আনোয়ারুল হক
দেশের ছাত্ররাজনীতির সব থেকে বড় নির্বাচনী আয়োজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু)-এর নির্বাচন আগামী ৯ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত হবে। ২০২৪-এর ছাত্র-গনঅভ্যুত্থানের পরে একটি বছর পার হয়ে গেছে। এই এক বছরে আশা ও হতাশা দুটোই পাশাপাশি হেঁটে চলেছে। এবং সেই পটভূমিতে অভ্যুত্থানের পরে প্রথম ডাকসু নির্বাচন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে সমর্থন করে মানুষ স্বপ্ন দেখেছিল আন্দোলন বিজয়ী হলে সমাজ থেকে বৈষম্য দুর্বল হবে আর সমতা শক্তিশালী হবে, স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশ করা যাবে। বহুত্ববাদের ওপর ভিত্তি করে নতুন পথযাত্রায় নারী-পুরুষ, ভিন্ন-ভিন্ন ধর্মের মানুষ, বিশ্বাসী, অবিশ্বাসী সবাই পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ বজায় রেখে সমঅধিকার ভোগ করবেন। বিরোধীদের, ভিন্নমতের মানুষদের কথা বলার স্বাধীনতা থাকবে। আশা জেগেছিল দেশ ইনসাফের পথে অগ্রসর হবে।
আর হতাশার সবচেয়ে বড় দিক হলো অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী ছাত্র তরুণরা নতুন রাজনীতির স্বপ্ন দেখালেও আজ তারা পতিত স্বৈরাচারের ভাষায়ই কথা বলছেন। নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করলেও প্রচলিত রাজনৈতিক সংস্কৃতি থেকে তারা বেরিয়ে আসতে পারলেন না। উগ্রতা, প্রতিহিংসা আর ঘৃণার রাজনীতিতেই তারা আচ্ছন্ন হয়ে আছেন। হতাশার আরেকটি বড় দিক হলো দেশের বুকে এক উগ্রবাদী দক্ষিণপন্থার উত্থান। উত্থান হয়েছে বাংলাদেশের জন্মযুদ্ধের বিরোধী রাজনৈতিক শক্তির। এসকল শক্তি স্বৈরাচার পতনের পরে গণতন্ত্রে উত্তরণ এবং দেশের গনতান্ত্রিক পূনর্গঠনের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। হতাশার আরো একটি দিক, আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিতে দেশের রাজনীতিতে একচেটিয়া আধিপত্য যে রাজনৈতিক দলের, এক যুগেরও বেশি সময় যারা তীব্র দমননীতি মোকাবেলা করে রাজপথ কাঁপিয়েছেন তারাও দখলদারিত্বের পুরনো রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসতে পারলেন না।
ডাকসু নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ছাত্রদের মধ্যে একটা প্রধান আকাক্সক্ষা, ছাত্র নেতৃত্ব সংকীর্ণ দলবাজি না করে ক্যাম্পাসকেন্দ্রিক এবং ছাত্র জীবনের সমস্যা সমাধান কেন্দ্রিক সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা করবে। গনণমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা আর বিকশিত জীবন গড়ার পাঠশালা হিসেবে ভূমিকা রাখবে। আর যে কতৃত্ববাদের হাত থেকে তারা মুক্ত হয়েছেন, বিশ্ববিদ্যালয় ও হল জীবনে আবার নতুন করে যেন কোনো কতৃত্ববাদ চেপে না বসে। সম্ভবত ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনে এ বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে ছাত্র-ছাত্রীরা তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন। গণঅভ্যুত্থানের আকাক্সক্ষার বিপরীতে গত এক বছরে নারী স্বাধীনতার উপর যে ক্রমাগত আক্রমণ চলছে ভোটাধিকার প্রয়োগের ক্ষেত্রে তা ছাত্রছাত্রীদের মাঝে বিশেষ করে ছাত্রী ভোটে বিশেষ প্রভাব ফেলবে। তেমনি বাউল, মাজার, মন্দির, ধর্মীয় সংখ্যালঘু এবং ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীসহ ভিন্ন মতবাদের মানুষের ওপর আক্রমণও ছাত্রদের একটা অংশের মধ্যে প্রভাব ফেলবে। আবার দীর্ঘদিন যাবৎ নানা কৌশলে এমনকি পূর্বতন শাসকদলের ছাত্র সংগঠনের মধ্যে আশ্রয় নিয়ে যে সাম্প্রদায়িক ও ধর্মীয় রাজনীতির চাষাবাদ হয়েছে, অন্যদিকে ক্ষমতার পালাবদলের পর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনেও তাদের আধিপত্য সৃষ্টি হয়েছে- তার একটা প্রভাবও থাকবে।
সাধারণভাবে ধারণা করা যায় যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো ছাত্র সংগঠনেরই শুধুমাত্র সংগঠন শক্তি বা এককভাবে ছাত্র সমর্থনের জোরে নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার মতো অবস্থা নেই। এবারের নির্বাচনের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো প্রধান প্রধান ছাত্র সংগঠনের নামের পরিচিতির চেয়ে বৈচিত্র্যময় প্রার্থী সমন্বয়ে প্যানেলের বিভিন্ন নাম। এমনকি অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের সমর্থনপুষ্ট এনসিপি দলের ছাত্র সংগঠন গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ বা ছাত্র লীগের অভ্যন্তরে পতিত সরকারের সুযোগ সুবিধা নিয়ে লুকিয়ে থাকা ও শক্তিশালী হয়ে ওঠা ছাত্র শিবির কিংবা বামপন্থী ছাত্র সংগঠন সমূহ স্ব স্ব নামে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করে প্যানেলের নামে নির্বাচন করছে। এটা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, সংগঠনের কর্মী- সমর্থকদের কাছে ছাড়া দলীয় পরিচয় সাধারণ ছাত্রদের কাছে খুব বেশি গুরুত্ব বহন করছে না।
লক্ষ্যায করার বিষয় একটা দীর্ঘ সময়ের পর অনুষ্ঠেয় এ নির্বাচনে কোনো ছাত্র সংগঠন বা কোনো কেন্দ্রীয় প্যাযানেলই হল সংসদগুলোতে সব আসনে প্রার্থী দিতে সক্ষম হয়নি বা নির্বাচনী কৌশলগত কারণে দেয়নি। প্রার্থী তালিকায় বৈচিত্র্য, ভিন্ন ধরনের প্রচারণা কৌশল এবং শিক্ষার্থীদের নতুন দৃষ্টিভঙ্গি এই নির্বাচনকে বিশেষ তাৎপর্য দিয়েছে। দলীয় রাজনীতির বাইরে থেকে স্বতন্ত্র হিসেবে যারা নির্বাচন করছেন, তাদেরও কিন্তু ক্যাম্পাসভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গি যেমন আছে তেমনি জাতীয় ভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং রাজনৈতিক মতামতও আছে।
তাই শেষ বিচারে ডাকসু নির্বাচন একটি রাজনৈতিক লড়াই। সেক্ষেত্রে খুবই দুঃখজনক বিষয় হলো এ লড়াইয়ে সকল বামপন্থী ছাত্র সংগঠন এক প্যানেলে নির্বাচন করছেন না। যা বামমনষ্ক ও সাধারণ ছাত্রদের একাংশকেই শুধু নয়, সকল প্রগতিবাদী শক্তিকে হতাশ করেছে। ডাকসু নির্বাচনে বামপন্থীদের বিভক্তির প্রভাব অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাচনগুলোতেও পড়েছে। অথচ ঘাড়ের উপর যখন নিঃশ্বাস ফেলছে ধর্মীয় ফ্যাসিবাদ তখন এ ধরনের রাজনৈতিক লড়াইয়ে বামপন্থী ও প্রগতিবাদীদেরতো, বটেই একই সাথে উদার গণতন্ত্রীমনাদের যৌথ প্রতিরোধ গড়ে তোলা ‘ফরজ কাজের’ মধ্যে পড়ে।
ধর্মান্ধ উগ্রবাদী গোষ্ঠী ডাকসু ভোটের ময়দানে একটা লিবারেল চেহারা দেখানোর কৌশলী প্রচেষ্টা নিলেও নানাভাবেই তাদের উগ্র এবং নারী বিদ্বেষী চেহারা প্রকাশ হয়ে পড়ছে। তাদের সাথে রাজনৈতিক ও আইনি বিতর্কে জড়িয়ে পড়া ছাত্রী প্রতিদ্বন্দ্বীকে গণধর্ষনের হুমকি দিয়ে তারা তাদের পূর্বসূরীদের ১৯৭১ সালের চেহারাকে আবার মনে করিয়ে দিলো। বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহে বিগত ৫৪ বছরে অনেক অঘটনই ঘটেছে। কিন্তু এভাবে প্রকাশ্যে গণধর্ষনের হুমকি দেওয়ার ঔদ্ধত্য দেখাতে কেউ সাহস করেনি। শিবির নেতারা ঘোষণা করছেন জয়লাভ করলে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘কালচারাল ফ্যাসীবাদ’ উৎখাত করবেন। কারো বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে, এই ধর্মীয় ফ্যাসিবাদীদের তূণের সব কটি তীরের লক্ষ্যবস্তু কথিত ‘কালচারাল ফ্যাসিবাদ’- এর নামে মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ ও সংস্কৃতির দিকেই। ’৭১-এর পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে তারা মরিয়া। কিন্তু এ কথা ভুলে গেলে চলবে না, মুক্তিযুদ্ধ এবং এর সাংস্কৃতিক ভাবাদর্শ আমাদের স্বাধীন সত্তার অংশ। তা রক্ষা করে বহুত্ববাদী ও অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতান্ত্রিক পূনর্গঠনের প্রয়োজনে ‘২৪-কে ‘৭১-এর মুখোমুখি দাঁড় করানোর উগ্রবাদী শক্তিকে রুখে দাঁড়ানো ছাড়া ভিন্ন কোনো পথ নেই।
অথচ এ সকল অপশক্তি এবং পুরানো দখলদারিত্ব কায়েমের স্বপ্ন দেখা গোষ্ঠীর বিপরীতে বাম ও উদারমনষ্ক স্বতন্ত্র প্রার্থীদের এবং ‘অপরাজেয় ৭১, জাগ্রত ২৪কে সাথে নিয়ে ‘ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ পর্ষদ’ গড়ে তোলার আকাক্সক্ষা সফল হয়নি। ভোটের বাকি আছে আর মাত্র কদিন। তবে খেলা ঘুরানোর জন্য এটা কম সময় নয়। এ ধরনের আলোচনায় যদি-কিন্তুর স্থান নেই। তবুও মতামত বিনিময়ের প্রয়োজনে ৫ আগস্টের পরের কয়েকটা দিন আমরা একটু ভিন্নভাবে কল্পনা করি। কার্যত সরকারবিহীন ঐ কটা দিন যদি সামরিক বাহিনী ও আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী অন্যান্য বাহিনী দৃঢ় অবস্থান নিয়ে বলতো- ছাত্র-জনতার আকাক্সক্ষা অনুযায়ী স্বৈরশাসকের পতন সম্পন্ন হয়েছে; এখন গণতান্ত্রিক পূনর্গঠনের প্রয়োজনে কোনো ধরনের অরাজকতা বরদাস্ত করা হবে না। জাতীয় পতাকা ও জাতীয় সংগীত নিয়ে অবমাননাকর মন্তব্যকারীদের, ধর্মীয় সংখ্যালঘু গোষ্ঠী এবং মন্দির, মাজারে হামলাকারীদের আইনের আওতায় আনা হবে, মব হামলা ও সহিংসতা নয়, সকল অপরাধের বিচার আইনানুগভাবে সম্পন্ন হবে। তাহলে পরিস্থিতি ভিন্ন হতে পারতো। আজ ‘দক্ষিণপন্থার যে উগ্রমূর্তি’ দেখে বিএনপি বিচলিত বোধ করছে, ৫ আগস্ট পরবর্তী কয়েকটা দিন দখলদারিত্বে ব্যস্ত না থেকে এবং উগ্রপন্থাকে বাতাস না দিয়ে বরং উগ্রবাদীদের সম্ভবমত রাজনৈতিকভাবে বিচ্ছিন্ন করে দিলে পরিস্থিতি ভিন্ন থাকতে পারতো। কিন্তু তা না ঘটায়, ৫ আগস্ট পরবর্তী ৩/৪ দিনেই খেলা কিন্তু উগ্রপন্থার অনুকূলে ঘুরে যায়।
তাই বলছিলাম, ৩/৪ দিনেই খেলা ঘুরানো সম্ভব। নেতিবাচক ও প্রতিক্রিয়াশীল ধারায় খেলা ঘোরানো সম্ভব হলে ইতিবাচক ও প্রগতিশীল ধারায় কেনো খেলা ঘোরানো সম্ভব হবে না? বামপন্থীরা নানা প্যানেলে বিভক্ত না থেকে ঐক্য ও সমঝোতার নতুন কোনো সূত্র উদ্ভাবন করতে পারলে সোশ্যাল মিডিয়ার প্রচারের এই যুগে এই স্বল্প সময়েই খেলা ঘুরানো সম্ভব। বিড়ালের গলায় ঘন্টা বাঁধার জন্য কি কেউ নেই?
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
[লেখক: সাবেক ছাত্র নেতা]
আনোয়ারুল হক
শুক্রবার, ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫
দেশের ছাত্ররাজনীতির সব থেকে বড় নির্বাচনী আয়োজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু)-এর নির্বাচন আগামী ৯ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত হবে। ২০২৪-এর ছাত্র-গনঅভ্যুত্থানের পরে একটি বছর পার হয়ে গেছে। এই এক বছরে আশা ও হতাশা দুটোই পাশাপাশি হেঁটে চলেছে। এবং সেই পটভূমিতে অভ্যুত্থানের পরে প্রথম ডাকসু নির্বাচন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে সমর্থন করে মানুষ স্বপ্ন দেখেছিল আন্দোলন বিজয়ী হলে সমাজ থেকে বৈষম্য দুর্বল হবে আর সমতা শক্তিশালী হবে, স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশ করা যাবে। বহুত্ববাদের ওপর ভিত্তি করে নতুন পথযাত্রায় নারী-পুরুষ, ভিন্ন-ভিন্ন ধর্মের মানুষ, বিশ্বাসী, অবিশ্বাসী সবাই পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ বজায় রেখে সমঅধিকার ভোগ করবেন। বিরোধীদের, ভিন্নমতের মানুষদের কথা বলার স্বাধীনতা থাকবে। আশা জেগেছিল দেশ ইনসাফের পথে অগ্রসর হবে।
আর হতাশার সবচেয়ে বড় দিক হলো অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী ছাত্র তরুণরা নতুন রাজনীতির স্বপ্ন দেখালেও আজ তারা পতিত স্বৈরাচারের ভাষায়ই কথা বলছেন। নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করলেও প্রচলিত রাজনৈতিক সংস্কৃতি থেকে তারা বেরিয়ে আসতে পারলেন না। উগ্রতা, প্রতিহিংসা আর ঘৃণার রাজনীতিতেই তারা আচ্ছন্ন হয়ে আছেন। হতাশার আরেকটি বড় দিক হলো দেশের বুকে এক উগ্রবাদী দক্ষিণপন্থার উত্থান। উত্থান হয়েছে বাংলাদেশের জন্মযুদ্ধের বিরোধী রাজনৈতিক শক্তির। এসকল শক্তি স্বৈরাচার পতনের পরে গণতন্ত্রে উত্তরণ এবং দেশের গনতান্ত্রিক পূনর্গঠনের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। হতাশার আরো একটি দিক, আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিতে দেশের রাজনীতিতে একচেটিয়া আধিপত্য যে রাজনৈতিক দলের, এক যুগেরও বেশি সময় যারা তীব্র দমননীতি মোকাবেলা করে রাজপথ কাঁপিয়েছেন তারাও দখলদারিত্বের পুরনো রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসতে পারলেন না।
ডাকসু নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ছাত্রদের মধ্যে একটা প্রধান আকাক্সক্ষা, ছাত্র নেতৃত্ব সংকীর্ণ দলবাজি না করে ক্যাম্পাসকেন্দ্রিক এবং ছাত্র জীবনের সমস্যা সমাধান কেন্দ্রিক সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা করবে। গনণমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা আর বিকশিত জীবন গড়ার পাঠশালা হিসেবে ভূমিকা রাখবে। আর যে কতৃত্ববাদের হাত থেকে তারা মুক্ত হয়েছেন, বিশ্ববিদ্যালয় ও হল জীবনে আবার নতুন করে যেন কোনো কতৃত্ববাদ চেপে না বসে। সম্ভবত ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনে এ বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে ছাত্র-ছাত্রীরা তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন। গণঅভ্যুত্থানের আকাক্সক্ষার বিপরীতে গত এক বছরে নারী স্বাধীনতার উপর যে ক্রমাগত আক্রমণ চলছে ভোটাধিকার প্রয়োগের ক্ষেত্রে তা ছাত্রছাত্রীদের মাঝে বিশেষ করে ছাত্রী ভোটে বিশেষ প্রভাব ফেলবে। তেমনি বাউল, মাজার, মন্দির, ধর্মীয় সংখ্যালঘু এবং ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীসহ ভিন্ন মতবাদের মানুষের ওপর আক্রমণও ছাত্রদের একটা অংশের মধ্যে প্রভাব ফেলবে। আবার দীর্ঘদিন যাবৎ নানা কৌশলে এমনকি পূর্বতন শাসকদলের ছাত্র সংগঠনের মধ্যে আশ্রয় নিয়ে যে সাম্প্রদায়িক ও ধর্মীয় রাজনীতির চাষাবাদ হয়েছে, অন্যদিকে ক্ষমতার পালাবদলের পর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনেও তাদের আধিপত্য সৃষ্টি হয়েছে- তার একটা প্রভাবও থাকবে।
সাধারণভাবে ধারণা করা যায় যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো ছাত্র সংগঠনেরই শুধুমাত্র সংগঠন শক্তি বা এককভাবে ছাত্র সমর্থনের জোরে নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার মতো অবস্থা নেই। এবারের নির্বাচনের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো প্রধান প্রধান ছাত্র সংগঠনের নামের পরিচিতির চেয়ে বৈচিত্র্যময় প্রার্থী সমন্বয়ে প্যানেলের বিভিন্ন নাম। এমনকি অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের সমর্থনপুষ্ট এনসিপি দলের ছাত্র সংগঠন গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ বা ছাত্র লীগের অভ্যন্তরে পতিত সরকারের সুযোগ সুবিধা নিয়ে লুকিয়ে থাকা ও শক্তিশালী হয়ে ওঠা ছাত্র শিবির কিংবা বামপন্থী ছাত্র সংগঠন সমূহ স্ব স্ব নামে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করে প্যানেলের নামে নির্বাচন করছে। এটা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, সংগঠনের কর্মী- সমর্থকদের কাছে ছাড়া দলীয় পরিচয় সাধারণ ছাত্রদের কাছে খুব বেশি গুরুত্ব বহন করছে না।
লক্ষ্যায করার বিষয় একটা দীর্ঘ সময়ের পর অনুষ্ঠেয় এ নির্বাচনে কোনো ছাত্র সংগঠন বা কোনো কেন্দ্রীয় প্যাযানেলই হল সংসদগুলোতে সব আসনে প্রার্থী দিতে সক্ষম হয়নি বা নির্বাচনী কৌশলগত কারণে দেয়নি। প্রার্থী তালিকায় বৈচিত্র্য, ভিন্ন ধরনের প্রচারণা কৌশল এবং শিক্ষার্থীদের নতুন দৃষ্টিভঙ্গি এই নির্বাচনকে বিশেষ তাৎপর্য দিয়েছে। দলীয় রাজনীতির বাইরে থেকে স্বতন্ত্র হিসেবে যারা নির্বাচন করছেন, তাদেরও কিন্তু ক্যাম্পাসভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গি যেমন আছে তেমনি জাতীয় ভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং রাজনৈতিক মতামতও আছে।
তাই শেষ বিচারে ডাকসু নির্বাচন একটি রাজনৈতিক লড়াই। সেক্ষেত্রে খুবই দুঃখজনক বিষয় হলো এ লড়াইয়ে সকল বামপন্থী ছাত্র সংগঠন এক প্যানেলে নির্বাচন করছেন না। যা বামমনষ্ক ও সাধারণ ছাত্রদের একাংশকেই শুধু নয়, সকল প্রগতিবাদী শক্তিকে হতাশ করেছে। ডাকসু নির্বাচনে বামপন্থীদের বিভক্তির প্রভাব অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাচনগুলোতেও পড়েছে। অথচ ঘাড়ের উপর যখন নিঃশ্বাস ফেলছে ধর্মীয় ফ্যাসিবাদ তখন এ ধরনের রাজনৈতিক লড়াইয়ে বামপন্থী ও প্রগতিবাদীদেরতো, বটেই একই সাথে উদার গণতন্ত্রীমনাদের যৌথ প্রতিরোধ গড়ে তোলা ‘ফরজ কাজের’ মধ্যে পড়ে।
ধর্মান্ধ উগ্রবাদী গোষ্ঠী ডাকসু ভোটের ময়দানে একটা লিবারেল চেহারা দেখানোর কৌশলী প্রচেষ্টা নিলেও নানাভাবেই তাদের উগ্র এবং নারী বিদ্বেষী চেহারা প্রকাশ হয়ে পড়ছে। তাদের সাথে রাজনৈতিক ও আইনি বিতর্কে জড়িয়ে পড়া ছাত্রী প্রতিদ্বন্দ্বীকে গণধর্ষনের হুমকি দিয়ে তারা তাদের পূর্বসূরীদের ১৯৭১ সালের চেহারাকে আবার মনে করিয়ে দিলো। বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহে বিগত ৫৪ বছরে অনেক অঘটনই ঘটেছে। কিন্তু এভাবে প্রকাশ্যে গণধর্ষনের হুমকি দেওয়ার ঔদ্ধত্য দেখাতে কেউ সাহস করেনি। শিবির নেতারা ঘোষণা করছেন জয়লাভ করলে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘কালচারাল ফ্যাসীবাদ’ উৎখাত করবেন। কারো বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে, এই ধর্মীয় ফ্যাসিবাদীদের তূণের সব কটি তীরের লক্ষ্যবস্তু কথিত ‘কালচারাল ফ্যাসিবাদ’- এর নামে মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ ও সংস্কৃতির দিকেই। ’৭১-এর পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে তারা মরিয়া। কিন্তু এ কথা ভুলে গেলে চলবে না, মুক্তিযুদ্ধ এবং এর সাংস্কৃতিক ভাবাদর্শ আমাদের স্বাধীন সত্তার অংশ। তা রক্ষা করে বহুত্ববাদী ও অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতান্ত্রিক পূনর্গঠনের প্রয়োজনে ‘২৪-কে ‘৭১-এর মুখোমুখি দাঁড় করানোর উগ্রবাদী শক্তিকে রুখে দাঁড়ানো ছাড়া ভিন্ন কোনো পথ নেই।
অথচ এ সকল অপশক্তি এবং পুরানো দখলদারিত্ব কায়েমের স্বপ্ন দেখা গোষ্ঠীর বিপরীতে বাম ও উদারমনষ্ক স্বতন্ত্র প্রার্থীদের এবং ‘অপরাজেয় ৭১, জাগ্রত ২৪কে সাথে নিয়ে ‘ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ পর্ষদ’ গড়ে তোলার আকাক্সক্ষা সফল হয়নি। ভোটের বাকি আছে আর মাত্র কদিন। তবে খেলা ঘুরানোর জন্য এটা কম সময় নয়। এ ধরনের আলোচনায় যদি-কিন্তুর স্থান নেই। তবুও মতামত বিনিময়ের প্রয়োজনে ৫ আগস্টের পরের কয়েকটা দিন আমরা একটু ভিন্নভাবে কল্পনা করি। কার্যত সরকারবিহীন ঐ কটা দিন যদি সামরিক বাহিনী ও আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী অন্যান্য বাহিনী দৃঢ় অবস্থান নিয়ে বলতো- ছাত্র-জনতার আকাক্সক্ষা অনুযায়ী স্বৈরশাসকের পতন সম্পন্ন হয়েছে; এখন গণতান্ত্রিক পূনর্গঠনের প্রয়োজনে কোনো ধরনের অরাজকতা বরদাস্ত করা হবে না। জাতীয় পতাকা ও জাতীয় সংগীত নিয়ে অবমাননাকর মন্তব্যকারীদের, ধর্মীয় সংখ্যালঘু গোষ্ঠী এবং মন্দির, মাজারে হামলাকারীদের আইনের আওতায় আনা হবে, মব হামলা ও সহিংসতা নয়, সকল অপরাধের বিচার আইনানুগভাবে সম্পন্ন হবে। তাহলে পরিস্থিতি ভিন্ন হতে পারতো। আজ ‘দক্ষিণপন্থার যে উগ্রমূর্তি’ দেখে বিএনপি বিচলিত বোধ করছে, ৫ আগস্ট পরবর্তী কয়েকটা দিন দখলদারিত্বে ব্যস্ত না থেকে এবং উগ্রপন্থাকে বাতাস না দিয়ে বরং উগ্রবাদীদের সম্ভবমত রাজনৈতিকভাবে বিচ্ছিন্ন করে দিলে পরিস্থিতি ভিন্ন থাকতে পারতো। কিন্তু তা না ঘটায়, ৫ আগস্ট পরবর্তী ৩/৪ দিনেই খেলা কিন্তু উগ্রপন্থার অনুকূলে ঘুরে যায়।
তাই বলছিলাম, ৩/৪ দিনেই খেলা ঘুরানো সম্ভব। নেতিবাচক ও প্রতিক্রিয়াশীল ধারায় খেলা ঘোরানো সম্ভব হলে ইতিবাচক ও প্রগতিশীল ধারায় কেনো খেলা ঘোরানো সম্ভব হবে না? বামপন্থীরা নানা প্যানেলে বিভক্ত না থেকে ঐক্য ও সমঝোতার নতুন কোনো সূত্র উদ্ভাবন করতে পারলে সোশ্যাল মিডিয়ার প্রচারের এই যুগে এই স্বল্প সময়েই খেলা ঘুরানো সম্ভব। বিড়ালের গলায় ঘন্টা বাঁধার জন্য কি কেউ নেই?
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
[লেখক: সাবেক ছাত্র নেতা]