গাজী তারেক আজিজ
সমাজবিজ্ঞানের পরিভাষায় মেরিটোক্রেসি মানে এমন এক ব্যবস্থা, যেখানে ব্যক্তির মূল্যায়ন হয় তার যোগ্যতা, মেধা, দক্ষতা ও কর্মফল অনুসারে। বংশ, সম্পদ কিংবা রাজনৈতিক পরিচয় নয়; বরং মানুষ কীভাবে নিজের সামর্থ্যকে কাজে লাগাচ্ছে, সেটিই মূল নির্ধারক। এক অর্থে মেরিটোক্রেসি হলো ‘যোগ্যতমের জয়’। আধুনিক রাষ্ট্র ও সমাজে এটি ন্যায়সংগত ও কার্যকর শাসনব্যবস্থার এক গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত হয়। এখানে একটি বারের জন্যও কিন্তু শিক্ষিত বলা হয়নি। তাহলে কী দাঁড়ায়? যোগ্যতা কেবলই শিক্ষা নয়। দক্ষতার মিশেলে সামর্থ্য।
বাংলাদেশের সমাজ-রাজনীতি ও রাষ্ট্রপরিচালনায় মেরিটোক্রেসির ধারণাটি কতটা প্রযোজ্য, সেটিই আজকের আলোচ্য বিষয়। কারণ, স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দী পেরিয়ে এসেও আমরা এখনও বিতর্কে আছি- আমাদের সমাজ কি প্রকৃতপক্ষে যোগ্যতার ভিত্তিতে এগোচ্ছে, নাকি পরিবার, সম্পদ ও রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার ঘূর্ণিতে আটকে আছে?
শিক্ষাক্ষেত্রই মূলত মেরিটোক্রেসির প্রাথমিক ভিত্তি। কারণ, শিক্ষা ব্যবস্থা যোগ্যতাকে যাচাই ও পুরস্কৃত করার প্রধান মঞ্চ। কিন্তু বাংলাদেশের শিক্ষা বাস্তবতায় ‘মেরিট’ সব সময় সমানভাবে মূল্যায়িত হয় না। সরকারি-বেসরকারি শিক্ষার মধ্যে বিপুল বৈষম্য, কোচিং নির্ভরতা, প্রশ্নফাঁস, এমনকি অতি মাত্রায় গ্রেডফুল ইনফ্লেশন মেধাকে আড়াল করে রাখে।
একজন মেধাবী ছাত্র যদি গ্রামীণ দরিদ্র পরিবারের সন্তান হয়, তবে তার যোগ্যতা প্রমাণের সুযোগ অনেকাংশে সীমিত। অন্যদিকে শহুরে ধনী পরিবার থেকে আগত কোনো শিক্ষার্থী পর্যাপ্ত টিউটর, কোচিং ও প্রযুক্তি-সহায়তা পায়। ফলে প্রতিযোগিতার ময়দানে সমান সুযোগ অনুপস্থিত থাকে। মেরিটোক্রেসি তখন কাগুজে তত্ত্ব হয়ে দাঁড়ায়। আর এর ব্যত্যয় ঘটিয়ে বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। যেখানে শিক্ষার চেয়েও নিজের সামর্থ্য বেশি প্রমাণিত। আর তা পুঁজি করেই লক্ষ লক্ষ টাকা আয় করছে স্বল্প শিক্ষিত কিছু তরুণ। যাদের সেইসব উদ্যোগের ফলে এমনটিও শোনা যায় যে, মাসে দশ লক্ষ বা ততোধিক টাকা আয় করে চলেছে। এতে একটা বিষয় পরিষ্কার উন্মুক্ত বাজার ব্যবস্থাপনার এই যুগে যে যার যার শক্তি সামর্থ্য প্রমাণ করে আয় করে যাচ্ছে। এখানে কোনরূপ কর্তৃত্ব লক্ষ্য করা যায় না। নিছক বোধবুদ্ধি খাটিয়ে নিজেকে নিজে ভেঙে গড়ার প্রতিযোগিতা। এটা কেবলই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নয়, বহুবিধ পন্থায় যেমন ইউটিউব বা মার্কেটপ্লেস ফাইভার, আপওয়ার্ক এর মাধ্যমে ফ্রিল্যান্সিং করে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে আয় করছে ঘরে বসে। যা আয়ের পুরো ধারণাকেই আমুল বদলে দিতে সক্ষম হয়েছে বলেও প্রমাণিত হয়ে আসছে। আর এটাই মেরিটোক্রেসি। যা পারিবারিক বা রাজনৈতিক বা বিত্তশালী না হয়েও অর্জন করা যেতে পারে।
সরকারি চাকরি কিংবা কর্পোরেট চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার ধারণা মেরিটোক্রেসির বহিঃপ্রকাশ। বাংলাদেশে বিসিএস কিংবা বিভিন্ন সরকারি চাকরির পরীক্ষায় হাজারো মেধাবী তরুণ প্রতিযোগিতা করেন। এখানেই এক ধরনের মেধাভিত্তিক ব্যবস্থা কার্যকর হয়। তবে বাস্তবতা হলো, পরীক্ষায় সফল হওয়ার পরও প্রভাবশালী সম্পর্ক, দলীয় আনুগত্য বা ঘুষের মতো অপসংস্কৃতি অনেক সময় যোগ্যতাকে ম্লান করে দেয়। আর তা অহরহই ঘটে থাকে আমাদের চোখের সামনে। সেক্ষেত্রে আমরা কেবলই নীরব দর্শক।
কর্পোরেট জগতে অবস্থান কিছুটা ভিন্ন। সেখানে প্রায়ই দক্ষতা ও কর্মফল অনুযায়ী পদোন্নতি ঘটে। তবে সেই ক্ষেত্রেও রাজনৈতিক প্রভাব, বিদেশি সংযোগ, পারিবারিক ব্যাকগ্রাউন্ড গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। মেরিটোক্রেসির স্বপ্ন তাই আংশিক বাস্তবায়িত হয়, পুরোপুরি নয়।
সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো রাজনীতি। বাংলাদেশের রাজনীতিতে যোগ্যতা বা মেধা কতটুকু প্রাধান্য পায়? বাস্তব উত্তর হলো- খুব সামান্য। রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃত্ব প্রায়শঃই পারিবারিক উত্তরাধিকার বা অর্থনৈতিক শক্তির হাতে গিয়ে ঠেকে। ছাত্র রাজনীতিতে যিনি সংগ্রাম করেছেন, নীতি-আদর্শ রক্ষা করেছেন, তিনি সব সময় নেতৃত্বে আসেন না। বরং যিনি পরিবারগত বা আর্থিকভাবে শক্তিশালী, তিনিই প্রায়শই প্রাধান্য পান। আর এরই বিপরীতে মেরিটোক্রেসি তার অবস্থান পোক্ত করতে চলেছে বলেও ধারণা করা যেতে পারে।
এই পরিস্থিতি মেরিটোক্রেসির মূলনীতির বিপরীত। রাজনীতিতে যোগ্যতা বলতে বোঝানো উচিত- সঠিক দৃষ্টি, সংগঠন চালানোর দক্ষতা, জনসমর্থন অর্জনের ক্ষমতা এবং নৈতিক সততা। কিন্তু বাংলাদেশে এগুলোর চেয়ে বেশি মূল্য পায় ক্ষমতাশালী বংশ বা অর্থনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা। ফলে রাজনীতি হয়ে ওঠে যোগ্যতার নয়, বরং সুবিধাভোগীদের খেলার মাঠ। যা মানুষ বর্জন করতে শুরু করেছে।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে মেরিটোক্রেসির কিছুটা ছাপ আছে। তৈরি পোশাক শিল্প কিংবা তথ্যপ্রযুক্তি খাতে অনেক তরুণ উদ্যোক্তা নিজেদের দক্ষতা ও শ্রমের মাধ্যমে সফল হয়েছেন। তাঁরা পারিবারিকভাবে সুবিধাপ্রাপ্ত না হলেও, নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করে এগিয়ে এসেছেন। তবে এর পাশাপাশি কিছু খাত একচেটিয়াভাবে পরিবারকেন্দ্রিক ব্যবসায়ীর হাতে বন্দী। ব্যাংক লোন সুবিধা, লাইসেন্স, কনসেশন সবকিছু তারা সহজে পায়; সাধারণ উদ্যোক্তারা পায় না। ফলে সামগ্রিকভাবে অর্থনীতিতে মেরিটোক্রেসির বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়।
বাংলাদেশের সমাজ কাঠামোতে এখনও পরিবার ও বংশের প্রভাব প্রবল। একজন শিক্ষার্থী মেধাবী হলেও সমাজে মূল্যায়নের জন্য প্রায়ই তার পরিবারের অবস্থান দেখা হয়। বিয়ে থেকে শুরু করে চাকরি পর্যন্ত-সবখানেই ‘কে কোন পরিবারের সন্তান’-এই প্রশ্ন অগ্রাধিকার পায়। মেরিটোক্রেসি সমাজে মূলধারার মানদ- হয়ে উঠতে পারছে না। তবে পারিবারিক বা রাজনৈতিক বলয় ভাঙতে শুরু করেছে। মেরিটোক্রেসি ধীরে ধীরে নিজের অবস্থানের ভীত মজবুত করে নিতে সক্ষম হচ্ছে। আর তাই এর গুরুত্ব অপরিসীম।
১. ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা: যোগ্যতাভিত্তিক ব্যবস্থা মানুষকে ন্যায্য প্রতিযোগিতার সুযোগ দেয়।
২. অর্থনৈতিক দক্ষতা: মেধা ও দক্ষতাসম্পন্ন মানুষ সুযোগ পেলে উৎপাদনশীলতা বাড়ে।
৩. সামাজিক গতিশীলতা: দরিদ্র পরিবার থেকেও প্রতিভাবানরা উঠে আসতে পারে, ফলে শ্রেণিগত বৈষম্য কমে।
৪. রাজনীতির মানোন্নয়ন: যোগ্য নেতৃত্ব আসলে নীতিনিষ্ঠ শাসন প্রতিষ্ঠা সহজ হয়।
তবে তা এত সহজ নয়। কারণ দীর্ঘদিনের সামাজিক বলয় ভেদ করে নিজেকে জানান দিতে বেশকিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়। সেই চ্যালেঞ্জ থেকে উত্তরণ ঘটানো এতো সহজ নয়। এতে অনেক চ্যালেঞ্জ ও বাধা সামনে আসতে পারে। যার জন্য মানসিক প্রস্তুতিও অসামান্য থাকা জরুরী। বাংলাদেশে মেরিটোক্রেসি প্রতিষ্ঠায় কিছু বড় বাধা রয়েছে-
শিক্ষাব্যবস্থার বৈষম্য ও দুর্বলতা।
দুর্নীতি, দলীয়করণ ও প্রভাবশালী গোষ্ঠীর আধিপত্য।
সামাজিক ও পারিবারিক উত্তরাধিকারের প্রবল প্রভাব।
রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া সুযোগ না পাওয়ার সংস্কৃতি।
এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় যা যা করণীয় তা হচ্ছে-
১. শিক্ষায় সমান সুযোগ নিশ্চিত করা: গ্রামীণ ও শহুরে শিক্ষার ব্যবধান কমানো জরুরি।
২. নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা: ঘুষ, প্রভাব ও দলীয়করণ দূর করতে কঠোর আইন ও প্রয়োগ দরকার।
৩. রাজনীতিতে অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র: পরিবারভিত্তিক উত্তরাধিকার রাজনীতি ভেঙে যোগ্য নেতৃত্বকে উত্থানের সুযোগ দিতে
হবে।
৪. উদ্যোক্তাদের জন্য সমান সুযোগ: লোন, লাইসেন্স ও সরকারি সুবিধা সবার জন্য সমানভাবে উন্মুক্ত করা উচিত।
৫. সামাজিক সচেতনতা: মেরিটোক্রেসিকে সমাজের মূল মূল্যবোধে রূপান্তরিত করা দরকার।
পরিশেষে বলা যায়, মেরিটোক্রেসি কেবল তত্ত্ব নয়; এটি একটি ন্যায়ভিত্তিক ও কার্যকর সমাজ গড়ার অন্যতম হাতিয়ার। বাংলাদেশ যদি টেকসই উন্নয়ন, দক্ষ নেতৃত্ব ও সত্যিকার অর্থে প্রগতিশীল সমাজ চায়, তবে যোগ্যতা ও মেধার মর্যাদা দিতে হবে সর্বক্ষেত্রে। পরিবার, সম্পদ কিংবা রাজনৈতিক পরিচয়ের চেয়ে মেধা ও দক্ষতা যে গুরুত্বপূর্ণ- এই বার্তাই সমাজের প্রতিটি স্তরে ছড়িয়ে দিতে হবে। নইলে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম বিশ্বাস হারাবে, যোগ্যতা ব্যর্থ হবে এবং জাতি আবারো ‘সুযোগের বৈষম্যে’ বন্দি হয়ে পড়বে। গবৎরঃড়পৎধপু শব্দটির জন্ম হয়েছিল ব্যঙ্গ-সমালোচনা হিসেবে, কিন্তু পরে এটি সমাজ ও রাজনীতির বাস্তব আলোচনায় এক ইতিবাচক মূল্যবোধ হিসেবে স্থান করে নেয়। মাইকেল ইয়াং চেয়েছিলেন মানুষ যেন চোখ খুলে দেখে-শুধু মেধা নয়, সমতা, সুযোগ ও মানবিকতাও গুরুত্বপূর্ণ। আজকের বিশ্বে এই দ্বৈত অর্থই মেরিটোক্রেসি ধারণাকে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ করে তুলেছে। মেরিটোক্রেসি প্রতিষ্ঠা তাই শুধু তাত্ত্বিক নয়, আমাদের ভবিষ্যতের অপরিহার্য শর্ত।
[লেখক: অ্যাডভোকেট, জেলা ও দায়রা জজ আদালত, ফেনী]
গাজী তারেক আজিজ
বৃহস্পতিবার, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫
সমাজবিজ্ঞানের পরিভাষায় মেরিটোক্রেসি মানে এমন এক ব্যবস্থা, যেখানে ব্যক্তির মূল্যায়ন হয় তার যোগ্যতা, মেধা, দক্ষতা ও কর্মফল অনুসারে। বংশ, সম্পদ কিংবা রাজনৈতিক পরিচয় নয়; বরং মানুষ কীভাবে নিজের সামর্থ্যকে কাজে লাগাচ্ছে, সেটিই মূল নির্ধারক। এক অর্থে মেরিটোক্রেসি হলো ‘যোগ্যতমের জয়’। আধুনিক রাষ্ট্র ও সমাজে এটি ন্যায়সংগত ও কার্যকর শাসনব্যবস্থার এক গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত হয়। এখানে একটি বারের জন্যও কিন্তু শিক্ষিত বলা হয়নি। তাহলে কী দাঁড়ায়? যোগ্যতা কেবলই শিক্ষা নয়। দক্ষতার মিশেলে সামর্থ্য।
বাংলাদেশের সমাজ-রাজনীতি ও রাষ্ট্রপরিচালনায় মেরিটোক্রেসির ধারণাটি কতটা প্রযোজ্য, সেটিই আজকের আলোচ্য বিষয়। কারণ, স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দী পেরিয়ে এসেও আমরা এখনও বিতর্কে আছি- আমাদের সমাজ কি প্রকৃতপক্ষে যোগ্যতার ভিত্তিতে এগোচ্ছে, নাকি পরিবার, সম্পদ ও রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার ঘূর্ণিতে আটকে আছে?
শিক্ষাক্ষেত্রই মূলত মেরিটোক্রেসির প্রাথমিক ভিত্তি। কারণ, শিক্ষা ব্যবস্থা যোগ্যতাকে যাচাই ও পুরস্কৃত করার প্রধান মঞ্চ। কিন্তু বাংলাদেশের শিক্ষা বাস্তবতায় ‘মেরিট’ সব সময় সমানভাবে মূল্যায়িত হয় না। সরকারি-বেসরকারি শিক্ষার মধ্যে বিপুল বৈষম্য, কোচিং নির্ভরতা, প্রশ্নফাঁস, এমনকি অতি মাত্রায় গ্রেডফুল ইনফ্লেশন মেধাকে আড়াল করে রাখে।
একজন মেধাবী ছাত্র যদি গ্রামীণ দরিদ্র পরিবারের সন্তান হয়, তবে তার যোগ্যতা প্রমাণের সুযোগ অনেকাংশে সীমিত। অন্যদিকে শহুরে ধনী পরিবার থেকে আগত কোনো শিক্ষার্থী পর্যাপ্ত টিউটর, কোচিং ও প্রযুক্তি-সহায়তা পায়। ফলে প্রতিযোগিতার ময়দানে সমান সুযোগ অনুপস্থিত থাকে। মেরিটোক্রেসি তখন কাগুজে তত্ত্ব হয়ে দাঁড়ায়। আর এর ব্যত্যয় ঘটিয়ে বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। যেখানে শিক্ষার চেয়েও নিজের সামর্থ্য বেশি প্রমাণিত। আর তা পুঁজি করেই লক্ষ লক্ষ টাকা আয় করছে স্বল্প শিক্ষিত কিছু তরুণ। যাদের সেইসব উদ্যোগের ফলে এমনটিও শোনা যায় যে, মাসে দশ লক্ষ বা ততোধিক টাকা আয় করে চলেছে। এতে একটা বিষয় পরিষ্কার উন্মুক্ত বাজার ব্যবস্থাপনার এই যুগে যে যার যার শক্তি সামর্থ্য প্রমাণ করে আয় করে যাচ্ছে। এখানে কোনরূপ কর্তৃত্ব লক্ষ্য করা যায় না। নিছক বোধবুদ্ধি খাটিয়ে নিজেকে নিজে ভেঙে গড়ার প্রতিযোগিতা। এটা কেবলই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নয়, বহুবিধ পন্থায় যেমন ইউটিউব বা মার্কেটপ্লেস ফাইভার, আপওয়ার্ক এর মাধ্যমে ফ্রিল্যান্সিং করে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে আয় করছে ঘরে বসে। যা আয়ের পুরো ধারণাকেই আমুল বদলে দিতে সক্ষম হয়েছে বলেও প্রমাণিত হয়ে আসছে। আর এটাই মেরিটোক্রেসি। যা পারিবারিক বা রাজনৈতিক বা বিত্তশালী না হয়েও অর্জন করা যেতে পারে।
সরকারি চাকরি কিংবা কর্পোরেট চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার ধারণা মেরিটোক্রেসির বহিঃপ্রকাশ। বাংলাদেশে বিসিএস কিংবা বিভিন্ন সরকারি চাকরির পরীক্ষায় হাজারো মেধাবী তরুণ প্রতিযোগিতা করেন। এখানেই এক ধরনের মেধাভিত্তিক ব্যবস্থা কার্যকর হয়। তবে বাস্তবতা হলো, পরীক্ষায় সফল হওয়ার পরও প্রভাবশালী সম্পর্ক, দলীয় আনুগত্য বা ঘুষের মতো অপসংস্কৃতি অনেক সময় যোগ্যতাকে ম্লান করে দেয়। আর তা অহরহই ঘটে থাকে আমাদের চোখের সামনে। সেক্ষেত্রে আমরা কেবলই নীরব দর্শক।
কর্পোরেট জগতে অবস্থান কিছুটা ভিন্ন। সেখানে প্রায়ই দক্ষতা ও কর্মফল অনুযায়ী পদোন্নতি ঘটে। তবে সেই ক্ষেত্রেও রাজনৈতিক প্রভাব, বিদেশি সংযোগ, পারিবারিক ব্যাকগ্রাউন্ড গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। মেরিটোক্রেসির স্বপ্ন তাই আংশিক বাস্তবায়িত হয়, পুরোপুরি নয়।
সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো রাজনীতি। বাংলাদেশের রাজনীতিতে যোগ্যতা বা মেধা কতটুকু প্রাধান্য পায়? বাস্তব উত্তর হলো- খুব সামান্য। রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃত্ব প্রায়শঃই পারিবারিক উত্তরাধিকার বা অর্থনৈতিক শক্তির হাতে গিয়ে ঠেকে। ছাত্র রাজনীতিতে যিনি সংগ্রাম করেছেন, নীতি-আদর্শ রক্ষা করেছেন, তিনি সব সময় নেতৃত্বে আসেন না। বরং যিনি পরিবারগত বা আর্থিকভাবে শক্তিশালী, তিনিই প্রায়শই প্রাধান্য পান। আর এরই বিপরীতে মেরিটোক্রেসি তার অবস্থান পোক্ত করতে চলেছে বলেও ধারণা করা যেতে পারে।
এই পরিস্থিতি মেরিটোক্রেসির মূলনীতির বিপরীত। রাজনীতিতে যোগ্যতা বলতে বোঝানো উচিত- সঠিক দৃষ্টি, সংগঠন চালানোর দক্ষতা, জনসমর্থন অর্জনের ক্ষমতা এবং নৈতিক সততা। কিন্তু বাংলাদেশে এগুলোর চেয়ে বেশি মূল্য পায় ক্ষমতাশালী বংশ বা অর্থনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা। ফলে রাজনীতি হয়ে ওঠে যোগ্যতার নয়, বরং সুবিধাভোগীদের খেলার মাঠ। যা মানুষ বর্জন করতে শুরু করেছে।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে মেরিটোক্রেসির কিছুটা ছাপ আছে। তৈরি পোশাক শিল্প কিংবা তথ্যপ্রযুক্তি খাতে অনেক তরুণ উদ্যোক্তা নিজেদের দক্ষতা ও শ্রমের মাধ্যমে সফল হয়েছেন। তাঁরা পারিবারিকভাবে সুবিধাপ্রাপ্ত না হলেও, নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করে এগিয়ে এসেছেন। তবে এর পাশাপাশি কিছু খাত একচেটিয়াভাবে পরিবারকেন্দ্রিক ব্যবসায়ীর হাতে বন্দী। ব্যাংক লোন সুবিধা, লাইসেন্স, কনসেশন সবকিছু তারা সহজে পায়; সাধারণ উদ্যোক্তারা পায় না। ফলে সামগ্রিকভাবে অর্থনীতিতে মেরিটোক্রেসির বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়।
বাংলাদেশের সমাজ কাঠামোতে এখনও পরিবার ও বংশের প্রভাব প্রবল। একজন শিক্ষার্থী মেধাবী হলেও সমাজে মূল্যায়নের জন্য প্রায়ই তার পরিবারের অবস্থান দেখা হয়। বিয়ে থেকে শুরু করে চাকরি পর্যন্ত-সবখানেই ‘কে কোন পরিবারের সন্তান’-এই প্রশ্ন অগ্রাধিকার পায়। মেরিটোক্রেসি সমাজে মূলধারার মানদ- হয়ে উঠতে পারছে না। তবে পারিবারিক বা রাজনৈতিক বলয় ভাঙতে শুরু করেছে। মেরিটোক্রেসি ধীরে ধীরে নিজের অবস্থানের ভীত মজবুত করে নিতে সক্ষম হচ্ছে। আর তাই এর গুরুত্ব অপরিসীম।
১. ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা: যোগ্যতাভিত্তিক ব্যবস্থা মানুষকে ন্যায্য প্রতিযোগিতার সুযোগ দেয়।
২. অর্থনৈতিক দক্ষতা: মেধা ও দক্ষতাসম্পন্ন মানুষ সুযোগ পেলে উৎপাদনশীলতা বাড়ে।
৩. সামাজিক গতিশীলতা: দরিদ্র পরিবার থেকেও প্রতিভাবানরা উঠে আসতে পারে, ফলে শ্রেণিগত বৈষম্য কমে।
৪. রাজনীতির মানোন্নয়ন: যোগ্য নেতৃত্ব আসলে নীতিনিষ্ঠ শাসন প্রতিষ্ঠা সহজ হয়।
তবে তা এত সহজ নয়। কারণ দীর্ঘদিনের সামাজিক বলয় ভেদ করে নিজেকে জানান দিতে বেশকিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়। সেই চ্যালেঞ্জ থেকে উত্তরণ ঘটানো এতো সহজ নয়। এতে অনেক চ্যালেঞ্জ ও বাধা সামনে আসতে পারে। যার জন্য মানসিক প্রস্তুতিও অসামান্য থাকা জরুরী। বাংলাদেশে মেরিটোক্রেসি প্রতিষ্ঠায় কিছু বড় বাধা রয়েছে-
শিক্ষাব্যবস্থার বৈষম্য ও দুর্বলতা।
দুর্নীতি, দলীয়করণ ও প্রভাবশালী গোষ্ঠীর আধিপত্য।
সামাজিক ও পারিবারিক উত্তরাধিকারের প্রবল প্রভাব।
রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া সুযোগ না পাওয়ার সংস্কৃতি।
এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় যা যা করণীয় তা হচ্ছে-
১. শিক্ষায় সমান সুযোগ নিশ্চিত করা: গ্রামীণ ও শহুরে শিক্ষার ব্যবধান কমানো জরুরি।
২. নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা: ঘুষ, প্রভাব ও দলীয়করণ দূর করতে কঠোর আইন ও প্রয়োগ দরকার।
৩. রাজনীতিতে অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র: পরিবারভিত্তিক উত্তরাধিকার রাজনীতি ভেঙে যোগ্য নেতৃত্বকে উত্থানের সুযোগ দিতে
হবে।
৪. উদ্যোক্তাদের জন্য সমান সুযোগ: লোন, লাইসেন্স ও সরকারি সুবিধা সবার জন্য সমানভাবে উন্মুক্ত করা উচিত।
৫. সামাজিক সচেতনতা: মেরিটোক্রেসিকে সমাজের মূল মূল্যবোধে রূপান্তরিত করা দরকার।
পরিশেষে বলা যায়, মেরিটোক্রেসি কেবল তত্ত্ব নয়; এটি একটি ন্যায়ভিত্তিক ও কার্যকর সমাজ গড়ার অন্যতম হাতিয়ার। বাংলাদেশ যদি টেকসই উন্নয়ন, দক্ষ নেতৃত্ব ও সত্যিকার অর্থে প্রগতিশীল সমাজ চায়, তবে যোগ্যতা ও মেধার মর্যাদা দিতে হবে সর্বক্ষেত্রে। পরিবার, সম্পদ কিংবা রাজনৈতিক পরিচয়ের চেয়ে মেধা ও দক্ষতা যে গুরুত্বপূর্ণ- এই বার্তাই সমাজের প্রতিটি স্তরে ছড়িয়ে দিতে হবে। নইলে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম বিশ্বাস হারাবে, যোগ্যতা ব্যর্থ হবে এবং জাতি আবারো ‘সুযোগের বৈষম্যে’ বন্দি হয়ে পড়বে। গবৎরঃড়পৎধপু শব্দটির জন্ম হয়েছিল ব্যঙ্গ-সমালোচনা হিসেবে, কিন্তু পরে এটি সমাজ ও রাজনীতির বাস্তব আলোচনায় এক ইতিবাচক মূল্যবোধ হিসেবে স্থান করে নেয়। মাইকেল ইয়াং চেয়েছিলেন মানুষ যেন চোখ খুলে দেখে-শুধু মেধা নয়, সমতা, সুযোগ ও মানবিকতাও গুরুত্বপূর্ণ। আজকের বিশ্বে এই দ্বৈত অর্থই মেরিটোক্রেসি ধারণাকে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ করে তুলেছে। মেরিটোক্রেসি প্রতিষ্ঠা তাই শুধু তাত্ত্বিক নয়, আমাদের ভবিষ্যতের অপরিহার্য শর্ত।
[লেখক: অ্যাডভোকেট, জেলা ও দায়রা জজ আদালত, ফেনী]