alt

মতামত » উপ-সম্পাদকীয়

সমতা কি ন্যায্যতা নিশ্চিত করে?

গাজী তারেক আজিজ

: বুধবার, ১২ নভেম্বর ২০২৫

সমাজ, রাষ্ট্র, আইন ও রাজনীতির প্রায় সব আলোচনায় একটি শব্দ খুব ঘন ঘন উচ্চারিত হয়- “সমতা”। আরেকটি শব্দ, প্রায় একই আবেগে বলা হয়- “ন্যায্যতা”। কিন্তু এই দুটি শব্দ কি সত্যিই একই অর্থ বহন করে? সমতা কি স্বয়ংক্রিয়ভাবে ন্যায্যতা এনে দেয়? নাকি কখনও সমতার ভেতরেই লুকিয়ে থাকে নতুন ধরনের অন্যায়? এই প্রশ্ন শুধু দর্শনের নয়, আমাদের রাজনীতি ও সামাজিক বাস্তবতারও প্রশ্ন।

সমতা মানে সবাইকে এক দণ্ডে মাপা- সবার জন্য একই সুযোগ, একই নিয়ম, একই পরিমাপ। আর ন্যায্যতা মানে প্রতিটি মানুষকে তার প্রয়োজন, প্রেক্ষাপট ও যোগ্যতা অনুযায়ী সুযোগ দেওয়া। একটি সহজ উদাহরণ ধরা যাক- তিনজন মানুষ একই দেয়াল টপকে খেলা দেখতে চায়। সবাইকে সমান একটি করে চেয়ার দেওয়া হলো। কিন্তু একজন লম্বা, একজন মাঝারি, আর একজন খাটো। খাটো মানুষটি এখনও দেয়ালের ওপারে দেখতে পায় না, যদিও “সমান” সুযোগ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু যদি খাটো মানুষটি দুইটি চেয়ার পায়, মাঝারি পায় একটি, আর লম্বা কেউ কোনো চেয়ার না পায়- তাহলে সেটিই ন্যায্যতা। কারণ সেখানেই উদ্দেশ্য পূরণ হয়- সবাই যেন দেখতে পারে।

বাংলাদেশের বর্তমান সমাজে, বিশেষ করে রাজনৈতিক কাঠামো ও সামাজিক বণ্টনে এই পার্থক্যটা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। আমরা “সমতা” বলি, কিন্তু “ন্যায্যতা” দেখি না।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে “সমতা” শব্দটি বারবার ব্যবহৃত হয়েছে- সবার ভোটাধিকার, সবার বাকস্বাধীনতা, সবার সমান সুযোগের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এই সমতার ভিতরে কতটা ন্যায্যতা ছিল? জমিদারি বিলোপের পর কৃষকের মুক্তি এসেছে কি? নারী ভোটাধিকার নিশ্চিত হলেও নারীর রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব কতটা কার্যকর? সংবিধানে মৌলিক অধিকার থাকলেও কি দরিদ্র মানুষের কণ্ঠ রাজনীতির টেবিলে পৌঁছায়?

রাজনীতি প্রায়ই “সমতা”র মুখোশ পরে আসে, কিন্তু কার্যত ক্ষমতাবানদের জন্য ন্যায্যতার পরিধি তৈরি করে। বঞ্চিত, নিপীড়িত, নির্যাতিত, নিষ্পেষিত জনগোষ্ঠীর কাছে সমান সুযোগ মানেই বৈষম্যের পুনরুৎপাদন। যখন ধনবান ও গরীব, প্রভাবশালী ও প্রান্তিককে একই মাপে বিচার করা হয়, তখন ন্যায্যতা হারিয়ে যায়।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে বঞ্চনার ইতিহাস নতুন নয়। স্বাধীনতার পর থেকেই দেখা গেছে- একদল বঞ্চনা থেকে মুক্তির প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় আসে, কিন্তু পরবর্তী সময়ে সেই বঞ্চনাই নতুন রূপে ফিরে আসে। একসময় শ্রেণিভিত্তিক বৈষম্য ছিল- জমিদার বনাম কৃষক, ধনী বনাম দরিদ্র। পরে সেই জায়গা নিয়েছে ক্ষমতার রাজনীতি- দলীয় আনুগত্য, প্রশাসনিক প্রভাব, আর রাজনৈতিক সম্পর্ক।

আজকের বাস্তবতায় “সমান সুযোগ” নামের ধারণা অনেক সময় দমন-পীড়নের হাতিয়ার হয়ে দাঁড়ায়। যখন একজন নিপীড়িত শ্রমিক, প্রান্তিক নারী বা সংখ্যালঘু নাগরিকের জন্য রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান একই নিয়মে আচরণ করে যেমনটি করে ক্ষমতাবান শ্রেণির সঙ্গে, তখন সেটি ন্যায্যতা নয়- বরং অবিচারকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া।

ন্যায্যতা মানে শুধু আইনের চোখে সমান হওয়া নয়; বরং ইতিহাস, প্রেক্ষাপট ও বৈষম্যের উত্তরাধিকার বিবেচনা করা। বাংলাদেশের সংবিধান নাগরিকদের মৌলিক অধিকার দিয়েছে, কিন্তু বাস্তবে সুযোগের প্রাপ্তিতে এখনও ঘাটতি বিরাজমান। একজন শহরের শিক্ষার্থী ও একজন পাহাড়ি গ্রামের শিক্ষার্থীর জন্য একই পরীক্ষার প্রশ্ন হয়তো সমান, কিন্তু বাস্তবে ন্যায্য নয়। কারণ একজনের কাছে বই, বিদ্যুৎ, ইন্টারনেট, শিক্ষক আছে- অন্যজনের কাছে কিছুই নেই।

এখানে সমতা থাকলেও ন্যায্যতা অনুপস্থিত। তাই রাষ্ট্রের দায়িত্ব- অসাম্যের শিকড় উপড়ে ফেলা এবং যাদের পেছনে ফেলে দেওয়া হয়েছে তাদের জন্য অতিরিক্ত সুযোগ সৃষ্টি করা। সেটিই ন্যায্যতা। দমন-পীড়নের মূল যুক্তি প্রায়ই “আইনের শাসন” নামে ঢেকে দেওয়া হয়। কিন্তু যখন আইন শুধুমাত্র দুর্বলদের ওপর প্রয়োগ হয়, আর ক্ষমতাবানরা তার বাইরে থাকে, তখন তা কোনোভাবেই ন্যায্য হতে পারে না।

আজকের বাংলাদেশে দেখা যায়- কোনো রাজনৈতিক বিরোধী দলের সভা নিষিদ্ধ, সাংবাদিকের প্রশ্নের জন্য মামলা, মানবাধিকার কর্মীর ওপর চাপ- এগুলো সবই রাষ্ট্রের সমতার মুখোশে অন্যায়ের চর্চা।

যেখানে প্রতিবাদ করলে “রাষ্ট্রবিরোধী” তকমা জোটে। আর ক্ষমতাবানদের অন্যায় নীরবে সহ্য করা হয়। সেখানে সমতা নয়, বরং একপেশে বিচার-বিবেচনায় বরং অবিচারই চলছে। ন্যায্যতা তখন পরিণত হয় নিপীড়নের প্রতিরোধের মূল চেতনায়। রাজনৈতিক দলগুলো প্রায়ই সমান সুযোগের দাবি তোলে। কিন্তু সেই সুযোগ কতটা বাস্তব? একদল রাষ্ট্রযন্ত্রের সব সুবিধা ভোগ করছে, আরেকদল মাঠে নামার সুযোগই পাচ্ছে না- একে কি “সমান প্রতিযোগিতা” বলা যায়? নির্বাচনের মাঠে ভোটের অধিকার এক হলেও ভোটের নিরাপত্তা, প্রচারের স্বাধীনতা, গণমাধ্যমের প্রবেশাধিকার এক নয়।

তাই সমান সুযোগের নামে ন্যায্যতার ধারণা আজ ক্ষয়ে যাচ্ছে। রাজনীতির মাঠে “সমতা” মানে আজ ক্ষমতাবানদের একচ্ছত্র আধিপত্য, আর “ন্যায্যতা” মানে আজ প্রতিরোধ, প্রতিবাদ ও সামাজিক ন্যায়ের আহ্বান। দর্শনে জন রলস ন্যায্যতাকে ব্যাখ্যা করেছেন “জাস্টিস অ্যাজ ফেয়ারনেস” হিসেবে- যেখানে সমাজের প্রতিটি নিয়ম এমনভাবে গঠিত হবে যাতে দুর্বলতম মানুষও উপকৃত হয়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই তত্ত্ব অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। একটি রাষ্ট্র তখনই ন্যায্য হতে পারে, যখন তার নীতি দুর্বলদের পাশে দাঁড়ায়, সুবিধাবঞ্চিতদের সুযোগ দেয়, এবং অতীতের বৈষম্যের ক্ষতিপূরণ করে। আজ দরকার এমন রাষ্ট্রচিন্তা- যেখানে “সমান অধিকার” নয়, বরং “ন্যায্য অধিকার” প্রতিষ্ঠা পাবে। কারণ, সমান বণ্টন সবসময় ন্যায্য বণ্টন নয়।

বঞ্চিতদের কণ্ঠ রুদ্ধ হলে সমাজের বিবেকও রুদ্ধ হয়। একজন রিকশাচালক যখন বলে, “সবাই সমান, কিন্তু কেউই আমার কষ্ট বোঝে না” সেটি আসলে রাষ্ট্রের ন্যায্যতার ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি। নারী, সংখ্যালঘু, শ্রমিক, গ্রামীণ জনগোষ্ঠী- তাদের প্রতি অবিচার সমাজে যত বাড়ে, ন্যায্যতা তত ক্ষয় হয়। সমতা তখন কেবল কথার ফুলঝুরি হয়ে দাঁড়ায়। ন্যায্যতা নিশ্চিত করতে হলে সমাজকে তাদের ইতিহাস, সংগ্রাম, নিপীড়ন- সবকিছু বুঝে নীতিনির্ধারণ করতে হবে।

সমতা একটি সুন্দর ধারণা, কিন্তু অসম সমাজে সেটি অনেক সময় অন্যায়ের আবরণ হয়ে দাঁড়ায়। ন্যায্যতা মানে ইতিহাসের ভার বুঝে পদক্ষেপ নেওয়া- যেখানে প্রান্তিক মানুষের জন্য অতিরিক্ত সুযোগ, সুরক্ষা ও কণ্ঠস্বর নিশ্চিত করা হয়। বাংলাদেশের রাজনীতি, প্রশাসন ও সমাজ যদি সত্যিকারের ন্যায়ভিত্তিক হতে চায়, তবে “সমান আচরণ” নয়, “ন্যায্য আচরণ”কে প্রাধান্য দিতে হবে। কারণ ন্যায্যতা ছাড়া সমতা শুধু মুখোশ। আর সেই মুখোশের আড়ালে বেঁচে থাকে- বঞ্চিতের দীর্ঘশ্বাস, নিপীড়িতের কান্না, আর নিষ্পেষিত মানুষের অবদমন। যেদিন রাষ্ট্র এই কান্নার ভাষা শুনবে, সেদিনই প্রকৃত অর্থে সমতা আর ন্যায্যতা একসূত্রে বাঁধা পড়বে- আর সেই দিনেই হয়তো আমরা সত্যিকার অর্থে বলতে পারব, বাংলাদেশ একটি ন্যায়ভিত্তিক প্রজাতন্ত্র। যদিও প্রজাতন্ত্র না বলে নাগরিকতন্ত্র বলাই সমীচীন। কারণ রাজতন্ত্রের বিলোপের পর প্রজাতন্ত্র নাম ন্যায্যতাকেই প্রশ্নের ভেতর বন্দি করে রাখে।

[লেখক: অ্যাডভোকেট, জেলা ও দায়রা জজ আদালত, ফেনী]

ভাষার বৈচিত্র্য রক্ষায় নীরব বিপ্লব

উপাত্ত সুরক্ষা আইন : গোপনীয়তা রক্ষা নাকি রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ?

ডেঙ্গু সংকট দূরদৃষ্টির ব্যর্থতা

ষাটের দশকে বামপন্থী ভাবনার উত্থান ও বিবর্তন

দেখিতে পাও না তুমি মৃত্যুদূত দাঁড়ায়েছে দ্বারে!

বায়ুর অপর নাম জীবন

ছবি

হাওরের জীবন ও সংস্কৃতি

বিখণ্ডিত আত্মপরিচয়: তরল সহানুভূতিতে নৈতিক মূলধনের সমাজতত্ত্ব

প্রভাষকের ‘প্রভা’ যখন ‘শোক’: শিক্ষা ক্যাডারে পদোন্নতি বঞ্চনা

যুদ্ধ বিরতি গাজাবাসীর জন্য জরুরি ছিল

লবলং খালের মৃত্যু: স্মৃতিতে নদী, বাস্তবে দূষণ

বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বাধীনতা: অর্থনৈতিক স্থিতির পূর্বশর্ত

হায় যম! আর কতক্ষণ, হবে অপেক্ষা করিতে মোরে?

পোশাক শিল্প : অগ্রগতি ও শ্রমিকের অধিকার

গণভোটের রাজনৈতিক গুরুত্ব

বামঘরানার বাটখারা...

বাগদা ফার্ম : স্মারকলিপি, অবরোধ, অনশন, আন্দোলন- কিছুতেই বরফ গলেনি

ব্যাটারি-শকট: নতুন সংকট

মতপ্রকাশ কিংবা দ্বিমত পোষণ: নাগরিক অধিকার ও রাজনৈতিক বাস্তবতা

সরকারি কর্মচারীদের জন্য নতুন ব্যাংক কি আদৌ প্রয়োজন

ট্রাম্প ও শি’র ‘কৌশলগত শান্তি’

আশার সমাজতত্ত্ব: বিভ্রান্তির যুগে ভবিষ্যৎ নির্মাণের বিপ্লবী বিজ্ঞান

পিএইচডি: উচ্চ শিক্ষার মানদণ্ড না প্রতীকী মরীচিকা?

ডিম নয় তবু অশ্বডিম্ব!

ছবি

অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও নির্বাচন

পিএইচডি: উচ্চ শিক্ষার মানদণ্ড না প্রতীকী মরীচিকা?

প্রকৃতার্থে ফকির কারা

এনসিপি চায় অবিনাশী জুলাই সনদ

পিএইচডি: উচ্চ শিক্ষার মানদণ্ড না প্রতীকী মরীচিকা?

আলুর প্রাচুর্যে কৃষকের সংকট

তাহলে কী ‘কোটা’ই জয়যুক্ত হবে!

ব্যাংকিং খাতে বিষফোঁড়া: বাংলাদেশের অর্থনীতির ধমনী বিষাক্ত হয়ে উঠছে

ছবি

ঢাকার নদী ও খালের দখল-দূষণ: পুনরুদ্ধার কোন পথে

জমি কী মূলে রেকর্ড হয়েছে, দলিল মূলে না উত্তরাধিকার মূলে?

কার্বন-নিরপেক্ষ শিশুর অনুপ্রেরণায় দেশ

এবার আমরা সভ্য হলাম!

tab

মতামত » উপ-সম্পাদকীয়

সমতা কি ন্যায্যতা নিশ্চিত করে?

গাজী তারেক আজিজ

বুধবার, ১২ নভেম্বর ২০২৫

সমাজ, রাষ্ট্র, আইন ও রাজনীতির প্রায় সব আলোচনায় একটি শব্দ খুব ঘন ঘন উচ্চারিত হয়- “সমতা”। আরেকটি শব্দ, প্রায় একই আবেগে বলা হয়- “ন্যায্যতা”। কিন্তু এই দুটি শব্দ কি সত্যিই একই অর্থ বহন করে? সমতা কি স্বয়ংক্রিয়ভাবে ন্যায্যতা এনে দেয়? নাকি কখনও সমতার ভেতরেই লুকিয়ে থাকে নতুন ধরনের অন্যায়? এই প্রশ্ন শুধু দর্শনের নয়, আমাদের রাজনীতি ও সামাজিক বাস্তবতারও প্রশ্ন।

সমতা মানে সবাইকে এক দণ্ডে মাপা- সবার জন্য একই সুযোগ, একই নিয়ম, একই পরিমাপ। আর ন্যায্যতা মানে প্রতিটি মানুষকে তার প্রয়োজন, প্রেক্ষাপট ও যোগ্যতা অনুযায়ী সুযোগ দেওয়া। একটি সহজ উদাহরণ ধরা যাক- তিনজন মানুষ একই দেয়াল টপকে খেলা দেখতে চায়। সবাইকে সমান একটি করে চেয়ার দেওয়া হলো। কিন্তু একজন লম্বা, একজন মাঝারি, আর একজন খাটো। খাটো মানুষটি এখনও দেয়ালের ওপারে দেখতে পায় না, যদিও “সমান” সুযোগ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু যদি খাটো মানুষটি দুইটি চেয়ার পায়, মাঝারি পায় একটি, আর লম্বা কেউ কোনো চেয়ার না পায়- তাহলে সেটিই ন্যায্যতা। কারণ সেখানেই উদ্দেশ্য পূরণ হয়- সবাই যেন দেখতে পারে।

বাংলাদেশের বর্তমান সমাজে, বিশেষ করে রাজনৈতিক কাঠামো ও সামাজিক বণ্টনে এই পার্থক্যটা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। আমরা “সমতা” বলি, কিন্তু “ন্যায্যতা” দেখি না।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে “সমতা” শব্দটি বারবার ব্যবহৃত হয়েছে- সবার ভোটাধিকার, সবার বাকস্বাধীনতা, সবার সমান সুযোগের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এই সমতার ভিতরে কতটা ন্যায্যতা ছিল? জমিদারি বিলোপের পর কৃষকের মুক্তি এসেছে কি? নারী ভোটাধিকার নিশ্চিত হলেও নারীর রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব কতটা কার্যকর? সংবিধানে মৌলিক অধিকার থাকলেও কি দরিদ্র মানুষের কণ্ঠ রাজনীতির টেবিলে পৌঁছায়?

রাজনীতি প্রায়ই “সমতা”র মুখোশ পরে আসে, কিন্তু কার্যত ক্ষমতাবানদের জন্য ন্যায্যতার পরিধি তৈরি করে। বঞ্চিত, নিপীড়িত, নির্যাতিত, নিষ্পেষিত জনগোষ্ঠীর কাছে সমান সুযোগ মানেই বৈষম্যের পুনরুৎপাদন। যখন ধনবান ও গরীব, প্রভাবশালী ও প্রান্তিককে একই মাপে বিচার করা হয়, তখন ন্যায্যতা হারিয়ে যায়।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে বঞ্চনার ইতিহাস নতুন নয়। স্বাধীনতার পর থেকেই দেখা গেছে- একদল বঞ্চনা থেকে মুক্তির প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় আসে, কিন্তু পরবর্তী সময়ে সেই বঞ্চনাই নতুন রূপে ফিরে আসে। একসময় শ্রেণিভিত্তিক বৈষম্য ছিল- জমিদার বনাম কৃষক, ধনী বনাম দরিদ্র। পরে সেই জায়গা নিয়েছে ক্ষমতার রাজনীতি- দলীয় আনুগত্য, প্রশাসনিক প্রভাব, আর রাজনৈতিক সম্পর্ক।

আজকের বাস্তবতায় “সমান সুযোগ” নামের ধারণা অনেক সময় দমন-পীড়নের হাতিয়ার হয়ে দাঁড়ায়। যখন একজন নিপীড়িত শ্রমিক, প্রান্তিক নারী বা সংখ্যালঘু নাগরিকের জন্য রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান একই নিয়মে আচরণ করে যেমনটি করে ক্ষমতাবান শ্রেণির সঙ্গে, তখন সেটি ন্যায্যতা নয়- বরং অবিচারকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া।

ন্যায্যতা মানে শুধু আইনের চোখে সমান হওয়া নয়; বরং ইতিহাস, প্রেক্ষাপট ও বৈষম্যের উত্তরাধিকার বিবেচনা করা। বাংলাদেশের সংবিধান নাগরিকদের মৌলিক অধিকার দিয়েছে, কিন্তু বাস্তবে সুযোগের প্রাপ্তিতে এখনও ঘাটতি বিরাজমান। একজন শহরের শিক্ষার্থী ও একজন পাহাড়ি গ্রামের শিক্ষার্থীর জন্য একই পরীক্ষার প্রশ্ন হয়তো সমান, কিন্তু বাস্তবে ন্যায্য নয়। কারণ একজনের কাছে বই, বিদ্যুৎ, ইন্টারনেট, শিক্ষক আছে- অন্যজনের কাছে কিছুই নেই।

এখানে সমতা থাকলেও ন্যায্যতা অনুপস্থিত। তাই রাষ্ট্রের দায়িত্ব- অসাম্যের শিকড় উপড়ে ফেলা এবং যাদের পেছনে ফেলে দেওয়া হয়েছে তাদের জন্য অতিরিক্ত সুযোগ সৃষ্টি করা। সেটিই ন্যায্যতা। দমন-পীড়নের মূল যুক্তি প্রায়ই “আইনের শাসন” নামে ঢেকে দেওয়া হয়। কিন্তু যখন আইন শুধুমাত্র দুর্বলদের ওপর প্রয়োগ হয়, আর ক্ষমতাবানরা তার বাইরে থাকে, তখন তা কোনোভাবেই ন্যায্য হতে পারে না।

আজকের বাংলাদেশে দেখা যায়- কোনো রাজনৈতিক বিরোধী দলের সভা নিষিদ্ধ, সাংবাদিকের প্রশ্নের জন্য মামলা, মানবাধিকার কর্মীর ওপর চাপ- এগুলো সবই রাষ্ট্রের সমতার মুখোশে অন্যায়ের চর্চা।

যেখানে প্রতিবাদ করলে “রাষ্ট্রবিরোধী” তকমা জোটে। আর ক্ষমতাবানদের অন্যায় নীরবে সহ্য করা হয়। সেখানে সমতা নয়, বরং একপেশে বিচার-বিবেচনায় বরং অবিচারই চলছে। ন্যায্যতা তখন পরিণত হয় নিপীড়নের প্রতিরোধের মূল চেতনায়। রাজনৈতিক দলগুলো প্রায়ই সমান সুযোগের দাবি তোলে। কিন্তু সেই সুযোগ কতটা বাস্তব? একদল রাষ্ট্রযন্ত্রের সব সুবিধা ভোগ করছে, আরেকদল মাঠে নামার সুযোগই পাচ্ছে না- একে কি “সমান প্রতিযোগিতা” বলা যায়? নির্বাচনের মাঠে ভোটের অধিকার এক হলেও ভোটের নিরাপত্তা, প্রচারের স্বাধীনতা, গণমাধ্যমের প্রবেশাধিকার এক নয়।

তাই সমান সুযোগের নামে ন্যায্যতার ধারণা আজ ক্ষয়ে যাচ্ছে। রাজনীতির মাঠে “সমতা” মানে আজ ক্ষমতাবানদের একচ্ছত্র আধিপত্য, আর “ন্যায্যতা” মানে আজ প্রতিরোধ, প্রতিবাদ ও সামাজিক ন্যায়ের আহ্বান। দর্শনে জন রলস ন্যায্যতাকে ব্যাখ্যা করেছেন “জাস্টিস অ্যাজ ফেয়ারনেস” হিসেবে- যেখানে সমাজের প্রতিটি নিয়ম এমনভাবে গঠিত হবে যাতে দুর্বলতম মানুষও উপকৃত হয়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই তত্ত্ব অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। একটি রাষ্ট্র তখনই ন্যায্য হতে পারে, যখন তার নীতি দুর্বলদের পাশে দাঁড়ায়, সুবিধাবঞ্চিতদের সুযোগ দেয়, এবং অতীতের বৈষম্যের ক্ষতিপূরণ করে। আজ দরকার এমন রাষ্ট্রচিন্তা- যেখানে “সমান অধিকার” নয়, বরং “ন্যায্য অধিকার” প্রতিষ্ঠা পাবে। কারণ, সমান বণ্টন সবসময় ন্যায্য বণ্টন নয়।

বঞ্চিতদের কণ্ঠ রুদ্ধ হলে সমাজের বিবেকও রুদ্ধ হয়। একজন রিকশাচালক যখন বলে, “সবাই সমান, কিন্তু কেউই আমার কষ্ট বোঝে না” সেটি আসলে রাষ্ট্রের ন্যায্যতার ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি। নারী, সংখ্যালঘু, শ্রমিক, গ্রামীণ জনগোষ্ঠী- তাদের প্রতি অবিচার সমাজে যত বাড়ে, ন্যায্যতা তত ক্ষয় হয়। সমতা তখন কেবল কথার ফুলঝুরি হয়ে দাঁড়ায়। ন্যায্যতা নিশ্চিত করতে হলে সমাজকে তাদের ইতিহাস, সংগ্রাম, নিপীড়ন- সবকিছু বুঝে নীতিনির্ধারণ করতে হবে।

সমতা একটি সুন্দর ধারণা, কিন্তু অসম সমাজে সেটি অনেক সময় অন্যায়ের আবরণ হয়ে দাঁড়ায়। ন্যায্যতা মানে ইতিহাসের ভার বুঝে পদক্ষেপ নেওয়া- যেখানে প্রান্তিক মানুষের জন্য অতিরিক্ত সুযোগ, সুরক্ষা ও কণ্ঠস্বর নিশ্চিত করা হয়। বাংলাদেশের রাজনীতি, প্রশাসন ও সমাজ যদি সত্যিকারের ন্যায়ভিত্তিক হতে চায়, তবে “সমান আচরণ” নয়, “ন্যায্য আচরণ”কে প্রাধান্য দিতে হবে। কারণ ন্যায্যতা ছাড়া সমতা শুধু মুখোশ। আর সেই মুখোশের আড়ালে বেঁচে থাকে- বঞ্চিতের দীর্ঘশ্বাস, নিপীড়িতের কান্না, আর নিষ্পেষিত মানুষের অবদমন। যেদিন রাষ্ট্র এই কান্নার ভাষা শুনবে, সেদিনই প্রকৃত অর্থে সমতা আর ন্যায্যতা একসূত্রে বাঁধা পড়বে- আর সেই দিনেই হয়তো আমরা সত্যিকার অর্থে বলতে পারব, বাংলাদেশ একটি ন্যায়ভিত্তিক প্রজাতন্ত্র। যদিও প্রজাতন্ত্র না বলে নাগরিকতন্ত্র বলাই সমীচীন। কারণ রাজতন্ত্রের বিলোপের পর প্রজাতন্ত্র নাম ন্যায্যতাকেই প্রশ্নের ভেতর বন্দি করে রাখে।

[লেখক: অ্যাডভোকেট, জেলা ও দায়রা জজ আদালত, ফেনী]

back to top