জিয়াউদ্দীন আহমেদ
নির্বাচনমুখী রাজনৈতিক দলের কথা শুনলে মনে হয় নির্বাচন হলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। নির্বাচন হলে স্বৈরতন্ত্রের আর উদ্ভব হবে না, বাংলাদেশ থেকে ফ্যাসিজমের অবসান ঘটবে, দুর্নীতি নির্মূল হবে, ঘুষ শব্দটি অভিধান ছাড়া আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না, ব্যাংকলুট থাকবে না, ঋণ মেয়াদোত্তীর্ণ হবে না, অর্থ পাচার বন্ধ হবে, পাচার করা সব অর্থ ফেরত আসবে, কৃষি ও শিল্প উৎপাদনে দেশ সয়লাব হয়ে যাবে, বেকার লোক খুঁজতে আফ্রিকা যেতে হবে, ডলারের সন্ধানে বাংলাদেশের কোন বুভুক্ষুকে মালয়েশিয়ার বনজঙ্গলে রাত কাটাতে হবে না, ডিঙ্গি নৌকায় সমুদ্র পাড়ি দেওয়ার বাসনা জাগবে না, লিবিয়ার মানব পাচারকারীদের নির্যাতনে পুত্রের গোঙানির শব্দ শুনে মাকে সর্বস্ব বিক্রি করে অর্থ পাঠাতে হবে না, শুনতে হবে না টাকা না দিয়ে পতিতার দেহভোগের কাহিনী। মনে হচ্ছে নির্বাচন হলেই ভূমিদস্যুরা সৎ হয়ে যাবে, তাদের আবাসিক এলাকায় নক্সায় চিহ্নিত খেলার মাঠগুলো জেগে উঠবে, খালবিল ভরাট হবে না, সন্ত্রাস-ছিনতাই থাকবে না, চুরি-ডাকাতি হবে না, ঘরের দরজা খোলা রেখে মানুষ ঘুমাবে, আতশবাজির বিকট শব্দে পশু-পাখি মরবে না, কুকুরের মাথার উপর গরম চা কেউ ঢালবে না।
শুধু তাই নয়, নির্বাচনমুখী লোকজনের ধারণা নির্বাচন হলে মূল্যস্ফীতি হ্রাস পাবে, জিডিপি বৃদ্ধি পাবে, বিনিয়োগের মহাপ্লাবন হবে, কলকারখানা বন্ধ হবে না, গ্যাসের সরবরাহে কমতি হবে না, বিদ্যুতের দাম কমবে, লোডশেডিং হবে না, রাস্তায় ট্রাফিক জ্যাম থাকবে না, ওয়াজ আর ব্যা- সঙ্গীতের আওয়াজে শিক্ষার্থীর মনোযোগ নষ্ট হবে না, মাইকের শব্দে রোগী আঁৎকে উঠবে না। আবার কিছু মানুষের ধারণা, নির্বাচন হলেও এগুলোর কিচ্ছু হবে না, বরং আবির্ভাব হবে নতুন চোর, ভিন্ন সাজের ডাকাত, অর্থগৃধœু দুর্নীতিবাজ, লেবাসধারী ঘুষখোর, নব সাজে অর্থ পাচারকারী। বর্তমান দুদক কমিশনার মিঞা মুহাম্মদ আলি আকবার আজিজী তার ঘুষ দেওয়ার কাহিনী শুনিয়েছেন গণশুনানীতে। শুনিয়েছেন বহুতলা ভবনের নক্সা অনুমোদনে অসংখ্য প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন বা অনাপত্তি নিতে গিয়ে কিভাবে তাকে হেনস্তা হতে হয়েছে, উল্লেখ করেছেন কিভাবে হজে যাওয়ার ঠিক পূর্বদিন তাকে এক লক্ষ টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে। ঘুষ দেওয়া অপরাধ বিধায় ঘুষ দেওয়ার কথা কেউ বলে না, ঘুষ ইমানদার লোকদেরও দিতে হয়, কিন্তু প্রমাণ করা কঠিন। প্রমাণ করা গেলেও প্রশাসনের বিরুদ্ধে লড়তে যাওয়া বোকামি, আইনের অসংখ্য ধারা, কোন ধারা জামিন অযোগ্য তা ঘুষখোর জানে। এগুলো শুধু স্বৈরাচারের আমলে হয় না, নির্বাচিত সরকারের গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায়ও হয়।
জনগণের ক্ষমতায়নই নাকি গণতান্ত্রিক নির্বাচনের মূল বৈশিষ্ট্য। অথচ বাংলাদেশে যতবার নির্বাচন হয়েছে জনগণ ততবারই ক্ষমতাহীন হয়েছে। বৈষম্য, ঘুষ-দুর্নীতি আর সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে ইশতেহার দিয়ে জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রতিটি দলীয় সরকার ক্ষমতায় বসে সবগুলো অপরাধের সঙ্গে আপোষ করেছে। নির্বাচনে যতবার ক্ষমতার বদল হয়েছে ততবার বৃদ্ধি পেয়েছে দুর্নীতি আর সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প। বিরোধী দল সব সময় সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য মিছিল করেছে, মিটিং করেছে, রাজপথে রক্ত দিয়েছে। কিন্তু এই একই বিরোধী দল ক্ষমতায় গিয়েই ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করার সর্বপ্রকার অবৈধ পন্থার আশ্রয় নিয়েছে। ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করতে গিয়েই আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টির সরকারের গণঅভ্যুত্থানে পতন হয়েছে। এই তিনটি দলের শীর্ষ নেতার কথাই আইন, তাদের কথায় দল চলে, কোন দলের অভ্যন্তরে গণতান্ত্রিক রীতিনীতির লেশমাত্রও নেই। তাই এই দলগুলো যখন ক্ষমতায় বসে তখন দলীয় শীর্ষ নেতার স্বৈরতান্ত্রিক আচরণ অটোমেটিক্যালি সরকারের উপর ছায়া ফেলে।
নির্বাচনের মাধ্যমে শুধু দুর্নীতিবাজের পরিবর্তন হয়। দুঃখের বিষয় আমাদের দেশে নির্বাচনটাও দুর্নীতিগ্রস্ত, নির্বাচনকে যারাই দুর্নীতিগ্রস্ত করেছে তাদের আবার পতনও হয়েছে। নির্বাচনকে দুর্নীতিগ্রস্ত করার কারণে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ূব খানেরও পতন হয়েছিল। ১৯৭৩ সনে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত প্রথম নির্বাচনেও কারচুপি হয়েছে। সুষ্ঠু নির্বাচন হলেও আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করতে পারত। কিন্তু তারা চেয়েছিল ৩০০ আসনে জিততে। আওয়ামী লীগের খন্দকার মোশতাক স্বতন্ত্র প্রার্থী আব্দুর রশীদ ইঞ্জিনিয়ারের নিকট বিপুল ভোটে পরাজিত হলেও খন্দকার মোস্তাককেই বিজয়ী ঘোষণা করা হয়, এমন ঘটনা আরও হয়েছে। তারপর হলো জিয়াউর রহমানে ‘গণভোট’, ১৯৭৯ সনের দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচন। গণভোটে কোন কোন কেন্দ্রে মোট ভোটের চেয়ে জিয়াউর রহমানের পক্ষে কাস্টিং ভোট ছিল বেশি। এরশাদের আমলে ১৯৮৬ ও ১৯৮৮ সনের নির্বাচন, বিএনপির আমলের ১৯৯৪ সনের মাগুরার উপনির্বাচন ও ১৯৯৬ সনের ফেব্রুয়ারির জাতীয় সংসদ নির্বাচন, আওয়ামী লীগ আমলের ২০১৪ সনের নির্বাচন- সবগুলো নির্বাচনই ছিল একতরফা ও একচেটিয়া।এছাড়াও ২০১৮ সনের নৈশ ভোটের কথা সবার জানা। স্বাধীনতা লাভের পর থেকে অদ্যাবধি দলীয় সরকারের অধীনে একটি নির্বাচনও সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়নি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত চারটি নির্বাচন বাহ্যিক দৃষ্টিকোণ থাকে সুষ্ঠু হলেও বিরোধী দলের সংসদ সদস্যরা কিন্তু সংসদে অনুপস্থিত ছিলেন। অনুপস্থিত থাকলেও তারা বেতনভাতা নিতে ভুল করেননি। এমন নীতিহীন সাংসদদের নির্বাচন করার জন্যই আমাদের ভোট দিতে হবে।
সংসদে কী হয়? ক্ষমতাসীন সরকার যা চায় তাই পাস হয়, পাস হয় কণ্ঠ ভোটে। বাংলাদেশে বিগত ৫৪ বছরে সংসদে এবং সংসদের বাইরে নিবর্তনমূলক আইন পাস করতে কোন দলীয় সরকারের কখনো বেগ পেতে হয়নি। বাক স্বাধীনতা রুদ্ধ করার জন্য বা বিরোধী দলকে দমন করার জন্য সব সরকারই গণতান্ত্রিক নিয়মকানুন মেনে নিবর্তনমূলক আইন করেছে। এই সকল আইন পাসের সময় বিরোধী সাংসদদের আপত্তির প্রতি কর্ণপাত করা হয়নি। ভবিষ্যতেও তাই হবে। যে সংসদ সদস্যদের অনুমোদনে জনগণের উপর ট্যাক্স আরোপিত হয়, সেই সংসদ সদস্যদের ট্যাক্স ছাড়া গাড়ি আমদানির অনুমোন দেওয়া হয়েছে এই সংসদেই। ইন্টারেস্টিং বিষয় হচ্ছে, নিজেদের সুবিধা নেওয়ার ক্ষেত্রে সরকার এবং বিরোধী সংসদ সদস্যগণের মধ্যে কোন বিরোধ থাকে না। সংসদ সদস্যগণ জনগণের প্রতিনিধি, কিন্তু সংসদের ভেতরে ও বাইরে তাদের আচরণ প্রতিনিধিত্বমূলক থাকে না- সংসদের বাইরে অনেক চড়থাপ্পড়ের কথা শুনেছি, আর সংসদের ভেতরে শুনেছি কোনো কোনো সংসদ সদস্যের খিস্তিখেউড়। সংসদ সদস্যদের আরও কিছু বিরক্তিকর কীর্তি আছে- বরাদ্দকৃত দুই মিনিটের বক্তব্যে পৌনে দুই মিনিট দলীয় শীর্ষ নেতার গুণগান করেন, দলীয় নেতার দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য অভিধান থেকে বেছে বেছে উপযোগী বিশেষণগুলো প্রয়োগ করেন, কিন্তু দলীয় শীর্ষ নেতা সংসদে না থাকলে জনগণের কথা বলার ক্ষেত্রেও তাদের কোন আগ্রহ থাকে না। এমন সংসদের জন্য রাজনৈতিক দলের নেতাদের আগ্রহ আকাশচুম্বি হলেও জনগণ ত্যক্তবিরক্ত।
যে গণতন্ত্রে সরকার দলীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ সংসদ সদস্যদের ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় ভালো-মন্দ সব আইনসম্মত করা সম্ভব হয়, সেই গণতান্ত্রিক নির্বাচনের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার দরকার নেই, সুষ্ঠু নির্বাচন অপরিহার্য নয়। বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবীরা নির্বাচনে স্বচ্ছতা আনার ব্যাপারে সোচ্চার, কিন্তু সুশাসন প্রতিষ্ঠায় বা গণতান্ত্রিক আচরণে সরকারকে বাধ্য করতে পারে না। জনবিরোধী আইন করে গণবিরোধী কর্মকা- পরিচালনার জন্য সুষ্ঠু নির্বাচনে জনগণও কিন্তু একদিনের গণতন্ত্র উপভোগ করার সুযোগ পায়, ভোট দিতে পারে। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যে রাজা-বাদশাহর সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে যেমন কথা বলে নিস্কৃতি পাওয়া যায় না, তেমনি বাংলাদেশেও নির্বাচিত সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলে খাঁচার বাইরে থাকা যায় না। রাজা-বাদশাহর বিরুদ্ধে কথা বললে সাংবাদিক খাসোগীর মতো করাত দিয়ে টুকরা টুকরা করে কেটে ফেলা হয়, আর বাংলাদেশে হয় হামলা-মামলা, রিমা-, গুম, হত্যা, মব লিঞ্চিং ইত্যাদি। সবই হয় গণতন্ত্রের নিয়মকানুন মেনে, সব হয় নির্বাচিত সরকারের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে। তাই মনে হয় সরকারের কিছু অপকর্মকে আইনের ভিত্তি দেওয়ার জন্যই নির্বাচন প্রয়োজন। বাংলাদেশে সুশাসনের বড়ই অভাব। ক্ষমতায় গিয়েই বলবে, নতুন দেশ, এত দ্রুত সুশাসন প্রত্যাশিত নয়। বিরোধী দল কিন্তু তা বলে না। চুয়ান্ন বছর বয়সেও কেন বাংলাদেশ এখনো শিশু রয়ে গেল সেই প্রশ্নের উত্তর ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের কাছে কখনো পাওয়া যায়নি।
প্রকৃত গণতান্ত্রিক নির্বাচন বা গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা এই দেশের জনগণ কখনো দেখেনি, অদূর ভবিষ্যতে দেখবে বলেও মনে হয় না। তারপরও দেশের জনগণ মাওলানা ভাসানীর মতো ‘ভোটের বাক্সে লাথি’ মারতে চায় না। কারণ ভোটের আমেজে কখনো কখনো ভোটারদেরও প্রপ্তিযোগ হয়- কথাটি প্রধান উপদেষ্টাও বলেছেন। আওয়ামী লীগ কার্যত নিষিদ্ধ, যদিও আওয়ামী লীগের কর্মকা-ের উপর নিষেধাজ্ঞা একেবারেই ‘সাময়িক’ বলে উল্লেখ করেছেন প্রধান উপদেষ্টা। কিন্তু আওয়ামী লীগকে নির্বাচন করতে দেওয়া হবে বলে মনে হয় না। ফলে মুহাম্মদ ইউনূসের কথিত ‘এক পরিবার’ আর গড়ে উঠল না, এতে ভবিষ্যতের জন্য একটা বিষফোঁড়ার জন্ম হলো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সারা পৃথিবী থেকে ইংরেজ জাতি তাদের কলোনিগুলোকে স্বাধীনতা প্রদান করলেও প্রতিটি কলোনিতে এক বা একাধিক বিষফোঁড়া রেখে গেছে, সেই বিষফোঁড়ার বিষে আজও প্রতিটি দেশ জাতিগত সংঘাতে মারামারি করছে, এক প্রতিবেশী আরেক প্রতিবেশীর সঙ্গে করছে যুদ্ধ। এক পরিবার গড়তে না পারার ব্যর্থতায় যে বিষফোঁড়ার জন্ম হয়েছে তা বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিম-লে আজ না হোক আগামীকাল যে একটি বিস্ফোরণ ঘটাবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। কথাটি শুধু আমাদের নয়, ১২৫ বছরের পুরানো পত্রিকা ‘জাপান টাইমসেরও’। পাকিস্তানের অন্যতম প্রভাবশালী পত্রিকা ‘দ্য ডন’ও বলেছে, ‘আওয়ামী লীগের নিবন্ধন বাতিল এবং নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিষিদ্ধের বিষয়টি বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নির্বাচনের স্বচ্ছতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে’।
কোন সংস্কার ছাড়াই নির্বাচন হচ্ছে, তাহলে এই নির্বাচন কিভাবে স্বৈরতন্ত্রের আবির্ভাব প্রতিরোধ করবে? আমরা যে নির্বাচন কমিশন দেখছি তা তো পুরাতন কাঠামোতে নতুন লোকের সমাবেশ মাত্র। নির্বাচন সংশ্লিষ্ট কিছু মৌলিক সংস্কার ব্যতিরেকে আসন্ন নির্বাচন অবশ্যই প্রশ্নবিদ্ধ হবে। স্রেফ আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের জন্য গণঅভ্যুত্থান হয়নি, অভ্যুত্থান হয়েছে দেশের ঘুনেধরা মনমানসিকতায় পরিবর্তন এনে বাংলাদেশকে বৈষম্যহীন, মানবিক ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত করার বৃহত্তর প্রেষণায়। কিন্তু একটি বছর কেটে গেল শুধু ‘আওয়ামী ফোবিয়া’ আর অপ্রয়োজনীয় বাকবিত-ায়। আগের ধারায় নির্বাচন হলে ‘জুলাই অভ্যূত্থানের চেতনা’ও প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে।
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
[লেখক: সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক]
জিয়াউদ্দীন আহমেদ
রোববার, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫
নির্বাচনমুখী রাজনৈতিক দলের কথা শুনলে মনে হয় নির্বাচন হলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। নির্বাচন হলে স্বৈরতন্ত্রের আর উদ্ভব হবে না, বাংলাদেশ থেকে ফ্যাসিজমের অবসান ঘটবে, দুর্নীতি নির্মূল হবে, ঘুষ শব্দটি অভিধান ছাড়া আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না, ব্যাংকলুট থাকবে না, ঋণ মেয়াদোত্তীর্ণ হবে না, অর্থ পাচার বন্ধ হবে, পাচার করা সব অর্থ ফেরত আসবে, কৃষি ও শিল্প উৎপাদনে দেশ সয়লাব হয়ে যাবে, বেকার লোক খুঁজতে আফ্রিকা যেতে হবে, ডলারের সন্ধানে বাংলাদেশের কোন বুভুক্ষুকে মালয়েশিয়ার বনজঙ্গলে রাত কাটাতে হবে না, ডিঙ্গি নৌকায় সমুদ্র পাড়ি দেওয়ার বাসনা জাগবে না, লিবিয়ার মানব পাচারকারীদের নির্যাতনে পুত্রের গোঙানির শব্দ শুনে মাকে সর্বস্ব বিক্রি করে অর্থ পাঠাতে হবে না, শুনতে হবে না টাকা না দিয়ে পতিতার দেহভোগের কাহিনী। মনে হচ্ছে নির্বাচন হলেই ভূমিদস্যুরা সৎ হয়ে যাবে, তাদের আবাসিক এলাকায় নক্সায় চিহ্নিত খেলার মাঠগুলো জেগে উঠবে, খালবিল ভরাট হবে না, সন্ত্রাস-ছিনতাই থাকবে না, চুরি-ডাকাতি হবে না, ঘরের দরজা খোলা রেখে মানুষ ঘুমাবে, আতশবাজির বিকট শব্দে পশু-পাখি মরবে না, কুকুরের মাথার উপর গরম চা কেউ ঢালবে না।
শুধু তাই নয়, নির্বাচনমুখী লোকজনের ধারণা নির্বাচন হলে মূল্যস্ফীতি হ্রাস পাবে, জিডিপি বৃদ্ধি পাবে, বিনিয়োগের মহাপ্লাবন হবে, কলকারখানা বন্ধ হবে না, গ্যাসের সরবরাহে কমতি হবে না, বিদ্যুতের দাম কমবে, লোডশেডিং হবে না, রাস্তায় ট্রাফিক জ্যাম থাকবে না, ওয়াজ আর ব্যা- সঙ্গীতের আওয়াজে শিক্ষার্থীর মনোযোগ নষ্ট হবে না, মাইকের শব্দে রোগী আঁৎকে উঠবে না। আবার কিছু মানুষের ধারণা, নির্বাচন হলেও এগুলোর কিচ্ছু হবে না, বরং আবির্ভাব হবে নতুন চোর, ভিন্ন সাজের ডাকাত, অর্থগৃধœু দুর্নীতিবাজ, লেবাসধারী ঘুষখোর, নব সাজে অর্থ পাচারকারী। বর্তমান দুদক কমিশনার মিঞা মুহাম্মদ আলি আকবার আজিজী তার ঘুষ দেওয়ার কাহিনী শুনিয়েছেন গণশুনানীতে। শুনিয়েছেন বহুতলা ভবনের নক্সা অনুমোদনে অসংখ্য প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন বা অনাপত্তি নিতে গিয়ে কিভাবে তাকে হেনস্তা হতে হয়েছে, উল্লেখ করেছেন কিভাবে হজে যাওয়ার ঠিক পূর্বদিন তাকে এক লক্ষ টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে। ঘুষ দেওয়া অপরাধ বিধায় ঘুষ দেওয়ার কথা কেউ বলে না, ঘুষ ইমানদার লোকদেরও দিতে হয়, কিন্তু প্রমাণ করা কঠিন। প্রমাণ করা গেলেও প্রশাসনের বিরুদ্ধে লড়তে যাওয়া বোকামি, আইনের অসংখ্য ধারা, কোন ধারা জামিন অযোগ্য তা ঘুষখোর জানে। এগুলো শুধু স্বৈরাচারের আমলে হয় না, নির্বাচিত সরকারের গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায়ও হয়।
জনগণের ক্ষমতায়নই নাকি গণতান্ত্রিক নির্বাচনের মূল বৈশিষ্ট্য। অথচ বাংলাদেশে যতবার নির্বাচন হয়েছে জনগণ ততবারই ক্ষমতাহীন হয়েছে। বৈষম্য, ঘুষ-দুর্নীতি আর সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে ইশতেহার দিয়ে জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রতিটি দলীয় সরকার ক্ষমতায় বসে সবগুলো অপরাধের সঙ্গে আপোষ করেছে। নির্বাচনে যতবার ক্ষমতার বদল হয়েছে ততবার বৃদ্ধি পেয়েছে দুর্নীতি আর সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প। বিরোধী দল সব সময় সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য মিছিল করেছে, মিটিং করেছে, রাজপথে রক্ত দিয়েছে। কিন্তু এই একই বিরোধী দল ক্ষমতায় গিয়েই ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করার সর্বপ্রকার অবৈধ পন্থার আশ্রয় নিয়েছে। ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করতে গিয়েই আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টির সরকারের গণঅভ্যুত্থানে পতন হয়েছে। এই তিনটি দলের শীর্ষ নেতার কথাই আইন, তাদের কথায় দল চলে, কোন দলের অভ্যন্তরে গণতান্ত্রিক রীতিনীতির লেশমাত্রও নেই। তাই এই দলগুলো যখন ক্ষমতায় বসে তখন দলীয় শীর্ষ নেতার স্বৈরতান্ত্রিক আচরণ অটোমেটিক্যালি সরকারের উপর ছায়া ফেলে।
নির্বাচনের মাধ্যমে শুধু দুর্নীতিবাজের পরিবর্তন হয়। দুঃখের বিষয় আমাদের দেশে নির্বাচনটাও দুর্নীতিগ্রস্ত, নির্বাচনকে যারাই দুর্নীতিগ্রস্ত করেছে তাদের আবার পতনও হয়েছে। নির্বাচনকে দুর্নীতিগ্রস্ত করার কারণে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ূব খানেরও পতন হয়েছিল। ১৯৭৩ সনে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত প্রথম নির্বাচনেও কারচুপি হয়েছে। সুষ্ঠু নির্বাচন হলেও আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করতে পারত। কিন্তু তারা চেয়েছিল ৩০০ আসনে জিততে। আওয়ামী লীগের খন্দকার মোশতাক স্বতন্ত্র প্রার্থী আব্দুর রশীদ ইঞ্জিনিয়ারের নিকট বিপুল ভোটে পরাজিত হলেও খন্দকার মোস্তাককেই বিজয়ী ঘোষণা করা হয়, এমন ঘটনা আরও হয়েছে। তারপর হলো জিয়াউর রহমানে ‘গণভোট’, ১৯৭৯ সনের দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচন। গণভোটে কোন কোন কেন্দ্রে মোট ভোটের চেয়ে জিয়াউর রহমানের পক্ষে কাস্টিং ভোট ছিল বেশি। এরশাদের আমলে ১৯৮৬ ও ১৯৮৮ সনের নির্বাচন, বিএনপির আমলের ১৯৯৪ সনের মাগুরার উপনির্বাচন ও ১৯৯৬ সনের ফেব্রুয়ারির জাতীয় সংসদ নির্বাচন, আওয়ামী লীগ আমলের ২০১৪ সনের নির্বাচন- সবগুলো নির্বাচনই ছিল একতরফা ও একচেটিয়া।এছাড়াও ২০১৮ সনের নৈশ ভোটের কথা সবার জানা। স্বাধীনতা লাভের পর থেকে অদ্যাবধি দলীয় সরকারের অধীনে একটি নির্বাচনও সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়নি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত চারটি নির্বাচন বাহ্যিক দৃষ্টিকোণ থাকে সুষ্ঠু হলেও বিরোধী দলের সংসদ সদস্যরা কিন্তু সংসদে অনুপস্থিত ছিলেন। অনুপস্থিত থাকলেও তারা বেতনভাতা নিতে ভুল করেননি। এমন নীতিহীন সাংসদদের নির্বাচন করার জন্যই আমাদের ভোট দিতে হবে।
সংসদে কী হয়? ক্ষমতাসীন সরকার যা চায় তাই পাস হয়, পাস হয় কণ্ঠ ভোটে। বাংলাদেশে বিগত ৫৪ বছরে সংসদে এবং সংসদের বাইরে নিবর্তনমূলক আইন পাস করতে কোন দলীয় সরকারের কখনো বেগ পেতে হয়নি। বাক স্বাধীনতা রুদ্ধ করার জন্য বা বিরোধী দলকে দমন করার জন্য সব সরকারই গণতান্ত্রিক নিয়মকানুন মেনে নিবর্তনমূলক আইন করেছে। এই সকল আইন পাসের সময় বিরোধী সাংসদদের আপত্তির প্রতি কর্ণপাত করা হয়নি। ভবিষ্যতেও তাই হবে। যে সংসদ সদস্যদের অনুমোদনে জনগণের উপর ট্যাক্স আরোপিত হয়, সেই সংসদ সদস্যদের ট্যাক্স ছাড়া গাড়ি আমদানির অনুমোন দেওয়া হয়েছে এই সংসদেই। ইন্টারেস্টিং বিষয় হচ্ছে, নিজেদের সুবিধা নেওয়ার ক্ষেত্রে সরকার এবং বিরোধী সংসদ সদস্যগণের মধ্যে কোন বিরোধ থাকে না। সংসদ সদস্যগণ জনগণের প্রতিনিধি, কিন্তু সংসদের ভেতরে ও বাইরে তাদের আচরণ প্রতিনিধিত্বমূলক থাকে না- সংসদের বাইরে অনেক চড়থাপ্পড়ের কথা শুনেছি, আর সংসদের ভেতরে শুনেছি কোনো কোনো সংসদ সদস্যের খিস্তিখেউড়। সংসদ সদস্যদের আরও কিছু বিরক্তিকর কীর্তি আছে- বরাদ্দকৃত দুই মিনিটের বক্তব্যে পৌনে দুই মিনিট দলীয় শীর্ষ নেতার গুণগান করেন, দলীয় নেতার দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য অভিধান থেকে বেছে বেছে উপযোগী বিশেষণগুলো প্রয়োগ করেন, কিন্তু দলীয় শীর্ষ নেতা সংসদে না থাকলে জনগণের কথা বলার ক্ষেত্রেও তাদের কোন আগ্রহ থাকে না। এমন সংসদের জন্য রাজনৈতিক দলের নেতাদের আগ্রহ আকাশচুম্বি হলেও জনগণ ত্যক্তবিরক্ত।
যে গণতন্ত্রে সরকার দলীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ সংসদ সদস্যদের ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় ভালো-মন্দ সব আইনসম্মত করা সম্ভব হয়, সেই গণতান্ত্রিক নির্বাচনের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার দরকার নেই, সুষ্ঠু নির্বাচন অপরিহার্য নয়। বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবীরা নির্বাচনে স্বচ্ছতা আনার ব্যাপারে সোচ্চার, কিন্তু সুশাসন প্রতিষ্ঠায় বা গণতান্ত্রিক আচরণে সরকারকে বাধ্য করতে পারে না। জনবিরোধী আইন করে গণবিরোধী কর্মকা- পরিচালনার জন্য সুষ্ঠু নির্বাচনে জনগণও কিন্তু একদিনের গণতন্ত্র উপভোগ করার সুযোগ পায়, ভোট দিতে পারে। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যে রাজা-বাদশাহর সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে যেমন কথা বলে নিস্কৃতি পাওয়া যায় না, তেমনি বাংলাদেশেও নির্বাচিত সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলে খাঁচার বাইরে থাকা যায় না। রাজা-বাদশাহর বিরুদ্ধে কথা বললে সাংবাদিক খাসোগীর মতো করাত দিয়ে টুকরা টুকরা করে কেটে ফেলা হয়, আর বাংলাদেশে হয় হামলা-মামলা, রিমা-, গুম, হত্যা, মব লিঞ্চিং ইত্যাদি। সবই হয় গণতন্ত্রের নিয়মকানুন মেনে, সব হয় নির্বাচিত সরকারের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে। তাই মনে হয় সরকারের কিছু অপকর্মকে আইনের ভিত্তি দেওয়ার জন্যই নির্বাচন প্রয়োজন। বাংলাদেশে সুশাসনের বড়ই অভাব। ক্ষমতায় গিয়েই বলবে, নতুন দেশ, এত দ্রুত সুশাসন প্রত্যাশিত নয়। বিরোধী দল কিন্তু তা বলে না। চুয়ান্ন বছর বয়সেও কেন বাংলাদেশ এখনো শিশু রয়ে গেল সেই প্রশ্নের উত্তর ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের কাছে কখনো পাওয়া যায়নি।
প্রকৃত গণতান্ত্রিক নির্বাচন বা গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা এই দেশের জনগণ কখনো দেখেনি, অদূর ভবিষ্যতে দেখবে বলেও মনে হয় না। তারপরও দেশের জনগণ মাওলানা ভাসানীর মতো ‘ভোটের বাক্সে লাথি’ মারতে চায় না। কারণ ভোটের আমেজে কখনো কখনো ভোটারদেরও প্রপ্তিযোগ হয়- কথাটি প্রধান উপদেষ্টাও বলেছেন। আওয়ামী লীগ কার্যত নিষিদ্ধ, যদিও আওয়ামী লীগের কর্মকা-ের উপর নিষেধাজ্ঞা একেবারেই ‘সাময়িক’ বলে উল্লেখ করেছেন প্রধান উপদেষ্টা। কিন্তু আওয়ামী লীগকে নির্বাচন করতে দেওয়া হবে বলে মনে হয় না। ফলে মুহাম্মদ ইউনূসের কথিত ‘এক পরিবার’ আর গড়ে উঠল না, এতে ভবিষ্যতের জন্য একটা বিষফোঁড়ার জন্ম হলো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সারা পৃথিবী থেকে ইংরেজ জাতি তাদের কলোনিগুলোকে স্বাধীনতা প্রদান করলেও প্রতিটি কলোনিতে এক বা একাধিক বিষফোঁড়া রেখে গেছে, সেই বিষফোঁড়ার বিষে আজও প্রতিটি দেশ জাতিগত সংঘাতে মারামারি করছে, এক প্রতিবেশী আরেক প্রতিবেশীর সঙ্গে করছে যুদ্ধ। এক পরিবার গড়তে না পারার ব্যর্থতায় যে বিষফোঁড়ার জন্ম হয়েছে তা বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিম-লে আজ না হোক আগামীকাল যে একটি বিস্ফোরণ ঘটাবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। কথাটি শুধু আমাদের নয়, ১২৫ বছরের পুরানো পত্রিকা ‘জাপান টাইমসেরও’। পাকিস্তানের অন্যতম প্রভাবশালী পত্রিকা ‘দ্য ডন’ও বলেছে, ‘আওয়ামী লীগের নিবন্ধন বাতিল এবং নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিষিদ্ধের বিষয়টি বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নির্বাচনের স্বচ্ছতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে’।
কোন সংস্কার ছাড়াই নির্বাচন হচ্ছে, তাহলে এই নির্বাচন কিভাবে স্বৈরতন্ত্রের আবির্ভাব প্রতিরোধ করবে? আমরা যে নির্বাচন কমিশন দেখছি তা তো পুরাতন কাঠামোতে নতুন লোকের সমাবেশ মাত্র। নির্বাচন সংশ্লিষ্ট কিছু মৌলিক সংস্কার ব্যতিরেকে আসন্ন নির্বাচন অবশ্যই প্রশ্নবিদ্ধ হবে। স্রেফ আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের জন্য গণঅভ্যুত্থান হয়নি, অভ্যুত্থান হয়েছে দেশের ঘুনেধরা মনমানসিকতায় পরিবর্তন এনে বাংলাদেশকে বৈষম্যহীন, মানবিক ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত করার বৃহত্তর প্রেষণায়। কিন্তু একটি বছর কেটে গেল শুধু ‘আওয়ামী ফোবিয়া’ আর অপ্রয়োজনীয় বাকবিত-ায়। আগের ধারায় নির্বাচন হলে ‘জুলাই অভ্যূত্থানের চেতনা’ও প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে।
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
[লেখক: সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক]