ফকর উদ্দিন মানিক
একটি চিরকুটে কয়েকটি লাইন, তারপর রক্তাক্ত নীরবতা। রাজশাহীর বামনশিকড় গ্রামের মিনারুল ইসলাম লিখে গেলেনÑ“আমরা মরে গেলাম ঋণের দায়ে আর খাওয়ার অভাবে।” এরপর তিনি শেষ করে দিলেন নিজের জীবন, সঙ্গে স্ত্রী ও দুই সন্তানের জীবনও। মানুষটি চলে গেলেন, কিন্তু রেখে গেলেন প্রশ্নের পাহাড়। সেই প্রশ্ন এখনো সমাজকে তাড়া করে ফেরেÑআমরা কি বুঝতে পারছি না ঋণ কেবল অর্থনৈতিক বোঝা নয়, বরং জীবনসংহারী এক ফাঁদ?
অদ্ভুতভাবে, মৃত্যুর পরেও এই ঋণ শেষ হলো না। পরিবারের চল্লিশার আয়োজন করতে মিনারুলের বাবা আবারও ঋণ নিলেন। ভাত নেই ঘরে, তবুও ধার করতে হলো ভোজ সাজাতে। এ কেমন সভ্যতা, যেখানে বেঁচে থাকতে মানুষ ক্ষুধায় মরে, আর মরার পর আত্মার শান্তির নামে বিরিয়ানি রান্না হয় ধার করা টাকায়? এটাকে কি আমরা ধর্ম বলব, নাকি সামাজিক চাপের মুখোশে শোক-বাণিজ্য?
বাংলার গ্রামে গ্রামে এখন যেন কেবল কিস্তি চাষ হয়। ধানক্ষেতে শস্য কম, কিন্তু মানুষের জীবনে কিস্তির হিসাব জমে পাহাড় হয়। একসময় মাইক্রোক্রেডিটের নামে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিলÑক্ষুদ্রঋণ মানুষকে স্বাবলম্বী করবে, ঘরে ঘরে আলো জ্বলবে। বাস্তবে সেই আলো এখন জ্বলে শুধু ঋণের কাগজে, মানুষের চোখে নয়। এনজিও আর ব্যাংকের ফিল্ড অফিসাররা এসেছিল মুক্তিদাতা সেজে, কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই তারা হয়ে উঠেছে নতুন শৃঙ্খলের কারিগর। প্রতিটি বাড়িতে এখন দেখা যায় কিস্তির দিন মানেই উদ্বেগের দিন, ফিল্ড অফিসারের ভিজিট মানেই ঘরে আতঙ্ক।
কোনো এক সময় ক্ষুদ্রঋণকে উন্নয়নের হাতিয়ার বলা হয়েছিল। বলা হয়েছিল, গরিব মানুষ সামান্য মূলধন পেলে ব্যবসা গড়বে, সংসার টিকবে, স্বপ্ন পূরণ হবে। কিন্তু ক্ষুদ্রঋণ অনেকের জন্য হয়ে উঠেছে মহাদৈত্য। পাঁচশো টাকার কিস্তি দিতে গিয়ে যে গরিব মানুষ হাঁস মুরগি বিক্রি করে, সে পরের সপ্তাহে আবার নতুন ঋণের জালে জড়ায়। যেন এক অনন্ত চক্রÑঋণ নিয়ে কিস্তি শোধ, আবার ঋণ নিয়ে বেঁচে থাকা। এ এক নতুন ধর্ম, যার পূজা হয় প্রতিসপ্তাহে, মন্দির হলো এনজিওর অফিস, আর পূজার সামগ্রী হলো কিস্তির টাকা।
অন্যদিকে রাষ্ট্রের ভূমিকাও কম অদ্ভুত নয়। রাজনৈতিক নেতারা গর্ব করে বলেনÑ“গ্রামে গ্রামে ঋণ পৌঁছে গেছে, সবাই উন্নয়নের পথে।” কিন্তু বাস্তব চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। ভাত নেই, চাল নেই, কিন্তু কিস্তির রশিদ আছে। টকশোর মঞ্চে বলা হয়Ñক্রেডিট অ্যাম্বুলেন্স চলছে, উন্নয়ন গল্প পৌঁছে গেছে প্রতিটি ঘরে। অথচ সেই ঘরের ভিতরে ক্ষুধার্ত শিশু কাঁদছে। এ উন্নয়ন একধরনের ললিপপ, যা কেবল নির্বাচনী বক্তৃতায় মিষ্টি শোনায়, বাস্তবে তেতো লাগে।
সবচেয়ে করুণ হলো ধর্মীয় অনুষঙ্গের ব্যবহার। চল্লিশা নিয়ে যে সামাজিক চাপ, সেটি এখন গরিব মানুষের কাঁধে অদৃশ্য বোমা হয়ে নেমে আসে। কেউ প্রশ্ন করতে সাহস করে না, কারণ প্রশ্ন তুললেই ধর্মীয় তিরস্কার। অথচ সত্য হলোÑধর্ম কখনো গরিবকে ধার করে শোক পালন করতে বলে না। কিন্তু সমাজ বানিয়েছে নিজের নিয়ম, নিজের সংস্কার। ফলে মরার পরেও শান্তি নেই; জীবিতরা মরছে ক্ষুধায়, আর মৃতদের নামে চলছে শোকের প্রদর্শনী।
অর্থনীতিবিদরা বলেন, ঋণ হলো বিনিয়োগ। তাদের ভাষায় ঋণ মানে গ্রাফ, এক্সেল শিট, সংখ্যার খেলা। কিন্তু গরিব মানুষের জন্য ঋণ মানে এক অদৃশ্য শিকল, যা বুকে চাপ সৃষ্টি করে। রাতে ঘুম ভাঙে কিস্তির চিন্তায়, সকালে ওঠে নতুন উৎকণ্ঠা নিয়ে। ঋণ মানে শিশুর স্কুল ফি বন্ধ, অসুস্থ মায়ের চিকিৎসা বন্ধ, সংসারের হাঁড়ি খালি। অথচ এই কষ্ট অর্থনীতির পাঠ্যবইতে লেখা নেই। লেখা নেই উন্নয়নের স্লোগানে।
রূপক দিয়ে বললেÑঋণ আর গাছ নয়, ঋণ এখন আগাছা। আগাছা একবার জন্মালে পুরো ক্ষেত দখল করে ফেলে। যতই কেটে ফেলো, আবার জন্মায়। আজ বাংলাদেশের প্রতিটি ঘরে সেই আগাছা জন্ম নিচ্ছে। ঋণ মানুষকে স্বপ্ন দেয় না, বরং তার শিকড়ে ঢুকে স্বপ্ন খেয়ে ফেলে।
প্রশ্ন হলোÑএর সমাধান কী? প্রথমত, ঋণ দিতে হবে মানুষের প্রয়োজন বুঝে, ফাঁদ পেতে নয়। সুদের হার হবে স্বচ্ছ ও মানবিক। ফিল্ড অফিসারদের কাজ হবে সহায়তা, জবরদস্তি নয়। দ্বিতীয়ত, প্রয়োজন আর্থিক শিক্ষা। স্কুল, বাজার, মসজিদÑপ্রতিটি জায়গায় মানুষকে শেখাতে হবে কিস্তির ঝুঁকি, সুদের ফাঁদ, আর্থিক পরিকল্পনার গুরুত্ব। তৃতীয়ত, সমাজকে বদলাতে হবে। কেবল দোয়া নয়, বাস্তব সহায়তা দরকার। ক্ষুধার্ত মানুষকে ভাত দিতে না পারলে চল্লিশার ভোজ কোনো অর্থ বহন করে না।
মিনারুল ইসলামের মৃত্যুকে আমরা যদি শুধু ব্যক্তিগত ব্যর্থতা ভেবে থামি, তাহলে ভুল করব। এটি আসলে সমাজ ও রাষ্ট্রের ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি। আত্মহত্যা কোনো সমাধান নয়, বরং তা দেখায় যে সিস্টেম ভেঙে পড়েছে। যখন মানুষ মনে করে বেঁচে থাকার কোনো পথ নেই, তখনই সে বেছে নেয় মৃত্যুকে। আর সেটিই আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় লজ্জা।
মিনারুলের শেষ চিরকুট যেন সমাজের মুখে আছড়ে পড়া এক আয়না। সেই আয়নায় আমরা নিজেদের মুখ দেখতে পাইÑভ- উন্নয়নের মুখ, সামাজিক ভ-ামির মুখ, ধর্মের নামে চাপিয়ে দেওয়া সংস্কারের মুখ। কিন্তু আমরা কি সাহসী হয়ে সে আয়নায় তাকাচ্ছি? নাকি চল্লিশার ভিড়ে দাঁড়িয়ে আবার নতুন ঋণের আয়োজন করছি?
বাংলার ইতিহাস একদিন হয়তো লিখবেÑমানুষ ভাতের অভাবে নয়, কিস্তির বোঝায় আত্মহত্যা করেছে। আর শোকের অনুষ্ঠানে সমবেত হয়েছে লোকজন, হাতে ছিল ধার করা বিরিয়ানির প্লেট। এটাই আমাদের উন্নয়নের অমোঘ বিধানÑবেঁচে থাকতে ঋণ, মরার পরেও ঋণ, শোকের ভোজেও ঋণ।
এখন সময় এসেছে এই চক্র ভাঙার। মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখতে হবে, গ্রাহক হিসেবে নয়। অর্থনীতিকে সংখ্যার খেলায় না বেঁধে রাখতে হবে মানুষের মর্যাদার সঙ্গে। আর ধর্মকে ব্যবহার করতে হবে দয়া ও সহানুভূতির জন্য, প্রদর্শনী ও ব্যবসার জন্য নয়। সমাজ যদি সত্যিই মানবিক হতে চায়, তবে ক্ষুধার্ত মানুষের পাশে দাঁড়াক জীবিত অবস্থায়, মৃতের চল্লিশায় নয়।
শেষ পর্যন্ত, মিনারুলের চিরকুট আমাদের শেখায়Ñঋণ কেবল কাগজের অঙ্ক নয়, তা মানুষের জীবন-মৃত্যুর খেলা। আমরা যদি এই শিক্ষা না নিই, তবে আগামীকাল আরও কোনো মিনারুল লিখে যাবে নতুন চিরকুট, আর আমরা আবার শোক পালন করব ধার করা টাকায়। এভাবেই চলতে থাকলে আমাদের পুরো সমাজই ঋণের কবরস্থানে পরিণত হবে।
[লেখক: সভাপতি, কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগ এলামনাই এসোসিয়েশন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়]
ফকর উদ্দিন মানিক
বুধবার, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫
একটি চিরকুটে কয়েকটি লাইন, তারপর রক্তাক্ত নীরবতা। রাজশাহীর বামনশিকড় গ্রামের মিনারুল ইসলাম লিখে গেলেনÑ“আমরা মরে গেলাম ঋণের দায়ে আর খাওয়ার অভাবে।” এরপর তিনি শেষ করে দিলেন নিজের জীবন, সঙ্গে স্ত্রী ও দুই সন্তানের জীবনও। মানুষটি চলে গেলেন, কিন্তু রেখে গেলেন প্রশ্নের পাহাড়। সেই প্রশ্ন এখনো সমাজকে তাড়া করে ফেরেÑআমরা কি বুঝতে পারছি না ঋণ কেবল অর্থনৈতিক বোঝা নয়, বরং জীবনসংহারী এক ফাঁদ?
অদ্ভুতভাবে, মৃত্যুর পরেও এই ঋণ শেষ হলো না। পরিবারের চল্লিশার আয়োজন করতে মিনারুলের বাবা আবারও ঋণ নিলেন। ভাত নেই ঘরে, তবুও ধার করতে হলো ভোজ সাজাতে। এ কেমন সভ্যতা, যেখানে বেঁচে থাকতে মানুষ ক্ষুধায় মরে, আর মরার পর আত্মার শান্তির নামে বিরিয়ানি রান্না হয় ধার করা টাকায়? এটাকে কি আমরা ধর্ম বলব, নাকি সামাজিক চাপের মুখোশে শোক-বাণিজ্য?
বাংলার গ্রামে গ্রামে এখন যেন কেবল কিস্তি চাষ হয়। ধানক্ষেতে শস্য কম, কিন্তু মানুষের জীবনে কিস্তির হিসাব জমে পাহাড় হয়। একসময় মাইক্রোক্রেডিটের নামে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিলÑক্ষুদ্রঋণ মানুষকে স্বাবলম্বী করবে, ঘরে ঘরে আলো জ্বলবে। বাস্তবে সেই আলো এখন জ্বলে শুধু ঋণের কাগজে, মানুষের চোখে নয়। এনজিও আর ব্যাংকের ফিল্ড অফিসাররা এসেছিল মুক্তিদাতা সেজে, কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই তারা হয়ে উঠেছে নতুন শৃঙ্খলের কারিগর। প্রতিটি বাড়িতে এখন দেখা যায় কিস্তির দিন মানেই উদ্বেগের দিন, ফিল্ড অফিসারের ভিজিট মানেই ঘরে আতঙ্ক।
কোনো এক সময় ক্ষুদ্রঋণকে উন্নয়নের হাতিয়ার বলা হয়েছিল। বলা হয়েছিল, গরিব মানুষ সামান্য মূলধন পেলে ব্যবসা গড়বে, সংসার টিকবে, স্বপ্ন পূরণ হবে। কিন্তু ক্ষুদ্রঋণ অনেকের জন্য হয়ে উঠেছে মহাদৈত্য। পাঁচশো টাকার কিস্তি দিতে গিয়ে যে গরিব মানুষ হাঁস মুরগি বিক্রি করে, সে পরের সপ্তাহে আবার নতুন ঋণের জালে জড়ায়। যেন এক অনন্ত চক্রÑঋণ নিয়ে কিস্তি শোধ, আবার ঋণ নিয়ে বেঁচে থাকা। এ এক নতুন ধর্ম, যার পূজা হয় প্রতিসপ্তাহে, মন্দির হলো এনজিওর অফিস, আর পূজার সামগ্রী হলো কিস্তির টাকা।
অন্যদিকে রাষ্ট্রের ভূমিকাও কম অদ্ভুত নয়। রাজনৈতিক নেতারা গর্ব করে বলেনÑ“গ্রামে গ্রামে ঋণ পৌঁছে গেছে, সবাই উন্নয়নের পথে।” কিন্তু বাস্তব চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। ভাত নেই, চাল নেই, কিন্তু কিস্তির রশিদ আছে। টকশোর মঞ্চে বলা হয়Ñক্রেডিট অ্যাম্বুলেন্স চলছে, উন্নয়ন গল্প পৌঁছে গেছে প্রতিটি ঘরে। অথচ সেই ঘরের ভিতরে ক্ষুধার্ত শিশু কাঁদছে। এ উন্নয়ন একধরনের ললিপপ, যা কেবল নির্বাচনী বক্তৃতায় মিষ্টি শোনায়, বাস্তবে তেতো লাগে।
সবচেয়ে করুণ হলো ধর্মীয় অনুষঙ্গের ব্যবহার। চল্লিশা নিয়ে যে সামাজিক চাপ, সেটি এখন গরিব মানুষের কাঁধে অদৃশ্য বোমা হয়ে নেমে আসে। কেউ প্রশ্ন করতে সাহস করে না, কারণ প্রশ্ন তুললেই ধর্মীয় তিরস্কার। অথচ সত্য হলোÑধর্ম কখনো গরিবকে ধার করে শোক পালন করতে বলে না। কিন্তু সমাজ বানিয়েছে নিজের নিয়ম, নিজের সংস্কার। ফলে মরার পরেও শান্তি নেই; জীবিতরা মরছে ক্ষুধায়, আর মৃতদের নামে চলছে শোকের প্রদর্শনী।
অর্থনীতিবিদরা বলেন, ঋণ হলো বিনিয়োগ। তাদের ভাষায় ঋণ মানে গ্রাফ, এক্সেল শিট, সংখ্যার খেলা। কিন্তু গরিব মানুষের জন্য ঋণ মানে এক অদৃশ্য শিকল, যা বুকে চাপ সৃষ্টি করে। রাতে ঘুম ভাঙে কিস্তির চিন্তায়, সকালে ওঠে নতুন উৎকণ্ঠা নিয়ে। ঋণ মানে শিশুর স্কুল ফি বন্ধ, অসুস্থ মায়ের চিকিৎসা বন্ধ, সংসারের হাঁড়ি খালি। অথচ এই কষ্ট অর্থনীতির পাঠ্যবইতে লেখা নেই। লেখা নেই উন্নয়নের স্লোগানে।
রূপক দিয়ে বললেÑঋণ আর গাছ নয়, ঋণ এখন আগাছা। আগাছা একবার জন্মালে পুরো ক্ষেত দখল করে ফেলে। যতই কেটে ফেলো, আবার জন্মায়। আজ বাংলাদেশের প্রতিটি ঘরে সেই আগাছা জন্ম নিচ্ছে। ঋণ মানুষকে স্বপ্ন দেয় না, বরং তার শিকড়ে ঢুকে স্বপ্ন খেয়ে ফেলে।
প্রশ্ন হলোÑএর সমাধান কী? প্রথমত, ঋণ দিতে হবে মানুষের প্রয়োজন বুঝে, ফাঁদ পেতে নয়। সুদের হার হবে স্বচ্ছ ও মানবিক। ফিল্ড অফিসারদের কাজ হবে সহায়তা, জবরদস্তি নয়। দ্বিতীয়ত, প্রয়োজন আর্থিক শিক্ষা। স্কুল, বাজার, মসজিদÑপ্রতিটি জায়গায় মানুষকে শেখাতে হবে কিস্তির ঝুঁকি, সুদের ফাঁদ, আর্থিক পরিকল্পনার গুরুত্ব। তৃতীয়ত, সমাজকে বদলাতে হবে। কেবল দোয়া নয়, বাস্তব সহায়তা দরকার। ক্ষুধার্ত মানুষকে ভাত দিতে না পারলে চল্লিশার ভোজ কোনো অর্থ বহন করে না।
মিনারুল ইসলামের মৃত্যুকে আমরা যদি শুধু ব্যক্তিগত ব্যর্থতা ভেবে থামি, তাহলে ভুল করব। এটি আসলে সমাজ ও রাষ্ট্রের ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি। আত্মহত্যা কোনো সমাধান নয়, বরং তা দেখায় যে সিস্টেম ভেঙে পড়েছে। যখন মানুষ মনে করে বেঁচে থাকার কোনো পথ নেই, তখনই সে বেছে নেয় মৃত্যুকে। আর সেটিই আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় লজ্জা।
মিনারুলের শেষ চিরকুট যেন সমাজের মুখে আছড়ে পড়া এক আয়না। সেই আয়নায় আমরা নিজেদের মুখ দেখতে পাইÑভ- উন্নয়নের মুখ, সামাজিক ভ-ামির মুখ, ধর্মের নামে চাপিয়ে দেওয়া সংস্কারের মুখ। কিন্তু আমরা কি সাহসী হয়ে সে আয়নায় তাকাচ্ছি? নাকি চল্লিশার ভিড়ে দাঁড়িয়ে আবার নতুন ঋণের আয়োজন করছি?
বাংলার ইতিহাস একদিন হয়তো লিখবেÑমানুষ ভাতের অভাবে নয়, কিস্তির বোঝায় আত্মহত্যা করেছে। আর শোকের অনুষ্ঠানে সমবেত হয়েছে লোকজন, হাতে ছিল ধার করা বিরিয়ানির প্লেট। এটাই আমাদের উন্নয়নের অমোঘ বিধানÑবেঁচে থাকতে ঋণ, মরার পরেও ঋণ, শোকের ভোজেও ঋণ।
এখন সময় এসেছে এই চক্র ভাঙার। মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখতে হবে, গ্রাহক হিসেবে নয়। অর্থনীতিকে সংখ্যার খেলায় না বেঁধে রাখতে হবে মানুষের মর্যাদার সঙ্গে। আর ধর্মকে ব্যবহার করতে হবে দয়া ও সহানুভূতির জন্য, প্রদর্শনী ও ব্যবসার জন্য নয়। সমাজ যদি সত্যিই মানবিক হতে চায়, তবে ক্ষুধার্ত মানুষের পাশে দাঁড়াক জীবিত অবস্থায়, মৃতের চল্লিশায় নয়।
শেষ পর্যন্ত, মিনারুলের চিরকুট আমাদের শেখায়Ñঋণ কেবল কাগজের অঙ্ক নয়, তা মানুষের জীবন-মৃত্যুর খেলা। আমরা যদি এই শিক্ষা না নিই, তবে আগামীকাল আরও কোনো মিনারুল লিখে যাবে নতুন চিরকুট, আর আমরা আবার শোক পালন করব ধার করা টাকায়। এভাবেই চলতে থাকলে আমাদের পুরো সমাজই ঋণের কবরস্থানে পরিণত হবে।
[লেখক: সভাপতি, কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগ এলামনাই এসোসিয়েশন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়]