alt

উপ-সম্পাদকীয়

ডেঙ্গু প্রতিরোধে করণীয়

মাহতাব হোসাইন মাজেদ

: শনিবার, ১৭ মে ২০২৫

বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্যের জন্য বর্তমানে অন্যতম বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে ডেঙ্গু জ্বর। বিশেষ করে গ্রীষ্ম ও বর্ষাকালে এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গুর প্রকোপ ভয়াবহ রূপ নেয়। প্রতিবার মৌসুম শুরুর আগে এবং পরে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান জনমনে উদ্বেগ সৃষ্টি করে। বিগত কয়েক বছর ধরে ডেঙ্গু কেবল শহরকেন্দ্রিক নয়, বরং সারাদেশেই এর বিস্তার ঘটেছে, যা এর ভয়াবহতা আরও বাড়িয়ে তুলেছে।

পরিসংখ্যান : সংখ্যায় ডেঙ্গুর চিত্র

২০২৫ সালের মে মাস পর্যন্ত স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২,৯৮৬ জন, যাদের মধ্যে পুরুষ ১,৮০৮ জন এবং নারী ১,১৭৮ জন। মোট রোগীর ৯১.৬৩ শতাংশ ইতিমধ্যে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন। এ সময়ের মধ্যে ডেঙ্গুতে মৃত্যুবরণ করেছেন ২১ জন।

এর আগে ২০২৪ সালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন ১,০১,২১৪ জন এবং মৃত্যুবরণ করেছিলেন ৫৭৫ জন। ২০২৩ সালে পরিস্থিতি ছিল আরও ভয়াবহÑ আক্রান্ত হয়েছিলেন ৩,২১,১৭৯ জন এবং প্রাণ হারান ১,৭০৫ জন। ২০২২ সালে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৬২,৩৮২ এবং মৃত্যুর সংখ্যা ২৮১।

স্বাস্থ্য বিশ্লেষকদের মতে, ২০২৩ সালের রেকর্ডসংখ্যক মৃত্যু কেবল চিকিৎসার ঘাটতির কারণে নয়, বরং বিলম্বিত শনাক্তকরণ, জনগণের অসচেতনতা ও সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবও দায়ী।

ডেঙ্গু কী এবং কেন তা ভয়াবহ?

ডেঙ্গু হলো এডিস ইজিপ্টাই মশা দ্বারা বিস্তার লাভকারী একটি ভাইরাল রোগ। এই মশাটি সাধারণত দিনের বেলা কামড়ায় এবং পরিষ্কার পানি জমে থাকা জায়গায় বংশ বিস্তার করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, প্রতি বছর প্রায় ৫০ লাখ মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন এবং এর মধ্যে প্রায় ৫ লাখ মানুষকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়। মৃত্যুহার কম হলেও উপযুক্ত চিকিৎসা না পেলে জটিলতা ও মৃত্যু ঘটার আশঙ্কা থাকে।

ডেঙ্গু ভাইরাসের চারটি প্রধান ধরনের মধ্যে একটির সংক্রমণের পর শরীরে সেই ধরনটির বিরুদ্ধে প্রতিরোধক্ষমতা গড়ে ওঠে। কিন্তু পরবর্তীতে অন্য কোনো ধরন দ্বারা সংক্রমিত হলে রোগ আরও জটিল হতে পারে, যা প্রাণঘাতী ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভারে রূপ নেয়।

ডেঙ্গুর লক্ষণ ও ধরন

ডেঙ্গুর সাধারণ লক্ষণগুলো হলো: হঠাৎ উচ্চ জ্বর, তীব্র মাথাব্যথা ও চোখের পেছনে ব্যথা, পেশি ও গাঁটে ব্যথা, বমি বমি ভাব বা বমি, লালচে ফুসকুড়ি বা র‌্যাশ, অনুচক্রিকা (প্লাটিলেট) হ্রাস।

ডেঙ্গুর প্রকারভেদ : ডেঙ্গু ফিভার (সাধারণ জ্বর), ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার (রক্তক্ষরণজনিত সমস্যা), ডেঙ্গু শক সিনড্রোম (রক্তচাপ হ্রাস, অঙ্গ বিকল, মারাত্মক জটিলতা)।

ডেঙ্গু কেন বাড়ছে?

বাংলাদেশে ডেঙ্গুর বিস্তারের পেছনে রয়েছে বেশ কয়েকটি মূল কারণ:

জলবায়ু পরিবর্তন : তাপমাত্রা ও আর্দ্রতার পরিবর্তনের ফলে এডিস মশার বংশ বিস্তারের অনুকূল পরিবেশ তৈরি হচ্ছে।

শহরকেন্দ্রিক জনসংখ্যার ঘনত্ব: ঢাকা ও চট্টগ্রামের মতো শহরে আবর্জনা, অপ্রতুল পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থাপনা এবং অপরিকল্পিত নগরায়ণ মশা প্রজননের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করছে।

পর্যাপ্ত জনসচেতনতার অভাব: অনেক মানুষ জানেন না কীভাবে ডেঙ্গু ছড়ায় বা কিভাবে তা প্রতিরোধ করতে হয়।

মশা নিধনে সরকারি কার্যক্রমের দুর্বলতা: অনেক সময় স্থানীয় সরকার মশা নিধনের কার্যক্রম নিয়মিত ও কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করতে ব্যর্থ হয়।

বিশ্বব্যাপী প্রেক্ষাপট

ডেঙ্গু এখন আর কেবল গ্রীষ্মপ্রধান দেশের সমস্যা নয়। ইউরোপ, উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা, এমনকি দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানের মতো উন্নত দেশেও ডেঙ্গুর সংক্রমণ দেখা যাচ্ছে। বর্তমানে প্রায় ১২৮টি দেশে ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে মশার বিস্তার নতুন নতুন অঞ্চলেও ঘটছে।

স্বাস্থ্য খাতে চাপ ও অর্থনৈতিক প্রভাব

ডেঙ্গু শুধু জনস্বাস্থ্যের হুমকি নয়, এটি অর্থনীতির ওপরও চাপ সৃষ্টি করে। প্রতিটি ডেঙ্গুরোগীর চিকিৎসা ব্যয় গড়ে ১০ হাজার টাকা থেকে শুরু করে কয়েক লাখ টাকায় পৌঁছায়, বিশেষ করে জটিল অবস্থায় আইসিইউ ব্যবস্থাপনায় গেলে। এর ফলে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারের ওপর ব্যাপক আর্থিক চাপ পড়ে। এছাড়া, কর্মজীবী মানুষ আক্রান্ত হলে কর্মঘণ্টা হারিয়ে দেশের উৎপাদনশীলতাও হ্রাস পায়।

জনগণের করণীয় : সচেতনতাই প্রধান অস্ত্র

ডেঙ্গু প্রতিরোধে সবার আগে প্রয়োজন সচেতনতা ও নাগরিক দায়িত্ববোধ। যে কোনও রোগ প্রতিরোধে সচেতনতাই সবচেয়ে বড় ভ্যাকসিন।

করণীয় পদক্ষেপসমূহ :

ফুলের টব, ডাবের খোসা, টায়ার, ড্রাম, বোতলÑ যেখানে পানি জমে, তা প্রতি তিন দিন অন্তর পরিষ্কার করা।

ঘরে মশারি ব্যবহার ও মশা নিধক স্প্রে প্রয়োগ দিনের বেলা পুরো হাত-পা ঢাকা জামা পরিধান। বাসা, অফিস ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়মিত পরিচ্ছন্নতা অভিযান। সন্দেহজনক উপসর্গ দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া

প্রাকৃতিক প্রতিরোধ : ঘরোয়া পথ্য ও খাদ্যাভ্যাস

ঘরোয়া প্রতিকার হিসেবে কিছু খাবার ও উপাদান রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করতে পারে:

পেঁপে পাতা: প্লাটিলেট বাড়াতে সহায়ক

ড্রাগন ফল ও লেবু: ভিটামিন সি সরবরাহ করে

মধু ও হলুদ: রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়

কালিজিরা ও নিম তেল: ভাইরাস প্রতিরোধে সহায়ক

নারকেল তেল: মশা তাড়াতে কার্যকর,

তবে চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া যেকোনো ঘরোয়া পদ্ধতি প্রয়োগ ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে, বিশেষ করে শিশু, গর্ভবতী নারী ও জটিল রোগীদের জন্য।

রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ : আরও জোরালো হতে হবে

সরকার প্রতি বছরই ডেঙ্গু প্রতিরোধে অভিযান পরিচালনা করে। তবে তা মৌসুমকেন্দ্রিক, যা দীর্ঘমেয়াদি সমাধান নয়। স্থানীয় সরকার, সিটি করপোরেশন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে।

মশা নিয়ন্ত্রণে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার (ড্রোন, জেনেটিকালি মডিফায়েড মশা ইত্যাদি), স্কুল-কলেজে স্বাস্থ্য শিক্ষা গবেষণার জন্য বাজেট বরাদ্দ, আক্রান্ত এলাকা চিহ্নিত করে টার্গেটেড মশানিধন কার্যক্রম। ডেঙ্গু মোকাবিলায় কেবল সরকারি পদক্ষেপ নয়, প্রয়োজন ব্যক্তিগত সচেতনতা, সামাজিক উদ্যোগ ও সম্মিলিত প্রয়াস। ডেঙ্গু প্রতিরোধ করতে হলে আমাদের জীবনের অভ্যাস ও পরিবেশ ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন আনতে হবে। আজই উদ্যোগ নিন, আগামীকাল যেন কেউ হাসপাতালে না যায়। মনে রাখবেনÑ আপনার একটু সাবধানতা, হতে পারে একজনের জীবনরক্ষাকারী সিদ্ধান্ত।

[লেখক: প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান ,জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি]

প্রযুক্তির ফাঁদে শৈশব : স্ক্রিন টাইম গিলে খাচ্ছে খেলার মাঠ

রমগদ্য : সিরাজগঞ্জে ‘ব্রিটিশ প্রেতাত্মা’

বামপন্থা : নীতির সঙ্গে নেতৃত্বের ভূমিকা

দাবি আদায়ে জনদুর্ভোগ : জনশিক্ষা ও সুশাসনের পথ

ইমাম রইস উদ্দিন হত্যাকাণ্ড : সুবিচার নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব

কারাগার, সংশোধনাগার ও ভবঘুরে কেন্দ্রগুলোর সংস্কার কি হবে

জ্বালানির বদল, জীবিকার ঝুঁকি

প্রসঙ্গ : রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনী ও চট্টগ্রামে এস্কর্ট ডিউটি

দেশটা কারো বাপের নয়!

বুদ্ধের বাণীতে বিশ্বশান্তির প্রার্থনা

আর কত ধর্ষণের খবর শুনতে হবে?

সংস্কারের স্বপ্ন বনাম বাস্তবতার রাজনীতি

মধুমাসের স্মৃতি ও দেশীয় ফলের রসাল সমারোহ

মুর্শিদাবাদে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট

লিঙ্গের রাজনীতি বা বিবাদ নয়, চাই মানবিকতার নিবিড় বন্ধন

বাজেট : বাস্তবতা, চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা

যুক্তরাষ্ট্র-ইরান পারমাণবিক আলোচনার স্থবিরতা

রম্যগদ্য: “বাঙালি আমরা, নহি তো মেষ...”

সর্বজনীন শিক্ষার বলয়ের বাইরে আদিবাসীরা : অন্তর্ভুক্তির লড়াইয়ে বৈষম্যের দেয়াল

শোনার গান, দেখার টান : অনুভূতির ভোঁতা সময়

ছবি

ছিন্নপত্রে বাংলাদেশের প্রকৃতি ও রবীন্দ্র চেতনা

ভেতরের অদৃশ্য অপরাধ : সমাজের বিপন্ন মানসিকতা

দারিদ্র্য ও বৈষম্য নিরসনে খাসজমি ও জলার গুরুত্ব

অবহেলিত কৃষক ও বাজার ব্যবস্থার বৈষম্য

রাক্ষুসে মাছের দাপটে বিপন্ন দেশীয় মাছ : করণীয় কী?

বজ্রপাতের আতঙ্কে জনজীবন

তাহলে কি ঘৃণায় ছেয়ে যাবে দেশ, মানবজমিন রইবে পতিত

কর্পোরেট ও ব্যক্তিগত সামাজিক দায়বদ্ধতা

‘রাখাইন করিডর’ : একটি ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষণ

ভিন্নমতের ভয়, নির্বাচনের দোলাচল ও অন্তর্বর্তী সরকারের কৌশলী অবস্থান

সমুদ্রসম্পদ সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা

কৃষি শিক্ষা হোক উদ্যোক্তা গড়ার মাধ্যম

রঙ্গব্যঙ্গ : কোটের কেবল রং বদলায়

মে দিবসের চেতনা বনাম বাস্তবতা

শ্রম আইন ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় চাই আন্তরিকতা

বাসযোগ্যতা সূচকে ঢাকা কেন এত পিছিয়ে

tab

উপ-সম্পাদকীয়

ডেঙ্গু প্রতিরোধে করণীয়

মাহতাব হোসাইন মাজেদ

শনিবার, ১৭ মে ২০২৫

বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্যের জন্য বর্তমানে অন্যতম বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে ডেঙ্গু জ্বর। বিশেষ করে গ্রীষ্ম ও বর্ষাকালে এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গুর প্রকোপ ভয়াবহ রূপ নেয়। প্রতিবার মৌসুম শুরুর আগে এবং পরে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান জনমনে উদ্বেগ সৃষ্টি করে। বিগত কয়েক বছর ধরে ডেঙ্গু কেবল শহরকেন্দ্রিক নয়, বরং সারাদেশেই এর বিস্তার ঘটেছে, যা এর ভয়াবহতা আরও বাড়িয়ে তুলেছে।

পরিসংখ্যান : সংখ্যায় ডেঙ্গুর চিত্র

২০২৫ সালের মে মাস পর্যন্ত স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২,৯৮৬ জন, যাদের মধ্যে পুরুষ ১,৮০৮ জন এবং নারী ১,১৭৮ জন। মোট রোগীর ৯১.৬৩ শতাংশ ইতিমধ্যে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন। এ সময়ের মধ্যে ডেঙ্গুতে মৃত্যুবরণ করেছেন ২১ জন।

এর আগে ২০২৪ সালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন ১,০১,২১৪ জন এবং মৃত্যুবরণ করেছিলেন ৫৭৫ জন। ২০২৩ সালে পরিস্থিতি ছিল আরও ভয়াবহÑ আক্রান্ত হয়েছিলেন ৩,২১,১৭৯ জন এবং প্রাণ হারান ১,৭০৫ জন। ২০২২ সালে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৬২,৩৮২ এবং মৃত্যুর সংখ্যা ২৮১।

স্বাস্থ্য বিশ্লেষকদের মতে, ২০২৩ সালের রেকর্ডসংখ্যক মৃত্যু কেবল চিকিৎসার ঘাটতির কারণে নয়, বরং বিলম্বিত শনাক্তকরণ, জনগণের অসচেতনতা ও সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবও দায়ী।

ডেঙ্গু কী এবং কেন তা ভয়াবহ?

ডেঙ্গু হলো এডিস ইজিপ্টাই মশা দ্বারা বিস্তার লাভকারী একটি ভাইরাল রোগ। এই মশাটি সাধারণত দিনের বেলা কামড়ায় এবং পরিষ্কার পানি জমে থাকা জায়গায় বংশ বিস্তার করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, প্রতি বছর প্রায় ৫০ লাখ মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন এবং এর মধ্যে প্রায় ৫ লাখ মানুষকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়। মৃত্যুহার কম হলেও উপযুক্ত চিকিৎসা না পেলে জটিলতা ও মৃত্যু ঘটার আশঙ্কা থাকে।

ডেঙ্গু ভাইরাসের চারটি প্রধান ধরনের মধ্যে একটির সংক্রমণের পর শরীরে সেই ধরনটির বিরুদ্ধে প্রতিরোধক্ষমতা গড়ে ওঠে। কিন্তু পরবর্তীতে অন্য কোনো ধরন দ্বারা সংক্রমিত হলে রোগ আরও জটিল হতে পারে, যা প্রাণঘাতী ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভারে রূপ নেয়।

ডেঙ্গুর লক্ষণ ও ধরন

ডেঙ্গুর সাধারণ লক্ষণগুলো হলো: হঠাৎ উচ্চ জ্বর, তীব্র মাথাব্যথা ও চোখের পেছনে ব্যথা, পেশি ও গাঁটে ব্যথা, বমি বমি ভাব বা বমি, লালচে ফুসকুড়ি বা র‌্যাশ, অনুচক্রিকা (প্লাটিলেট) হ্রাস।

ডেঙ্গুর প্রকারভেদ : ডেঙ্গু ফিভার (সাধারণ জ্বর), ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার (রক্তক্ষরণজনিত সমস্যা), ডেঙ্গু শক সিনড্রোম (রক্তচাপ হ্রাস, অঙ্গ বিকল, মারাত্মক জটিলতা)।

ডেঙ্গু কেন বাড়ছে?

বাংলাদেশে ডেঙ্গুর বিস্তারের পেছনে রয়েছে বেশ কয়েকটি মূল কারণ:

জলবায়ু পরিবর্তন : তাপমাত্রা ও আর্দ্রতার পরিবর্তনের ফলে এডিস মশার বংশ বিস্তারের অনুকূল পরিবেশ তৈরি হচ্ছে।

শহরকেন্দ্রিক জনসংখ্যার ঘনত্ব: ঢাকা ও চট্টগ্রামের মতো শহরে আবর্জনা, অপ্রতুল পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থাপনা এবং অপরিকল্পিত নগরায়ণ মশা প্রজননের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করছে।

পর্যাপ্ত জনসচেতনতার অভাব: অনেক মানুষ জানেন না কীভাবে ডেঙ্গু ছড়ায় বা কিভাবে তা প্রতিরোধ করতে হয়।

মশা নিধনে সরকারি কার্যক্রমের দুর্বলতা: অনেক সময় স্থানীয় সরকার মশা নিধনের কার্যক্রম নিয়মিত ও কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করতে ব্যর্থ হয়।

বিশ্বব্যাপী প্রেক্ষাপট

ডেঙ্গু এখন আর কেবল গ্রীষ্মপ্রধান দেশের সমস্যা নয়। ইউরোপ, উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা, এমনকি দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানের মতো উন্নত দেশেও ডেঙ্গুর সংক্রমণ দেখা যাচ্ছে। বর্তমানে প্রায় ১২৮টি দেশে ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে মশার বিস্তার নতুন নতুন অঞ্চলেও ঘটছে।

স্বাস্থ্য খাতে চাপ ও অর্থনৈতিক প্রভাব

ডেঙ্গু শুধু জনস্বাস্থ্যের হুমকি নয়, এটি অর্থনীতির ওপরও চাপ সৃষ্টি করে। প্রতিটি ডেঙ্গুরোগীর চিকিৎসা ব্যয় গড়ে ১০ হাজার টাকা থেকে শুরু করে কয়েক লাখ টাকায় পৌঁছায়, বিশেষ করে জটিল অবস্থায় আইসিইউ ব্যবস্থাপনায় গেলে। এর ফলে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারের ওপর ব্যাপক আর্থিক চাপ পড়ে। এছাড়া, কর্মজীবী মানুষ আক্রান্ত হলে কর্মঘণ্টা হারিয়ে দেশের উৎপাদনশীলতাও হ্রাস পায়।

জনগণের করণীয় : সচেতনতাই প্রধান অস্ত্র

ডেঙ্গু প্রতিরোধে সবার আগে প্রয়োজন সচেতনতা ও নাগরিক দায়িত্ববোধ। যে কোনও রোগ প্রতিরোধে সচেতনতাই সবচেয়ে বড় ভ্যাকসিন।

করণীয় পদক্ষেপসমূহ :

ফুলের টব, ডাবের খোসা, টায়ার, ড্রাম, বোতলÑ যেখানে পানি জমে, তা প্রতি তিন দিন অন্তর পরিষ্কার করা।

ঘরে মশারি ব্যবহার ও মশা নিধক স্প্রে প্রয়োগ দিনের বেলা পুরো হাত-পা ঢাকা জামা পরিধান। বাসা, অফিস ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়মিত পরিচ্ছন্নতা অভিযান। সন্দেহজনক উপসর্গ দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া

প্রাকৃতিক প্রতিরোধ : ঘরোয়া পথ্য ও খাদ্যাভ্যাস

ঘরোয়া প্রতিকার হিসেবে কিছু খাবার ও উপাদান রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করতে পারে:

পেঁপে পাতা: প্লাটিলেট বাড়াতে সহায়ক

ড্রাগন ফল ও লেবু: ভিটামিন সি সরবরাহ করে

মধু ও হলুদ: রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়

কালিজিরা ও নিম তেল: ভাইরাস প্রতিরোধে সহায়ক

নারকেল তেল: মশা তাড়াতে কার্যকর,

তবে চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া যেকোনো ঘরোয়া পদ্ধতি প্রয়োগ ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে, বিশেষ করে শিশু, গর্ভবতী নারী ও জটিল রোগীদের জন্য।

রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ : আরও জোরালো হতে হবে

সরকার প্রতি বছরই ডেঙ্গু প্রতিরোধে অভিযান পরিচালনা করে। তবে তা মৌসুমকেন্দ্রিক, যা দীর্ঘমেয়াদি সমাধান নয়। স্থানীয় সরকার, সিটি করপোরেশন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে।

মশা নিয়ন্ত্রণে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার (ড্রোন, জেনেটিকালি মডিফায়েড মশা ইত্যাদি), স্কুল-কলেজে স্বাস্থ্য শিক্ষা গবেষণার জন্য বাজেট বরাদ্দ, আক্রান্ত এলাকা চিহ্নিত করে টার্গেটেড মশানিধন কার্যক্রম। ডেঙ্গু মোকাবিলায় কেবল সরকারি পদক্ষেপ নয়, প্রয়োজন ব্যক্তিগত সচেতনতা, সামাজিক উদ্যোগ ও সম্মিলিত প্রয়াস। ডেঙ্গু প্রতিরোধ করতে হলে আমাদের জীবনের অভ্যাস ও পরিবেশ ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন আনতে হবে। আজই উদ্যোগ নিন, আগামীকাল যেন কেউ হাসপাতালে না যায়। মনে রাখবেনÑ আপনার একটু সাবধানতা, হতে পারে একজনের জীবনরক্ষাকারী সিদ্ধান্ত।

[লেখক: প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান ,জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি]

back to top