গমন উপলক্ষে ছোট ওই দ্বীপ শহরটিতে ৮৩টি তোরণ নির্মিত হয়েছিল এবং সারজিস আলমের মতো একই ধরনের গাড়ির বহরের আয়োজন ছিলো। হাতিয়া সফর শেষে এক টকশোতে সঞ্চালকের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তাঁর এখন একটি গাড়ি দরকার। কেউ যদি তাকে একটি গাড়ি দেয় তিনি সানন্দে তা গ্রহণ করবেন এবং ইতোমধ্যে তিনি গাড়ি পেয়ে গেছেন। শীর্ষ কয়েকজন নেতার বিলাসী জীবনযাপন নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে দলের অন্দরেই। দলের বয়স মাত্র এক মাস হওয়ার আগেই দল কর্তৃক বিলাসবহুল হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টালে ইফতার পার্টির আয়োজন এবং ইতোপূর্বে সমন্বয়কদের দীর্ঘ সময় যাবত ওই হোটেলের কয়েকটি স্যুট ও রুম তাদের নামে অলিখিতভাবে বরাদ্দ রাখা ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা সমালোচনা রয়েছে। আর ২০ লাখের কম্বল দিতে ২২ লাখের হেলিকপ্টার বিলাস নিয়েও প্রচুর প্রশ্ন উঠেছিল। বাতাসে কান পাতলেই শোনা যায় ব্যবসা বাণিজ্য ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর যে সিন্ডিকেট ছিলো তারা মুক্ত হস্তে বিশাল অংকের টাকা নতুন দলকে দিচ্ছেন এবং তারা তা সানন্দে গ্রহণও করছেন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক সমন্বয়ক ও বর্তমান যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদের এপিএস মোয়াজ্জেম হোসেনের বিরুদ্ধে গত কয়েক মাসে নানা অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। সোমবার তাকে তার পদ থেকে অব্যাহতি দিয়ে প্রজ্ঞাপনও জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। আসিফ মাহমুদের পিতা স্থানীয় স্কুলের প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধেও অভিযোগ উঠে এবং এ জন্য আসিফ মাহমুদ ক্ষমা প্রার্থনা করেন। নানা অভিযোগে আসিফ মাহমুদের নিজ এলাকা মুরাদনগরে তার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ মিছিলও হয়েছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় মেডিকেল দলের সদস্য বর্তমান স্বাস্থ্য উপদেষ্টার ব্যক্তিগত কর্মকর্তা তুহিন ফারাবীকে নিয়েও মন্ত্রণালয়ে নানা ধরনের অভিযোগ উঠেছে। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকেও জাতীয় নাগরিক পার্টির নেতাদের বিরুদ্ধে নানা দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ আসছে।
রাজনীতিতে গুনগত পরিবর্তনের ঘোষণা দিয়ে তারুণ্যনির্ভর রাজনৈতিক দল আত্মপ্রকাশের পর এই দলটিকে ঘিরে জনসাধারনের একটা অংশের মাঝে নানা প্রত্যাশা ছিল; কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে নতুন দল হিসেবে যাত্রার শুরু থেকেই কেন এসব অভিযোগ আসছে দলটির বিরুদ্ধে? কেন তাদের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের এত অপরিণত আচরণ? কেন তাদের নেতৃত্বে একটা অংশের মধ্যে শুধু ক্রোধ আর উদ্ধত্য? কেন বিলাসী জীবনের প্রতি এত ভালোবাসা? তাহলে কি রাজনীতির সেই পুরোনো পথেই হাঁটছে জাতীয় নাগরিক পার্টি?
জুলাই গনঅভ্যুত্থানের অন্যতম পরিকল্পনাকারী হিসেবে খ্যাত উপদেষ্টা মাহফুজ আলম তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে আক্ষেপ ও হতাশা প্রকাশ করে লিখেছেনÑ ‘সবচেয়ে ডেডিকেটেড ছাত্রকর্মীরা ক্রেডিট, দলবাজি আর কোরামবাজির খপ্পরে পড়েছেন। আর্থিক অস্বচ্ছতার অভিযোগ হাতেগোনা কয়েকজনের বিরুদ্ধে, কিন্তু ডিমোরালাইজড হয়েছে সমগ্র ছাত্র-জনতা।’ এ ছাত্র-জনতাকে ডিমোরালাইজড করার দায় তো ছাত্র সমন্বয়ক ও নতুন দলের নেতৃত্বের একাংশের ওপর বর্তায়। তারা এমনভাবে চলছেন যেন- ‘যখন চাহে এ মন যা’ তাই করতে হবে।
জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের হত্যকান্ডের বিচার হতে হবে। সরকার, দল, ব্যক্তি সবারই বিচার হতে পারে। কে না করেছে? জুলাই-আগস্ট হত্যাকা-ের কুশীলবদের বিচারের দাবি আওয়ামী লীগের ভেতর থেকেই ওঠা উচিত ছিল। সেটা তো দূরের কথা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে সাধারণভাবে কোন আত্মসমালোচনা ও অনুশোচনা নেই; কিন্তু বিচারিক প্রক্রিয়া বাদ দিয়ে জামায়াত আর হেফাজতকে সাথে নিয়ে, যমুনায় যেখানে সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ সেখানে মব সৃষ্টি করিয়ে তারপর উপদেষ্টা পরিষদ সভা করে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হলো (যা কার্যত ৫ আগস্ট থেকে নিষিদ্ধই আছে)। এ পরিস্থিতি চলতে থাকলে দেখা যাবে নির্বাচন দাবি করার অপরাধে ‘যমুনা মব’ এক সময় বিএনপিকেও নিষিদ্ধ করার দাবি করতে পারে। এভাবে ‘দেশটি নিজের বাপের’ মনে করার মতো রাজনৈতিক তৎপরতা চললে এবং ক্রোধ, হিংসা, উগ্রতা ও ঔদ্ধত্যের সমাবেশের কাছে আত্মসমর্পণ করে এবং বেআইনি অবস্থানে আহুত সমাবেশকে গ্রীষ্মের দাবদাহ থেকে স্বস্তি দিতে ঠান্ডা পানি স্প্রে করে আরো নিকৃষ্ট ফ্যাসিবাদকে আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে। জাতীয় নাগরিক পার্টি উগ্র মৌলবাদী শক্তির সাথে মিলে যে রাজনৈতিক মেরুকরণ দাঁড় করালেন, যে মেরুকরণের সমাবেশ থেকে সেøাগান উঠলো ‘গোলাম আযমের বাংলায় আওয়ামী লীগের ঠাঁই নাই’Ñ তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে গণতন্ত্রে উত্তরণের প্রক্রিয়া, সংস্কার প্রক্রিয়া, ক্ষতিগ্রস্ত হবে দল হিসেবে এনসিপি আর ২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থানের আকাক্সক্ষা।
লাখো ছাত্র-তরুণদের সেই সেøাগান ‘দেশটি কারো বাপের নয়’, আর দেয়ালে দেয়ালে গ্রাফিতি আকারে আঁকা স্বপ্ন কি প্রত্যাশা ভঙ্গের বেদনা হিসেবে রয়ে যাবে?
[লেখক : সাবেক ছাত্র নেতা]
আনোয়ারুল হক
সোমবার, ১২ মে ২০২৫
২০২৪ সালের বিরোধী দলবিহীন একতরফা বা আমি-ডামি নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করে বিএনপির আন্দোলন সমাবেশে শিল্পী ইথুন বাবুর গাওয়াÑ ‘দেশটি তোমার বাপের নাকি, করছো ছলাকলা’ গানটি বিএনপি কর্মীদের উদ্দীপ্ত করলেও দলীয় রাজনীতির ইঙ্গিতবহ এবং ব্যক্তিগত আক্রমণ ও বিদ্বেষমূলক হওয়ার কারণে সাধারণের মধ্যে বিশেষ দাগ কাটতে পারেনি। আবার দলীয় রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে জুলাই অভ্যুত্থানের সময়ে ছাত্র-তরুণরা যখন সেøাগান তুললো ‘দেশটা কারো বাপের নয়’Ñ তা সার্বজনীনতা পেলো। অভ্যুত্থানও সফল হলো; কিন্তু ওই সেøাগান উচ্চারণের মধ্য দিয়ে ছাত্র-তরুণরা শাসকের স্বেচ্ছাচারিতা, একনায়কতন্ত্র ও পরিবারতন্ত্রের বিপরীতে যে বৈষম্যহীন, উদার, মানবিক এক গণতান্ত্রিক সমাজের স্বপ্নে বিভোর ছিল তা আজ অনেকটাই ম্লান হয়ে গেছে।
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের প্রধান কারণ ছিলো দুইটিÑ ‘ইলেকশন’ ও ‘করাপশন’। এ দুই ইস্যুতে মানুষের পুঞ্জীভূত ক্ষোভে ‘কোটা’ বা ‘রাজাকারের নাতি’ ইস্যু আগুনে ঘি ঢেলেছে মাত্র। কোটা ইস্যু ঠিক ঠিকভাবে ‘হ্যান্ডেল’ করতে পারলেও এ পতন দুই দিন পরে হলেও অনিবার্য ছিলো। সরকার বদলের সব নিয়মতান্ত্রিক পন্থা বন্ধ করে দেয়া হলে দল, প্রশাসন, রাষ্ট্র লাগামহীনভাবে দুর্নীতি, অন্যায়, অবিচারে মত্ত হয়ে এক হিংস্র নিপীড়কে পরিণত হয় এবং শেষপর্যন্ত একপর্যায়ে নিজেদের জন্য করুণ পরিণতি ডেকে আনে। দেশে দেশে তার অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে। এসব পরিবর্তনের ঘটনার সাথে ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং দুনিয়ার মোড়লদেরও ভূমিকা থাকে; কিন্তু পরিবর্তনের জন্য আন্দোলনের জমিনকে উর্বর করে তোলেন ক্ষমতাসীনরা তাদের কর্মফলের মাধ্যমে। আর শাসক পরিবর্তনে সৃষ্ট শূন্যতা পূরণে গণতান্ত্রিক শক্তি অক্ষম হলে সৃষ্টি হয় নৈরাজ্য এবং অসাংবিধানিক শাসন। আমাদের দেশেও সেই নৈরাজ্য আমরা দেখতে পাচ্ছি।
কোটাবিরোধী বা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ব্যাপক ছাত্রসমাজ সম্পৃক্ত হলেও খুবই পরিকল্পিতভাবে ও চাতুরতার সাথে একটি গোষ্ঠী বামপন্থি বা গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল ছাত্রকর্মীদের আন্দোলনের সামনের কাতারে বা সমন্বয়ক হিসাবে যুক্ত হতে দেয় নাই। তারা আন্দোলনের অরাজনৈতিক চেহারা স্পষ্ট রাখার যুক্তি তুলে ধরে ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতৃস্থানীয়দের সম্মুখসারিতে থাকা থেকে বিরত রাখতে সক্ষম হয়। একমাত্র উমামা ফাতেমার ৫টি ছাত্রী হলেই ব্যাপক জনপ্রিয়তা থাকায় তাকে হয়তো বাদ রাখা সম্ভব হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংগঠন সমূহের নেতৃত্ব সম্পর্কে আমার তেমন ধারনা নেই; কিন্তু একটা বিষয় তো আন্দোলনের দিন গুলোতে স্পষ্ট ছিলো বামপন্থী ছাত্র নেতা মেঘ মল্লার বসু সমন্বয়কদের থেকে যোগ্যতায় কারো থেকে কম ছিলেন না। হয়তো আরো অনেকে এমনটি ছিলেন। ছাত্র ইউনিয়ন, সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট, ছাত্রদল প্রভৃতি সংগঠনের অনেকেই ছিলেন যারা সমন্বয়কের দায়িত্ব পালনে যোগ্যতা রাখেন; কিন্তু তাদের ছাত্র সংগঠনের নেতা বলে নেতৃত্ব থেকে বাদ রাখা হয়েছে; কিন্তু যারা সাধারণ ছাত্র হিসেবে সমন্বয়ক হলেন তারা কিন্তু তলে তলে ছাত্র সংগঠনের বিশেষত অনেকেই ধর্মাশ্রয়ী ছাত্র সংগঠনের নেতৃত্বে ছিলেন। কোনো সংগঠনের কার্যক্রম গোপনে এমনকি ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে থেকে হতো, আবার কোনো সংগঠনের কার্যক্রম পাঠচক্র ভিত্তিক হওয়ায় সাধারণ ছাত্রদের কাছে তারা ছাত্র রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে পরিচিত ছিলেন না। এ সুযোগের সদ্ব্যবহার করে তারা সবাই সমন্বয়ক হয়েছেন। আন্দোলনে তারা যেমন সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন আবার সরকারি চাপের কাছে নতিস্বীকার করে আন্দোলন স্থগিত, প্রত্যাহার ইত্যাদি বিবৃতি দিয়ে বন্দিদশা থেকে মুক্ত হওয়ার ‘কৌশল’ অবলম্বন করেছেন। অতীতে ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের চাপের মুখে এমনকি সামরিক হেফাজতে নিয়ে নির্যাতন করেও কাবু করা যায় নাই এবং বন্দিদশা থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য তারা কখনও এমন কৌশল করেছেন বলে জানা নেই।
শুধু তাই নয়, তাদের আর একটি কৌশলের কাছেও ছাত্র সংগঠনগুলো হেরে যায়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে কোনো ছাত্র সংগঠন ক্যাম্পাসে পৃথকভাবে সভা সমাবেশ করতে পারবে না এই প্রস্তাবে সংগঠনসমূহের সম্মতি আদায়ে তারা সমর্থ হয়। ছাত্রদল, ছাত্র ইউনিয়ন, সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টসহ অন্যান্য ছাত্র সংগঠনের নেতাদের সামনের কাতারে কৌশলে না থাকতে দেয়ায় ওইসব সংগঠনের কর্মীদের লড়াইয়ে অংশগ্রহণও উপযুক্তভাবে দৃশ্যমান হয়নি। এমনকি ছাত্রশিবিরকে সাথে নিয়ে তারা আওয়াজ তোলে ভবিষ্যতে ক্যাম্পাস ছাত্র রাজনীতি মুক্ত থাকবে এবং নির্বাচিত ছাত্র সংসদ ছাড়া ক্যাম্পাসে কোনো ছাত্র সংগঠনের কার্যক্রম চলবে না। ছাত্রদের একটা অংশকেও ওই সময়ে তারা এই বক্তব্যের সমর্থনে আনতে সমর্থ হয়। অথচ অভ্যুত্থান পরবর্তীতে সবার আগে ক্যাম্পাসকে কেন্দ্র করে তারাই রাজনৈতিক দল এনসিপি এবং ছাত্র সংগঠন গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ গড়ে তোলেন। অথচ অভ্যুত্থান পরবর্তীতে সবার আগে ক্যাম্পাসকে কেন্দ্র করে তারাই রাজনৈতিক দল এনসিপি এবং ছাত্র সংগঠন গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ গড়ে তোলেন। এর চেয়ে বড় দ্বিচারিতা আর কী হতে পারে।
এসব সমন্বয়কবৃন্দ এবং পরবর্তীতে যারা রাজনৈতিক দলের নেতা হয়েছেন তারা কিন্তু নয় মাস ধরে মানুষের পর্যবেক্ষণে আছেন। জুলাই অভ্যুত্থানের সাথে সাথেই আন্দোলনমুখী ছাত্র সমন্বয়কদের একাংশ হয়ে ওঠেন সচিবালয়মুখী। সরকারি কর্মকর্তাদের নিয়োগ, বদলি, পদায়ন, পদোন্নতি, পদচ্যুতি সব কিছুই করতে হয়েছে তাদের মর্জিমাফিক এবং অভিযোগ আছে অনেক কিছুই হয়েছে মোটা অংকের বিনিময়ে। ‘দেশটা বাপের’ না হলে কি সচিবালয়কে এভাবে নিয়ন্ত্রণে নেয়া যায়?
জুলাই অভ্যুত্থানের পরপরই কুমিল্লা ও ফেনীর বিস্তৃত এলাকায় বড় ধরনের বন্যা হয়। ছাত্র আন্দোলনের ভাবমূর্তি তখন তুঙ্গে। সমন্বয়কদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে মানুষ তাদের রিলিফ ফান্ডে কোটি কোটি টাকা জমা দেয়ার পরেও ওই টাকা তারা রিলিফ তৎপরতায় ব্যবহার না করে ব্যাংকে জমা রেখে দেওয়ায় ব্যাপক সমালোচনার মুখে অন্তর্বর্তী সরকার ছাত্র নেতাদের ওই টাকা সরকারি রিলিফ ফান্ডে জমা দেয়ার নির্দেশ দেয়। রিলিফের টাকা নিয়ে এ ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ায় সমন্বয়কদের ভাবমূর্তি যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়। একই অভিযোগ উঠতে থাকে ‘জুলাই ফাউন্ডেশনের তহবিল সংগ্রহে ও তা বিতরণে এবং এজন্য দল থেকে বহিষ্কারের ঘটনাও ঘটেছে।
অন্যদিকে রাজনৈতিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশের পর থেকেই জাতীয় নাগরিক পার্টির শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন নেতার বিরুদ্ধে নানা ধরনের অভিযোগ উঠেছে। পাঠ্যবই ছাপানোর কাজে দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ ওঠে জাতীয় নাগরিক পার্টির যুগ্ম সদস্য সচিব গাজী সালাউদ্দিন তানভীরের বিরুদ্ধে। এ নিয়ে তখন গণমাধ্যমে খবরও প্রকাশিত হয়। গত মার্চ মাসে জেলা প্রশাসক নিয়োগে অবৈধ হস্তক্ষেপের অভিযোগ ওঠে তানভীরের বিরুদ্ধে। তবে তানভীর তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ অস্বীকার করে আসছিলেন। অবশেষে তানভীরকে দল থেকে সাময়িক অব্যাহতি দিতে বাধ্য হয় দলটির নেতৃত্ব।
জাতীয় নাগরিক পার্টির দুই শীর্ষ নেতা উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম ও দক্ষিণের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আব্দুল্লাহ। জুলাই-আগস্টে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় প্রথমসারির সমন্বয়ক ছিলেন তারা দুজনই। গত মার্চে ঈদের আগে বিশাল গাড়িবহর নিয়ে নিজ এলাকা পঞ্চগড়ে শোডাউন দেন সারজিস আলম। তার এই গাড়িবহরের বিশাল শোডাউন নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানা সমালোচনা তৈরি হয়। এমনকি তখন দলের কেন্দ্রীয় নেত্রী তাসনিম জারা বিষয়টির সমালোচনা করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্টও করেন। গত ৯ এপ্রিল হাসনাত আব্দুল্লাহ ও সারজিস আলম দুর্নীতি দমন কমিশনে যান। এ বিষয়টি নিয়ে তখন নানা ধরনের আলোচনা পত্রপত্রিকায় ও সামাজিক মাধ্যমে দেখা যায়। দক্ষিণাঞ্চলের আহ্বায়ক দক্ষিণে না যেয়ে গাজীপুরে যেয়ে আক্রান্ত হওয়া নিয়েও নানা ধরনের মন্তব্য আসছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। গত কয়েক মাস ধরেই এই দুই নেতার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগে দলটির কেন্দ্রীয় কমিটির অনেকেই এক ধরনের অস্বস্তিতে রয়েছেন বলে জানা যায়।
সাবেক সমন্বয়ক এবং এখন নতুন দলের নেতা আব্দুল হান্নান মাসউদের হাতিয়া গমন উপলক্ষে ছোট ওই দ্বীপ শহরটিতে ৮৩টি তোরণ নির্মিত হয়েছিল এবং সারজিস আলমের মতো একই ধরনের গাড়ির বহরের আয়োজন ছিলো। হাতিয়া সফর শেষে এক টকশোতে সঞ্চালকের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তাঁর এখন একটি গাড়ি দরকার। কেউ যদি তাকে একটি গাড়ি দেয় তিনি সানন্দে তা গ্রহণ করবেন এবং ইতোমধ্যে তিনি গাড়ি পেয়ে গেছেন। শীর্ষ কয়েকজন নেতার বিলাসী জীবনযাপন নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে দলের অন্দরেই। দলের বয়স মাত্র এক মাস হওয়ার আগেই দল কর্তৃক বিলাসবহুল হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টালে ইফতার পার্টির আয়োজন এবং ইতোপূর্বে সমন্বয়কদের দীর্ঘ সময় যাবত ওই হোটেলের কয়েকটি স্যুট ও রুম তাদের নামে অলিখিতভাবে বরাদ্দ রাখা ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা সমালোচনা রয়েছে। আর ২০ লাখের কম্বল দিতে ২২ লাখের হেলিকপ্টার বিলাস নিয়েও প্রচুর প্রশ্ন উঠেছিল। বাতাসে কান পাতলেই শোনা যায় ব্যবসা বাণিজ্য ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর যে সিন্ডিকেট ছিলো তারা মুক্ত হস্তে বিশাল অংকের টাকা নতুন দলকে দিচ্ছেন এবং তারা তা সানন্দে গ্রহণও করছেন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক সমন্বয়ক ও বর্তমান যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদের এপিএস মোয়াজ্জেম হোসেনের বিরুদ্ধে গত কয়েক মাসে নানা অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। সোমবার তাকে তার পদ থেকে অব্যাহতি দিয়ে প্রজ্ঞাপনও জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। আসিফ মাহমুদের পিতা স্থানীয় স্কুলের প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধেও অভিযোগ উঠে এবং এ জন্য আসিফ মাহমুদ ক্ষমা প্রার্থনা করেন। নানা অভিযোগে আসিফ মাহমুদের নিজ এলাকা মুরাদনগরে তার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ মিছিলও হয়েছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় মেডিকেল দলের সদস্য বর্তমান স্বাস্থ্য উপদেষ্টার ব্যক্তিগত কর্মকর্তা তুহিন ফারাবীকে নিয়েও মন্ত্রণালয়ে নানা ধরনের অভিযোগ উঠেছে। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকেও জাতীয় নাগরিক পার্টির নেতাদের বিরুদ্ধে নানা দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ আসছে।
রাজনীতিতে গুনগত পরিবর্তনের ঘোষণা দিয়ে তারুণ্যনির্ভর রাজনৈতিক দল আত্মপ্রকাশের পর এই দলটিকে ঘিরে জনসাধারনের একটা অংশের মাঝে নানা প্রত্যাশা ছিল; কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে নতুন দল হিসেবে যাত্রার শুরু থেকেই কেন এসব অভিযোগ আসছে দলটির বিরুদ্ধে? কেন তাদের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের এত অপরিণত আচরণ? কেন তাদের নেতৃত্বে একটা অংশের মধ্যে শুধু ক্রোধ আর উদ্ধত্য? কেন বিলাসী জীবনের প্রতি এত ভালোবাসা? তাহলে কি রাজনীতির সেই পুরোনো পথেই হাঁটছে জাতীয় নাগরিক পার্টি?
জুলাই গনঅভ্যুত্থানের অন্যতম পরিকল্পনাকারী হিসেবে খ্যাত উপদেষ্টা মাহফুজ আলম তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে আক্ষেপ ও হতাশা প্রকাশ করে লিখেছেনÑ ‘সবচেয়ে ডেডিকেটেড ছাত্রকর্মীরা ক্রেডিট, দলবাজি আর কোরামবাজির খপ্পরে পড়েছেন। আর্থিক অস্বচ্ছতার অভিযোগ হাতেগোনা কয়েকজনের বিরুদ্ধে, কিন্তু ডিমোরালাইজড হয়েছে সমগ্র ছাত্র-জনতা।’ এ ছাত্র-জনতাকে ডিমোরালাইজড করার দায় তো ছাত্র সমন্বয়ক ও নতুন দলের নেতৃত্বের একাংশের ওপর বর্তায়। তারা এমনভাবে চলছেন যেন- ‘যখন চাহে এ মন যা’ তাই করতে হবে।
জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের হত্যকান্ডের বিচার হতে হবে। সরকার, দল, ব্যক্তি সবারই বিচার হতে পারে। কে না করেছে? জুলাই-আগস্ট হত্যাকা-ের কুশীলবদের বিচারের দাবি আওয়ামী লীগের ভেতর থেকেই ওঠা উচিত ছিল। সেটা তো দূরের কথা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে সাধারণভাবে কোন আত্মসমালোচনা ও অনুশোচনা নেই; কিন্তু বিচারিক প্রক্রিয়া বাদ দিয়ে জামায়াত আর হেফাজতকে সাথে নিয়ে, যমুনায় যেখানে সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ সেখানে মব সৃষ্টি করিয়ে তারপর উপদেষ্টা পরিষদ সভা করে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হলো (যা কার্যত ৫ আগস্ট থেকে নিষিদ্ধই আছে)। এ পরিস্থিতি চলতে থাকলে দেখা যাবে নির্বাচন দাবি করার অপরাধে ‘যমুনা মব’ এক সময় বিএনপিকেও নিষিদ্ধ করার দাবি করতে পারে। এভাবে ‘দেশটি নিজের বাপের’ মনে করার মতো রাজনৈতিক তৎপরতা চললে এবং ক্রোধ, হিংসা, উগ্রতা ও ঔদ্ধত্যের সমাবেশের কাছে আত্মসমর্পণ করে এবং বেআইনি অবস্থানে আহুত সমাবেশকে গ্রীষ্মের দাবদাহ থেকে স্বস্তি দিতে ঠান্ডা পানি স্প্রে করে আরো নিকৃষ্ট ফ্যাসিবাদকে আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে। জাতীয় নাগরিক পার্টি উগ্র মৌলবাদী শক্তির সাথে মিলে যে রাজনৈতিক মেরুকরণ দাঁড় করালেন, যে মেরুকরণের সমাবেশ থেকে সেøাগান উঠলো ‘গোলাম আযমের বাংলায় আওয়ামী লীগের ঠাঁই নাই’Ñ তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে গণতন্ত্রে উত্তরণের প্রক্রিয়া, সংস্কার প্রক্রিয়া, ক্ষতিগ্রস্ত হবে দল হিসেবে এনসিপি আর ২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থানের আকাক্সক্ষা।
লাখো ছাত্র-তরুণদের সেই সেøাগান ‘দেশটি কারো বাপের নয়’, আর দেয়ালে দেয়ালে গ্রাফিতি আকারে আঁকা স্বপ্ন কি প্রত্যাশা ভঙ্গের বেদনা হিসেবে রয়ে যাবে?
[লেখক : সাবেক ছাত্র নেতা]