alt

opinion » post-editorial

সড়ক দুর্ঘটনা: কারও মৃত্যু সাধারণ, কারও মৃত্যু বিশেষ

শুভাশিস ব্যানার্জি শুভ

: রোববার, ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫

চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসের ৫ তারিখ। বাংলাদেশ ব্যুরো অব ম্যানপাওয়ার (বিএমইটি)-এর সাবেক উপ

পরিচালক গোপেশ চন্দ্র সান্যাল রাতে পারিবারিক অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ার জন্য মুক্তাগাছা থেকে

নারায়ণগঞ্জ অভিমুখে রওনা দেন। একটি মাইক্রোবাসে তার পরিবার পরিজনের প্রায় ১০ জন সদস্য ছিলের

তার যাত্রা সঙ্গী। গাজীপুরে তাদের মাইক্রোবাসটিকে পিষে দিয়ে চলে যায় নিয়ন্ত্রণহীন ট্রাক। নিমেষেই

লন্ডভন্ড হয়ে যায় সবকিছু। আশপাশের লোকজন ছুটে আসেন উদ্ধার করতে। তারা যাদের উদ্ধার করেন

তাদের দুই জন মৃত। বাকিদের অবস্থাও আশঙ্কাজনক। মৃতদের মধ্যে রয়েছেন, গোপেশ

চন্দ্র সান্যাল এবং তার পরিবারের ৬ মাস বয়সী শিশু। যদি প্রশ্ন করা হয়, কখন এবং কিভাবে এই

দুর্ঘটনা ঘটলো? সেটির ধারণা পাওয়া যায় সংশ্লিষ্ট প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায়।

এর পরের প্রশ্নটি এমনটি ঘটলো কেন? সেই উত্তর কারও জানা নেই। তবে, একটু গভীরে চিন্তা করলে এই

প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়া অসম্ভব নয়। গভীরে যাওয়ার আগে হালকা উত্তরটি হচ্ছে, ‘এমন ঘটনা

হরহামেশা-ই ঘটে। প্রতিকার নেই। প্রতিরোধও নেই। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভিকটিম মামলা করেন না, ফলে

পুলিশের এখানে করার কিছু নেই। মামলা হলে, পুলিশ ব্যবস্থা নিতে পারে, অন্যথায় পুলিশ কী করবে? কাকে

আটক করবে? কোন অভিযোগের ভিত্তিতে আটক করবে?’ হালকা প্রশ্নের উত্তরে ভারী জবাব দিয়েছেন

গাজীপুর মেট্রোপলিটন সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মেহেদী হাসান। তার কাছে এটি কোনো

উল্লেখযোগ্য ঘটনা নয়। একজন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা আর ছয় মাস বয়েসী শিশুর মৃত্যু

কোনো ব্যাপার নয়! কিন্তু সকালের এই উত্তর, এই প্রেক্ষাপট কী সন্ধ্যায় পাল্টে যেতে পারে? হ্যাঁ,

পারে। যদি কোনো প্রভাবশালী ব্যক্তি ভিকটিম হয়, তখন।

একটি জাতীয় দৈনিকের অনলাইন ভার্সনে ‘গাজীপুরে বাসের ধাক্কায় নওগাঁ ডিবির ওসি নিহত, আহত

স্ত্রী’ শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। রাত ১১ টা ৫৯ মিনিটে প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়েছে,

‘গাজীপুর মহানগরের তিনসড়ক এলাকায় রাস্তা পারাপারের সময় পথের সাথী পরিবহন নামে বাসের ধাক্কায়

নওগাঁ জেলার ডিবি পুলিশের ওসি মোস্তাফিজ হাসান নিহত হয়েছেন। শুক্রবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে গাজীপুর

পুলিশ লাইনসের সামনে এ ঘটনায় তার স্ত্রী আহত হয়েছেন। তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় পাঠানো

হয়েছে। নিহত মোস্তাফিজ হাসান (৫২) রাজশাহী মহানগরের মতিহার থানার কাজলা গ্রামের আক্তার

হোসেনের ছেলে। তিনি নওগাঁ জেলার ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চের (ডিবি) ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হিসেবে কর্মরত ছিলেন। গাজীপুর মেট্রোপলিটন সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মেহেদী হাসান বলেন,

জেলা পুলিশ লাইনসের সামনে রাস্তা পারাপারের সময় একটি বাস ধাক্কা দেয়। এতে নওগাঁ জেলার ডিবির

ওসি মোস্তাফিজ হাসান নিহত হয়েছেন। এ ঘটনায় তার স্ত্রী লতিফা জেসমিন (৪৮) গুরুতর আহত হয়েছেন।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, শুক্রবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে মোস্তাফিজ হাসান ও তার স্ত্রী গাজীপুর জেলা

পুলিশ লাইনসের বিপরীত পাশে ব্যক্তিগত প্রাইভেটকার দাঁড় করিয়ে রাস্তা পার হয়ে পুলিশ লাইনসের গেট

সংলগ্ন দোকানে আসেন। পার্কিং করে রাখা প্রাইভেটকারে ফিরে যাওয়ার সময় চান্দনা চৌরাস্তা থেকে

শিববাড়িগামী পথের সাথী পরিবহনের একটি বাস মোস্তাফিজ ও স্ত্রী লতিফা জেসমিনকে ধাক্কা দিলে

তারা গুরুতর আহত হন। তাৎক্ষণিক পুলিশ লাইনসের সামনে থাকা পুলিশ সদস্য ও স্থানীয় লোকজন তাদের

উদ্ধার করে গাজীপুর শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে যান।

সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক মোস্তাফিজকে মৃত ঘোষণা করেন। তার স্ত্রীকে গুরুতর আহত অবস্থায়

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে উন্নত চিকিৎসার জন্য পাঠানো হয়েছে। এ ঘটনায় চালকসহ বাসটিকে

আটক করা হয়েছে। নওগাঁ জেলা পুলিশ সুপার মো. সাফিউল সারোয়ার বলেন, মোস্তাফিজ হাসান ছুটিতে

স্বজনদের কাছে গিয়েছিলেন।

এই দুটি দুর্ঘটনাকে পাশাপাশি রাখলে যে সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য দেখা যাচ্ছে, সেগুলো হলো: ১.

তাৎক্ষণিকভাবে পুলিশ আহতদের উদ্ধার করে এবং গাজীপুর শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ

হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যান। ২. সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক মোস্তাফিজকে মৃত ঘোষণা করেন। ৩. তার স্ত্রীকে গুরুতর আহত অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে উন্নত চিকিৎসার

জন্য পাঠানো হয়। ৪. এ ঘটনায় চালকসহ বাসটিকে আটক করা হয়েছে। ৫. ঘাতক বাস (পথের সাথী)-কে

সেটির চালকসহ আটক করা হয়েছে। কোনো মামলা করার আগেই পুলিশ সেটা করেছে।

৬. সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মেহেদী হাসান জানান, ‘ওসি মোস্তাফিজ হাসান সড়কের পাশে

প্রাইভেটকারটি রেখে তার স্ত্রী লতিফা জেসমিনসহ পুলিশ লাইনে প্রবেশ করেন। পরে রাস্তা পার হওয়ার

সময় শিববাড়ি থেকে কাপাসিয়া গামী পথের সাথী পরিবহনের একটি যাত্রীবাহী বাস তাদের চাপা দেয়। পুলিশ

ও স্থানীয়রা তাৎক্ষণিকভাবে তাদের উদ্ধার করে শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে

নিয়ে গেলে চিকিৎসক মোস্তাফিজ হাসানকে মৃত ঘোষণা করেন।’

তিনি জানান, ‘গুরুতর আহত লতিফা জেসমিনকে প্রাথমিক চিকিৎসার পর ঢাকা মেডিকেল কলেজ

হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। এ ঘটনায় ঘাতক বাসের চালককে আটক ও বাসটি জব্দ করা হয়েছে। এ ব্যাপারে

প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। (ওসি’র এই বক্তব্যটি অপর একটি জাতীয় দৈনিকের অনলাইন

ভার্সন থেকে সংগৃহীত। সেই পত্রিকার সংবাদ শিরোনাম ‘গাজীপুরে বাসচাপায় নওগাঁর ডিবির ওসি নিহত’,

সংবাদটি রাত ০১টা ৩৮ মিনিটে প্রকাশিত)

সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্যের যে রূপ ফুটে উঠেছে, সেটি অত্যন্ত মর্মান্তিক। প্রথম ঘটনায় আহতরা পুলিশের

কোনো প্রকার সহযোগিতা পায়নি। অপরিচিত এলাকায় এবং আহত অবস্থায় হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা

নিতে নিজে যাওয়া সহজ ব্যাপার নয়। এক ঝটকায় হয়তো গুরুতর আহত হয়েও, তারা হয়তো জীবিত ছিলেন,

যাদের ‘স্পট ডেড’ ঘোষণা করা হয়েছে। নিহত গোপেশ চন্দ্র সান্যালের পরিবারের সদস্যদের সাথে কথা বলে

জানা গেছে, তার দেহটি রাস্তার পাশে দীর্ঘক্ষণ পড়ে ছিল। তাৎক্ষনিক চিকিৎসা পেলে হয়তো তিনি প্রাণে

বেঁচে যেতেন। তার দুই ছেলে। তন্ময় সান্যাল ও তমাল সান্যাল। দুইজনেই সরকারি চাকরিজীবী। তার সহধর্মীনি গায়ত্রী সান্যাল অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষিকা। নিয়তির বিধানে তারা সেই সময় সেই স্থানে ছিলেন

না। গোপেশ চন্দ্র সান্যালের মরদেহটি সৎকার করার জন্য ডেড সার্টিফিকেট জোগাড় করতে অনেক

কাঠখড় পোহাতে হয়েছে। তিনি সেই সব সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন, যেই সব সুবিধা নওগাঁ জেলার ডিবি

পুলিশের ওসি মোস্তাফিজ হাসান পেয়েছেন। তার লাশের ‘ডেথ সার্টিফিকেট’ জোগাড় করতে কসরত করতে

হয়নি, গাজীপুর পুলিশ সেটা ম্যানেজ করে দিয়েছেন।

প্রতিদিন আমরা সড়ক দুর্ঘটায় মৃত্যুর খবর দেখি। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্যমতে, ২০২০ থেকে

২০২৪ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ৩০ হাজার ৭৭৩টি। এসব দুর্ঘটনায় মারা

গেছেন ৩৩ হাজার ২৪৬ জন, এদের মধ্যে ৪ হাজার ৮০৬টি শিশু মারা গেছে। আহত হয়েছেন আরও প্রায় ৫১

হাজার মানুষ। সড়কের দুর্ঘটার এই তথ্য শতভাগ সঠিক নয়। এগুলো সাধারণত পুলিশের নথি ভিত্তিক

প্রতিবেদন। গোপেশ চন্দ্র সান্যালের ঘটনা পুলিশের নথিভুক্ত নয়। সুতরাং সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে যেসকল

প্রতিবেদন তৈরী করা হয়, সেসবে এই ঘটনাটির কোনো উল্লেখ থাকবে না। এভাবেই শত শত ঘটনার কোনো

দালিলিক প্রমাণ থাকে না। তবুও যেসব যৎসামান্য ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এই ধরণের প্রতিবেদন তৈরী

করা হয়, সেগুলো সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগের অজানা নয়। তারা কেন তাদের দায়িত্ব পালন করছেন না?

এমন অসংখ্য ‘কেন’ আছে, যেগুলোর উত্তর সাধারণ মানুষ জানলেও সংশ্লিষ্টদের দৃষ্টিগোচর হয় না।

দেশে প্রতিদিনই সড়ক দুর্ঘটনায় অগুনতি প্রাণ ঝরছে, অনেকে আহত হয়ে দুর্বিষহ জীবন কাটাচ্ছে।

দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিল কিছুতেই থামছে না। দুর্ঘটনা রোধে সরকারের পক্ষ থেকে নানান পদক্ষেপ

গ্রহণের কথা শোনা যায়, কিন্তু সেসব বাস্তবায়নের নজির নেই বললেই চলে। দুর্ঘটনা কমেনি। বেপরোয়া

যান চলাচল বন্ধ হয়নি। এতে বোঝা যায়, দুর্ঘটনা রোধের পদক্ষেপগুলোয় অথবা সেসব কার্যকর করার

ক্ষেত্রে নানান গলদ রয়েছে। এসব গলদ গুলো সংস্কার অতি জরুরি।

সড়কের নিরাপত্তা একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ইস্যু। এই ইস্যুতে সরকারের কঠোর নজরদারি

প্রয়োজন। সড়ক পরিবহন আইন যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করতে পারলে হয়তো সড়কে নিত্যদিন মৃত্যুর

সংখ্যা কিছতা হলেও কমবে। আনন্দের আমেজে ঘর থেকে বের হয়ে, সেই ঘরে লাশ হয়ে ফেরার নিষ্ঠুর

বাস্তবতা হয়তো রাতারাতি বদল হবে না। গত কয়েক দশকে দেশে সড়ক যোগাযোগব্যবস্থায় অবকাঠামোগত

উন্নয়ন হলেও কেন দেশের সড়ক-মহাসড়কগুলো ভয়ংকর মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়েছে, তা বহুল আলোচিত।

সমস্যাগুলোর সমাধানে কী করণীয় তা-ও বহুল আলোচিত। বাস্তবতা হচ্ছে, এসব আলোচনা- সমালোচনার

মারপ্যাঁচে অপরাধীরা যেমন পার পাচ্ছে, তেমনি দুর্ঘটনা রোধে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হয়নি, হচ্ছেও না।

পরিস্থিতির এহেন ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকলে, আজ না হয় কাল আমাদেরও শেষ পরিনতি হবে গোপেশ

চন্দ্র সান্যালের মতোÑযা কোনোভাবেই কাম্য নয়!

[লেখক: সংবাদকর্মী]

ঐকমত্য ছাড়াও কিছু সংস্কার সম্ভব

আবার বাড়ছে নিত্যপণ্যের দাম : সংকটে সাধারণ মানুষ

ডায়াবেটিস রোগীর সেবা ও জনসচেতনতা

ভিন্ন ধরনের ডাকসু নির্বাচন

ডাকসু নির্বাচন : পেছনে ফেলে আসি

প্রসঙ্গ : এলডিসি তালিকা থেকে বাংলাদেশের উত্তরণ

“কোপা চাটিগাঁ...”

ই-কমার্স হতে পারে প্রবৃদ্ধির ইঞ্জিন

ভারত-চীনের নতুন সমীকরণ

সাইবার যুগে মানুষের মর্যাদা ও নিরাপত্তা

ছবি

ভারত-চীন সম্পর্কে কৌশলগত উষ্ণতার সূচনা

ভারত-চীন সম্পর্কে কৌশলগত উষ্ণতার সূচনা

একজন নাগরিকের অভিমানী বিদায় ও রাষ্ট্রের নৈতিক সংকট

নিষিদ্ধ জালের অভিশাপে হুমকির মুখে সমুদ্রের জীববৈচিত্র্য

আধিপত্যবাদের শৃঙ্খল এবং পুঁজির লুন্ঠন যাদের রক্তাক্ত করে, তাদের চাই একজোটে

জার্মানি : কৃচ্ছসাধনের বোঝা জনগণের কাঁধে

পাট চাষের সংকট ও সম্ভাবনা

সামাজিক-প্রযুক্তিগত কল্পনা: বাংলাদেশের উন্নয়ন চিন্তার নতুন দিগন্ত

অগ্রক্রয় মোকদ্দমায় উভয় পক্ষের আইনি ডিফেন্স

পশ্চিমবঙ্গে শিক্ষক নিয়োগে অনিয়ম

এক সাংবাদিকের খোলা চিঠি

বাংলাদেশের দারিদ্র্য বৃদ্ধি ও অর্থনীতির চ্যালেঞ্জ

ক্লাউডবার্স্ট: মৃত্যুর বার্তা নিয়ে, আকাশ যখন কান্নায় ভেঙে পড়ে

রম্যগদ্য:“কবি এখন জেলে...”

কারা কর্তৃপক্ষের সীমাবদ্ধতা ও ‘কারেকশন সার্ভিস’-এর বাস্তবতা

ছবি

বাংলাদেশের শহর পরিকল্পনার চ্যালেঞ্জ ও করণীয়

ছবি

‘আজ ফির তুমপে পেয়ার আয়া হ্যায়’

স্বপ্নের দক্ষিণ কোরিয়া; বাংলাদেশে আন্দোলন, ভিয়েতনামের সাফল্য

ডাকসু নির্বাচন ও জাতীয় রাজনীতি

ঢাকা শহরের উষ্ণতা: সবুজ হারানোর মূল্য

তিন বাহিনী প্রধানদের আশা ও সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা

গনমাধ্যম জগতও নিষ্ঠুরতায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে!

মানবিক ও নৈতিক শিক্ষা: জাপান এক অনুসরণীয় আদর্শ

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার নতুন ট্র্যাজেডি

হোক সবুজ বিপ্লব

পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি : একজন বিধায়কের জামিন

tab

opinion » post-editorial

সড়ক দুর্ঘটনা: কারও মৃত্যু সাধারণ, কারও মৃত্যু বিশেষ

শুভাশিস ব্যানার্জি শুভ

রোববার, ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫

চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসের ৫ তারিখ। বাংলাদেশ ব্যুরো অব ম্যানপাওয়ার (বিএমইটি)-এর সাবেক উপ

পরিচালক গোপেশ চন্দ্র সান্যাল রাতে পারিবারিক অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ার জন্য মুক্তাগাছা থেকে

নারায়ণগঞ্জ অভিমুখে রওনা দেন। একটি মাইক্রোবাসে তার পরিবার পরিজনের প্রায় ১০ জন সদস্য ছিলের

তার যাত্রা সঙ্গী। গাজীপুরে তাদের মাইক্রোবাসটিকে পিষে দিয়ে চলে যায় নিয়ন্ত্রণহীন ট্রাক। নিমেষেই

লন্ডভন্ড হয়ে যায় সবকিছু। আশপাশের লোকজন ছুটে আসেন উদ্ধার করতে। তারা যাদের উদ্ধার করেন

তাদের দুই জন মৃত। বাকিদের অবস্থাও আশঙ্কাজনক। মৃতদের মধ্যে রয়েছেন, গোপেশ

চন্দ্র সান্যাল এবং তার পরিবারের ৬ মাস বয়সী শিশু। যদি প্রশ্ন করা হয়, কখন এবং কিভাবে এই

দুর্ঘটনা ঘটলো? সেটির ধারণা পাওয়া যায় সংশ্লিষ্ট প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায়।

এর পরের প্রশ্নটি এমনটি ঘটলো কেন? সেই উত্তর কারও জানা নেই। তবে, একটু গভীরে চিন্তা করলে এই

প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়া অসম্ভব নয়। গভীরে যাওয়ার আগে হালকা উত্তরটি হচ্ছে, ‘এমন ঘটনা

হরহামেশা-ই ঘটে। প্রতিকার নেই। প্রতিরোধও নেই। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভিকটিম মামলা করেন না, ফলে

পুলিশের এখানে করার কিছু নেই। মামলা হলে, পুলিশ ব্যবস্থা নিতে পারে, অন্যথায় পুলিশ কী করবে? কাকে

আটক করবে? কোন অভিযোগের ভিত্তিতে আটক করবে?’ হালকা প্রশ্নের উত্তরে ভারী জবাব দিয়েছেন

গাজীপুর মেট্রোপলিটন সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মেহেদী হাসান। তার কাছে এটি কোনো

উল্লেখযোগ্য ঘটনা নয়। একজন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা আর ছয় মাস বয়েসী শিশুর মৃত্যু

কোনো ব্যাপার নয়! কিন্তু সকালের এই উত্তর, এই প্রেক্ষাপট কী সন্ধ্যায় পাল্টে যেতে পারে? হ্যাঁ,

পারে। যদি কোনো প্রভাবশালী ব্যক্তি ভিকটিম হয়, তখন।

একটি জাতীয় দৈনিকের অনলাইন ভার্সনে ‘গাজীপুরে বাসের ধাক্কায় নওগাঁ ডিবির ওসি নিহত, আহত

স্ত্রী’ শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। রাত ১১ টা ৫৯ মিনিটে প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়েছে,

‘গাজীপুর মহানগরের তিনসড়ক এলাকায় রাস্তা পারাপারের সময় পথের সাথী পরিবহন নামে বাসের ধাক্কায়

নওগাঁ জেলার ডিবি পুলিশের ওসি মোস্তাফিজ হাসান নিহত হয়েছেন। শুক্রবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে গাজীপুর

পুলিশ লাইনসের সামনে এ ঘটনায় তার স্ত্রী আহত হয়েছেন। তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় পাঠানো

হয়েছে। নিহত মোস্তাফিজ হাসান (৫২) রাজশাহী মহানগরের মতিহার থানার কাজলা গ্রামের আক্তার

হোসেনের ছেলে। তিনি নওগাঁ জেলার ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চের (ডিবি) ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হিসেবে কর্মরত ছিলেন। গাজীপুর মেট্রোপলিটন সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মেহেদী হাসান বলেন,

জেলা পুলিশ লাইনসের সামনে রাস্তা পারাপারের সময় একটি বাস ধাক্কা দেয়। এতে নওগাঁ জেলার ডিবির

ওসি মোস্তাফিজ হাসান নিহত হয়েছেন। এ ঘটনায় তার স্ত্রী লতিফা জেসমিন (৪৮) গুরুতর আহত হয়েছেন।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, শুক্রবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে মোস্তাফিজ হাসান ও তার স্ত্রী গাজীপুর জেলা

পুলিশ লাইনসের বিপরীত পাশে ব্যক্তিগত প্রাইভেটকার দাঁড় করিয়ে রাস্তা পার হয়ে পুলিশ লাইনসের গেট

সংলগ্ন দোকানে আসেন। পার্কিং করে রাখা প্রাইভেটকারে ফিরে যাওয়ার সময় চান্দনা চৌরাস্তা থেকে

শিববাড়িগামী পথের সাথী পরিবহনের একটি বাস মোস্তাফিজ ও স্ত্রী লতিফা জেসমিনকে ধাক্কা দিলে

তারা গুরুতর আহত হন। তাৎক্ষণিক পুলিশ লাইনসের সামনে থাকা পুলিশ সদস্য ও স্থানীয় লোকজন তাদের

উদ্ধার করে গাজীপুর শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে যান।

সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক মোস্তাফিজকে মৃত ঘোষণা করেন। তার স্ত্রীকে গুরুতর আহত অবস্থায়

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে উন্নত চিকিৎসার জন্য পাঠানো হয়েছে। এ ঘটনায় চালকসহ বাসটিকে

আটক করা হয়েছে। নওগাঁ জেলা পুলিশ সুপার মো. সাফিউল সারোয়ার বলেন, মোস্তাফিজ হাসান ছুটিতে

স্বজনদের কাছে গিয়েছিলেন।

এই দুটি দুর্ঘটনাকে পাশাপাশি রাখলে যে সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য দেখা যাচ্ছে, সেগুলো হলো: ১.

তাৎক্ষণিকভাবে পুলিশ আহতদের উদ্ধার করে এবং গাজীপুর শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ

হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যান। ২. সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক মোস্তাফিজকে মৃত ঘোষণা করেন। ৩. তার স্ত্রীকে গুরুতর আহত অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে উন্নত চিকিৎসার

জন্য পাঠানো হয়। ৪. এ ঘটনায় চালকসহ বাসটিকে আটক করা হয়েছে। ৫. ঘাতক বাস (পথের সাথী)-কে

সেটির চালকসহ আটক করা হয়েছে। কোনো মামলা করার আগেই পুলিশ সেটা করেছে।

৬. সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মেহেদী হাসান জানান, ‘ওসি মোস্তাফিজ হাসান সড়কের পাশে

প্রাইভেটকারটি রেখে তার স্ত্রী লতিফা জেসমিনসহ পুলিশ লাইনে প্রবেশ করেন। পরে রাস্তা পার হওয়ার

সময় শিববাড়ি থেকে কাপাসিয়া গামী পথের সাথী পরিবহনের একটি যাত্রীবাহী বাস তাদের চাপা দেয়। পুলিশ

ও স্থানীয়রা তাৎক্ষণিকভাবে তাদের উদ্ধার করে শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে

নিয়ে গেলে চিকিৎসক মোস্তাফিজ হাসানকে মৃত ঘোষণা করেন।’

তিনি জানান, ‘গুরুতর আহত লতিফা জেসমিনকে প্রাথমিক চিকিৎসার পর ঢাকা মেডিকেল কলেজ

হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। এ ঘটনায় ঘাতক বাসের চালককে আটক ও বাসটি জব্দ করা হয়েছে। এ ব্যাপারে

প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। (ওসি’র এই বক্তব্যটি অপর একটি জাতীয় দৈনিকের অনলাইন

ভার্সন থেকে সংগৃহীত। সেই পত্রিকার সংবাদ শিরোনাম ‘গাজীপুরে বাসচাপায় নওগাঁর ডিবির ওসি নিহত’,

সংবাদটি রাত ০১টা ৩৮ মিনিটে প্রকাশিত)

সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্যের যে রূপ ফুটে উঠেছে, সেটি অত্যন্ত মর্মান্তিক। প্রথম ঘটনায় আহতরা পুলিশের

কোনো প্রকার সহযোগিতা পায়নি। অপরিচিত এলাকায় এবং আহত অবস্থায় হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা

নিতে নিজে যাওয়া সহজ ব্যাপার নয়। এক ঝটকায় হয়তো গুরুতর আহত হয়েও, তারা হয়তো জীবিত ছিলেন,

যাদের ‘স্পট ডেড’ ঘোষণা করা হয়েছে। নিহত গোপেশ চন্দ্র সান্যালের পরিবারের সদস্যদের সাথে কথা বলে

জানা গেছে, তার দেহটি রাস্তার পাশে দীর্ঘক্ষণ পড়ে ছিল। তাৎক্ষনিক চিকিৎসা পেলে হয়তো তিনি প্রাণে

বেঁচে যেতেন। তার দুই ছেলে। তন্ময় সান্যাল ও তমাল সান্যাল। দুইজনেই সরকারি চাকরিজীবী। তার সহধর্মীনি গায়ত্রী সান্যাল অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষিকা। নিয়তির বিধানে তারা সেই সময় সেই স্থানে ছিলেন

না। গোপেশ চন্দ্র সান্যালের মরদেহটি সৎকার করার জন্য ডেড সার্টিফিকেট জোগাড় করতে অনেক

কাঠখড় পোহাতে হয়েছে। তিনি সেই সব সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন, যেই সব সুবিধা নওগাঁ জেলার ডিবি

পুলিশের ওসি মোস্তাফিজ হাসান পেয়েছেন। তার লাশের ‘ডেথ সার্টিফিকেট’ জোগাড় করতে কসরত করতে

হয়নি, গাজীপুর পুলিশ সেটা ম্যানেজ করে দিয়েছেন।

প্রতিদিন আমরা সড়ক দুর্ঘটায় মৃত্যুর খবর দেখি। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্যমতে, ২০২০ থেকে

২০২৪ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ৩০ হাজার ৭৭৩টি। এসব দুর্ঘটনায় মারা

গেছেন ৩৩ হাজার ২৪৬ জন, এদের মধ্যে ৪ হাজার ৮০৬টি শিশু মারা গেছে। আহত হয়েছেন আরও প্রায় ৫১

হাজার মানুষ। সড়কের দুর্ঘটার এই তথ্য শতভাগ সঠিক নয়। এগুলো সাধারণত পুলিশের নথি ভিত্তিক

প্রতিবেদন। গোপেশ চন্দ্র সান্যালের ঘটনা পুলিশের নথিভুক্ত নয়। সুতরাং সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে যেসকল

প্রতিবেদন তৈরী করা হয়, সেসবে এই ঘটনাটির কোনো উল্লেখ থাকবে না। এভাবেই শত শত ঘটনার কোনো

দালিলিক প্রমাণ থাকে না। তবুও যেসব যৎসামান্য ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এই ধরণের প্রতিবেদন তৈরী

করা হয়, সেগুলো সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগের অজানা নয়। তারা কেন তাদের দায়িত্ব পালন করছেন না?

এমন অসংখ্য ‘কেন’ আছে, যেগুলোর উত্তর সাধারণ মানুষ জানলেও সংশ্লিষ্টদের দৃষ্টিগোচর হয় না।

দেশে প্রতিদিনই সড়ক দুর্ঘটনায় অগুনতি প্রাণ ঝরছে, অনেকে আহত হয়ে দুর্বিষহ জীবন কাটাচ্ছে।

দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিল কিছুতেই থামছে না। দুর্ঘটনা রোধে সরকারের পক্ষ থেকে নানান পদক্ষেপ

গ্রহণের কথা শোনা যায়, কিন্তু সেসব বাস্তবায়নের নজির নেই বললেই চলে। দুর্ঘটনা কমেনি। বেপরোয়া

যান চলাচল বন্ধ হয়নি। এতে বোঝা যায়, দুর্ঘটনা রোধের পদক্ষেপগুলোয় অথবা সেসব কার্যকর করার

ক্ষেত্রে নানান গলদ রয়েছে। এসব গলদ গুলো সংস্কার অতি জরুরি।

সড়কের নিরাপত্তা একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ইস্যু। এই ইস্যুতে সরকারের কঠোর নজরদারি

প্রয়োজন। সড়ক পরিবহন আইন যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করতে পারলে হয়তো সড়কে নিত্যদিন মৃত্যুর

সংখ্যা কিছতা হলেও কমবে। আনন্দের আমেজে ঘর থেকে বের হয়ে, সেই ঘরে লাশ হয়ে ফেরার নিষ্ঠুর

বাস্তবতা হয়তো রাতারাতি বদল হবে না। গত কয়েক দশকে দেশে সড়ক যোগাযোগব্যবস্থায় অবকাঠামোগত

উন্নয়ন হলেও কেন দেশের সড়ক-মহাসড়কগুলো ভয়ংকর মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়েছে, তা বহুল আলোচিত।

সমস্যাগুলোর সমাধানে কী করণীয় তা-ও বহুল আলোচিত। বাস্তবতা হচ্ছে, এসব আলোচনা- সমালোচনার

মারপ্যাঁচে অপরাধীরা যেমন পার পাচ্ছে, তেমনি দুর্ঘটনা রোধে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হয়নি, হচ্ছেও না।

পরিস্থিতির এহেন ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকলে, আজ না হয় কাল আমাদেরও শেষ পরিনতি হবে গোপেশ

চন্দ্র সান্যালের মতোÑযা কোনোভাবেই কাম্য নয়!

[লেখক: সংবাদকর্মী]

back to top