জিয়াউদ্দীন আহমেদ
সংস্কার কমিশনের সুপারিশ হচ্ছে, বিচার বিভাগের জন্য আলাদা সচিবালয় এবং তার জন্য অর্থ খরচের স্বাধীনতা থাকলে সরকারের নির্বাহী বিভাগের ওপর তাদের নির্ভরশীলতা কমবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরও বলছেন, তাদের অধিকতর স্বাধীনতা দেওয়ার ব্যাপারে সরকার নীতিগতভাবে ইতিবাচক। কিন্তু স্বাধীনতা দেওয়া হলেও স্বাধীনতা সমুন্নত রাখা কঠিন হবে। নির্বাচন কমিশন ও দুদককে অনেক স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে, কিন্তু তারা কখনো সরকারের নির্বাহী বিভাগের কর্তৃত্ব এড়িয়ে চলতে পারেনি, ভবিষ্যতেও পারবে বলে মনে হয় না। প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী প্রধানের মনমানসিকতা সংস্কারাবদ্ধ হলে, রাজনৈতিক দল বা দলের আদর্শের প্রতি অন্ধ ভক্তি ও আনুগত্য থাকলে, ঘুষ আর দুর্নীতির প্রতি মোহ সৃষ্টি হলে প্রতিষ্ঠানের অবাধ স্বাধীনতাও অকার্যকর হয়ে পড়ে। স্বাধীন সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে আইন বা বিধিবিধানের চেয়ে প্রতিষ্ঠানের নীতি নির্ধারকদের জ্ঞান-গরিমা, সাহস ও সক্ষমতা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাই প্রতিষ্ঠানের কাঠামো এবং আইন, বিধিবিধানের সংস্কার করার আগে সংস্কারমুক্ত মানুষের নিয়োগ হওয়া দরকার।
বাংলাদেশে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা চায় শুধু বিরোধী দল, ক্ষমতাসীন দল নয়। আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথক হয়েছিল ২০০৭ সালে। কিন্তু আজ পর্যন্ত বিচার বিভাগের স্বাধীনতা কখনো জনগণের নিকট দৃশ্যমান হয়নি। আইনকানুন সম্পর্কে জ্ঞান না থাকায় দেশের ৯৯ শতাংশ লোক আদালত অবমাননার ভয়ে চুপ থাকে, চুপ থাকলেও আদালতের জনসম্পৃক্ত রায়গুলো অশিক্ষিত লোকগুলোও পর্যবেক্ষণ করে। গত ১৫ বছর ধরে বিএনপিসহ বিভিন্ন পক্ষ থেকে অভিযোগ তোলা হয়েছিল যে, বিচার বিভাগ আওয়ামী লীগ সরকারের ইচ্ছা অনুযায়ীই পরিচালিত হয়েছে। এখন কিন্তু বিএনপি আর বিচার বিভাগ নিয়ে কোন কথা বলে না, অবশ্য বলার কথাও নয়, এখন তাদের দলের ফাঁসির আসামীও জেলখানা থেকে বেরিয়ে আসছে। এখন বিচার বিভাগের স্বাধীনতা দরকার শুধু আওয়ামী লীগের জন্য, কিন্তু ক্ষমতায় থাকাকালীন আওয়ামী লীগ ছিল বেহুঁশ, তারা মনে করেছিল কেয়ামত পর্যন্ত তারা ক্ষমতায় থাকবে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করবে এমন সরকার বাংলাদেশে আসবে এবং তা দেখে যাব এমন আয়ু আমার অন্তত নেই।
আরেকটি সংস্কার খুব জরুরি বলে মনে হয়। বাংলাদেশের সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী কোনো ব্যক্তি বিদেশি রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব নিলে বা বিদেশি রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করলে তিনি সংসদ সদস্য এবং মন্ত্রী হতে পারেন না। মনে হচ্ছে এই অনুচ্ছেদ শুধু সংসদ সদস্যের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য এবং কোন সংসদ সদস্য মন্ত্রী হলে তার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। টেকনোক্রেট মন্ত্রী, আমলা বা অন্য কোন পেশাজীবীর ক্ষেত্রে মনে হয় প্রয়োজ্য নয়। এমন একটি প্রতিবন্ধকতা থাকা সত্বেও অতীতের প্রায় সব সরকারের আমলেই ভিন দেশের নাগরিকত্ব গ্রহণকারী আমলা, সংসদ সদস্য, মন্ত্রী ছিলেন। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের কয়েকজন উপদেষ্টাও নাকি ভিন দেশের পাসপোর্টধারী। দুই বা ততোধিক দেশের নাগরিকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ হচ্ছে, একজন ব্যক্তি একই সময়ে দুই দেশের প্রতি অনুগত থাকতে পারে না। তবে জন্মগত নাগরিকত্ব কেউ ভুলতেও পারে না। ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত ইংল্যান্ড টিমের সঙ্গে ক্রিকেট খেলায় গ্যালারির প্রায় সব বাঙালি বাংলাদেশ টিমকে সমর্থন করে থাকে, যদিও তাদের অধিকাংশ ইংল্যান্ডের নাগরিক। সব সরকারের আমলেই যখন বাংলাদেশ বংশোদ্ভূত বিদেশি নাগরিক সরকারে অন্তর্ভুক্ত করে সংবিধান লঙ্ঘন করা হয়, তখন সংবিধান লঙ্ঘন করার চেয়ে এই অনুচ্ছেদ সংবিধান থেকে বাতিল করাই শ্রেয়। কিন্তু এই অনুচ্ছেদ কেন আজ পর্যন্ত বাতিল হলো না তা অদ্ভুত লাগে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী টার্গেটেড ব্যক্তিকে ফাঁসানোর জন্য অস্ত্র বা মাদক গুঁজে দিয়ে গ্রেফতার করার রীতি চালু করেছে বহু আগে থেকেই। কোন সরকার তা রোধ করার চেষ্টা করেনি, কারণ বিরোধী দলের লোকদের ধরে জেলে পুরতে হলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এই সকল অপকর্মে সরকারের সায় থাকতে হয়। আওয়ামী লীগ সরকারের উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান এবং আইনমন্ত্রী আনিসুল হককে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে হস্তান্তর করা সত্ত্বেও তাদের দাড়ি কেটে, লুঙ্গি পরিয়ে নৌকায় পালিয়ে যাওয়ার নাটক সাজানো হয়েছে- কথাটি রাখঢাক করে বলেছেন উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন। সংস্কারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেই এমন ঘটনা ঘটেছে। ২১ আগস্টে আওয়ামী লীগের জনসভায় গ্রেনেড হামলার বেলায়ও জজমিয়ার নাটক রচনা করা হয়েছিল। নির্দিষ্ট অপরাধে সুনির্দিষ্ট ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের চিহ্নিত না করে অগণিত অজ্ঞাত লোকের সংশ্লিষ্টতা উল্লেখ করে আসামী ধরা ও ছাড়ার ঘুষ বাণিজ্যের নাটকের মঞ্চায়ন এখনো চলছে। অতীতে প্রতিটি সরকারের আমলে সরকারের সম্মতিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এই অপকর্মটি করেছে, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেও হচ্ছে, এই অনিয়মের সংস্কার কেউ করবে না, করবে না বলেই মাদক আর পিস্তল গুঁজে দিয়ে টার্গেটেড ব্যক্তিকে ভবিষ্যতেও গ্রেফতার করা হবে, এবং পুলিশের এই কাজে সরকারের সায়ও থাকবে।
কোথাও কোন অপরাধ সংঘটিত হলে, কাউকে হত্যা করা হলে সরকারের সম্মতি না থাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জেনেও নিজ উদ্যোগে কোন ব্যবস্থা নেয় না, অথবা তাদের জানানো হলেও তারা বলে, লিখিত অভিযোগ পেলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এটা কী ধরনের ব্যবস্থা! আরেকটি সমস্যা আরও মারাত্মক। বাদীর বাসা যেখানেই হোক না কেন, অভিযোগ দায়ের করতে হবে সংঘটিত ঘটনার নিকটবর্তী থানায়। ইন্টারনেটের যুগে সংঘটিত ঘটনার স্থান নির্বিশেষে যে কোন থানায় জিডি বা এফআইআর করার সুযোগ থাকা দরকার। কয়েক মাস আগে রাজশাহীগামী একটি চলন্ত বাসে ডাকাতির ঘটনার মামলা নথিভুক্ত করা নিয়ে টাঙ্গাইলের মির্জাপুর ও নাটোরের বড়াইগ্রাম থানা পুলিশের মধ্যে তিন দিন ধরে ঠেলাঠেলি পর ডাকাতির উৎসস্থল মির্জাপুর থানায় মামলাটি রুজু হয়েছে। এমন ঘটনা নতুন নয়, বাল্যকাল থেকে তা শুনে আসছি। এমন ঠেলাঠেলির জন্য দুই থানার সীমান্তে একজনের মরদেহ কয়েক দিন যাবত পড়ে থাকার কাহিনী কয়েক দশক আগে পত্রিকায় পড়েছিলাম। কয়েকদিন আগে আমার স্ত্রী আমাদের বাসা থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে ছিনতাইয়ের কবলে পড়ে। বাসার কাছের থানায় গেলে একই কথা- ছিনতাই যেখানে হয়েছে সেখানে গিয়ে জিডি করতে হবে। ছিনতাইকারী গ্যাস ব্যবহারের প্রিপেইড কার্ডটিও নিয়ে যাওয়াতে জিডির প্রয়োজন দেখা যায়, নতুবা অভিনেতা এটিএম শামছুজ্জমানের মতো বলতাম, ‘আমাকে কেউ কেটে টুকরো টুকরো করলেও থানায় যাব না’।
একাডেমিক সার্টিফিকেট, আইডি কার্ড, গ্যাস কার্ড ইত্যাদি হারালে আবেদনের ভিত্তিতে ডুপ্লিকেট কার্ড ইস্যু করতে পত্রিকায় কেন বিজ্ঞপ্তি দিতে হবে এবং থানায় জিডি করার প্রয়োজন কেন তা বোধগম্য নয়। নানাবিধ পরীক্ষায় পাস করার পর কোথাও আবেদন করতে হলে কেন ছবির সত্যায়ন প্রয়োজন, কেন চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে পাসপোর্ট বা জাতীয় পরিচয়পত্রধারীর পুলিশ রিপোর্ট প্রয়োজন তা বোধগম্য নয়। আজকের অসৎ লোক কালকে সততার পরকাষ্ঠা হতে পারেন এবং সৎ লোকও অসৎ হতে পারে। পুলিশ রিপোর্ট যদি মানুষের চরিত্র বিচারে অকাট্য হতো তাহলে দেশে এত ঘুষ আর দুর্নীতির ছড়াছড়ি হতো না। দলীয় আনুগত্য বের করার জন্য কোন কোন পদোন্নতির ক্ষেত্রে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্ট বিবেচনায় নেওয়ার অপকর্মটাও বাদ দেওয়া দরকার। এই সকল নিয়মনীতি থাকায় ঘুষ আর দুর্নীতির উদ্ভব ঘটে। অন্তর্বর্তী সরকার পাসপোর্ট প্রদানে পুলিশ ভেরিফিকেশন রদ করেছে, একটি উত্তম সিদ্ধান্ত। চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গোপনীয় প্রতিবেদনের আবশ্যকতা দুর্নীতির জন্ম দেয়। কোন নাগরিকের বিরুদ্ধে মামলা থাকলে বা তার শাস্তি হলে তিনি চাকরির জন্য অনুপযুক্ত হবেন কেন? মামলায় গ্রেফতার করে থানায় নেওয়া হলেই চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করার নিয়মটি জংলি আইন, কারণ নিরপরাধী লোকদের ফাঁসানোর বহু মামলা হতে পারে। এমনও দেখা গেছে, মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে সংশ্লিষ্ট কর্মচারী-কর্মকর্তার অবসর নেওয়ার পর।
সারা বছর ওয়াজ আর ব্যান্ড সঙ্গীতের প্রচ- আওয়াজে শুধু রোগী নয়, সুস্থ্য লোকও অসুস্থ্য হয়ে যায়, ছাত্র-ছাত্রীদের পড়ালেখায় ব্যাঘাত ঘটে। মাইকের আওয়াজে পড়ালেখায় মনোযোগ দিতে না পেরে এক ছাত্রী তার বার্ষিক পরীক্ষার সময় মানসিক বৈকল্যে পতিত হয়ে পরীক্ষা দিতে পারেনি। ওয়াজ-মাহফিল ও ব্যান্ডসঙ্গীতে উচ্চস্বরে মাইক বাজানো বন্ধ করার ঝুঁকি কেউ নেবে না। কারণ আইন ভঙ্গ হলেও সরকার স্পর্শকাতর বলে চুপ থাকে। অবশ্য কয়েকজন আলেম স্পষ্ট করে বলেছেন, ওয়াজ এবং ব্যান্ড সঙ্গীতের মাইকের আওয়াজ আয়োজন স্থলে সীমাবদ্ধ রাখা উচিত। এক্ষেত্রে একটা আইন তো করা যায়- সেই আইনটি হচ্ছে যেখানে অনুষ্ঠান বা ওয়াজ হচ্ছে তার সীমানার বাইরে স্পিকার লাগানো যাবে না। জনগণ আজকাল ইউটিউবেই ওয়াজ শু তে অভ্যস্ত। লাগেজ হ্যান্ডলিং ও চেক করার ক্ষেত্রে নৌ ও বিমান বন্দরের সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে এত অভিযোগ, কিন্তু আজ পর্যন্ত কেউ সমাধান করল না। আমাদের বিমানবন্দরের বেল্টে মালামাল দিতে এত দেরি কেন হয় তা কেউ আজ পর্যন্ত আবিস্কার করতে পারল না। বহু বছর বিদেশ যাওয়া হয়নি, তাই স্যুটকেস কাটা বন্ধ হয়েছে কিনা সেই বিষয়ে জ্ঞাত নই।
আওয়ামী লীগ আমলে করা বাংলা একাডেমির ‘ইদ’ অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে হয়ে গেল ‘ঈদ’। বুদ্ধিজীবী এবং প-িতদের পা-িত্য কেন সরকারের পতন ও আগমনের সাথে পরিবর্তন হয় তার শানে নযুল বের করা দরকার। বের করা দরকার, প্রধানমন্ত্রীকে বিদায় দেওয়ার জন্য বিমানবন্দরে এত এত মন্ত্রী, আমলা, রাষ্ট্রদূতকে যেতে হয় কেন? দুর্ঘটনায় পতিত লোকদের দেখার জন্য দলবল নিয়ে রাজনীতিবিদেরা কেন হাসপাতালে গিয়ে অনবচ্ছিন্ন চিকিৎসায় ব্যাঘাত ঘটান তার অন্তর্নিহিত রহস্য জানা দরকার। রাজনীতিববিদ এবং সরকারের লোকদের হাসপাতালে যাওয়া বন্ধ করা সম্ভব যদি টিভি-ক্যামেরার প্রবেশ বন্ধ করা যায়। টিভি চ্যানেলের ক্যামেরা ঢুকতে না দিলে কেউ যাবে বলে মনে হয় না। বের করা দরকার, নির্বাচনে প্রায় সব প্রার্থী নির্বাচনী ব্যয়ের মিথ্যা হিসাব দিয়ে পার পেয়ে যায় কী করে? কেন একজন স্বতন্ত্র নাগরিককে এক শতাংশ ভোটারের সম্মতি নিয়ে নির্বাচনে প্রার্থী হতে হবে? এই সকল নিয়ম বহাল রেখে প্রার্থীদের নিয়ম ভঙ্গকারী বানানোর দরকারই বা কী? প্রতিটি রাজনৈতিক দল অর্থ-সম্পদের মালিকদের নির্বাচনে মনোনয়ন দিয়ে থাকে, কারণ দল জানে, নির্বাচনে জেতার জন্য অগুণতি টাকার দরকার। নির্বাচন কমিশনের বেঁধে দেওয়া অর্থসীমার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকা প্রায় অসম্ভব। সংসদ সদস্য হওয়ার পূর্বেই সব প্রার্থীকে নির্বাচন প্রক্রিয়ায় অসৎ বানানো হয়, তাই তাদের কাছ থেকে সুশাসন ও জবাবদিহিতা আশা করা নিরর্থক।
প্রায় সব প্রতিষ্ঠানের সিবিএ-কে সরকার কব্জা করতে চায় কেন? চায় বলেই সরকারের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে কোন কোন সিবিএ লাগামহীন দৈত্য-দানবে পরিণত হয়, প্রতিষ্ঠানের অনেক কিছু করতে হয় তাদের মর্জি মাফিক। কেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ছাত্র, আইনজীবী, সাংবাদিক, ডাক্তারদের দলীয় রাজনীতির লেজুড়বৃত্তি করতে হয়? লেজুড়বৃত্তি করার অন্যতম প্রধান কারণ ক্ষমতার কাছাকাছি থাকার বাসনা। যে দল ক্ষমতায় থাকে সেই দলের সমর্থক আইনজীবীদের যে কোন মামলায় নিয়োজিত করার একটা মনস্তত্ত্বিক তৃপ্তি পরিলক্ষিত হয়, সম্ভবত কিছুটা সুবিধাও পাওয়া যায়। চলাফেরাকে বাধাগ্রস্ত করে রাস্তায় মিছিল, মিটিং, জনসভা ও ধর্মীয় অনুষ্ঠান বন্ধ করার সংস্কার কেউ করতে চাইবে না। বিরোধী দলকে রাস্তা থেকে সরানো যাবে না, কারণ তারা মনে করে এটা তাদের সাংবিধানিক অধিকার, অন্যদিকে ক্ষমতাসীন সব সরকারই বলে এটা বেআইনি। মাঝখানে জনগণ হয় ভিকটিম, তাদের দুর্ভোগ লেগেই আছে। কিছু সংস্কারের জন্য বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ঐক্যমতের প্রয়োজন নেই, অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাহী আদেশে সংস্কারগুলো করে ভবিষ্যতের জন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে যেতে পারে।
[লেখক: সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক]
জিয়াউদ্দীন আহমেদ
রোববার, ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫
সংস্কার কমিশনের সুপারিশ হচ্ছে, বিচার বিভাগের জন্য আলাদা সচিবালয় এবং তার জন্য অর্থ খরচের স্বাধীনতা থাকলে সরকারের নির্বাহী বিভাগের ওপর তাদের নির্ভরশীলতা কমবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরও বলছেন, তাদের অধিকতর স্বাধীনতা দেওয়ার ব্যাপারে সরকার নীতিগতভাবে ইতিবাচক। কিন্তু স্বাধীনতা দেওয়া হলেও স্বাধীনতা সমুন্নত রাখা কঠিন হবে। নির্বাচন কমিশন ও দুদককে অনেক স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে, কিন্তু তারা কখনো সরকারের নির্বাহী বিভাগের কর্তৃত্ব এড়িয়ে চলতে পারেনি, ভবিষ্যতেও পারবে বলে মনে হয় না। প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী প্রধানের মনমানসিকতা সংস্কারাবদ্ধ হলে, রাজনৈতিক দল বা দলের আদর্শের প্রতি অন্ধ ভক্তি ও আনুগত্য থাকলে, ঘুষ আর দুর্নীতির প্রতি মোহ সৃষ্টি হলে প্রতিষ্ঠানের অবাধ স্বাধীনতাও অকার্যকর হয়ে পড়ে। স্বাধীন সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে আইন বা বিধিবিধানের চেয়ে প্রতিষ্ঠানের নীতি নির্ধারকদের জ্ঞান-গরিমা, সাহস ও সক্ষমতা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাই প্রতিষ্ঠানের কাঠামো এবং আইন, বিধিবিধানের সংস্কার করার আগে সংস্কারমুক্ত মানুষের নিয়োগ হওয়া দরকার।
বাংলাদেশে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা চায় শুধু বিরোধী দল, ক্ষমতাসীন দল নয়। আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথক হয়েছিল ২০০৭ সালে। কিন্তু আজ পর্যন্ত বিচার বিভাগের স্বাধীনতা কখনো জনগণের নিকট দৃশ্যমান হয়নি। আইনকানুন সম্পর্কে জ্ঞান না থাকায় দেশের ৯৯ শতাংশ লোক আদালত অবমাননার ভয়ে চুপ থাকে, চুপ থাকলেও আদালতের জনসম্পৃক্ত রায়গুলো অশিক্ষিত লোকগুলোও পর্যবেক্ষণ করে। গত ১৫ বছর ধরে বিএনপিসহ বিভিন্ন পক্ষ থেকে অভিযোগ তোলা হয়েছিল যে, বিচার বিভাগ আওয়ামী লীগ সরকারের ইচ্ছা অনুযায়ীই পরিচালিত হয়েছে। এখন কিন্তু বিএনপি আর বিচার বিভাগ নিয়ে কোন কথা বলে না, অবশ্য বলার কথাও নয়, এখন তাদের দলের ফাঁসির আসামীও জেলখানা থেকে বেরিয়ে আসছে। এখন বিচার বিভাগের স্বাধীনতা দরকার শুধু আওয়ামী লীগের জন্য, কিন্তু ক্ষমতায় থাকাকালীন আওয়ামী লীগ ছিল বেহুঁশ, তারা মনে করেছিল কেয়ামত পর্যন্ত তারা ক্ষমতায় থাকবে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করবে এমন সরকার বাংলাদেশে আসবে এবং তা দেখে যাব এমন আয়ু আমার অন্তত নেই।
আরেকটি সংস্কার খুব জরুরি বলে মনে হয়। বাংলাদেশের সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী কোনো ব্যক্তি বিদেশি রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব নিলে বা বিদেশি রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করলে তিনি সংসদ সদস্য এবং মন্ত্রী হতে পারেন না। মনে হচ্ছে এই অনুচ্ছেদ শুধু সংসদ সদস্যের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য এবং কোন সংসদ সদস্য মন্ত্রী হলে তার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। টেকনোক্রেট মন্ত্রী, আমলা বা অন্য কোন পেশাজীবীর ক্ষেত্রে মনে হয় প্রয়োজ্য নয়। এমন একটি প্রতিবন্ধকতা থাকা সত্বেও অতীতের প্রায় সব সরকারের আমলেই ভিন দেশের নাগরিকত্ব গ্রহণকারী আমলা, সংসদ সদস্য, মন্ত্রী ছিলেন। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের কয়েকজন উপদেষ্টাও নাকি ভিন দেশের পাসপোর্টধারী। দুই বা ততোধিক দেশের নাগরিকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ হচ্ছে, একজন ব্যক্তি একই সময়ে দুই দেশের প্রতি অনুগত থাকতে পারে না। তবে জন্মগত নাগরিকত্ব কেউ ভুলতেও পারে না। ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত ইংল্যান্ড টিমের সঙ্গে ক্রিকেট খেলায় গ্যালারির প্রায় সব বাঙালি বাংলাদেশ টিমকে সমর্থন করে থাকে, যদিও তাদের অধিকাংশ ইংল্যান্ডের নাগরিক। সব সরকারের আমলেই যখন বাংলাদেশ বংশোদ্ভূত বিদেশি নাগরিক সরকারে অন্তর্ভুক্ত করে সংবিধান লঙ্ঘন করা হয়, তখন সংবিধান লঙ্ঘন করার চেয়ে এই অনুচ্ছেদ সংবিধান থেকে বাতিল করাই শ্রেয়। কিন্তু এই অনুচ্ছেদ কেন আজ পর্যন্ত বাতিল হলো না তা অদ্ভুত লাগে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী টার্গেটেড ব্যক্তিকে ফাঁসানোর জন্য অস্ত্র বা মাদক গুঁজে দিয়ে গ্রেফতার করার রীতি চালু করেছে বহু আগে থেকেই। কোন সরকার তা রোধ করার চেষ্টা করেনি, কারণ বিরোধী দলের লোকদের ধরে জেলে পুরতে হলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এই সকল অপকর্মে সরকারের সায় থাকতে হয়। আওয়ামী লীগ সরকারের উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান এবং আইনমন্ত্রী আনিসুল হককে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে হস্তান্তর করা সত্ত্বেও তাদের দাড়ি কেটে, লুঙ্গি পরিয়ে নৌকায় পালিয়ে যাওয়ার নাটক সাজানো হয়েছে- কথাটি রাখঢাক করে বলেছেন উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন। সংস্কারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেই এমন ঘটনা ঘটেছে। ২১ আগস্টে আওয়ামী লীগের জনসভায় গ্রেনেড হামলার বেলায়ও জজমিয়ার নাটক রচনা করা হয়েছিল। নির্দিষ্ট অপরাধে সুনির্দিষ্ট ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের চিহ্নিত না করে অগণিত অজ্ঞাত লোকের সংশ্লিষ্টতা উল্লেখ করে আসামী ধরা ও ছাড়ার ঘুষ বাণিজ্যের নাটকের মঞ্চায়ন এখনো চলছে। অতীতে প্রতিটি সরকারের আমলে সরকারের সম্মতিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এই অপকর্মটি করেছে, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেও হচ্ছে, এই অনিয়মের সংস্কার কেউ করবে না, করবে না বলেই মাদক আর পিস্তল গুঁজে দিয়ে টার্গেটেড ব্যক্তিকে ভবিষ্যতেও গ্রেফতার করা হবে, এবং পুলিশের এই কাজে সরকারের সায়ও থাকবে।
কোথাও কোন অপরাধ সংঘটিত হলে, কাউকে হত্যা করা হলে সরকারের সম্মতি না থাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জেনেও নিজ উদ্যোগে কোন ব্যবস্থা নেয় না, অথবা তাদের জানানো হলেও তারা বলে, লিখিত অভিযোগ পেলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এটা কী ধরনের ব্যবস্থা! আরেকটি সমস্যা আরও মারাত্মক। বাদীর বাসা যেখানেই হোক না কেন, অভিযোগ দায়ের করতে হবে সংঘটিত ঘটনার নিকটবর্তী থানায়। ইন্টারনেটের যুগে সংঘটিত ঘটনার স্থান নির্বিশেষে যে কোন থানায় জিডি বা এফআইআর করার সুযোগ থাকা দরকার। কয়েক মাস আগে রাজশাহীগামী একটি চলন্ত বাসে ডাকাতির ঘটনার মামলা নথিভুক্ত করা নিয়ে টাঙ্গাইলের মির্জাপুর ও নাটোরের বড়াইগ্রাম থানা পুলিশের মধ্যে তিন দিন ধরে ঠেলাঠেলি পর ডাকাতির উৎসস্থল মির্জাপুর থানায় মামলাটি রুজু হয়েছে। এমন ঘটনা নতুন নয়, বাল্যকাল থেকে তা শুনে আসছি। এমন ঠেলাঠেলির জন্য দুই থানার সীমান্তে একজনের মরদেহ কয়েক দিন যাবত পড়ে থাকার কাহিনী কয়েক দশক আগে পত্রিকায় পড়েছিলাম। কয়েকদিন আগে আমার স্ত্রী আমাদের বাসা থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে ছিনতাইয়ের কবলে পড়ে। বাসার কাছের থানায় গেলে একই কথা- ছিনতাই যেখানে হয়েছে সেখানে গিয়ে জিডি করতে হবে। ছিনতাইকারী গ্যাস ব্যবহারের প্রিপেইড কার্ডটিও নিয়ে যাওয়াতে জিডির প্রয়োজন দেখা যায়, নতুবা অভিনেতা এটিএম শামছুজ্জমানের মতো বলতাম, ‘আমাকে কেউ কেটে টুকরো টুকরো করলেও থানায় যাব না’।
একাডেমিক সার্টিফিকেট, আইডি কার্ড, গ্যাস কার্ড ইত্যাদি হারালে আবেদনের ভিত্তিতে ডুপ্লিকেট কার্ড ইস্যু করতে পত্রিকায় কেন বিজ্ঞপ্তি দিতে হবে এবং থানায় জিডি করার প্রয়োজন কেন তা বোধগম্য নয়। নানাবিধ পরীক্ষায় পাস করার পর কোথাও আবেদন করতে হলে কেন ছবির সত্যায়ন প্রয়োজন, কেন চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে পাসপোর্ট বা জাতীয় পরিচয়পত্রধারীর পুলিশ রিপোর্ট প্রয়োজন তা বোধগম্য নয়। আজকের অসৎ লোক কালকে সততার পরকাষ্ঠা হতে পারেন এবং সৎ লোকও অসৎ হতে পারে। পুলিশ রিপোর্ট যদি মানুষের চরিত্র বিচারে অকাট্য হতো তাহলে দেশে এত ঘুষ আর দুর্নীতির ছড়াছড়ি হতো না। দলীয় আনুগত্য বের করার জন্য কোন কোন পদোন্নতির ক্ষেত্রে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্ট বিবেচনায় নেওয়ার অপকর্মটাও বাদ দেওয়া দরকার। এই সকল নিয়মনীতি থাকায় ঘুষ আর দুর্নীতির উদ্ভব ঘটে। অন্তর্বর্তী সরকার পাসপোর্ট প্রদানে পুলিশ ভেরিফিকেশন রদ করেছে, একটি উত্তম সিদ্ধান্ত। চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গোপনীয় প্রতিবেদনের আবশ্যকতা দুর্নীতির জন্ম দেয়। কোন নাগরিকের বিরুদ্ধে মামলা থাকলে বা তার শাস্তি হলে তিনি চাকরির জন্য অনুপযুক্ত হবেন কেন? মামলায় গ্রেফতার করে থানায় নেওয়া হলেই চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করার নিয়মটি জংলি আইন, কারণ নিরপরাধী লোকদের ফাঁসানোর বহু মামলা হতে পারে। এমনও দেখা গেছে, মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে সংশ্লিষ্ট কর্মচারী-কর্মকর্তার অবসর নেওয়ার পর।
সারা বছর ওয়াজ আর ব্যান্ড সঙ্গীতের প্রচ- আওয়াজে শুধু রোগী নয়, সুস্থ্য লোকও অসুস্থ্য হয়ে যায়, ছাত্র-ছাত্রীদের পড়ালেখায় ব্যাঘাত ঘটে। মাইকের আওয়াজে পড়ালেখায় মনোযোগ দিতে না পেরে এক ছাত্রী তার বার্ষিক পরীক্ষার সময় মানসিক বৈকল্যে পতিত হয়ে পরীক্ষা দিতে পারেনি। ওয়াজ-মাহফিল ও ব্যান্ডসঙ্গীতে উচ্চস্বরে মাইক বাজানো বন্ধ করার ঝুঁকি কেউ নেবে না। কারণ আইন ভঙ্গ হলেও সরকার স্পর্শকাতর বলে চুপ থাকে। অবশ্য কয়েকজন আলেম স্পষ্ট করে বলেছেন, ওয়াজ এবং ব্যান্ড সঙ্গীতের মাইকের আওয়াজ আয়োজন স্থলে সীমাবদ্ধ রাখা উচিত। এক্ষেত্রে একটা আইন তো করা যায়- সেই আইনটি হচ্ছে যেখানে অনুষ্ঠান বা ওয়াজ হচ্ছে তার সীমানার বাইরে স্পিকার লাগানো যাবে না। জনগণ আজকাল ইউটিউবেই ওয়াজ শু তে অভ্যস্ত। লাগেজ হ্যান্ডলিং ও চেক করার ক্ষেত্রে নৌ ও বিমান বন্দরের সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে এত অভিযোগ, কিন্তু আজ পর্যন্ত কেউ সমাধান করল না। আমাদের বিমানবন্দরের বেল্টে মালামাল দিতে এত দেরি কেন হয় তা কেউ আজ পর্যন্ত আবিস্কার করতে পারল না। বহু বছর বিদেশ যাওয়া হয়নি, তাই স্যুটকেস কাটা বন্ধ হয়েছে কিনা সেই বিষয়ে জ্ঞাত নই।
আওয়ামী লীগ আমলে করা বাংলা একাডেমির ‘ইদ’ অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে হয়ে গেল ‘ঈদ’। বুদ্ধিজীবী এবং প-িতদের পা-িত্য কেন সরকারের পতন ও আগমনের সাথে পরিবর্তন হয় তার শানে নযুল বের করা দরকার। বের করা দরকার, প্রধানমন্ত্রীকে বিদায় দেওয়ার জন্য বিমানবন্দরে এত এত মন্ত্রী, আমলা, রাষ্ট্রদূতকে যেতে হয় কেন? দুর্ঘটনায় পতিত লোকদের দেখার জন্য দলবল নিয়ে রাজনীতিবিদেরা কেন হাসপাতালে গিয়ে অনবচ্ছিন্ন চিকিৎসায় ব্যাঘাত ঘটান তার অন্তর্নিহিত রহস্য জানা দরকার। রাজনীতিববিদ এবং সরকারের লোকদের হাসপাতালে যাওয়া বন্ধ করা সম্ভব যদি টিভি-ক্যামেরার প্রবেশ বন্ধ করা যায়। টিভি চ্যানেলের ক্যামেরা ঢুকতে না দিলে কেউ যাবে বলে মনে হয় না। বের করা দরকার, নির্বাচনে প্রায় সব প্রার্থী নির্বাচনী ব্যয়ের মিথ্যা হিসাব দিয়ে পার পেয়ে যায় কী করে? কেন একজন স্বতন্ত্র নাগরিককে এক শতাংশ ভোটারের সম্মতি নিয়ে নির্বাচনে প্রার্থী হতে হবে? এই সকল নিয়ম বহাল রেখে প্রার্থীদের নিয়ম ভঙ্গকারী বানানোর দরকারই বা কী? প্রতিটি রাজনৈতিক দল অর্থ-সম্পদের মালিকদের নির্বাচনে মনোনয়ন দিয়ে থাকে, কারণ দল জানে, নির্বাচনে জেতার জন্য অগুণতি টাকার দরকার। নির্বাচন কমিশনের বেঁধে দেওয়া অর্থসীমার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকা প্রায় অসম্ভব। সংসদ সদস্য হওয়ার পূর্বেই সব প্রার্থীকে নির্বাচন প্রক্রিয়ায় অসৎ বানানো হয়, তাই তাদের কাছ থেকে সুশাসন ও জবাবদিহিতা আশা করা নিরর্থক।
প্রায় সব প্রতিষ্ঠানের সিবিএ-কে সরকার কব্জা করতে চায় কেন? চায় বলেই সরকারের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে কোন কোন সিবিএ লাগামহীন দৈত্য-দানবে পরিণত হয়, প্রতিষ্ঠানের অনেক কিছু করতে হয় তাদের মর্জি মাফিক। কেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ছাত্র, আইনজীবী, সাংবাদিক, ডাক্তারদের দলীয় রাজনীতির লেজুড়বৃত্তি করতে হয়? লেজুড়বৃত্তি করার অন্যতম প্রধান কারণ ক্ষমতার কাছাকাছি থাকার বাসনা। যে দল ক্ষমতায় থাকে সেই দলের সমর্থক আইনজীবীদের যে কোন মামলায় নিয়োজিত করার একটা মনস্তত্ত্বিক তৃপ্তি পরিলক্ষিত হয়, সম্ভবত কিছুটা সুবিধাও পাওয়া যায়। চলাফেরাকে বাধাগ্রস্ত করে রাস্তায় মিছিল, মিটিং, জনসভা ও ধর্মীয় অনুষ্ঠান বন্ধ করার সংস্কার কেউ করতে চাইবে না। বিরোধী দলকে রাস্তা থেকে সরানো যাবে না, কারণ তারা মনে করে এটা তাদের সাংবিধানিক অধিকার, অন্যদিকে ক্ষমতাসীন সব সরকারই বলে এটা বেআইনি। মাঝখানে জনগণ হয় ভিকটিম, তাদের দুর্ভোগ লেগেই আছে। কিছু সংস্কারের জন্য বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ঐক্যমতের প্রয়োজন নেই, অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাহী আদেশে সংস্কারগুলো করে ভবিষ্যতের জন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে যেতে পারে।
[লেখক: সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক]