alt

মতামত » উপ-সম্পাদকীয়

নবাগত শিক্ষকদের পেশাগত ভাবনা

আকমল হোসেন

: শুক্রবার, ১৪ নভেম্বর ২০২৫

যুদ্ধের ময়দানে অস্ত্র ছাড়া সৈন্য যেমন গুরুত্বহীন আর ক্লাস রুমে প্রশিক্ষণ ছাড়া শিক্ষকও তেমনই। এনটিসির মাধ্যমে নিয়োগ প্রাপ্ত ৪২ হাজার শিক্ষককে কোন ধরণের প্রশিক্ষণ ছাড়াই ক্লাস রুমে পাঠানোর প্রেক্ষিতে বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। বাংলাদেশে বিভিন্ন ধরণের শিক্ষার মধ্যে সাধারণ মাদ্রসা ও কারিগরি এবং ইংরেজি মাধ্যমের মধ্যে প্রায় ৯০ ভাগ শিক্ষার্থীর লেখা-পড়ানোর দায়িত্ব পালন করছেন বেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা। যাদের সংখ্যা এই মুহূর্তে ৬ লক্ষাধিক। এর মধ্যে মাওশির অধীনে ৩ লক্ষ ৯৮ হাজার, মাদ্রাসার অধীনে ২লক্ষ, এবং কারিগরি শাখায় ২৩ হাজারের মতো।

সমস্যার আসল কারণ বের না করে দায়িত্বপ্রাপ্তরা বলে থাকেন, শিক্ষকতা চাকরি নয় এটা তপস্যা। এজন্য তো সেই সমাজ থাকতে হবে, যে সমাজে জ্ঞানের কদর হয়, যেখানে চিত্তহীন বিত্তের দাপট সেখানে টাকা ছাড়া কাজ পাওয়া যায় না

এবছর এনটিআরসির মাধ্যমে ৪২ হাজার শিক্ষককে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, এরা এমপিওভুক্ত হলে এই সংখ্যাটা আরো বেড়ে যাবে। এদের বেতন ভাতা মাসিক ১২৫০০টাকা, চিকিৎসা ভাতা-৫০০টাকা এবং বাড়িভাড়া আপাতাত ১০০০টাকা। সম্প্রতি ঘোষণা হওয়া ৭.৫% কার্যকর হলে সর্বন্মিœ ২০০০ টাকা এবং জুলাই২৭ থেকে ১৫% হবে। এই শিক্ষকরা ২০১৫ সালের পূর্বে ম্যানেজিং কমিটি বা গভর্নিংবডির মাধ্যমে নিযোগপ্রাপ্ত হতেন, ২০১৫ সালের পর এনটিআরসির মাধ্যমে নিবাচিত হয়েছেন। পূর্বের নিয়োগ প্রক্রিয়ায় রাজনীতিকদের দ্বারা গঠিত কমিটির বিরুদ্ধে উতকোচের মাধ্যমে, তুলনামুলক কম মেধার লোক শিক্ষকতায় নিয়োগের অভিযোগ ছিলো । প্রতিষ্ঠান প্রধান সহকারী প্রধানসহ অফিশিয়াল পদে নিয়োগের ক্ষমতা কমিটি হাতে থাকায় প্রতিষ্ঠানে দলীয়করণের অভিযোগ এবং স্থানীয় পর্যায়ে শিক্ষা প্রশাসনে কিছু জটিলতার সৃষ্টি হলে শিক্ষাবিদ ও শিক্ষক সংগঠনের দাবির প্রেক্ষিতে সম্প্রতি বেরসরকারি প্রতিষ্ঠানের সকল পদে এনটিআরসির মাধ্যমে নিয়োগের লক্ষ্যে প্রশাসনিক সকল পদে নিয়োগ প্রক্রিয়া আপাতত বন্ধ করা হয়েছে, নিয়োগ নীতিমালা চুড়ান্ত হলে এনটিসির মাধ্যমে নিয়োগ শুরু হবে।

মানুষের নৈতিকতা, সততা, দেশপ্রেম আজ তলানিতে, শিশু-কিশোর তরুণদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা, কিশোর গ্যাং,আর মাদকের বিস্তার মানসিকভাবেই বিকারগ্রস্থ করছে না, শারিরীকভাবেও দুর্বল করে দিচ্ছে। একদিকে ক্রমবর্ধমান জনশক্তির সামগ্রীক চাহিদা, বিশ্বায়নের অসম প্রতিযোগিতা আর প্রযুক্তির উন্নয়নের সাথে যোগসুত্র সৃষ্টি করতে না পারলে জাতির জন্য ভালো কিছু আশা করার নেই। এমন বাস্তবতায় দক্ষ, কর্মঠ, সৎ ও দেশপ্রেমিক মানুষ সৃষ্টিতে শিক্ষার ভূমিকা নতুনভাবে মূল্যায়ন ও গুরুত্ব দেওয়া সময়ের দাবি। এ দাবি বাস্তবায়নে দেশের নীতি নির্ধারক, রাজনীতিবিদ অর্থনীতিবিদ এবং শিক্ষাবিদদের আন্তরিকতা আর সদিচ্ছা নিয়ে এগিয়ে আসার দরকার। দরকার শিক্ষার দর্শন,অর্থায়ন এবং ব্যবস্থাপনা নিয়ে ভাববার। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিপরীতে ভাববাদী শিক্ষার বিস্তার ঘটিয়ে বেকারত্বেও লাইন বড় করা তৌহিদী জনতার ব্যানারে মব সৃষ্টির সংস্কৃতি দেশের উন্নয়নকে বাধাগ্রস্থ করছে এবং করবে। প্রথম শ্রেণি-মাস্টার্স পর্যন্ত ১৬ বছর ধরে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পরও যদি নৈতিকতা,মূল্যবোধ সততা আর দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ একটি জেনারেশন তৈরি করা না যায় তার জন্যও জবাবদিহি থাকার দরকার। এই জরাবদিহির জন্য পিতা-মাতা,আত্বীয় পরিজন,কমিউনিটির লোকজন ও শিক্ষক সমাজ দায় এড়াতে পারেন না, কারণ এদের পেছনে জনগণের টাকা ব্যয় করতে হয়।

বেতন-ভাতা তুলনামুলকভাবে কম হওয়ায় অধিকতর মেধাবীরা এ পেশায় আসতে চান না আবার যারা আসেন পদোন্নতির সময়ভিত্তিক মূল্যায়নের মাধ্যমে পদোন্নতির বিধান কার্যকর থাকা এবং সারা চাকুরি জীবনে দুটির বেশি পদোন্নতি না থাকায় শেষ পর্যন্ত তাদের এ পেশায় ধরে রাখা যায় না । আর্থিক বঞ্চনার পরও সামাজিক মর্যাদার অবস্থানটি থাকলে তাতে এ পেশায় রাখা সম্ভব ছিলো, কিন্তু সেটিও নেই। এক সময় ছিলো গ্রামীণ জনপদে ছেলে-মেয়ের বিয়ে দিতে পরিবারের লোকজন বলতো দেখতে হবে ঘর নয়তো বর।

সমস্যার আসল কারণ বের না করে দায়িত্বপ্রাপ্তরা বলে থাকেন, শিক্ষকতা চাকরি নয় এটা তপস্যা। এজন্য তো সেই সমাজ থাকতে হবে, যে সমাজে জ্ঞানের কদর হয়, যেখানে চিত্তহীন বিত্তের দাপট সেখানে টাকা ছাড়া কাজ পাওয়া যায় না। ভোগবাদী এবং পূঁজিবাদী সমাজ মানুষের মনোজগতে যে ন্যারেটিভ তৈরি করেছে সেটা রেখে তপস্যার চর্চা করা কঠিন। তাই বলে যারা শিক্ষতার পেশায় আছেন বা আসছেন তাদের চিন্তা শক্তিকে প্রসারিত করতে হবে, জীবিত থেকে জীবন্তের ভূমিকা পালন করতে হবে। কারণ তাদের হাত দিয়ে বের হচ্ছে অসংখ্য আগামীর ভবিষত। দক্ষ,কর্মঠ,সত ও দেশপ্রেমিক ভবিষ্যৎ গঠন না হলে তার দায়িত্ব শিক্ষক সমাজ এড়াতে পারে না। সেইসাথে ২০২৪ সালের জুলাই অভ্যুত্থানের পরে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক ও প্রতিষ্ঠান প্রধানদের হেনস্থা এবং জোর করে পদত্যাগ করানো হয়েছিলো সে সমস্যার এখন পুরোপুরি সমাধান হয়নি, বিপথগামী পেশী শক্তিধারীদেও একজনের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড, পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে এটি সাংবিধানিক অধিকারও বটে তবে আমাদের দেশে সকলের জন্য খাদ্য বস্ত্র শিক্ষা স্বাস্থ্য ও বাসস্থান জনগণের জন্য মৌলিক অধিকার নয়, এগুলি নিশ্চিত করা রাষ্ট্রীয় মৌলিক দায়িত্ব। শিক্ষার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য বাস্তবায়নে আরো কিছু করার আছে, সেটা করতে হবে। তবে বিদ্যমান অবস্থায় যার যেটুকু দায়িত্ব আছে সেটি করা জরুরি। কারিকুলাম সিলেবাস,পাঠদান কার্যক্রমটায় শিক্ষকদের গুরুতাবপূর্ণ ভূমিকা আছে সেটা করতে হবে। নতুন করে যারা শিক্ষকতায় আসছেন তাদের কাজের প্রতি আগ্রহী ও আন্তারিক করে গড়ে তোলার কাজটিও করতে হবে।

ভালো শিক্ষকরা আগে পড়বেন তারপর পড়াবেন। তিনি একই সাথে ছাত্র তারপর শিক্ষক এবং মেন্টর। পড়াবেন এবং অভিজ্ঞতার মাধ্যমে শিখাবেন,সে জন্যই বলা হয় তিনিই ভালো শিক্ষক, যিনি পড়াবেন, দেখাবেন এবং নিজে তার সাথে কাজ করবেন। ছাত্র শিক্ষক সম্পর্ক হবে বন্ধুরমতো ক্লাসগুলি হবে প্রাণবন্ত পাঠদান হবে কর্মশালার মতো। ভয় ও শংকামুক্ত পরিবেশে যেন ছেলে-মেয়েরা শেখে। শ্রেীণ ব্যবস্থাপনা প্যাডাগজি সম্পর্কে ভালো ধারণা শিক্ষার্থীদের সক্ষমতা অনুযায়ী শেখানো ভালো, তুলনামুলকভাবে দূর্বল এবং ভালো শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ নজর রাখা, মনিটরিং, মূল্যায়ন এবং পরবর্তি নির্দেশনা প্রদান করতে হবে। এগুলি করার জন্যই তাকে পড়তে হয় শিখতে হয়, প্রশিক্ষণ নিতে হয়। শিক্ষার্থীদের জাতীয় স্বক্ষমতায় উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করা শিক্ষার্থীতে মান সপ্তম শ্রেণির সমান।

৪২ হাজার শিক্ষককে নিয়োগ দিয়েই ক্লাস রুমে পাঠিয়ে দেওয়া হলো, কোন ধরণের প্রশিক্ষণ ছাড়াই। পুলিশের কনস্টেবল, এএসপি, প্রশাসন ক্যাডারের লোক-জনকে প্রশিক্ষণ ছাড়া কর্মে না পাঠালেও শিক্ষকদের পাঠানো হলো। শিক্ষার গুণগত মানের জন্য এটি ইতিবাচক নয় । শিক্ষার মানে অনুসরণীয় পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে শিক্ষা বিষয়ে পাশ করা লোক ছাড়া শিক্ষতায় আবেদনই করতে পারে না।

আমাদের দেশে প্রাইমারি স্কুলে সিএনএড, মাধ্যমিক শিক্ষায় বিএড, সরকারি কলেজ মিশকদের জন্য বুনিয়াদী প্রশিক্ষণের পর পেশার কাজে পাঠালেও বেসরকারি শিক্ষার ক্ষেত্রে এমন সুযোগ নেই,অথচ এখানেই অধ্যয়ন করে ৯০ ভাগ শিক্ষার্থী। এ বিষয়ে কমিউনিটি, স্বানীয় সরকার এবং সমাজের বিত্তবানদের ভ’মিকা রাখা দরকার । তবে বেসরকারি শিক্ষায় নানান সীমাবদ্ধতা জেনেই যারা এ পেশায় এসেছেন এবং থাকতে চান,তাদের পেশার উৎকর্ষতা সাধন এবং কাজের প্রতি দায়িত্বশীল হওয়া জরুরি। সেজন্য তাদের পেশাদারিত্বের প্রস্তুতির কাজটা শেষ করতে হবে। একজন রাজমিস্ত্রির যেমন জন্যে কড়াই, কাঠমিস্ত্রির জন্য হাতুড়ি-বাঁটাল, ক্ষেতমুজুরের জন্য কাস্তে- মাথাল লাগে, সেরূপ শিক্ষকতার জন্য তার কিছু জিনিস থাকতে হয় এবং তার ব্যবহার করা শিখতে হয়। পড়াশোনা, লেখালেখি, গবেষণা, সেমিনার-সিম্পেজিয়ামে অংশগ্রহন করতে হয়। এটা শারিরীক শ্রমের কোন কাজ নয়, বুদ্ধিবিত্তিক ও মানসিক শ্রমের কাজ। প্রতিষ্ঠানের নির্ধারিত শ্রমের বাইরেও তাকে কাজ করতে হয়, সেজন্য তাদের আর্থিক বিষয়টিতে গুরুত্ব দিতে হয়। এ দেশের জন্য এটা ভাবাই যেন কল্পনা।

মূল্যবোধ অবক্ষয়ের এসমাজে দায়িত্ব-জ্ঞানহীন নানা উক্তির মধ্যে এ কথাটিও উচারিত হচ্ছে আগে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির ঘরগুলি ছিলো কাঁচা আর শিক্ষকেরা ছিলেন পাকা আর বর্তমানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির ঘরগুলি হয়েছে পাকা আর শিক্ষকেরা হয়েছেন কাঁচা। বিষয়টি শিক্ষক সমাজের আত্নমর্যাদার, সেজন্য পেশার দায়িত্ব যেমন যথাযথভাবে পালন করতে হবে তেমনি নিজেদেও আর্থিক ও সামাজিক মর্যাদা রক্ষা এবং বৃদ্ধিও জন্য কাজ করতে হবে।

[লেখক: কলেজ অধ্যক্ষ; যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি]

চেকের মামলায় বৈধ বিনিময়, লেনদেন, দেনা-পাওনা প্রমাণ ছাড়া আর জেল নয়

মাদকাসক্তি: শুধু নিরাময় নয়, চাই সমাজ ব্যবস্থার সংস্কার

আমেরিকার “নো কিংস” আন্দোলন

ঘি তো আমাদের লাগবেই, নো হাংকি পাংকি!

“মামদানি না জামদানি...”

ভাষার বৈচিত্র্য রক্ষায় নীরব বিপ্লব

উপাত্ত সুরক্ষা আইন : গোপনীয়তা রক্ষা নাকি রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ?

সমতা কি ন্যায্যতা নিশ্চিত করে?

ডেঙ্গু সংকট দূরদৃষ্টির ব্যর্থতা

ষাটের দশকে বামপন্থী ভাবনার উত্থান ও বিবর্তন

দেখিতে পাও না তুমি মৃত্যুদূত দাঁড়ায়েছে দ্বারে!

বায়ুর অপর নাম জীবন

ছবি

হাওরের জীবন ও সংস্কৃতি

বিখণ্ডিত আত্মপরিচয়: তরল সহানুভূতিতে নৈতিক মূলধনের সমাজতত্ত্ব

প্রভাষকের ‘প্রভা’ যখন ‘শোক’: শিক্ষা ক্যাডারে পদোন্নতি বঞ্চনা

যুদ্ধ বিরতি গাজাবাসীর জন্য জরুরি ছিল

লবলং খালের মৃত্যু: স্মৃতিতে নদী, বাস্তবে দূষণ

বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বাধীনতা: অর্থনৈতিক স্থিতির পূর্বশর্ত

হায় যম! আর কতক্ষণ, হবে অপেক্ষা করিতে মোরে?

পোশাক শিল্প : অগ্রগতি ও শ্রমিকের অধিকার

গণভোটের রাজনৈতিক গুরুত্ব

বামঘরানার বাটখারা...

বাগদা ফার্ম : স্মারকলিপি, অবরোধ, অনশন, আন্দোলন- কিছুতেই বরফ গলেনি

ব্যাটারি-শকট: নতুন সংকট

মতপ্রকাশ কিংবা দ্বিমত পোষণ: নাগরিক অধিকার ও রাজনৈতিক বাস্তবতা

সরকারি কর্মচারীদের জন্য নতুন ব্যাংক কি আদৌ প্রয়োজন

ট্রাম্প ও শি’র ‘কৌশলগত শান্তি’

আশার সমাজতত্ত্ব: বিভ্রান্তির যুগে ভবিষ্যৎ নির্মাণের বিপ্লবী বিজ্ঞান

পিএইচডি: উচ্চ শিক্ষার মানদণ্ড না প্রতীকী মরীচিকা?

ডিম নয় তবু অশ্বডিম্ব!

ছবি

অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও নির্বাচন

পিএইচডি: উচ্চ শিক্ষার মানদণ্ড না প্রতীকী মরীচিকা?

প্রকৃতার্থে ফকির কারা

এনসিপি চায় অবিনাশী জুলাই সনদ

পিএইচডি: উচ্চ শিক্ষার মানদণ্ড না প্রতীকী মরীচিকা?

আলুর প্রাচুর্যে কৃষকের সংকট

tab

মতামত » উপ-সম্পাদকীয়

নবাগত শিক্ষকদের পেশাগত ভাবনা

আকমল হোসেন

শুক্রবার, ১৪ নভেম্বর ২০২৫

যুদ্ধের ময়দানে অস্ত্র ছাড়া সৈন্য যেমন গুরুত্বহীন আর ক্লাস রুমে প্রশিক্ষণ ছাড়া শিক্ষকও তেমনই। এনটিসির মাধ্যমে নিয়োগ প্রাপ্ত ৪২ হাজার শিক্ষককে কোন ধরণের প্রশিক্ষণ ছাড়াই ক্লাস রুমে পাঠানোর প্রেক্ষিতে বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। বাংলাদেশে বিভিন্ন ধরণের শিক্ষার মধ্যে সাধারণ মাদ্রসা ও কারিগরি এবং ইংরেজি মাধ্যমের মধ্যে প্রায় ৯০ ভাগ শিক্ষার্থীর লেখা-পড়ানোর দায়িত্ব পালন করছেন বেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা। যাদের সংখ্যা এই মুহূর্তে ৬ লক্ষাধিক। এর মধ্যে মাওশির অধীনে ৩ লক্ষ ৯৮ হাজার, মাদ্রাসার অধীনে ২লক্ষ, এবং কারিগরি শাখায় ২৩ হাজারের মতো।

সমস্যার আসল কারণ বের না করে দায়িত্বপ্রাপ্তরা বলে থাকেন, শিক্ষকতা চাকরি নয় এটা তপস্যা। এজন্য তো সেই সমাজ থাকতে হবে, যে সমাজে জ্ঞানের কদর হয়, যেখানে চিত্তহীন বিত্তের দাপট সেখানে টাকা ছাড়া কাজ পাওয়া যায় না

এবছর এনটিআরসির মাধ্যমে ৪২ হাজার শিক্ষককে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, এরা এমপিওভুক্ত হলে এই সংখ্যাটা আরো বেড়ে যাবে। এদের বেতন ভাতা মাসিক ১২৫০০টাকা, চিকিৎসা ভাতা-৫০০টাকা এবং বাড়িভাড়া আপাতাত ১০০০টাকা। সম্প্রতি ঘোষণা হওয়া ৭.৫% কার্যকর হলে সর্বন্মিœ ২০০০ টাকা এবং জুলাই২৭ থেকে ১৫% হবে। এই শিক্ষকরা ২০১৫ সালের পূর্বে ম্যানেজিং কমিটি বা গভর্নিংবডির মাধ্যমে নিযোগপ্রাপ্ত হতেন, ২০১৫ সালের পর এনটিআরসির মাধ্যমে নিবাচিত হয়েছেন। পূর্বের নিয়োগ প্রক্রিয়ায় রাজনীতিকদের দ্বারা গঠিত কমিটির বিরুদ্ধে উতকোচের মাধ্যমে, তুলনামুলক কম মেধার লোক শিক্ষকতায় নিয়োগের অভিযোগ ছিলো । প্রতিষ্ঠান প্রধান সহকারী প্রধানসহ অফিশিয়াল পদে নিয়োগের ক্ষমতা কমিটি হাতে থাকায় প্রতিষ্ঠানে দলীয়করণের অভিযোগ এবং স্থানীয় পর্যায়ে শিক্ষা প্রশাসনে কিছু জটিলতার সৃষ্টি হলে শিক্ষাবিদ ও শিক্ষক সংগঠনের দাবির প্রেক্ষিতে সম্প্রতি বেরসরকারি প্রতিষ্ঠানের সকল পদে এনটিআরসির মাধ্যমে নিয়োগের লক্ষ্যে প্রশাসনিক সকল পদে নিয়োগ প্রক্রিয়া আপাতত বন্ধ করা হয়েছে, নিয়োগ নীতিমালা চুড়ান্ত হলে এনটিসির মাধ্যমে নিয়োগ শুরু হবে।

মানুষের নৈতিকতা, সততা, দেশপ্রেম আজ তলানিতে, শিশু-কিশোর তরুণদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা, কিশোর গ্যাং,আর মাদকের বিস্তার মানসিকভাবেই বিকারগ্রস্থ করছে না, শারিরীকভাবেও দুর্বল করে দিচ্ছে। একদিকে ক্রমবর্ধমান জনশক্তির সামগ্রীক চাহিদা, বিশ্বায়নের অসম প্রতিযোগিতা আর প্রযুক্তির উন্নয়নের সাথে যোগসুত্র সৃষ্টি করতে না পারলে জাতির জন্য ভালো কিছু আশা করার নেই। এমন বাস্তবতায় দক্ষ, কর্মঠ, সৎ ও দেশপ্রেমিক মানুষ সৃষ্টিতে শিক্ষার ভূমিকা নতুনভাবে মূল্যায়ন ও গুরুত্ব দেওয়া সময়ের দাবি। এ দাবি বাস্তবায়নে দেশের নীতি নির্ধারক, রাজনীতিবিদ অর্থনীতিবিদ এবং শিক্ষাবিদদের আন্তরিকতা আর সদিচ্ছা নিয়ে এগিয়ে আসার দরকার। দরকার শিক্ষার দর্শন,অর্থায়ন এবং ব্যবস্থাপনা নিয়ে ভাববার। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিপরীতে ভাববাদী শিক্ষার বিস্তার ঘটিয়ে বেকারত্বেও লাইন বড় করা তৌহিদী জনতার ব্যানারে মব সৃষ্টির সংস্কৃতি দেশের উন্নয়নকে বাধাগ্রস্থ করছে এবং করবে। প্রথম শ্রেণি-মাস্টার্স পর্যন্ত ১৬ বছর ধরে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পরও যদি নৈতিকতা,মূল্যবোধ সততা আর দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ একটি জেনারেশন তৈরি করা না যায় তার জন্যও জবাবদিহি থাকার দরকার। এই জরাবদিহির জন্য পিতা-মাতা,আত্বীয় পরিজন,কমিউনিটির লোকজন ও শিক্ষক সমাজ দায় এড়াতে পারেন না, কারণ এদের পেছনে জনগণের টাকা ব্যয় করতে হয়।

বেতন-ভাতা তুলনামুলকভাবে কম হওয়ায় অধিকতর মেধাবীরা এ পেশায় আসতে চান না আবার যারা আসেন পদোন্নতির সময়ভিত্তিক মূল্যায়নের মাধ্যমে পদোন্নতির বিধান কার্যকর থাকা এবং সারা চাকুরি জীবনে দুটির বেশি পদোন্নতি না থাকায় শেষ পর্যন্ত তাদের এ পেশায় ধরে রাখা যায় না । আর্থিক বঞ্চনার পরও সামাজিক মর্যাদার অবস্থানটি থাকলে তাতে এ পেশায় রাখা সম্ভব ছিলো, কিন্তু সেটিও নেই। এক সময় ছিলো গ্রামীণ জনপদে ছেলে-মেয়ের বিয়ে দিতে পরিবারের লোকজন বলতো দেখতে হবে ঘর নয়তো বর।

সমস্যার আসল কারণ বের না করে দায়িত্বপ্রাপ্তরা বলে থাকেন, শিক্ষকতা চাকরি নয় এটা তপস্যা। এজন্য তো সেই সমাজ থাকতে হবে, যে সমাজে জ্ঞানের কদর হয়, যেখানে চিত্তহীন বিত্তের দাপট সেখানে টাকা ছাড়া কাজ পাওয়া যায় না। ভোগবাদী এবং পূঁজিবাদী সমাজ মানুষের মনোজগতে যে ন্যারেটিভ তৈরি করেছে সেটা রেখে তপস্যার চর্চা করা কঠিন। তাই বলে যারা শিক্ষতার পেশায় আছেন বা আসছেন তাদের চিন্তা শক্তিকে প্রসারিত করতে হবে, জীবিত থেকে জীবন্তের ভূমিকা পালন করতে হবে। কারণ তাদের হাত দিয়ে বের হচ্ছে অসংখ্য আগামীর ভবিষত। দক্ষ,কর্মঠ,সত ও দেশপ্রেমিক ভবিষ্যৎ গঠন না হলে তার দায়িত্ব শিক্ষক সমাজ এড়াতে পারে না। সেইসাথে ২০২৪ সালের জুলাই অভ্যুত্থানের পরে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক ও প্রতিষ্ঠান প্রধানদের হেনস্থা এবং জোর করে পদত্যাগ করানো হয়েছিলো সে সমস্যার এখন পুরোপুরি সমাধান হয়নি, বিপথগামী পেশী শক্তিধারীদেও একজনের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড, পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে এটি সাংবিধানিক অধিকারও বটে তবে আমাদের দেশে সকলের জন্য খাদ্য বস্ত্র শিক্ষা স্বাস্থ্য ও বাসস্থান জনগণের জন্য মৌলিক অধিকার নয়, এগুলি নিশ্চিত করা রাষ্ট্রীয় মৌলিক দায়িত্ব। শিক্ষার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য বাস্তবায়নে আরো কিছু করার আছে, সেটা করতে হবে। তবে বিদ্যমান অবস্থায় যার যেটুকু দায়িত্ব আছে সেটি করা জরুরি। কারিকুলাম সিলেবাস,পাঠদান কার্যক্রমটায় শিক্ষকদের গুরুতাবপূর্ণ ভূমিকা আছে সেটা করতে হবে। নতুন করে যারা শিক্ষকতায় আসছেন তাদের কাজের প্রতি আগ্রহী ও আন্তারিক করে গড়ে তোলার কাজটিও করতে হবে।

ভালো শিক্ষকরা আগে পড়বেন তারপর পড়াবেন। তিনি একই সাথে ছাত্র তারপর শিক্ষক এবং মেন্টর। পড়াবেন এবং অভিজ্ঞতার মাধ্যমে শিখাবেন,সে জন্যই বলা হয় তিনিই ভালো শিক্ষক, যিনি পড়াবেন, দেখাবেন এবং নিজে তার সাথে কাজ করবেন। ছাত্র শিক্ষক সম্পর্ক হবে বন্ধুরমতো ক্লাসগুলি হবে প্রাণবন্ত পাঠদান হবে কর্মশালার মতো। ভয় ও শংকামুক্ত পরিবেশে যেন ছেলে-মেয়েরা শেখে। শ্রেীণ ব্যবস্থাপনা প্যাডাগজি সম্পর্কে ভালো ধারণা শিক্ষার্থীদের সক্ষমতা অনুযায়ী শেখানো ভালো, তুলনামুলকভাবে দূর্বল এবং ভালো শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ নজর রাখা, মনিটরিং, মূল্যায়ন এবং পরবর্তি নির্দেশনা প্রদান করতে হবে। এগুলি করার জন্যই তাকে পড়তে হয় শিখতে হয়, প্রশিক্ষণ নিতে হয়। শিক্ষার্থীদের জাতীয় স্বক্ষমতায় উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করা শিক্ষার্থীতে মান সপ্তম শ্রেণির সমান।

৪২ হাজার শিক্ষককে নিয়োগ দিয়েই ক্লাস রুমে পাঠিয়ে দেওয়া হলো, কোন ধরণের প্রশিক্ষণ ছাড়াই। পুলিশের কনস্টেবল, এএসপি, প্রশাসন ক্যাডারের লোক-জনকে প্রশিক্ষণ ছাড়া কর্মে না পাঠালেও শিক্ষকদের পাঠানো হলো। শিক্ষার গুণগত মানের জন্য এটি ইতিবাচক নয় । শিক্ষার মানে অনুসরণীয় পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে শিক্ষা বিষয়ে পাশ করা লোক ছাড়া শিক্ষতায় আবেদনই করতে পারে না।

আমাদের দেশে প্রাইমারি স্কুলে সিএনএড, মাধ্যমিক শিক্ষায় বিএড, সরকারি কলেজ মিশকদের জন্য বুনিয়াদী প্রশিক্ষণের পর পেশার কাজে পাঠালেও বেসরকারি শিক্ষার ক্ষেত্রে এমন সুযোগ নেই,অথচ এখানেই অধ্যয়ন করে ৯০ ভাগ শিক্ষার্থী। এ বিষয়ে কমিউনিটি, স্বানীয় সরকার এবং সমাজের বিত্তবানদের ভ’মিকা রাখা দরকার । তবে বেসরকারি শিক্ষায় নানান সীমাবদ্ধতা জেনেই যারা এ পেশায় এসেছেন এবং থাকতে চান,তাদের পেশার উৎকর্ষতা সাধন এবং কাজের প্রতি দায়িত্বশীল হওয়া জরুরি। সেজন্য তাদের পেশাদারিত্বের প্রস্তুতির কাজটা শেষ করতে হবে। একজন রাজমিস্ত্রির যেমন জন্যে কড়াই, কাঠমিস্ত্রির জন্য হাতুড়ি-বাঁটাল, ক্ষেতমুজুরের জন্য কাস্তে- মাথাল লাগে, সেরূপ শিক্ষকতার জন্য তার কিছু জিনিস থাকতে হয় এবং তার ব্যবহার করা শিখতে হয়। পড়াশোনা, লেখালেখি, গবেষণা, সেমিনার-সিম্পেজিয়ামে অংশগ্রহন করতে হয়। এটা শারিরীক শ্রমের কোন কাজ নয়, বুদ্ধিবিত্তিক ও মানসিক শ্রমের কাজ। প্রতিষ্ঠানের নির্ধারিত শ্রমের বাইরেও তাকে কাজ করতে হয়, সেজন্য তাদের আর্থিক বিষয়টিতে গুরুত্ব দিতে হয়। এ দেশের জন্য এটা ভাবাই যেন কল্পনা।

মূল্যবোধ অবক্ষয়ের এসমাজে দায়িত্ব-জ্ঞানহীন নানা উক্তির মধ্যে এ কথাটিও উচারিত হচ্ছে আগে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির ঘরগুলি ছিলো কাঁচা আর শিক্ষকেরা ছিলেন পাকা আর বর্তমানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির ঘরগুলি হয়েছে পাকা আর শিক্ষকেরা হয়েছেন কাঁচা। বিষয়টি শিক্ষক সমাজের আত্নমর্যাদার, সেজন্য পেশার দায়িত্ব যেমন যথাযথভাবে পালন করতে হবে তেমনি নিজেদেও আর্থিক ও সামাজিক মর্যাদা রক্ষা এবং বৃদ্ধিও জন্য কাজ করতে হবে।

[লেখক: কলেজ অধ্যক্ষ; যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি]

back to top