alt

উপ-সম্পাদকীয়

মেগাসিটি : দারিদ্র্য যখন ‘অবাঞ্ছিত বর্জ্য’

মতিউর রহমান

: বৃহস্পতিবার, ০৩ জুলাই ২০২৫

আধুনিক শহর, বিশেষত উন্নয়নশীল বিশ্বের মেগাসিটিগুলো, এক অদ্ভুত দ্বান্দ্বিকতার সাক্ষী। একদিকে যেমন এখানে প্রতিনিয়ত চোখে পড়ে দারিদ্র্যের প্রকট উপস্থিতি-রাস্তায় হকার, ভিক্ষুক, ছিন্নমূল শিশু এবং অনানুষ্ঠানিক শ্রমজীবী মানুষের ভিড়; অন্যদিকে, এই দৃশ্যমান দারিদ্র্য শহুরে মধ্যবিত্তের মনে করুণা বা সহানুভূতির পরিবর্তে জন্ম দেয় এক ধরনের বিরক্তি, উদ্বেগ, এমনকি অসহিষ্ণুতা। এই বৈপরীত্য, যেখানে মানুষ দৃষ্টিসীমায় থেকেও নৈতিক ও সামাজিকভাবে অদৃশ্য হয়ে ওঠে, তাকেই নন্দিত সমাজতাত্ত্বিক জিগমুন্ট বাউম্যান তার ওয়েস্টেড লাইভস : মডারনিটি অ্যান্ড ইটস আউটকাস্টস (২০০৪) গ্রন্থে মোরাল ডিসট্যান্সিং বা নৈতিক দূরত্ব বলে ব্যাখ্যা করেছেন।

ার মতে, আধুনিক ভোক্তাবাদী সমাজে দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে আর পূর্ণাঙ্গ নাগরিক হিসেবে দেখা হয় না, বরং ব্যর্থ রাষ্ট্রব্যবস্থার অনিবার্য পরিণতিজনিত ‘অবাঞ্ছিত বর্জ্য’ হিসেবেই তাদের চিহ্নিত করা হয়। এই মানসিক বিচ্ছিন্নতা শুধু ব্যক্তিগত মনস্তত্ত্বের ফসল নয়, বরং এটি এক জটিল রাজনৈতিক অর্থনীতি, সাংস্কৃতিক পরিবর্তন এবং নব্য উদারনৈতিক বৈশ্বিকীকরণের সম্মিলিত প্রভাবের ফল, যা সমাজের এক বিশাল অংশকে ‘নষ্ট জীবন’র আবর্তে ঠেলে দেয়।

নৈতিক দূরত্ব কোনো সরল মানসিক প্রক্রিয়া নয়, এটি একটি জটিল সামাজিক কাঠামোর ফল, যা বিভিন্ন স্তরে কাজ করে। আধুনিক শহরের মধ্যবিত্ত শ্রেণী এখন আর শুধু তাদের পেশা বা অর্থনৈতিক ভূমিকার দ্বারা সংজ্ঞায়িত হয় না, বরং তাদের ভোগ্যপণ্যের ধরন, জীবনযাপন পদ্ধতি এবং সামাজিক উচ্চাকাক্সক্ষার ভিত্তিতেই তাদের পরিচয় নির্ধারিত হয়। শহরগুলো ক্রমেই হয়ে উঠছে বেসরকারিকৃত, নিরাপত্তাচর্চিত এবং প্রাচীরঘেরা স্থান, যেখানে নাগরিকদের মধ্যে সংযোগের চেয়ে বিচ্ছিন্নতা বেশি পরিলক্ষিত হয়। এই প্রেক্ষাপটে, রাস্তায় থাকা দরিদ্র মানুষকে অপ্রাসঙ্গিক, শহরের সৌন্দর্য ও শৃঙ্খলার জন্য হুমকি এবং সামাজিক ব্যবস্থার বাইরে অবস্থানকারী হিসেবে দেখা হয়। এই যে ‘তারা’ ‘আমাদের’ অংশ নয়, বরং ‘অন্য কেউ’- এই মনোভাবই মূলত নৈতিক দূরত্বের ভিত্তি স্থাপন করে।

বাউম্যানের ওয়েস্টেড লাইভস ধারণা আধুনিকতার এক অন্ধকার দিক উন্মোচন করে। উন্নয়নের নামে যে সামাজিক ও অর্থনৈতিক কার্যকারিতা প্রতিষ্ঠা করা হয়, তার অনিবার্য ফলাফল হিসেবে এক ধরনের মানব-আবর্জনার সৃষ্টি হয়। এই অবর্জনা অর্থনৈতিকভাবে নিষ্ক্রিয়, রাজনৈতিকভাবে প্রান্তিক এবং নৈতিকভাবে পরিত্যাজ্য মানুষদের নিয়ে গঠিত। সমাজে এই জনসংখ্যাকে অংশগ্রহণকারী নয়, বরং বোঝা হিসেবে দেখা হয়; তাদের প্রতি সহানুভূতি নয়, বরং অবহেলাই যেন তাদের প্রাপ্য হয়ে দাঁড়ায়। নৈতিক দূরত্ব সেই মানসিক কৌশল, যার মাধ্যমে সমাজ এই জনসংখ্যাকে দায়মুক্তির চোখে দেখে। এর ফলে একদিকে নাগরিকদের বিবেক সুস্থ থাকে, অন্যদিকে দরিদ্রদের প্রান্তিকতা ক্রমশ প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়।

বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে এই নৈতিক দূরত্ব প্রতিদিনের নগরজীবনে অনায়াসে দৃশ্যমান। রাস্তার পাশে ভিক্ষুক দেখলে, বাসে উঠে গানের অনুরোধ করা হকারের মুখোমুখি হলে, অথবা ফুটপাতে শুয়ে থাকা কোনো বৃদ্ধাকে দেখলে-শহুরে মধ্যবিত্তের প্রতিক্রিয়া প্রায়শই বিরক্তি, ঘৃণা, কিংবা নির্লিপ্তি। এদের কষ্ট কিংবা মানবিক পরিস্থিতি নিয়ে কোনো গভীর চিন্তা প্রায়শই তাদের মনে জন্ম নেয় না। বরং সমাজে প্রচলিত নৈতিক বর্ণনায় এদের ব্যর্থতা ব্যক্তিগত হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়-তারা অলস, অসৎ, বা ঠকবাজ। এই ধারণার ফলে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর প্রতি সমাজের যে নৈতিক বাধ্যবাধকতা থাকা উচিত, তা ক্রমেই বিলুপ্ত হয়।

এই নৈতিক দূরত্বকে আরও শক্তিশালী করে তোলে ভোগ্যপণ্যের সংস্কৃতি। মধ্যবিত্ত শ্রেণীর জীবনযাপন এখন শপিংমল, ক্যাফে, বিদেশি পণ্য ও প্রযুক্তি-নির্ভর। এই গ্লোবালাইজড জীবনধারায় রাস্তার হকার বা ভিক্ষুক যেন এক বিরক্তিকর ব্যতিক্রম-আধুনিকতার গতি ও সৌন্দর্যের পথে এক চোখের বিষ। তারা কেবল অর্থনৈতিকভাবে দরিদ্র নয়, বরং সামাজিকভাবে অপ্রাসঙ্গিক। তাদের কাজ, পোশাক, ভাষা- সবকিছুই যেন অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয়। তাদের উপস্থিতি যেন শহরের উন্নয়নের গতিকে বাধাগ্রস্ত করছে-এমন একটি ভ্রান্ত ধারণা সমাজে বদ্ধমূল। এই দৃষ্টিভঙ্গির ফলে দরিদ্ররা কেবল বঞ্চিত নয়, সামাজিকভাবে লাঞ্ছিতও। তাদের মানবসত্তা যেন অস্বীকৃত হয়, এবং তারা কেবল সমাজের অযোগ্য অংশ হিসেবে বিবেচিত হতে থাকে।

বাউম্যান দেখিয়েছেন যে, এই প্রক্রিয়া কেবল মনস্তাত্ত্বিক নয়, বরং রাষ্ট্রীয় নীতিমালার মধ্য দিয়েও এটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়। ভিক্ষাবৃত্তি দমন আইন, হকার উচ্ছেদ অভিযান, ছিন্নমূল জনগোষ্ঠীকে শহর থেকে সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা এসব কিছুই হচ্ছে শহরের মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত শ্রেণীর স্বস্তি ও ভোগের জন্য গৃহীত পদক্ষেপ। এটি একটি গভীর সামাজিক রোগ, যেখানে রাষ্ট্র দরিদ্রদের নয়, বরং সম্পদশালী ও আধুনিক শ্রেণীর শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের কথা বিবেচনা করে। শহর পরিকল্পনা, নান্দনিকতা এবং পরিবেশের নামে দরিদ্রদের জীবন ও কাজের অধিকার নিয়মিতভাবে অস্বীকার করা হয়। উন্নয়ন প্রকল্পের নামে বস্তি উচ্ছেদ, ফুটপাত দখলমুক্তকরণ, ইত্যাদি পদক্ষেপগুলো প্রায়শই দরিদ্রদের জীবন-জীবিকা ধ্বংস করে এবং তাদের আরও প্রান্তিক করে তোলে। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে এই পদক্ষেপগুলো একটি বার্তা দেয় যে, দরিদ্ররা শহরের অংশ নয়, বরং একটি অনাকাক্সিক্ষত উপদ্রব, যাদের থেকে শহরকে পরিষ্কার রাখা জরুরি।

গণমাধ্যম ও জনপ্রিয় সংস্কৃতিও এই দূরত্বের প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। দরিদ্রদের নিয়ে যে চিত্রপট নির্মিত হয়, তা সাধারণত ভুল ধারণা ও ভ্রান্ত বিশ্বাসে পূর্ণ। ভিক্ষুক মানেই প্রতারক, হকার মানেই অসৎ, ছিন্নমূল শিশু মানেই ভবিষ্যতের অপরাধী-এই ধরনের চিত্রণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জটিল বাস্তবতাকে আড়াল করে, তাদের মনুষ্যত্বকে মুছে দেয় এবং সমাজে সহানুভূতির স্থানকে সংকুচিত করে। গণমাধ্যম তাদের গল্পগুলোকে বিকৃত করে উপস্থাপন করে, অথবা তাদের সমস্যাগুলোকে কেবল ব্যক্তিগত ব্যর্থতা হিসেবে তুলে ধরে। এর ফলে, সমাজের মূল স্রোতের মানুষ তাদের প্রতি এক ধরনের ঘৃণা বা অবজ্ঞা পোষণ করতে শেখে। বাউম্যান দেখিয়েছেন, ভোক্তা সমাজে নৈতিকতা একটি পণ্য হয়ে যায়; দায়িত্ব কাঁধে না নিয়ে কেবল সিস্টেমে ছেড়ে দেয়া হয়-এনজিও, দাতব্য সংস্থা বা সরকারের ঘাড়ে। ব্যক্তি নিজেকে দায়মুক্ত মনে করে, অথচ কাঠামোগত বৈষম্যের অংশীদার হয়ে যায়। এই দায়মুক্তির মানসিকতা সমাজে আরও গভীরে নৈতিক দূরত্বকে প্রোথিত করে।

তবুও এই নৈতিক দূরত্বের ভেতরে মাঝে মাঝে ফাটল দেখা যায়। কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মহামারি বা সামাজিক আন্দোলনের সময় এই দূরত্ব সাময়িকভাবে দুর্বল হয়। উদাহরণস্বরূপ, কোভিড-১৯ মহামারির সময়, শহরের মধ্যবিত্ত শ্রেডু এক অদ্ভুত বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছিল। তারা উপলব্ধি করেছিল যে, রিকশাচালক, গার্মেন্টস শ্রমিক, বা হকারদের শ্রম ছাড়া শহর অচল। হাজারো মানুষ যখন কাজ হারিয়ে পথে নেমেছিল, তখন কিছুটা হলেও সমাজের উচ্চবর্গ বাস্তবতাকে চিনতে শুরু করেছিল। গণমাধ্যমে দরিদ্রদের দুর্দশার চিত্র ফুটে উঠেছিল, এবং সাময়িকভাবে এক ধরনের মানবিক আবেদন তৈরি হয়েছিল। ব্যক্তিগত পর্যায়ে অনেকেই এগিয়ে এসেছিল সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে। কিন্তু এই উপলব্ধি ছিল অস্থায়ী। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সহানুভূতির সেই ক্ষণস্থায়ী আলোর বদলে আবারো অন্ধকার দূরত্ব ফিরে আসে। শহর আবার তার পুরোনো রূপে ফিরে যায়, যেখানে দরিদ্ররা অদৃশ্য এবং তাদের জীবন নষ্ট হয়েই থাকে। এই প্রবণতা প্রমাণ করে যে, সমাজে নৈতিক দূরত্বের শেকড় কতটা গভীরে প্রোথিত।

তাহলে এই নৈতিক দূরত্বকে কীভাবে ভাঙা যায়? কেবল দান-খয়রাত বা ফেসবুকে ছবি পোস্ট করাই এর সমাধান নয়। এটি একটি গভীরতর সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান, যার জন্য প্রয়োজন সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন।

প্রথমত, দরকার একটি গভীর সামাজিক সচেতনতা -যেখানে শহর কেবল মধ্যবিত্তের স্বপ্নপুরী নয়, বরং সব শ্রেডুর নাগরিকের বসবাসযোগ্য ও সম্মানজনক স্থান। এই সচেতনতা শুধুমাত্র দরিদ্রদের প্রতি সহানুভূতি তৈরি করবে না, বরং তাদের অধিকার ও মর্যাদাকে স্বীকৃতি দেবে। সমাজের প্রতিটি স্তরে এই বার্তা পৌঁছানো জরুরি যে, শহরের প্রবৃদ্ধি ও সমৃদ্ধি সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফল, এবং দরিদ্ররাও এই প্রক্রিয়ার অবিচ্ছেদ্য অংশ।

দ্বিতীয়ত, দরকার দরিদ্রদেরকে অতিরিক্ত জনসংখ্যা নয়, বরং শহরের গঠনমূলক শক্তি হিসেবে দেখা। রিকশাচালক, হকার, নির্মাণ শ্রমিক- এরা শহরের অর্থনৈতিক চাকা সচল রাখে। তাদের শ্রম ও অবদানকে স্বীকৃতি দেয়া প্রয়োজন। তাদের কাজের পরিবেশ উন্নত করা এবং তাদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। তাদের জীবন-জীবিকার অধিকারকে সম্মান জানানো হলে তারা কেবল অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবে না, বরং সমাজে তাদের মর্যাদাও বৃদ্ধি পাবে।

তৃতীয়ত, দরকার এমন নীতিমালা ও সামাজিক আন্দোলন, যা প্রান্তিক মানুষের অধিকার, মর্যাদা ও অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে। ভিক্ষাবৃত্তি দমন আইন বা হকার উচ্ছেদের মতো দমনমূলক ব্যবস্থার পরিবর্তে, দরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি, স্বল্পমূল্যে আবাসন ব্যবস্থা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার মতো মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার ওপর জোর দিতে হবে। এনজিও এবং দাতব্য সংস্থাগুলোর ভূমিকাও পুনর্বিবেচনা করা প্রয়োজন, যাতে তারা কেবল ত্রাণের কাজ না করে, বরং দরিদ্রদের ক্ষমতায়নের ওপর জোর দেয়। গণমাধ্যমকে তাদের দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে, যাতে দরিদ্রদের সম্পর্কে ভুল ধারণা না ছড়িয়ে তাদের বাস্তবসম্মত এবং মানবিক চিত্র তুলে ধরা হয়।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, এটি কেবল অর্থনৈতিক পুনর্বণ্টনের প্রশ্ন নয়, বরং সামাজিক মর্যাদার ন্যায়সঙ্গত পুনর্নির্মাণের প্রশ্ন। দারিদ্র্যকে কেবল একটি অর্থনৈতিক সমস্যা হিসেবে না দেখে, বরং এটিকে সামাজিক অসম্মান ও বঞ্চনার ফল হিসেবে দেখতে হবে। দরিদ্রদের মানুষ হিসেবে দেখা, তাদের মুখোমুখি হওয়া এবং তাদের গল্পকে শোনা একটি রাজনৈতিক ও নৈতিক কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায়। এক সামাজিক প্রজন্মের কাছে এটা চ্যালেঞ্জ - দারিদ্র্যকে কেবল একটি বিচ্ছিন্ন সমস্যা হিসেবে না দেখে, বরং এর পেছনের কাঠামোগত বৈষম্যকে প্রশ্ন করে দেখা।

বাউম্যান আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন যে, আমরা যদি সমাজের একাংশকে কেবল বর্জ্য হিসেবে ভাবি, তাহলে সেই সমাজ নিজেরই মানবিক ভিত্তি হারায়। তিনি হুঁশিয়ার করেছেন যে, নৈতিক দূরত্ব কোনো নিরীহ প্রক্রিয়া নয়-এটি আত্মার অবক্ষয়ের নাম।

এই প্রেক্ষাপটে, শহরকে একটি ন্যায্য, মানবিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক জায়গা হিসেবে গড়ে তোলার কাজ কেবল রাষ্ট্রের নয়, প্রতিটি সচেতন নাগরিকেরও। শহরের প্রতিটি মানুষ-রিকশাচালক, হকার, কুলি, বেকার যুবক-এই শহরের শরীর ও আত্মার অংশ। তাদের অদৃশ্য করে আমরা কেবল তাদের নয়, নিজেদেরও অক্ষম করে তুলি। এই আত্মিক পুনর্জাগরণই হতে পারে নৈতিক দূরত্বের বিরুদ্ধে সবচেয়ে কার্যকর প্রতিরোধ। যখন আমরা একে অপরের প্রতি সহমর্মিতা এবং মানবিকতার বোধ জাগ্রত করতে পারব, তখনই একটি সত্যিকারের অন্তর্ভুক্তিমূলক ও মানবিক সমাজ গড়ে তোলা সম্ভব হবে।

[লেখক : গবেষক ও উন্নয়নকর্মী ]

কোথায় হারাল একান্নবর্তী পরিবার?

এই শান্তি কি মহাঝড়ের পূর্বলক্ষণ?

ফলের রাজ্য পার্বত্য চট্টগ্রাম

ছবি

তৃতীয় শক্তির জন্য জায়গা খালি : বামপন্থীরা কি ঘুরে দাঁড়াতে পারে না

জমি আপনার, দখল অন্যের?

সিধু-কানু : ধ্বংসস্তূপের নিচেও জেগে আছে সাহস

ছবি

বাংলার অনন্য লোকসংস্কৃতি ও গণতান্ত্রিক চেতনা

চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী সাম্পান

তিন দিক থেকে স্বাস্থ্যঝুঁকি : করোনা, ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া

দেশের অর্থ পাচারের বাস্তবতা

খাদ্য নিরাপত্তার নতুন দিগন্ত

আবারও কি রোহিঙ্গাদের ত্যাগ করবে বিশ্ব?

প্লান্ট ক্লিনিক বদলে দিচ্ছে কৃষির ভবিষ্যৎ

ঢাকাকে বাসযোগ্য নগরী করতে করণীয়

রম্যগদ্য : ‘ডন ডনা ডন ডন...’

ইরান-ইসরায়েল দ্বন্দ্ব : কে সন্ত্রাসী, কে শিকার?

সুস্থ ও শক্তিশালী জাতি গঠনে শারীরিক শিক্ষার গুরুত্ব

প্রতিরোধই উত্তম : মাদকমুক্ত প্রজন্ম গড়ার ডাক

ছবি

বিকাশের পথকে পরিত্যাগ করা যাবে না

বর্ষা ও বৃক্ষরোপণ : সবুজ বিপ্লবের আহ্বান

প্রাথমিক শিক্ষায় ঝরে পড়া রোধে শিক্ষকের করণীয়

পারমাণবিক ন্যায়বিচার ও বৈশ্বিক ভণ্ডামির প্রতিচ্ছবি

পরিবেশের নীরব রক্ষক : শকুন সংরক্ষণে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ প্রয়োজন

মশার উপদ্রব : জনস্বাস্থ্য ও নগর ব্যবস্থাপনার চরম ব্যর্থতা

ভুল স্বীকারে গ্লানি নেই

ভাঙনের বুকে টিকে থাকা স্বপ্ন

একটি সফর, একাধিক সংকেত : কে পেল কোন বার্তা?

দেশের কারা ব্যবস্থার বাস্তবতা

ইসলামী ব্যাংক একীভূতকরণ : আস্থা ফেরাতে সংস্কার, না দায়মুক্তির প্রহসন?

রম্যগদ্য : চাঁদাবাজি চলছে, চলবে

বায়ুদূষণ : নীরব ঘাতক

ইসরায়েলের কৌশলগত ঔদ্ধত্য

পরিবার : সুনাগরিক ও সুশাসক তৈরির ভিত্তিমূল

শিল্পে গ্যাস সংকট : দ্রুত সমাধানের উদ্যোগ নিন

আমাদের লড়াইটা আমাদের লড়তে দিন

ব্যাকবেঞ্চারদের পৃথিবী : ব্যর্থতার গায়ে সাফল্যের ছাপ

tab

উপ-সম্পাদকীয়

মেগাসিটি : দারিদ্র্য যখন ‘অবাঞ্ছিত বর্জ্য’

মতিউর রহমান

বৃহস্পতিবার, ০৩ জুলাই ২০২৫

আধুনিক শহর, বিশেষত উন্নয়নশীল বিশ্বের মেগাসিটিগুলো, এক অদ্ভুত দ্বান্দ্বিকতার সাক্ষী। একদিকে যেমন এখানে প্রতিনিয়ত চোখে পড়ে দারিদ্র্যের প্রকট উপস্থিতি-রাস্তায় হকার, ভিক্ষুক, ছিন্নমূল শিশু এবং অনানুষ্ঠানিক শ্রমজীবী মানুষের ভিড়; অন্যদিকে, এই দৃশ্যমান দারিদ্র্য শহুরে মধ্যবিত্তের মনে করুণা বা সহানুভূতির পরিবর্তে জন্ম দেয় এক ধরনের বিরক্তি, উদ্বেগ, এমনকি অসহিষ্ণুতা। এই বৈপরীত্য, যেখানে মানুষ দৃষ্টিসীমায় থেকেও নৈতিক ও সামাজিকভাবে অদৃশ্য হয়ে ওঠে, তাকেই নন্দিত সমাজতাত্ত্বিক জিগমুন্ট বাউম্যান তার ওয়েস্টেড লাইভস : মডারনিটি অ্যান্ড ইটস আউটকাস্টস (২০০৪) গ্রন্থে মোরাল ডিসট্যান্সিং বা নৈতিক দূরত্ব বলে ব্যাখ্যা করেছেন।

ার মতে, আধুনিক ভোক্তাবাদী সমাজে দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে আর পূর্ণাঙ্গ নাগরিক হিসেবে দেখা হয় না, বরং ব্যর্থ রাষ্ট্রব্যবস্থার অনিবার্য পরিণতিজনিত ‘অবাঞ্ছিত বর্জ্য’ হিসেবেই তাদের চিহ্নিত করা হয়। এই মানসিক বিচ্ছিন্নতা শুধু ব্যক্তিগত মনস্তত্ত্বের ফসল নয়, বরং এটি এক জটিল রাজনৈতিক অর্থনীতি, সাংস্কৃতিক পরিবর্তন এবং নব্য উদারনৈতিক বৈশ্বিকীকরণের সম্মিলিত প্রভাবের ফল, যা সমাজের এক বিশাল অংশকে ‘নষ্ট জীবন’র আবর্তে ঠেলে দেয়।

নৈতিক দূরত্ব কোনো সরল মানসিক প্রক্রিয়া নয়, এটি একটি জটিল সামাজিক কাঠামোর ফল, যা বিভিন্ন স্তরে কাজ করে। আধুনিক শহরের মধ্যবিত্ত শ্রেণী এখন আর শুধু তাদের পেশা বা অর্থনৈতিক ভূমিকার দ্বারা সংজ্ঞায়িত হয় না, বরং তাদের ভোগ্যপণ্যের ধরন, জীবনযাপন পদ্ধতি এবং সামাজিক উচ্চাকাক্সক্ষার ভিত্তিতেই তাদের পরিচয় নির্ধারিত হয়। শহরগুলো ক্রমেই হয়ে উঠছে বেসরকারিকৃত, নিরাপত্তাচর্চিত এবং প্রাচীরঘেরা স্থান, যেখানে নাগরিকদের মধ্যে সংযোগের চেয়ে বিচ্ছিন্নতা বেশি পরিলক্ষিত হয়। এই প্রেক্ষাপটে, রাস্তায় থাকা দরিদ্র মানুষকে অপ্রাসঙ্গিক, শহরের সৌন্দর্য ও শৃঙ্খলার জন্য হুমকি এবং সামাজিক ব্যবস্থার বাইরে অবস্থানকারী হিসেবে দেখা হয়। এই যে ‘তারা’ ‘আমাদের’ অংশ নয়, বরং ‘অন্য কেউ’- এই মনোভাবই মূলত নৈতিক দূরত্বের ভিত্তি স্থাপন করে।

বাউম্যানের ওয়েস্টেড লাইভস ধারণা আধুনিকতার এক অন্ধকার দিক উন্মোচন করে। উন্নয়নের নামে যে সামাজিক ও অর্থনৈতিক কার্যকারিতা প্রতিষ্ঠা করা হয়, তার অনিবার্য ফলাফল হিসেবে এক ধরনের মানব-আবর্জনার সৃষ্টি হয়। এই অবর্জনা অর্থনৈতিকভাবে নিষ্ক্রিয়, রাজনৈতিকভাবে প্রান্তিক এবং নৈতিকভাবে পরিত্যাজ্য মানুষদের নিয়ে গঠিত। সমাজে এই জনসংখ্যাকে অংশগ্রহণকারী নয়, বরং বোঝা হিসেবে দেখা হয়; তাদের প্রতি সহানুভূতি নয়, বরং অবহেলাই যেন তাদের প্রাপ্য হয়ে দাঁড়ায়। নৈতিক দূরত্ব সেই মানসিক কৌশল, যার মাধ্যমে সমাজ এই জনসংখ্যাকে দায়মুক্তির চোখে দেখে। এর ফলে একদিকে নাগরিকদের বিবেক সুস্থ থাকে, অন্যদিকে দরিদ্রদের প্রান্তিকতা ক্রমশ প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়।

বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে এই নৈতিক দূরত্ব প্রতিদিনের নগরজীবনে অনায়াসে দৃশ্যমান। রাস্তার পাশে ভিক্ষুক দেখলে, বাসে উঠে গানের অনুরোধ করা হকারের মুখোমুখি হলে, অথবা ফুটপাতে শুয়ে থাকা কোনো বৃদ্ধাকে দেখলে-শহুরে মধ্যবিত্তের প্রতিক্রিয়া প্রায়শই বিরক্তি, ঘৃণা, কিংবা নির্লিপ্তি। এদের কষ্ট কিংবা মানবিক পরিস্থিতি নিয়ে কোনো গভীর চিন্তা প্রায়শই তাদের মনে জন্ম নেয় না। বরং সমাজে প্রচলিত নৈতিক বর্ণনায় এদের ব্যর্থতা ব্যক্তিগত হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়-তারা অলস, অসৎ, বা ঠকবাজ। এই ধারণার ফলে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর প্রতি সমাজের যে নৈতিক বাধ্যবাধকতা থাকা উচিত, তা ক্রমেই বিলুপ্ত হয়।

এই নৈতিক দূরত্বকে আরও শক্তিশালী করে তোলে ভোগ্যপণ্যের সংস্কৃতি। মধ্যবিত্ত শ্রেণীর জীবনযাপন এখন শপিংমল, ক্যাফে, বিদেশি পণ্য ও প্রযুক্তি-নির্ভর। এই গ্লোবালাইজড জীবনধারায় রাস্তার হকার বা ভিক্ষুক যেন এক বিরক্তিকর ব্যতিক্রম-আধুনিকতার গতি ও সৌন্দর্যের পথে এক চোখের বিষ। তারা কেবল অর্থনৈতিকভাবে দরিদ্র নয়, বরং সামাজিকভাবে অপ্রাসঙ্গিক। তাদের কাজ, পোশাক, ভাষা- সবকিছুই যেন অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয়। তাদের উপস্থিতি যেন শহরের উন্নয়নের গতিকে বাধাগ্রস্ত করছে-এমন একটি ভ্রান্ত ধারণা সমাজে বদ্ধমূল। এই দৃষ্টিভঙ্গির ফলে দরিদ্ররা কেবল বঞ্চিত নয়, সামাজিকভাবে লাঞ্ছিতও। তাদের মানবসত্তা যেন অস্বীকৃত হয়, এবং তারা কেবল সমাজের অযোগ্য অংশ হিসেবে বিবেচিত হতে থাকে।

বাউম্যান দেখিয়েছেন যে, এই প্রক্রিয়া কেবল মনস্তাত্ত্বিক নয়, বরং রাষ্ট্রীয় নীতিমালার মধ্য দিয়েও এটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়। ভিক্ষাবৃত্তি দমন আইন, হকার উচ্ছেদ অভিযান, ছিন্নমূল জনগোষ্ঠীকে শহর থেকে সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা এসব কিছুই হচ্ছে শহরের মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত শ্রেণীর স্বস্তি ও ভোগের জন্য গৃহীত পদক্ষেপ। এটি একটি গভীর সামাজিক রোগ, যেখানে রাষ্ট্র দরিদ্রদের নয়, বরং সম্পদশালী ও আধুনিক শ্রেণীর শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের কথা বিবেচনা করে। শহর পরিকল্পনা, নান্দনিকতা এবং পরিবেশের নামে দরিদ্রদের জীবন ও কাজের অধিকার নিয়মিতভাবে অস্বীকার করা হয়। উন্নয়ন প্রকল্পের নামে বস্তি উচ্ছেদ, ফুটপাত দখলমুক্তকরণ, ইত্যাদি পদক্ষেপগুলো প্রায়শই দরিদ্রদের জীবন-জীবিকা ধ্বংস করে এবং তাদের আরও প্রান্তিক করে তোলে। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে এই পদক্ষেপগুলো একটি বার্তা দেয় যে, দরিদ্ররা শহরের অংশ নয়, বরং একটি অনাকাক্সিক্ষত উপদ্রব, যাদের থেকে শহরকে পরিষ্কার রাখা জরুরি।

গণমাধ্যম ও জনপ্রিয় সংস্কৃতিও এই দূরত্বের প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। দরিদ্রদের নিয়ে যে চিত্রপট নির্মিত হয়, তা সাধারণত ভুল ধারণা ও ভ্রান্ত বিশ্বাসে পূর্ণ। ভিক্ষুক মানেই প্রতারক, হকার মানেই অসৎ, ছিন্নমূল শিশু মানেই ভবিষ্যতের অপরাধী-এই ধরনের চিত্রণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জটিল বাস্তবতাকে আড়াল করে, তাদের মনুষ্যত্বকে মুছে দেয় এবং সমাজে সহানুভূতির স্থানকে সংকুচিত করে। গণমাধ্যম তাদের গল্পগুলোকে বিকৃত করে উপস্থাপন করে, অথবা তাদের সমস্যাগুলোকে কেবল ব্যক্তিগত ব্যর্থতা হিসেবে তুলে ধরে। এর ফলে, সমাজের মূল স্রোতের মানুষ তাদের প্রতি এক ধরনের ঘৃণা বা অবজ্ঞা পোষণ করতে শেখে। বাউম্যান দেখিয়েছেন, ভোক্তা সমাজে নৈতিকতা একটি পণ্য হয়ে যায়; দায়িত্ব কাঁধে না নিয়ে কেবল সিস্টেমে ছেড়ে দেয়া হয়-এনজিও, দাতব্য সংস্থা বা সরকারের ঘাড়ে। ব্যক্তি নিজেকে দায়মুক্ত মনে করে, অথচ কাঠামোগত বৈষম্যের অংশীদার হয়ে যায়। এই দায়মুক্তির মানসিকতা সমাজে আরও গভীরে নৈতিক দূরত্বকে প্রোথিত করে।

তবুও এই নৈতিক দূরত্বের ভেতরে মাঝে মাঝে ফাটল দেখা যায়। কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মহামারি বা সামাজিক আন্দোলনের সময় এই দূরত্ব সাময়িকভাবে দুর্বল হয়। উদাহরণস্বরূপ, কোভিড-১৯ মহামারির সময়, শহরের মধ্যবিত্ত শ্রেডু এক অদ্ভুত বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছিল। তারা উপলব্ধি করেছিল যে, রিকশাচালক, গার্মেন্টস শ্রমিক, বা হকারদের শ্রম ছাড়া শহর অচল। হাজারো মানুষ যখন কাজ হারিয়ে পথে নেমেছিল, তখন কিছুটা হলেও সমাজের উচ্চবর্গ বাস্তবতাকে চিনতে শুরু করেছিল। গণমাধ্যমে দরিদ্রদের দুর্দশার চিত্র ফুটে উঠেছিল, এবং সাময়িকভাবে এক ধরনের মানবিক আবেদন তৈরি হয়েছিল। ব্যক্তিগত পর্যায়ে অনেকেই এগিয়ে এসেছিল সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে। কিন্তু এই উপলব্ধি ছিল অস্থায়ী। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সহানুভূতির সেই ক্ষণস্থায়ী আলোর বদলে আবারো অন্ধকার দূরত্ব ফিরে আসে। শহর আবার তার পুরোনো রূপে ফিরে যায়, যেখানে দরিদ্ররা অদৃশ্য এবং তাদের জীবন নষ্ট হয়েই থাকে। এই প্রবণতা প্রমাণ করে যে, সমাজে নৈতিক দূরত্বের শেকড় কতটা গভীরে প্রোথিত।

তাহলে এই নৈতিক দূরত্বকে কীভাবে ভাঙা যায়? কেবল দান-খয়রাত বা ফেসবুকে ছবি পোস্ট করাই এর সমাধান নয়। এটি একটি গভীরতর সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান, যার জন্য প্রয়োজন সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন।

প্রথমত, দরকার একটি গভীর সামাজিক সচেতনতা -যেখানে শহর কেবল মধ্যবিত্তের স্বপ্নপুরী নয়, বরং সব শ্রেডুর নাগরিকের বসবাসযোগ্য ও সম্মানজনক স্থান। এই সচেতনতা শুধুমাত্র দরিদ্রদের প্রতি সহানুভূতি তৈরি করবে না, বরং তাদের অধিকার ও মর্যাদাকে স্বীকৃতি দেবে। সমাজের প্রতিটি স্তরে এই বার্তা পৌঁছানো জরুরি যে, শহরের প্রবৃদ্ধি ও সমৃদ্ধি সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফল, এবং দরিদ্ররাও এই প্রক্রিয়ার অবিচ্ছেদ্য অংশ।

দ্বিতীয়ত, দরকার দরিদ্রদেরকে অতিরিক্ত জনসংখ্যা নয়, বরং শহরের গঠনমূলক শক্তি হিসেবে দেখা। রিকশাচালক, হকার, নির্মাণ শ্রমিক- এরা শহরের অর্থনৈতিক চাকা সচল রাখে। তাদের শ্রম ও অবদানকে স্বীকৃতি দেয়া প্রয়োজন। তাদের কাজের পরিবেশ উন্নত করা এবং তাদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। তাদের জীবন-জীবিকার অধিকারকে সম্মান জানানো হলে তারা কেবল অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবে না, বরং সমাজে তাদের মর্যাদাও বৃদ্ধি পাবে।

তৃতীয়ত, দরকার এমন নীতিমালা ও সামাজিক আন্দোলন, যা প্রান্তিক মানুষের অধিকার, মর্যাদা ও অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে। ভিক্ষাবৃত্তি দমন আইন বা হকার উচ্ছেদের মতো দমনমূলক ব্যবস্থার পরিবর্তে, দরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি, স্বল্পমূল্যে আবাসন ব্যবস্থা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার মতো মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার ওপর জোর দিতে হবে। এনজিও এবং দাতব্য সংস্থাগুলোর ভূমিকাও পুনর্বিবেচনা করা প্রয়োজন, যাতে তারা কেবল ত্রাণের কাজ না করে, বরং দরিদ্রদের ক্ষমতায়নের ওপর জোর দেয়। গণমাধ্যমকে তাদের দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে, যাতে দরিদ্রদের সম্পর্কে ভুল ধারণা না ছড়িয়ে তাদের বাস্তবসম্মত এবং মানবিক চিত্র তুলে ধরা হয়।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, এটি কেবল অর্থনৈতিক পুনর্বণ্টনের প্রশ্ন নয়, বরং সামাজিক মর্যাদার ন্যায়সঙ্গত পুনর্নির্মাণের প্রশ্ন। দারিদ্র্যকে কেবল একটি অর্থনৈতিক সমস্যা হিসেবে না দেখে, বরং এটিকে সামাজিক অসম্মান ও বঞ্চনার ফল হিসেবে দেখতে হবে। দরিদ্রদের মানুষ হিসেবে দেখা, তাদের মুখোমুখি হওয়া এবং তাদের গল্পকে শোনা একটি রাজনৈতিক ও নৈতিক কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায়। এক সামাজিক প্রজন্মের কাছে এটা চ্যালেঞ্জ - দারিদ্র্যকে কেবল একটি বিচ্ছিন্ন সমস্যা হিসেবে না দেখে, বরং এর পেছনের কাঠামোগত বৈষম্যকে প্রশ্ন করে দেখা।

বাউম্যান আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন যে, আমরা যদি সমাজের একাংশকে কেবল বর্জ্য হিসেবে ভাবি, তাহলে সেই সমাজ নিজেরই মানবিক ভিত্তি হারায়। তিনি হুঁশিয়ার করেছেন যে, নৈতিক দূরত্ব কোনো নিরীহ প্রক্রিয়া নয়-এটি আত্মার অবক্ষয়ের নাম।

এই প্রেক্ষাপটে, শহরকে একটি ন্যায্য, মানবিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক জায়গা হিসেবে গড়ে তোলার কাজ কেবল রাষ্ট্রের নয়, প্রতিটি সচেতন নাগরিকেরও। শহরের প্রতিটি মানুষ-রিকশাচালক, হকার, কুলি, বেকার যুবক-এই শহরের শরীর ও আত্মার অংশ। তাদের অদৃশ্য করে আমরা কেবল তাদের নয়, নিজেদেরও অক্ষম করে তুলি। এই আত্মিক পুনর্জাগরণই হতে পারে নৈতিক দূরত্বের বিরুদ্ধে সবচেয়ে কার্যকর প্রতিরোধ। যখন আমরা একে অপরের প্রতি সহমর্মিতা এবং মানবিকতার বোধ জাগ্রত করতে পারব, তখনই একটি সত্যিকারের অন্তর্ভুক্তিমূলক ও মানবিক সমাজ গড়ে তোলা সম্ভব হবে।

[লেখক : গবেষক ও উন্নয়নকর্মী ]

back to top