মাহতাব হোসাইন মাজেদ
জীবনকে যদি একটি হাসপাতালের সঙ্গে তুলনা করা হয়, তাহলে আমাদের অন্তরই হবে সেই আনন্দবেদনার হাসপাতাল। এখানে মানুষের আনন্দ ও বেদনার অনুভূতি একত্রিত হয়। জীবন যেমন নিখুঁত নয়, ঠিক তেমনই সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালও নিখুঁত নয়। আমরা প্রায়ই প্রত্যাশিত সহানুভূতি বা সঠিক সেবা পাই না। সরকারি হাসপাতাল আমাদের ধৈর্য, সহনশীলতা ও মানসিক স্থিরতার পরীক্ষা নেয়। বেসরকারি হাসপাতাল আমাদের আর্থিক সামর্থ্য, সামাজিক অবস্থান এবং সুযোগের সীমাবদ্ধতার বাস্তবতা দেখায়। এই বাস্তবতা আমাদের শেখায়, কীভাবে সীমিত সুযোগ থাকা সত্ত্বেও ধৈর্য ধরে চলা যায় এবং ছোট ছোট আনন্দের মুহূর্তগুলো উপভোগ করা যায়।
সরকারি হাসপাতাল সাধারণ মানুষের জন্য চিকিৎসার প্রধান মাধ্যম, তবে বাস্তবতা প্রায়শই ভিন্ন। এখানে দীর্ঘ লাইন ও সময়ের অভাবের কারণে রোগীর সংখ্যা অত্যধিক হয়ে থাকে। উদাহরণস্বরূপ, ঢাকা শহরের একটি সরকারি হাসপাতালে দৈনিক ভর্তি রোগীর সংখ্যা গড়ে পাঁচ হাজারের মতো হয়, বিপরীতে ডাক্তারের সংখ্যা মাত্র বিশ থেকে ত্রিশ। এতে রোগীকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয় এবং ছোট সমস্যা নিয়েও সময় নষ্ট হয়, ফলে রোগীর অবস্থা জটিল হয়ে ওঠে। ব
াংলাদেশে সরকারি হাসপাতালে রোগী-ডাক্তার অনুপাত প্রতি পাঁচ হাজার জনের মধ্যে একজন, যেখানে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সুপারিশ করে প্রতি এক হাজার জনের জন্য একজন ডাক্তার থাকা। এতে রোগীর প্রয়োজনীয় সময় পাওয়া কঠিন হয়। অনেক হাসপাতালে আধুনিক চিকিৎসা সরঞ্জামের অভাব রয়েছে, যেমন সিটি স্ক্যান, এমআরআই, জরুরি সেবা ইউনিটের পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতি নেই, ফলে রোগীকে উন্নত মানের চিকিৎসা পেতে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়। ডাক্তার ও নার্সদের অতিরিক্ত চাপের কারণে রোগীর সঙ্গে মানবিক যোগাযোগ কমে যায় এবং অনেক রোগী অভিযোগ করে যে, তাদের সমস্যার প্রতি পর্যাপ্ত মনোযোগ দেওয়া হয় না। হাসপাতালের পর্যাপ্ত পরিচ্ছন্নতা না থাকায় সংক্রমণ ও স্বাস্থ্যঝুঁকি বৃদ্ধি পায়, এমনকি জরুরি বিভাগেও রোগীরা সংক্রমণের ঝুঁকিতে থাকে। রোগীর ভর্তি ও চিকিৎসা শেষ হওয়ার পর পর্যাপ্ত ফলো-আপ বা পরামর্শ দেওয়া হয় না, ফলে সুস্থতা প্রক্রিয়া বিলম্বিত হয়।
রোগীর চিকিৎসা ইতিহাস ডিজিটালভাবে সংরক্ষণ না থাকায় বিভিন্ন দফতরে তথ্য পুনরায় সংগ্রহ করতে হয়, যা সময় ও কার্যকারিতা কমায়। পরিসংখ্যান অনুসারে, প্রায় পঁয়ষট্টি শতাংশ রোগী সরকারি হাসপাতালে তাদের সমস্যার সমাধান দ্রুত পান না, জরুরি বিভাগে গড়ে রোগীর জন্য অপেক্ষার সময় এক থেকে দুই ঘণ্টা এবং নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীর অভাবের কারণে প্রতিদিন বিশ থেকে ত্রিশ শতাংশ রোগী সঠিক চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হন, এ ছাড়া পঞ্চাশ শতাংশ রোগী জানায় যে তারা হাসপাতালে মনোযোগপূর্ণ সহানুভূতি পান না।
এই সমস্যাগুলোর প্রতিকার হিসেবে ডাক্তার, নার্স ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীর সংখ্যা বৃদ্ধি করা দরকার, সিটি স্ক্যান, এমআরআই এবং জরুরি চিকিৎসা ইউনিটের আধুনিক যন্ত্রপাতি যোগ করা উচিত। ডিজিটাল প্রযুক্তির মাধ্যমে রোগীর তথ্য সংরক্ষণ ও চিকিৎসা প্রক্রিয়া সহজ করা যায়, ডাক্তার ও নার্সদের মানবিক যোগাযোগ ও রোগী পরিচালনার প্রশিক্ষণ দেওয়া দরকার। রোগীদের অধিকার ও সেবা সম্পর্কে সচেতন করা উচিত, হাসপাতালের নিয়মিত পরিচ্ছন্নতা ও সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা জোরদার করা প্রয়োজন। রোগীদের অভ্যন্তরীণ মানসিক ও সামাজিক সহায়তা প্রদানের জন্য বিশেষ কাউন্সেলিং বিভাগ তৈরি করা যায়।
বেসরকারি হাসপাতাল আধুনিক প্রযুক্তি ও সুবিধার প্রতীক হলেও এটি সবসময় আদর্শ নয়। এখানে চিকিৎসা সেবা প্রায়শই মানুষের আর্থিক সামর্থ্যের উপর নির্ভরশীল হয়। অনেক বেসরকারি হাসপাতালে স্বাস্থ্য বীমা গ্রহণযোগ্য নয়। কিছু হাসপাতাল রোগীর জীবন নয় বরং আর্থিক লাভকে গুরুত্ব দেয়। উন্নত প্রযুক্তি থাকলেও সাধারণ মানুষ তা ব্যবহার করতে পারে না। কিছু হাসপাতাল রোগীর অবস্থা অনুসারে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি পরীক্ষা বা চিকিৎসা করায় যার ফলে অতিরিক্ত ব্যয় হয়। রোগীর ব্যক্তিগত ও চিকিৎসা তথ্য সুরক্ষিতভাবে সংরক্ষণ না করলে ব্যক্তিগত তথ্য লিক বা দোষমুক্ত ব্যবহারের ঝুঁকি থাকে এবং রোগীর মানসিক চাপ, উদ্বেগ ও মানসিক অসুবিধা সমাধানে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই।
পরিসংখ্যান অনুসারে, গড়ে চল্লিশ শতাংশ রোগী চিকিৎসা ব্যয় বহন করতে অক্ষম। স্বাস্থ্য বীমা গ্রহণযোগ্যতা খুবই কম যা প্রায় বিশ থেকে পঁচিশ শতাংশ রোগীর জন্য। আধুনিক যন্ত্রপাতি থাকলেও তিরিশ শতাংশ রোগী তা ব্যবহার করতে পারে না আর্থিক সীমাবদ্ধতার কারণে এবং পঞ্চাশ শতাংশ রোগী জানায় যে তারা মানসিক সহায়তা বা কাউন্সেলিং পান না।
এই সমস্যাগুলোর প্রতিকার হিসেবে সকল বেসরকারি হাসপাতাল স্বাস্থ্য বীমা গ্রহণযোগ্য করা দরকার। চিকিৎসার খরচ নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকারের নিয়মাবলী প্রয়োজন। হাসপাতালগুলোকে মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে সেবা প্রদানের নিয়ম মেনে চলতে হবে। রোগী ও পরিবারকে তাদের অধিকার এবং সেবা সম্পর্কে জানানো উচিত। আর্থিকভাবে অক্ষম রোগীর জন্য বিশেষ ছাড় বা সরকারি সহায়তা নিশ্চিত করা দরকার। রোগীর মানসিক ও সামাজিক সহায়তা প্রদানের জন্য বিশেষ কাউন্সেলিং এবং সমর্থন সেবা চালু করা যায়।
সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালের মধ্যে সমন্বয় স্থাপন করে কার্যকর স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা গড়ে তোলা জরুরি। স্বাস্থ্য বাজেট বৃদ্ধি করে হাসপাতালের অবকাঠামো, ডাক্তার-নার্স সংখ্যা এবং আধুনিক যন্ত্রপাতি বৃদ্ধি করা দরকার। টেলিমেডিসিন, ই-হেলথ রেকর্ড এবং ডিজিটাল মেডিকেল সিস্টেম ব্যবহার করে চিকিৎসা প্রক্রিয়া সহজ ও কার্যকর করা যায়। রোগী ও পরিবারকে স্বাস্থ্যসেবা সম্পর্কে সচেতন করা এবং ডাক্তার-নার্সদের আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতি ও মানবিক সেবা বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া উচিত। স্বাস্থ্যকর্মীরা রোগীর মানসিক ও শারীরিক অবস্থার প্রতি যতœশীল হোক। হাসপাতালগুলোর কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ ও পরিসংখ্যান সংগ্রহ করে উন্নয়নমূলক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা দরকার। সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালের মধ্যে কার্যকর সমন্বয় স্থাপন করে রোগীর সেবার মান বৃদ্ধি করা যায়। রোগীর অভ্যন্তরীণ মানসিক ও সামাজিক সহায়তার জন্য সমন্বিত সামাজিক সেবা কেন্দ্র তৈরি করা উচিত এবং রোগীর অভিজ্ঞতা ও অভিযোগগুলো নিয়মিত সংগ্রহ করে সেবার মান উন্নয়নে ব্যবহার করা দরকার।
ঢাকা শহরের একটি সরকারি হাসপাতালের জরুরি বিভাগে রোগীকে পরীক্ষা ও চিকিৎসা পেতে গড়ে দুই ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়। বেসরকারি হাসপাতালে একই পরীক্ষা তিরিশ মিনিটে হয় তবে খরচ অনেক বেশি। একটি বেসরকারি হাসপাতালে রোগী অক্ষম হওয়ার কারণে চিকিৎসা বন্ধ হয়ে যায়। সরকারি হাসপাতালগুলোতে সময়মতো চিকিৎসা না পাওয়ায় রোগীর স্বাস্থ্য আরও খারাপ হয়। অনেক পরিবার অভিযোগ করে যে সরকারি হাসপাতালের মানসিক সহানুভূতি অত্যন্ত সীমিত এবং কিছু বেসরকারি হাসপাতালে রোগীর পরিবারকে পর্যাপ্ত তথ্য প্রদান করা হয় না ফলে চিকিৎসা প্রক্রিয়ায় বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়। এই উদাহরণগুলো দেখায় যে সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল উভয়েই বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা ও চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। তবে সঠিক সমন্বয় ও পরিকল্পনা থাকলে এসব সমস্যা অনেকাংশে সমাধান করা সম্ভব।
বাস্তবিকভাবে আনন্দবেদনার হাসপাতাল নিখুঁত নয়। সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল উভয় ক্ষেত্রেই আমরা প্রায়ই সীমাবদ্ধতা, অসুবিধা এবং হতাশার সম্মুখীন হই। সরকারি হাসপাতাল ধৈর্য, সহনশীলতা এবং সহমর্মিতা শেখায়। বেসরকারি হাসপাতাল আর্থিক বাস্তবতা ও সীমাবদ্ধতার পাঠ দেয়। আনন্দবেদনার হাসপাতাল আমাদের শেখায় সীমিত সুযোগের মধ্যেও মানবিক মনোভাব, সহানুভূতি এবং জীবন পরিচালনার কৌশল। আমরা বুঝতে শিখি সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও ধৈর্য ধরে এগোনো যায়, অন্যের কষ্ট বোঝা যায় এবং সমস্যার সমাধান খোঁজা যায়। এটি আমাদের শেখায় প্রতিটি ছোট সমস্যার মাঝেও আনন্দ ও শিক্ষা খুঁজে পাওয়া সম্ভব। হতাশা ও সীমাবদ্ধতা ছাড়া জীবনের প্রকৃত আনন্দ বোঝা যায় না। ফলে জীবনের প্রতিটি মুহূর্তের মূল্য আরও গভীরভাবে উপলব্ধি করা যায়।
[লেখক: প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি]
মাহতাব হোসাইন মাজেদ
সোমবার, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫
জীবনকে যদি একটি হাসপাতালের সঙ্গে তুলনা করা হয়, তাহলে আমাদের অন্তরই হবে সেই আনন্দবেদনার হাসপাতাল। এখানে মানুষের আনন্দ ও বেদনার অনুভূতি একত্রিত হয়। জীবন যেমন নিখুঁত নয়, ঠিক তেমনই সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালও নিখুঁত নয়। আমরা প্রায়ই প্রত্যাশিত সহানুভূতি বা সঠিক সেবা পাই না। সরকারি হাসপাতাল আমাদের ধৈর্য, সহনশীলতা ও মানসিক স্থিরতার পরীক্ষা নেয়। বেসরকারি হাসপাতাল আমাদের আর্থিক সামর্থ্য, সামাজিক অবস্থান এবং সুযোগের সীমাবদ্ধতার বাস্তবতা দেখায়। এই বাস্তবতা আমাদের শেখায়, কীভাবে সীমিত সুযোগ থাকা সত্ত্বেও ধৈর্য ধরে চলা যায় এবং ছোট ছোট আনন্দের মুহূর্তগুলো উপভোগ করা যায়।
সরকারি হাসপাতাল সাধারণ মানুষের জন্য চিকিৎসার প্রধান মাধ্যম, তবে বাস্তবতা প্রায়শই ভিন্ন। এখানে দীর্ঘ লাইন ও সময়ের অভাবের কারণে রোগীর সংখ্যা অত্যধিক হয়ে থাকে। উদাহরণস্বরূপ, ঢাকা শহরের একটি সরকারি হাসপাতালে দৈনিক ভর্তি রোগীর সংখ্যা গড়ে পাঁচ হাজারের মতো হয়, বিপরীতে ডাক্তারের সংখ্যা মাত্র বিশ থেকে ত্রিশ। এতে রোগীকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয় এবং ছোট সমস্যা নিয়েও সময় নষ্ট হয়, ফলে রোগীর অবস্থা জটিল হয়ে ওঠে। ব
াংলাদেশে সরকারি হাসপাতালে রোগী-ডাক্তার অনুপাত প্রতি পাঁচ হাজার জনের মধ্যে একজন, যেখানে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সুপারিশ করে প্রতি এক হাজার জনের জন্য একজন ডাক্তার থাকা। এতে রোগীর প্রয়োজনীয় সময় পাওয়া কঠিন হয়। অনেক হাসপাতালে আধুনিক চিকিৎসা সরঞ্জামের অভাব রয়েছে, যেমন সিটি স্ক্যান, এমআরআই, জরুরি সেবা ইউনিটের পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতি নেই, ফলে রোগীকে উন্নত মানের চিকিৎসা পেতে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়। ডাক্তার ও নার্সদের অতিরিক্ত চাপের কারণে রোগীর সঙ্গে মানবিক যোগাযোগ কমে যায় এবং অনেক রোগী অভিযোগ করে যে, তাদের সমস্যার প্রতি পর্যাপ্ত মনোযোগ দেওয়া হয় না। হাসপাতালের পর্যাপ্ত পরিচ্ছন্নতা না থাকায় সংক্রমণ ও স্বাস্থ্যঝুঁকি বৃদ্ধি পায়, এমনকি জরুরি বিভাগেও রোগীরা সংক্রমণের ঝুঁকিতে থাকে। রোগীর ভর্তি ও চিকিৎসা শেষ হওয়ার পর পর্যাপ্ত ফলো-আপ বা পরামর্শ দেওয়া হয় না, ফলে সুস্থতা প্রক্রিয়া বিলম্বিত হয়।
রোগীর চিকিৎসা ইতিহাস ডিজিটালভাবে সংরক্ষণ না থাকায় বিভিন্ন দফতরে তথ্য পুনরায় সংগ্রহ করতে হয়, যা সময় ও কার্যকারিতা কমায়। পরিসংখ্যান অনুসারে, প্রায় পঁয়ষট্টি শতাংশ রোগী সরকারি হাসপাতালে তাদের সমস্যার সমাধান দ্রুত পান না, জরুরি বিভাগে গড়ে রোগীর জন্য অপেক্ষার সময় এক থেকে দুই ঘণ্টা এবং নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীর অভাবের কারণে প্রতিদিন বিশ থেকে ত্রিশ শতাংশ রোগী সঠিক চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হন, এ ছাড়া পঞ্চাশ শতাংশ রোগী জানায় যে তারা হাসপাতালে মনোযোগপূর্ণ সহানুভূতি পান না।
এই সমস্যাগুলোর প্রতিকার হিসেবে ডাক্তার, নার্স ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীর সংখ্যা বৃদ্ধি করা দরকার, সিটি স্ক্যান, এমআরআই এবং জরুরি চিকিৎসা ইউনিটের আধুনিক যন্ত্রপাতি যোগ করা উচিত। ডিজিটাল প্রযুক্তির মাধ্যমে রোগীর তথ্য সংরক্ষণ ও চিকিৎসা প্রক্রিয়া সহজ করা যায়, ডাক্তার ও নার্সদের মানবিক যোগাযোগ ও রোগী পরিচালনার প্রশিক্ষণ দেওয়া দরকার। রোগীদের অধিকার ও সেবা সম্পর্কে সচেতন করা উচিত, হাসপাতালের নিয়মিত পরিচ্ছন্নতা ও সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা জোরদার করা প্রয়োজন। রোগীদের অভ্যন্তরীণ মানসিক ও সামাজিক সহায়তা প্রদানের জন্য বিশেষ কাউন্সেলিং বিভাগ তৈরি করা যায়।
বেসরকারি হাসপাতাল আধুনিক প্রযুক্তি ও সুবিধার প্রতীক হলেও এটি সবসময় আদর্শ নয়। এখানে চিকিৎসা সেবা প্রায়শই মানুষের আর্থিক সামর্থ্যের উপর নির্ভরশীল হয়। অনেক বেসরকারি হাসপাতালে স্বাস্থ্য বীমা গ্রহণযোগ্য নয়। কিছু হাসপাতাল রোগীর জীবন নয় বরং আর্থিক লাভকে গুরুত্ব দেয়। উন্নত প্রযুক্তি থাকলেও সাধারণ মানুষ তা ব্যবহার করতে পারে না। কিছু হাসপাতাল রোগীর অবস্থা অনুসারে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি পরীক্ষা বা চিকিৎসা করায় যার ফলে অতিরিক্ত ব্যয় হয়। রোগীর ব্যক্তিগত ও চিকিৎসা তথ্য সুরক্ষিতভাবে সংরক্ষণ না করলে ব্যক্তিগত তথ্য লিক বা দোষমুক্ত ব্যবহারের ঝুঁকি থাকে এবং রোগীর মানসিক চাপ, উদ্বেগ ও মানসিক অসুবিধা সমাধানে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই।
পরিসংখ্যান অনুসারে, গড়ে চল্লিশ শতাংশ রোগী চিকিৎসা ব্যয় বহন করতে অক্ষম। স্বাস্থ্য বীমা গ্রহণযোগ্যতা খুবই কম যা প্রায় বিশ থেকে পঁচিশ শতাংশ রোগীর জন্য। আধুনিক যন্ত্রপাতি থাকলেও তিরিশ শতাংশ রোগী তা ব্যবহার করতে পারে না আর্থিক সীমাবদ্ধতার কারণে এবং পঞ্চাশ শতাংশ রোগী জানায় যে তারা মানসিক সহায়তা বা কাউন্সেলিং পান না।
এই সমস্যাগুলোর প্রতিকার হিসেবে সকল বেসরকারি হাসপাতাল স্বাস্থ্য বীমা গ্রহণযোগ্য করা দরকার। চিকিৎসার খরচ নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকারের নিয়মাবলী প্রয়োজন। হাসপাতালগুলোকে মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে সেবা প্রদানের নিয়ম মেনে চলতে হবে। রোগী ও পরিবারকে তাদের অধিকার এবং সেবা সম্পর্কে জানানো উচিত। আর্থিকভাবে অক্ষম রোগীর জন্য বিশেষ ছাড় বা সরকারি সহায়তা নিশ্চিত করা দরকার। রোগীর মানসিক ও সামাজিক সহায়তা প্রদানের জন্য বিশেষ কাউন্সেলিং এবং সমর্থন সেবা চালু করা যায়।
সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালের মধ্যে সমন্বয় স্থাপন করে কার্যকর স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা গড়ে তোলা জরুরি। স্বাস্থ্য বাজেট বৃদ্ধি করে হাসপাতালের অবকাঠামো, ডাক্তার-নার্স সংখ্যা এবং আধুনিক যন্ত্রপাতি বৃদ্ধি করা দরকার। টেলিমেডিসিন, ই-হেলথ রেকর্ড এবং ডিজিটাল মেডিকেল সিস্টেম ব্যবহার করে চিকিৎসা প্রক্রিয়া সহজ ও কার্যকর করা যায়। রোগী ও পরিবারকে স্বাস্থ্যসেবা সম্পর্কে সচেতন করা এবং ডাক্তার-নার্সদের আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতি ও মানবিক সেবা বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া উচিত। স্বাস্থ্যকর্মীরা রোগীর মানসিক ও শারীরিক অবস্থার প্রতি যতœশীল হোক। হাসপাতালগুলোর কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ ও পরিসংখ্যান সংগ্রহ করে উন্নয়নমূলক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা দরকার। সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালের মধ্যে কার্যকর সমন্বয় স্থাপন করে রোগীর সেবার মান বৃদ্ধি করা যায়। রোগীর অভ্যন্তরীণ মানসিক ও সামাজিক সহায়তার জন্য সমন্বিত সামাজিক সেবা কেন্দ্র তৈরি করা উচিত এবং রোগীর অভিজ্ঞতা ও অভিযোগগুলো নিয়মিত সংগ্রহ করে সেবার মান উন্নয়নে ব্যবহার করা দরকার।
ঢাকা শহরের একটি সরকারি হাসপাতালের জরুরি বিভাগে রোগীকে পরীক্ষা ও চিকিৎসা পেতে গড়ে দুই ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়। বেসরকারি হাসপাতালে একই পরীক্ষা তিরিশ মিনিটে হয় তবে খরচ অনেক বেশি। একটি বেসরকারি হাসপাতালে রোগী অক্ষম হওয়ার কারণে চিকিৎসা বন্ধ হয়ে যায়। সরকারি হাসপাতালগুলোতে সময়মতো চিকিৎসা না পাওয়ায় রোগীর স্বাস্থ্য আরও খারাপ হয়। অনেক পরিবার অভিযোগ করে যে সরকারি হাসপাতালের মানসিক সহানুভূতি অত্যন্ত সীমিত এবং কিছু বেসরকারি হাসপাতালে রোগীর পরিবারকে পর্যাপ্ত তথ্য প্রদান করা হয় না ফলে চিকিৎসা প্রক্রিয়ায় বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়। এই উদাহরণগুলো দেখায় যে সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল উভয়েই বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা ও চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। তবে সঠিক সমন্বয় ও পরিকল্পনা থাকলে এসব সমস্যা অনেকাংশে সমাধান করা সম্ভব।
বাস্তবিকভাবে আনন্দবেদনার হাসপাতাল নিখুঁত নয়। সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল উভয় ক্ষেত্রেই আমরা প্রায়ই সীমাবদ্ধতা, অসুবিধা এবং হতাশার সম্মুখীন হই। সরকারি হাসপাতাল ধৈর্য, সহনশীলতা এবং সহমর্মিতা শেখায়। বেসরকারি হাসপাতাল আর্থিক বাস্তবতা ও সীমাবদ্ধতার পাঠ দেয়। আনন্দবেদনার হাসপাতাল আমাদের শেখায় সীমিত সুযোগের মধ্যেও মানবিক মনোভাব, সহানুভূতি এবং জীবন পরিচালনার কৌশল। আমরা বুঝতে শিখি সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও ধৈর্য ধরে এগোনো যায়, অন্যের কষ্ট বোঝা যায় এবং সমস্যার সমাধান খোঁজা যায়। এটি আমাদের শেখায় প্রতিটি ছোট সমস্যার মাঝেও আনন্দ ও শিক্ষা খুঁজে পাওয়া সম্ভব। হতাশা ও সীমাবদ্ধতা ছাড়া জীবনের প্রকৃত আনন্দ বোঝা যায় না। ফলে জীবনের প্রতিটি মুহূর্তের মূল্য আরও গভীরভাবে উপলব্ধি করা যায়।
[লেখক: প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি]