জাহাঙ্গীর আলম সরকার
তরুণ প্রজন্মের ক্ষোভ, রাজনৈতিক পরিবারতন্ত্রের প্রতি বিতৃষ্ণা আর দুর্নীতির দীর্ঘশ্বাসÑ সব মিলিয়ে নেপালের রাজপথ এখন এক নতুন প্রশ্নের সামনে দাঁড়িয়ে
নেপালের রাজনীতি আবারও উত্তাল। সহিংস বিক্ষোভ আর তরুণদের বিদ্রোহী গ্রোতের মুখে শেষ পর্যন্ত পদত্যাগ করতে হলো কে পি শর্মা অলিকে। তার বিদায়পত্র গ্রহণ করেছেন প্রেসিডেন্ট রামচন্দ্র পাওদেল, যিনি এখন সেনাবাহিনীর সুরক্ষায় অবস্থান করছেন। অলি-অধ্যায়ের অবসানে নেপালজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে এক অচেনা শূন্যতা, অনিশ্চয়তার ভারি ছায়া। তরুণ প্রজন্মের ক্ষোভ, রাজনৈতিক পরিবারতন্ত্রের প্রতি বিতৃষ্ণা আর দুর্নীতির দীর্ঘশ্বাস—সব মিলিয়ে নেপালের রাজপথ এখন এক নতুন প্রশ্নের সামনে দাঁড়িয়ে: অলির পতনের পর দেশটি কোন পথে এগোবে, আর কার হাতে উঠবে ভবিষ্যতের নেতৃত্বের পতাকা?
প্রেসিডেন্টের কার্যালয় থেকে জারি করা এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে—কে পি শর্মা অলির পদত্যাগপত্র আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ করা হয়েছে। তবে রাষ্ট্রীয় স্থিতিশীলতা রক্ষার স্বার্থে এবং নতুন কোনো রাজনৈতিক সমাধান না আসা পর্যন্ত তাকেই দায়িত্বে বহাল থাকার অনুরোধ জানানো হয়েছে। এই ঘোষণাই জনমনে নতুন প্রশ্ন তুলেছে—যে ব্যক্তির পদত্যাগ গৃহীত হলো, তাকেই আবার কেন দায়িত্বে থেকে যেতে অনুরোধ করা হলো? অনেকে একে সাংবিধানিক জটিলতা বলছেন, কেউ আবার দেখছেন এটি সেনা-সমর্থিত এক অস্থায়ী রাজনৈতিক সমঝোতা। অলি বর্তমানে কোথায় আছেন, তার নিরাপত্তা বা রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ কী—সে বিষয়ে কোনো সরকারি বক্তব্য পাওয়া যায়নি। প্রেসিডেন্ট বা সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকেও এ নিয়ে নীরবতা বজায় রাখা হয়েছে। এই রহস্যময় নীরবতা রাজনৈতিক অনিশ্চয়তাকে আরও ঘনীভূত করেছে।
নেপালের খ্যাতনামা সংবিধান বিশেষজ্ঞ ভিমার্জুন আচার্য স্পষ্ট করেই বলেছেন, ‘আমাদের সামনে এমন এক পরিস্থিতি এসেছে, যার জন্য আমরা প্রস্তুত ছিলাম না। এখন একমাত্র পথ সর্বদলীয় আলোচনার মাধ্যমে সমাধান খোঁজা। তবে তার জন্য আগে রাস্তায় চলমান বিক্ষোভ থামাতে হবে, স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরিয়ে আনতে হবে, এবং জনগণের জীবন ও মৌলিক অধিকার সুরক্ষিত করতে হবে।’ তার মতে, ১০ বছর আগে প্রণীত নেপালের সংবিধান কার্যত আজ অকার্যকর হয়ে পড়েছে। বর্তমান অচলাবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য অন্তর্র্বতী ব্যবস্থার কোনো বিকল্প নেই। প্রশ্ন হচ্ছে—এই অন্তর্র্বতী সরকারের নেতৃত্ব দেবেন কে? সেটিই এখন নেপালের সবচেয়ে কঠিন ও বিতর্কিত প্রশ্ন। কারণ রাস্তায় যে তরুণদের ঝড় উঠেছে, তা শুধু অলি বা তার দলের বিরুদ্ধে নয়, কার্যত সব প্রচলিত রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধেই। দুর্নীতি, পরিবারতন্ত্র ও ব্যর্থ নেতৃত্বের বিরুদ্ধে ক্ষোভে জনরোষ সমানভাবে পড়েছে সব নেতাদের ওপর।
এই প্রেক্ষাপটে নতুন এক নাম আলোচনায় উঠে এসেছে—নেপালের সুপ্রিম কোর্টের সাবেক প্রধান বিচারপতি সুশীলা কার্কি। সরকারের অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে যিনি দীর্ঘদিন ধরেই সোচ্চার ছিলেন। তরুণদের আন্দোলনের সঙ্গে প্রকাশ্যে সংহতি জানিয়েছেন তিনি। তার অতীত অবস্থানও অনেকের কাছে আস্থা জাগাচ্ছে। তিনি ছিলেন দুর্নীতির বিরুদ্ধে আপসহীন কণ্ঠস্বর, বিভিন্ন জনমঞ্চে দৃঢ়ভাবে বলেছেন রাষ্ট্রের শীর্ষ মহলে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তার কথা। শুধু তাই নয়, তিনি নিয়মিত যোগাযোগ রেখেছেন জেন-জি প্রজন্মের বিভিন্ন দল ও নাগরিক সমাজের সঙ্গে। অন্তর্র্বতী সরকারের সম্ভাব্য নেতৃত্বের তালিকায় তার নাম যেমন শোনা যাচ্ছে, তেমনি আলোচনায় আছেন তার পূর্বসূরি কল্যাণ শ্রেষ্ঠাও। উভয়েই অভিজ্ঞ, নিরপেক্ষ ও ন্যায়পরায়ণ হিসেবে পরিচিত। তবে তাদের বয়স সত্তরের ঘরে পৌঁছেছে অনেক আগে। তাই একদিকে অভিজ্ঞতার ভরসা, অন্যদিকে বয়সজনিত সীমাবদ্ধতা—এই দুইয়ের মধ্যে ভারসাম্য খুঁজে বের করাই এখন নেপালের রাজনীতির সামনে বড় চ্যালেঞ্জ।
সব মিলিয়ে নেপাল এখন দাঁড়িয়ে আছে এক সন্ধিক্ষণে। রাজপথে বিক্ষোভ অব্যাহত, রাষ্ট্রপতি নীরব, সেনাবাহিনী সতর্ক, আর জনগণ অপেক্ষায়—কোন হাতে উঠবে নেপালের আগামী দিনের হালধরা? নেপালের সাংবিধানিক সংকট ঘনীভূত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিশেষজ্ঞ মহল নানা মত দিচ্ছেন। নেপালের সংবিধান বিশেষজ্ঞ ভিমার্জুন আচার্যের মতে, অন্তর্র্বতী সরকারের প্রধান নির্বাচনে সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি। যদিও অনেকে ইতোমধ্যেই প্রশ্ন তুলেছেন—যদি সুশীলা কার্কি বা কল্যাণ শ্রেষ্ঠার মতো প্রবীণ ব্যক্তিদের মধ্য থেকে কাউকে অন্তর্র্বতী সরকারের নেতৃত্বে বসানো হয়, তবে তরুণদের এ আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হয়ে যাবে। কারণ এ আন্দোলনের প্রধান চালিকাশক্তি হলো ৩০ বছরের কম বয়সী প্রজন্ম, যারা দুর্নীতি ও রাজনৈতিক পরিবারতন্ত্র ভেঙে নতুন নেতৃত্বের স্বপ্ন দেখছে। প্রবীণ নেতৃত্বে সেই স্বপ্ন অপূর্ণ থেকে যেতে পারে।
এই পরিস্থিতিতে আরেকটি নাম প্রবলভাবে উচ্চারিত হচ্ছে—তিনি হলেন কাঠমান্ডুর বর্তমান মেয়র বালেন শাহ। বয়স মাত্র ৩৫। পেশায় তিনি একজন স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ার, পাশাপাশি পরিচিত একজন গায়ক হিসেবেও। তার পরিচয় শুধু রাজনীতিক হিসেবে নয়, বরং এক ভিন্নধর্মী সাংস্কৃতিক প্রতীকের সঙ্গেও জড়িত। অলির কট্টর সমালোচক হিসেবে বহুবার জনসমক্ষে সরাসরি দুর্নীতিবাজ বলে অভিযুক্ত করেছেন তাকে। বালেন শাহ খোলাখুলি বলেছেন, নেপালের রাজনৈতিক নেতৃত্ব দুর্নীতির কারণে জনআস্থা হারিয়েছে। এজন্যই তিনি জেন-জিদের বিক্ষোভে নৈতিক সমর্থন দিয়েছেন এবং তরুণদের দুর্নীতিবিরোধী অবস্থানকে শক্তিশালী করেছেন। তবে এখানেই আসে বড় দ্বিধা। আন্দোলনের তরুণরা তাকে স্বাভাবিকভাবেই ভবিষ্যতের নেতৃত্বে দেখতে চেয়েছে। অলি সরকারের পতনের পর রাস্তায় অনেক তরুণকেই শোনা গেছে, তারা বালেন শাহকেই নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে চান। কিন্তু বালেন শাহ তাদের আবেদন প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি স্পষ্ট জানিয়েছেন—যেহেতু তার বয়স ইতোমধ্যেই ২৮ ছাড়িয়েছে, তিনি নিজেকে আর সেই প্রজন্মের (যারা ৩০-এর নিচে) প্রতিনিধি বলে দাবি করতে চান না। বরং তিনি তরুণ প্রজন্মের প্রতিই দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছেন এবং আহ্বান জানিয়েছেন—‘এখন সময় এসেছে তোমাদের নিজেদের হাতে দেশ চালনার।’
এই বক্তব্য নেপালের রাজনীতিতে এক অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ, সাধারণত রাজনীতিকরা ক্ষমতার প্রলোভন এড়িয়ে চলেন না। অথচ বালেন শাহ তরুণদের উদ্দেশে বলেছেন—তোমরাই সামনে এগিয়ে এসো, নেতৃত্ব দাও, নেপালের ভবিষ্যৎ নির্মাণ করো। তার এই অবস্থান তাকে তরুণদের কাছে আরও গ্রহণযোগ্য করেছে।
সব মিলিয়ে আজকের নেপাল এক অভূতপূর্ব সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। একদিকে প্রবীণ ও অভিজ্ঞ নেতৃত্বের প্রস্তাব, অন্যদিকে উদীয়মান ও সাহসী তরুণদের দাবির প্রতিধ্বনি। সেই দ্বন্ধের কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে আছেন বালেন শাহ—যিনি নিজে ক্ষমতা নিতে অস্বীকৃতি জানালেও, তরুণ প্রজন্মকে নেতৃত্বের পথে ঠেলে দিয়েছেন নতুন এক দিগন্তের দিকে। রাজপথে আগুনের আঁচর, বাতাসে বারুদের গন্ধ। তরুণদের কণ্ঠে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে নতুন ভোরের দাবি। সেই আবেগমথিত সময়েই সেনাবাহিনী তাদের ঠা-া আহবান জানায়—শান্ত থাকো, রক্ষা করো তোমাদের স্বপ্নের শহর, রক্ষা করো জীবন আর মর্যাদা। তাদের কণ্ঠে শোনা যায় প্রতিশ্রুতির সুর—‘আমরা আছি তোমাদের পাশে, আমরা আছি নাগরিকদের প্রাণের নিরাপত্তায়।’
কিন্তু এ আহবান কি শুধুই শান্তির, নাকি অদৃশ্য এক শক্তির সতর্ক বার্তা? ইতিহাস সাক্ষী, সেনারা যখন ‘মধ্যস্থতাকারী’ হয়, তখন ক্ষমতার ভারসাম্য পাল্টে যায় নীরবে। নেপালের রক্তাক্ত রাজপথ আজ যেন এক প্রশ্নবোধক চিহ্ন—নেপালে কি সত্যিই জেন-জির স্বপ্নময় প্রভাত আসবে, নাকি শৃঙ্খলার নামে এক নতুন ছায়াশাসন নেমে আসবে? জনতার বুক ধুকধুক করছে, আকাশে ঝুলে আছে অনিশ্চয়তার অগ্নিগোলক। একদিকে স্বাধীনতার স্বপ্ন, অন্যদিকে ইতিহাসের অন্ধকার ছায়া। নেপাল দাঁড়িয়ে আছে দ্বারপ্রান্তে— এ পথ কোথায় নিয়ে যাবে, তা এখনো অজানা।
[লেখক: আইনজীবী]
জাহাঙ্গীর আলম সরকার
তরুণ প্রজন্মের ক্ষোভ, রাজনৈতিক পরিবারতন্ত্রের প্রতি বিতৃষ্ণা আর দুর্নীতির দীর্ঘশ্বাসÑ সব মিলিয়ে নেপালের রাজপথ এখন এক নতুন প্রশ্নের সামনে দাঁড়িয়ে
বৃহস্পতিবার, ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৫
নেপালের রাজনীতি আবারও উত্তাল। সহিংস বিক্ষোভ আর তরুণদের বিদ্রোহী গ্রোতের মুখে শেষ পর্যন্ত পদত্যাগ করতে হলো কে পি শর্মা অলিকে। তার বিদায়পত্র গ্রহণ করেছেন প্রেসিডেন্ট রামচন্দ্র পাওদেল, যিনি এখন সেনাবাহিনীর সুরক্ষায় অবস্থান করছেন। অলি-অধ্যায়ের অবসানে নেপালজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে এক অচেনা শূন্যতা, অনিশ্চয়তার ভারি ছায়া। তরুণ প্রজন্মের ক্ষোভ, রাজনৈতিক পরিবারতন্ত্রের প্রতি বিতৃষ্ণা আর দুর্নীতির দীর্ঘশ্বাস—সব মিলিয়ে নেপালের রাজপথ এখন এক নতুন প্রশ্নের সামনে দাঁড়িয়ে: অলির পতনের পর দেশটি কোন পথে এগোবে, আর কার হাতে উঠবে ভবিষ্যতের নেতৃত্বের পতাকা?
প্রেসিডেন্টের কার্যালয় থেকে জারি করা এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে—কে পি শর্মা অলির পদত্যাগপত্র আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ করা হয়েছে। তবে রাষ্ট্রীয় স্থিতিশীলতা রক্ষার স্বার্থে এবং নতুন কোনো রাজনৈতিক সমাধান না আসা পর্যন্ত তাকেই দায়িত্বে বহাল থাকার অনুরোধ জানানো হয়েছে। এই ঘোষণাই জনমনে নতুন প্রশ্ন তুলেছে—যে ব্যক্তির পদত্যাগ গৃহীত হলো, তাকেই আবার কেন দায়িত্বে থেকে যেতে অনুরোধ করা হলো? অনেকে একে সাংবিধানিক জটিলতা বলছেন, কেউ আবার দেখছেন এটি সেনা-সমর্থিত এক অস্থায়ী রাজনৈতিক সমঝোতা। অলি বর্তমানে কোথায় আছেন, তার নিরাপত্তা বা রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ কী—সে বিষয়ে কোনো সরকারি বক্তব্য পাওয়া যায়নি। প্রেসিডেন্ট বা সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকেও এ নিয়ে নীরবতা বজায় রাখা হয়েছে। এই রহস্যময় নীরবতা রাজনৈতিক অনিশ্চয়তাকে আরও ঘনীভূত করেছে।
নেপালের খ্যাতনামা সংবিধান বিশেষজ্ঞ ভিমার্জুন আচার্য স্পষ্ট করেই বলেছেন, ‘আমাদের সামনে এমন এক পরিস্থিতি এসেছে, যার জন্য আমরা প্রস্তুত ছিলাম না। এখন একমাত্র পথ সর্বদলীয় আলোচনার মাধ্যমে সমাধান খোঁজা। তবে তার জন্য আগে রাস্তায় চলমান বিক্ষোভ থামাতে হবে, স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরিয়ে আনতে হবে, এবং জনগণের জীবন ও মৌলিক অধিকার সুরক্ষিত করতে হবে।’ তার মতে, ১০ বছর আগে প্রণীত নেপালের সংবিধান কার্যত আজ অকার্যকর হয়ে পড়েছে। বর্তমান অচলাবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য অন্তর্র্বতী ব্যবস্থার কোনো বিকল্প নেই। প্রশ্ন হচ্ছে—এই অন্তর্র্বতী সরকারের নেতৃত্ব দেবেন কে? সেটিই এখন নেপালের সবচেয়ে কঠিন ও বিতর্কিত প্রশ্ন। কারণ রাস্তায় যে তরুণদের ঝড় উঠেছে, তা শুধু অলি বা তার দলের বিরুদ্ধে নয়, কার্যত সব প্রচলিত রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধেই। দুর্নীতি, পরিবারতন্ত্র ও ব্যর্থ নেতৃত্বের বিরুদ্ধে ক্ষোভে জনরোষ সমানভাবে পড়েছে সব নেতাদের ওপর।
এই প্রেক্ষাপটে নতুন এক নাম আলোচনায় উঠে এসেছে—নেপালের সুপ্রিম কোর্টের সাবেক প্রধান বিচারপতি সুশীলা কার্কি। সরকারের অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে যিনি দীর্ঘদিন ধরেই সোচ্চার ছিলেন। তরুণদের আন্দোলনের সঙ্গে প্রকাশ্যে সংহতি জানিয়েছেন তিনি। তার অতীত অবস্থানও অনেকের কাছে আস্থা জাগাচ্ছে। তিনি ছিলেন দুর্নীতির বিরুদ্ধে আপসহীন কণ্ঠস্বর, বিভিন্ন জনমঞ্চে দৃঢ়ভাবে বলেছেন রাষ্ট্রের শীর্ষ মহলে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তার কথা। শুধু তাই নয়, তিনি নিয়মিত যোগাযোগ রেখেছেন জেন-জি প্রজন্মের বিভিন্ন দল ও নাগরিক সমাজের সঙ্গে। অন্তর্র্বতী সরকারের সম্ভাব্য নেতৃত্বের তালিকায় তার নাম যেমন শোনা যাচ্ছে, তেমনি আলোচনায় আছেন তার পূর্বসূরি কল্যাণ শ্রেষ্ঠাও। উভয়েই অভিজ্ঞ, নিরপেক্ষ ও ন্যায়পরায়ণ হিসেবে পরিচিত। তবে তাদের বয়স সত্তরের ঘরে পৌঁছেছে অনেক আগে। তাই একদিকে অভিজ্ঞতার ভরসা, অন্যদিকে বয়সজনিত সীমাবদ্ধতা—এই দুইয়ের মধ্যে ভারসাম্য খুঁজে বের করাই এখন নেপালের রাজনীতির সামনে বড় চ্যালেঞ্জ।
সব মিলিয়ে নেপাল এখন দাঁড়িয়ে আছে এক সন্ধিক্ষণে। রাজপথে বিক্ষোভ অব্যাহত, রাষ্ট্রপতি নীরব, সেনাবাহিনী সতর্ক, আর জনগণ অপেক্ষায়—কোন হাতে উঠবে নেপালের আগামী দিনের হালধরা? নেপালের সাংবিধানিক সংকট ঘনীভূত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিশেষজ্ঞ মহল নানা মত দিচ্ছেন। নেপালের সংবিধান বিশেষজ্ঞ ভিমার্জুন আচার্যের মতে, অন্তর্র্বতী সরকারের প্রধান নির্বাচনে সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি। যদিও অনেকে ইতোমধ্যেই প্রশ্ন তুলেছেন—যদি সুশীলা কার্কি বা কল্যাণ শ্রেষ্ঠার মতো প্রবীণ ব্যক্তিদের মধ্য থেকে কাউকে অন্তর্র্বতী সরকারের নেতৃত্বে বসানো হয়, তবে তরুণদের এ আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হয়ে যাবে। কারণ এ আন্দোলনের প্রধান চালিকাশক্তি হলো ৩০ বছরের কম বয়সী প্রজন্ম, যারা দুর্নীতি ও রাজনৈতিক পরিবারতন্ত্র ভেঙে নতুন নেতৃত্বের স্বপ্ন দেখছে। প্রবীণ নেতৃত্বে সেই স্বপ্ন অপূর্ণ থেকে যেতে পারে।
এই পরিস্থিতিতে আরেকটি নাম প্রবলভাবে উচ্চারিত হচ্ছে—তিনি হলেন কাঠমান্ডুর বর্তমান মেয়র বালেন শাহ। বয়স মাত্র ৩৫। পেশায় তিনি একজন স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ার, পাশাপাশি পরিচিত একজন গায়ক হিসেবেও। তার পরিচয় শুধু রাজনীতিক হিসেবে নয়, বরং এক ভিন্নধর্মী সাংস্কৃতিক প্রতীকের সঙ্গেও জড়িত। অলির কট্টর সমালোচক হিসেবে বহুবার জনসমক্ষে সরাসরি দুর্নীতিবাজ বলে অভিযুক্ত করেছেন তাকে। বালেন শাহ খোলাখুলি বলেছেন, নেপালের রাজনৈতিক নেতৃত্ব দুর্নীতির কারণে জনআস্থা হারিয়েছে। এজন্যই তিনি জেন-জিদের বিক্ষোভে নৈতিক সমর্থন দিয়েছেন এবং তরুণদের দুর্নীতিবিরোধী অবস্থানকে শক্তিশালী করেছেন। তবে এখানেই আসে বড় দ্বিধা। আন্দোলনের তরুণরা তাকে স্বাভাবিকভাবেই ভবিষ্যতের নেতৃত্বে দেখতে চেয়েছে। অলি সরকারের পতনের পর রাস্তায় অনেক তরুণকেই শোনা গেছে, তারা বালেন শাহকেই নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে চান। কিন্তু বালেন শাহ তাদের আবেদন প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি স্পষ্ট জানিয়েছেন—যেহেতু তার বয়স ইতোমধ্যেই ২৮ ছাড়িয়েছে, তিনি নিজেকে আর সেই প্রজন্মের (যারা ৩০-এর নিচে) প্রতিনিধি বলে দাবি করতে চান না। বরং তিনি তরুণ প্রজন্মের প্রতিই দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছেন এবং আহ্বান জানিয়েছেন—‘এখন সময় এসেছে তোমাদের নিজেদের হাতে দেশ চালনার।’
এই বক্তব্য নেপালের রাজনীতিতে এক অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ, সাধারণত রাজনীতিকরা ক্ষমতার প্রলোভন এড়িয়ে চলেন না। অথচ বালেন শাহ তরুণদের উদ্দেশে বলেছেন—তোমরাই সামনে এগিয়ে এসো, নেতৃত্ব দাও, নেপালের ভবিষ্যৎ নির্মাণ করো। তার এই অবস্থান তাকে তরুণদের কাছে আরও গ্রহণযোগ্য করেছে।
সব মিলিয়ে আজকের নেপাল এক অভূতপূর্ব সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। একদিকে প্রবীণ ও অভিজ্ঞ নেতৃত্বের প্রস্তাব, অন্যদিকে উদীয়মান ও সাহসী তরুণদের দাবির প্রতিধ্বনি। সেই দ্বন্ধের কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে আছেন বালেন শাহ—যিনি নিজে ক্ষমতা নিতে অস্বীকৃতি জানালেও, তরুণ প্রজন্মকে নেতৃত্বের পথে ঠেলে দিয়েছেন নতুন এক দিগন্তের দিকে। রাজপথে আগুনের আঁচর, বাতাসে বারুদের গন্ধ। তরুণদের কণ্ঠে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে নতুন ভোরের দাবি। সেই আবেগমথিত সময়েই সেনাবাহিনী তাদের ঠা-া আহবান জানায়—শান্ত থাকো, রক্ষা করো তোমাদের স্বপ্নের শহর, রক্ষা করো জীবন আর মর্যাদা। তাদের কণ্ঠে শোনা যায় প্রতিশ্রুতির সুর—‘আমরা আছি তোমাদের পাশে, আমরা আছি নাগরিকদের প্রাণের নিরাপত্তায়।’
কিন্তু এ আহবান কি শুধুই শান্তির, নাকি অদৃশ্য এক শক্তির সতর্ক বার্তা? ইতিহাস সাক্ষী, সেনারা যখন ‘মধ্যস্থতাকারী’ হয়, তখন ক্ষমতার ভারসাম্য পাল্টে যায় নীরবে। নেপালের রক্তাক্ত রাজপথ আজ যেন এক প্রশ্নবোধক চিহ্ন—নেপালে কি সত্যিই জেন-জির স্বপ্নময় প্রভাত আসবে, নাকি শৃঙ্খলার নামে এক নতুন ছায়াশাসন নেমে আসবে? জনতার বুক ধুকধুক করছে, আকাশে ঝুলে আছে অনিশ্চয়তার অগ্নিগোলক। একদিকে স্বাধীনতার স্বপ্ন, অন্যদিকে ইতিহাসের অন্ধকার ছায়া। নেপাল দাঁড়িয়ে আছে দ্বারপ্রান্তে— এ পথ কোথায় নিয়ে যাবে, তা এখনো অজানা।
[লেখক: আইনজীবী]