মতিউর রহমান
ডিজিটাল যুগে হাস্যরস কেবল একটি বিনোদন মাধ্যম নয়; এটি সামাজিক বাস্তবতা বোঝার, সমালোচনা করার এবং সমাজের জটিলতার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার একটি শক্তিশালী হাতিয়ার। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, স্মার্টফোন ব্যবহার এবং ইন্টারনেট প্রবেশযোগ্যতার বিস্তার অনলাইন মিম, ভাইরাল ভিডিও এবং জোকসকে কেবল বিনোদনের মাধ্যম নয়, বরং রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিফলনের গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হিসেবে গড়ে তুলেছে। এই পরিবর্তনকে গভীরভাবে উপলব্ধি করতে হলে হাস্যরসকে কেবল হাসি হিসেবে নয়, বরং ক্ষমতা, সামাজিক নিয়ম এবং সমষ্টিগত চেতনার সঙ্গে সম্পর্কিত একটি জটিল সামাজিক অনুশীলন হিসেবে দেখা অপরিহার্য।
হাস্যরসের সমাজবিজ্ঞান নিয়ে গবেষণাকারী বিখ্যাত মনীষী ক্রিস্টি ডেভিস দেখিয়েছেন যে, হাস্যরস প্রায়ই সামাজিক উত্তেজনা, দ্বন্দ্ব এবং নিয়ন্ত্রণের প্রতিফলন হিসেবে কাজ করে। বাংলাদেশের অনলাইন সংস্কৃতিতে রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক সংকটের সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয়গুলো নিয়ে অনলাইন জোকস এবং মিম ব্যাপকভাবে প্রকাশ পায়। উদাহরণস্বরূপ, ঢাকার ট্রাফিক জ্যাম নিয়ে একটি মিম কেবল হাসি দেয় না, এটি নাগরিকদের প্রতিদিনের হতাশা ও অসহায়তার অনুভূতিকে সংক্ষেপে প্রকাশ করে।
এই ধরনের অনলাইন কনটেন্ট নাগরিকদের একটি সামাজিক সম্মিলন তৈরি করে এবং সরকার বা প্রতিষ্ঠানের সমালোচনা করার একটি নিরাপদ মাধ্যম হিসেবে কাজ করে। এই মিমগুলো একটি ‘সংক্ষেপিত প্রতিবাদের ভাষা’ হিসেবে কাজ করে, যেখানে গভীর ও জটিল সমস্যাগুলোকে কয়েক সেকেন্ডের ভিজ্যুয়াল বা টেক্সটে রূপান্তরিত করা হয়। এর মধ্য দিয়ে সাধারণ মানুষ নিজেদের দৈনন্দিন জীবনের হতাশা এবং অসন্তোষ প্রকাশ করার সুযোগ পায়।
লিমোর শিফম্যান অনলাইন হাস্যরসের সৃজনশীল ও ভাইরাল প্রকৃতি নিয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি মনে করেন, মিম হলো এমন এক ধরনের সাংস্কৃতিক একক যা অনলাইনে ছড়ায়, অভিযোজিত হয় এবং নতুন আকার ধারণ করে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এটি স্পষ্টভাবে দেখা যায়Ñরাজনৈতিক ইভেন্ট, সরকারি ঘোষণাপত্র, বা সামাজিক বিতর্কের সময় মিম দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।
ভাইরাল হওয়া মিমগুলো কেবল বিনোদন নয়; নাগরিকদের অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে সমালোচনা করার একটি অপ্রচলিত মাধ্যম হিসেবেও কাজ করে। নাগরিকরা নিজস্ব সৃজনশীলতা এবং স্থানীয় প্রেক্ষাপটকে মিশিয়ে এই কনটেন্ট তৈরি ও পুনঃপ্রসারিত করে, যা এক ধরনের ডিজিটাল এজেন্সির প্রতিফলন। এটি প্রমাণ করে যে, সাধারণ মানুষ কেবল তথ্যের ভোক্তা নয়, বরং এর সক্রিয় নির্মাতা ও পরিবেশক। এই প্রক্রিয়াটি একটি গণতান্ত্রিক স্থান তৈরি করে, যেখানে সাধারণ কণ্ঠস্বরও ক্ষমতাশালী হয়।
মিখাইল বাখ্তিনের কার্নিভালেস্ক ধারণা অনলাইন হাস্যরস বোঝার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাখ্তিনের মতে, হাসি এবং অদ্ভুত চিত্রসমূহ সাময়িকভাবে সামাজিক স্তরবিন্যাসকে উল্টে দেয় এবং প্রান্তিক বা সাধারণ মানুষের ভয়ভীতিকে প্রকাশের সুযোগ দেয়। বাংলাদেশের অনলাইন সংস্কৃতিতে মিম প্রায়শই এই কার্নিভালেস্কের রূপ হিসেবে কাজ করে, যেখানে রাজনীতিবিদ, সরকারি কর্মকর্তা বা জনপ্রিয় ব্যক্তিত্বদের নিয়ে রসিকতা করা হয়।
রাজনৈতিক উত্তেজনা বা দুর্নীতি স্ক্যান্ডালের সময় ভাইরাল হওয়া মিম নাগরিকদের যৌথভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বদের ঠাট্টা করার সুযোগ দেয়, যা সরাসরি সংঘর্ষ ছাড়াই সামাজিক শক্তির অস্থায়ী বিপর্যয় তৈরি করে। এটি একটি প্রতীকী প্রতিবাদ, যা বাস্তবের ক্ষমতা কাঠামোর উপর সরাসরি প্রভাব না ফেললেও, মানুষের মনে পরিবর্তনের বীজ বপন করে এবং তাদের মধ্যে একাত্মতার বোধ তৈরি করে।
তবে, হাস্যরস সর্বদা মুক্তিদায়ক নয়। ক্রিস্টি ডেভিস এবং অন্যান্য গবেষকরা দেখিয়েছেন যে, মিম এবং অনলাইন জোকস কখনও কখনও পক্ষপাত, বৈষম্য বা সামাজিক স্তরবিন্যাসকে পুনঃস্থাপন করে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, কিছু মিম লিঙ্গ, শ্রেণি, বা জাতিগত পরিচয় নিয়ে সেগুলোকে নিপীড়নমূলক বা স্টিরিওটাইপিকাল করে তুলে ধরে। গ্রামীণ জনসংখ্যা, ভাষা-বিভাগ বা নারীদের নেতৃত্ব নিয়ে করা রসিকতা কখনও কখনও সামাজিক বৈষম্যকে আরও দৃঢ় করে। এই দ্বৈত প্রকৃতিÑপ্রতিরোধ ও নিপীড়নÑআমাদের অনলাইন হাস্যরস বিশ্লেষণে সতর্ক হতে শেখায়। এই একই হাসি যা ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করে, তা আবার প্রান্তিক গোষ্ঠীগুলোর প্রতি বিদ্যমান কুসংস্কারকেও দৃঢ় করতে পারে।
উদাহরণস্বরূপ, কিছু মিম বা জোকস গ্রামীণ মানুষের আঞ্চলিক ভাষাকে বিকৃত করে হাস্যরস তৈরি করে, যা আসলে তাদের প্রতি শহুরে সমাজের একটি সুপ্ত বৈষম্য প্রকাশ করে। একইভাবে, নারীদের কর্মক্ষেত্র বা রাজনৈতিক অবস্থানে তাদের নিয়ে তৈরি মিমগুলো প্রায়শই নারীবিদ্বেষী মনোভাব প্রকাশ করে। এই ধরনের মিমগুলো আপাতদৃষ্টিতে নির্দোষ মনে হলেও, সমাজের গভীরে প্রোথিত অসমতাকে আরও শক্তিশালী করে। এটি প্রমাণ করে যে, অনলাইন হাস্যরস একটি নিরপেক্ষ মাধ্যম নয়; এটি বিদ্যমান সামাজিক কাঠামোর প্রতিফলন।
ডিজিটাল হাস্যরসের অংশগ্রহণমূলক প্রকৃতি এটিকে প্রচলিত কৌতুক থেকে আলাদা করে। প্রচলিত কমেডির থেকে ভিন্নভাবে, অনলাইন কনটেন্ট ক্রমাগত পরিবর্তিত, পুনঃমিশ্রিত এবং নতুন আকার গ্রহণ করে। বাংলাদেশের ছাত্রসমাজ, নগর যুবসমাজ এবং প্রবাসী বাংলাদেশিরা প্রায়শই বৈশ্বিক মিম ফরম্যাটকে স্থানীয় বাস্তবতার সঙ্গে মিশিয়ে নতুন কনটেন্ট তৈরি করে। এই অংশগ্রহণমূলক সংস্কৃতি দেখায় যে, হাস্যরস একক স্রষ্টার তৈরি নয়; বরং এটি সামাজিক নেটওয়ার্কের জটিল আন্তঃক্রিয়ার ফল।
ভাইরাল হওয়ার ক্ষমতা হাস্যরসের সামাজিক প্রভাবকে আরও বাড়িয়ে দেয়। রাজনৈতিক, সামাজিক, বা পরিবেশগত সংকটের সময় বাংলাদেশের ভাইরাল মিম এবং রসিকতা নাগরিকদের সংযোগ, মত বিনিময়, এবং সমালোচনা করার সুযোগ দেয়। উদাহরণস্বরূপ, বন্যা, সড়ক দুর্ঘটনা বা রাজনৈতিক কেলেঙ্কারির সময় অনলাইন রসিকতা একটি যৌথ চাপ কমানোর এবং সামাজিক প্রতিফলনের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে। এটি একটি ডিজিটাল ‘ভেন্টিং’ প্রক্রিয়া, যা সাধারণ মানুষের হতাশা ও উদ্বেগ প্রকাশে সাহায্য করে। তবে ভাইরাল কনটেন্টের একটি বিপরীত দিকও আছেÑকোনো মিম ভুল বোঝানো, রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার বা স্বার্থান্বেষী উদ্দেশ্যে অপব্যবহার করা যেতে পারে।
ডিজিটাল হাস্যরস বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে প্রথাগত এবং আধুনিকতার মধ্যে একটি সেতু তৈরি করেছে। প্রিন্ট মিডিয়া ও রাস্তায় অনুষ্ঠিত হওয়া রসিকতা-প্রদর্শন থেকে উদ্ভূত স্যাটায়ার এখন অনলাইনে মিম এবং ভাইরাল ভিডিওর মাধ্যমে প্রকাশ পায়। এটি কেবল প্রযুক্তিগত পরিবর্তন নয়; এটি সামাজিক পরিবর্তনওÑহাস্যরস আরও ইন্টারেক্টিভ, অংশগ্রহণমূলক, এবং নেটওয়ার্কভিত্তিক হয়ে উঠেছে। এটি প্রযোজক এবং ভোক্তার মধ্যেকার সীমা মিশিয়ে দেয়, ব্যক্তিগত প্রতিফলন এবং জনসাধারণের আলোচনার মধ্যেকার ফারাককে ঘুচিয়ে দেয়।
হাস্যরস পরিচয় এবং অন্তর্ভুক্তির সঙ্গেও ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মিম কখনও কখনও “ইন-গ্রুপ” এবং “আউট-গ্রুপ” চিহ্নিত করে, যা সাংস্কৃতিক অংশগ্রহণকে প্রভাবিত করে। বাংলাদেশে, যুবসমাজ, ছাত্র আন্দোলনকারীরা এবং অনলাইন কমিউনিটি প্রায়শই তাদের প্রজন্মের দৃষ্টিভঙ্গি, ভাষাগত পরিচয়, বা রাজনৈতিক অবস্থানকে হাস্যরসের মাধ্যমে প্রকাশ করে। স্থানীয় ভাষা, জনপ্রিয় সংস্কৃতি, বা রাজনৈতিক রসিকতা মিশ্রিত মিম একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক স্থান তৈরি করে, যেখানে অভ্যন্তরীণ দর্শকরা নিজেদেরকে একটি গোষ্ঠীর অংশ মনে করে এবং স্বীকৃত বোধ করে। অন্যদিকে, যারা এই কোড বা রসিকতা বোঝে না, তারা এর বাইরে থেকে যায়। এই প্রক্রিয়া একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের মধ্যে সংহতি তৈরি করলেও, তা অন্যদের বাদও দিতে পারে।
সামাজিক মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলোতে, নির্দিষ্ট হ্যাশট্যাগ এবং ট্রেন্ডের মাধ্যমে হাস্যরস একটি আন্দোলন বা প্রতিবাদের রূপ নিতে পারে। যেমন, কোনো সরকারি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে একটি হাস্যরসাত্মক হ্যাশট্যাগ ভাইরাল হয়ে যায়, যা হাজার হাজার মানুষকে একত্রিত করে এবং একটি যৌথ কণ্ঠস্বর তৈরি করে। এই ধরনের আন্দোলনগুলো দেখায় যে, ডিজিটাল হাস্যরস কেবল হাসির জন্য নয়, বরং একটি উদ্দেশ্যমূলক সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তনের হাতিয়ার হিসেবেও কাজ করে।
বাংলাদেশের ডিজিটাল হাস্যরস সংস্কৃতি কিছু চ্যালেঞ্জেরও মুখোমুখি। প্রথমত, বাক স্বাধীনতার সীমাবদ্ধতা। যদিও হাস্যরস একটি নিরাপদ স্থান তৈরি করে, তবুও অনেক সময় রাজনৈতিক বা সামাজিক ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের কারণে ব্যবহারকারীরা আইনি ঝামেলায় পড়তে পারেন। দ্বিতীয়ত, ভুল তথ্য বা ‘ফেক নিউজ’ ছড়ানোর ঝুঁকি। কিছু মিম বা জোকস এমনভাবে তৈরি করা হয় যা মিথ্যা তথ্য ছড়ায় এবং সমাজে বিভ্রান্তি তৈরি করে। তৃতীয়ত, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অ্যালগরিদম প্রায়শই বিতর্কিত বা সংবেদনশীল বিষয়গুলোকে বেশি প্রচার করে, যা সমাজের মেরুকরণকে বাড়িয়ে তোলে।
ভবিষ্যতে, বাংলাদেশের অনলাইন হাস্যরস সম্ভবত আরও জটিল এবং বহুমুখী হয়ে উঠবে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং অন্যান্য প্রযুক্তিগত উন্নয়নের কারণে মিম তৈরির প্রক্রিয়া আরও সহজ হবে এবং এটি আরও বেশি সৃজনশীল রূপ ধারণ করবে। এর ফলে, হাস্যরসের মাধ্যমে সামাজিক ও রাজনৈতিক আলোচনা আরও প্রসারিত হবে, এবং একই সাথে নতুন ধরনের চ্যালেঞ্জও সামনে আসবে।
সার্বিকভাবে, অনলাইন হাস্যরস বাংলাদেশে একাধিক মাত্রায় কাজ করে। এটি প্রতিরোধের মাধ্যম, সমালোচনার হাতিয়ার, সামাজিক উৎকণ্ঠার প্রতিবিম্ব, এবং সামাজিক সংহতির একটি প্রক্রিয়া। ক্রিস্টি ডেভিসের তত্ত্ব, লিমোর শিফম্যানের ডিজিটাল অংশগ্রহণমূলক মডেল, এবং মিখাইল বাখ্তিনের কার্নিভালেস্ক ধারণার আলোকে আমরা দেখতে পাই, হাস্যরস কেবল বিনোদন নয়; এটি সামাজিক শক্তি, পরিচয়, এবং সাংস্কৃতিক প্রকাশের একটি জটিল মাধ্যম।
বাংলাদেশের জন্য অনলাইন হাস্যরস অধ্যয়ন করা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। রাজনৈতিক অস্থিরতা, সামাজিক বৈষম্য, এবং দ্রুত প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের মধ্যে নাগরিকরা অনলাইন মিম এবং রসিকতার মাধ্যমে নিজেদের অভিজ্ঞতা প্রকাশ করছে। এই হাস্যরস শুধুমাত্র বিনোদন নয়; এটি সামাজিক আয়না, একটি মধ্যস্থতা এবং রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সমালোচনার হাতিয়ার।
যেখানে সরাসরি প্রতিবাদ সীমিত হতে পারে, সেখানে হাস্যরস একটি শক্তিশালী মাধ্যম হয়ে দাঁড়ায়, যা সমালোচনা, একতা, এবং সচেতনতার এক অনন্য সংমিশ্রণ তৈরি করে। বাংলাদেশি সমাজের হৃদস্পন্দনকে বোঝার জন্য এই হাসি, এই রসিকতা এবং এই প্রতিক্রিয়াশীলতা একটি অপরিহার্য সামাজিক সংকেত।
[লেখক: গবেষক ও উন্নয়নকর্মী]
মতিউর রহমান
বৃহস্পতিবার, ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৫
ডিজিটাল যুগে হাস্যরস কেবল একটি বিনোদন মাধ্যম নয়; এটি সামাজিক বাস্তবতা বোঝার, সমালোচনা করার এবং সমাজের জটিলতার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার একটি শক্তিশালী হাতিয়ার। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, স্মার্টফোন ব্যবহার এবং ইন্টারনেট প্রবেশযোগ্যতার বিস্তার অনলাইন মিম, ভাইরাল ভিডিও এবং জোকসকে কেবল বিনোদনের মাধ্যম নয়, বরং রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিফলনের গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হিসেবে গড়ে তুলেছে। এই পরিবর্তনকে গভীরভাবে উপলব্ধি করতে হলে হাস্যরসকে কেবল হাসি হিসেবে নয়, বরং ক্ষমতা, সামাজিক নিয়ম এবং সমষ্টিগত চেতনার সঙ্গে সম্পর্কিত একটি জটিল সামাজিক অনুশীলন হিসেবে দেখা অপরিহার্য।
হাস্যরসের সমাজবিজ্ঞান নিয়ে গবেষণাকারী বিখ্যাত মনীষী ক্রিস্টি ডেভিস দেখিয়েছেন যে, হাস্যরস প্রায়ই সামাজিক উত্তেজনা, দ্বন্দ্ব এবং নিয়ন্ত্রণের প্রতিফলন হিসেবে কাজ করে। বাংলাদেশের অনলাইন সংস্কৃতিতে রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক সংকটের সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয়গুলো নিয়ে অনলাইন জোকস এবং মিম ব্যাপকভাবে প্রকাশ পায়। উদাহরণস্বরূপ, ঢাকার ট্রাফিক জ্যাম নিয়ে একটি মিম কেবল হাসি দেয় না, এটি নাগরিকদের প্রতিদিনের হতাশা ও অসহায়তার অনুভূতিকে সংক্ষেপে প্রকাশ করে।
এই ধরনের অনলাইন কনটেন্ট নাগরিকদের একটি সামাজিক সম্মিলন তৈরি করে এবং সরকার বা প্রতিষ্ঠানের সমালোচনা করার একটি নিরাপদ মাধ্যম হিসেবে কাজ করে। এই মিমগুলো একটি ‘সংক্ষেপিত প্রতিবাদের ভাষা’ হিসেবে কাজ করে, যেখানে গভীর ও জটিল সমস্যাগুলোকে কয়েক সেকেন্ডের ভিজ্যুয়াল বা টেক্সটে রূপান্তরিত করা হয়। এর মধ্য দিয়ে সাধারণ মানুষ নিজেদের দৈনন্দিন জীবনের হতাশা এবং অসন্তোষ প্রকাশ করার সুযোগ পায়।
লিমোর শিফম্যান অনলাইন হাস্যরসের সৃজনশীল ও ভাইরাল প্রকৃতি নিয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি মনে করেন, মিম হলো এমন এক ধরনের সাংস্কৃতিক একক যা অনলাইনে ছড়ায়, অভিযোজিত হয় এবং নতুন আকার ধারণ করে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এটি স্পষ্টভাবে দেখা যায়Ñরাজনৈতিক ইভেন্ট, সরকারি ঘোষণাপত্র, বা সামাজিক বিতর্কের সময় মিম দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।
ভাইরাল হওয়া মিমগুলো কেবল বিনোদন নয়; নাগরিকদের অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে সমালোচনা করার একটি অপ্রচলিত মাধ্যম হিসেবেও কাজ করে। নাগরিকরা নিজস্ব সৃজনশীলতা এবং স্থানীয় প্রেক্ষাপটকে মিশিয়ে এই কনটেন্ট তৈরি ও পুনঃপ্রসারিত করে, যা এক ধরনের ডিজিটাল এজেন্সির প্রতিফলন। এটি প্রমাণ করে যে, সাধারণ মানুষ কেবল তথ্যের ভোক্তা নয়, বরং এর সক্রিয় নির্মাতা ও পরিবেশক। এই প্রক্রিয়াটি একটি গণতান্ত্রিক স্থান তৈরি করে, যেখানে সাধারণ কণ্ঠস্বরও ক্ষমতাশালী হয়।
মিখাইল বাখ্তিনের কার্নিভালেস্ক ধারণা অনলাইন হাস্যরস বোঝার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাখ্তিনের মতে, হাসি এবং অদ্ভুত চিত্রসমূহ সাময়িকভাবে সামাজিক স্তরবিন্যাসকে উল্টে দেয় এবং প্রান্তিক বা সাধারণ মানুষের ভয়ভীতিকে প্রকাশের সুযোগ দেয়। বাংলাদেশের অনলাইন সংস্কৃতিতে মিম প্রায়শই এই কার্নিভালেস্কের রূপ হিসেবে কাজ করে, যেখানে রাজনীতিবিদ, সরকারি কর্মকর্তা বা জনপ্রিয় ব্যক্তিত্বদের নিয়ে রসিকতা করা হয়।
রাজনৈতিক উত্তেজনা বা দুর্নীতি স্ক্যান্ডালের সময় ভাইরাল হওয়া মিম নাগরিকদের যৌথভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বদের ঠাট্টা করার সুযোগ দেয়, যা সরাসরি সংঘর্ষ ছাড়াই সামাজিক শক্তির অস্থায়ী বিপর্যয় তৈরি করে। এটি একটি প্রতীকী প্রতিবাদ, যা বাস্তবের ক্ষমতা কাঠামোর উপর সরাসরি প্রভাব না ফেললেও, মানুষের মনে পরিবর্তনের বীজ বপন করে এবং তাদের মধ্যে একাত্মতার বোধ তৈরি করে।
তবে, হাস্যরস সর্বদা মুক্তিদায়ক নয়। ক্রিস্টি ডেভিস এবং অন্যান্য গবেষকরা দেখিয়েছেন যে, মিম এবং অনলাইন জোকস কখনও কখনও পক্ষপাত, বৈষম্য বা সামাজিক স্তরবিন্যাসকে পুনঃস্থাপন করে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, কিছু মিম লিঙ্গ, শ্রেণি, বা জাতিগত পরিচয় নিয়ে সেগুলোকে নিপীড়নমূলক বা স্টিরিওটাইপিকাল করে তুলে ধরে। গ্রামীণ জনসংখ্যা, ভাষা-বিভাগ বা নারীদের নেতৃত্ব নিয়ে করা রসিকতা কখনও কখনও সামাজিক বৈষম্যকে আরও দৃঢ় করে। এই দ্বৈত প্রকৃতিÑপ্রতিরোধ ও নিপীড়নÑআমাদের অনলাইন হাস্যরস বিশ্লেষণে সতর্ক হতে শেখায়। এই একই হাসি যা ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করে, তা আবার প্রান্তিক গোষ্ঠীগুলোর প্রতি বিদ্যমান কুসংস্কারকেও দৃঢ় করতে পারে।
উদাহরণস্বরূপ, কিছু মিম বা জোকস গ্রামীণ মানুষের আঞ্চলিক ভাষাকে বিকৃত করে হাস্যরস তৈরি করে, যা আসলে তাদের প্রতি শহুরে সমাজের একটি সুপ্ত বৈষম্য প্রকাশ করে। একইভাবে, নারীদের কর্মক্ষেত্র বা রাজনৈতিক অবস্থানে তাদের নিয়ে তৈরি মিমগুলো প্রায়শই নারীবিদ্বেষী মনোভাব প্রকাশ করে। এই ধরনের মিমগুলো আপাতদৃষ্টিতে নির্দোষ মনে হলেও, সমাজের গভীরে প্রোথিত অসমতাকে আরও শক্তিশালী করে। এটি প্রমাণ করে যে, অনলাইন হাস্যরস একটি নিরপেক্ষ মাধ্যম নয়; এটি বিদ্যমান সামাজিক কাঠামোর প্রতিফলন।
ডিজিটাল হাস্যরসের অংশগ্রহণমূলক প্রকৃতি এটিকে প্রচলিত কৌতুক থেকে আলাদা করে। প্রচলিত কমেডির থেকে ভিন্নভাবে, অনলাইন কনটেন্ট ক্রমাগত পরিবর্তিত, পুনঃমিশ্রিত এবং নতুন আকার গ্রহণ করে। বাংলাদেশের ছাত্রসমাজ, নগর যুবসমাজ এবং প্রবাসী বাংলাদেশিরা প্রায়শই বৈশ্বিক মিম ফরম্যাটকে স্থানীয় বাস্তবতার সঙ্গে মিশিয়ে নতুন কনটেন্ট তৈরি করে। এই অংশগ্রহণমূলক সংস্কৃতি দেখায় যে, হাস্যরস একক স্রষ্টার তৈরি নয়; বরং এটি সামাজিক নেটওয়ার্কের জটিল আন্তঃক্রিয়ার ফল।
ভাইরাল হওয়ার ক্ষমতা হাস্যরসের সামাজিক প্রভাবকে আরও বাড়িয়ে দেয়। রাজনৈতিক, সামাজিক, বা পরিবেশগত সংকটের সময় বাংলাদেশের ভাইরাল মিম এবং রসিকতা নাগরিকদের সংযোগ, মত বিনিময়, এবং সমালোচনা করার সুযোগ দেয়। উদাহরণস্বরূপ, বন্যা, সড়ক দুর্ঘটনা বা রাজনৈতিক কেলেঙ্কারির সময় অনলাইন রসিকতা একটি যৌথ চাপ কমানোর এবং সামাজিক প্রতিফলনের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে। এটি একটি ডিজিটাল ‘ভেন্টিং’ প্রক্রিয়া, যা সাধারণ মানুষের হতাশা ও উদ্বেগ প্রকাশে সাহায্য করে। তবে ভাইরাল কনটেন্টের একটি বিপরীত দিকও আছেÑকোনো মিম ভুল বোঝানো, রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার বা স্বার্থান্বেষী উদ্দেশ্যে অপব্যবহার করা যেতে পারে।
ডিজিটাল হাস্যরস বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে প্রথাগত এবং আধুনিকতার মধ্যে একটি সেতু তৈরি করেছে। প্রিন্ট মিডিয়া ও রাস্তায় অনুষ্ঠিত হওয়া রসিকতা-প্রদর্শন থেকে উদ্ভূত স্যাটায়ার এখন অনলাইনে মিম এবং ভাইরাল ভিডিওর মাধ্যমে প্রকাশ পায়। এটি কেবল প্রযুক্তিগত পরিবর্তন নয়; এটি সামাজিক পরিবর্তনওÑহাস্যরস আরও ইন্টারেক্টিভ, অংশগ্রহণমূলক, এবং নেটওয়ার্কভিত্তিক হয়ে উঠেছে। এটি প্রযোজক এবং ভোক্তার মধ্যেকার সীমা মিশিয়ে দেয়, ব্যক্তিগত প্রতিফলন এবং জনসাধারণের আলোচনার মধ্যেকার ফারাককে ঘুচিয়ে দেয়।
হাস্যরস পরিচয় এবং অন্তর্ভুক্তির সঙ্গেও ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মিম কখনও কখনও “ইন-গ্রুপ” এবং “আউট-গ্রুপ” চিহ্নিত করে, যা সাংস্কৃতিক অংশগ্রহণকে প্রভাবিত করে। বাংলাদেশে, যুবসমাজ, ছাত্র আন্দোলনকারীরা এবং অনলাইন কমিউনিটি প্রায়শই তাদের প্রজন্মের দৃষ্টিভঙ্গি, ভাষাগত পরিচয়, বা রাজনৈতিক অবস্থানকে হাস্যরসের মাধ্যমে প্রকাশ করে। স্থানীয় ভাষা, জনপ্রিয় সংস্কৃতি, বা রাজনৈতিক রসিকতা মিশ্রিত মিম একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক স্থান তৈরি করে, যেখানে অভ্যন্তরীণ দর্শকরা নিজেদেরকে একটি গোষ্ঠীর অংশ মনে করে এবং স্বীকৃত বোধ করে। অন্যদিকে, যারা এই কোড বা রসিকতা বোঝে না, তারা এর বাইরে থেকে যায়। এই প্রক্রিয়া একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের মধ্যে সংহতি তৈরি করলেও, তা অন্যদের বাদও দিতে পারে।
সামাজিক মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলোতে, নির্দিষ্ট হ্যাশট্যাগ এবং ট্রেন্ডের মাধ্যমে হাস্যরস একটি আন্দোলন বা প্রতিবাদের রূপ নিতে পারে। যেমন, কোনো সরকারি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে একটি হাস্যরসাত্মক হ্যাশট্যাগ ভাইরাল হয়ে যায়, যা হাজার হাজার মানুষকে একত্রিত করে এবং একটি যৌথ কণ্ঠস্বর তৈরি করে। এই ধরনের আন্দোলনগুলো দেখায় যে, ডিজিটাল হাস্যরস কেবল হাসির জন্য নয়, বরং একটি উদ্দেশ্যমূলক সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তনের হাতিয়ার হিসেবেও কাজ করে।
বাংলাদেশের ডিজিটাল হাস্যরস সংস্কৃতি কিছু চ্যালেঞ্জেরও মুখোমুখি। প্রথমত, বাক স্বাধীনতার সীমাবদ্ধতা। যদিও হাস্যরস একটি নিরাপদ স্থান তৈরি করে, তবুও অনেক সময় রাজনৈতিক বা সামাজিক ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের কারণে ব্যবহারকারীরা আইনি ঝামেলায় পড়তে পারেন। দ্বিতীয়ত, ভুল তথ্য বা ‘ফেক নিউজ’ ছড়ানোর ঝুঁকি। কিছু মিম বা জোকস এমনভাবে তৈরি করা হয় যা মিথ্যা তথ্য ছড়ায় এবং সমাজে বিভ্রান্তি তৈরি করে। তৃতীয়ত, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অ্যালগরিদম প্রায়শই বিতর্কিত বা সংবেদনশীল বিষয়গুলোকে বেশি প্রচার করে, যা সমাজের মেরুকরণকে বাড়িয়ে তোলে।
ভবিষ্যতে, বাংলাদেশের অনলাইন হাস্যরস সম্ভবত আরও জটিল এবং বহুমুখী হয়ে উঠবে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং অন্যান্য প্রযুক্তিগত উন্নয়নের কারণে মিম তৈরির প্রক্রিয়া আরও সহজ হবে এবং এটি আরও বেশি সৃজনশীল রূপ ধারণ করবে। এর ফলে, হাস্যরসের মাধ্যমে সামাজিক ও রাজনৈতিক আলোচনা আরও প্রসারিত হবে, এবং একই সাথে নতুন ধরনের চ্যালেঞ্জও সামনে আসবে।
সার্বিকভাবে, অনলাইন হাস্যরস বাংলাদেশে একাধিক মাত্রায় কাজ করে। এটি প্রতিরোধের মাধ্যম, সমালোচনার হাতিয়ার, সামাজিক উৎকণ্ঠার প্রতিবিম্ব, এবং সামাজিক সংহতির একটি প্রক্রিয়া। ক্রিস্টি ডেভিসের তত্ত্ব, লিমোর শিফম্যানের ডিজিটাল অংশগ্রহণমূলক মডেল, এবং মিখাইল বাখ্তিনের কার্নিভালেস্ক ধারণার আলোকে আমরা দেখতে পাই, হাস্যরস কেবল বিনোদন নয়; এটি সামাজিক শক্তি, পরিচয়, এবং সাংস্কৃতিক প্রকাশের একটি জটিল মাধ্যম।
বাংলাদেশের জন্য অনলাইন হাস্যরস অধ্যয়ন করা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। রাজনৈতিক অস্থিরতা, সামাজিক বৈষম্য, এবং দ্রুত প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের মধ্যে নাগরিকরা অনলাইন মিম এবং রসিকতার মাধ্যমে নিজেদের অভিজ্ঞতা প্রকাশ করছে। এই হাস্যরস শুধুমাত্র বিনোদন নয়; এটি সামাজিক আয়না, একটি মধ্যস্থতা এবং রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সমালোচনার হাতিয়ার।
যেখানে সরাসরি প্রতিবাদ সীমিত হতে পারে, সেখানে হাস্যরস একটি শক্তিশালী মাধ্যম হয়ে দাঁড়ায়, যা সমালোচনা, একতা, এবং সচেতনতার এক অনন্য সংমিশ্রণ তৈরি করে। বাংলাদেশি সমাজের হৃদস্পন্দনকে বোঝার জন্য এই হাসি, এই রসিকতা এবং এই প্রতিক্রিয়াশীলতা একটি অপরিহার্য সামাজিক সংকেত।
[লেখক: গবেষক ও উন্নয়নকর্মী]