alt

মতামত » উপ-সম্পাদকীয়

অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও নির্বাচন

শেখর ভট্টাচার্য

: রোববার, ০২ নভেম্বর ২০২৫
image

সমাজ ও রাজনীতির মধ্যে সকল নাগরিককে অন্তর্ভুক্ত না করে শুধুমাত্র অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনের প্রচেষ্টা জাতীয় জীবনে খুব বড় পরিবর্তন নিয়ে আসতে পারে না

অন্তর্ভূক্তিমূলক নির্বাচন নিয়ে আমাদের গণমাধ্যমগুলো বেশ কিছুদিন থেকে সরগরম। অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ নিয়ে “সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ”-এর মতো গবেষণা সংস্থা এবং কিছু বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা গোলটেবিল বৈঠকসহ নানা গবেষণাকর্ম করে আসছে। অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজের প্রাসঙ্গিকতায় অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতির কথাও এসব সংস্থার গবেষণা এবং আলাপ আলোচনায় উঠে আসছে। একটি কথা মনে রাখতে হবে অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ, রাজনীতি এবং সংস্কৃতি একটি আর একটির পরিপূরক। একটিকে বাদ দিয়ে অন্যটির আলোচনা অসম্পূর্ণ এবং অর্থহীন। এই সামাজিক অবস্থাগুলো অবিভাজ্য, একই সূত্রে গাঁথা। আমাদের রাজনীতিবিদেরা যে অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন নিয়ে অতিমাত্রায় আলোচনা করে থাকেন তা’ শুধু ক্ষমতার মসনদকে লক্ষ্য করে “মেঠো বক্তৃতা”, যেখানে আন্তরিকতার থেকে নিজেদেরকে আদর্শবান প্রমাণ করাটাই মুখ্য। জাতীয়, স্থানীয় বিভিন্ন নির্বাচনের যে চর্চা আমরা স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশ থেকে এ’পর্যন্ত দেখে আসছি এর সাথে রাজনীতিবিদদের অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনের নিবেদিত ইচ্ছা, আগ্রহ এবং বাস্তব অবস্থার সাদৃশ্য পাওয়া বড় কঠিন। এ’কথা দৃঢ়ভাবে বলা যায় স্বাধীনতাপরবর্তী কালে কোন নির্বাচনকে আমরা অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন হিসেবে অভিহিত করতে পারবো না। এক কথায় বলতে গেলে জাতি হিসেবে আমরা এ’পর্যন্ত অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন আয়োজন করতে সফল হতে পারিনি। কেনো পারিনি এর অন্তর্নিহিত কারণ কী?

অন্তর্ভূক্তিমূলক নির্বাচনের ভিত্তিভূমি তৈরি করে দেয় যে দুটি সামজিক অবস্থা সেগুলো হলো অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজব্যবস্থা এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতি। অন্তর্ভূক্তিমূলক নির্বাচনের দৃষ্টিভঙ্গি এবং পথরেখা তৈরি করে অন্তর্ভূক্তিমূলক নির্বাচনকে নিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে সমর্থ হয় অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ ও রাজনীতি। সমাজ ও রাজনীতি যদি অন্তর্ভুক্তিমূলক না হয় তাহলে কোনভাবেই অন্তর্ভূক্তিমূলক নির্বাচন করা সম্ভব নয়, কারণ এ অবস্থাগুলো একটি আর একটির উপর নির্ভরশীল। সমাজ, রাজনীতি এবং সংস্কৃতিতে অন্তর্ভুক্তি সমন্বিত না করে অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন আয়োজন করার প্রচেষ্টা গ্রহণ অনেকটা ঘোড়ার আগে গাড়িকে জুড়ে দেওয়ার মতো। এরকম চেষ্টাকে আরোপিত চেষ্টা বলা যায় যা শুধু মাত্র আনুষ্ঠানিকতা ছাড়া আর কিছুই নয়। ক্ষমতার রাজনীতির প্রতি রাজনৈতিক দলগুলোর দৃষ্টি উন্মীলিত থাকে তাই সমাজ এবং রাজনীতির সংস্কৃতিতে অন্তর্ভুক্তির প্রতি রাজনীতিবিদদের মহৎ নিবেদন লক্ষ্য করা যায় না। ক্ষমতার রাজনীতিকে অনুসরণ করতে গিয়ে আমাদের গণমাধ্যম, রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ সকলেই অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন নিয়ে মশগুল। রাষ্ট্রের এসব গুরুত্বপূর্ণ অংশীজন গণতন্ত্র এবং প্রান্তিক মানুষের ক্ষমতায়নকে রাজনীতিবিদদের লেন্সে দেখতে পছন্দ করেন, দেশপ্রেমিক নাগরিকের দৃষ্টিতে দেখার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন সামজিক স্থিতাবস্থাকে টিকিয়ে রাখার জন্য। ক্ষমতার রাজনীতি আমাদেরকে শ্রেণি, পেশা, প্রান্তিকজন গোষ্ঠীকে অন্তর্ভুক্ত করে এগিয়ে যাওয়ার পথ দেখাতে পারে না বরঞ্চ তাদের মূল স্রোতের বাইরে রেখে এগিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা তৈরি করে। সমতাভিত্তিক সমাজ ও রাষ্ট্রের স্বপ্ন তখন প্রান্তিক মানুষের কাছ থেকে অনেক দূরে চলে যায়। সমাজে বৈষম্য ক্রমাগতভাবে বৃদ্ধি পেতে থাকে। সমাজ ও রাজনীতির মধ্যে সকল নাগরিককে অন্তর্ভুক্ত না করে শুধুমাত্র অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনের প্রচেষ্টা জাতীয় জীবনে খুব বড় পরিবর্তন নিয়ে আসতে পারে না।

অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ হলো একটি দর্শন। এই দর্শনকে রাতারাতি বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। সমাজের ভেতরের ইতিবাচক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার ফলাফল হিসেবে রাজনীতিতে সকল নাগরিকের প্রতি সমদৃষ্টি আনয়ন সম্ভব হয়। সমদৃষ্টি, সমতার সমাজের প্রতি নাগরিকদের স্বতঃস্ফুর্ত দাবি রাজনীতিতে অন্তর্ভূক্তিমূলক দৃষ্টিভঙ্গির জন্ম দেয়। আর একটি বিষয় মনে রাখতে হবে অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন হলো ফলাফল এর এই ফলাফল পেতে হলে আমাদের অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ এবং রাজনৈতিক সংস্কৃতি চর্চার ভেতর দিয়ে যেতে হবে। সমাজ চাহিদা তৈরি করে অর্থাৎ সমাজ হলো ডিমান্ড বা চাহিদার দিক আর রাজনীতি হলো সাপ্লাই বা সরবরাহের দিক। সামাজিক চাহিদার বিপরীতে অন্তর্মূলক চর্চা নিশ্চিত করে নির্বাচনকে অন্তর্ভূক্তিমূলক করে তুলতে সক্ষম হয় রাজনৈতিক সংস্কৃতি। ভাবলে অবাক হতে হয়, রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে অন্তর্ভুক্তির উপাদান যুক্ত না করে রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা কীকরে পরিশুদ্ধ, অন্তর্ভূক্তিমূলক নির্বাচন প্রত্যাশা করে থাকেন।

অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ বলতে আমরা কী বুঝি? খুব সহজভাবে বললে, অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ হলো এমন একটি সমাজ যে সমাজে প্রতিটি নাগরিকের দৃষ্টিভঙ্গি, মতামতকে সমান ভাবে মূল্যায়ন করা হয়। জাতি, ধর্ম, শ্রেণি, লিঙ্গ, পেশা, সংস্কৃতি নির্বিশেষে সকল নাগরিক সমান অধিকার, সুযোগ এবং মর্যাদার অধিকারী হিসেবে গণ্য হয়। বৈষম্য, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বিভাজন থেকে মুক্ত থেকে সবাইকে সমান সুযোগ দেয়া হয়। এটি সামাজিক ন্যায়বিচার, স্বাধীনতা ও মতপ্রকাশের অধিকার নিশ্চিত করে এবং পিছিয়ে পড়া জনগণের জন্য বিশেষ সহায়তা প্রদান করে। অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠন প্রক্রিয়ায় সমান সুযোগ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কর্মসংস্থানে মনোযোগ দেওয়াকে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করা হয়। অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠন করতে হলে সামাজিক বৈচিত্র্যকে সৌন্দর্য হিসেবে গ্রহণ করতে হয়; বৈচিত্র্যর সৌন্দর্য যে সমাজকে সমৃদ্ধ করে তুলে সেই ধারণাকে অন্তর থেকে ধারণ করতে হয়।অন্তর্ভুক্তির ধারণায় প্রতিটি মানুষের নিজস্ব অভিজ্ঞতা, মূল্যবোধ এবং দৃষ্টিভঙ্গি যা সমাজকে সমৃদ্ধ করে এ’ বিষয়টিকে বিশ্বাস করার সামাজিক সংস্কৃতি তৈরি করার প্রচেষ্টা করা হয়। প্রতিটি মানুষ অসীম ক্ষমতার অধিকারী, সকল সামাজিক পরবর্তনের মূল শক্তি এই মনোবৃত্তিকে সমাজে গভীর ভাবে প্রোথিত করতে না পারলে অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠন করা কোন ভাবেই সম্ভব হবেনা।মনে রাখতে হবে সমাজ অন্তর্ভুক্তিমূলক না হলে রাজনৈতিক প্রক্রিয়া, শাসনকার্য, সহ সকল রাষ্ট্রীয় কর্মকান্ডে নাগরিকদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ মূল স্রোতের বাইরে চলে যাবে এটি অবশ্যম্ভাবী।

অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ ও রাজনীতির মধ্যে সম্পর্ক গভীর ও অবিচ্ছেদ্য।অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠনের জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতি অপরিহার্য, কারণ অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতি সমাজে সমতা, সুযোগ ও অংশগ্রহণের নিশ্চয়তা দিয়ে থাকে।সামাজিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক প্রক্রিয়ায় এই যে সকল নাগরিকের অবাধ অংশগ্রহণ এবং সকলের প্রতি সকলের প্রবল সম্মানবোধ তা হলো অন্তর্ভূক্তিমূলক প্রক্রিয়ার সৌন্দর্য। এই প্রক্রিয়া রাজনৈতিক, সামজিক কিংবা সাংস্কৃতিক হতে পারে। আমরা যে গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকিকরনের কথা বলি, সে প্রাতিষ্ঠানিকরন সম্ভব হবে যদি সকল নাগরিকের ভিন্ন মত, ভিন্ন পথের সমন্বয় সম্ভব হয়। রাজনীতি এবং সমাজে সকল শ্রেণি, পেশার মানুষ অন্তর্ভুক্ত না হলে সমতা, নায্যতা, সমদৃষ্টির ধারণা স্বপ্ন হয়ে থেকে যাবে। যা রাষ্ট্র জনগণকে নায্যতা, সমতার অধিকারকে কোন ভাবে উপলব্ধির পর্যায়ে নিয়ে যেতে সমর্থ হবে না।

যে কথাটি পূর্বে উল্লেখ করেছি অন্তর্ভুক্তি মূলক সমাজ হলো একটি সামজিক দর্শন। যে দর্শন প্রগতিশীল সমাজ দ্বারা নির্মিত হয়ে থাকে। রাজনৈতিক মতাদর্শ, ধর্ম, ভাষা ও সংস্কৃতিকে সম্মান জানিয়ে এই দর্শন তৈরি করতে হয়। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্র কাঠামো গড়ে তোলা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দারিদ্র্য বিমোচন, বৈষম্য দূরীকরণ, নারীর ক্ষমতায়ন, টেকসই উন্নয়ন ও গণতন্ত্রের পথকে সুদৃঢ় করতে পারে শুধুমাত্র অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ। সমাজ যখন অন্তর্ভুক্তি মূলক হয় তখন এর ফলাফল হিসেবে বৈষম্য, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বিভাজন দূর হয়ে সকল নাগরিককে সমান সুযোগ দেওয়ার সংস্কৃতি গড়ে ওঠে।

ফিরে আসি বহুল আলোচিত অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনের সফল বাস্তবায়নের আলোচনায়। অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনের লক্ষ্য হলো বৈষম্যহীন, সমতার, সমদৃষ্টির সমাজ প্রতিষ্ঠা করার প্রক্রিয়াকে বেগবান করে তোলা। লেখাটির অবতারণা এই কারণে আমাদের দুরবর্তী স্বপ্নের দরোজা দিয়ে আলো ফেলতে হলে সমাজ ও রাজনীতিকে অন্তর্ভুক্তিমূলক করে তোলা যে জরুরী এ’কথাটির গুরুত্ব উপস্থাপনা করা। সামজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক আন্দোলন হলো একটি প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ার ভিত্তিকে শক্তিশালী করে গড়ে তুলতে না পারলে বৈষম্যহীন সমাজ গড়ার শত বছরের স্বপ্ন যে সফল হবেনা এ’কতাহটি বলাই যায়। সময় হয়েছে অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের পূর্বে সমাজ, রাজনীতি, সংস্কৃতিক্যা সকলের অংশ গ্রহণের মাধ্যমে বৈচিত্র্যের সৌন্দর্য গড়ে তোলা। যে সৌন্দর্যের মধ্যে সকল নাগরিকের আশা, আকাক্সক্ষা, মতামতের প্রতিফলন থাকবে।খন্ডাকারে বা পিস মিল আকারে ভাবনা হলো সনাতনী ভাবনা যে ভাবনা স্থিতাবস্তাকে বজায় রাখতে সহায়তা করে। আমরা কী কল্যাণ বিমুখ স্থিতাবস্থাকে বয়ে নিয়ে যেতে চাই। সে কথাটি গভীর ভাবে ভাবতে এবং বিশ্লেষণ করতে হবে।

[লেখক: প্রাবন্ধিক ও উন্নয়ন গবেষক]

পিএইচডি: উচ্চ শিক্ষার মানদণ্ড না প্রতীকী মরীচিকা?

ডিম নয় তবু অশ্বডিম্ব!

পিএইচডি: উচ্চ শিক্ষার মানদণ্ড না প্রতীকী মরীচিকা?

প্রকৃতার্থে ফকির কারা

এনসিপি চায় অবিনাশী জুলাই সনদ

পিএইচডি: উচ্চ শিক্ষার মানদণ্ড না প্রতীকী মরীচিকা?

আলুর প্রাচুর্যে কৃষকের সংকট

তাহলে কী ‘কোটা’ই জয়যুক্ত হবে!

ব্যাংকিং খাতে বিষফোঁড়া: বাংলাদেশের অর্থনীতির ধমনী বিষাক্ত হয়ে উঠছে

ছবি

ঢাকার নদী ও খালের দখল-দূষণ: পুনরুদ্ধার কোন পথে

জমি কী মূলে রেকর্ড হয়েছে, দলিল মূলে না উত্তরাধিকার মূলে?

কার্বন-নিরপেক্ষ শিশুর অনুপ্রেরণায় দেশ

এবার আমরা সভ্য হলাম!

সোনার প্রাসাদের দেয়ালে ঘামের দাগ

নিরাপদ সড়ক চাই কিন্তু কার্যকর উদ্যোগ কোথায়?

অবহেলিত শিক্ষার দুর্দশা বাড়ছে

টেকসই উন্নয়নের পূর্বশর্ত নিরাপদ সড়ক

বাংলার সংস্কৃতি কি মূলধারা হারিয়ে ফেলবে?

ছবি

সমদৃষ্টি, বহুত্ববাদী সমাজ এবং সহিষ্ণুতা

খাদ্য অপচয় : ক্ষুধার্ত পৃথিবীর এক নিঃশব্দ ট্র্যাজেডি

টেকসই বাংলাদেশ গঠনে পরিবেশ সংস্কার কেন অপরিহার্য

সে এক রূপকথারই দেশ

উপকূলের খাদ্যসংকট নিয়ে ভাবছেন কি নীতিনির্ধারকেরা?

মানসিক স্বাস্থ্য: মানবাধিকারের নতুন চ্যালেঞ্জ

ঢাকার যানজট ও বিকেন্দ্রীকরণ

নির্বাচনী মাঠে জামায়াতী হেকমত

শিক্ষা ব্যবস্থায় গভীর বৈষম্য ও জাতির অগ্রযাত্রাধ

উপমহাদেশে সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন, বাস্তবতা ও চ্যালেঞ্জ

এইচএসসি ফল: সংখ্যার খেল না কি শিক্ষার বাস্তব চিত্র?

বিনা ভোট, নিশি ভোট, ডামি ভোটের পরে এবার নাকি গণভোট!

কমরেড ইলা মিত্রের শততম জন্মজয়ন্তী

কত মৃত্যু হলে জাগবে বিবেক?

বৈষম্যের বিবিধ মুখ

মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষায় জরুরি আইনি সহায়তা

গাজা : এখন শান্তি রক্ষা করবে কে?

দোসর, বাই ডিফল্ট!

tab

মতামত » উপ-সম্পাদকীয়

অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও নির্বাচন

শেখর ভট্টাচার্য

image

সমাজ ও রাজনীতির মধ্যে সকল নাগরিককে অন্তর্ভুক্ত না করে শুধুমাত্র অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনের প্রচেষ্টা জাতীয় জীবনে খুব বড় পরিবর্তন নিয়ে আসতে পারে না

রোববার, ০২ নভেম্বর ২০২৫

অন্তর্ভূক্তিমূলক নির্বাচন নিয়ে আমাদের গণমাধ্যমগুলো বেশ কিছুদিন থেকে সরগরম। অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ নিয়ে “সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ”-এর মতো গবেষণা সংস্থা এবং কিছু বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা গোলটেবিল বৈঠকসহ নানা গবেষণাকর্ম করে আসছে। অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজের প্রাসঙ্গিকতায় অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতির কথাও এসব সংস্থার গবেষণা এবং আলাপ আলোচনায় উঠে আসছে। একটি কথা মনে রাখতে হবে অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ, রাজনীতি এবং সংস্কৃতি একটি আর একটির পরিপূরক। একটিকে বাদ দিয়ে অন্যটির আলোচনা অসম্পূর্ণ এবং অর্থহীন। এই সামাজিক অবস্থাগুলো অবিভাজ্য, একই সূত্রে গাঁথা। আমাদের রাজনীতিবিদেরা যে অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন নিয়ে অতিমাত্রায় আলোচনা করে থাকেন তা’ শুধু ক্ষমতার মসনদকে লক্ষ্য করে “মেঠো বক্তৃতা”, যেখানে আন্তরিকতার থেকে নিজেদেরকে আদর্শবান প্রমাণ করাটাই মুখ্য। জাতীয়, স্থানীয় বিভিন্ন নির্বাচনের যে চর্চা আমরা স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশ থেকে এ’পর্যন্ত দেখে আসছি এর সাথে রাজনীতিবিদদের অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনের নিবেদিত ইচ্ছা, আগ্রহ এবং বাস্তব অবস্থার সাদৃশ্য পাওয়া বড় কঠিন। এ’কথা দৃঢ়ভাবে বলা যায় স্বাধীনতাপরবর্তী কালে কোন নির্বাচনকে আমরা অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন হিসেবে অভিহিত করতে পারবো না। এক কথায় বলতে গেলে জাতি হিসেবে আমরা এ’পর্যন্ত অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন আয়োজন করতে সফল হতে পারিনি। কেনো পারিনি এর অন্তর্নিহিত কারণ কী?

অন্তর্ভূক্তিমূলক নির্বাচনের ভিত্তিভূমি তৈরি করে দেয় যে দুটি সামজিক অবস্থা সেগুলো হলো অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজব্যবস্থা এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতি। অন্তর্ভূক্তিমূলক নির্বাচনের দৃষ্টিভঙ্গি এবং পথরেখা তৈরি করে অন্তর্ভূক্তিমূলক নির্বাচনকে নিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে সমর্থ হয় অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ ও রাজনীতি। সমাজ ও রাজনীতি যদি অন্তর্ভুক্তিমূলক না হয় তাহলে কোনভাবেই অন্তর্ভূক্তিমূলক নির্বাচন করা সম্ভব নয়, কারণ এ অবস্থাগুলো একটি আর একটির উপর নির্ভরশীল। সমাজ, রাজনীতি এবং সংস্কৃতিতে অন্তর্ভুক্তি সমন্বিত না করে অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন আয়োজন করার প্রচেষ্টা গ্রহণ অনেকটা ঘোড়ার আগে গাড়িকে জুড়ে দেওয়ার মতো। এরকম চেষ্টাকে আরোপিত চেষ্টা বলা যায় যা শুধু মাত্র আনুষ্ঠানিকতা ছাড়া আর কিছুই নয়। ক্ষমতার রাজনীতির প্রতি রাজনৈতিক দলগুলোর দৃষ্টি উন্মীলিত থাকে তাই সমাজ এবং রাজনীতির সংস্কৃতিতে অন্তর্ভুক্তির প্রতি রাজনীতিবিদদের মহৎ নিবেদন লক্ষ্য করা যায় না। ক্ষমতার রাজনীতিকে অনুসরণ করতে গিয়ে আমাদের গণমাধ্যম, রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ সকলেই অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন নিয়ে মশগুল। রাষ্ট্রের এসব গুরুত্বপূর্ণ অংশীজন গণতন্ত্র এবং প্রান্তিক মানুষের ক্ষমতায়নকে রাজনীতিবিদদের লেন্সে দেখতে পছন্দ করেন, দেশপ্রেমিক নাগরিকের দৃষ্টিতে দেখার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন সামজিক স্থিতাবস্থাকে টিকিয়ে রাখার জন্য। ক্ষমতার রাজনীতি আমাদেরকে শ্রেণি, পেশা, প্রান্তিকজন গোষ্ঠীকে অন্তর্ভুক্ত করে এগিয়ে যাওয়ার পথ দেখাতে পারে না বরঞ্চ তাদের মূল স্রোতের বাইরে রেখে এগিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা তৈরি করে। সমতাভিত্তিক সমাজ ও রাষ্ট্রের স্বপ্ন তখন প্রান্তিক মানুষের কাছ থেকে অনেক দূরে চলে যায়। সমাজে বৈষম্য ক্রমাগতভাবে বৃদ্ধি পেতে থাকে। সমাজ ও রাজনীতির মধ্যে সকল নাগরিককে অন্তর্ভুক্ত না করে শুধুমাত্র অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনের প্রচেষ্টা জাতীয় জীবনে খুব বড় পরিবর্তন নিয়ে আসতে পারে না।

অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ হলো একটি দর্শন। এই দর্শনকে রাতারাতি বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। সমাজের ভেতরের ইতিবাচক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার ফলাফল হিসেবে রাজনীতিতে সকল নাগরিকের প্রতি সমদৃষ্টি আনয়ন সম্ভব হয়। সমদৃষ্টি, সমতার সমাজের প্রতি নাগরিকদের স্বতঃস্ফুর্ত দাবি রাজনীতিতে অন্তর্ভূক্তিমূলক দৃষ্টিভঙ্গির জন্ম দেয়। আর একটি বিষয় মনে রাখতে হবে অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন হলো ফলাফল এর এই ফলাফল পেতে হলে আমাদের অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ এবং রাজনৈতিক সংস্কৃতি চর্চার ভেতর দিয়ে যেতে হবে। সমাজ চাহিদা তৈরি করে অর্থাৎ সমাজ হলো ডিমান্ড বা চাহিদার দিক আর রাজনীতি হলো সাপ্লাই বা সরবরাহের দিক। সামাজিক চাহিদার বিপরীতে অন্তর্মূলক চর্চা নিশ্চিত করে নির্বাচনকে অন্তর্ভূক্তিমূলক করে তুলতে সক্ষম হয় রাজনৈতিক সংস্কৃতি। ভাবলে অবাক হতে হয়, রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে অন্তর্ভুক্তির উপাদান যুক্ত না করে রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা কীকরে পরিশুদ্ধ, অন্তর্ভূক্তিমূলক নির্বাচন প্রত্যাশা করে থাকেন।

অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ বলতে আমরা কী বুঝি? খুব সহজভাবে বললে, অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ হলো এমন একটি সমাজ যে সমাজে প্রতিটি নাগরিকের দৃষ্টিভঙ্গি, মতামতকে সমান ভাবে মূল্যায়ন করা হয়। জাতি, ধর্ম, শ্রেণি, লিঙ্গ, পেশা, সংস্কৃতি নির্বিশেষে সকল নাগরিক সমান অধিকার, সুযোগ এবং মর্যাদার অধিকারী হিসেবে গণ্য হয়। বৈষম্য, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বিভাজন থেকে মুক্ত থেকে সবাইকে সমান সুযোগ দেয়া হয়। এটি সামাজিক ন্যায়বিচার, স্বাধীনতা ও মতপ্রকাশের অধিকার নিশ্চিত করে এবং পিছিয়ে পড়া জনগণের জন্য বিশেষ সহায়তা প্রদান করে। অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠন প্রক্রিয়ায় সমান সুযোগ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কর্মসংস্থানে মনোযোগ দেওয়াকে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করা হয়। অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠন করতে হলে সামাজিক বৈচিত্র্যকে সৌন্দর্য হিসেবে গ্রহণ করতে হয়; বৈচিত্র্যর সৌন্দর্য যে সমাজকে সমৃদ্ধ করে তুলে সেই ধারণাকে অন্তর থেকে ধারণ করতে হয়।অন্তর্ভুক্তির ধারণায় প্রতিটি মানুষের নিজস্ব অভিজ্ঞতা, মূল্যবোধ এবং দৃষ্টিভঙ্গি যা সমাজকে সমৃদ্ধ করে এ’ বিষয়টিকে বিশ্বাস করার সামাজিক সংস্কৃতি তৈরি করার প্রচেষ্টা করা হয়। প্রতিটি মানুষ অসীম ক্ষমতার অধিকারী, সকল সামাজিক পরবর্তনের মূল শক্তি এই মনোবৃত্তিকে সমাজে গভীর ভাবে প্রোথিত করতে না পারলে অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠন করা কোন ভাবেই সম্ভব হবেনা।মনে রাখতে হবে সমাজ অন্তর্ভুক্তিমূলক না হলে রাজনৈতিক প্রক্রিয়া, শাসনকার্য, সহ সকল রাষ্ট্রীয় কর্মকান্ডে নাগরিকদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ মূল স্রোতের বাইরে চলে যাবে এটি অবশ্যম্ভাবী।

অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ ও রাজনীতির মধ্যে সম্পর্ক গভীর ও অবিচ্ছেদ্য।অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠনের জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতি অপরিহার্য, কারণ অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতি সমাজে সমতা, সুযোগ ও অংশগ্রহণের নিশ্চয়তা দিয়ে থাকে।সামাজিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক প্রক্রিয়ায় এই যে সকল নাগরিকের অবাধ অংশগ্রহণ এবং সকলের প্রতি সকলের প্রবল সম্মানবোধ তা হলো অন্তর্ভূক্তিমূলক প্রক্রিয়ার সৌন্দর্য। এই প্রক্রিয়া রাজনৈতিক, সামজিক কিংবা সাংস্কৃতিক হতে পারে। আমরা যে গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকিকরনের কথা বলি, সে প্রাতিষ্ঠানিকরন সম্ভব হবে যদি সকল নাগরিকের ভিন্ন মত, ভিন্ন পথের সমন্বয় সম্ভব হয়। রাজনীতি এবং সমাজে সকল শ্রেণি, পেশার মানুষ অন্তর্ভুক্ত না হলে সমতা, নায্যতা, সমদৃষ্টির ধারণা স্বপ্ন হয়ে থেকে যাবে। যা রাষ্ট্র জনগণকে নায্যতা, সমতার অধিকারকে কোন ভাবে উপলব্ধির পর্যায়ে নিয়ে যেতে সমর্থ হবে না।

যে কথাটি পূর্বে উল্লেখ করেছি অন্তর্ভুক্তি মূলক সমাজ হলো একটি সামজিক দর্শন। যে দর্শন প্রগতিশীল সমাজ দ্বারা নির্মিত হয়ে থাকে। রাজনৈতিক মতাদর্শ, ধর্ম, ভাষা ও সংস্কৃতিকে সম্মান জানিয়ে এই দর্শন তৈরি করতে হয়। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্র কাঠামো গড়ে তোলা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দারিদ্র্য বিমোচন, বৈষম্য দূরীকরণ, নারীর ক্ষমতায়ন, টেকসই উন্নয়ন ও গণতন্ত্রের পথকে সুদৃঢ় করতে পারে শুধুমাত্র অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ। সমাজ যখন অন্তর্ভুক্তি মূলক হয় তখন এর ফলাফল হিসেবে বৈষম্য, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বিভাজন দূর হয়ে সকল নাগরিককে সমান সুযোগ দেওয়ার সংস্কৃতি গড়ে ওঠে।

ফিরে আসি বহুল আলোচিত অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনের সফল বাস্তবায়নের আলোচনায়। অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনের লক্ষ্য হলো বৈষম্যহীন, সমতার, সমদৃষ্টির সমাজ প্রতিষ্ঠা করার প্রক্রিয়াকে বেগবান করে তোলা। লেখাটির অবতারণা এই কারণে আমাদের দুরবর্তী স্বপ্নের দরোজা দিয়ে আলো ফেলতে হলে সমাজ ও রাজনীতিকে অন্তর্ভুক্তিমূলক করে তোলা যে জরুরী এ’কথাটির গুরুত্ব উপস্থাপনা করা। সামজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক আন্দোলন হলো একটি প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ার ভিত্তিকে শক্তিশালী করে গড়ে তুলতে না পারলে বৈষম্যহীন সমাজ গড়ার শত বছরের স্বপ্ন যে সফল হবেনা এ’কতাহটি বলাই যায়। সময় হয়েছে অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের পূর্বে সমাজ, রাজনীতি, সংস্কৃতিক্যা সকলের অংশ গ্রহণের মাধ্যমে বৈচিত্র্যের সৌন্দর্য গড়ে তোলা। যে সৌন্দর্যের মধ্যে সকল নাগরিকের আশা, আকাক্সক্ষা, মতামতের প্রতিফলন থাকবে।খন্ডাকারে বা পিস মিল আকারে ভাবনা হলো সনাতনী ভাবনা যে ভাবনা স্থিতাবস্তাকে বজায় রাখতে সহায়তা করে। আমরা কী কল্যাণ বিমুখ স্থিতাবস্থাকে বয়ে নিয়ে যেতে চাই। সে কথাটি গভীর ভাবে ভাবতে এবং বিশ্লেষণ করতে হবে।

[লেখক: প্রাবন্ধিক ও উন্নয়ন গবেষক]

back to top