alt

opinion » post-editorial

ডায়াবেটিস রোগীর সেবা ও জনসচেতনতা

অরূপরতন চৌধুরী

সংবাদ অনলাইন রিপোর্ট : শুক্রবার, ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫

বাংলাদেশে ডায়াবেটিসের চিকিৎসা সেবায় একটি আস্থার প্রতীক ‘বাংলাদেশ ডায়াবেটিস সমিতি (বাডাস)’। প্রতিষ্ঠিত বাডাস নাম মাত্র মূল্যে ডায়াবেটিসের সঠিক চিকিৎসা সেবা প্রদানে গণমানুষের ভরসাস্থল হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। ডায়াবেটিসের আধুনিক চিকিৎসা সেবা ও গবেষণায় বাডাস দেশের সর্বত্র এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গণে অগ্রগণ্য প্রতিষ্ঠান। জনকল্যাণের মহান ব্রত নিয়ে অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে চলেছে বাডাস। জাতীয় অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ ইব্রাহিম, বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি (বাডাস) এর প্রতিষ্ঠাতা একইসাথে বাংলাদেশে ডায়াবেটিস এর চিকিৎসা সেবার ক্ষেত্রে সারা বিশে^ একজন পথিকৃত।

ডা. মোহাম্মদ ইব্রাহিম ১৯৮৯ সালের ৬ সেপ্টেম্বর আমাদের ছেড়ে পাড়ি জমিয়েছেন অনন্তের পথে। নিরব মহামারী ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে মানুষকে সচেতন করে তুলতেই বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি প্রতিষ্ঠাতার মৃত্যুবার্ষিকীর দিনটিকে (০৬ সেপ্টেম্বর) ‘ডায়াবেটিক সেবা দিবস’ হিসেবে পালন করে থাকে।

বাংলাদেশে ডায়াবেটিস বর্তমানে একটি মহামারী রোগ হিসেবে চিহ্নিত এবং এই রোগ সারা জীবনের রোগ। নিয়ন্ত্রণে থাকলে স্বাভাবিক জীবন-যাপন করা যায় কিন্তু, অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস এর জটিলতা অনেক। আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিস ফেডারেশন (আইডিএফ) এর ডায়াবেটিস এটলাস ডায়াবেটিসের বৈশি^ক প্রভাব সম্পর্কে সর্বশেষ যে পরিসংখ্যান এবং তথ্য দিয়েছে তাতে দেখা যায়- ২০২১ সালে ৫৩.৭ কোটি মানুষ (প্রতি ১০ জনে এক জন) ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ছিলেন। ২০৩০ সালের মধ্যে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ৬৪.৩ কোটিতে এবং ২০৪৫ সালে ৭৮.৩ কোটিতে পৌছানোর আশঙ্কা রয়েছে। এছাড়া- ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ২৪ কোটি মানুষ (প্রতি ২ জনে ১ জন) জানেন না, তারা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। তাদের অধিকাংশই টাইপ-২ ডায়াবেটিস আক্রান্ত। ১২ লক্ষেরও বেশি শিশু ও কিশোর (০-১৯ বছর) টাইপ-১ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। ২০২১ সালে বিশে^র ৬৭ লক্ষ মানুষ ডায়াবেটিস এর কারণে মৃত্যুবরণ করেন। ২০২১ সালে ৯৬৬ বিলিয়ন ডলার ব্যয় হয় ডায়াবেটিস এর কারণে, যা বৈশি^ক স্বাস্থ্য খাতে মোট ব্যয়ের ৯%।

একজন ডায়াবেটিক রোগী যদি তার ডায়াবেটিসের সুগার লেভেল স্বাভাবিক রাখতে চান তবে তার নিয়মিত ওষুধ (ট্যাবলেট বা ইনসুলিন) ব্যায়াম ও খাদ্য গ্রহণের ব্যাপারে যেমন শৃঙ্খলা বা নিয়মকানুন (ডাক্তারের পরামর্শ ও পথ্যবিদ এর খাদ্য তালিকা) মেনে চলবেন ঠিক তেমনভাবে তিনি কিন্তু মুখের ভিতরের অংশ যেমন দাঁত, মাড়ি ও জিহ্বার যত্ন করবেন। কারণ মুখের ভিতরের দাঁতে, মাড়িতে, জিহ্বার বা গালের কোনো অংশে প্রদাহ বা ইনফেকশন থাকলে ডায়াবেটিস রোগীদের ব্লাড সুগার বা শর্করা নিয়ন্ত্রণে থাকবে না। ভালো দাঁতের যত্ন মুখের বিভিন্ন সমস্যা প্রতিরোধ করতে পারে এবং ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করতে পারে। মুখে যখন কম লালা প্রবাহিত হয়, তখন দাঁতের রোগ, মাড়ির রোগ এবং মুখের অন্যান্য সমস্যার ঝুঁকি বেড়ে যায়। ডায়াবেটিস লালায় গ্লুকোজের পরিমাণও বাড়িয়ে দিতে পারে। রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা, যাকে ব্লাড সুগারও বলা হয়, যখন খুব বেশি হয় তখন ডায়াবেটিস অনিয়ন্ত্রিত থাকে। ডায়াবেটিস মুখের ভিতরের অনেক অংশের যেমন: দাঁত ও মাড়িতে ছাড়াও শরীরের অনেক অংশকে প্রভাবিত করে। যাদের ডায়াবেটিস আছে তাদের মাড়ির রোগ মুখ গহ্বরের বিভিন্ন অংশ এবং দাঁতের অন্যান্য সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।

নিয়মিত স্কেলিং করা এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসহ দাঁত এবং মাড়ির ভালো যত্ন নিলে এই সমস্যাগুলো প্রতিরোধ করতে বা আরও খারাপ হওয়া অবস্থা বন্ধ করতে সহায়তা করবে। মুখকে বা মুখগহ্বরকে সুস্থ রাখলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ রাখা এবং ডায়াবেটিস-সম্পর্কিত স্বাস্থ্য সমস্যা যেমন হৃদরোগ এবং কিডনি রোগ প্রতিরোধ করা অনেক সহজ হবে। ডায়বেটিস লালা পরিবর্তন করে মুখকে প্রভাবিত করতে পারে-তরল যা মুখকে ভিজা রাখে। অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসের ফলে লালা কমে গেলে মুখে ডেন্টাল ক্যারিজ, বা দন্তক্ষয় বেশি হয়। ডায়াবেটিস এবং ডায়াবেটিসের চিকিৎসার জন্য ব্যবহৃত কিছু ওষুধের কারণে মুখের লালা গ্রন্থিগুলো কম লালা তৈরি করতে পারে। যখন কম লালা প্রবাহিত হয়, তখন মুখ গহ্বর ও মাড়ির রোগ এবং মুখের অন্যান্য রোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়।

ডায়াবেটিস লালায় গ্লুকোজের পরিমাণও বাড়িয়ে দিতে পারে। যখন ডায়াবেটিস দেখা দেয় তখন রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বা ব্লাড সুগার খুব বেশি হয়। রক্তে উচ্চমাত্রার গ্লুকোজও লালায় গ্লুকোজ তৈরি করতে পারে। এই গ্লুকোজ ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়া খাবারের সঙ্গে মিলিত হয়ে প্লেক নামক নরম আঠালো ফিল্ম তৈরি করে, যা দাঁতে গর্ত বা ক্ষয় সৃষ্টি করে। যদি খাবারের আবরণ অপসারণ না হয় তবে এটি মাড়ির লাইনের কাছে দাঁতের ওপর তৈরি হতে পারে এবং টার্টার নামক শক্ত আবরণ হয়ে যেতে পারে, যা মাড়ির রোগের কারণ হতে পারে। চিকিৎসা না করা হলে মুখের এই সমস্যাগুলো থাকলে দাঁতের ও মাড়ির ক্ষতি হতে পারে। মাড়ির রোগ যাকে পিরিওডন্টাল গাম ডিজিজও বলা হয়, এটি ডায়াবেটিস সম্পর্কিত মুখের সবচেয়ে বেশি লক্ষণীয় রোগ এবং গুরুতর সমস্যা সৃষ্টিকারী রোগ। চিকিৎসা না করা হলে, রোগটি পর্যায়ক্রমে অগ্রসর হয়, মাড়ি ফোলা বা রক্ত পড়া অবস্থা থেকে দাঁত পড়ে যাওয়া পর্যন্ত। রক্তে গ্লুকোজের উচ্চ মাত্রা উপস্থিতি মাড়ির রোগ মৃদু থেকে গুরুতর হওয়ার ঝুঁকি বাড়ায়। যেমন জিনজিভাইটিস থেকে পেরিওডনটাইটিজ।

ডায়াবেটিস থেকে মুখের সমস্যাগুলো কিভাবে প্রতিরোধ এবং চিকিৎসা করা যায় সে সম্পর্কে দাঁতের ডাক্তারের বা ডেন্টাল সার্জনের পরামর্শ মেনে চলা প্রয়োজন। যদি ডেন্টিস্টের কাছে যেতে নার্ভাস বোধ করেন, তাহলে ডেন্টিস্ট এবং কর্মীদের ভয় সম্পর্কে বলুন। ডেন্টিস্ট প্রয়োজন অনুযায়ী চিকিৎসা ব্যবস্থা নিতে পারবেন।

তামাক ও ধূমপানের সঙ্গে ডায়াবেটিস এর সম্পর্ক ইতোমধ্যে প্রমাণিত হয়েছে। ধূমপান ও তামাক সেবন ডায়াবেটিসের ভয়াবহতা, মুখের সমস্যা এবং জটিলতা অনেকগুণ বাড়িয়ে দেয়। গবেষণায় দেখা গেছে, যারা তরুণ বয়সে ধূমপান শুরু করে তারা পরবর্তীতে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হতে পারে। ডায়াবেটিস আছে এমন কেউ যদি ধূমপান, তামাক সেবন করে তবে তাদেরও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকে না। ফলে তাদের মধ্যে ফুসফুসের ক্যান্সার, হৃদরোগ, স্ট্রোক ও পায়ের পঁচনশীল রোগ ‘গ্যাংগ্রীণ’ হওয়ার সম্ভাবণা ৫ গুণ বেশি। তামাক ব্যবহার মুখের স্বাস্থ্যের উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। সহজভাবে বলতে গেলে- মাথার চুল থেকে শুরু করে পায়ের নঁখ পর্যন্ত প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গই তামাকের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মুখের রোগে আক্রান্ত হওয়ার ক্ষেত্রে ধূমপান/তামাক সেবনকে অন্যতম বড় ঝুঁকি হিসেবে চিহ্নিত করা হয় যেমন: পিরিওডোন্টাইটিস (দাঁতের সহায়ক হাঁড় ও নরম টিস্যুর রোগ) এবং দাঁতের ক্ষয় বা দাঁত পড়ে যাওয়া। তাছাড়াও ডায়াবেটিস রোগীদের ধূমপানের কারণে ‘মাড়ির রোগ বা পেরিওডেন্টাল ডিজিজ’ এর জটিলতা বেশি হয় এবং অকালে দাঁত পড়ে যায়।

দেহের স্বাস্থ্য রক্ষায় মুখের স্বাস্থের যত্ন নেওয়াটা জরুরি। এজন্যই ঐতিহ্য ও স্বাস্থ্য ঝুঁকির ভারসাম্য নিয়ে ভাবা প্রয়োজন। প্রায় চার দশক ধরে মুখ ও দাঁতের রোগ নিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে অনেক রোগীকে দেখেছি পান সুপারী খাওয়ার ফলে তাদের মুখের স্বাস্থ্যের করুণ দশা। জর্দা, গুল, সাদাপাতা ক্ষতিকর সেটা পরিক্ষিত। তবে, পান, সুপারি এমনকি জর্দা ছাড়া শুধু পান-সুপারি খেলেও মুখগহ্বরের জন্য ক্ষতি বয়ে আনতে পারে। সমাজে প্রচলিত আছে- অনেকে মনে করেন, “আমি তো শুধু পান খাই, জর্দা খাই না” তাদের উদ্দেশে বলব, শুধুমাত্র পান ও সুপারীও শরীরের জন্য নিরাপদ নয়। পান, সুপারীর অপকারিতা নিয়ে অনেক গবেষণা কাজ সম্পন্ন হয়েছে এবং বিভিন্ন জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। মিথ বা অপব্যাখ্যার কারণে জনমনে বিভ্রান্তি আছে বিধায় পান, সুপারীর ক্ষতি তেমন একটা ছড়ানো সম্ভব হয়নি। আমাদের প্রেক্ষাপটে তা আরো কঠিন, কারণ পান, সুপারী সংস্কৃতির গভীরে এবং এখনো এটা চর্চ্চা হয়ে আসছে।

অতএব, মুখের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে বা মুখের রোগ প্রতিরোধে যেমন ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয় তেমনি, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতেও মুখের যত্ন বা রোগ প্রতিরোধ বা চিকিৎসা করানো জরুরি। একই সাথে যে সকল আচরণ ডায়াবেটিসে আক্রান্তের ঝুঁকি বাড়ায় যেমন: ধূমপান, তামাক সেবন এগুলো বন্ধ করতে হবে। প্রতিকারের চাইতে প্রতিরোধই শ্রেয়, সস্তা ও নিরাপদ।

[লেখক: ভিজিটিং প্রফেসর, ডিপার্টমেন্ট অব ডেন্টাল সার্জারি, বারডেম জেনারেল হাসপাতাল]

আবার বাড়ছে নিত্যপণ্যের দাম : সংকটে সাধারণ মানুষ

ভিন্ন ধরনের ডাকসু নির্বাচন

ডাকসু নির্বাচন : পেছনে ফেলে আসি

প্রসঙ্গ : এলডিসি তালিকা থেকে বাংলাদেশের উত্তরণ

“কোপা চাটিগাঁ...”

ই-কমার্স হতে পারে প্রবৃদ্ধির ইঞ্জিন

ভারত-চীনের নতুন সমীকরণ

সাইবার যুগে মানুষের মর্যাদা ও নিরাপত্তা

ছবি

ভারত-চীন সম্পর্কে কৌশলগত উষ্ণতার সূচনা

ভারত-চীন সম্পর্কে কৌশলগত উষ্ণতার সূচনা

একজন নাগরিকের অভিমানী বিদায় ও রাষ্ট্রের নৈতিক সংকট

নিষিদ্ধ জালের অভিশাপে হুমকির মুখে সমুদ্রের জীববৈচিত্র্য

আধিপত্যবাদের শৃঙ্খল এবং পুঁজির লুন্ঠন যাদের রক্তাক্ত করে, তাদের চাই একজোটে

জার্মানি : কৃচ্ছসাধনের বোঝা জনগণের কাঁধে

পাট চাষের সংকট ও সম্ভাবনা

সামাজিক-প্রযুক্তিগত কল্পনা: বাংলাদেশের উন্নয়ন চিন্তার নতুন দিগন্ত

অগ্রক্রয় মোকদ্দমায় উভয় পক্ষের আইনি ডিফেন্স

পশ্চিমবঙ্গে শিক্ষক নিয়োগে অনিয়ম

এক সাংবাদিকের খোলা চিঠি

বাংলাদেশের দারিদ্র্য বৃদ্ধি ও অর্থনীতির চ্যালেঞ্জ

ক্লাউডবার্স্ট: মৃত্যুর বার্তা নিয়ে, আকাশ যখন কান্নায় ভেঙে পড়ে

রম্যগদ্য:“কবি এখন জেলে...”

কারা কর্তৃপক্ষের সীমাবদ্ধতা ও ‘কারেকশন সার্ভিস’-এর বাস্তবতা

ছবি

বাংলাদেশের শহর পরিকল্পনার চ্যালেঞ্জ ও করণীয়

ছবি

‘আজ ফির তুমপে পেয়ার আয়া হ্যায়’

স্বপ্নের দক্ষিণ কোরিয়া; বাংলাদেশে আন্দোলন, ভিয়েতনামের সাফল্য

ডাকসু নির্বাচন ও জাতীয় রাজনীতি

ঢাকা শহরের উষ্ণতা: সবুজ হারানোর মূল্য

তিন বাহিনী প্রধানদের আশা ও সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা

গনমাধ্যম জগতও নিষ্ঠুরতায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে!

মানবিক ও নৈতিক শিক্ষা: জাপান এক অনুসরণীয় আদর্শ

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার নতুন ট্র্যাজেডি

হোক সবুজ বিপ্লব

পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি : একজন বিধায়কের জামিন

নিউটনের আপেল : পতনের ভেতরে জাগরণের গল্প

বায়ুদূষণ গবেষণার প্রসার ও তরুণদের ভূমিকা : প্রয়োজনীয়তা ও সম্ভাবনা আহমদ

tab

opinion » post-editorial

ডায়াবেটিস রোগীর সেবা ও জনসচেতনতা

অরূপরতন চৌধুরী

সংবাদ অনলাইন রিপোর্ট

শুক্রবার, ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫

বাংলাদেশে ডায়াবেটিসের চিকিৎসা সেবায় একটি আস্থার প্রতীক ‘বাংলাদেশ ডায়াবেটিস সমিতি (বাডাস)’। প্রতিষ্ঠিত বাডাস নাম মাত্র মূল্যে ডায়াবেটিসের সঠিক চিকিৎসা সেবা প্রদানে গণমানুষের ভরসাস্থল হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। ডায়াবেটিসের আধুনিক চিকিৎসা সেবা ও গবেষণায় বাডাস দেশের সর্বত্র এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গণে অগ্রগণ্য প্রতিষ্ঠান। জনকল্যাণের মহান ব্রত নিয়ে অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে চলেছে বাডাস। জাতীয় অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ ইব্রাহিম, বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি (বাডাস) এর প্রতিষ্ঠাতা একইসাথে বাংলাদেশে ডায়াবেটিস এর চিকিৎসা সেবার ক্ষেত্রে সারা বিশে^ একজন পথিকৃত।

ডা. মোহাম্মদ ইব্রাহিম ১৯৮৯ সালের ৬ সেপ্টেম্বর আমাদের ছেড়ে পাড়ি জমিয়েছেন অনন্তের পথে। নিরব মহামারী ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে মানুষকে সচেতন করে তুলতেই বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি প্রতিষ্ঠাতার মৃত্যুবার্ষিকীর দিনটিকে (০৬ সেপ্টেম্বর) ‘ডায়াবেটিক সেবা দিবস’ হিসেবে পালন করে থাকে।

বাংলাদেশে ডায়াবেটিস বর্তমানে একটি মহামারী রোগ হিসেবে চিহ্নিত এবং এই রোগ সারা জীবনের রোগ। নিয়ন্ত্রণে থাকলে স্বাভাবিক জীবন-যাপন করা যায় কিন্তু, অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস এর জটিলতা অনেক। আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিস ফেডারেশন (আইডিএফ) এর ডায়াবেটিস এটলাস ডায়াবেটিসের বৈশি^ক প্রভাব সম্পর্কে সর্বশেষ যে পরিসংখ্যান এবং তথ্য দিয়েছে তাতে দেখা যায়- ২০২১ সালে ৫৩.৭ কোটি মানুষ (প্রতি ১০ জনে এক জন) ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ছিলেন। ২০৩০ সালের মধ্যে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ৬৪.৩ কোটিতে এবং ২০৪৫ সালে ৭৮.৩ কোটিতে পৌছানোর আশঙ্কা রয়েছে। এছাড়া- ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ২৪ কোটি মানুষ (প্রতি ২ জনে ১ জন) জানেন না, তারা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। তাদের অধিকাংশই টাইপ-২ ডায়াবেটিস আক্রান্ত। ১২ লক্ষেরও বেশি শিশু ও কিশোর (০-১৯ বছর) টাইপ-১ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। ২০২১ সালে বিশে^র ৬৭ লক্ষ মানুষ ডায়াবেটিস এর কারণে মৃত্যুবরণ করেন। ২০২১ সালে ৯৬৬ বিলিয়ন ডলার ব্যয় হয় ডায়াবেটিস এর কারণে, যা বৈশি^ক স্বাস্থ্য খাতে মোট ব্যয়ের ৯%।

একজন ডায়াবেটিক রোগী যদি তার ডায়াবেটিসের সুগার লেভেল স্বাভাবিক রাখতে চান তবে তার নিয়মিত ওষুধ (ট্যাবলেট বা ইনসুলিন) ব্যায়াম ও খাদ্য গ্রহণের ব্যাপারে যেমন শৃঙ্খলা বা নিয়মকানুন (ডাক্তারের পরামর্শ ও পথ্যবিদ এর খাদ্য তালিকা) মেনে চলবেন ঠিক তেমনভাবে তিনি কিন্তু মুখের ভিতরের অংশ যেমন দাঁত, মাড়ি ও জিহ্বার যত্ন করবেন। কারণ মুখের ভিতরের দাঁতে, মাড়িতে, জিহ্বার বা গালের কোনো অংশে প্রদাহ বা ইনফেকশন থাকলে ডায়াবেটিস রোগীদের ব্লাড সুগার বা শর্করা নিয়ন্ত্রণে থাকবে না। ভালো দাঁতের যত্ন মুখের বিভিন্ন সমস্যা প্রতিরোধ করতে পারে এবং ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করতে পারে। মুখে যখন কম লালা প্রবাহিত হয়, তখন দাঁতের রোগ, মাড়ির রোগ এবং মুখের অন্যান্য সমস্যার ঝুঁকি বেড়ে যায়। ডায়াবেটিস লালায় গ্লুকোজের পরিমাণও বাড়িয়ে দিতে পারে। রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা, যাকে ব্লাড সুগারও বলা হয়, যখন খুব বেশি হয় তখন ডায়াবেটিস অনিয়ন্ত্রিত থাকে। ডায়াবেটিস মুখের ভিতরের অনেক অংশের যেমন: দাঁত ও মাড়িতে ছাড়াও শরীরের অনেক অংশকে প্রভাবিত করে। যাদের ডায়াবেটিস আছে তাদের মাড়ির রোগ মুখ গহ্বরের বিভিন্ন অংশ এবং দাঁতের অন্যান্য সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।

নিয়মিত স্কেলিং করা এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসহ দাঁত এবং মাড়ির ভালো যত্ন নিলে এই সমস্যাগুলো প্রতিরোধ করতে বা আরও খারাপ হওয়া অবস্থা বন্ধ করতে সহায়তা করবে। মুখকে বা মুখগহ্বরকে সুস্থ রাখলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ রাখা এবং ডায়াবেটিস-সম্পর্কিত স্বাস্থ্য সমস্যা যেমন হৃদরোগ এবং কিডনি রোগ প্রতিরোধ করা অনেক সহজ হবে। ডায়বেটিস লালা পরিবর্তন করে মুখকে প্রভাবিত করতে পারে-তরল যা মুখকে ভিজা রাখে। অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসের ফলে লালা কমে গেলে মুখে ডেন্টাল ক্যারিজ, বা দন্তক্ষয় বেশি হয়। ডায়াবেটিস এবং ডায়াবেটিসের চিকিৎসার জন্য ব্যবহৃত কিছু ওষুধের কারণে মুখের লালা গ্রন্থিগুলো কম লালা তৈরি করতে পারে। যখন কম লালা প্রবাহিত হয়, তখন মুখ গহ্বর ও মাড়ির রোগ এবং মুখের অন্যান্য রোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়।

ডায়াবেটিস লালায় গ্লুকোজের পরিমাণও বাড়িয়ে দিতে পারে। যখন ডায়াবেটিস দেখা দেয় তখন রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বা ব্লাড সুগার খুব বেশি হয়। রক্তে উচ্চমাত্রার গ্লুকোজও লালায় গ্লুকোজ তৈরি করতে পারে। এই গ্লুকোজ ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়া খাবারের সঙ্গে মিলিত হয়ে প্লেক নামক নরম আঠালো ফিল্ম তৈরি করে, যা দাঁতে গর্ত বা ক্ষয় সৃষ্টি করে। যদি খাবারের আবরণ অপসারণ না হয় তবে এটি মাড়ির লাইনের কাছে দাঁতের ওপর তৈরি হতে পারে এবং টার্টার নামক শক্ত আবরণ হয়ে যেতে পারে, যা মাড়ির রোগের কারণ হতে পারে। চিকিৎসা না করা হলে মুখের এই সমস্যাগুলো থাকলে দাঁতের ও মাড়ির ক্ষতি হতে পারে। মাড়ির রোগ যাকে পিরিওডন্টাল গাম ডিজিজও বলা হয়, এটি ডায়াবেটিস সম্পর্কিত মুখের সবচেয়ে বেশি লক্ষণীয় রোগ এবং গুরুতর সমস্যা সৃষ্টিকারী রোগ। চিকিৎসা না করা হলে, রোগটি পর্যায়ক্রমে অগ্রসর হয়, মাড়ি ফোলা বা রক্ত পড়া অবস্থা থেকে দাঁত পড়ে যাওয়া পর্যন্ত। রক্তে গ্লুকোজের উচ্চ মাত্রা উপস্থিতি মাড়ির রোগ মৃদু থেকে গুরুতর হওয়ার ঝুঁকি বাড়ায়। যেমন জিনজিভাইটিস থেকে পেরিওডনটাইটিজ।

ডায়াবেটিস থেকে মুখের সমস্যাগুলো কিভাবে প্রতিরোধ এবং চিকিৎসা করা যায় সে সম্পর্কে দাঁতের ডাক্তারের বা ডেন্টাল সার্জনের পরামর্শ মেনে চলা প্রয়োজন। যদি ডেন্টিস্টের কাছে যেতে নার্ভাস বোধ করেন, তাহলে ডেন্টিস্ট এবং কর্মীদের ভয় সম্পর্কে বলুন। ডেন্টিস্ট প্রয়োজন অনুযায়ী চিকিৎসা ব্যবস্থা নিতে পারবেন।

তামাক ও ধূমপানের সঙ্গে ডায়াবেটিস এর সম্পর্ক ইতোমধ্যে প্রমাণিত হয়েছে। ধূমপান ও তামাক সেবন ডায়াবেটিসের ভয়াবহতা, মুখের সমস্যা এবং জটিলতা অনেকগুণ বাড়িয়ে দেয়। গবেষণায় দেখা গেছে, যারা তরুণ বয়সে ধূমপান শুরু করে তারা পরবর্তীতে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হতে পারে। ডায়াবেটিস আছে এমন কেউ যদি ধূমপান, তামাক সেবন করে তবে তাদেরও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকে না। ফলে তাদের মধ্যে ফুসফুসের ক্যান্সার, হৃদরোগ, স্ট্রোক ও পায়ের পঁচনশীল রোগ ‘গ্যাংগ্রীণ’ হওয়ার সম্ভাবণা ৫ গুণ বেশি। তামাক ব্যবহার মুখের স্বাস্থ্যের উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। সহজভাবে বলতে গেলে- মাথার চুল থেকে শুরু করে পায়ের নঁখ পর্যন্ত প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গই তামাকের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মুখের রোগে আক্রান্ত হওয়ার ক্ষেত্রে ধূমপান/তামাক সেবনকে অন্যতম বড় ঝুঁকি হিসেবে চিহ্নিত করা হয় যেমন: পিরিওডোন্টাইটিস (দাঁতের সহায়ক হাঁড় ও নরম টিস্যুর রোগ) এবং দাঁতের ক্ষয় বা দাঁত পড়ে যাওয়া। তাছাড়াও ডায়াবেটিস রোগীদের ধূমপানের কারণে ‘মাড়ির রোগ বা পেরিওডেন্টাল ডিজিজ’ এর জটিলতা বেশি হয় এবং অকালে দাঁত পড়ে যায়।

দেহের স্বাস্থ্য রক্ষায় মুখের স্বাস্থের যত্ন নেওয়াটা জরুরি। এজন্যই ঐতিহ্য ও স্বাস্থ্য ঝুঁকির ভারসাম্য নিয়ে ভাবা প্রয়োজন। প্রায় চার দশক ধরে মুখ ও দাঁতের রোগ নিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে অনেক রোগীকে দেখেছি পান সুপারী খাওয়ার ফলে তাদের মুখের স্বাস্থ্যের করুণ দশা। জর্দা, গুল, সাদাপাতা ক্ষতিকর সেটা পরিক্ষিত। তবে, পান, সুপারি এমনকি জর্দা ছাড়া শুধু পান-সুপারি খেলেও মুখগহ্বরের জন্য ক্ষতি বয়ে আনতে পারে। সমাজে প্রচলিত আছে- অনেকে মনে করেন, “আমি তো শুধু পান খাই, জর্দা খাই না” তাদের উদ্দেশে বলব, শুধুমাত্র পান ও সুপারীও শরীরের জন্য নিরাপদ নয়। পান, সুপারীর অপকারিতা নিয়ে অনেক গবেষণা কাজ সম্পন্ন হয়েছে এবং বিভিন্ন জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। মিথ বা অপব্যাখ্যার কারণে জনমনে বিভ্রান্তি আছে বিধায় পান, সুপারীর ক্ষতি তেমন একটা ছড়ানো সম্ভব হয়নি। আমাদের প্রেক্ষাপটে তা আরো কঠিন, কারণ পান, সুপারী সংস্কৃতির গভীরে এবং এখনো এটা চর্চ্চা হয়ে আসছে।

অতএব, মুখের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে বা মুখের রোগ প্রতিরোধে যেমন ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয় তেমনি, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতেও মুখের যত্ন বা রোগ প্রতিরোধ বা চিকিৎসা করানো জরুরি। একই সাথে যে সকল আচরণ ডায়াবেটিসে আক্রান্তের ঝুঁকি বাড়ায় যেমন: ধূমপান, তামাক সেবন এগুলো বন্ধ করতে হবে। প্রতিকারের চাইতে প্রতিরোধই শ্রেয়, সস্তা ও নিরাপদ।

[লেখক: ভিজিটিং প্রফেসর, ডিপার্টমেন্ট অব ডেন্টাল সার্জারি, বারডেম জেনারেল হাসপাতাল]

back to top