সামছুল আলম
বাংলাদেশের মৎস্য খাত দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, পুষ্টি চাহিদাপূরণ ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এ খাত শুধু দেশের খাদ্য চাহিদা মেটাচ্ছে তা না, বরং আন্তর্জাতিক বাজারে রপ্তানি ও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনেও বিশেষ অবদান রাখছে।
বাংলাদেশে মৎস্য খাতের সম্ভাবনা এবং চ্যালেঞ্জ উভয়ই রয়েছে। মৎস্য খাত সবচেয়ে উৎপাদনশীল এবং গতিশীল খাতগুলোর মধ্যে একটি হওয়ায়, গত কয়েক দশক ধরে অর্থনীতিতে ধারাবাহিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশ মৎস্য খাতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। এই খাত আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে এবং বাংলাদেশের কৃষি অর্থনীতিতে ভবিষ্যতের উন্নয়নের জন্য সম্ভাবনার দাবি রাখে।
বর্তমানে নিরাপদ মাছ উৎপাদন ও দেশীয় মাছ রক্ষা করে তার সরবরাহ বৃদ্ধি করা একটি অন্যতম চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উষ্ণতা, অনাবৃষ্টি ও অপর্যাপ্ত বৃষ্টি, সমুদ্রের পানির উচ্চতা এবং লবণাক্ততা বৃদ্ধির ফলে উপকূলীয় মৎস্য সম্পদের ওপর ক্রমশ নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। নদীগুলোতে লবণাক্ত পানি অনুপ্রবেশের ফলে মিঠা পানির মাছ ও প্রাথমিক উৎপাদনশীলতায় পরিবর্তন ঘটছে। মাছের আবাসস্থল, বিচরণক্ষেত্র, অভিপ্রয়াণ ও প্রজনন প্রভাবিত হচ্ছে। জলবায়ুর ধারাবাহিক ক্রম-অবনতির ফলে মাছের অনেক আচরণগত বৈশিষ্ট্যও পরিবর্তিত হচ্ছে। মাছের প্রাকৃতিক প্রজনন মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে মাছের প্রজাতি-বৈচিত্র্যেও। এছাড়া ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমান্বয়ে নিচে নেমে যাওয়ায় পুকুর-দিঘীর পানির স্তর কমে যাচ্ছে। সারা বছর যেসব পুকুরে পানি থাকতো সেসব পুকুর মৌসুমি পুকুরে (শুধু বর্ষায় পানি থাকে) রূপান্তরিত হচ্ছে।
ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার জন্য আবাসস্থল, রাস্তা-ঘাট, বেড়িবাঁধ ও শিল্পকারখানা নির্মাণ, পুকুর ও প্রাকৃতিক জলাশয় ভরাট করার ফলে আবাদি পুকুর ও প্রাকৃতিক জলাশয়ের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। ফলে মৎস্য উৎপাদন তথা দেশীয় মাছ উৎপাদনে বিরূপ প্রভাব পড়ছে। বিশেষকরে জমিতে অতিমাত্রায় বালাইনাশক প্রয়োগ, পোনা ও ডিমওয়ালা মাছ নিধন এবং মাছের প্রজনন মৌসুমে নির্বিচারে মাছ ধরার কারণে এখন আর পরিচিত অনেক দেশি মাছের সন্ধান মেলে না। বাংলাদেশে অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ে মোট ২৬১ প্রজাতির মিঠাপানির মাছ রয়েছে। ২০১৫ সালের আইইউসিএনের তথ্য অনুযায়ী এর মধ্যে ৬৪ প্রজাতির মাছ বিলুপ্তপ্রায়। তবে দেশীয় এ মাছ যাতে মানুষের পাতে আবার ফিরিয়ে আনা যায় এবং দেশীয় মাছ যাতে বিলুপ্ত না হয় সেজন্য সরকারের প্রচেষ্টায় বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট-এ লাইভ জিন ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।
এছাড়া বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীদের অব্যাহত প্রচেষ্টায় প্রায় ৪০ প্রজাতির বিলুপ্তপ্রায় দেশীয় মাছ ফিরিয়ে আনা হয়েছে। যে অঞ্চলে এ মাছ বিলুপ্ত হবে, লাইভ জিন ব্যাংক থেকে সে অঞ্চলে মাছের পোনা সরবরাহ করা হবে। যাতে সে অঞ্চলে নতুন করে দেশীয় মাছের বিস্তার হতে পারে।
কথায় আছে মাছের পোনা, দেশের সোনা। আর দেশি মাছ পুষ্টির আধার। বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশি এ মাছগুলোতে আছে প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, লৌহ ও আয়োডিনের মতো খনিজ উপাদান এবং ভিটামিন। তাছাড়া দেশি মাছের আছে অন্ধত্ব, রক্তশূন্যতা, গলগ- প্রতিরোধ ক্ষমতা। বিশেষকরে গর্ভবতী মা ও শিশুদের ছোট ছোট মাছ খাওয়া ভীষণ প্রয়োজন। দেশি মাছের এসব পুষ্টিগুণ আমিষের নিরাপত্তা গড়ে তুলতে অতুলনীয়। এ কারণেই দেশি মাছ সংরক্ষণ ও চাষ করা দরকার। অতিমূল্যবান এ দেশি মাছ রক্ষা করতে হলে মাছগুলোকে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চাষের আওতায় আনতে হবে। বদ্ধ জলাশয়ে দেশি প্রজাতির মাছ যাতে বেশি পাওয়া যায় সেজন্য বেশ কিছু কৌশল অবলম্বন করা যেতে পারে। সেগুলো হলো ধান ক্ষেতে ছোট প্রজাতির মাছ চাষের ব্যবস্থা করা এবং এ ধরনের মাছ সারা বছর পাওয়ার জন্য ধানক্ষেতে মিনি পুকুর তৈরি; অপরিকল্পিত বালাইনাশক ব্যবহার না করা, মাছের প্রজনন মৌসুমে মাছ না ধরা, কারেন্ট জাল, চায়না দুয়ারি ও ফাঁস জাল ব্যবহার না করা, রাক্ষুসে মাছ কমানোর জন্য পুকুরে বা প্রাকৃতিক জলাশয়ে বিষ প্রয়োগ না করা, রুই জাতীয় মাছের সাথে ছোট প্রজাতির মাছের মিশ্র চাষ, জলাশয় প্লাবনভূমি এবং পুকুরে দেশি মাছের চাষাবাদের জন্য সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা।
মাছের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক জীবন-জীবিকার ও বেঁচে থাকার। অতীতকাল থেকেই এ দেশ ছিল মাছের ভা-ার। প্রাণিজ আমিষের অন্যতম উৎস হলো মাছ। গ্রাম থেকে শহর পর্যন্ত পুষ্টি চাহিদার একটি বড় অংশই পূরণ হয় মাছ থেকে। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রাণিজ আমিষের শতকরা ৬২.৭ ভাগ আসে মাছ থেকে। এক তথ্যে জানা যায়, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পর সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে চাষের মাছের উৎপাদন ছিল মাত্র ৬৮ হাজার টন; কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় সরকারের মৎস্য অধিদপ্তর ও বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটসহ সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় বিশাল সম্ভাবনাময় জলসম্পদ সমৃদ্ধ বাংলাদেশে ২০২৩-২৪ সালে মোট ৫০.১৮ লাখ মেট্রিক টন মাছ উৎপাদন হয়েছে। যেখানে অভ্যন্তরীণ উন্মুক্ত জলাশয় (কৃষি) মোট মাছ উৎপাদনে ২৮.১৩% (১৪.১২ লাখ মেট্রিক টন) এবং অভ্যন্তরীণ বদ্ধ জলাশয় (কৃষি) ৫৯.৩৪% (২৯.৭৮ লাখ মেট্রিক টন) অবদান রাখে।
সুতরাং, মোট মাছ উৎপাদনের ৮৭.৪৭% আসে অভ্যন্তরীণ মৎস্য চাষ থেকে। অভ্যন্তরীণ মৎস্য আহরণ এবং অভ্যন্তরীণ চাষের মৎস্য আহরণের বৃদ্ধির হার যথাক্রমে ২.০৬% এবং ৪.৪২%। অন্যদিকে সামুদ্রিক মৎস্য উৎপাদন ৬.২৯ লক্ষ মেট্রিক টন এবং মোট মৎস্য উৎপাদনে এর অবদান ১২.৫৩%, বৃদ্ধির হার ৭.৪৭%। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ে মাছ আহরণে তৃতীয় এবং বদ্ধ জলাশয়ে চাষের মাছ উৎপাদনে বিশ্বে পঞ্চম স্থানে রয়েছে। তেলাপিয়া উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে চতুর্থ এবং এশিয়ায় তৃতীয় স্থানে রয়েছে। ক্রাস্টাসিয়ান্স আহরণে বিশ্বে ৮ম এবং কোস্টাল ও সামুদ্রিক মাছ আহরণে ১৪ তম স্থান অর্জন করেছে। এছাড়া বিশ্বের ১১টি ইলিশ উৎপাদনকারী দেশের মধ্যে বাংলাদেশ প্রথম স্থানে রয়েছে।
দেশে বদ্ধ জলাশয়ে মাছ চাষ জনপ্রিয় হয়ে উঠলেও মুক্ত জলাশয়ে এখনো বহু প্রজাতির মাছ বিদ্যমান এবং এসব মাছ যথামাত্রায় বৃদ্ধির জন্য উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে; যাতে মা মাছ সারা বছর প্রতিটি মৎস্য বিচরণ ক্ষেত্রের অভয়াশ্রমে অবস্থান করতে পারে।
[লেখক : গণযোগাযোগ কর্মকর্তা, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ তথ্য দপ্তর]
সামছুল আলম
বুধবার, ৩০ জুলাই ২০২৫
বাংলাদেশের মৎস্য খাত দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, পুষ্টি চাহিদাপূরণ ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এ খাত শুধু দেশের খাদ্য চাহিদা মেটাচ্ছে তা না, বরং আন্তর্জাতিক বাজারে রপ্তানি ও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনেও বিশেষ অবদান রাখছে।
বাংলাদেশে মৎস্য খাতের সম্ভাবনা এবং চ্যালেঞ্জ উভয়ই রয়েছে। মৎস্য খাত সবচেয়ে উৎপাদনশীল এবং গতিশীল খাতগুলোর মধ্যে একটি হওয়ায়, গত কয়েক দশক ধরে অর্থনীতিতে ধারাবাহিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশ মৎস্য খাতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। এই খাত আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে এবং বাংলাদেশের কৃষি অর্থনীতিতে ভবিষ্যতের উন্নয়নের জন্য সম্ভাবনার দাবি রাখে।
বর্তমানে নিরাপদ মাছ উৎপাদন ও দেশীয় মাছ রক্ষা করে তার সরবরাহ বৃদ্ধি করা একটি অন্যতম চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উষ্ণতা, অনাবৃষ্টি ও অপর্যাপ্ত বৃষ্টি, সমুদ্রের পানির উচ্চতা এবং লবণাক্ততা বৃদ্ধির ফলে উপকূলীয় মৎস্য সম্পদের ওপর ক্রমশ নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। নদীগুলোতে লবণাক্ত পানি অনুপ্রবেশের ফলে মিঠা পানির মাছ ও প্রাথমিক উৎপাদনশীলতায় পরিবর্তন ঘটছে। মাছের আবাসস্থল, বিচরণক্ষেত্র, অভিপ্রয়াণ ও প্রজনন প্রভাবিত হচ্ছে। জলবায়ুর ধারাবাহিক ক্রম-অবনতির ফলে মাছের অনেক আচরণগত বৈশিষ্ট্যও পরিবর্তিত হচ্ছে। মাছের প্রাকৃতিক প্রজনন মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে মাছের প্রজাতি-বৈচিত্র্যেও। এছাড়া ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমান্বয়ে নিচে নেমে যাওয়ায় পুকুর-দিঘীর পানির স্তর কমে যাচ্ছে। সারা বছর যেসব পুকুরে পানি থাকতো সেসব পুকুর মৌসুমি পুকুরে (শুধু বর্ষায় পানি থাকে) রূপান্তরিত হচ্ছে।
ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার জন্য আবাসস্থল, রাস্তা-ঘাট, বেড়িবাঁধ ও শিল্পকারখানা নির্মাণ, পুকুর ও প্রাকৃতিক জলাশয় ভরাট করার ফলে আবাদি পুকুর ও প্রাকৃতিক জলাশয়ের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। ফলে মৎস্য উৎপাদন তথা দেশীয় মাছ উৎপাদনে বিরূপ প্রভাব পড়ছে। বিশেষকরে জমিতে অতিমাত্রায় বালাইনাশক প্রয়োগ, পোনা ও ডিমওয়ালা মাছ নিধন এবং মাছের প্রজনন মৌসুমে নির্বিচারে মাছ ধরার কারণে এখন আর পরিচিত অনেক দেশি মাছের সন্ধান মেলে না। বাংলাদেশে অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ে মোট ২৬১ প্রজাতির মিঠাপানির মাছ রয়েছে। ২০১৫ সালের আইইউসিএনের তথ্য অনুযায়ী এর মধ্যে ৬৪ প্রজাতির মাছ বিলুপ্তপ্রায়। তবে দেশীয় এ মাছ যাতে মানুষের পাতে আবার ফিরিয়ে আনা যায় এবং দেশীয় মাছ যাতে বিলুপ্ত না হয় সেজন্য সরকারের প্রচেষ্টায় বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট-এ লাইভ জিন ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।
এছাড়া বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীদের অব্যাহত প্রচেষ্টায় প্রায় ৪০ প্রজাতির বিলুপ্তপ্রায় দেশীয় মাছ ফিরিয়ে আনা হয়েছে। যে অঞ্চলে এ মাছ বিলুপ্ত হবে, লাইভ জিন ব্যাংক থেকে সে অঞ্চলে মাছের পোনা সরবরাহ করা হবে। যাতে সে অঞ্চলে নতুন করে দেশীয় মাছের বিস্তার হতে পারে।
কথায় আছে মাছের পোনা, দেশের সোনা। আর দেশি মাছ পুষ্টির আধার। বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশি এ মাছগুলোতে আছে প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, লৌহ ও আয়োডিনের মতো খনিজ উপাদান এবং ভিটামিন। তাছাড়া দেশি মাছের আছে অন্ধত্ব, রক্তশূন্যতা, গলগ- প্রতিরোধ ক্ষমতা। বিশেষকরে গর্ভবতী মা ও শিশুদের ছোট ছোট মাছ খাওয়া ভীষণ প্রয়োজন। দেশি মাছের এসব পুষ্টিগুণ আমিষের নিরাপত্তা গড়ে তুলতে অতুলনীয়। এ কারণেই দেশি মাছ সংরক্ষণ ও চাষ করা দরকার। অতিমূল্যবান এ দেশি মাছ রক্ষা করতে হলে মাছগুলোকে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চাষের আওতায় আনতে হবে। বদ্ধ জলাশয়ে দেশি প্রজাতির মাছ যাতে বেশি পাওয়া যায় সেজন্য বেশ কিছু কৌশল অবলম্বন করা যেতে পারে। সেগুলো হলো ধান ক্ষেতে ছোট প্রজাতির মাছ চাষের ব্যবস্থা করা এবং এ ধরনের মাছ সারা বছর পাওয়ার জন্য ধানক্ষেতে মিনি পুকুর তৈরি; অপরিকল্পিত বালাইনাশক ব্যবহার না করা, মাছের প্রজনন মৌসুমে মাছ না ধরা, কারেন্ট জাল, চায়না দুয়ারি ও ফাঁস জাল ব্যবহার না করা, রাক্ষুসে মাছ কমানোর জন্য পুকুরে বা প্রাকৃতিক জলাশয়ে বিষ প্রয়োগ না করা, রুই জাতীয় মাছের সাথে ছোট প্রজাতির মাছের মিশ্র চাষ, জলাশয় প্লাবনভূমি এবং পুকুরে দেশি মাছের চাষাবাদের জন্য সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা।
মাছের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক জীবন-জীবিকার ও বেঁচে থাকার। অতীতকাল থেকেই এ দেশ ছিল মাছের ভা-ার। প্রাণিজ আমিষের অন্যতম উৎস হলো মাছ। গ্রাম থেকে শহর পর্যন্ত পুষ্টি চাহিদার একটি বড় অংশই পূরণ হয় মাছ থেকে। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রাণিজ আমিষের শতকরা ৬২.৭ ভাগ আসে মাছ থেকে। এক তথ্যে জানা যায়, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পর সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে চাষের মাছের উৎপাদন ছিল মাত্র ৬৮ হাজার টন; কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় সরকারের মৎস্য অধিদপ্তর ও বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটসহ সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় বিশাল সম্ভাবনাময় জলসম্পদ সমৃদ্ধ বাংলাদেশে ২০২৩-২৪ সালে মোট ৫০.১৮ লাখ মেট্রিক টন মাছ উৎপাদন হয়েছে। যেখানে অভ্যন্তরীণ উন্মুক্ত জলাশয় (কৃষি) মোট মাছ উৎপাদনে ২৮.১৩% (১৪.১২ লাখ মেট্রিক টন) এবং অভ্যন্তরীণ বদ্ধ জলাশয় (কৃষি) ৫৯.৩৪% (২৯.৭৮ লাখ মেট্রিক টন) অবদান রাখে।
সুতরাং, মোট মাছ উৎপাদনের ৮৭.৪৭% আসে অভ্যন্তরীণ মৎস্য চাষ থেকে। অভ্যন্তরীণ মৎস্য আহরণ এবং অভ্যন্তরীণ চাষের মৎস্য আহরণের বৃদ্ধির হার যথাক্রমে ২.০৬% এবং ৪.৪২%। অন্যদিকে সামুদ্রিক মৎস্য উৎপাদন ৬.২৯ লক্ষ মেট্রিক টন এবং মোট মৎস্য উৎপাদনে এর অবদান ১২.৫৩%, বৃদ্ধির হার ৭.৪৭%। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ে মাছ আহরণে তৃতীয় এবং বদ্ধ জলাশয়ে চাষের মাছ উৎপাদনে বিশ্বে পঞ্চম স্থানে রয়েছে। তেলাপিয়া উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে চতুর্থ এবং এশিয়ায় তৃতীয় স্থানে রয়েছে। ক্রাস্টাসিয়ান্স আহরণে বিশ্বে ৮ম এবং কোস্টাল ও সামুদ্রিক মাছ আহরণে ১৪ তম স্থান অর্জন করেছে। এছাড়া বিশ্বের ১১টি ইলিশ উৎপাদনকারী দেশের মধ্যে বাংলাদেশ প্রথম স্থানে রয়েছে।
দেশে বদ্ধ জলাশয়ে মাছ চাষ জনপ্রিয় হয়ে উঠলেও মুক্ত জলাশয়ে এখনো বহু প্রজাতির মাছ বিদ্যমান এবং এসব মাছ যথামাত্রায় বৃদ্ধির জন্য উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে; যাতে মা মাছ সারা বছর প্রতিটি মৎস্য বিচরণ ক্ষেত্রের অভয়াশ্রমে অবস্থান করতে পারে।
[লেখক : গণযোগাযোগ কর্মকর্তা, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ তথ্য দপ্তর]