alt

মতামত » উপ-সম্পাদকীয়

একতার বাতাসে উড়ুক দক্ষিণ এশিয়ার পতাকা

ফকর উদ্দিন মানিক

: বুধবার, ২৬ নভেম্বর ২০২৫

দক্ষিণ এশিয়া-মানচিত্রে আটটি দেশ। কিন্তু এই অঞ্চলের মানুষ, সংস্কৃতি, ভাষা, খাদ্য, ইতিহাস, নদী, উপত্যকা-সবই যেন একই শিকড়ের বিস্তার। তবুও সীমান্তের রেখা, রাজনৈতিক অবিশ্বাস, সামরিক উত্তেজনা এবং উপনিবেশিক অতীতের বিভাজন এই অঞ্চলকে আজও ভাঙ্গা আয়নার খণ্ড খণ্ড অংশের মতো করে রেখেছে। প্রশ্নটি তাই উঠতেই পারে-ইউরোপ যদি শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে একে অপরের রক্তে নদী বানানোর পরও এক হতে পারে, যুক্তরাষ্ট্র যদি ব্রিটেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেও পরে তার বৃহত্তম কৌশলগত মিত্র হতে পারে, জার্মানি-ফ্রান্স যদি দুই বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতার পরেও হাত ধরতে পারে, তাহলে দক্ষিণ এশিয়া কেন পারে না?

বিশ্বের ইতিহাসে ইউরোপের যুদ্ধের নির্মমতা তুলনাহীন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে নিহত হয়েছিল প্রায় ২ কোটি মানুষ; দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সে সংখ্যা দাঁড়ায় ৭ থেকে ৮ কোটি পর্যন্ত-সম্ভবত মানবসভ্যতার সবচেয়ে অন্ধকার পর্ব। ব্রিটেন-ফ্রান্স, জার্মানি-ফ্রান্স, রাশিয়া-জার্মানি, ইতালি-ইথিওপিয়া-যেখানে তাকানো যায়, সেখানেই রক্তাক্ত পর্ব। তবুও, সেই মহাদেশই আজ গড়ে তুলেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যেখানে মুক্ত ভ্রমণ, অভিন্ন বাজার, মানবাধিকার সুরক্ষা, বিজ্ঞান-প্রযুক্তিতে সহযোগিতা-সবই বাস্তব। একইভাবে জাপান-যে দেশ যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক বোমার আঘাতে ধ্বংসস্তূপ হয়েছিল, আজ তাকেই নিজের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য নিরাপত্তা-সঙ্গী মেনে নিয়েছে। ইতিহাসের ক্ষত মুছে না গেলেও তারা শিখেছে একটি সত্য: ভবিষ্যৎ তৈরির জন্য অতীতের শত্রুতা চিরকালের শিকল হতে পারে না।

এই বাস্তবতার আলোকে দক্ষিণ এশিয়াকে দেখলে প্রশ্ন জাগে-ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভুটান, আফগানিস্তান এবং এমনকি বৃহৎ প্রতিবেশী চীন-এরা কি এক আঞ্চলিক জোটে একত্র হতে পারে না? শুধু আবেগ নয়, বাস্তবতার আলোচনাও প্রয়োজন। অর্থনৈতিক হিসাব বলছে, চীনসহ দক্ষিণ এশিয়া যদি ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো একটি অর্থনৈতিক জোট গঠন করতে পারে, তবে বিশ্বের সর্ববৃহৎ বাজারগুলোর একটি গড়ে উঠবে। প্রায় সাড়ে তিনশ কোটি মানুষের সম্মিলিত বাজার, বিপুল মানবসম্পদ, কৃষি-শিল্প-পর্যটনের অসীম সম্ভাবনা-এগুলো একত্র হলে পৃথিবীর অর্থনৈতিক নেতৃত্ব এশিয়ার হাতেই চলে আসতে পারে।

ঐতিহাসিকভাবে ভারত-পাকিস্তান বৈরিতাই আঞ্চলিক অগ্রগতির সবচেয়ে বড় বাধা। কাশ্মীর নিয়ে যুদ্ধ, সীমান্ত উত্তেজনা, অস্ত্র প্রতিযোগিতা-সব মিলিয়ে দুই দেশ নিজেদেরই ক্ষত তৈরি করেছে। কিন্তু মনে রাখা জরুরি-ইউরোপের যেসব দেশ আজ একক মুদ্রায় বাণিজ্য করে, তারাই পরস্পরের বিরুদ্ধে শতাব্দীর পর শতাব্দী যুদ্ধ করেছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সোম নদীর যুদ্ধেই নিহত হয়েছিল ১০ লাখ যুবক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের স্টালিনগ্রাদ ছিল মানব ইতিহাসের নির্মমতম রণক্ষেত্র। এই দুই গণহত্যার পরও তারা শান্তির পথে হাঁটতে পেরেছে। কারণ তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল-ঘৃণার মাটিতে সমাধি গড়ে তোলা বন্ধ করে উন্নয়নের বীজ বোনা শুরু করতে হবে।

দক্ষিণ এশিয়ায় অনেকেই যুক্তি দেন-চীন-ভারত প্রতিদ্বন্দ্বিতা, পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা, ভারতের আকারের বৈষম্য-এসবের কারণে ঐক্য বাস্তবসম্মত নয়। কিন্তু একই যুক্তি ইউরোপেও ছিল। জার্মানি অর্থনৈতিক দানব-গ্রিস দেউলিয়া; পোল্যান্ড-হাঙ্গেরির নেতৃত্বে রাজনৈতিক অস্থিরতা, ব্রিটেনের ব্রেক্সিট-সবই বিভাজনের গল্প। কিন্তু তবুও ইউরোপ একটি ‘কমন প্ল্যাটফর্ম’ বজায় রাখতে পেরেছে, কারণ তাদের কৌশলগত স্বার্থ-অর্থনীতি, নিরাপত্তা ও বিশ্ব রাজনীতিতে শক্তি অর্জন-এক ছিল।

দক্ষিণ এশিয়ারও তেমন যৌথ স্বার্থ রয়েছে। প্রথমত, অর্থনীতি। ভারত চীনের পর বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম জনসংখ্যাবহুল দেশ; পাকিস্তানের ভৌগোলিক অবস্থান বাণিজ্যের কেন্দ্র; চীনের প্রযুক্তি-শিল্প সাম্প্রতিক দশকে বিশ্বকে বদলে দিয়েছে; বাংলাদেশ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারক এবং দ্রুত-বর্ধনশীল অর্থনীতি। এগুলো যদি এক অর্থনৈতিক জোটে যুক্ত হয়-পরিবহন করিডর, জ্বালানি গ্রিড, অভিন্ন বাণিজ্যনীতি-তাহলে দক্ষিণ এশিয়া হবে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী উৎপাদন ও সাপ্লাই-চেইন কেন্দ্র।

দ্বিতীয়ত, নিরাপত্তা। ভারত-চীন উত্তেজনা, আফগানিস্তানের অস্থিতিশীলতা, পাকিস্তানের সন্ত্রাসবিরোধী সংগ্রাম-এই সমস্যাগুলো প্রতিটি দেশকে দুর্বল করে। একটি “দক্ষিণ এশীয় নিরাপত্তা চুক্তি” যদি ন্যাটোর মতো গঠিত হয়, তবে এই অঞ্চল বাইরের সামরিক প্রভাব থেকে মুক্ত হতে পারে এবং নিজেদের সিদ্ধান্ত নিজে নিতে পারে। ইউরোপ যেমন বুঝেছিল, নিরাপত্তা সহযোগিতা না থাকলে স্থায়ী উন্নয়ন সম্ভব নয়; দক্ষিণ এশিয়ার ক্ষেত্রেও বিষয়টি সত্য।

তৃতীয়ত, জলবায়ু সংকট। হিমালয় গলছে, নদী বদলাচ্ছে, ঘূর্ণিঝড়-বন্যা-খরা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এটি কোনো এক দেশের সমস্যা নয়; এটি পুরো অঞ্চলের অস্তিত্বসঙ্কট। ভবিষ্যতে পানির জন্য যুদ্ধ এড়াতে চাইলে এ অঞ্চলের দেশগুলোর সমন্বিত নদী ব্যবস্থাপনা, জল-সম্পদ ভাগাভাগি, পরিবেশনীতি-সব এক ফ্রেমওয়ার্কে আনতেই হবে। তাহলে কি দক্ষিণ এশীয় ঐক্য আজকের দিনে সম্ভব? উত্তরটি সরল নয়; তবে অসম্ভবও নয়।

একদা যেসব দেশ ইউরোপে অসংখ্য যুদ্ধক্ষেত্র তৈরি করেছিল, আজ তারা অভিন্ন পতাকার নিচে দাঁড়াতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র ব্রিটেনকে পরাজিত করেও তার ঘনিষ্ঠতম মিত্র হতে পারে। জাপান-যে দেশ যুক্তরাষ্ট্রের হাতে পারমাণবিক বোমায় বিধ্বস্ত হয়েছিল-আজ শান্তি চুক্তিতে তাদের কৌশলগত শক্তি ভাগ করে। ইতিহাস বারবার প্রমাণ করেছে-অতীতের ক্ষত ভবিষ্যতের শত্রু নয়; প্রকৃত শত্রু হলো অবিশ্বাস, অহংকার ও সংকীর্ণতা।

দক্ষিণ এশিয়া যদি একই পথ ধরে হাঁটতে পারে, তবে এটি শুধু অর্থনৈতিক শক্তি হবে না-একটি নতুন সভ্যতার পুনর্জাগরণ ঘটতে পারে। ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশ-চীন যদি নিজেদের প্রতিদ্বন্দ্বিতার ওপর উঠে কৌশলগত গভীরতা তৈরি করে, তবে পৃথিবীর শক্তির ভারসাম্য পশ্চিম থেকে পূর্বে স্থায়ীভাবে সরতে বাধ্য। প্রযুক্তি, বাণিজ্য, প্রতিরক্ষা, গবেষণা-সব ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়া হয়ে উঠতে পারে মানবসভ্যতার নতুন নেতৃত্ব।

এই অঞ্চলের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে একটাই প্রশ্ন-অতীত আমাদের নিয়ন্ত্রণ করবে, নাকি আমরা অতীতকে অতিক্রম করব?

ইউরোপ বার্তা দিয়েছে-যুদ্ধের ধ্বংস থেকে শান্তির মহাসড়ক তৈরি করা যায়, যদি রাজনৈতিক ইচ্ছা, নেতৃত্বের প্রজ্ঞা এবং জনগণের আকাক্সক্ষা একসঙ্গে কাজ করে। দক্ষিণ এশিয়াও তেমন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। হয় আমরা বিভাজনের ইতিহাস ধরে রেখে নিজেদের দুর্বল করে দেব, নয়তো আমরা মানচিত্রের রেখাকে অতিক্রম করে মানুষের স্বপ্নকে নতুন শক্তির ভিত্তিতে রূপ দেব।

বিশ্ব এখন বহুমেরু; নতুন জোট গঠনের সময় এসেছে। দক্ষিণ এশিয়া যদি সত্যিই এক হতে পারে-কমপক্ষে একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক–অর্থনৈতিক জোট হিসেবে-তবে বিশ্বের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ হবে দিল্লি, ঢাকা, ইসলামাবাদ, বেইজিং ও কাঠমাণ্ডুর সিদ্ধান্তে। আর হয়তো একদিন ইতিহাস লিখবে-অতীতের দেয়াল ভেঙে দক্ষিণ এশিয়া নতুন সময়ের স্থপতি হয়ে উঠেছিল।

(মতামত লেখকের নিজস্ব)

[লেখক: সভাপতি, কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগ এলামনাই এসোসিয়েশন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়]

ছবি

স্মরণ: শহীদ ডা. মিলন ও বৈষম্যহীন ব্যবস্থার সংগ্রাম

মনে পুরানো দিনের কথা আসে, মনে আসে, ফিরে আসে...

রাসায়নিক দূষণ ও ক্যান্সারের ঝুঁকি

আছদগঞ্জের শুটকি : অতীতের গৌরব, বর্তমানের দুঃসময়

নবান্নের আনন্দ ও আমনের ফলন

‘প্রশ্ন কোরো না, প্রশ্ন সর্বনাশী’

ভূমিকম্প, অর্থনৈতিক চাপ এবং অনিশ্চয়তা: মানসিকতার নতুন অর্থনীতি

নবম পে স্কেল ও এর আর্থসামাজিক প্রভাব

মৃত্যুদণ্ড, তারপর...

জমির ভুয়া দলিল কীভাবে বাতিল করবেন?

জুলাই সনদ আদিবাসীদের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি

ব্যাংকের দুরবস্থা থামানো যাচ্ছে না কেন

আমন ধানে ব্রাউন প্ল্যান্টহপারের প্রাদুর্ভাব

বৈষম্য, অপচয় ও খাদ্যনিরাপত্তার সংকট

“বাঙালি আমরা, নহিতো...”

নারী নির্যাতন, মানসিক স্বাস্থ্য এবং সমাজের দায়

কাঁপছে ডলারের সিংহাসন

ত্রিশতম জলবায়ু সম্মেলন : প্রতীকী প্রদর্শনী, নাকি বৈশ্বিক জলবায়ু রাজনীতির বাঁক নেওয়ার মুহূর্ত?

অপরিণত নবজাতক : ঝুঁকি, প্রতিরোধ ও যত্নের জরুরি বাস্তবতা

বাংলাদেশী উত্তরাধিকার: প্রবাস-জীবন ও আমাদের সংস্কৃতি

রাজনীতিতে ভাষার সহনীয় প্রয়োগ

ভারত : এসআইআর এবং সাম্প্রদায়িক বিভাজন

মনে কী দ্বিধা নিয়ে...

নিরাপদ সড়ক ভাবনা

অপরিকল্পিত বাঁধ-শিল্পায়নে বিপর্যস্ত বরেন্দ্র কৃষি

ছবি

মামদানি দেখালেন নেতৃত্বের মূল পরিচয় কী

চেকের মামলায় বৈধ বিনিময়, লেনদেন, দেনা-পাওনা প্রমাণ ছাড়া আর জেল নয়

নবাগত শিক্ষকদের পেশাগত ভাবনা

মাদকাসক্তি: শুধু নিরাময় নয়, চাই সমাজ ব্যবস্থার সংস্কার

আমেরিকার “নো কিংস” আন্দোলন

ঘি তো আমাদের লাগবেই, নো হাংকি পাংকি!

“মামদানি না জামদানি...”

ভাষার বৈচিত্র্য রক্ষায় নীরব বিপ্লব

উপাত্ত সুরক্ষা আইন : গোপনীয়তা রক্ষা নাকি রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ?

সমতা কি ন্যায্যতা নিশ্চিত করে?

ডেঙ্গু সংকট দূরদৃষ্টির ব্যর্থতা

tab

মতামত » উপ-সম্পাদকীয়

একতার বাতাসে উড়ুক দক্ষিণ এশিয়ার পতাকা

ফকর উদ্দিন মানিক

বুধবার, ২৬ নভেম্বর ২০২৫

দক্ষিণ এশিয়া-মানচিত্রে আটটি দেশ। কিন্তু এই অঞ্চলের মানুষ, সংস্কৃতি, ভাষা, খাদ্য, ইতিহাস, নদী, উপত্যকা-সবই যেন একই শিকড়ের বিস্তার। তবুও সীমান্তের রেখা, রাজনৈতিক অবিশ্বাস, সামরিক উত্তেজনা এবং উপনিবেশিক অতীতের বিভাজন এই অঞ্চলকে আজও ভাঙ্গা আয়নার খণ্ড খণ্ড অংশের মতো করে রেখেছে। প্রশ্নটি তাই উঠতেই পারে-ইউরোপ যদি শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে একে অপরের রক্তে নদী বানানোর পরও এক হতে পারে, যুক্তরাষ্ট্র যদি ব্রিটেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেও পরে তার বৃহত্তম কৌশলগত মিত্র হতে পারে, জার্মানি-ফ্রান্স যদি দুই বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতার পরেও হাত ধরতে পারে, তাহলে দক্ষিণ এশিয়া কেন পারে না?

বিশ্বের ইতিহাসে ইউরোপের যুদ্ধের নির্মমতা তুলনাহীন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে নিহত হয়েছিল প্রায় ২ কোটি মানুষ; দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সে সংখ্যা দাঁড়ায় ৭ থেকে ৮ কোটি পর্যন্ত-সম্ভবত মানবসভ্যতার সবচেয়ে অন্ধকার পর্ব। ব্রিটেন-ফ্রান্স, জার্মানি-ফ্রান্স, রাশিয়া-জার্মানি, ইতালি-ইথিওপিয়া-যেখানে তাকানো যায়, সেখানেই রক্তাক্ত পর্ব। তবুও, সেই মহাদেশই আজ গড়ে তুলেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যেখানে মুক্ত ভ্রমণ, অভিন্ন বাজার, মানবাধিকার সুরক্ষা, বিজ্ঞান-প্রযুক্তিতে সহযোগিতা-সবই বাস্তব। একইভাবে জাপান-যে দেশ যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক বোমার আঘাতে ধ্বংসস্তূপ হয়েছিল, আজ তাকেই নিজের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য নিরাপত্তা-সঙ্গী মেনে নিয়েছে। ইতিহাসের ক্ষত মুছে না গেলেও তারা শিখেছে একটি সত্য: ভবিষ্যৎ তৈরির জন্য অতীতের শত্রুতা চিরকালের শিকল হতে পারে না।

এই বাস্তবতার আলোকে দক্ষিণ এশিয়াকে দেখলে প্রশ্ন জাগে-ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভুটান, আফগানিস্তান এবং এমনকি বৃহৎ প্রতিবেশী চীন-এরা কি এক আঞ্চলিক জোটে একত্র হতে পারে না? শুধু আবেগ নয়, বাস্তবতার আলোচনাও প্রয়োজন। অর্থনৈতিক হিসাব বলছে, চীনসহ দক্ষিণ এশিয়া যদি ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো একটি অর্থনৈতিক জোট গঠন করতে পারে, তবে বিশ্বের সর্ববৃহৎ বাজারগুলোর একটি গড়ে উঠবে। প্রায় সাড়ে তিনশ কোটি মানুষের সম্মিলিত বাজার, বিপুল মানবসম্পদ, কৃষি-শিল্প-পর্যটনের অসীম সম্ভাবনা-এগুলো একত্র হলে পৃথিবীর অর্থনৈতিক নেতৃত্ব এশিয়ার হাতেই চলে আসতে পারে।

ঐতিহাসিকভাবে ভারত-পাকিস্তান বৈরিতাই আঞ্চলিক অগ্রগতির সবচেয়ে বড় বাধা। কাশ্মীর নিয়ে যুদ্ধ, সীমান্ত উত্তেজনা, অস্ত্র প্রতিযোগিতা-সব মিলিয়ে দুই দেশ নিজেদেরই ক্ষত তৈরি করেছে। কিন্তু মনে রাখা জরুরি-ইউরোপের যেসব দেশ আজ একক মুদ্রায় বাণিজ্য করে, তারাই পরস্পরের বিরুদ্ধে শতাব্দীর পর শতাব্দী যুদ্ধ করেছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সোম নদীর যুদ্ধেই নিহত হয়েছিল ১০ লাখ যুবক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের স্টালিনগ্রাদ ছিল মানব ইতিহাসের নির্মমতম রণক্ষেত্র। এই দুই গণহত্যার পরও তারা শান্তির পথে হাঁটতে পেরেছে। কারণ তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল-ঘৃণার মাটিতে সমাধি গড়ে তোলা বন্ধ করে উন্নয়নের বীজ বোনা শুরু করতে হবে।

দক্ষিণ এশিয়ায় অনেকেই যুক্তি দেন-চীন-ভারত প্রতিদ্বন্দ্বিতা, পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা, ভারতের আকারের বৈষম্য-এসবের কারণে ঐক্য বাস্তবসম্মত নয়। কিন্তু একই যুক্তি ইউরোপেও ছিল। জার্মানি অর্থনৈতিক দানব-গ্রিস দেউলিয়া; পোল্যান্ড-হাঙ্গেরির নেতৃত্বে রাজনৈতিক অস্থিরতা, ব্রিটেনের ব্রেক্সিট-সবই বিভাজনের গল্প। কিন্তু তবুও ইউরোপ একটি ‘কমন প্ল্যাটফর্ম’ বজায় রাখতে পেরেছে, কারণ তাদের কৌশলগত স্বার্থ-অর্থনীতি, নিরাপত্তা ও বিশ্ব রাজনীতিতে শক্তি অর্জন-এক ছিল।

দক্ষিণ এশিয়ারও তেমন যৌথ স্বার্থ রয়েছে। প্রথমত, অর্থনীতি। ভারত চীনের পর বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম জনসংখ্যাবহুল দেশ; পাকিস্তানের ভৌগোলিক অবস্থান বাণিজ্যের কেন্দ্র; চীনের প্রযুক্তি-শিল্প সাম্প্রতিক দশকে বিশ্বকে বদলে দিয়েছে; বাংলাদেশ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারক এবং দ্রুত-বর্ধনশীল অর্থনীতি। এগুলো যদি এক অর্থনৈতিক জোটে যুক্ত হয়-পরিবহন করিডর, জ্বালানি গ্রিড, অভিন্ন বাণিজ্যনীতি-তাহলে দক্ষিণ এশিয়া হবে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী উৎপাদন ও সাপ্লাই-চেইন কেন্দ্র।

দ্বিতীয়ত, নিরাপত্তা। ভারত-চীন উত্তেজনা, আফগানিস্তানের অস্থিতিশীলতা, পাকিস্তানের সন্ত্রাসবিরোধী সংগ্রাম-এই সমস্যাগুলো প্রতিটি দেশকে দুর্বল করে। একটি “দক্ষিণ এশীয় নিরাপত্তা চুক্তি” যদি ন্যাটোর মতো গঠিত হয়, তবে এই অঞ্চল বাইরের সামরিক প্রভাব থেকে মুক্ত হতে পারে এবং নিজেদের সিদ্ধান্ত নিজে নিতে পারে। ইউরোপ যেমন বুঝেছিল, নিরাপত্তা সহযোগিতা না থাকলে স্থায়ী উন্নয়ন সম্ভব নয়; দক্ষিণ এশিয়ার ক্ষেত্রেও বিষয়টি সত্য।

তৃতীয়ত, জলবায়ু সংকট। হিমালয় গলছে, নদী বদলাচ্ছে, ঘূর্ণিঝড়-বন্যা-খরা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এটি কোনো এক দেশের সমস্যা নয়; এটি পুরো অঞ্চলের অস্তিত্বসঙ্কট। ভবিষ্যতে পানির জন্য যুদ্ধ এড়াতে চাইলে এ অঞ্চলের দেশগুলোর সমন্বিত নদী ব্যবস্থাপনা, জল-সম্পদ ভাগাভাগি, পরিবেশনীতি-সব এক ফ্রেমওয়ার্কে আনতেই হবে। তাহলে কি দক্ষিণ এশীয় ঐক্য আজকের দিনে সম্ভব? উত্তরটি সরল নয়; তবে অসম্ভবও নয়।

একদা যেসব দেশ ইউরোপে অসংখ্য যুদ্ধক্ষেত্র তৈরি করেছিল, আজ তারা অভিন্ন পতাকার নিচে দাঁড়াতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র ব্রিটেনকে পরাজিত করেও তার ঘনিষ্ঠতম মিত্র হতে পারে। জাপান-যে দেশ যুক্তরাষ্ট্রের হাতে পারমাণবিক বোমায় বিধ্বস্ত হয়েছিল-আজ শান্তি চুক্তিতে তাদের কৌশলগত শক্তি ভাগ করে। ইতিহাস বারবার প্রমাণ করেছে-অতীতের ক্ষত ভবিষ্যতের শত্রু নয়; প্রকৃত শত্রু হলো অবিশ্বাস, অহংকার ও সংকীর্ণতা।

দক্ষিণ এশিয়া যদি একই পথ ধরে হাঁটতে পারে, তবে এটি শুধু অর্থনৈতিক শক্তি হবে না-একটি নতুন সভ্যতার পুনর্জাগরণ ঘটতে পারে। ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশ-চীন যদি নিজেদের প্রতিদ্বন্দ্বিতার ওপর উঠে কৌশলগত গভীরতা তৈরি করে, তবে পৃথিবীর শক্তির ভারসাম্য পশ্চিম থেকে পূর্বে স্থায়ীভাবে সরতে বাধ্য। প্রযুক্তি, বাণিজ্য, প্রতিরক্ষা, গবেষণা-সব ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়া হয়ে উঠতে পারে মানবসভ্যতার নতুন নেতৃত্ব।

এই অঞ্চলের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে একটাই প্রশ্ন-অতীত আমাদের নিয়ন্ত্রণ করবে, নাকি আমরা অতীতকে অতিক্রম করব?

ইউরোপ বার্তা দিয়েছে-যুদ্ধের ধ্বংস থেকে শান্তির মহাসড়ক তৈরি করা যায়, যদি রাজনৈতিক ইচ্ছা, নেতৃত্বের প্রজ্ঞা এবং জনগণের আকাক্সক্ষা একসঙ্গে কাজ করে। দক্ষিণ এশিয়াও তেমন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। হয় আমরা বিভাজনের ইতিহাস ধরে রেখে নিজেদের দুর্বল করে দেব, নয়তো আমরা মানচিত্রের রেখাকে অতিক্রম করে মানুষের স্বপ্নকে নতুন শক্তির ভিত্তিতে রূপ দেব।

বিশ্ব এখন বহুমেরু; নতুন জোট গঠনের সময় এসেছে। দক্ষিণ এশিয়া যদি সত্যিই এক হতে পারে-কমপক্ষে একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক–অর্থনৈতিক জোট হিসেবে-তবে বিশ্বের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ হবে দিল্লি, ঢাকা, ইসলামাবাদ, বেইজিং ও কাঠমাণ্ডুর সিদ্ধান্তে। আর হয়তো একদিন ইতিহাস লিখবে-অতীতের দেয়াল ভেঙে দক্ষিণ এশিয়া নতুন সময়ের স্থপতি হয়ে উঠেছিল।

(মতামত লেখকের নিজস্ব)

[লেখক: সভাপতি, কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগ এলামনাই এসোসিয়েশন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়]

back to top