alt

opinion » post-editorial

বেসরকারি খাতে সিআইবি’র যাত্রা: ঋণ ব্যবস্থার নতুন দিগন্ত

ফজলে রাব্বি মোহাম্মদ আহ্সান

: রোববার, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫

অতি সম্প্রতি দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক মূলত ব্যাংকিং খাতের নৈরাজ্য বন্ধ করতে, তাদের স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা নিশ্চিত করণে বেসরকারি খাতে বাংলাদেশ ব্যাংক বিকাশ ক্রেডিট, সিটি ক্রেডিট, ইত্যাদি নামে পাঁচটি প্রতিষ্ঠানকে ঋণ তথ্যসেবা বা ক্রেডিট ইনফরমেশন সার্ভিস প্রদানের জন্যে উদ্দেশ্য পত্র দিয়েছে। সরল ভাষায় বললে, এর মানে হলো তারা ব্যবসা শুরু করার প্রাথমিক অনুমতি পেয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পাশাপাশি এ প্রতিষ্ঠানগুলো ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরোর কাজ করবে। তাদের প্রধান কাজ হবে ঋণ গ্রহীতাদের আর্থিক ইতিহাস পর্যালোচনা এবং ঋণ পরিশোধের সক্ষমতার উপর বিস্তারিত প্রতিবেদন তৈরি করা। যার মূল লক্ষ্য হবে ঋণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে উপস্থাপন করা। এর ফলে, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে ঝুঁকি কমাতে সক্ষম হবে। এ নতুন ব্যবস্থা দেশের ঋণ ব্যবস্থাপনাকে আরও স্বচ্ছ ও কার্যকর করে তুলতে সাহায্য করবে তথা ব্যাংকিং খাতের চলমান নৈরাজ্য বন্ধে ভূমিকা রাখবে বলে প্রত্যাশা।

সিআইবি কী এবং এর কাজ কী?

একটি ঋণ তথ্যসেবা দপ্তর বা ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরো হলো এমন একটি প্রতিষ্ঠান, যা কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের ঋণ সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ, বিশ্লেষণ এবং সংরক্ষণ করে। সহজ ভাষায় এটি একটি ডেটাবেজ বা তথ্যভান্ডার। যেখানে একজন ব্যক্তির ব্যাংক ঋণ, ক্রেডিট কার্ডের ব্যবহার এবং অন্যান্য আর্থিক লেনদেনের রেকর্ড থাকে। যখন কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান কোনো গ্রাহককে ঋণ/লোন দিতে চায় তখন তারা এ ব্যুরো/দপ্তর থেকে গ্রাহকের আর্থিক তথ্যের প্রতিবেদন সংগ্রহ করে।

এ প্রতিবেদনে গ্রাহক অতীতে কোনো ঋণ/লোন নিয়েছিলেন কিনা, সেটি নিয়মিত পরিশোধ করেছেন কিনা বা অন্য কোনো খেলাপি ঋণ/লোন আছে কিনা- এ তথ্যগুলো ঋণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানসমূহকে তুলে ধরে। ঋণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো ঐ প্রতিবেদনকে আশ্রয় করে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যে, ঐ ঋণ প্রত্যাশী গ্রাহক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান ঋণ/লোন পাবে, নাকি পাবে না! এর মাধ্যমে তারা বুঝতে চেষ্টা করে যে গ্রাহক তার ঋণ/লোন পরিশোধের ক্ষেত্রে কতটা সক্ষম ও নির্ভরযোগ্য।

সিআইবি কীভাবে কাজ করে?

ঋণ তথ্য সরবরাহ সেবা দপ্তর বা লোন তথ্য ব্যুরো বেশ কয়েকটি ধাপে এ কার্যদি সম্পন্ন করে:

ক. তথ্য সংগ্রহ: ব্যাংক এবং অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের গ্রাহকদের ঋণ/লোনসংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য, যেমন: ঋণের পরিমাণ, পরিশোধের তারিখ, খেলাপি হওয়ার রেকর্ড ইত্যাদি নিয়মিত সিআইবিকে সরবরাহ করে।

খ. তথ্য বিশ্লেষণ: প্রাপ্ত তথ্যগুলো সিআইবি তাদের নিজস্ব পদ্ধতিতে বিশ্লেষণ ও বিন্যাস করে। এর ভিত্তিতে প্রতিটি গ্রাহকের জন্যে একটি ক্রেডিট রিপোর্ট তৈরি করা হয়।

গ. রিপোর্ট প্রদান: যখন কোনো ব্যাংক কোনো নতুন গ্রাহককে ঋণ দিতে চায়, তখন তারা সিআইবি -এর কাছে সেই গ্রাহকের ক্রেডিট রিপোর্টের জন্য আবেদন করে। সিআইবি তখন তার ডেটাবেজ থেকে সেই রিপোর্টটি সরবরাহ করে।

ঘ. সিদ্ধান্ত গ্রহণ: ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান রিপোর্টটি পর্যালোচনা করে গ্রাহকের আর্থিক অবস্থা, ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা এবং নির্ভরযোগ্যতা, ইত্যাদি সম্পর্কে নিশ্চিত হয়। এর উপর ভিত্তি করে তারা ঋণ অনুমোদন করবে কিনা সে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।

পার্শ্ববর্তী দেশসমূহের অভিজ্ঞতা

বেসরকারি খাতে কেবল আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর মধ্যে ভারত এবং শ্রীলঙ্কার ঋণ ব্যুরো পরিচালনার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা রয়েছে। এ দেশগুলোর অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায় যে, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে এবং খেলাপি ঋণ কমাতে এ ধরনের শক্তিশালী ঋণ তথ্য সরবরাহ সেবা দপ্তর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

শুরুতেই যদি ভারতের দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাবো যে, ভারতে একাধিক ঋণ তথ্য সরবরাহ সেবা কোম্পানি কাজ করছে। এরা ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ক্রেডিট রিপোর্ট সরবরাহ করে। এ প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্রেডিট রিপোর্টেও তথ্যের উপর ভিত্তি করে প্রতিটি ব্যুরো তাদের নিজস্ব অ্যালগরিদম ব্যবহার করে একটি তিন-সংখ্যার ক্রেডিট স্কোর গণনা করে। ভারতে সাধারণত এই স্কোর ৩০০ থেকে ৯০০-এর মধ্যে হয়। ৭৫০ বা তার বেশি স্কোরকে সাধারণত: ‘ভালো’ বা ‘উত্তম’ স্কোর হিসাবে গণ্য করা হয়। ঐ ‘উত্তম’ স্কোরের ওপর ভিত্তি করে লোন বিতরণ করা হয়/ হচ্ছে। এর ফলে, ভারতে ঋণ বিতরণে স্বচ্ছতা বেড়েছে। তাদের খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে এ প্রতিষ্ঠানগুলো সহায়তা করছে/করেছে।

এরপর, শ্রীলঙ্কার কথা বিবেচনা করলে দেখবো যে, শ্রীলঙ্কার কেবল একটি ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরো রয়েছে। এটি ১৯৯০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি একটি স্বাধীন সংবিধিবদ্ধ সংস্থা এবং পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপে প্রতিষ্ঠিত। এ সুপ্রতিষ্ঠিত ক্রেডিট ব্যুরো তাদের ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঋণ তথ্য সরবরাহ করে যাচ্ছে। এর ফলে, শ্রীলঙ্কা ঋণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণ প্রক্রিয়াকে আরো কার্যকরি করতে এবং ঋণ ঝুঁকি কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে।

শ্রীলঙ্কা বা ভারতের এ পথচলা তথা তাদের অনুসৃত মডেল বাংলাদেশের জন্যে প্রেরণা বা একটি ভালোর উদাহরণ হতে পারে।

বাংলাদেশে এদের ভবিষ্যৎ ও সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ

বাংলাদেশে এ নতুন প্রতিষ্ঠানগুলোর ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল। কারণ, তারা ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে অতিসহজেই ঝুঁকি কমিয়ে এবং স্বচ্ছতা বাড়িয়ে আর্থিক খাতকে আরও শক্তিশালী করতে সক্ষম হবে। তবে তাদের কার্যক্রমে কিছু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হতে পারে:

তথ্যের ঘাটতি বা ডেটার সীমাবদ্ধতা: বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষের ব্যাংক লেন-দেনের তথ্য নেই। অনেক ব্যক্তি এবং ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত থেকে লোন নিয়ে থাকেন। যার কোনো রেকর্ড থাকে না। ফলে এ ডেটাবেজটির পূর্ণাঙ্গ রূপ পেতে বা কাজ করতে সময় লাগবে।

সমন্বয়ের অভাব: ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে তথ্য আদান-প্রদানে সমন্বয়ের অভাব রয়ে গেছে। যদি ব্যাংকগুলোও সঠিকভাবে তথ্য সরবরাহ না করে, তবে এ ব্যুরো কার্যকরি হয়ে উঠতে পারবে না।

প্রযুক্তিগত অবকাঠামো: একটি শক্তিশালী ডেটাবেজ এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্যে উন্নত প্রযুক্তিগত অবকাঠামো প্রয়োজন। এটি স্থাপন ও রক্ষণাবেক্ষণে যথেষ্ট বিনিয়োগের প্রয়োজন হবে।

তথ্যের নিরাপত্তা: গ্রাহকদের ব্যক্তিগত ও আর্থিক তথ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। কোনো ধরনের তথ্য ফাঁস বা অপব্যবহার হলে তা সাধারণ মানুষের কষ্টের কারণ হতে পারে। বিশ্বাস নষ্ট করতে পারে।

চ্যালেঞ্জ উত্তরণে করণীয়

এ চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করার জন্যে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে:

সচেতনতা বৃদ্ধি: আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং সাধারণ মানুষকে ক্রেডিট রিপোর্টের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন করে তোলা । এটি ঋণ গ্রহীতা এবং ঋণ প্রদানকারী উভয়ের জন্যই লাভজনক।

ব্যাপক তথ্য সংগ্রহ: শুধু ব্যাংকিং খাত নয়। বরং অন্যান্য ক্ষুদ্র ঋণ প্রদানকারী সংস্থা এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের তথ্য সংগ্রহের ব্যবস্থা তৈরি করা।

শক্তিশালী আইন ও নিয়ন্ত্রণ: বাংলাদেশ ব্যাংককে এ প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রমের উপর কঠোর নজরদারি রাখতে হবে। তথ্যের নিরাপত্তার জন্যে শক্তিশালী আইন তৈরি ও প্রয়োগ করতে হবে।

প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বৃদ্ধি: আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে একটি নিরাপদ এবং দক্ষ ডেটাবেজ তৈরি করতে হবে। যা তথ্যের দ্রুত আদান-প্রদান নিশ্চিত করবে।

বেসরকারি খাতে বিকাশ ক্রেডিট, সিটি ক্রেডিট, ট্রান্স ইউনিয়ন ক্রেডিট, ইত্যাদি পাঁচটি নতুন বেসরকারি ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরোর কার্যক্রম পরিচালনা বাংলাদেশের জন্যে এ এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ। এটি কেবল ঋণ ব্যবস্থাকেই শক্তিশালী করবে না। বরং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নের পথও সুগম করবে। যদি এই ব্যুরো এবং ব্যাংকগুলো পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে কাজ করে, তবে খেলাপি ঋণের পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে কমে আসবে বা কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। দেশের আর্থিক খাত আরও গতিশীল হবে। তবে, তথ্যের সুরক্ষা, সংগ্রহ এবং কার্যকর সমন্বয় নিশ্চিত করাই হবে এ সাফল্যের মূল চাবিকাঠি।

[লেখক: ডেপুটি চিফ (প্লানিং), ঢাকা ওয়াসা]

স্বাস্থ্যসেবায় মানবিকতা প্রতিষ্ঠা হোক

ছবি

নেপালে সরকার পতন ও বামপন্থীদের ভবিষ্যৎ

ডাকসু নির্বাচন ও সংস্কারপ্রয়াস: রাজনৈতিক চিন্তার নতুন দিগন্ত

নির্বাচন কি সব সমস্যার সমাধান

জিতিয়া উৎসব

ছবি

অলির পর নেপাল কোন পথে?

রম্যগদ্য: “মরেও বাঁচবি নারে পাগলা...”

অপরিকল্পিত নগরায়ন ও শ্রীপুর পৌরসভা

ভূরিভোজ, উচ্ছেদ এবং আদিবাসী পাহাড়িয়া

অনলাইন সংস্কৃতিতে হাস্যরসের সমাজবিজ্ঞান

মামলাজট নিরসনে দেওয়ানি কার্যবিধির সংস্কার

বাস্তব মস্কো বনাম বিভ্রান্ত ইউরোপ

ছাত্রসংসদ নির্বাচন ও ভবিষ্যৎ ছাত্ররাজনীতির গতিপ্রকৃতি

সড়ক দুর্ঘটনা: কারও মৃত্যু সাধারণ, কারও মৃত্যু বিশেষ

ঐকমত্য ছাড়াও কিছু সংস্কার সম্ভব

আবার বাড়ছে নিত্যপণ্যের দাম : সংকটে সাধারণ মানুষ

ডায়াবেটিস রোগীর সেবা ও জনসচেতনতা

ভিন্ন ধরনের ডাকসু নির্বাচন

ডাকসু নির্বাচন : পেছনে ফেলে আসি

প্রসঙ্গ : এলডিসি তালিকা থেকে বাংলাদেশের উত্তরণ

“কোপা চাটিগাঁ...”

ই-কমার্স হতে পারে প্রবৃদ্ধির ইঞ্জিন

ভারত-চীনের নতুন সমীকরণ

সাইবার যুগে মানুষের মর্যাদা ও নিরাপত্তা

ছবি

ভারত-চীন সম্পর্কে কৌশলগত উষ্ণতার সূচনা

ভারত-চীন সম্পর্কে কৌশলগত উষ্ণতার সূচনা

একজন নাগরিকের অভিমানী বিদায় ও রাষ্ট্রের নৈতিক সংকট

নিষিদ্ধ জালের অভিশাপে হুমকির মুখে সমুদ্রের জীববৈচিত্র্য

আধিপত্যবাদের শৃঙ্খল এবং পুঁজির লুন্ঠন যাদের রক্তাক্ত করে, তাদের চাই একজোটে

জার্মানি : কৃচ্ছসাধনের বোঝা জনগণের কাঁধে

পাট চাষের সংকট ও সম্ভাবনা

সামাজিক-প্রযুক্তিগত কল্পনা: বাংলাদেশের উন্নয়ন চিন্তার নতুন দিগন্ত

অগ্রক্রয় মোকদ্দমায় উভয় পক্ষের আইনি ডিফেন্স

পশ্চিমবঙ্গে শিক্ষক নিয়োগে অনিয়ম

এক সাংবাদিকের খোলা চিঠি

বাংলাদেশের দারিদ্র্য বৃদ্ধি ও অর্থনীতির চ্যালেঞ্জ

tab

opinion » post-editorial

বেসরকারি খাতে সিআইবি’র যাত্রা: ঋণ ব্যবস্থার নতুন দিগন্ত

ফজলে রাব্বি মোহাম্মদ আহ্সান

রোববার, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫

অতি সম্প্রতি দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক মূলত ব্যাংকিং খাতের নৈরাজ্য বন্ধ করতে, তাদের স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা নিশ্চিত করণে বেসরকারি খাতে বাংলাদেশ ব্যাংক বিকাশ ক্রেডিট, সিটি ক্রেডিট, ইত্যাদি নামে পাঁচটি প্রতিষ্ঠানকে ঋণ তথ্যসেবা বা ক্রেডিট ইনফরমেশন সার্ভিস প্রদানের জন্যে উদ্দেশ্য পত্র দিয়েছে। সরল ভাষায় বললে, এর মানে হলো তারা ব্যবসা শুরু করার প্রাথমিক অনুমতি পেয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পাশাপাশি এ প্রতিষ্ঠানগুলো ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরোর কাজ করবে। তাদের প্রধান কাজ হবে ঋণ গ্রহীতাদের আর্থিক ইতিহাস পর্যালোচনা এবং ঋণ পরিশোধের সক্ষমতার উপর বিস্তারিত প্রতিবেদন তৈরি করা। যার মূল লক্ষ্য হবে ঋণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে উপস্থাপন করা। এর ফলে, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে ঝুঁকি কমাতে সক্ষম হবে। এ নতুন ব্যবস্থা দেশের ঋণ ব্যবস্থাপনাকে আরও স্বচ্ছ ও কার্যকর করে তুলতে সাহায্য করবে তথা ব্যাংকিং খাতের চলমান নৈরাজ্য বন্ধে ভূমিকা রাখবে বলে প্রত্যাশা।

সিআইবি কী এবং এর কাজ কী?

একটি ঋণ তথ্যসেবা দপ্তর বা ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরো হলো এমন একটি প্রতিষ্ঠান, যা কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের ঋণ সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ, বিশ্লেষণ এবং সংরক্ষণ করে। সহজ ভাষায় এটি একটি ডেটাবেজ বা তথ্যভান্ডার। যেখানে একজন ব্যক্তির ব্যাংক ঋণ, ক্রেডিট কার্ডের ব্যবহার এবং অন্যান্য আর্থিক লেনদেনের রেকর্ড থাকে। যখন কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান কোনো গ্রাহককে ঋণ/লোন দিতে চায় তখন তারা এ ব্যুরো/দপ্তর থেকে গ্রাহকের আর্থিক তথ্যের প্রতিবেদন সংগ্রহ করে।

এ প্রতিবেদনে গ্রাহক অতীতে কোনো ঋণ/লোন নিয়েছিলেন কিনা, সেটি নিয়মিত পরিশোধ করেছেন কিনা বা অন্য কোনো খেলাপি ঋণ/লোন আছে কিনা- এ তথ্যগুলো ঋণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানসমূহকে তুলে ধরে। ঋণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো ঐ প্রতিবেদনকে আশ্রয় করে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যে, ঐ ঋণ প্রত্যাশী গ্রাহক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান ঋণ/লোন পাবে, নাকি পাবে না! এর মাধ্যমে তারা বুঝতে চেষ্টা করে যে গ্রাহক তার ঋণ/লোন পরিশোধের ক্ষেত্রে কতটা সক্ষম ও নির্ভরযোগ্য।

সিআইবি কীভাবে কাজ করে?

ঋণ তথ্য সরবরাহ সেবা দপ্তর বা লোন তথ্য ব্যুরো বেশ কয়েকটি ধাপে এ কার্যদি সম্পন্ন করে:

ক. তথ্য সংগ্রহ: ব্যাংক এবং অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের গ্রাহকদের ঋণ/লোনসংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য, যেমন: ঋণের পরিমাণ, পরিশোধের তারিখ, খেলাপি হওয়ার রেকর্ড ইত্যাদি নিয়মিত সিআইবিকে সরবরাহ করে।

খ. তথ্য বিশ্লেষণ: প্রাপ্ত তথ্যগুলো সিআইবি তাদের নিজস্ব পদ্ধতিতে বিশ্লেষণ ও বিন্যাস করে। এর ভিত্তিতে প্রতিটি গ্রাহকের জন্যে একটি ক্রেডিট রিপোর্ট তৈরি করা হয়।

গ. রিপোর্ট প্রদান: যখন কোনো ব্যাংক কোনো নতুন গ্রাহককে ঋণ দিতে চায়, তখন তারা সিআইবি -এর কাছে সেই গ্রাহকের ক্রেডিট রিপোর্টের জন্য আবেদন করে। সিআইবি তখন তার ডেটাবেজ থেকে সেই রিপোর্টটি সরবরাহ করে।

ঘ. সিদ্ধান্ত গ্রহণ: ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান রিপোর্টটি পর্যালোচনা করে গ্রাহকের আর্থিক অবস্থা, ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা এবং নির্ভরযোগ্যতা, ইত্যাদি সম্পর্কে নিশ্চিত হয়। এর উপর ভিত্তি করে তারা ঋণ অনুমোদন করবে কিনা সে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।

পার্শ্ববর্তী দেশসমূহের অভিজ্ঞতা

বেসরকারি খাতে কেবল আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর মধ্যে ভারত এবং শ্রীলঙ্কার ঋণ ব্যুরো পরিচালনার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা রয়েছে। এ দেশগুলোর অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায় যে, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে এবং খেলাপি ঋণ কমাতে এ ধরনের শক্তিশালী ঋণ তথ্য সরবরাহ সেবা দপ্তর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

শুরুতেই যদি ভারতের দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাবো যে, ভারতে একাধিক ঋণ তথ্য সরবরাহ সেবা কোম্পানি কাজ করছে। এরা ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ক্রেডিট রিপোর্ট সরবরাহ করে। এ প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্রেডিট রিপোর্টেও তথ্যের উপর ভিত্তি করে প্রতিটি ব্যুরো তাদের নিজস্ব অ্যালগরিদম ব্যবহার করে একটি তিন-সংখ্যার ক্রেডিট স্কোর গণনা করে। ভারতে সাধারণত এই স্কোর ৩০০ থেকে ৯০০-এর মধ্যে হয়। ৭৫০ বা তার বেশি স্কোরকে সাধারণত: ‘ভালো’ বা ‘উত্তম’ স্কোর হিসাবে গণ্য করা হয়। ঐ ‘উত্তম’ স্কোরের ওপর ভিত্তি করে লোন বিতরণ করা হয়/ হচ্ছে। এর ফলে, ভারতে ঋণ বিতরণে স্বচ্ছতা বেড়েছে। তাদের খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে এ প্রতিষ্ঠানগুলো সহায়তা করছে/করেছে।

এরপর, শ্রীলঙ্কার কথা বিবেচনা করলে দেখবো যে, শ্রীলঙ্কার কেবল একটি ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরো রয়েছে। এটি ১৯৯০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি একটি স্বাধীন সংবিধিবদ্ধ সংস্থা এবং পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপে প্রতিষ্ঠিত। এ সুপ্রতিষ্ঠিত ক্রেডিট ব্যুরো তাদের ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঋণ তথ্য সরবরাহ করে যাচ্ছে। এর ফলে, শ্রীলঙ্কা ঋণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণ প্রক্রিয়াকে আরো কার্যকরি করতে এবং ঋণ ঝুঁকি কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে।

শ্রীলঙ্কা বা ভারতের এ পথচলা তথা তাদের অনুসৃত মডেল বাংলাদেশের জন্যে প্রেরণা বা একটি ভালোর উদাহরণ হতে পারে।

বাংলাদেশে এদের ভবিষ্যৎ ও সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ

বাংলাদেশে এ নতুন প্রতিষ্ঠানগুলোর ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল। কারণ, তারা ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে অতিসহজেই ঝুঁকি কমিয়ে এবং স্বচ্ছতা বাড়িয়ে আর্থিক খাতকে আরও শক্তিশালী করতে সক্ষম হবে। তবে তাদের কার্যক্রমে কিছু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হতে পারে:

তথ্যের ঘাটতি বা ডেটার সীমাবদ্ধতা: বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষের ব্যাংক লেন-দেনের তথ্য নেই। অনেক ব্যক্তি এবং ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত থেকে লোন নিয়ে থাকেন। যার কোনো রেকর্ড থাকে না। ফলে এ ডেটাবেজটির পূর্ণাঙ্গ রূপ পেতে বা কাজ করতে সময় লাগবে।

সমন্বয়ের অভাব: ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে তথ্য আদান-প্রদানে সমন্বয়ের অভাব রয়ে গেছে। যদি ব্যাংকগুলোও সঠিকভাবে তথ্য সরবরাহ না করে, তবে এ ব্যুরো কার্যকরি হয়ে উঠতে পারবে না।

প্রযুক্তিগত অবকাঠামো: একটি শক্তিশালী ডেটাবেজ এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্যে উন্নত প্রযুক্তিগত অবকাঠামো প্রয়োজন। এটি স্থাপন ও রক্ষণাবেক্ষণে যথেষ্ট বিনিয়োগের প্রয়োজন হবে।

তথ্যের নিরাপত্তা: গ্রাহকদের ব্যক্তিগত ও আর্থিক তথ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। কোনো ধরনের তথ্য ফাঁস বা অপব্যবহার হলে তা সাধারণ মানুষের কষ্টের কারণ হতে পারে। বিশ্বাস নষ্ট করতে পারে।

চ্যালেঞ্জ উত্তরণে করণীয়

এ চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করার জন্যে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে:

সচেতনতা বৃদ্ধি: আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং সাধারণ মানুষকে ক্রেডিট রিপোর্টের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন করে তোলা । এটি ঋণ গ্রহীতা এবং ঋণ প্রদানকারী উভয়ের জন্যই লাভজনক।

ব্যাপক তথ্য সংগ্রহ: শুধু ব্যাংকিং খাত নয়। বরং অন্যান্য ক্ষুদ্র ঋণ প্রদানকারী সংস্থা এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের তথ্য সংগ্রহের ব্যবস্থা তৈরি করা।

শক্তিশালী আইন ও নিয়ন্ত্রণ: বাংলাদেশ ব্যাংককে এ প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রমের উপর কঠোর নজরদারি রাখতে হবে। তথ্যের নিরাপত্তার জন্যে শক্তিশালী আইন তৈরি ও প্রয়োগ করতে হবে।

প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বৃদ্ধি: আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে একটি নিরাপদ এবং দক্ষ ডেটাবেজ তৈরি করতে হবে। যা তথ্যের দ্রুত আদান-প্রদান নিশ্চিত করবে।

বেসরকারি খাতে বিকাশ ক্রেডিট, সিটি ক্রেডিট, ট্রান্স ইউনিয়ন ক্রেডিট, ইত্যাদি পাঁচটি নতুন বেসরকারি ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরোর কার্যক্রম পরিচালনা বাংলাদেশের জন্যে এ এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ। এটি কেবল ঋণ ব্যবস্থাকেই শক্তিশালী করবে না। বরং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নের পথও সুগম করবে। যদি এই ব্যুরো এবং ব্যাংকগুলো পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে কাজ করে, তবে খেলাপি ঋণের পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে কমে আসবে বা কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। দেশের আর্থিক খাত আরও গতিশীল হবে। তবে, তথ্যের সুরক্ষা, সংগ্রহ এবং কার্যকর সমন্বয় নিশ্চিত করাই হবে এ সাফল্যের মূল চাবিকাঠি।

[লেখক: ডেপুটি চিফ (প্লানিং), ঢাকা ওয়াসা]

back to top