হোসেন আবদুল মান্নান
ছয় বছরের বিরতির পর ১৯৭৯ এবং ১৯৮০ সালে পরপর দুটো ডাকসু নির্বাচন হওয়ার মধ্য দিয়ে ক্যাম্পাসে ছাত্র সংসদের কার্যক্রম চালু হয়েছিল।
বলা যায়, বন্ধ গাড়ির চাকা সড়কে ওঠার মতো। তবে দুটো নির্বাচনেই একই ব্যক্তিদ্বয় সহ-সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। তারা যথাক্রমে মাহমুদুর রহমান মান্না ও আখতারউজ্জামান। তারা প্রথমবার জাসদ ছাত্রলীগের হয়ে নির্বাচন করেছিলেন। দ্বিতীয়বারের নির্বাচনের সময় দুজনই বাসদের আশীর্বাদপুষ্ট প্রার্থী ছিলেন। প্রসঙ্গত, জাসদ ভেঙে বাসদের জন্ম হয় ১৯৮০ সালের ৭ নভেম্বর। মূলত ১৯৭৫ সালের পরে জাতীয় রাজনীতিতে জাসদ, বাসদের তারুণ্যের অভাবনীয় প্রভাবই এমন ফলাফল এনে দেয়। একই সঙ্গে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আসা মান্না’র বাগ্মিতা ছিল পেছনের প্রধান চালিকা শক্তি।
১৯৮১ সালের ডাকসু নির্বাচনটি অনুষ্ঠিত হয় ২৩ জানুয়ারি ১৯৮২ সালে। ’৮০ সালের শেষ দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার কারণে পূর্ববর্তী নির্বাচন দুটো স্বচক্ষে দেখিনি। তবে বিভিন্ন প্যানেল নিয়ে মতবিরোধ, মতদ্বৈধতার গল্প শুনেছি নানা সময়ে নানা জনের কাছ থেকে।
২.
১৯৮২ সালের জানুয়ারি মাসের নির্বাচনে মুহসীন হলের অনাবাসিক ছাত্র হিসেবে হল সংসদ ও ডাকসুতে ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছিলাম। ভোটার লিস্ট এবং ব্যালট পেপার উভয়ই হাতে এসেছিল। দিনভর আনন্দঘন পরিবেশের মধ্যে নির্বাচন হয়েছিল। হল থেকে একাধিকবার কলা ভবনে গিয়ে নির্বাচনী উৎসব ও কোলাহলমুখরতা উপভোগ করেছিলাম। কোনো সন্ত্রাস, সংঘাতের কথা মনে পড়ে না। বড় কোন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছিল বলেও জানি না। এমনকি রাষ্ট্রীয় প্রভাবের গল্পও শুনিনি। শান্তি ও সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশ বলতে যা বোঝায় তা-ই বিদ্যমান ছিল। বলাবাহুল্য, গোপন ব্যালটে কাউকে সমর্থন করে ভোট দেওয়ার অভিজ্ঞতা বলতে সে-ই ছিল প্রথম। সন্ধ্যায় ফল প্রকাশ হলে শুনেছি, পূর্বেকার দুবারের সাধারণ সম্পাদক এবং ডিপ্লোমা লাইব্রেরি সায়েন্সের ছাত্র আখতারউজ্জামান সহ-সভাপতি এবং এমএসএস ১ম পর্ব অর্থনীতির ছাত্র জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছেন। মনে পড়ে বিজয়ী নেতৃবৃন্দকে বিজিতদের পক্ষ থেকে ফুলেল শুভেচছা জানানো হয়েছিল। উল্লেখ করা যায়, নির্বাচিত ভিপি, জিএস উভয়ই যথারীতি পাশ করার পরে রাজনীতির উদ্দেশ্যে ছাত্রত্ব ধরে রাখার মানসে এসব বিভাগে ভর্তি ছিলেন। তারা তখন বাসদ ছাত্রলীগের হয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিলেন। ডাকসু’র সুদীর্ঘ ইতিহাসে তখনকার তিনটা নির্বাচনই স্মরণীয় হয়ে আছে। উল্লেখ্য, সে সময়কালে ডাকসুর সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছিলেন প্রবল ব্যক্তিবান, বরেণ্য শিক্ষাবিদ উপাচার্য অধ্যাপক ফজলুল হালিম চৌধুরী। তিনি দীর্ঘ সময় ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের (১৯৭৬-৮৩ সাল) দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
৩.
জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে ডাকসুর নির্বাচন সম্পন্ন হলো। পরবর্তীতে ১৬ মার্চ ১৯৮২ সালে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ একটা অভিষেক অনুষ্ঠানের আয়োজন করলেন। জিমনেসিয়ামসংলগ্ন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠে ভ্যেনু করা হলো। এই ঐতিহ্যবাহী ও গুরুগম্ভীর আয়োজনের প্রধান অতিথি ছিলেন বিচারপতি আবদুর রহমান চৌধুরী। যিনি ১৯৪৮ সালের ১৫ মার্চের রাষ্ট্র ভাষা আন্দোলনের অন্যতম প্রধান ছাত্রনেতা ছিলেন। তিনি সলিমুল্লাহ মুসলিম হল ছাত্র সংসদের তৎকালীন সহ-সভাপতি হিসেবে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। নব-নির্বাচিত ডাকসু নেতাদের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তরের সেই অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন অধ্যাপক ফজলুল হালিম চৌধুরী। অনুষ্ঠানে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। বিদায়ী ভিপি মাহমুদুর রহমান মান্না এবং নির্বাচিত ভিপি আখতারউজ্জামান ও জিএস জিয়াউদ্দিন বাবলু বক্তব্য রাখেন।
৪.
সেদিনের অভিষেক অনুষ্ঠানে টানা দুবার নির্বাচিত হওয়া ডাকসুর বিদায়ী সহ-সভাপতি হিসেবে মাহমুদুর রহমান মান্না তার সাড়ে তিন পৃষ্ঠার দীর্ঘ ভাষণ থেকে অংশবিশেষ তুলে ধরা হলো।
“দেশে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতির দরুণ গুম-খুন বেড়েই চলেছে। শিক্ষাঙ্গনেও চলছে সন্ত্রাস। স্বৈরতান্ত্রিক শক্তিসমূহ তাদের অশুভ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার মানসে সন্ত্রাসবাদকে লালন করছে। এ ব্যাপারে পুলিশ অসহায়।”
৫.
অভিষেক অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি হিসেবে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি আবদুর রহমান চৌধুরী সেদিন যে বক্তব্য দিয়েছিলেন তা আজও প্রাসঙ্গিক এবং সত্য বলে প্রতীয়মান হয়। তিনি বলেছিলেন,
“বিচার নিজের হাতে তুলে নেয়া, লোক পিটিয়ে মারা, চোখ তুলে নেওয়া ইত্যাদি ঘটনাগুলো বিচ্ছিন্ন হলেও এগুলো আসলে সেই ভয়াবহ ব্যাধির উপসর্গ। আর এজন্য দায়ী শৃঙ্খলাবোধের অভাব, পরমতসহিষ্ণুতার অভাব, অ্যাকাউন্টিবিলিটির অভাব এবং দুর্নীতির অবাধ প্রসার। সমাজ জীবনে আজ এমনই একটা অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে যে, যার যত ক্ষতি করার ক্ষমতা তার প্রভাব-প্রতিপত্তি তত বেশি। সমাজে যারা সৎ এবং ভালো মানুষ তারা বড্ড অসহায় কাল কাটাতে বাধ্য হচ্ছে। ধীরে ধীরে ভালো মানুষগুলো জনজীবন থেকে নিজেদেরকে গুটিয়ে নিচ্ছেন। আজকের অপরাধীদের মধ্যে শতকরা ৭৫ ভাগই তরুণ এবং এরা আমার আপনার পরিবারেরই ছেলে। জাতির মেরুদ- যে তরুণরা তারাই যদি ধ্বংস হয়ে গেল তবে এদেশের ভবিষ্যৎ কী?”
তিনি আরও বলেছিলেন, “আইনের শাসনই গণতন্ত্রের একমাত্র রক্ষা কবচ। আইনের শাসনের অভাবে ডেমক্রেসি নেমে আসবে মবক্রেসির পর্যায়ে, যা আমাদের কারও কাম্য নয়। আমাদের জনগণ স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও মৌলিক মানবাধিকারে বিশ্বাসী।”
৬.
আজও দিব্যি মনে পড়ে, এই অভিষেক অনুষ্ঠানের মাত্র আট দিন পরে অর্থাৎ ২৪ মার্চ ’৮২ দিবাগত রাতে জাতির উদ্দেশ্যে আকস্মিক এক ভাষণ দেন তৎকালীন সেনাপ্রধান হুসেন মুহাম্মদ এরশাদ। তিনি তার ভাষণে বিচারপতি আবদুর রহমান চৌধুরীর এই বক্তব্যকে উদ্বৃত করে দেশে সামরিক শাসন জারি করেছিলেন। এবং যা নামে-বেনামে দীর্ঘ ৯ বছর বহাল ছিল।
এবারের ডাকসুসহ দেশের অপরাপর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আসন্ন ছাত্র সংসদ নির্বাচন অবাধ, নিরপেক্ষ ও সন্ত্রাসমুক্ত হোক। এর মাধ্যমেই দেশের ভেতরে আগামীর সঠিক নেতৃত্ব উঠে আসুক। দেশের ছাত্র রাজনীতিতে ফিরে আসুক অতীত ঐতিহ্যের শোভন ও ছন্দময় সেই সময়। ফিরে আসুক গণতন্ত্র, পরমতসহিষ্ণুতা এবং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের জীবনবোধ। সবার উপরে দেশ হোক।
[লেখক: অবসরপ্রাপ্ত সচিব]
হোসেন আবদুল মান্নান
বৃহস্পতিবার, ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫
ছয় বছরের বিরতির পর ১৯৭৯ এবং ১৯৮০ সালে পরপর দুটো ডাকসু নির্বাচন হওয়ার মধ্য দিয়ে ক্যাম্পাসে ছাত্র সংসদের কার্যক্রম চালু হয়েছিল।
বলা যায়, বন্ধ গাড়ির চাকা সড়কে ওঠার মতো। তবে দুটো নির্বাচনেই একই ব্যক্তিদ্বয় সহ-সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। তারা যথাক্রমে মাহমুদুর রহমান মান্না ও আখতারউজ্জামান। তারা প্রথমবার জাসদ ছাত্রলীগের হয়ে নির্বাচন করেছিলেন। দ্বিতীয়বারের নির্বাচনের সময় দুজনই বাসদের আশীর্বাদপুষ্ট প্রার্থী ছিলেন। প্রসঙ্গত, জাসদ ভেঙে বাসদের জন্ম হয় ১৯৮০ সালের ৭ নভেম্বর। মূলত ১৯৭৫ সালের পরে জাতীয় রাজনীতিতে জাসদ, বাসদের তারুণ্যের অভাবনীয় প্রভাবই এমন ফলাফল এনে দেয়। একই সঙ্গে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আসা মান্না’র বাগ্মিতা ছিল পেছনের প্রধান চালিকা শক্তি।
১৯৮১ সালের ডাকসু নির্বাচনটি অনুষ্ঠিত হয় ২৩ জানুয়ারি ১৯৮২ সালে। ’৮০ সালের শেষ দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার কারণে পূর্ববর্তী নির্বাচন দুটো স্বচক্ষে দেখিনি। তবে বিভিন্ন প্যানেল নিয়ে মতবিরোধ, মতদ্বৈধতার গল্প শুনেছি নানা সময়ে নানা জনের কাছ থেকে।
২.
১৯৮২ সালের জানুয়ারি মাসের নির্বাচনে মুহসীন হলের অনাবাসিক ছাত্র হিসেবে হল সংসদ ও ডাকসুতে ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছিলাম। ভোটার লিস্ট এবং ব্যালট পেপার উভয়ই হাতে এসেছিল। দিনভর আনন্দঘন পরিবেশের মধ্যে নির্বাচন হয়েছিল। হল থেকে একাধিকবার কলা ভবনে গিয়ে নির্বাচনী উৎসব ও কোলাহলমুখরতা উপভোগ করেছিলাম। কোনো সন্ত্রাস, সংঘাতের কথা মনে পড়ে না। বড় কোন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছিল বলেও জানি না। এমনকি রাষ্ট্রীয় প্রভাবের গল্পও শুনিনি। শান্তি ও সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশ বলতে যা বোঝায় তা-ই বিদ্যমান ছিল। বলাবাহুল্য, গোপন ব্যালটে কাউকে সমর্থন করে ভোট দেওয়ার অভিজ্ঞতা বলতে সে-ই ছিল প্রথম। সন্ধ্যায় ফল প্রকাশ হলে শুনেছি, পূর্বেকার দুবারের সাধারণ সম্পাদক এবং ডিপ্লোমা লাইব্রেরি সায়েন্সের ছাত্র আখতারউজ্জামান সহ-সভাপতি এবং এমএসএস ১ম পর্ব অর্থনীতির ছাত্র জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছেন। মনে পড়ে বিজয়ী নেতৃবৃন্দকে বিজিতদের পক্ষ থেকে ফুলেল শুভেচছা জানানো হয়েছিল। উল্লেখ করা যায়, নির্বাচিত ভিপি, জিএস উভয়ই যথারীতি পাশ করার পরে রাজনীতির উদ্দেশ্যে ছাত্রত্ব ধরে রাখার মানসে এসব বিভাগে ভর্তি ছিলেন। তারা তখন বাসদ ছাত্রলীগের হয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিলেন। ডাকসু’র সুদীর্ঘ ইতিহাসে তখনকার তিনটা নির্বাচনই স্মরণীয় হয়ে আছে। উল্লেখ্য, সে সময়কালে ডাকসুর সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছিলেন প্রবল ব্যক্তিবান, বরেণ্য শিক্ষাবিদ উপাচার্য অধ্যাপক ফজলুল হালিম চৌধুরী। তিনি দীর্ঘ সময় ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের (১৯৭৬-৮৩ সাল) দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
৩.
জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে ডাকসুর নির্বাচন সম্পন্ন হলো। পরবর্তীতে ১৬ মার্চ ১৯৮২ সালে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ একটা অভিষেক অনুষ্ঠানের আয়োজন করলেন। জিমনেসিয়ামসংলগ্ন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠে ভ্যেনু করা হলো। এই ঐতিহ্যবাহী ও গুরুগম্ভীর আয়োজনের প্রধান অতিথি ছিলেন বিচারপতি আবদুর রহমান চৌধুরী। যিনি ১৯৪৮ সালের ১৫ মার্চের রাষ্ট্র ভাষা আন্দোলনের অন্যতম প্রধান ছাত্রনেতা ছিলেন। তিনি সলিমুল্লাহ মুসলিম হল ছাত্র সংসদের তৎকালীন সহ-সভাপতি হিসেবে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। নব-নির্বাচিত ডাকসু নেতাদের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তরের সেই অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন অধ্যাপক ফজলুল হালিম চৌধুরী। অনুষ্ঠানে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। বিদায়ী ভিপি মাহমুদুর রহমান মান্না এবং নির্বাচিত ভিপি আখতারউজ্জামান ও জিএস জিয়াউদ্দিন বাবলু বক্তব্য রাখেন।
৪.
সেদিনের অভিষেক অনুষ্ঠানে টানা দুবার নির্বাচিত হওয়া ডাকসুর বিদায়ী সহ-সভাপতি হিসেবে মাহমুদুর রহমান মান্না তার সাড়ে তিন পৃষ্ঠার দীর্ঘ ভাষণ থেকে অংশবিশেষ তুলে ধরা হলো।
“দেশে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতির দরুণ গুম-খুন বেড়েই চলেছে। শিক্ষাঙ্গনেও চলছে সন্ত্রাস। স্বৈরতান্ত্রিক শক্তিসমূহ তাদের অশুভ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার মানসে সন্ত্রাসবাদকে লালন করছে। এ ব্যাপারে পুলিশ অসহায়।”
৫.
অভিষেক অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি হিসেবে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি আবদুর রহমান চৌধুরী সেদিন যে বক্তব্য দিয়েছিলেন তা আজও প্রাসঙ্গিক এবং সত্য বলে প্রতীয়মান হয়। তিনি বলেছিলেন,
“বিচার নিজের হাতে তুলে নেয়া, লোক পিটিয়ে মারা, চোখ তুলে নেওয়া ইত্যাদি ঘটনাগুলো বিচ্ছিন্ন হলেও এগুলো আসলে সেই ভয়াবহ ব্যাধির উপসর্গ। আর এজন্য দায়ী শৃঙ্খলাবোধের অভাব, পরমতসহিষ্ণুতার অভাব, অ্যাকাউন্টিবিলিটির অভাব এবং দুর্নীতির অবাধ প্রসার। সমাজ জীবনে আজ এমনই একটা অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে যে, যার যত ক্ষতি করার ক্ষমতা তার প্রভাব-প্রতিপত্তি তত বেশি। সমাজে যারা সৎ এবং ভালো মানুষ তারা বড্ড অসহায় কাল কাটাতে বাধ্য হচ্ছে। ধীরে ধীরে ভালো মানুষগুলো জনজীবন থেকে নিজেদেরকে গুটিয়ে নিচ্ছেন। আজকের অপরাধীদের মধ্যে শতকরা ৭৫ ভাগই তরুণ এবং এরা আমার আপনার পরিবারেরই ছেলে। জাতির মেরুদ- যে তরুণরা তারাই যদি ধ্বংস হয়ে গেল তবে এদেশের ভবিষ্যৎ কী?”
তিনি আরও বলেছিলেন, “আইনের শাসনই গণতন্ত্রের একমাত্র রক্ষা কবচ। আইনের শাসনের অভাবে ডেমক্রেসি নেমে আসবে মবক্রেসির পর্যায়ে, যা আমাদের কারও কাম্য নয়। আমাদের জনগণ স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও মৌলিক মানবাধিকারে বিশ্বাসী।”
৬.
আজও দিব্যি মনে পড়ে, এই অভিষেক অনুষ্ঠানের মাত্র আট দিন পরে অর্থাৎ ২৪ মার্চ ’৮২ দিবাগত রাতে জাতির উদ্দেশ্যে আকস্মিক এক ভাষণ দেন তৎকালীন সেনাপ্রধান হুসেন মুহাম্মদ এরশাদ। তিনি তার ভাষণে বিচারপতি আবদুর রহমান চৌধুরীর এই বক্তব্যকে উদ্বৃত করে দেশে সামরিক শাসন জারি করেছিলেন। এবং যা নামে-বেনামে দীর্ঘ ৯ বছর বহাল ছিল।
এবারের ডাকসুসহ দেশের অপরাপর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আসন্ন ছাত্র সংসদ নির্বাচন অবাধ, নিরপেক্ষ ও সন্ত্রাসমুক্ত হোক। এর মাধ্যমেই দেশের ভেতরে আগামীর সঠিক নেতৃত্ব উঠে আসুক। দেশের ছাত্র রাজনীতিতে ফিরে আসুক অতীত ঐতিহ্যের শোভন ও ছন্দময় সেই সময়। ফিরে আসুক গণতন্ত্র, পরমতসহিষ্ণুতা এবং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের জীবনবোধ। সবার উপরে দেশ হোক।
[লেখক: অবসরপ্রাপ্ত সচিব]