মিথুশিলাক মুরমু
বৃহত্তর সিলেটের চা বাগানের সূচনা থেকেই ভারতের বিভিন্ন রাজ্য থেকে আদিবাসী, বর্ণহিন্দু ও বিভিন্ন জনগোষ্ঠীকে শ্রমিক হিসেবে নিয়ে আসা হয়। চা শ্রমিকরা আমাদেরই আপনজন। মূলত সাঁওতাল, গারো, মু-া, মাহালী, উড়িয়া, কোল, ভূমিজ, ভূঁইয়া, রাজোয়ার, রবিদাস, পাহান, উরাও, খোদাল, তেলেগু, খ-, খাড়িয়া, বাউরি, লায়েক, নায়েক, ফুলমালি, ছত্রি, কর্মকার, ময়রাচাষা, গোয়ালা, খেওতমওজি, মালি, সবর, বাইগা, টনটো, ভক্তা, কৃষ্ণগোয়ালা, কুমার, তাঁতি, সওরা, গোয়ার, বোয়ার্জি, মিথার, বাগতি সম্প্রদায়ের লোকজনই সর্বাধিক কাজের সঙ্গে যুক্ত।
১৯৫১ খ্রিষ্টাব্দের আদমশুমারি অনুযায়ী, চা বাগান এলাকায় শ্রমিক সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৫৭ হাজার ৪১৯ জন এবং ১৯১১ খ্রিষ্টাব্দে তা ছিল ১ লাখ ৪৪ হাজার ৮৭৬ জন। এই বিশাল জনগোষ্ঠী খ্রিষ্টান, হিন্দু ও নিজস্ব কিছু ধর্ম পালন করে আসছেন। হিন্দু ধর্মের রীতি-রেওয়াজ পালন করলেও কিছু জটিলতা রয়ে গেছে।
সে যাই হোক, চা বাগানের সহজ-সরল মানুষেরা বংশপরম্পরায় মালিকপক্ষের উপেক্ষা স্বীকার করে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করলেও চৈত্র মাসে স্বপ্ন ও প্রত্যাশা নিয়ে দ-পূজা উৎসর্গ করে থাকেন। মূলত এটি কলিঙ্গ রাজ্যের একটি প্রাচীন উৎসব এবং প্রাচীন কলিঙ্গ রাজধানী সাম্পা অর্থাৎ গঞ্জাম জেলার আধুনিক জৌগাড়ার আশেপাশে বিদ্যমান।
ডা-ের অংশগ্রহণকারীদের ডা-ুয়া (ভক্তা নামেও পরিচিত) বলা হয় এবং তারা ১৩, ১৮ বা ২১ দিনের দ-ের সময়কালে দেবী কালী ও শিবের পূজা করে। শুধুমাত্র পুরুষের অংশগ্রহণে এই পূজায় ভক্তারা নির্দিষ্ট দিনগুলোতে ধার্মিক জীবনযাপনে সচেষ্ট থাকেন। এ সময় তারা মাংস, মাছ, এমনকি স্বামী-স্ত্রীর দাম্পত্য সম্পর্ক থেকেও বিরত থাকেন।
লোককাহিনি অনুসারে, প্রাচীনকালে দ- অনুশীলনের ২০ দিন পরে ডা-ুয়ারা তারিণী শক্তি/তন্ত্রপীঠে (যিনি মহান কলিঙ্গ শাসকদের ইষ্টদেবী) জড়ো হতো এবং কঠোর আচার-অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শেষ দিনে দ-ের সমাপ্তি ঘটত। ব্রত পালনের মধ্য দিয়ে পুরোনো বছরের দুঃখ-কষ্ট দূর হয়ে নতুন বছর সুখ-সমৃদ্ধিতে কাটুকÑএই কামনাই করতেন তারা।
দুঃখ-কষ্টের মধ্যে রয়েছে অনেক অব্যক্ত কথা, অদেখা বাস্তবতা এবং জীবনের প্রতিটি স্তরে বঞ্চনার দীর্ঘ তালিকা। এই ‘টি স্টেট’-এর নাগরিকদের কথা কখনো রাষ্ট্র বা সরকার ওয়াকিবহাল হতে পারে না। তবু সামান্য প্রাপ্তি কিংবা সুখের আশায় না দেখা দেবতাদের উদ্দেশ্যে তাদের প্রার্থনা মুখের ভাষায় পৌঁছে থাকে। আদৌ চা জনগোষ্ঠীর প্রার্থনা শোনা হয় কি না, সেটি জানার চেষ্টা ধর্মবিশ্বাস লঙ্ঘনের শামিল।
অধিকার বনাম দাবি
বিগত মে মাসে চা বাগানের শ্রমিক ও ইউনিয়ন নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে শ্রম উপদেষ্টা শ্রমিক নেতৃবৃন্দকে উজ্জীবিত করে বলেনÑ “আপনারা চা শ্রমিকেরা যা বললেন, এগুলো দাবি নয়, এগুলো আপনাদের অধিকার।”
তিনি প্রথম প্রস্তাব করেনÑ “বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সবকিছু দেখতেই টিকিট লাগে। অনেক দেশে ফুলের বাগান দেখতেও টিকিট কেটে ভেতরে ঢুকতে হয়। আমাদের দেশে চা বাগানগুলোতে পর্যটকদের জন্য টিকিটের ব্যবস্থা করা দরকার। পর্যটকেরা এত দামি রিসোর্টে থাকতে পারলে সামান্য ২০ টাকা টিকিট খরচ তাদের জন্য তেমন কিছু নয়। এই টিকিটের টাকা শ্রমিকদের কল্যাণে কাজে লাগানো যাবে।”
শ্রমিকদের দাবির তালিকায় ছিলÑ
কম মজুরি ও বৈষম্য দূরীকরণ,
বকেয়া পরিশোধ,
চাকরির ধরণ নির্ধারণ,
কর্মস্থলে নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ,
বাসস্থান, শিক্ষা, উন্নত চিকিৎসা, স্যানিটেশন, যোগাযোগ,
নিরাপদ ও সুপেয় পানির নিশ্চয়তা,
মাতৃত্বকালীন ছুটি বৃদ্ধি,
সরকারি ছুটি,
এবং সাহিত্য-সংস্কৃতি সংরক্ষণের জন্য চা জনগোষ্ঠী শিল্পকলা একাডেমি স্থাপন।
নারী শ্রমিকের নিরাপত্তাহীনতা
সংশ্লিষ্টরা স্বীকার করেছেনÑ চা বাগানে কাজ করা দেশের ৩৪.৮ শতাংশ নারী শ্রমিক কর্মস্থলে যৌন নির্যাতনের শিকার হন। এর মধ্যে ৩০ শতাংশ মৌখিক, ১৪ শতাংশ শারীরিক নির্যাতন এবং ২৪.৩ শতাংশ নারী কর্মক্ষেত্রকে নিরাপদ মনে করেন না।
চা বাগানে কর্মরত ৩০০-এর বেশি নারী শ্রমিকের মধ্যে জরিপে দেখা যায়Ñ
৯৫.৭% নারী অশ্লীল বা অপমানজনক কথা ও অঙ্গভঙ্গির শিকার,
৩০.৪% অনাকাক্সিক্ষত স্পর্শ,
২৬.১% যৌন হয়রানি ও ভয়ভীতি প্রদর্শন,
১৭.৭% শারীরিক নির্যাতনের শিকার।
চা শ্রমিকেরা শারীরিক, মানসিক কিংবা আত্মিকভাবে কোথাও সান্ত¡না খুঁজে পান না। প্রতিটি ক্ষেত্রে অবিচারের শিকার হয়ে বিচারহীনতার বেদনা নিভৃতে কাঁদে। বিশেষত নারী শ্রমিকদের কাজের পরিবেশ ও নিরাপত্তার বিষয়টি সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ও অগ্রাধিকারযোগ্য।
শিক্ষা ও স্বপ্নভঙ্গ
শিক্ষার ক্ষেত্রে চায়ের রাজ্য থেকে এক-দুজন তরুণ-তরুণী গোবরে পদ্মফুলের মতো বেরিয়ে আসেন। যেহেতু বাগান এলাকায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপনে অনাগ্রহ রয়েছে, তাই বহু প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে উচ্চশিক্ষায় পৌঁছানো প্রায় অসম্ভব কাজ।
উদাহরণস্বরূপÑ
মৌলভীবাজারের কুলাউড়ার ইতি গৌড় দৈনিক পত্রিকার শিরোনাম হয়েছিলেন: “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেলেন ইতি, বরমচাল চা বাগানে তিনিই প্রথম।”
হবিগঞ্জের চুনারুঘাট চা বাগানের শ্রমিকপুত্র সাঞ্জু বাড়াইক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞানের ছাত্র ছিলেন। দুঃখজনকভাবে তিনি জগন্নাথ হলের ছাদ থেকে লাফিয়ে আত্মহত্যা করলে তার মা অনিমা বাড়াইকের স্বপ্ন ভেঙে যায়।
মৌলভীবাজারের কমলি রবিদাস দুঃখ-কষ্ট উপেক্ষা করে সন্তান সন্তোষ রবিদাসকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগ থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জন করিয়েছেন। তাকে ২০১৮ সালে শ্রেষ্ঠ মা নির্বাচিত করা হলেও পরবর্তীতে জানা যায় তিনি চা শ্রমিক। স্টেজে উঠে কথা বলতে পারবেন না বলে তার নাম কেটে দেওয়া হয়েছিল।
শুধুমাত্র শিক্ষার সুযোগের অভাবেই চা জনগোষ্ঠীর প্রজন্মের পর প্রজন্ম কায়িক শ্রমিক হয়ে উঠছে। মাতৃমৃত্যুর হার ও প্রতিরোধযোগ্য রোগে তাদের অকালে ঝরে পড়তে হচ্ছে।
শতবর্ষের বঞ্চনা
চা বাগানগুলোতে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বারবার পরিদর্শন করেছেন। শ্রম সংস্কার কমিশনের প্রধানও সম্প্রতি পরিদর্শন করেছেন।
১৯২১ খ্রিষ্টাব্দের ২০ মে ব্রিটিশ মালিকদের প্রতারণা, বঞ্চনা ও শোষণের বিরুদ্ধে চা শ্রমিকরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে “মুল্লুক চলো”Ñ অর্থাৎ পিতৃভূমিতে ফিরে যাওয়ার ডাক দিয়েছিলেন। বাংলার ভূখ- ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি শোষণ থেকে স্বাধীন হলেও আজ অবধি ৫৫ বছরে চা জনগোষ্ঠীর জীবনে কোনো বড় পরিবর্তন ঘটেনি।
বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের শ্রম উপদেষ্টা হৃদয় থেকে উপলব্ধি করেছেন চা জনগোষ্ঠীর চাওয়া-পাওয়া। সময়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে তাদের ন্যূনতম অধিকারগুলো নিশ্চিত করতে তিনি উদ্যোগ নেবেনÑ এ বিশ্বাস রাখা যায়। কেননা তিনিই প্রথম চা জনগোষ্ঠীকে “দাবি” থেকে “অধিকার” প্রাপ্তির নৈতিক শক্তিতে উন্নীত করেছেন।
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
[লেখক: কলামিস্ট]
মিথুশিলাক মুরমু
বৃহস্পতিবার, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫
বৃহত্তর সিলেটের চা বাগানের সূচনা থেকেই ভারতের বিভিন্ন রাজ্য থেকে আদিবাসী, বর্ণহিন্দু ও বিভিন্ন জনগোষ্ঠীকে শ্রমিক হিসেবে নিয়ে আসা হয়। চা শ্রমিকরা আমাদেরই আপনজন। মূলত সাঁওতাল, গারো, মু-া, মাহালী, উড়িয়া, কোল, ভূমিজ, ভূঁইয়া, রাজোয়ার, রবিদাস, পাহান, উরাও, খোদাল, তেলেগু, খ-, খাড়িয়া, বাউরি, লায়েক, নায়েক, ফুলমালি, ছত্রি, কর্মকার, ময়রাচাষা, গোয়ালা, খেওতমওজি, মালি, সবর, বাইগা, টনটো, ভক্তা, কৃষ্ণগোয়ালা, কুমার, তাঁতি, সওরা, গোয়ার, বোয়ার্জি, মিথার, বাগতি সম্প্রদায়ের লোকজনই সর্বাধিক কাজের সঙ্গে যুক্ত।
১৯৫১ খ্রিষ্টাব্দের আদমশুমারি অনুযায়ী, চা বাগান এলাকায় শ্রমিক সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৫৭ হাজার ৪১৯ জন এবং ১৯১১ খ্রিষ্টাব্দে তা ছিল ১ লাখ ৪৪ হাজার ৮৭৬ জন। এই বিশাল জনগোষ্ঠী খ্রিষ্টান, হিন্দু ও নিজস্ব কিছু ধর্ম পালন করে আসছেন। হিন্দু ধর্মের রীতি-রেওয়াজ পালন করলেও কিছু জটিলতা রয়ে গেছে।
সে যাই হোক, চা বাগানের সহজ-সরল মানুষেরা বংশপরম্পরায় মালিকপক্ষের উপেক্ষা স্বীকার করে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করলেও চৈত্র মাসে স্বপ্ন ও প্রত্যাশা নিয়ে দ-পূজা উৎসর্গ করে থাকেন। মূলত এটি কলিঙ্গ রাজ্যের একটি প্রাচীন উৎসব এবং প্রাচীন কলিঙ্গ রাজধানী সাম্পা অর্থাৎ গঞ্জাম জেলার আধুনিক জৌগাড়ার আশেপাশে বিদ্যমান।
ডা-ের অংশগ্রহণকারীদের ডা-ুয়া (ভক্তা নামেও পরিচিত) বলা হয় এবং তারা ১৩, ১৮ বা ২১ দিনের দ-ের সময়কালে দেবী কালী ও শিবের পূজা করে। শুধুমাত্র পুরুষের অংশগ্রহণে এই পূজায় ভক্তারা নির্দিষ্ট দিনগুলোতে ধার্মিক জীবনযাপনে সচেষ্ট থাকেন। এ সময় তারা মাংস, মাছ, এমনকি স্বামী-স্ত্রীর দাম্পত্য সম্পর্ক থেকেও বিরত থাকেন।
লোককাহিনি অনুসারে, প্রাচীনকালে দ- অনুশীলনের ২০ দিন পরে ডা-ুয়ারা তারিণী শক্তি/তন্ত্রপীঠে (যিনি মহান কলিঙ্গ শাসকদের ইষ্টদেবী) জড়ো হতো এবং কঠোর আচার-অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শেষ দিনে দ-ের সমাপ্তি ঘটত। ব্রত পালনের মধ্য দিয়ে পুরোনো বছরের দুঃখ-কষ্ট দূর হয়ে নতুন বছর সুখ-সমৃদ্ধিতে কাটুকÑএই কামনাই করতেন তারা।
দুঃখ-কষ্টের মধ্যে রয়েছে অনেক অব্যক্ত কথা, অদেখা বাস্তবতা এবং জীবনের প্রতিটি স্তরে বঞ্চনার দীর্ঘ তালিকা। এই ‘টি স্টেট’-এর নাগরিকদের কথা কখনো রাষ্ট্র বা সরকার ওয়াকিবহাল হতে পারে না। তবু সামান্য প্রাপ্তি কিংবা সুখের আশায় না দেখা দেবতাদের উদ্দেশ্যে তাদের প্রার্থনা মুখের ভাষায় পৌঁছে থাকে। আদৌ চা জনগোষ্ঠীর প্রার্থনা শোনা হয় কি না, সেটি জানার চেষ্টা ধর্মবিশ্বাস লঙ্ঘনের শামিল।
অধিকার বনাম দাবি
বিগত মে মাসে চা বাগানের শ্রমিক ও ইউনিয়ন নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে শ্রম উপদেষ্টা শ্রমিক নেতৃবৃন্দকে উজ্জীবিত করে বলেনÑ “আপনারা চা শ্রমিকেরা যা বললেন, এগুলো দাবি নয়, এগুলো আপনাদের অধিকার।”
তিনি প্রথম প্রস্তাব করেনÑ “বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সবকিছু দেখতেই টিকিট লাগে। অনেক দেশে ফুলের বাগান দেখতেও টিকিট কেটে ভেতরে ঢুকতে হয়। আমাদের দেশে চা বাগানগুলোতে পর্যটকদের জন্য টিকিটের ব্যবস্থা করা দরকার। পর্যটকেরা এত দামি রিসোর্টে থাকতে পারলে সামান্য ২০ টাকা টিকিট খরচ তাদের জন্য তেমন কিছু নয়। এই টিকিটের টাকা শ্রমিকদের কল্যাণে কাজে লাগানো যাবে।”
শ্রমিকদের দাবির তালিকায় ছিলÑ
কম মজুরি ও বৈষম্য দূরীকরণ,
বকেয়া পরিশোধ,
চাকরির ধরণ নির্ধারণ,
কর্মস্থলে নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ,
বাসস্থান, শিক্ষা, উন্নত চিকিৎসা, স্যানিটেশন, যোগাযোগ,
নিরাপদ ও সুপেয় পানির নিশ্চয়তা,
মাতৃত্বকালীন ছুটি বৃদ্ধি,
সরকারি ছুটি,
এবং সাহিত্য-সংস্কৃতি সংরক্ষণের জন্য চা জনগোষ্ঠী শিল্পকলা একাডেমি স্থাপন।
নারী শ্রমিকের নিরাপত্তাহীনতা
সংশ্লিষ্টরা স্বীকার করেছেনÑ চা বাগানে কাজ করা দেশের ৩৪.৮ শতাংশ নারী শ্রমিক কর্মস্থলে যৌন নির্যাতনের শিকার হন। এর মধ্যে ৩০ শতাংশ মৌখিক, ১৪ শতাংশ শারীরিক নির্যাতন এবং ২৪.৩ শতাংশ নারী কর্মক্ষেত্রকে নিরাপদ মনে করেন না।
চা বাগানে কর্মরত ৩০০-এর বেশি নারী শ্রমিকের মধ্যে জরিপে দেখা যায়Ñ
৯৫.৭% নারী অশ্লীল বা অপমানজনক কথা ও অঙ্গভঙ্গির শিকার,
৩০.৪% অনাকাক্সিক্ষত স্পর্শ,
২৬.১% যৌন হয়রানি ও ভয়ভীতি প্রদর্শন,
১৭.৭% শারীরিক নির্যাতনের শিকার।
চা শ্রমিকেরা শারীরিক, মানসিক কিংবা আত্মিকভাবে কোথাও সান্ত¡না খুঁজে পান না। প্রতিটি ক্ষেত্রে অবিচারের শিকার হয়ে বিচারহীনতার বেদনা নিভৃতে কাঁদে। বিশেষত নারী শ্রমিকদের কাজের পরিবেশ ও নিরাপত্তার বিষয়টি সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ও অগ্রাধিকারযোগ্য।
শিক্ষা ও স্বপ্নভঙ্গ
শিক্ষার ক্ষেত্রে চায়ের রাজ্য থেকে এক-দুজন তরুণ-তরুণী গোবরে পদ্মফুলের মতো বেরিয়ে আসেন। যেহেতু বাগান এলাকায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপনে অনাগ্রহ রয়েছে, তাই বহু প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে উচ্চশিক্ষায় পৌঁছানো প্রায় অসম্ভব কাজ।
উদাহরণস্বরূপÑ
মৌলভীবাজারের কুলাউড়ার ইতি গৌড় দৈনিক পত্রিকার শিরোনাম হয়েছিলেন: “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেলেন ইতি, বরমচাল চা বাগানে তিনিই প্রথম।”
হবিগঞ্জের চুনারুঘাট চা বাগানের শ্রমিকপুত্র সাঞ্জু বাড়াইক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞানের ছাত্র ছিলেন। দুঃখজনকভাবে তিনি জগন্নাথ হলের ছাদ থেকে লাফিয়ে আত্মহত্যা করলে তার মা অনিমা বাড়াইকের স্বপ্ন ভেঙে যায়।
মৌলভীবাজারের কমলি রবিদাস দুঃখ-কষ্ট উপেক্ষা করে সন্তান সন্তোষ রবিদাসকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগ থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জন করিয়েছেন। তাকে ২০১৮ সালে শ্রেষ্ঠ মা নির্বাচিত করা হলেও পরবর্তীতে জানা যায় তিনি চা শ্রমিক। স্টেজে উঠে কথা বলতে পারবেন না বলে তার নাম কেটে দেওয়া হয়েছিল।
শুধুমাত্র শিক্ষার সুযোগের অভাবেই চা জনগোষ্ঠীর প্রজন্মের পর প্রজন্ম কায়িক শ্রমিক হয়ে উঠছে। মাতৃমৃত্যুর হার ও প্রতিরোধযোগ্য রোগে তাদের অকালে ঝরে পড়তে হচ্ছে।
শতবর্ষের বঞ্চনা
চা বাগানগুলোতে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বারবার পরিদর্শন করেছেন। শ্রম সংস্কার কমিশনের প্রধানও সম্প্রতি পরিদর্শন করেছেন।
১৯২১ খ্রিষ্টাব্দের ২০ মে ব্রিটিশ মালিকদের প্রতারণা, বঞ্চনা ও শোষণের বিরুদ্ধে চা শ্রমিকরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে “মুল্লুক চলো”Ñ অর্থাৎ পিতৃভূমিতে ফিরে যাওয়ার ডাক দিয়েছিলেন। বাংলার ভূখ- ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি শোষণ থেকে স্বাধীন হলেও আজ অবধি ৫৫ বছরে চা জনগোষ্ঠীর জীবনে কোনো বড় পরিবর্তন ঘটেনি।
বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের শ্রম উপদেষ্টা হৃদয় থেকে উপলব্ধি করেছেন চা জনগোষ্ঠীর চাওয়া-পাওয়া। সময়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে তাদের ন্যূনতম অধিকারগুলো নিশ্চিত করতে তিনি উদ্যোগ নেবেনÑ এ বিশ্বাস রাখা যায়। কেননা তিনিই প্রথম চা জনগোষ্ঠীকে “দাবি” থেকে “অধিকার” প্রাপ্তির নৈতিক শক্তিতে উন্নীত করেছেন।
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
[লেখক: কলামিস্ট]