শাহ মো. জিয়াউদ্দিন
১২ সেপ্টেম্বর আদিবাসী মাহালী সম্প্রদায়ের জিতিয়া উৎসব। এটা মাহালিদের অন্যতম একটি উৎসব। এই উৎসব মূলত একটি প্রাচীন সনাতনী ধর্মীয় উৎসব। এই উৎসবে মায়েরা তাদের ছেলেদের মঙ্গল কামনায় উপবাস পালন করেন। নেপাল, ভারতের উত্তরপ্রদেশ, বিহার ও ঝাড়খ- এবং বাংলাদেশের রাজশাহীসহ বিভিন্ন অঞ্চলের মাহালিদের মধ্যে এটি পালিত হয়।
এই উৎসবের দিন গণনায় সাধারণত বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গে আশ্বিন মাসের কৃষ্ণপক্ষের সপ্তম থেকে নবম চান্দ্রদিন পর্যন্ত তিন দিন ধরা হয়। আর ঝাড়খ-ে প্রথম চাঁদের দিন থেকে অষ্টম চাঁদের দিন পর্যন্ত আট দিন ধরে পালিত হয়। এর উদ্দেশ্য হলোÑমায়েরা তাদের ছেলেদের দীর্ঘায়ু ও মঙ্গল কামনায় উপবাস করেন। বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল ছাড়াও এই উৎসব ভুটানের কিছু অংশে পালিত হয়। বাংলাদেশের রাজশাহীসহ অন্যান্য স্থানে মাহালী সম্প্রদায়ও ঘটা করে এই উৎসব পালন করে।
এটা পালনের মূল উদ্দেশ্য হলো জীবিতপুত্রিকা বা জিতিয়া উপবাস। এই উপবাস শিশুদের দীর্ঘায়ু ও সুখী জীবনের কামনায় করা হয়। বিশ্বাস করা হয়, যে মহিলা এই উপবাসের গল্প শোনেন তাদের সন্তানের ক্ষতি হয় না এবং জীবনে সবসময় সুখ বিরাজ করে। এই উৎসবে মায়েরা তাদের সন্তানদের দীর্ঘায়ু ও মঙ্গল কামনায় দিনটি পালন করেন।
ঝাড়খ-ে এই উৎসব আট দিন ধরে পালিত হয়। এটি কৃষিভিত্তিক একটি পরব হিসেবেও পরিচিত, যেখানে প্রকৃতিকে তুষ্ট করতে এবং ফসলের সমৃদ্ধি কামনায় এই উৎসব উদযাপন করা হয়। অর্থাৎ শস্যফল উৎপাদন প্রক্রিয়াটাও যেন শস্যগাছ তার সন্তান বা শস্যপণ্য দিয়ে থাকে, যা অনেকটা সন্তান প্রসবের মতো। তাই যাতে এই শস্য উৎপাদন ক্রমে বৃদ্ধি পায়, তার জন্যও এই উৎসবটি পালিত হয়। ফলে উৎসবটা আদি বাংলার একটি উৎসব হিসেবে ধরা হয়।
মাহালী সম্প্রদায় অনার্য গোষ্ঠী। আর্যদের আগমনের পূর্বে এদের বসবাস ছিল ভারতীয় উপমহাদেশে। মাহালী জনজাতির মানুষ বেশ কয়েকটি গোত্রে বিভক্ত, প্রতিটি গোত্রের নিজস্ব টোটেম অর্থাৎ উপাস্য দেবতা বর্তমান। মূলত ১৩টি গোত্র ও তাদের টোটেমগুলো হলোÑবাস্কে (লাল নটে শাক), বেসরা (বাজপাখি), হাঁসদা (বুনো হাঁস), হেমব্রম (বাদাম), কিস্কু (মাছরাঙা), মা-ি (নীল চক্র নামে নীল পাখি), মুর্মু (শাল মাছ), সোরেন, টুডু (মেঠো ইঁদুর), ছোরে (গিরগিটি), সামাহ (এক প্রকার ঘাস), পাহিরি (গোল কুমড়ো), খাংগার (ডোমকাক)।
মাহালিরা কয়েকটি গোত্রের জন্য কিছু নিজস্ব শব্দ ব্যবহার করে, যেমনÑ‘মুর্মু’-এর জন্য ডুমরি, ‘কিস্কু’-এর জন্য বিসরা, ‘টুডু’-এর জন্য বারহে, ‘মা-ি’-এর জন্য মারডি, ‘সোরেন’-এর জন্য কাউরিয়া ইত্যাদি। প্রতিটি গোত্র আবার কয়েকটি উপগোত্রে বিভক্ত, যেগুলো ‘খুঁট’ নামে পরিচিত। মাহালিদের মধ্যে সমজাতির মধ্যে বিবাহ এবং আন্তঃগোত্র বিবাহ প্রচলিত। তবে বহুবিবাহ প্রচলিত নয়।
মাহালী সম্প্রদায়ের বাড়িগুলোকে ‘ওরাক’ বলা হয়। মাহালিদের মধ্যে অনু পরিবার প্রচলিত। পরিবারের প্রধানের মৃত্যুর পর সম্পত্তির মালিকানা মৃতের ছেলে ভোগ করে। মাহালী সমাজ পিতৃতান্ত্রিক, এখানে বিয়ের পর মেয়েরা স্বামীর বাড়িতে বসবাস করে। সাধারণত বিয়ের পর বর-কনের বসবাসের জন্য নতুন গৃহনির্মাণের প্রচলন রয়েছে। এই কারণে মাহালী সমাজে যৌথ পরিবার খুব সীমিত। পিতৃতান্ত্রিকতার কারণে পুত্রদের সুখ ও সমৃদ্ধির জন্য মায়েরা বিশেষ ব্রত পালন করেনÑএমন ধারণাও প্রচলিত, কারণ নারীরা পুরুষের আয় বা সম্পত্তির ওপর নির্ভরশীল হয়ে জীবন যাপন করেন।
জিতিয়া ব্রত মূলত পূর্ব ভারত ও নেপালে পালন করা হয়। এটি হিন্দুধর্মে বিশেষত মহিলাদের মধ্যে অপরিসীম তাৎপর্য বহন করে। ভগবান জীবিতবাহনকে উৎসর্গীকৃত এই উপবাস সাধারণত মায়েরা তাদের সন্তানদের দীর্ঘায়ু ও মঙ্গলের জন্য পালন করেন। আশ্বিন মাসে পালিত এই ব্রত একজন মায়ের অবিচল ভক্তি ও নিঃস্বার্থ ভালোবাসার প্রতীক। সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত উপবাস করে মহিলারা সন্তানদের স্বাস্থ্য, সমৃদ্ধি ও সুখের জন্য আশীর্বাদ খোঁজেন।
তিন দিনব্যাপী অনুষ্ঠানের ধাপগুলো হলোÑ
নাহাই-খাই: প্রথম দিন, মায়েরা স্নান সেরে নিরামিষ খাবার খান, যা ঘি ও গোলাপি লবণ দিয়ে তৈরি হয়।
খুর-জিতিয়া বা জীবিতপুত্রিকা দিবস: দ্বিতীয় দিন, কঠোর উপবাস পালিত হয়, জল পানও নিষিদ্ধ।
পারানা: তৃতীয় দিন, উপবাস ভঙ্গ করা হয়। তৈরি হয় নানা সুস্বাদু খাবারÑকারি ভাত, ননি শাক ও মারুয়া রুটি।
বিহার ও উত্তরপ্রদেশে শৃগাল ও ঈগলের কাহিনি বিখ্যাত। ভগবান জিমুতবাহনের সঙ্গে শৃগাল ও ঈগলের নামেও প্রার্থনা করা হয়। এই ব্রতটি জীবিতবাহনের কিংবদন্তিকেও স্মরণ করে, যিনি নিঃস্বার্থতা ও মাতৃপ্রেমের গুণাবলি তুলে ধরে অন্যকে বাঁচাতে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন।
জিতিয়া ব্রতের আচারে সূর্যোদয়ের পর স্নান ও নতুন পোশাক পরা দিয়ে শুরু হয়। ভক্তরা মন্দিরে বা বাড়িতে পূজা করেন। “নির্জলা ব্রত” পালনকারীরা সারাদিন জল পান করেন না, আবার কেউ কেউ “ফলাহার ব্রত”-এ ফল ও শাকসবজি খান। সন্ধ্যায় তারা সিঁদুর, চাল ও ফুল দিয়ে সাজানো মঞ্চে প্রদীপ জ্বালিয়ে প্রার্থনা করেন। সাতটি শস্য দিয়ে প্রতীকী অনুষ্ঠান হয়, যা সপ্তাহের সাত দিনের প্রতিনিধিত্ব করে।
উপবাস ভঙ্গের পর প্রসাদ ভাগ করা হয়, মিষ্টি, ফল ও নৈবেদ্য সবার মাঝে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। সন্তানদের মঙ্গল কামনায় সম্মিলিত প্রার্থনা করা হয়। পরদিন সকালে দরিদ্রদের মধ্যে খাবার ও পোশাক বিতরণ করা হয়।
কিংবদন্তি: জিমুতবাহন গন্ধর্বদের রাজা ছিলেন। রাজ্য ছেড়ে পিতার সেবায় বনে গিয়ে তিনি মলয়বতীকে বিয়ে করেন। এক বৃদ্ধাকে শোকে কাতর দেখে তিনি জানতে পারেন, শাপগ্রস্ত নাগবংশের কারণে তার পুত্রকে গরুড়ের খাদ্য হতে হবে। জিমুতবাহন নিজেকে উৎসর্গ করে শঙ্খচূড়কে রক্ষা করেন। গরুড় তার দয়া ও দানশীলতায় মুগ্ধ হয়ে নাগবংশের কাছে আর কোনো বলি নেবেন না বলে প্রতিশ্রুতি দেন। এ স্মৃতিই জিতিয়া ব্রতের অনুপ্রেরণা।
অনেকে বলেন, আশ্বিনে আদিবাসীদের আলাদা কোনো জিতিয়া উৎসব নেই। জিতিয়া আসলে একটি সনাতন হিন্দু উৎসব, যা হাজার বছর আগে থেকেই নেপাল ও ভারতের কিছু অঞ্চলে পালিত হচ্ছে। তবুও এটি মাহালী সম্প্রদায়ের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উৎসব।
উপমহাদেশের সমতলের আদিবাসীরা অনার্য, যারা হাজার হাজার বছর ধরে এখানে বাস করছে। এরা প্রকৃতির উপাসক। বর্ণহিন্দুরাও তাদের পূজা-অর্চনায় এই অনার্য সংস্কৃতির অনেক কিছু গ্রহণ করেছে। দুর্গাপূজায় ঘটোত্তলন, নবপত্রিকার পূজা, সন্ধিপূজা তার প্রমাণ। পশ্চিমবঙ্গের জঙ্গলমহল জুড়ে রঙ্গিনী, সাতবহনী, চ-ী, কনকদুর্গাসহ আদিবাসী দেবীদের পূজার পীঠস্থান রয়েছে। চ-ী এখানে নানা রূপে পূজিত হনÑজয়চ-ী, গুপ্তমণি, ভেটিয়াচ-ী, কালুয়াষাঁড়, বালিয়াবুড়ি ইত্যাদি।
কুড়মি সমাজে আশ্বিন অষ্টমীতে ধানখেতে গুঁড়ি দিয়ে জাগানোর রীতি আছে, যা সন্তানসম্ভবা ধানগাছকে স্বাদ খাওয়ানো বলে ধরা হয়। আরেকটি প্রবাদও প্রচলিতÑ“জিতা ভাসে, বোধন আসে।”
জিতিয়া উৎসব প্রাচীন বাংলার এক উৎসব, যার ভেতর দিয়ে প্রাচীন সংস্কৃতির ধারা আজও বহমান।
[লেখক: উন্নয়নকর্মী]
শাহ মো. জিয়াউদ্দিন
বৃহস্পতিবার, ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৫
১২ সেপ্টেম্বর আদিবাসী মাহালী সম্প্রদায়ের জিতিয়া উৎসব। এটা মাহালিদের অন্যতম একটি উৎসব। এই উৎসব মূলত একটি প্রাচীন সনাতনী ধর্মীয় উৎসব। এই উৎসবে মায়েরা তাদের ছেলেদের মঙ্গল কামনায় উপবাস পালন করেন। নেপাল, ভারতের উত্তরপ্রদেশ, বিহার ও ঝাড়খ- এবং বাংলাদেশের রাজশাহীসহ বিভিন্ন অঞ্চলের মাহালিদের মধ্যে এটি পালিত হয়।
এই উৎসবের দিন গণনায় সাধারণত বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গে আশ্বিন মাসের কৃষ্ণপক্ষের সপ্তম থেকে নবম চান্দ্রদিন পর্যন্ত তিন দিন ধরা হয়। আর ঝাড়খ-ে প্রথম চাঁদের দিন থেকে অষ্টম চাঁদের দিন পর্যন্ত আট দিন ধরে পালিত হয়। এর উদ্দেশ্য হলোÑমায়েরা তাদের ছেলেদের দীর্ঘায়ু ও মঙ্গল কামনায় উপবাস করেন। বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল ছাড়াও এই উৎসব ভুটানের কিছু অংশে পালিত হয়। বাংলাদেশের রাজশাহীসহ অন্যান্য স্থানে মাহালী সম্প্রদায়ও ঘটা করে এই উৎসব পালন করে।
এটা পালনের মূল উদ্দেশ্য হলো জীবিতপুত্রিকা বা জিতিয়া উপবাস। এই উপবাস শিশুদের দীর্ঘায়ু ও সুখী জীবনের কামনায় করা হয়। বিশ্বাস করা হয়, যে মহিলা এই উপবাসের গল্প শোনেন তাদের সন্তানের ক্ষতি হয় না এবং জীবনে সবসময় সুখ বিরাজ করে। এই উৎসবে মায়েরা তাদের সন্তানদের দীর্ঘায়ু ও মঙ্গল কামনায় দিনটি পালন করেন।
ঝাড়খ-ে এই উৎসব আট দিন ধরে পালিত হয়। এটি কৃষিভিত্তিক একটি পরব হিসেবেও পরিচিত, যেখানে প্রকৃতিকে তুষ্ট করতে এবং ফসলের সমৃদ্ধি কামনায় এই উৎসব উদযাপন করা হয়। অর্থাৎ শস্যফল উৎপাদন প্রক্রিয়াটাও যেন শস্যগাছ তার সন্তান বা শস্যপণ্য দিয়ে থাকে, যা অনেকটা সন্তান প্রসবের মতো। তাই যাতে এই শস্য উৎপাদন ক্রমে বৃদ্ধি পায়, তার জন্যও এই উৎসবটি পালিত হয়। ফলে উৎসবটা আদি বাংলার একটি উৎসব হিসেবে ধরা হয়।
মাহালী সম্প্রদায় অনার্য গোষ্ঠী। আর্যদের আগমনের পূর্বে এদের বসবাস ছিল ভারতীয় উপমহাদেশে। মাহালী জনজাতির মানুষ বেশ কয়েকটি গোত্রে বিভক্ত, প্রতিটি গোত্রের নিজস্ব টোটেম অর্থাৎ উপাস্য দেবতা বর্তমান। মূলত ১৩টি গোত্র ও তাদের টোটেমগুলো হলোÑবাস্কে (লাল নটে শাক), বেসরা (বাজপাখি), হাঁসদা (বুনো হাঁস), হেমব্রম (বাদাম), কিস্কু (মাছরাঙা), মা-ি (নীল চক্র নামে নীল পাখি), মুর্মু (শাল মাছ), সোরেন, টুডু (মেঠো ইঁদুর), ছোরে (গিরগিটি), সামাহ (এক প্রকার ঘাস), পাহিরি (গোল কুমড়ো), খাংগার (ডোমকাক)।
মাহালিরা কয়েকটি গোত্রের জন্য কিছু নিজস্ব শব্দ ব্যবহার করে, যেমনÑ‘মুর্মু’-এর জন্য ডুমরি, ‘কিস্কু’-এর জন্য বিসরা, ‘টুডু’-এর জন্য বারহে, ‘মা-ি’-এর জন্য মারডি, ‘সোরেন’-এর জন্য কাউরিয়া ইত্যাদি। প্রতিটি গোত্র আবার কয়েকটি উপগোত্রে বিভক্ত, যেগুলো ‘খুঁট’ নামে পরিচিত। মাহালিদের মধ্যে সমজাতির মধ্যে বিবাহ এবং আন্তঃগোত্র বিবাহ প্রচলিত। তবে বহুবিবাহ প্রচলিত নয়।
মাহালী সম্প্রদায়ের বাড়িগুলোকে ‘ওরাক’ বলা হয়। মাহালিদের মধ্যে অনু পরিবার প্রচলিত। পরিবারের প্রধানের মৃত্যুর পর সম্পত্তির মালিকানা মৃতের ছেলে ভোগ করে। মাহালী সমাজ পিতৃতান্ত্রিক, এখানে বিয়ের পর মেয়েরা স্বামীর বাড়িতে বসবাস করে। সাধারণত বিয়ের পর বর-কনের বসবাসের জন্য নতুন গৃহনির্মাণের প্রচলন রয়েছে। এই কারণে মাহালী সমাজে যৌথ পরিবার খুব সীমিত। পিতৃতান্ত্রিকতার কারণে পুত্রদের সুখ ও সমৃদ্ধির জন্য মায়েরা বিশেষ ব্রত পালন করেনÑএমন ধারণাও প্রচলিত, কারণ নারীরা পুরুষের আয় বা সম্পত্তির ওপর নির্ভরশীল হয়ে জীবন যাপন করেন।
জিতিয়া ব্রত মূলত পূর্ব ভারত ও নেপালে পালন করা হয়। এটি হিন্দুধর্মে বিশেষত মহিলাদের মধ্যে অপরিসীম তাৎপর্য বহন করে। ভগবান জীবিতবাহনকে উৎসর্গীকৃত এই উপবাস সাধারণত মায়েরা তাদের সন্তানদের দীর্ঘায়ু ও মঙ্গলের জন্য পালন করেন। আশ্বিন মাসে পালিত এই ব্রত একজন মায়ের অবিচল ভক্তি ও নিঃস্বার্থ ভালোবাসার প্রতীক। সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত উপবাস করে মহিলারা সন্তানদের স্বাস্থ্য, সমৃদ্ধি ও সুখের জন্য আশীর্বাদ খোঁজেন।
তিন দিনব্যাপী অনুষ্ঠানের ধাপগুলো হলোÑ
নাহাই-খাই: প্রথম দিন, মায়েরা স্নান সেরে নিরামিষ খাবার খান, যা ঘি ও গোলাপি লবণ দিয়ে তৈরি হয়।
খুর-জিতিয়া বা জীবিতপুত্রিকা দিবস: দ্বিতীয় দিন, কঠোর উপবাস পালিত হয়, জল পানও নিষিদ্ধ।
পারানা: তৃতীয় দিন, উপবাস ভঙ্গ করা হয়। তৈরি হয় নানা সুস্বাদু খাবারÑকারি ভাত, ননি শাক ও মারুয়া রুটি।
বিহার ও উত্তরপ্রদেশে শৃগাল ও ঈগলের কাহিনি বিখ্যাত। ভগবান জিমুতবাহনের সঙ্গে শৃগাল ও ঈগলের নামেও প্রার্থনা করা হয়। এই ব্রতটি জীবিতবাহনের কিংবদন্তিকেও স্মরণ করে, যিনি নিঃস্বার্থতা ও মাতৃপ্রেমের গুণাবলি তুলে ধরে অন্যকে বাঁচাতে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন।
জিতিয়া ব্রতের আচারে সূর্যোদয়ের পর স্নান ও নতুন পোশাক পরা দিয়ে শুরু হয়। ভক্তরা মন্দিরে বা বাড়িতে পূজা করেন। “নির্জলা ব্রত” পালনকারীরা সারাদিন জল পান করেন না, আবার কেউ কেউ “ফলাহার ব্রত”-এ ফল ও শাকসবজি খান। সন্ধ্যায় তারা সিঁদুর, চাল ও ফুল দিয়ে সাজানো মঞ্চে প্রদীপ জ্বালিয়ে প্রার্থনা করেন। সাতটি শস্য দিয়ে প্রতীকী অনুষ্ঠান হয়, যা সপ্তাহের সাত দিনের প্রতিনিধিত্ব করে।
উপবাস ভঙ্গের পর প্রসাদ ভাগ করা হয়, মিষ্টি, ফল ও নৈবেদ্য সবার মাঝে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। সন্তানদের মঙ্গল কামনায় সম্মিলিত প্রার্থনা করা হয়। পরদিন সকালে দরিদ্রদের মধ্যে খাবার ও পোশাক বিতরণ করা হয়।
কিংবদন্তি: জিমুতবাহন গন্ধর্বদের রাজা ছিলেন। রাজ্য ছেড়ে পিতার সেবায় বনে গিয়ে তিনি মলয়বতীকে বিয়ে করেন। এক বৃদ্ধাকে শোকে কাতর দেখে তিনি জানতে পারেন, শাপগ্রস্ত নাগবংশের কারণে তার পুত্রকে গরুড়ের খাদ্য হতে হবে। জিমুতবাহন নিজেকে উৎসর্গ করে শঙ্খচূড়কে রক্ষা করেন। গরুড় তার দয়া ও দানশীলতায় মুগ্ধ হয়ে নাগবংশের কাছে আর কোনো বলি নেবেন না বলে প্রতিশ্রুতি দেন। এ স্মৃতিই জিতিয়া ব্রতের অনুপ্রেরণা।
অনেকে বলেন, আশ্বিনে আদিবাসীদের আলাদা কোনো জিতিয়া উৎসব নেই। জিতিয়া আসলে একটি সনাতন হিন্দু উৎসব, যা হাজার বছর আগে থেকেই নেপাল ও ভারতের কিছু অঞ্চলে পালিত হচ্ছে। তবুও এটি মাহালী সম্প্রদায়ের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উৎসব।
উপমহাদেশের সমতলের আদিবাসীরা অনার্য, যারা হাজার হাজার বছর ধরে এখানে বাস করছে। এরা প্রকৃতির উপাসক। বর্ণহিন্দুরাও তাদের পূজা-অর্চনায় এই অনার্য সংস্কৃতির অনেক কিছু গ্রহণ করেছে। দুর্গাপূজায় ঘটোত্তলন, নবপত্রিকার পূজা, সন্ধিপূজা তার প্রমাণ। পশ্চিমবঙ্গের জঙ্গলমহল জুড়ে রঙ্গিনী, সাতবহনী, চ-ী, কনকদুর্গাসহ আদিবাসী দেবীদের পূজার পীঠস্থান রয়েছে। চ-ী এখানে নানা রূপে পূজিত হনÑজয়চ-ী, গুপ্তমণি, ভেটিয়াচ-ী, কালুয়াষাঁড়, বালিয়াবুড়ি ইত্যাদি।
কুড়মি সমাজে আশ্বিন অষ্টমীতে ধানখেতে গুঁড়ি দিয়ে জাগানোর রীতি আছে, যা সন্তানসম্ভবা ধানগাছকে স্বাদ খাওয়ানো বলে ধরা হয়। আরেকটি প্রবাদও প্রচলিতÑ“জিতা ভাসে, বোধন আসে।”
জিতিয়া উৎসব প্রাচীন বাংলার এক উৎসব, যার ভেতর দিয়ে প্রাচীন সংস্কৃতির ধারা আজও বহমান।
[লেখক: উন্নয়নকর্মী]