মিথুশিলাক মুরমু
গতবছর ২৩ নভেম্বর রাজশাহী বিভাগীয় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর কালচারাল একাডেমি ও পাহাড়িয়া পরিষদের যৌথ আয়োজনে পাহাড়িয়া জাতিগোষ্ঠীর মাতৃভাষার কিবোর্ড উদ্বোধন করা হয়েছিল। প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিভাগীয় কমিশনার। তিনি তার বক্তব্যে বলেছিলেন, ‘মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির সম্পর্ক তৈরি করতে ভাষা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। একমাত্র ভাষার কারণেই মানুষ অন্যান্য জীবের থেকে বিশেষ স্বীকৃতি পেয়েছে। তাই ভাষা প্রযুক্তি ও প্রকৃতির সঙ্গে সুসম্পর্ক তৈরি করেছে। এ ক্ষেত্রে যে জাতি যত বেশি ভাষা জানবে, সেই জাতি তত বেশি তথ্য ও জ্ঞানে সমৃদ্ধ হবে। আজ থেকে পাহাড়িয়া ভাষাটি দক্ষিণ এশিয়ার নবীনতম ভাষা হিসেবে ডিজিটাল যুগে প্রবেশ করল। এর মধ্য দিয়ে পাহাড়িয়া মাতৃভাষার কিবোর্ডটি বিশ্বে ২৯৫তম কিবোর্ড হিসেবে স্বীকৃতি পেল। বিশ্বে ভবিষ্যৎ তরুণ প্রজন্মকে পাহাড়িয়া ভাষার সঙ্গে পরিচিত করতে এই কিবোর্ড সহযোগিতা করবে।’
কয়েক মাস যেতে না যেতেই আদিবাসী পাহাড়িয়ারা এখন অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। মানুষ যদি বেঁচে না থাকে, বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে; তাহলে ভাষা কীভাবে চর্চিত হবে? ভাষার সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক বিদ্যমান, একমাত্র মানুষ ঐক্যবদ্ধভাবে বেঁচে থাকলে ভাষার বেঁচে থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। উদ্বোধনের সেই জায়গা থেকে মাত্র ১ কিলোমিটারের মধ্যে বসবাসকারী আদিবাসী পাহাড়িয়ারা আজ চরমভাবে অস্তিত্ব সংকটে পড়েছেন। ক্ষমতা ও প্রভাবশালীদের দাপটে অসহায়, নিরুপায় হয়ে পড়েছে আদিবাসী পাহাড়িয়ারা।
রাজশাহী সিটি করপোরেশনের ২ নম্বর ওয়ার্ডের মোল্লাপাড়ায় ৫৩ বছর ধরে ১৬ কাঠা জমির ওপর আদিবাসী পাড়ায় বসবাস করছেন পাহাড়িয়ারা। প্রথমদিকে ৬টি পরিবার থাকলেও প্রজন্ম বেড়ে বর্তমানে ১৬ পরিবারে বৃদ্ধি পেয়েছে। এই অবস্থায় ভিটে থেকে উচ্ছেদের চূড়ান্ত নোটিস দিয়েছেন স্থানীয় ক্ষমতাশালী এক ব্যক্তি। পার্শ্ববর্তী হড়গ্রামের বাসিন্দা সেই ব্যক্তির দাবি, তিনি ১৯৯৪ খ্রিস্টাব্দে জমিটি কিনেছেন। আদিবাসীদের ভাষ্য অনুযায়ী, ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় অনেক আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর পরিবার ভারতে আশ্রিত হয়েছিল। ৯ মাস পর মুক্ত ও স্বাধীন দেশে প্রত্যাবর্তিত হলেও বসতভিটায় স্থান হয়নি। এরপর ইন্দ্র ধুপি নামের এক হিন্দু ব্যক্তি তার ১৬ কাঠা জমিতে ছয়টি পরিবারকে বসবাসের সুযোগ দেন। আশ্রয়দাতা মালিক ইন্দ্র ধুপি অনেক আগেই মৃত্যুবরণ করেছেন। সময় ও সুযোগ বুঝে এখন সেই প্রভাবশালী ব্যক্তি দাবি করছেন, জমির মালিক ইন্দ্র ধুপি মৃত্যুর আগে এই জমি তার কাছে বিক্রি করে গিয়েছেন। সিটি করপোরেশন একটি নলকূপ ও দুটি পাকা শৌচাগার নির্মাণ করে দিয়েছে। আদিবাসীরা জানান, বছর দুয়েক আগে তাদের বাড়ি ছাড়তে বললে তৎকালীন ওয়ার্ড কাউন্সিলর দু’পক্ষকে নিয়ে সালিশে বসেছিলেন। সেদিন কাগজপত্র পর্যালোচনা করে কাউন্সিলর বলেছিলেন, এই দলিল জাল। তখন কৌশলে কাউন্সিলরের কার্যালয় থেকে সটকে পড়েন সেই ব্যক্তি। এরপর তাদের আর উচ্ছেদের চেষ্টা করা হয়নি। গত বছর ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটলে ৮ আগস্ট সেই ব্যক্তি সদলবলে আদিবাসী পল্লিতে এসে হানা দেন এবং জায়গা ছেড়ে দেওয়ার হুমকি দিয়ে যান। ঐক্যবদ্ধ আদিবাসী পাহাড়িয়ারা বাড়ি ছাড়তে না চাইলে তিনি এক পর্যায়ে টাকা দেওয়ারও প্রস্তাব দেন।
পূর্বের কথানুযায়ী, বিগত ৫ সেপ্টেম্বর ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ হওয়া ১৬টি পরিবারকে শেষমেশ খাসি খাওয়ানোর কথা জানিয়েছিলেন উক্ত ব্যক্তি। ৫ সেপ্টেম্বর শুক্রবার ভোজের পর তাদের বাড়ি ছাড়ার জন্য রবিবার (সেপ্টেম্বর ৭) পর্যন্ত সময় বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। তার হিসাবে, যুদ্ধের পর ছয়টা পরিবার ছিল, ওই ছয় পরিবার ধরে ৫ লাখ টাকা করে দেবেন। পরিবারের ছেলেরা টাকা ভাগ করে নেবেন। পরে অবশ্য ছয় বাড়ির প্রত্যেককে ৬ লাখ টাকা করে দিতে চেয়েছেন তিনি। সর্বশেষ জানা যায়, কয়েকজনকে নগদ অর্থ বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। বাড়ি ছাড়তে প্রথমে তিন মাস সময় দেওয়া হয়েছিল। এরপর ১৫ দিন, ৭ দিন ও ১০ দিন করে সময় বাড়ানো হয়েছে। মাসখানেক আগে টাকাও দেওয়া হয়েছে। সবশেষে ১০ দিনের সময় শেষ হয় শুক্রবার ৫ সেপ্টেম্বর। সেদিন খাসি কেটে খাওয়ানো কথা ছিল। গত রবিবারের মধ্যে তাদের এলাকা ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা ছিল। ইতোপূর্বে অবশ্য মুরগির মাংস দিয়ে ভোজ আয়োজনের আকাক্সক্ষা প্রকাশ করেছিলেন গ্রামবাসী। অর্থাৎ খাসির মাংস দিয়ে ভূরিভোজের আয়োজন করে জায়গা ছেড়ে দেওয়ার সব রকম নকশা প্রণীত হয়েছিল। ইতোমধ্যেই রাজনৈতিক দলের পরিচিত এই ব্যক্তির চাপে প্রাণের ভয়ে ৩টি পরিবার অন্যত্র চলে গিয়েছে। বিষয়টি সংবাদপত্রের এবং মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানের নজরে এলে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন হস্তক্ষেপ করে। জমির মালিকানা নিয়ে ফয়সালা না হওয়া পর্যন্ত ১৩টি আদিবাসী পাহাড়িয়া পরিবার সেখানেই থাকবে বলে জানিয়েছে পুলিশ। ‘আপনারা কেন থানায় যাননি?’Ñ এমন প্রশ্নের উত্তরে মিল্কি বিশ্বাস পুলিশের কাছে বলেন, ‘উক্ত প্রভাবশালী ব্যক্তি বলেছেন যে তোমরা যদি বাড়াবাড়ি করো, যেটুকু টাকা দিচ্ছি, সেটাও দেব না। এটার জন্য আমরা কোনো জায়গায় যেতে পারলাম না। আমরা টাকা নিতে বাধ্য হলাম।’
এখন প্রশ্ন হচ্ছেÑ আদিবাসী পাড়ার জমিটি যদি কেউ ১৯৯৪ খ্রিস্টাব্দে কিনে থাকেন, তাহলে নিশ্চয়ই তার দলিল দস্তাবেজ থাকবে! কাউন্সিলর অফিসে কাগজপত্র খোলা চোখে দেখার পর জাল দলিল হিসেবে আখ্যায়িত হলে তিনি উদ্বিগ্ন হয়ে নিরবে স্থান ত্যাগ করেছিলেন। এটি সহজেই অনুমেয় যে, কাগজপত্রের দুর্বলতা থাকলে হৃদয়ের উদ্বিগ্নতা বাড়ে, সত্যকে প্রতিষ্ঠা করতে পিছু হটা হয়; আদিবাসী পাড়ার ক্ষেত্রে সেটিই দেখেছি। স্থানীয় কাউন্সিলরের অফিসে কিংবা আদালতের মধ্যে দিয়েও ক্রয়কৃত জায়গাটিতে অধিকার প্রতিষ্ঠায় তাকে লড়তে দেখিনি। তাহলে নিশ্চয়ই এখানে কোনো না কোনো গূঢ় রহস্য লুকানো রয়েছে!
দ্বিতীয়তÑ সেই ব্যক্তিআদিবাসী পাড়ার পাহাড়িয়াদের কেন ও কোন শর্তে অর্থ দিতে সম্মতি জ্ঞাপন করেছেন! তার তথ্যানুযায়ী, আদিবাসী পাহাড়িয়ারা তার হাত থেকে অর্থ গ্রহণ করেছেন। সত্যিকার অর্থেই যদি তিনি ১৬ কাঠা জমির আইনগত স্বত্বাধিকারী হয়ে থাকেন, তাহলে কেন, কোন স্বার্থে আরো কয়েক লক্ষ টাকা দিয়ে জায়গাটি ছেড়ে দিতে বাধ্য করছিলেন? এটি সন্দেহজনক এবং অবিশ্বাস্য। কেন বল প্রয়োগের মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছেন?
তৃতীয়তÑ খাসি মেরে ভূরিভোজের আয়োজন করে বিদায় অনুষ্ঠানের আয়োজন করা কী সত্যিই আদিবাসী পাহাড়িয়ারা চেয়েছিলেন? যে জায়গায় দশকের পর দশক বসবাস করেছেন, তিনটি প্রজন্ম থেকেছেন; সে জায়গাটির মায়া অনেক বড়। কোনোকালেই শুনিনি যে, আদিবাসীদের স্থানচ্যুত করতে উৎসব হয়েছে, খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন হয়েছে; আদিবাসীদের খাওয়ানোর মধ্য দিয়ে কী দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে চেয়েছেন! এটি ঠিক যে, আদিবাসীদের মুখ বন্ধ করে প্রবল প্রতিরোধও বন্ধ করতে চেয়েছেন!
চতুর্থতÑ আদিবাসী পাড়ার ১৬ কাঠা জমির মূল্য এখন কয়েক কোটি টাকা। নীলনকশা প্রণয়নকারী ব্যক্তি হিসাব করেছেন, কয়েক লক্ষ টাকা দিয়ে যদি কোটি টাকার জায়গা দখল করা যায়, তাহলে মন্দ কী? সত্যিই আদিবাসীদের ছলে-বলে-কৌশলে অর্থ গ্রহণে সম্মত করিয়েছেন। আদিবাসীরা যদি নিরবে স্থান ত্যাগ করে, তাহলে সেটি হবে তার জন্য বাড়তি পাওনা। সবকিছুই সুন্দরভাবে এগোচ্ছিল, হঠাৎ করেই শ্রাবণের বাতাস ওলটপালট করে দিয়েছে। মিডিয়া থেকে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠান, আদিবাসী সংগঠনের প্রতিবাদ এবং স্থানীয় প্রশাসনের হস্তক্ষেপÑ প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটিত হলেই ভূরিভোজের রহস্যও উন্মোচিত হবে।
পঞ্চমতÑ আদিবাসীরা সহজ-সরল এবং ঝামেলামুক্ত জীবন অতিক্রান্ত করতে আগ্রহী হন। পাহাড়িয়ারা দেখেছেন, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে অনেক জায়গায় আদিবাসীরা নিগৃহীত, অত্যাচারিত এবং উচ্ছেদের শিকার হয়েছেন; আইনের কোনো শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ক্ষমতাশালীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় আদিবাসীরা টিকতে পারেন না; আর সেজন্যই ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দিয়ে গ্রামের বিশনি বিশ্বাস বলেছেন, ‘জন্ম জায়গা ছেড়ে কেউ চলে যেতে চায়? কেহু তো চাই না’। আদিবাসী পাহাড়িয়াদেরকে আদিবাসী পাড়া ছাড়ার পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে, এখন সময়ের অপেক্ষা মাত্র!
রাজনৈতিক পেশিশক্তির অধিকারী উক্ত ব্যক্তির দীর্ঘদিনের স্বপ্ন আদিবাসীদের জায়গাটি করায়ত্ত করার, যার জন্যে আদিবাসীদের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়েছেন। আদিবাসীরা এ দেশের নাগরিক, নাগরিক হিসেবে অবশ্যই ন্যায্যতা প্রাপ্তির প্রত্যাশা করতে পারেন। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে আমাদের নিবেদন, বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে থাকা আদিবাসী পাহাড়িয়াদের রক্ষার্থে উদ্যোগ গ্রহণ করুন। গ্রামের প্রবীণ ব্যক্তি ফুলমণি বিশ্বাস বলেছেন, ‘কোথায় যাব? আমরা তো এখুন আন্ধার ঘরে হাইতড়াই তো পাছি না। আন্ধার ঘরে মানুষ কিছু পায় কি না? ওই রকম আমরাও কিছু খুঁইজে পাছি না’? অশীতিপর ফুলমণি যেন সত্যিটা জেনে যান, অন্ধকারে থেকে অনিশ্চিত জীবনের সমাপ্তি হোক নিরন্তর শান্তি ও নিশ্চিন্তে।
[লেখক: কলামিস্ট]
মিথুশিলাক মুরমু
বৃহস্পতিবার, ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৫
গতবছর ২৩ নভেম্বর রাজশাহী বিভাগীয় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর কালচারাল একাডেমি ও পাহাড়িয়া পরিষদের যৌথ আয়োজনে পাহাড়িয়া জাতিগোষ্ঠীর মাতৃভাষার কিবোর্ড উদ্বোধন করা হয়েছিল। প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিভাগীয় কমিশনার। তিনি তার বক্তব্যে বলেছিলেন, ‘মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির সম্পর্ক তৈরি করতে ভাষা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। একমাত্র ভাষার কারণেই মানুষ অন্যান্য জীবের থেকে বিশেষ স্বীকৃতি পেয়েছে। তাই ভাষা প্রযুক্তি ও প্রকৃতির সঙ্গে সুসম্পর্ক তৈরি করেছে। এ ক্ষেত্রে যে জাতি যত বেশি ভাষা জানবে, সেই জাতি তত বেশি তথ্য ও জ্ঞানে সমৃদ্ধ হবে। আজ থেকে পাহাড়িয়া ভাষাটি দক্ষিণ এশিয়ার নবীনতম ভাষা হিসেবে ডিজিটাল যুগে প্রবেশ করল। এর মধ্য দিয়ে পাহাড়িয়া মাতৃভাষার কিবোর্ডটি বিশ্বে ২৯৫তম কিবোর্ড হিসেবে স্বীকৃতি পেল। বিশ্বে ভবিষ্যৎ তরুণ প্রজন্মকে পাহাড়িয়া ভাষার সঙ্গে পরিচিত করতে এই কিবোর্ড সহযোগিতা করবে।’
কয়েক মাস যেতে না যেতেই আদিবাসী পাহাড়িয়ারা এখন অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। মানুষ যদি বেঁচে না থাকে, বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে; তাহলে ভাষা কীভাবে চর্চিত হবে? ভাষার সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক বিদ্যমান, একমাত্র মানুষ ঐক্যবদ্ধভাবে বেঁচে থাকলে ভাষার বেঁচে থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। উদ্বোধনের সেই জায়গা থেকে মাত্র ১ কিলোমিটারের মধ্যে বসবাসকারী আদিবাসী পাহাড়িয়ারা আজ চরমভাবে অস্তিত্ব সংকটে পড়েছেন। ক্ষমতা ও প্রভাবশালীদের দাপটে অসহায়, নিরুপায় হয়ে পড়েছে আদিবাসী পাহাড়িয়ারা।
রাজশাহী সিটি করপোরেশনের ২ নম্বর ওয়ার্ডের মোল্লাপাড়ায় ৫৩ বছর ধরে ১৬ কাঠা জমির ওপর আদিবাসী পাড়ায় বসবাস করছেন পাহাড়িয়ারা। প্রথমদিকে ৬টি পরিবার থাকলেও প্রজন্ম বেড়ে বর্তমানে ১৬ পরিবারে বৃদ্ধি পেয়েছে। এই অবস্থায় ভিটে থেকে উচ্ছেদের চূড়ান্ত নোটিস দিয়েছেন স্থানীয় ক্ষমতাশালী এক ব্যক্তি। পার্শ্ববর্তী হড়গ্রামের বাসিন্দা সেই ব্যক্তির দাবি, তিনি ১৯৯৪ খ্রিস্টাব্দে জমিটি কিনেছেন। আদিবাসীদের ভাষ্য অনুযায়ী, ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় অনেক আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর পরিবার ভারতে আশ্রিত হয়েছিল। ৯ মাস পর মুক্ত ও স্বাধীন দেশে প্রত্যাবর্তিত হলেও বসতভিটায় স্থান হয়নি। এরপর ইন্দ্র ধুপি নামের এক হিন্দু ব্যক্তি তার ১৬ কাঠা জমিতে ছয়টি পরিবারকে বসবাসের সুযোগ দেন। আশ্রয়দাতা মালিক ইন্দ্র ধুপি অনেক আগেই মৃত্যুবরণ করেছেন। সময় ও সুযোগ বুঝে এখন সেই প্রভাবশালী ব্যক্তি দাবি করছেন, জমির মালিক ইন্দ্র ধুপি মৃত্যুর আগে এই জমি তার কাছে বিক্রি করে গিয়েছেন। সিটি করপোরেশন একটি নলকূপ ও দুটি পাকা শৌচাগার নির্মাণ করে দিয়েছে। আদিবাসীরা জানান, বছর দুয়েক আগে তাদের বাড়ি ছাড়তে বললে তৎকালীন ওয়ার্ড কাউন্সিলর দু’পক্ষকে নিয়ে সালিশে বসেছিলেন। সেদিন কাগজপত্র পর্যালোচনা করে কাউন্সিলর বলেছিলেন, এই দলিল জাল। তখন কৌশলে কাউন্সিলরের কার্যালয় থেকে সটকে পড়েন সেই ব্যক্তি। এরপর তাদের আর উচ্ছেদের চেষ্টা করা হয়নি। গত বছর ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটলে ৮ আগস্ট সেই ব্যক্তি সদলবলে আদিবাসী পল্লিতে এসে হানা দেন এবং জায়গা ছেড়ে দেওয়ার হুমকি দিয়ে যান। ঐক্যবদ্ধ আদিবাসী পাহাড়িয়ারা বাড়ি ছাড়তে না চাইলে তিনি এক পর্যায়ে টাকা দেওয়ারও প্রস্তাব দেন।
পূর্বের কথানুযায়ী, বিগত ৫ সেপ্টেম্বর ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ হওয়া ১৬টি পরিবারকে শেষমেশ খাসি খাওয়ানোর কথা জানিয়েছিলেন উক্ত ব্যক্তি। ৫ সেপ্টেম্বর শুক্রবার ভোজের পর তাদের বাড়ি ছাড়ার জন্য রবিবার (সেপ্টেম্বর ৭) পর্যন্ত সময় বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। তার হিসাবে, যুদ্ধের পর ছয়টা পরিবার ছিল, ওই ছয় পরিবার ধরে ৫ লাখ টাকা করে দেবেন। পরিবারের ছেলেরা টাকা ভাগ করে নেবেন। পরে অবশ্য ছয় বাড়ির প্রত্যেককে ৬ লাখ টাকা করে দিতে চেয়েছেন তিনি। সর্বশেষ জানা যায়, কয়েকজনকে নগদ অর্থ বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। বাড়ি ছাড়তে প্রথমে তিন মাস সময় দেওয়া হয়েছিল। এরপর ১৫ দিন, ৭ দিন ও ১০ দিন করে সময় বাড়ানো হয়েছে। মাসখানেক আগে টাকাও দেওয়া হয়েছে। সবশেষে ১০ দিনের সময় শেষ হয় শুক্রবার ৫ সেপ্টেম্বর। সেদিন খাসি কেটে খাওয়ানো কথা ছিল। গত রবিবারের মধ্যে তাদের এলাকা ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা ছিল। ইতোপূর্বে অবশ্য মুরগির মাংস দিয়ে ভোজ আয়োজনের আকাক্সক্ষা প্রকাশ করেছিলেন গ্রামবাসী। অর্থাৎ খাসির মাংস দিয়ে ভূরিভোজের আয়োজন করে জায়গা ছেড়ে দেওয়ার সব রকম নকশা প্রণীত হয়েছিল। ইতোমধ্যেই রাজনৈতিক দলের পরিচিত এই ব্যক্তির চাপে প্রাণের ভয়ে ৩টি পরিবার অন্যত্র চলে গিয়েছে। বিষয়টি সংবাদপত্রের এবং মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানের নজরে এলে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন হস্তক্ষেপ করে। জমির মালিকানা নিয়ে ফয়সালা না হওয়া পর্যন্ত ১৩টি আদিবাসী পাহাড়িয়া পরিবার সেখানেই থাকবে বলে জানিয়েছে পুলিশ। ‘আপনারা কেন থানায় যাননি?’Ñ এমন প্রশ্নের উত্তরে মিল্কি বিশ্বাস পুলিশের কাছে বলেন, ‘উক্ত প্রভাবশালী ব্যক্তি বলেছেন যে তোমরা যদি বাড়াবাড়ি করো, যেটুকু টাকা দিচ্ছি, সেটাও দেব না। এটার জন্য আমরা কোনো জায়গায় যেতে পারলাম না। আমরা টাকা নিতে বাধ্য হলাম।’
এখন প্রশ্ন হচ্ছেÑ আদিবাসী পাড়ার জমিটি যদি কেউ ১৯৯৪ খ্রিস্টাব্দে কিনে থাকেন, তাহলে নিশ্চয়ই তার দলিল দস্তাবেজ থাকবে! কাউন্সিলর অফিসে কাগজপত্র খোলা চোখে দেখার পর জাল দলিল হিসেবে আখ্যায়িত হলে তিনি উদ্বিগ্ন হয়ে নিরবে স্থান ত্যাগ করেছিলেন। এটি সহজেই অনুমেয় যে, কাগজপত্রের দুর্বলতা থাকলে হৃদয়ের উদ্বিগ্নতা বাড়ে, সত্যকে প্রতিষ্ঠা করতে পিছু হটা হয়; আদিবাসী পাড়ার ক্ষেত্রে সেটিই দেখেছি। স্থানীয় কাউন্সিলরের অফিসে কিংবা আদালতের মধ্যে দিয়েও ক্রয়কৃত জায়গাটিতে অধিকার প্রতিষ্ঠায় তাকে লড়তে দেখিনি। তাহলে নিশ্চয়ই এখানে কোনো না কোনো গূঢ় রহস্য লুকানো রয়েছে!
দ্বিতীয়তÑ সেই ব্যক্তিআদিবাসী পাড়ার পাহাড়িয়াদের কেন ও কোন শর্তে অর্থ দিতে সম্মতি জ্ঞাপন করেছেন! তার তথ্যানুযায়ী, আদিবাসী পাহাড়িয়ারা তার হাত থেকে অর্থ গ্রহণ করেছেন। সত্যিকার অর্থেই যদি তিনি ১৬ কাঠা জমির আইনগত স্বত্বাধিকারী হয়ে থাকেন, তাহলে কেন, কোন স্বার্থে আরো কয়েক লক্ষ টাকা দিয়ে জায়গাটি ছেড়ে দিতে বাধ্য করছিলেন? এটি সন্দেহজনক এবং অবিশ্বাস্য। কেন বল প্রয়োগের মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছেন?
তৃতীয়তÑ খাসি মেরে ভূরিভোজের আয়োজন করে বিদায় অনুষ্ঠানের আয়োজন করা কী সত্যিই আদিবাসী পাহাড়িয়ারা চেয়েছিলেন? যে জায়গায় দশকের পর দশক বসবাস করেছেন, তিনটি প্রজন্ম থেকেছেন; সে জায়গাটির মায়া অনেক বড়। কোনোকালেই শুনিনি যে, আদিবাসীদের স্থানচ্যুত করতে উৎসব হয়েছে, খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন হয়েছে; আদিবাসীদের খাওয়ানোর মধ্য দিয়ে কী দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে চেয়েছেন! এটি ঠিক যে, আদিবাসীদের মুখ বন্ধ করে প্রবল প্রতিরোধও বন্ধ করতে চেয়েছেন!
চতুর্থতÑ আদিবাসী পাড়ার ১৬ কাঠা জমির মূল্য এখন কয়েক কোটি টাকা। নীলনকশা প্রণয়নকারী ব্যক্তি হিসাব করেছেন, কয়েক লক্ষ টাকা দিয়ে যদি কোটি টাকার জায়গা দখল করা যায়, তাহলে মন্দ কী? সত্যিই আদিবাসীদের ছলে-বলে-কৌশলে অর্থ গ্রহণে সম্মত করিয়েছেন। আদিবাসীরা যদি নিরবে স্থান ত্যাগ করে, তাহলে সেটি হবে তার জন্য বাড়তি পাওনা। সবকিছুই সুন্দরভাবে এগোচ্ছিল, হঠাৎ করেই শ্রাবণের বাতাস ওলটপালট করে দিয়েছে। মিডিয়া থেকে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠান, আদিবাসী সংগঠনের প্রতিবাদ এবং স্থানীয় প্রশাসনের হস্তক্ষেপÑ প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটিত হলেই ভূরিভোজের রহস্যও উন্মোচিত হবে।
পঞ্চমতÑ আদিবাসীরা সহজ-সরল এবং ঝামেলামুক্ত জীবন অতিক্রান্ত করতে আগ্রহী হন। পাহাড়িয়ারা দেখেছেন, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে অনেক জায়গায় আদিবাসীরা নিগৃহীত, অত্যাচারিত এবং উচ্ছেদের শিকার হয়েছেন; আইনের কোনো শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ক্ষমতাশালীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় আদিবাসীরা টিকতে পারেন না; আর সেজন্যই ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দিয়ে গ্রামের বিশনি বিশ্বাস বলেছেন, ‘জন্ম জায়গা ছেড়ে কেউ চলে যেতে চায়? কেহু তো চাই না’। আদিবাসী পাহাড়িয়াদেরকে আদিবাসী পাড়া ছাড়ার পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে, এখন সময়ের অপেক্ষা মাত্র!
রাজনৈতিক পেশিশক্তির অধিকারী উক্ত ব্যক্তির দীর্ঘদিনের স্বপ্ন আদিবাসীদের জায়গাটি করায়ত্ত করার, যার জন্যে আদিবাসীদের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়েছেন। আদিবাসীরা এ দেশের নাগরিক, নাগরিক হিসেবে অবশ্যই ন্যায্যতা প্রাপ্তির প্রত্যাশা করতে পারেন। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে আমাদের নিবেদন, বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে থাকা আদিবাসী পাহাড়িয়াদের রক্ষার্থে উদ্যোগ গ্রহণ করুন। গ্রামের প্রবীণ ব্যক্তি ফুলমণি বিশ্বাস বলেছেন, ‘কোথায় যাব? আমরা তো এখুন আন্ধার ঘরে হাইতড়াই তো পাছি না। আন্ধার ঘরে মানুষ কিছু পায় কি না? ওই রকম আমরাও কিছু খুঁইজে পাছি না’? অশীতিপর ফুলমণি যেন সত্যিটা জেনে যান, অন্ধকারে থেকে অনিশ্চিত জীবনের সমাপ্তি হোক নিরন্তর শান্তি ও নিশ্চিন্তে।
[লেখক: কলামিস্ট]