শাহ মো. জিয়াউদ্দিন
বাংলাদেশের মতো নেপালেও তরুণ প্রজন্ম সরকারবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে
নেপালে তীব্র গণবিক্ষোভের মুখে কেপি শর্মা ওলির সরকার পদত্যাগে বাধ্য হয়েছে। বিক্ষোভের চরম পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী ওলি দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। বাংলাদেশের মতো নেপালেও তরুণ প্রজন্ম (জেন জি) সরকারবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ সত্ত্বেও গণরোষ ঠেকানো যায়নি। এই আন্দোলনে এ পর্যন্ত ২১ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। পদত্যাগের পরও নেপালে অশান্তি অব্যাহত রয়েছে; বিক্ষোভকারীরা সরকারি ভবন ও ভক্তপুরের বালাকোটে ওলির বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে।
কেপি শর্মা ওলি ২০১৪ সাল থেকে নেপালের কমিউনিস্ট পার্টি (ইউনিফাইড মার্কসবাদী-লেনিনবাদী) বা সিপিএন-ইউএমএল-এর চেয়ারম্যান। তিনি দুই মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন (২০১৫-১৬ এবং ২০১৮-২১) এবং ২০১৭ সাল থেকে ঝাপা-৫-এর সংসদ সদস্য। এর আগে তিনি ঝাপা-৬, ঝাপা-২, এবং ঝাপা-৭ থেকে সংসদ সদস্য ছিলেন। ওলি ২০১৫ সালে ভারতের অবরোধের বিরোধিতা করে চীনের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক জোরদার করেছিলেন। তবে, অশ্লীল মন্তব্য, সমালোচক ও মিডিয়ার প্রতি শত্রুতা, স্বজনপ্রীতি, এবং দুর্নীতির অভিযোগে তার শাসনকাল বিতর্কিত হয়ে ওঠে।
২০২২ সালের নভেম্বরে নেপালে সর্বশেষ সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এতে নেপালি কংগ্রেস (এনসি) বৃহত্তম দল হিসেবে আবির্ভূত হলেও সিপিএন-ইউএমএল এবং কমিউনিস্ট পার্টি-মাওবাদী সেন্টার (সিপিএন-এমসি) জোট সরকার গঠন করে। ২০২৪ সালের জুলাই থেকে এই জোটে অস্থিরতা দেখা দেয়, এবং ২০২৫ সালের মার্চে তিনকুনে সহিংস বিক্ষোভে দুই বেসামরিক নাগরিক নিহত হন। এই অস্থিরতার মধ্যে ২০২৭ সালের নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, কারণ ওলি সরকারকে জনগণ স্বৈরাচারী, গণবিরোধী, এবং দুর্নীতিগ্রস্ত হিসেবে বিবেচনা করেছে।
ওলি সরকারের পতনের পেছনে
নেপালের সংবাদমাধ্যমের দাবি, তরুণ নেতা সুদান গুরুং (৩৬) এই আন্দোলনের মূল কা-ারী। ২০১৫ সালের ভূমিকম্পে নিজের সন্তান হারানোর পর তিনি ‘হামি নেপাল’ নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। এই সংগঠন ছাত্র-যুবদের নিয়ে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য কাজ করে। সুদান ধীরে ধীরে তরুণদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন এবং বিপি কৈরালা ইনস্টিটিউটে দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদে নেতৃত্ব দেন।
তার নেতৃত্বে সুপরিকল্পিত আন্দোলন চারটি কৌশলের মাধ্যমে সফল হয়: ১. ডিজিটাল নেটওয়ার্ক: নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও বিকল্প মেসেজিং অ্যাপ, ভিপিএন, এবং সরাসরি যোগাযোগের মাধ্যমে বার্তা ছড়ানো হয়। ২. প্রতীকী প্রতিবাদ: তরুণরা স্কুল ইউনিফর্ম পরে বই হাতে রাস্তায় নামে, যা আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় ভাইরাল হয়। ৩. স্থানীয় সমন্বয়: প্রতিটি শহরে সমন্বয়ক নিয়োগ করে ভিড় নিয়ন্ত্রণ, মিডিয়া যোগাযোগ, এবং পুলিশি বাধা মোকাবিলা করা হয়। ৪. সরকারের পদত্যাগের দাবি: সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম পুনরায় চালু ও সরকারের পদত্যাগের দাবি জোরালো হয়।
এই সংগঠিত আন্দোলন দুই দিনের মধ্যে সরকারকে চাপে ফেলে। রাজধানী থেকে প্রদেশ পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়া বিক্ষোভ, আন্তর্জাতিক চাপ, এবং জনসমর্থনের মুখে ওলি পদত্যাগে বাধ্য হন। সুদান গুরুং আন্দোলনকারীদের শান্ত থাকতে এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিবর্তনের জন্য কাজ চালিয়ে যেতে বলেন। তার মতে, এটি নেপালের জন্য একটি নতুন সূচনা, যা দেশকে দুর্নীতি ও অকার্যকর শাসন থেকে স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক শাসনের দিকে নিয়ে যাবে।
জোট সরকারের ভাঙন
জেন জি’র আন্দোলনের প্রেক্ষিতে ক্ষমতাসীন জোট সরকার ভাঙনের মুখে পড়ে। সংসদের ২৭৫ আসনের মধ্যে নেপালি কংগ্রেসের ৮৯ আসন থাকলেও দলের জ্যেষ্ঠ নেতা শেখর কৈরালা সমর্থকদের সরকার থেকে সরে যাওয়ার নির্দেশ দেন। মাওবাদী সেন্টার (৩২ আসন) এবং জনতা সমাজবাদী পার্টিসহ অন্যান্য ছোট দল (প্রায় ১০ আসন) জোট থেকে বেরিয়ে যায়। ন্যাশনাল ইনডিপেন্ডেন্ট পার্টির (এনআইএসপি) ২১ জন এমপি একযোগে পদত্যাগ করেন এবং সংসদ ভেঙে নতুন নির্বাচনের দাবি জানান।
অর্থনৈতিক বিপর্যয়
নেপালের অর্থনীতি চরম সংকটে পড়েছে। বিশ্ব ব্যাঙ্কের পূর্বাভাসে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৪.৫% এবং ২০২৫-২৬ অর্থবছরে ৫.২% প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা ছিল, কিন্তু তা পূরণ হয়নি। ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে ফিন্যান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্ক ফোর্স (এফএটিএফ) নেপালকে দ্বিতীয়বার ধূসর তালিকাভুক্ত করে, অর্থ পাচার ও আর্থিক অপরাধ রোধে ব্যর্থতার কারণে। এটি বিনিয়োগ আকর্ষণে বাধা সৃষ্টি করেছে। তরুণরা সুযোগের অভাবে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে, এবং প্রবাসী নেপালিরা দেশের কর্মক্ষম জনসংখ্যার ১৪%।
ভুটানি শরণার্থী কেলেঙ্কারি, ললিত-নিবাস কেলেঙ্কারি, এবং সমবায় ও সোনা চোরাচালান কেলেঙ্কারি অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। ২০২০-২৩ সালে রেমিট্যান্স জিডিপির ২৪% অবদান রেখেছে, যা দক্ষিণ এশিয়ার গড় (৪%) থেকে অনেক বেশি। প্রাকৃতিক দুর্যোগও দেশটির জন্য ঝুঁকি, গত বছর বন্যায় জিডিপির ০.৮% ক্ষতি হয়েছে।
রাজনৈতিক অস্থিরতা
মার্চ থেকে রাজতন্ত্রপন্থী বিক্ষোভ কিছুটা স্তিমিত হলেও শিক্ষকদের বিক্ষোভে শিক্ষামন্ত্রী পদত্যাগ করেন। ত্রিভুবন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, নেপাল বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান, এবং জ্বালানি ও জলসম্পদ প্রতিমন্ত্রীকে বরখাস্ত করা হয়। সেন্ট্রাল ব্যাঙ্কের গভর্নর নিয়োগে বিলম্বও বিতর্কের সৃষ্টি করেছে।
বামপন্থীদের ব্যর্থতা
প্রশ্ন উঠছে, কমিউনিস্ট সরকার কেন দুর্নীতিগ্রস্ত হলো? মার্কসবাদ-লেনিনবাদের আদর্শে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য থাকলেও নেপালে শাসকশ্রেণী সম্পদের পাহাড় গড়েছে, যখন জনগণ অনাহারে-অর্ধাহারে জীবনযাপন করছে। বামপন্থী দলগুলো ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে। নেপালের পতন থেকে শিক্ষা নিয়ে বামপন্থীদের গণমানুষের দল হিসেবে গড়ে উঠতে হবে। বাংলাদেশেও বামপন্থী দলগুলো একই ভুল করছে। সদস্য নির্বাচনে নেতার তোষামোদকারীদের প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে, এমনকি মৌলবাদী সমর্থকরাও সদস্যপদ পাচ্ছে। এতে প্রশ্ন ওঠে, এই দলগুলো কি মার্কসের আদর্শে চলছে, নাকি ব্যক্তিস্বার্থে কমিউনিজমকে ব্যবহার করছে?
শিক্ষা ও ভবিষ্যৎ
নেপালের বিপর্যয় বামপন্থীদের জন্য শিক্ষণীয়। পুঁজিবাদ বা সিআইএ-এর এজেন্টদের দোষারোপ না করে নিজেদের দুর্বলতা সংশোধন করতে হবে। ব্যক্তিপূজার পরিবর্তে সমাজের চাহিদাভিত্তিক নেতৃত্ব গড়ে তুললে বামপন্থী দলগুলো জনগণের সমর্থন পাবে। অন্যথায়, তারা অস্তিত্বের সংকটে পড়বে। বাংলাদেশে হাসিনা পতনের আন্দোলনে বামপন্থীদের ভূমিকা ছিল, কিন্তু ডাকসু নির্বাচনে তাদের ব্যর্থতা প্রমাণ করে সংগঠনকে গণমুখী করতে হবে। নইলে, বামপন্থীরা ইতিহাসের পাতায় হারিয়ে যাবে।
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
[লেখক: উন্নয়নকর্মী]
শাহ মো. জিয়াউদ্দিন
বাংলাদেশের মতো নেপালেও তরুণ প্রজন্ম সরকারবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে
রোববার, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫
নেপালে তীব্র গণবিক্ষোভের মুখে কেপি শর্মা ওলির সরকার পদত্যাগে বাধ্য হয়েছে। বিক্ষোভের চরম পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী ওলি দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। বাংলাদেশের মতো নেপালেও তরুণ প্রজন্ম (জেন জি) সরকারবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ সত্ত্বেও গণরোষ ঠেকানো যায়নি। এই আন্দোলনে এ পর্যন্ত ২১ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। পদত্যাগের পরও নেপালে অশান্তি অব্যাহত রয়েছে; বিক্ষোভকারীরা সরকারি ভবন ও ভক্তপুরের বালাকোটে ওলির বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে।
কেপি শর্মা ওলি ২০১৪ সাল থেকে নেপালের কমিউনিস্ট পার্টি (ইউনিফাইড মার্কসবাদী-লেনিনবাদী) বা সিপিএন-ইউএমএল-এর চেয়ারম্যান। তিনি দুই মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন (২০১৫-১৬ এবং ২০১৮-২১) এবং ২০১৭ সাল থেকে ঝাপা-৫-এর সংসদ সদস্য। এর আগে তিনি ঝাপা-৬, ঝাপা-২, এবং ঝাপা-৭ থেকে সংসদ সদস্য ছিলেন। ওলি ২০১৫ সালে ভারতের অবরোধের বিরোধিতা করে চীনের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক জোরদার করেছিলেন। তবে, অশ্লীল মন্তব্য, সমালোচক ও মিডিয়ার প্রতি শত্রুতা, স্বজনপ্রীতি, এবং দুর্নীতির অভিযোগে তার শাসনকাল বিতর্কিত হয়ে ওঠে।
২০২২ সালের নভেম্বরে নেপালে সর্বশেষ সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এতে নেপালি কংগ্রেস (এনসি) বৃহত্তম দল হিসেবে আবির্ভূত হলেও সিপিএন-ইউএমএল এবং কমিউনিস্ট পার্টি-মাওবাদী সেন্টার (সিপিএন-এমসি) জোট সরকার গঠন করে। ২০২৪ সালের জুলাই থেকে এই জোটে অস্থিরতা দেখা দেয়, এবং ২০২৫ সালের মার্চে তিনকুনে সহিংস বিক্ষোভে দুই বেসামরিক নাগরিক নিহত হন। এই অস্থিরতার মধ্যে ২০২৭ সালের নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, কারণ ওলি সরকারকে জনগণ স্বৈরাচারী, গণবিরোধী, এবং দুর্নীতিগ্রস্ত হিসেবে বিবেচনা করেছে।
ওলি সরকারের পতনের পেছনে
নেপালের সংবাদমাধ্যমের দাবি, তরুণ নেতা সুদান গুরুং (৩৬) এই আন্দোলনের মূল কা-ারী। ২০১৫ সালের ভূমিকম্পে নিজের সন্তান হারানোর পর তিনি ‘হামি নেপাল’ নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। এই সংগঠন ছাত্র-যুবদের নিয়ে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য কাজ করে। সুদান ধীরে ধীরে তরুণদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন এবং বিপি কৈরালা ইনস্টিটিউটে দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদে নেতৃত্ব দেন।
তার নেতৃত্বে সুপরিকল্পিত আন্দোলন চারটি কৌশলের মাধ্যমে সফল হয়: ১. ডিজিটাল নেটওয়ার্ক: নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও বিকল্প মেসেজিং অ্যাপ, ভিপিএন, এবং সরাসরি যোগাযোগের মাধ্যমে বার্তা ছড়ানো হয়। ২. প্রতীকী প্রতিবাদ: তরুণরা স্কুল ইউনিফর্ম পরে বই হাতে রাস্তায় নামে, যা আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় ভাইরাল হয়। ৩. স্থানীয় সমন্বয়: প্রতিটি শহরে সমন্বয়ক নিয়োগ করে ভিড় নিয়ন্ত্রণ, মিডিয়া যোগাযোগ, এবং পুলিশি বাধা মোকাবিলা করা হয়। ৪. সরকারের পদত্যাগের দাবি: সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম পুনরায় চালু ও সরকারের পদত্যাগের দাবি জোরালো হয়।
এই সংগঠিত আন্দোলন দুই দিনের মধ্যে সরকারকে চাপে ফেলে। রাজধানী থেকে প্রদেশ পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়া বিক্ষোভ, আন্তর্জাতিক চাপ, এবং জনসমর্থনের মুখে ওলি পদত্যাগে বাধ্য হন। সুদান গুরুং আন্দোলনকারীদের শান্ত থাকতে এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিবর্তনের জন্য কাজ চালিয়ে যেতে বলেন। তার মতে, এটি নেপালের জন্য একটি নতুন সূচনা, যা দেশকে দুর্নীতি ও অকার্যকর শাসন থেকে স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক শাসনের দিকে নিয়ে যাবে।
জোট সরকারের ভাঙন
জেন জি’র আন্দোলনের প্রেক্ষিতে ক্ষমতাসীন জোট সরকার ভাঙনের মুখে পড়ে। সংসদের ২৭৫ আসনের মধ্যে নেপালি কংগ্রেসের ৮৯ আসন থাকলেও দলের জ্যেষ্ঠ নেতা শেখর কৈরালা সমর্থকদের সরকার থেকে সরে যাওয়ার নির্দেশ দেন। মাওবাদী সেন্টার (৩২ আসন) এবং জনতা সমাজবাদী পার্টিসহ অন্যান্য ছোট দল (প্রায় ১০ আসন) জোট থেকে বেরিয়ে যায়। ন্যাশনাল ইনডিপেন্ডেন্ট পার্টির (এনআইএসপি) ২১ জন এমপি একযোগে পদত্যাগ করেন এবং সংসদ ভেঙে নতুন নির্বাচনের দাবি জানান।
অর্থনৈতিক বিপর্যয়
নেপালের অর্থনীতি চরম সংকটে পড়েছে। বিশ্ব ব্যাঙ্কের পূর্বাভাসে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৪.৫% এবং ২০২৫-২৬ অর্থবছরে ৫.২% প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা ছিল, কিন্তু তা পূরণ হয়নি। ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে ফিন্যান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্ক ফোর্স (এফএটিএফ) নেপালকে দ্বিতীয়বার ধূসর তালিকাভুক্ত করে, অর্থ পাচার ও আর্থিক অপরাধ রোধে ব্যর্থতার কারণে। এটি বিনিয়োগ আকর্ষণে বাধা সৃষ্টি করেছে। তরুণরা সুযোগের অভাবে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে, এবং প্রবাসী নেপালিরা দেশের কর্মক্ষম জনসংখ্যার ১৪%।
ভুটানি শরণার্থী কেলেঙ্কারি, ললিত-নিবাস কেলেঙ্কারি, এবং সমবায় ও সোনা চোরাচালান কেলেঙ্কারি অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। ২০২০-২৩ সালে রেমিট্যান্স জিডিপির ২৪% অবদান রেখেছে, যা দক্ষিণ এশিয়ার গড় (৪%) থেকে অনেক বেশি। প্রাকৃতিক দুর্যোগও দেশটির জন্য ঝুঁকি, গত বছর বন্যায় জিডিপির ০.৮% ক্ষতি হয়েছে।
রাজনৈতিক অস্থিরতা
মার্চ থেকে রাজতন্ত্রপন্থী বিক্ষোভ কিছুটা স্তিমিত হলেও শিক্ষকদের বিক্ষোভে শিক্ষামন্ত্রী পদত্যাগ করেন। ত্রিভুবন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, নেপাল বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান, এবং জ্বালানি ও জলসম্পদ প্রতিমন্ত্রীকে বরখাস্ত করা হয়। সেন্ট্রাল ব্যাঙ্কের গভর্নর নিয়োগে বিলম্বও বিতর্কের সৃষ্টি করেছে।
বামপন্থীদের ব্যর্থতা
প্রশ্ন উঠছে, কমিউনিস্ট সরকার কেন দুর্নীতিগ্রস্ত হলো? মার্কসবাদ-লেনিনবাদের আদর্শে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য থাকলেও নেপালে শাসকশ্রেণী সম্পদের পাহাড় গড়েছে, যখন জনগণ অনাহারে-অর্ধাহারে জীবনযাপন করছে। বামপন্থী দলগুলো ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে। নেপালের পতন থেকে শিক্ষা নিয়ে বামপন্থীদের গণমানুষের দল হিসেবে গড়ে উঠতে হবে। বাংলাদেশেও বামপন্থী দলগুলো একই ভুল করছে। সদস্য নির্বাচনে নেতার তোষামোদকারীদের প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে, এমনকি মৌলবাদী সমর্থকরাও সদস্যপদ পাচ্ছে। এতে প্রশ্ন ওঠে, এই দলগুলো কি মার্কসের আদর্শে চলছে, নাকি ব্যক্তিস্বার্থে কমিউনিজমকে ব্যবহার করছে?
শিক্ষা ও ভবিষ্যৎ
নেপালের বিপর্যয় বামপন্থীদের জন্য শিক্ষণীয়। পুঁজিবাদ বা সিআইএ-এর এজেন্টদের দোষারোপ না করে নিজেদের দুর্বলতা সংশোধন করতে হবে। ব্যক্তিপূজার পরিবর্তে সমাজের চাহিদাভিত্তিক নেতৃত্ব গড়ে তুললে বামপন্থী দলগুলো জনগণের সমর্থন পাবে। অন্যথায়, তারা অস্তিত্বের সংকটে পড়বে। বাংলাদেশে হাসিনা পতনের আন্দোলনে বামপন্থীদের ভূমিকা ছিল, কিন্তু ডাকসু নির্বাচনে তাদের ব্যর্থতা প্রমাণ করে সংগঠনকে গণমুখী করতে হবে। নইলে, বামপন্থীরা ইতিহাসের পাতায় হারিয়ে যাবে।
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
[লেখক: উন্নয়নকর্মী]