হোসেন আবদুল মান্নান
শরৎ আসলেই দুর্গোৎসবের আনন্দধ্বনি কানে বাজে। মাতাল হাওয়ায় দুলে ওঠে কাশবনের সাদা-শুভ্র পালক। বর্ষায় স্নাত হওয়া প্রকৃতি যেন নতুন রূপে সেজেগুজে উদ্ভাসিত হয়। বাতাসে দুর্গা পূজার কলরব শোনা যায়। এই অনুভূতি কেবল সনাতন ধর্মাবলম্বীদের একার নয় সকল সম্প্রদায়ের মানুষেরই মননের গহীন ভেতরে প্রতিধ্বনিত হয়। আবহমান বাংলার সংস্কৃতি ও লোক ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় আশ্বিন মাসটা যেন সম্পূর্ণ ভিন্ন সত্তাকে বুকে ধারণ করে আছে। আর শারদীয় উৎসবের আবহ-ই তাকে দিয়েছে পৃথক মাত্রা ও সুধাময়ী আমেজ। ধর্ম-বর্ণ, উঁচু-নিচু নির্বিশেষে বাঙালির মুষ্টিমেয় সর্বজনীন আনন্দোৎসবের অন্যতম হলো শরতের দুর্গোৎসব। যুগযুগ ধরে যেখানে কারও অংশ নিতে বাধা থাকে না, বরঞ্চ থাকে স্বতঃস্ফূর্ততার এক সুখানুভূতি।
হিন্দুশাস্ত্র মতে শরৎকাল নিয়ে নানাবিধ মতভেদ ও শ্রুতি প্রচলিত আছে। এসময়ে দুর্গাপূজার বিধান নিয়েও রয়েছে নানা মত ও পথ। তবে শারদীয় উৎসবের মূল লক্ষ হলো, দেবী দুর্গার অশেষ কৃপায় ধরাধামে শান্তির বার্তা নিয়ে আসা। তাঁর আগমন এবং বিসর্জন বিদায়ের মধ্য দিয়ে মর্ত্যের মানুষের জন্য এক নিরাপদ আশ্রয় রেখে যাওয়া। সনাতন ধর্মালম্বীরা এমন বিশ্বাসের ওপর দাঁড়িয়েই অন্তত চারদিন নিবিড় আরাধনায় লিপ্ত হয়ে থাকেন।
২.
মাঠ প্রশাসনের সাথে দীর্ঘ সময় চাকরির সুবাদে বহুমাত্রিক দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে। কখনো কখনো দৃশ্যমান দায়িত্বের পাশাপাশি কিছু পরোক্ষ কাজেও অংশ নিতে হয়েছে। সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান, পূজা- পার্বণ, মেলা, সার্কাস বা বিয়ের আনুষ্ঠানিক পর্বে সদলে উপস্থিত হওয়ার অভিজ্ঞতা রয়েছে।
দেশে তখন ১/১১ নামে বহুল পরিচিত তত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতাসীন। সে সময় সাজোয়া গাড়িতে সামরিক কর্মকর্তাদের অবাধ বিচরণ ছিল সকলের চোখে পড়ার মতন। জেলাপ্রশাসনের সাথেও ছিল তাদের সার্বক্ষণিক যাতায়াত। আমার চাকরি চাঁদপুরের এডিসি। সেখানে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কাজ করি। এক সন্ধ্যায় জেলাপ্রশাসক (জেলা ম্যাজিস্ট্রেট) বললেন, ‘চল পূজা দেখে আসি’। বললাম, জ্বী, নিশ্চয়ই যাব।
সেদিন ছিল নবমী পূজার দিন। বিসর্জনের আগের আনন্দঘন মূহুর্ত। দেখলাম, বাড়ির বাইরের রাস্তা থেকেই আলোকসম্পাতের বর্ণিল আয়োজন। অনেক মানুষের ভিড় লেগেছে। জেলাপ্রশাসকের আগমনী বার্তায় কিছু স্থানীয় নেতৃবৃন্দও এগিয়ে এসেছেন। বাড়িতে অভাবনীয় জাকজমকপূর্ণ পরিবেশ। বিচারপতি মহোদয় স্বয়ং ডিসি সাহেবকে অভ্যর্থনা জানালেন। এটি অতিথির প্রতি তার ব্যক্তিগত সৌজন্য। তিনি তাদের নিজস্ব এবং একক উদ্যোগে বাড়ির পূজার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট তুলে ধরে সংক্ষিপ্ত ভাষণ দিলেন। এতে সকলেরই দু’চার কথা বলার সুযোগ হল। সেদিন পূজোর প্রসাদ গ্রহণে মিষ্টান্নের সঙ্গে বিচিত্র ফলমূলের আয়োজনে চমকিত হয়েছিলাম। পরিবেশনে ছিল নিখুঁত আভিজাত্য। ফিরে আসার সময় তিনি প্রত্যেকের হাতে একটা করে সিল্কের পাঞ্জাবি তুলে দিলেন। মনে পড়ে, অনেকদিন পরে পাঞ্জাবির প্যাকেটটি খোলা হলে দেখলাম। কী আশ্চর্য! আমার হাতে দেওয়া হয়েছিল প্যাকেটটির গায়ে জেলাপ্রশাসকের নাম লেখা। ইচ্ছে থাকলেও তখন পরিবর্তনের আর সুযোগ পাইনি। কারণ জেলাপ্রশাসক অন্যত্র বদলি হয়েছিলেন। সেদিন সুপ্রিমকোর্টের সেই বিচারপতির হৃদয়ের উষ্ণতায় আমরা সিক্ত হয়েছিলাম। তার পারিবারিক সদস্যদের আথিতেয়তায় নমিত হয়েছিলাম। সঙ্গে ছিল প্রকৃতির অকৃপণ সহযোগিতা। বলা যায়, শরৎ সন্ধ্যার এক মনোমুগ্ধকর আবহাওয়ার প্রসন্ন আশীর্বাদ ছিল।
৩.
জেলাপ্রশাসক হিসেবে ব্রাহ্মণবাড়িয়া এবং চট্টগ্রামে অসংখ্য পূজা পার্বণে অংশগ্রহণ করেছি। আশ্বিন মাসেই অংশ নিয়েছি বৌদ্ধদের বৃহত্তর আয়োজন প্রবারণা পূর্ণিমার বাৎসরিক আলোচনা অনুষ্ঠানে। তাদের কঠিন চীবর দান অনুষ্ঠানে গিয়ে নিজের হাতে রঙিন ফানুস উড়িয়েছি। আলোচনায় অংশ নিয়ে এদের জেনেছি। এগুলো দাপ্তরিক দায়িত্বেরও অংশ ছিল। পূজো-ম-প দেখার সাথে সনাতন ধর্মাবলম্বী মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত বিচরণ, এদের জীবনাচার ও আর্থিক স্বচ্ছলতার এক বাস্তব চিত্র চোখের সামনে ভেসে উঠতো। বড় বড় আয়োজনে সবসময় নিমন্ত্রণ পেলে পথের ধারের আর্থিক অস্বচ্ছল মানুষের খুব ক্ষুদ্রায়তন ম-পেও স্বইচ্ছায় গিয়েছি। আয়োজনকারীদের অপ্রত্যাশিত, অনিমন্ত্রিত অতিথি হয়েছি অনেকবার। এতে আমার অন্তরে অনাবিল আনন্দ জাগ্রত হত। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ, সরাইল থেকে কসবা, নবীনগর পর্যন্ত অনেক স্থানে পূজার বর্ণালি উদযাপন উপভোগ করেছি। তবে শহরের কালীবাড়ি মন্দিরের পূজার আয়োজনটা সবসময় ভিন্ন মাত্রা পেত। তারা অতীত ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা রক্ষার্থে যথেষ্ট সজাগ দৃষ্টি রাখতেন। পূজাপার্বণাদি উদযাপনের জন্য ব্রাহ্মণবাড়িয়া অনুকূল জনপদ না হলেও প্রীতিকর এবং সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশেই অনুষ্ঠান সম্পন্ন হতো। পেছনে ফিরে তাকালে দেখি, ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের বাইরে সরাইলের উচালিয়াপাড়ার সমাজ সেবক প্রয়াত আশুতোষ চক্রবর্তীর পৈত্রিক ভিটায় নিজস্ব আয়োজনে উদযাপিত বর্ণাঢ্য পূজাম-প দেখার জন্য একাধিকবার গিয়েছি। তারা বছরের পর বছর ধরে শারদীয় উৎসবকে মহিমান্বিত ও গৌরবান্বিত করে চলেছেন।
৪.
আজ থেকে প্রায় এক দশক আগে চট্টগ্রামের জেলাপ্রশাসক ও পরবর্তীতে বিভাগীয় কমিশনার হিসেবেও বিভিন্ন জেলার পূজা উৎসবের বিচিত্র আনুষ্ঠানিকতায় যোগদান করেছি। চট্টগ্রামের রাউজান, ফটিকছড়ি, হাটহাজারী থেকে পটিয়া, লোহাগাড়া, কাপ্তাই পর্যন্ত অগণিত এলাকায় ঘুরেছি। পূজার সময়ে আয়োজকদের সুরক্ষার নিমিত্ত আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ওপর নজরদারির লক্ষে গোটা বিভাগে নানাবিধ সতর্ক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হয়েছে। যা সুদীর্ঘকাল ধরে জেলা প্রশাসনই দেখভাল করে চলেছে। মনে হয়েছে, কুমিল্লা, ফেনী, লক্ষ্মীপুরে পূজার আনুষ্ঠানিকতা হয় খানিকটা পৃথক ব্যঞ্জনার আবহে। জেলা শহরগুলোতে দুর্গোৎসব অনুষ্ঠানের আর্থিক ব্যয় সচরাচর অনেক বেশি হয়ে থাকে। তাছাড়া দেবীর বিসর্জনে জলে নিমজ্জিত করা হয় বলে, পরিবেশ দূষণের বিষয়েও সতর্ক দৃষ্টি রাখা হতো।
৫.
আরও একবারের কথা মনে পড়ে, পূজার জমজমাট লোকারণ্য সময়ে রাঙামাটি থেকে ফিরে আসার পথে সূর্যাস্ত হয়ে যায়। সবুজ বনানী ছুঁয়ে ঘুটঘুটে অন্ধকার নেমে আসতে থাকে। হাটহাজারীর বিখ্যাত মাদ্রাসা সড়কের খানিক আগে স্থানীয় ইউএনও সাহেবের বিশেষ অনুরোধে এক আলো ঝলমলে ম-পে প্রবেশ করি। অনেক মানুষের নির্বিঘœ আগমন দেখে ভালো লেগেছিল। তবে বেশি আনন্দিত হয়েছিলাম মাদ্রাসাপড়–য়া ছোট ছোট কয়েকজন ছাত্রকে দেখে। তারা আনমনে ভেতর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল। এমন দৃশ্যই বাঙালির কাম্য। শিশুদের মধ্যে তখনও অন্যকোনো অনুভূতি আসেনি।
সেদিন শহরে প্রবেশের পূর্বে একেবারে আকস্মিক সিদ্ধান্তে এবং অনাহুতভাবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে চলে যাই। আমার সাথে থাকা অনুজ সহকর্মীদের বললাম, --শোন, এখন রাত হয়েছে। কেউ বুঝতে পারবে না। কাউকে কিছু বলারও দরকার নেই। আমরা দেশের অন্যতম বৃহৎ এই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান প্রধান স্থাপনা ও হলগুলোর অবস্থান গাড়ি থেকেই পাখির চোখে একটু দেখে নিব।
এবং তা-ই হলো। নিভৃতে কিন্তু জনান্তিকে প্রথমবারের মত নিসর্গঘেরা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশাল জমিনকে আমি অবলোকন করেছিলাম। তখন ক্যাম্পাসেও ছোটখাটো পূজোর আমেজ ছড়িয়ে ছিল। বলাবাহুল্য, এর আগে এবং পরে দুয়েকবার সে ক্যাম্পাসে গিয়েছিলাম, তবে সেটা দেখার জন্য নয়, কাজের প্রয়োজনে। এতদিন বাদে মনে হয়, পৃথিবীতে সবকিছু দেখতে হয় বিনা কাজে। কাজ করে সেভাবে দেখা হয় না, যা হয় তা কাজই, দেখা নয়।
[লেখক: গল্পকার, সাবেক সচিব]
হোসেন আবদুল মান্নান
বুধবার, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫
শরৎ আসলেই দুর্গোৎসবের আনন্দধ্বনি কানে বাজে। মাতাল হাওয়ায় দুলে ওঠে কাশবনের সাদা-শুভ্র পালক। বর্ষায় স্নাত হওয়া প্রকৃতি যেন নতুন রূপে সেজেগুজে উদ্ভাসিত হয়। বাতাসে দুর্গা পূজার কলরব শোনা যায়। এই অনুভূতি কেবল সনাতন ধর্মাবলম্বীদের একার নয় সকল সম্প্রদায়ের মানুষেরই মননের গহীন ভেতরে প্রতিধ্বনিত হয়। আবহমান বাংলার সংস্কৃতি ও লোক ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় আশ্বিন মাসটা যেন সম্পূর্ণ ভিন্ন সত্তাকে বুকে ধারণ করে আছে। আর শারদীয় উৎসবের আবহ-ই তাকে দিয়েছে পৃথক মাত্রা ও সুধাময়ী আমেজ। ধর্ম-বর্ণ, উঁচু-নিচু নির্বিশেষে বাঙালির মুষ্টিমেয় সর্বজনীন আনন্দোৎসবের অন্যতম হলো শরতের দুর্গোৎসব। যুগযুগ ধরে যেখানে কারও অংশ নিতে বাধা থাকে না, বরঞ্চ থাকে স্বতঃস্ফূর্ততার এক সুখানুভূতি।
হিন্দুশাস্ত্র মতে শরৎকাল নিয়ে নানাবিধ মতভেদ ও শ্রুতি প্রচলিত আছে। এসময়ে দুর্গাপূজার বিধান নিয়েও রয়েছে নানা মত ও পথ। তবে শারদীয় উৎসবের মূল লক্ষ হলো, দেবী দুর্গার অশেষ কৃপায় ধরাধামে শান্তির বার্তা নিয়ে আসা। তাঁর আগমন এবং বিসর্জন বিদায়ের মধ্য দিয়ে মর্ত্যের মানুষের জন্য এক নিরাপদ আশ্রয় রেখে যাওয়া। সনাতন ধর্মালম্বীরা এমন বিশ্বাসের ওপর দাঁড়িয়েই অন্তত চারদিন নিবিড় আরাধনায় লিপ্ত হয়ে থাকেন।
২.
মাঠ প্রশাসনের সাথে দীর্ঘ সময় চাকরির সুবাদে বহুমাত্রিক দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে। কখনো কখনো দৃশ্যমান দায়িত্বের পাশাপাশি কিছু পরোক্ষ কাজেও অংশ নিতে হয়েছে। সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান, পূজা- পার্বণ, মেলা, সার্কাস বা বিয়ের আনুষ্ঠানিক পর্বে সদলে উপস্থিত হওয়ার অভিজ্ঞতা রয়েছে।
দেশে তখন ১/১১ নামে বহুল পরিচিত তত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতাসীন। সে সময় সাজোয়া গাড়িতে সামরিক কর্মকর্তাদের অবাধ বিচরণ ছিল সকলের চোখে পড়ার মতন। জেলাপ্রশাসনের সাথেও ছিল তাদের সার্বক্ষণিক যাতায়াত। আমার চাকরি চাঁদপুরের এডিসি। সেখানে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কাজ করি। এক সন্ধ্যায় জেলাপ্রশাসক (জেলা ম্যাজিস্ট্রেট) বললেন, ‘চল পূজা দেখে আসি’। বললাম, জ্বী, নিশ্চয়ই যাব।
সেদিন ছিল নবমী পূজার দিন। বিসর্জনের আগের আনন্দঘন মূহুর্ত। দেখলাম, বাড়ির বাইরের রাস্তা থেকেই আলোকসম্পাতের বর্ণিল আয়োজন। অনেক মানুষের ভিড় লেগেছে। জেলাপ্রশাসকের আগমনী বার্তায় কিছু স্থানীয় নেতৃবৃন্দও এগিয়ে এসেছেন। বাড়িতে অভাবনীয় জাকজমকপূর্ণ পরিবেশ। বিচারপতি মহোদয় স্বয়ং ডিসি সাহেবকে অভ্যর্থনা জানালেন। এটি অতিথির প্রতি তার ব্যক্তিগত সৌজন্য। তিনি তাদের নিজস্ব এবং একক উদ্যোগে বাড়ির পূজার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট তুলে ধরে সংক্ষিপ্ত ভাষণ দিলেন। এতে সকলেরই দু’চার কথা বলার সুযোগ হল। সেদিন পূজোর প্রসাদ গ্রহণে মিষ্টান্নের সঙ্গে বিচিত্র ফলমূলের আয়োজনে চমকিত হয়েছিলাম। পরিবেশনে ছিল নিখুঁত আভিজাত্য। ফিরে আসার সময় তিনি প্রত্যেকের হাতে একটা করে সিল্কের পাঞ্জাবি তুলে দিলেন। মনে পড়ে, অনেকদিন পরে পাঞ্জাবির প্যাকেটটি খোলা হলে দেখলাম। কী আশ্চর্য! আমার হাতে দেওয়া হয়েছিল প্যাকেটটির গায়ে জেলাপ্রশাসকের নাম লেখা। ইচ্ছে থাকলেও তখন পরিবর্তনের আর সুযোগ পাইনি। কারণ জেলাপ্রশাসক অন্যত্র বদলি হয়েছিলেন। সেদিন সুপ্রিমকোর্টের সেই বিচারপতির হৃদয়ের উষ্ণতায় আমরা সিক্ত হয়েছিলাম। তার পারিবারিক সদস্যদের আথিতেয়তায় নমিত হয়েছিলাম। সঙ্গে ছিল প্রকৃতির অকৃপণ সহযোগিতা। বলা যায়, শরৎ সন্ধ্যার এক মনোমুগ্ধকর আবহাওয়ার প্রসন্ন আশীর্বাদ ছিল।
৩.
জেলাপ্রশাসক হিসেবে ব্রাহ্মণবাড়িয়া এবং চট্টগ্রামে অসংখ্য পূজা পার্বণে অংশগ্রহণ করেছি। আশ্বিন মাসেই অংশ নিয়েছি বৌদ্ধদের বৃহত্তর আয়োজন প্রবারণা পূর্ণিমার বাৎসরিক আলোচনা অনুষ্ঠানে। তাদের কঠিন চীবর দান অনুষ্ঠানে গিয়ে নিজের হাতে রঙিন ফানুস উড়িয়েছি। আলোচনায় অংশ নিয়ে এদের জেনেছি। এগুলো দাপ্তরিক দায়িত্বেরও অংশ ছিল। পূজো-ম-প দেখার সাথে সনাতন ধর্মাবলম্বী মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত বিচরণ, এদের জীবনাচার ও আর্থিক স্বচ্ছলতার এক বাস্তব চিত্র চোখের সামনে ভেসে উঠতো। বড় বড় আয়োজনে সবসময় নিমন্ত্রণ পেলে পথের ধারের আর্থিক অস্বচ্ছল মানুষের খুব ক্ষুদ্রায়তন ম-পেও স্বইচ্ছায় গিয়েছি। আয়োজনকারীদের অপ্রত্যাশিত, অনিমন্ত্রিত অতিথি হয়েছি অনেকবার। এতে আমার অন্তরে অনাবিল আনন্দ জাগ্রত হত। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ, সরাইল থেকে কসবা, নবীনগর পর্যন্ত অনেক স্থানে পূজার বর্ণালি উদযাপন উপভোগ করেছি। তবে শহরের কালীবাড়ি মন্দিরের পূজার আয়োজনটা সবসময় ভিন্ন মাত্রা পেত। তারা অতীত ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা রক্ষার্থে যথেষ্ট সজাগ দৃষ্টি রাখতেন। পূজাপার্বণাদি উদযাপনের জন্য ব্রাহ্মণবাড়িয়া অনুকূল জনপদ না হলেও প্রীতিকর এবং সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশেই অনুষ্ঠান সম্পন্ন হতো। পেছনে ফিরে তাকালে দেখি, ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের বাইরে সরাইলের উচালিয়াপাড়ার সমাজ সেবক প্রয়াত আশুতোষ চক্রবর্তীর পৈত্রিক ভিটায় নিজস্ব আয়োজনে উদযাপিত বর্ণাঢ্য পূজাম-প দেখার জন্য একাধিকবার গিয়েছি। তারা বছরের পর বছর ধরে শারদীয় উৎসবকে মহিমান্বিত ও গৌরবান্বিত করে চলেছেন।
৪.
আজ থেকে প্রায় এক দশক আগে চট্টগ্রামের জেলাপ্রশাসক ও পরবর্তীতে বিভাগীয় কমিশনার হিসেবেও বিভিন্ন জেলার পূজা উৎসবের বিচিত্র আনুষ্ঠানিকতায় যোগদান করেছি। চট্টগ্রামের রাউজান, ফটিকছড়ি, হাটহাজারী থেকে পটিয়া, লোহাগাড়া, কাপ্তাই পর্যন্ত অগণিত এলাকায় ঘুরেছি। পূজার সময়ে আয়োজকদের সুরক্ষার নিমিত্ত আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ওপর নজরদারির লক্ষে গোটা বিভাগে নানাবিধ সতর্ক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হয়েছে। যা সুদীর্ঘকাল ধরে জেলা প্রশাসনই দেখভাল করে চলেছে। মনে হয়েছে, কুমিল্লা, ফেনী, লক্ষ্মীপুরে পূজার আনুষ্ঠানিকতা হয় খানিকটা পৃথক ব্যঞ্জনার আবহে। জেলা শহরগুলোতে দুর্গোৎসব অনুষ্ঠানের আর্থিক ব্যয় সচরাচর অনেক বেশি হয়ে থাকে। তাছাড়া দেবীর বিসর্জনে জলে নিমজ্জিত করা হয় বলে, পরিবেশ দূষণের বিষয়েও সতর্ক দৃষ্টি রাখা হতো।
৫.
আরও একবারের কথা মনে পড়ে, পূজার জমজমাট লোকারণ্য সময়ে রাঙামাটি থেকে ফিরে আসার পথে সূর্যাস্ত হয়ে যায়। সবুজ বনানী ছুঁয়ে ঘুটঘুটে অন্ধকার নেমে আসতে থাকে। হাটহাজারীর বিখ্যাত মাদ্রাসা সড়কের খানিক আগে স্থানীয় ইউএনও সাহেবের বিশেষ অনুরোধে এক আলো ঝলমলে ম-পে প্রবেশ করি। অনেক মানুষের নির্বিঘœ আগমন দেখে ভালো লেগেছিল। তবে বেশি আনন্দিত হয়েছিলাম মাদ্রাসাপড়–য়া ছোট ছোট কয়েকজন ছাত্রকে দেখে। তারা আনমনে ভেতর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল। এমন দৃশ্যই বাঙালির কাম্য। শিশুদের মধ্যে তখনও অন্যকোনো অনুভূতি আসেনি।
সেদিন শহরে প্রবেশের পূর্বে একেবারে আকস্মিক সিদ্ধান্তে এবং অনাহুতভাবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে চলে যাই। আমার সাথে থাকা অনুজ সহকর্মীদের বললাম, --শোন, এখন রাত হয়েছে। কেউ বুঝতে পারবে না। কাউকে কিছু বলারও দরকার নেই। আমরা দেশের অন্যতম বৃহৎ এই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান প্রধান স্থাপনা ও হলগুলোর অবস্থান গাড়ি থেকেই পাখির চোখে একটু দেখে নিব।
এবং তা-ই হলো। নিভৃতে কিন্তু জনান্তিকে প্রথমবারের মত নিসর্গঘেরা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশাল জমিনকে আমি অবলোকন করেছিলাম। তখন ক্যাম্পাসেও ছোটখাটো পূজোর আমেজ ছড়িয়ে ছিল। বলাবাহুল্য, এর আগে এবং পরে দুয়েকবার সে ক্যাম্পাসে গিয়েছিলাম, তবে সেটা দেখার জন্য নয়, কাজের প্রয়োজনে। এতদিন বাদে মনে হয়, পৃথিবীতে সবকিছু দেখতে হয় বিনা কাজে। কাজ করে সেভাবে দেখা হয় না, যা হয় তা কাজই, দেখা নয়।
[লেখক: গল্পকার, সাবেক সচিব]