alt

মতামত » উপ-সম্পাদকীয়

ডিম নয় তবু অশ্বডিম্ব!

আনোয়ারুল হক

: রোববার, ০২ নভেম্বর ২০২৫

কিশোর কুমার, মালা সিনহা অভিনীত সেই ১৯৫৮ সালের ছায়াছবি ‘লুকোচুরি’ হয়তো আমাদের অনেকেরই দেখা হয়নি। তবে কিশোর কুমারের কন্ঠে ঐ ছবির গান “শিং নেই তবু নাম তার সিংহ/ ডিম নয় তবু অশ্বডিম্ব ...” আমরা অনেকেই শুনেছি। জুলাই সনদ ঘোষণা স্বাক্ষর অনুষ্ঠান এবং সবশেষে সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশ সরকারের কাছে পেশ করার পরে গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে রাজনৈতিক দল ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতামত শুনে যেমন ছায়াছবির ‘লুকোচুরি’ নামটি তেমনি কিশোর কুমারের গানের লাইন দুটি কেন জানি বার বার কানে বাজছে।

জনসাধারণের একাংশের প্রতিনিধিত্বকারী কয়েকটি রাজনৈতিক দলকে অন্তর্ভুক্ত না করেও ৩০টি দলের নেতাদের সঙ্গে দীর্ঘ নয় মাস ধরে আলোচনা করে যেসব বিষয়ে ঐকমত্য তৈরি হয়েছিল কমিশন তার সুপারিশে যেন সেই ঐক্যই ভেঙে দিলো। একটি অনির্বাচিত অন্তর্বর্তী সরকার দ্রুত জনগণের প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের লক্ষ্যে জাতীয় নির্বাচন না দিয়ে সংস্কারের নামে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করে প্রায় বছর পার করলেন ‘সংবিধান রচনা’ করতে বসে। রাজনৈতিক দলগুলোও সেই ফাঁদে ধরা দিয়ে এখন বলছে ‘লুকোচুরি’ করা হয়েছে। আর পার্লামেন্টে আলোচনা না করে সংবিধানের মূলনীতি সংশোধন বা পরিবর্তনের বিরোধিতা করে সিপিবিসহ চার বামপন্থী দল তো লুকোচুরির সনদে স্বাক্ষরই করেনি।

সব থেকে মারাত্মক অভিযোগ করেছেন বিএনপির মহাসচিব মীর্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেছেন, ‘এটা জনগণের সঙ্গে এবং রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্য কমিশনের একটা প্রতারণা’। তিনি আরো বলেছেন, ‘জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি দেয়ার অধিকার প্রধান উপদেষ্টা বা অন্তর্বর্তী সরকারের নেই। বিশ্বাসভঙ্গ ও প্রতারণা করে আমাদের অগোচরে জুলাই সনদের স্বাক্ষরিত কপি বদলে ফেলা হয়েছে। যা আলোচনা হয়েছে তা সুপারিশে নাই।’ বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, ‘শেষ পর্যন্ত রেফারিই গোল দিয়ে দিয়ে দিলেন।’ তবে মূল কথা বলেছেন বিএনপির নির্বাহী কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট আহমেদ আযম খান। তিনি সংবিধান ও আইন ব্যাখ্যা করে বলেছেন, “সামনে একটাই এজেন্ডা ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এছাড়া আর কোনো এজেন্ডা নেই। জাতীয় নির্বাচনের পর আমরা গণভোটের চিন্তা করব। এর আগে যারা গণভোট চায়, তারা দেশকে অস্থিতিশীল করতে চায়। তারা নির্বাচনকে বিলম্বিত করতে চায়।” আহমেদ আযম খানের বক্তব্যে যদি বিএনপি প্রথম থেকেই স্থির থাকতো তবে আজ এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হতো না।

শুধু বিএনপিই নয়, অন্যান্য রাজনৈতিক দলও তীব্র প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেছে। অন্তর্বর্তী সরকার প্রতারকের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে গেছে বলে মন্তব্য করেছেন নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না। গণসংহতি বলেছে, নির্বাচিত সংসদের কর্তৃত্ব খর্ব করে অন্তর্বর্তী সরকারের জারিকৃত আদেশেই সংবিধান সংস্কার করা হলে সেটা টেকসই হবে না এবং সংসদকে রাবার স্ট্যাম্পে পরিণত করা হবে। অর্থাৎ এনসিপি এবং জামায়াত ও তার মিত্ররা ছাড়া কেউই সরকার ও ঐকমত্য কমিশনের এই লুকোচুরি মেনে নিচ্ছে না।

জামায়াত কী বলছে? তারা সরকারকে নির্দেশ দিয়ে বলেছেন, আজ রাতের (অর্থাৎ ৩০ অক্টোবর বৃহস্পতিবার) মধ্যেই গণভোটের তারিখ ঘোষণা করুন। তাদের সরকারে, প্রশাসনে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ অংশীদারিত্ব আছে, তাই এ ভাষায় বলতেই পারেন। আর এনসিপি নেতা হাসনাত আব্দুল্লাহ ও নাসিরুদ্দিন পাটওয়ারী বিএনপিকে উদ্দেশ্য করে আগের মতোই ঔদ্ধত্তপূর্ণ সুরে বলছেন, ‘কাবিনে যেহেতু স্বাক্ষর করেছেন, সংসারও করতে হবে। তা না হলে ডিভোর্স দিতে হবে।’ কাবিনে স্বাক্ষর করা এবং ডিভোর্স করা তো আইনসম্মত পন্থা। কিন্তু পাটোয়ারী ও হাসনাতদের দল যে কাবিনে স্বাক্ষর না করে ‘লিভ টুগেদার’ করছেন, সেটা কী ভব্যতা হলো! পাটোয়ারী আরো বলেছেন, বিএনপির হ্যাঁ ভোটে জন্ম হয়েছে, মৃত্যু হবে না ভোটে। পাটোয়ারী এত অল্প সময়ে ভুলে গেলেন, শেখ হাসিনাও কিন্তু ভোটের রাজনীতির মাঠ থেকে বিএনপিকে ‘না’ বা বিদায় করে পরে নিজেই বিদায় নেন।

এ দিকে কোনো রাজনৈতিক দল যা বলেনি, সরকারি সূত্রসমূহও কোনো ইঙ্গিত দেয়নি তারপরেও এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু ভয়ানক জটিল পরিস্থিতির আশঙ্কা করে বললেন ঐকমত্যে পৌঁছাতে ব্যর্থ হলে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসকে পদত্যাগ করে চলে যেতে হতে পারে এবং নির্বাচন অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। মঞ্জু এটা নিজে বললেন, না তাকে দিয়ে বলানো হলো এটা একটা বিরাট প্রশ্ন। আবার কি সেই ‘আভি না যাও ছোড়কে’ নাটক মঞ্চস্থ করার আয়োজন হচ্ছে?

বিএনপি আজ নিজের রাজনৈতিক দূর্বলতার জন্য ফাটা বাঁশে আটকা পড়েছে। ৫ আগস্টের পরে দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল হিসেবে যে ভূমিকা নেয়ার ছিলো তা কি তারা নিয়েছেন বা নিতে পেরেছেন? উগ্রবাদী, জঙ্গিবাদী শক্তি এবং বাংলাদেশের জন্মযুদ্ধের বিরোধিতাকারী রাজনৈতিক শক্তিসমূহ শেখ হাসিনার সরকার পতনের সাথে সাথে যখন ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর, মন্দির, মাজার ইত্যাদির উপর হামলা করলো, আওয়ামী বিরোধীতা আর বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের লেবাসে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি চিহ্নগুলো গুড়িয়ে দিতে লাগলো, ঘোষণা দিয়ে দুই রাত দুই দিন ধরে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত শেখ মুজিবের ৩২ নং- ধানমন্ডির ঐতিহাসিক বাড়িটি সরকারি বাহিনীর উপস্থিতিতে ভেঙ্গে ফেললো - তখন যেমন শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ড. ইউনূস নেতৃত্বাধীন সরকার এসব কাজ করার সুযোগ দিয়ে পরে দায়সারা একটি বিবৃতি দিয়ে দায়িত্ব সম্পন্ন করলেন, বিএনপির প্রতিবাদও ঠিক তেমনটি বা তার কাছাকাছি ছিলো। বিএনপি নেতৃত্বের কি উচিত ছিলো না দুহাত প্রসারিত করে রাজপথে দাঁড়িয়ে বলা যথেষ্ট হয়েছে, এনাফ ইজ এনাফ- স্বৈরাচারমুক্ত দেশে আর প্রতিহিংসার রাজনীতি চলতে দেওয়া হবে না, সকল অপরাধের এবং সকল অপরাধীর বিচার আইন সম্মতভাবে হবে। জুলাই আন্দোলনকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের বিপরীতে দাঁড় করানোর ‘কৌশলী’ প্রচেষ্টা বিএনপি রুখে দাঁড়াবে। বিএনপি এ ঘোষণা দিয়ে মাঠে নামলে দলমত নির্বিশেষে দেশের অসাম্প্রদায়িক, মুক্তমনা, উদার গণতন্ত্রী মানুষ এবং সীমিত শক্তির হলেও সংগঠিত বাম প্রগতিশীল শক্তি সে কাফেলায় শামিল হতো।

বিএনপি তা না করায় নাটাই কিন্তু প্রথমেই উগ্রবাদী শক্তির হাতে চলে যায়। বছর ঘুরে যাওয়ার পরে বিএনপিকে আক্ষেপ করে বলতে হলো দেশে উগ্র দক্ষিণপন্থার উত্থান হয়েছে। আবার যখন ঐকমত্য কমিশন গঠন হলো এবং ‘সিং নাই তবু সিংহ’দের ঐ কমিশনের ও সংস্কারের দায়িত্ব দেওয়া হলো তখনতো প্রথম দিনেই বিএনপির বলে দেওয়া উচিত ছিলো সংবিধানে হাত না দিয়ে যত খুশি সংস্কার করেন। সংবিধানের ওপরে কোনো কিছুকে প্রাধান্য দেয়া রাজনৈতিক, আইনগত এবং সবদিক থেকেই রাষ্ট্র কাঠামোকে দুর্বল করার একটি অপপ্রয়াস। বিএনপি তা হতে দেবে না। সাংবিধানিক সংস্কার যা প্রয়োজন তা অবাধ, নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত জাতীয় সংসদ সংবিধান সম্মতভাবে করবে। দু’এক মাসের মধ্যে ‘সিংহের’ কাজ শেষ করে দেশকে জাতীয় নির্বাচনের পথে নিয়ে যেতে হবে।

দুই দুইবার রাষ্ট্র ক্ষমতায় যাওয়া এবং বিগত তিনটি ভোট যদি নিরপেক্ষ ব্যবস্থায় ও অংশগ্রহণমূলক হতো আরো দু’একবার বিএনপি রাষ্ট্র ক্ষমতায় যেতো - সেই দল কেনো সাহসী ভূমিকা নিতে পারলো না সেটা একটা বিষ্ময়ও বটে। উগ্র দক্ষিণ পন্থার প্রতিনিধিত্বকারীরা ছাড়া অন্যরা সরাসরি কথা না বলে সবাই কেমন যেন ইনিয়ে বিনিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কথা বলতেন। ঐকমত্য কমিশনে সিপিবি নেতা রুহিন হোসেন প্রিন্সসহ ২-৪ জন ছাড়া সরাসরি দলের কথা, মনের কথা বলার সাহসিকতা দেখলাম না। বিএনপি যে ভূমিকা রেখেছে আজ তার পরিণতি বিএনপিকে তো শুধু নয় গোটা দেশকে বহন করতে হচ্ছে। বিএনপি-জামায়াত-এনসিপির মধ্যকার সৃষ্ট বিরোধ সামাল দিতে সরকারের তরফ থেকে পর্দার আড়ালে সমঝোতার উদ্যোগ নেওয়ার পরে বিএনপি বলছে, “ যা হওয়ার হয়ে গেছে। আপনারা দয়া করে ওই সমস্যাগুলো সমাধান করেন”- মীর্জা ফখরুলের এসব ‘দয়া ভিক্ষা মার্কা’ কথায় কোনো কাজ হবে না। বিএনপির এখন সরাসরি বলে দেওয়া উচিত সংসদকে কিছু করতে বাধ্য করা যায় না। সাংবিধানিক সংস্কার প্রস্তাব জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরে পার্লামেন্টের সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে সাংবিধানিক গণভোটে দেওয়া হবে। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করুন। বিএনপি কি সেই হিম্মত দেখাতে পারবে? না পারলে ঐ ‘লুকোচুরি’র ফাঁদে পড়ে শুধু গান গেয়ে যেতে হবে “শিং নেই তবু নাম তার সিংহ/ ডিম নয় তবু অশ্বডিম্ব ......”।

(মতামত লেখকের নিজস্ব)

[লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা]

পিএইচডি: উচ্চ শিক্ষার মানদণ্ড না প্রতীকী মরীচিকা?

ছবি

অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও নির্বাচন

পিএইচডি: উচ্চ শিক্ষার মানদণ্ড না প্রতীকী মরীচিকা?

প্রকৃতার্থে ফকির কারা

এনসিপি চায় অবিনাশী জুলাই সনদ

পিএইচডি: উচ্চ শিক্ষার মানদণ্ড না প্রতীকী মরীচিকা?

আলুর প্রাচুর্যে কৃষকের সংকট

তাহলে কী ‘কোটা’ই জয়যুক্ত হবে!

ব্যাংকিং খাতে বিষফোঁড়া: বাংলাদেশের অর্থনীতির ধমনী বিষাক্ত হয়ে উঠছে

ছবি

ঢাকার নদী ও খালের দখল-দূষণ: পুনরুদ্ধার কোন পথে

জমি কী মূলে রেকর্ড হয়েছে, দলিল মূলে না উত্তরাধিকার মূলে?

কার্বন-নিরপেক্ষ শিশুর অনুপ্রেরণায় দেশ

এবার আমরা সভ্য হলাম!

সোনার প্রাসাদের দেয়ালে ঘামের দাগ

নিরাপদ সড়ক চাই কিন্তু কার্যকর উদ্যোগ কোথায়?

অবহেলিত শিক্ষার দুর্দশা বাড়ছে

টেকসই উন্নয়নের পূর্বশর্ত নিরাপদ সড়ক

বাংলার সংস্কৃতি কি মূলধারা হারিয়ে ফেলবে?

ছবি

সমদৃষ্টি, বহুত্ববাদী সমাজ এবং সহিষ্ণুতা

খাদ্য অপচয় : ক্ষুধার্ত পৃথিবীর এক নিঃশব্দ ট্র্যাজেডি

টেকসই বাংলাদেশ গঠনে পরিবেশ সংস্কার কেন অপরিহার্য

সে এক রূপকথারই দেশ

উপকূলের খাদ্যসংকট নিয়ে ভাবছেন কি নীতিনির্ধারকেরা?

মানসিক স্বাস্থ্য: মানবাধিকারের নতুন চ্যালেঞ্জ

ঢাকার যানজট ও বিকেন্দ্রীকরণ

নির্বাচনী মাঠে জামায়াতী হেকমত

শিক্ষা ব্যবস্থায় গভীর বৈষম্য ও জাতির অগ্রযাত্রাধ

উপমহাদেশে সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন, বাস্তবতা ও চ্যালেঞ্জ

এইচএসসি ফল: সংখ্যার খেল না কি শিক্ষার বাস্তব চিত্র?

বিনা ভোট, নিশি ভোট, ডামি ভোটের পরে এবার নাকি গণভোট!

কমরেড ইলা মিত্রের শততম জন্মজয়ন্তী

কত মৃত্যু হলে জাগবে বিবেক?

বৈষম্যের বিবিধ মুখ

মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষায় জরুরি আইনি সহায়তা

গাজা : এখন শান্তি রক্ষা করবে কে?

দোসর, বাই ডিফল্ট!

tab

মতামত » উপ-সম্পাদকীয়

ডিম নয় তবু অশ্বডিম্ব!

আনোয়ারুল হক

রোববার, ০২ নভেম্বর ২০২৫

কিশোর কুমার, মালা সিনহা অভিনীত সেই ১৯৫৮ সালের ছায়াছবি ‘লুকোচুরি’ হয়তো আমাদের অনেকেরই দেখা হয়নি। তবে কিশোর কুমারের কন্ঠে ঐ ছবির গান “শিং নেই তবু নাম তার সিংহ/ ডিম নয় তবু অশ্বডিম্ব ...” আমরা অনেকেই শুনেছি। জুলাই সনদ ঘোষণা স্বাক্ষর অনুষ্ঠান এবং সবশেষে সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশ সরকারের কাছে পেশ করার পরে গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে রাজনৈতিক দল ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতামত শুনে যেমন ছায়াছবির ‘লুকোচুরি’ নামটি তেমনি কিশোর কুমারের গানের লাইন দুটি কেন জানি বার বার কানে বাজছে।

জনসাধারণের একাংশের প্রতিনিধিত্বকারী কয়েকটি রাজনৈতিক দলকে অন্তর্ভুক্ত না করেও ৩০টি দলের নেতাদের সঙ্গে দীর্ঘ নয় মাস ধরে আলোচনা করে যেসব বিষয়ে ঐকমত্য তৈরি হয়েছিল কমিশন তার সুপারিশে যেন সেই ঐক্যই ভেঙে দিলো। একটি অনির্বাচিত অন্তর্বর্তী সরকার দ্রুত জনগণের প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের লক্ষ্যে জাতীয় নির্বাচন না দিয়ে সংস্কারের নামে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করে প্রায় বছর পার করলেন ‘সংবিধান রচনা’ করতে বসে। রাজনৈতিক দলগুলোও সেই ফাঁদে ধরা দিয়ে এখন বলছে ‘লুকোচুরি’ করা হয়েছে। আর পার্লামেন্টে আলোচনা না করে সংবিধানের মূলনীতি সংশোধন বা পরিবর্তনের বিরোধিতা করে সিপিবিসহ চার বামপন্থী দল তো লুকোচুরির সনদে স্বাক্ষরই করেনি।

সব থেকে মারাত্মক অভিযোগ করেছেন বিএনপির মহাসচিব মীর্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেছেন, ‘এটা জনগণের সঙ্গে এবং রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্য কমিশনের একটা প্রতারণা’। তিনি আরো বলেছেন, ‘জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি দেয়ার অধিকার প্রধান উপদেষ্টা বা অন্তর্বর্তী সরকারের নেই। বিশ্বাসভঙ্গ ও প্রতারণা করে আমাদের অগোচরে জুলাই সনদের স্বাক্ষরিত কপি বদলে ফেলা হয়েছে। যা আলোচনা হয়েছে তা সুপারিশে নাই।’ বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, ‘শেষ পর্যন্ত রেফারিই গোল দিয়ে দিয়ে দিলেন।’ তবে মূল কথা বলেছেন বিএনপির নির্বাহী কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট আহমেদ আযম খান। তিনি সংবিধান ও আইন ব্যাখ্যা করে বলেছেন, “সামনে একটাই এজেন্ডা ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এছাড়া আর কোনো এজেন্ডা নেই। জাতীয় নির্বাচনের পর আমরা গণভোটের চিন্তা করব। এর আগে যারা গণভোট চায়, তারা দেশকে অস্থিতিশীল করতে চায়। তারা নির্বাচনকে বিলম্বিত করতে চায়।” আহমেদ আযম খানের বক্তব্যে যদি বিএনপি প্রথম থেকেই স্থির থাকতো তবে আজ এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হতো না।

শুধু বিএনপিই নয়, অন্যান্য রাজনৈতিক দলও তীব্র প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেছে। অন্তর্বর্তী সরকার প্রতারকের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে গেছে বলে মন্তব্য করেছেন নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না। গণসংহতি বলেছে, নির্বাচিত সংসদের কর্তৃত্ব খর্ব করে অন্তর্বর্তী সরকারের জারিকৃত আদেশেই সংবিধান সংস্কার করা হলে সেটা টেকসই হবে না এবং সংসদকে রাবার স্ট্যাম্পে পরিণত করা হবে। অর্থাৎ এনসিপি এবং জামায়াত ও তার মিত্ররা ছাড়া কেউই সরকার ও ঐকমত্য কমিশনের এই লুকোচুরি মেনে নিচ্ছে না।

জামায়াত কী বলছে? তারা সরকারকে নির্দেশ দিয়ে বলেছেন, আজ রাতের (অর্থাৎ ৩০ অক্টোবর বৃহস্পতিবার) মধ্যেই গণভোটের তারিখ ঘোষণা করুন। তাদের সরকারে, প্রশাসনে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ অংশীদারিত্ব আছে, তাই এ ভাষায় বলতেই পারেন। আর এনসিপি নেতা হাসনাত আব্দুল্লাহ ও নাসিরুদ্দিন পাটওয়ারী বিএনপিকে উদ্দেশ্য করে আগের মতোই ঔদ্ধত্তপূর্ণ সুরে বলছেন, ‘কাবিনে যেহেতু স্বাক্ষর করেছেন, সংসারও করতে হবে। তা না হলে ডিভোর্স দিতে হবে।’ কাবিনে স্বাক্ষর করা এবং ডিভোর্স করা তো আইনসম্মত পন্থা। কিন্তু পাটোয়ারী ও হাসনাতদের দল যে কাবিনে স্বাক্ষর না করে ‘লিভ টুগেদার’ করছেন, সেটা কী ভব্যতা হলো! পাটোয়ারী আরো বলেছেন, বিএনপির হ্যাঁ ভোটে জন্ম হয়েছে, মৃত্যু হবে না ভোটে। পাটোয়ারী এত অল্প সময়ে ভুলে গেলেন, শেখ হাসিনাও কিন্তু ভোটের রাজনীতির মাঠ থেকে বিএনপিকে ‘না’ বা বিদায় করে পরে নিজেই বিদায় নেন।

এ দিকে কোনো রাজনৈতিক দল যা বলেনি, সরকারি সূত্রসমূহও কোনো ইঙ্গিত দেয়নি তারপরেও এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু ভয়ানক জটিল পরিস্থিতির আশঙ্কা করে বললেন ঐকমত্যে পৌঁছাতে ব্যর্থ হলে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসকে পদত্যাগ করে চলে যেতে হতে পারে এবং নির্বাচন অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। মঞ্জু এটা নিজে বললেন, না তাকে দিয়ে বলানো হলো এটা একটা বিরাট প্রশ্ন। আবার কি সেই ‘আভি না যাও ছোড়কে’ নাটক মঞ্চস্থ করার আয়োজন হচ্ছে?

বিএনপি আজ নিজের রাজনৈতিক দূর্বলতার জন্য ফাটা বাঁশে আটকা পড়েছে। ৫ আগস্টের পরে দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল হিসেবে যে ভূমিকা নেয়ার ছিলো তা কি তারা নিয়েছেন বা নিতে পেরেছেন? উগ্রবাদী, জঙ্গিবাদী শক্তি এবং বাংলাদেশের জন্মযুদ্ধের বিরোধিতাকারী রাজনৈতিক শক্তিসমূহ শেখ হাসিনার সরকার পতনের সাথে সাথে যখন ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর, মন্দির, মাজার ইত্যাদির উপর হামলা করলো, আওয়ামী বিরোধীতা আর বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের লেবাসে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি চিহ্নগুলো গুড়িয়ে দিতে লাগলো, ঘোষণা দিয়ে দুই রাত দুই দিন ধরে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত শেখ মুজিবের ৩২ নং- ধানমন্ডির ঐতিহাসিক বাড়িটি সরকারি বাহিনীর উপস্থিতিতে ভেঙ্গে ফেললো - তখন যেমন শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ড. ইউনূস নেতৃত্বাধীন সরকার এসব কাজ করার সুযোগ দিয়ে পরে দায়সারা একটি বিবৃতি দিয়ে দায়িত্ব সম্পন্ন করলেন, বিএনপির প্রতিবাদও ঠিক তেমনটি বা তার কাছাকাছি ছিলো। বিএনপি নেতৃত্বের কি উচিত ছিলো না দুহাত প্রসারিত করে রাজপথে দাঁড়িয়ে বলা যথেষ্ট হয়েছে, এনাফ ইজ এনাফ- স্বৈরাচারমুক্ত দেশে আর প্রতিহিংসার রাজনীতি চলতে দেওয়া হবে না, সকল অপরাধের এবং সকল অপরাধীর বিচার আইন সম্মতভাবে হবে। জুলাই আন্দোলনকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের বিপরীতে দাঁড় করানোর ‘কৌশলী’ প্রচেষ্টা বিএনপি রুখে দাঁড়াবে। বিএনপি এ ঘোষণা দিয়ে মাঠে নামলে দলমত নির্বিশেষে দেশের অসাম্প্রদায়িক, মুক্তমনা, উদার গণতন্ত্রী মানুষ এবং সীমিত শক্তির হলেও সংগঠিত বাম প্রগতিশীল শক্তি সে কাফেলায় শামিল হতো।

বিএনপি তা না করায় নাটাই কিন্তু প্রথমেই উগ্রবাদী শক্তির হাতে চলে যায়। বছর ঘুরে যাওয়ার পরে বিএনপিকে আক্ষেপ করে বলতে হলো দেশে উগ্র দক্ষিণপন্থার উত্থান হয়েছে। আবার যখন ঐকমত্য কমিশন গঠন হলো এবং ‘সিং নাই তবু সিংহ’দের ঐ কমিশনের ও সংস্কারের দায়িত্ব দেওয়া হলো তখনতো প্রথম দিনেই বিএনপির বলে দেওয়া উচিত ছিলো সংবিধানে হাত না দিয়ে যত খুশি সংস্কার করেন। সংবিধানের ওপরে কোনো কিছুকে প্রাধান্য দেয়া রাজনৈতিক, আইনগত এবং সবদিক থেকেই রাষ্ট্র কাঠামোকে দুর্বল করার একটি অপপ্রয়াস। বিএনপি তা হতে দেবে না। সাংবিধানিক সংস্কার যা প্রয়োজন তা অবাধ, নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত জাতীয় সংসদ সংবিধান সম্মতভাবে করবে। দু’এক মাসের মধ্যে ‘সিংহের’ কাজ শেষ করে দেশকে জাতীয় নির্বাচনের পথে নিয়ে যেতে হবে।

দুই দুইবার রাষ্ট্র ক্ষমতায় যাওয়া এবং বিগত তিনটি ভোট যদি নিরপেক্ষ ব্যবস্থায় ও অংশগ্রহণমূলক হতো আরো দু’একবার বিএনপি রাষ্ট্র ক্ষমতায় যেতো - সেই দল কেনো সাহসী ভূমিকা নিতে পারলো না সেটা একটা বিষ্ময়ও বটে। উগ্র দক্ষিণ পন্থার প্রতিনিধিত্বকারীরা ছাড়া অন্যরা সরাসরি কথা না বলে সবাই কেমন যেন ইনিয়ে বিনিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কথা বলতেন। ঐকমত্য কমিশনে সিপিবি নেতা রুহিন হোসেন প্রিন্সসহ ২-৪ জন ছাড়া সরাসরি দলের কথা, মনের কথা বলার সাহসিকতা দেখলাম না। বিএনপি যে ভূমিকা রেখেছে আজ তার পরিণতি বিএনপিকে তো শুধু নয় গোটা দেশকে বহন করতে হচ্ছে। বিএনপি-জামায়াত-এনসিপির মধ্যকার সৃষ্ট বিরোধ সামাল দিতে সরকারের তরফ থেকে পর্দার আড়ালে সমঝোতার উদ্যোগ নেওয়ার পরে বিএনপি বলছে, “ যা হওয়ার হয়ে গেছে। আপনারা দয়া করে ওই সমস্যাগুলো সমাধান করেন”- মীর্জা ফখরুলের এসব ‘দয়া ভিক্ষা মার্কা’ কথায় কোনো কাজ হবে না। বিএনপির এখন সরাসরি বলে দেওয়া উচিত সংসদকে কিছু করতে বাধ্য করা যায় না। সাংবিধানিক সংস্কার প্রস্তাব জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরে পার্লামেন্টের সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে সাংবিধানিক গণভোটে দেওয়া হবে। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করুন। বিএনপি কি সেই হিম্মত দেখাতে পারবে? না পারলে ঐ ‘লুকোচুরি’র ফাঁদে পড়ে শুধু গান গেয়ে যেতে হবে “শিং নেই তবু নাম তার সিংহ/ ডিম নয় তবু অশ্বডিম্ব ......”।

(মতামত লেখকের নিজস্ব)

[লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা]

back to top