alt

মতামত » উপ-সম্পাদকীয়

আইসিইউ থেকে বাড়ি ফেরা ও খাদের কিনারায় থাকা দেশ

মোহাম্মদ আবু নোমান

: সোমবার, ০১ ডিসেম্বর ২০২৫

চাকরি হারানো কিংবা আয় রোজগার কমে যাওয়ার কারণে দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যায় মানুষ। কিংবা গরিব থেকে আরও গরিব বা ‘অতি গরিব’ হয়ে যায়। বিশ্বব্যাংকের হিসাবটি বিবেচনায় আনলে ২০২৫ সাল শেষে উক্ত ‘অতি গরিব’ মানুষের সংখ্যাই হবে ১ কোটি ৫৮ লাখের মতো। অন্যদিকে জাতীয় দারিদ্র্য হার বা গরিব মানুষের সংখ্যা হবে ৩ কোটি ৯০ লাখ। কি বেদনা ও যন্ত্রণাদায়ক তথ্য, দেশে ‘অতি গরিব’ মানুষের সংখ্যা ১ কোটি ৫৮ লাখ!

সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের ‘বাংলাদেশের দারিদ্র্য ও বৈষম্য মূল্যায়ন ২০২৫’ প্রতিবেদনে যে উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তাজনক তথ্য উঠে এসেছে, যা আমাদের গভীরভাবে ভাবিয়ে তোলার জন্য যথেষ্ট। গবেষণায় এসেছে, দেশের মোট জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশ বা ৬ কোটি ২০ লাখ মানুষ দারিদ্র্যের ঝুঁকিতে রয়েছে। এই পরিসংখ্যান কেবল একটি সংখ্যা জপেই শেষ করার বিষয় কী? বরং এর মধ্যে রয়েছে কোটি মানুষের অতি দারিদ্রতা, ক্ষুধা, দুর্ভিক্ষ, অনাহার, অর্ধাহার, ধুকে-ধুকে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর দুয়ারে চলে যাওয়ার রেকর্ডও। যখন গরীবের কাজ নেই, পেটে ভাত নেই; তখন তাদের জন্য রিজার্ভ, ডলার, জিডিপি এগুলোর মূল্য কত?

যাদের প্রতি মাসের আয়ের পুরোটাই সংসার চালাতে খরচ হয়ে যায়। কিন্তু এর উপর যখন জিনিসপত্রের দাম বাড়ে, অথচ সে অনুযায়ী আয় না বাড়লে তাকে ধারদেনা করে সংসার চালাতে হয়, কিংবা খাবার, কাপড়চোপড়, যাতায়াতসহ বিভিন্ন খাতে কাটছাঁট করতে হবে। এতে সাধারণ মানুষের কষ্ট বাড়ার সাথে দ্রুতই দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যায়। মৌলিক জীবনধারণ অর্থাৎ, অতি প্রয়োজনীয় খাদ্য ও চিকিৎসা মেটাতে তাদের প্রাণ যায়যায় অবস্থা। যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা পরিবারের কেউ অসুস্থ হলে, সে ধাক্কা সামাল দেয়ার মতো সামর্থ থাকে না। বাংলাদেশে এরকম প্রায় ৫০ শতাংশ পরিবার যেকোনো সময় দরিদ্র হওয়ার ঝুঁকিতে থাকে।

মানুষের মধ্যে কখনো দারিদ্র্য বাড়ে, আবার তা কমে। কিন্তু সমস্যা তখনই হয়, যখন তা দীর্ঘমেয়াদী হয়। সাধারণ মানুষ কষ্টের মধ্যেও অনেক সময় পেট বেঁধে সাময়িকভাবে কিছু বিষয় মানিয়ে নেয়। যেমন কম পণ্য কেনা, কম খাওয়া। এ রকমটা চলতে পারে দুই এক মাস। কিন্তু এ অবস্থা যখন দীর্ঘমেয়াদি হয়, তখন মানুষের কষ্টের সীমা থাকে না। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর প্রায় ১৬ মাস অতিবাহিত হয়েছে। দেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর পরিবর্তে আরো বেশি দুর্বল হচ্ছে। শান্তি-স্বস্তির বদলে অস্থিরতা-উত্তেজনা বেড়েই চলেছে।

বিনিয়োগে স্থবিরতা, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, উচ্চ সুদের হারসহ নানা কারণে ধুঁকছে অর্থনীতি, ধুঁকছে শিল্প, ব্যবসা, বিনিয়োগ। এক প্রকার নীরব মন্দায় আক্রান্ত দেশ। অসংখ্য কারখানা এরই মধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে, কাজ হারিয়েছেন বিপুলসংখ্যক কর্মী। নতুন বিনিয়োগ না থাকায় নতুন কর্মসংস্থান হচ্ছে না। দ্রুত বাড়ছে বেকারের সংখ্যা। ব্যবসা-বাণিজ্যের গতি হারানোর প্রভাব সরাসরি পড়েছে সরকারের রাজস্ব আয়ে। চলতি অর্থবছরের চার মাসেই রাজস্ব ঘাটতি ১৭ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। সমস্যাগ্রস্ত করদাতারা ঠিকমতো করও দিতে পারছেন না। সর্বশেষ হিসাবে রিটার্ন জমা দেওয়া করদাতাদের মধ্যে ৮৮ শতাংশই শূন্য রিটার্ন জমা দিয়েছে, অর্থাৎ তারা কোনো কর দেয়নি। ভ্যাট বিভাগের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা গণমাধ্যমকে বলেছেন, মানুষের আয় কমে যাওয়ায় ভোগ কমেছে। প্রতিষ্ঠানগুলো কমিয়েছে উৎপাদন। আগের তুলনায় পণ্যের দাম বাড়লেও বিক্রি কমায় ভ্যাট আদায় কমেছে।

ব্যবসায়ী-অর্থনীতিবিদরা বলছেন, অনিশ্চয়তার কারণে আন্তর্জাতিক ক্রেতারা নতুন অর্ডার দিতে দ্বিধাগ্রস্ত হচ্ছেন। আইন-শৃঙ্খলা ও ব্যবসায় পরিবেশের উন্নতি আর রাজনৈতিক সরকার না আসা পর্যন্ত অর্থনীতিতে গতি ফিরবে না। রাজস্ব আদায় চাঙ্গা করতে গেলে ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগে চাঙ্গাভাব ফিরিয়ে আনতে হবে। অর্থনীতি গতিশীল না হলে রাজস্ব আদায় বাড়বে না।

ঢাকার উপকণ্ঠে শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্যে চাঁদাবাজির ভয়াবহ থাবার কথা গণমাধ্যমে উঠে এসেছে। মিরপুর ১২ নম্বরের একটি পোশাক কারখানার মালিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আমাকে প্রতি মাসে মোটা অঙ্কের চাঁদা দিতে হয়। শীর্ষ সন্ত্রাসীদের পাশাপাশি বর্তমানে স্থানীয় কিছু মাস্তান রাজনৈতিক পরিচয়ে নিয়মিত চাঁদা নিচ্ছে। পুলিশের কাছে অভিযোগ করেও তেমন সহায়তা পাওয়া যায় না। প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন ব্যক্তিদের জানিয়েও সুরাহা পাইনি।’ তিনি জানান, কারখানার কিছু পদে তাদের পছন্দের লোকদের নিয়োগ দিতে হয়েছে। চাঁদার টাকা দিতে দেরি হলেই তারা কারখানার নিচে মহড়া দেয়। প্রাণনাশের হুমকি দেয়। একইভাবে গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ ও সাভার এলাকায় গার্মেন্টসসহ আরো অনেক কারখানা ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে বিপুল চাঁদাবাজির অভিযোগ পাওয়া গেছে।

ইতিপূর্বে বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিশিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) এক গবেষণায় দারিদ্র্য বৃদ্ধির চিত্র প্রকাশ করেছে। সেখানে দেখা গেছে, একটি পরিবারের মাসের মোট খরচের প্রায় ৫৫ শতাংশ চলে যায় শুধু খাবার কেনায়। এর বাইরে শিক্ষা ও চিকিৎসার ব্যয়তো রয়েছেই। দীর্ঘস্থায়ী রোগের কারণে পরিবারগুলোকে চিকিৎসার পেছনে বাড়তি ব্যয় করতে হচ্ছে, যাতে আবার তাদের ঋণের বোঝা বাড়ছে। পিপিআরসির গবেষণায় বলা হয়েছে বর্তমানে দেশের প্রতি ৪ জনের ১ জন গরিব। আরও ব্যাপক মানুষ এমন আর্থিক অবস্থায় রয়েছেন যে, অসুস্থতা বা অন্য কোনো সংকটে তারা গরিব থেকে ‘অতি গরিব’ হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছেন।

পিপিআরসির গবেষণায় দেখা যায়, দেশের সবচেয়ে দরিদ্র অনেক পরিবারের সদস্যরা সপ্তাহে একাধিক বেলা কিংবা মাসে অন্তত একদিন একেবারেই না খেয়ে থাকছেন। দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩২ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। এর সঙ্গে ডলারের দর স্থিতিশীল রাখার গভীর সম্পর্ক আছে। রিজার্ভ বৃদ্ধির পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা ছিল প্রবাসী আয়ের। এছাড়া রপ্তানি আয়ের সাথে আমদানি নিয়ন্ত্রণের কারণে ডলারের চাহিদাও কম ছিল বলে রিজার্ভ বেড়েছে। বিনিয়োগহীন রাষ্ট্রে এই রিজার্ভ নিয়ে আমরা কী করব? রোগী ডাক্তারের কাছে পেট ব্যাথা নিয়ে গেল, ডাক্তার ওষুধ দিল এবং তা খেয়ে রোগী মরে গেল! এখন ডাক্তার যদি বলে, রোগীর পেট ব্যাথা ভাল হয়ে গেছে; এতে খুশি হওয়া আর গরিবের পেটে ক্ষুধার সাথে রিজার্ভ বাড়ছে বলে খুশি হওয়া একই কথা নয় কী? বিনিয়োগ নেই তাই রিজার্ভের স্বাস্থ্য মোটামুটি ভালো! এই রিজার্ভ নি¤œআয়ের মানুষের কী কাজে আসছে।

বেসরকারি খাত স্থবির, কোনো বিনিয়োগ নেই। শিল্পের উৎপাদন সংকুচিত। একে একে কারখানা বন্ধ হচ্ছে। উচ্চ সুদে কেউ ব্যবসার প্রসার ঘটাতে চাচ্ছেন না, আবার নতুন কারখানায়ও বিনিয়োগ করছেন না। অর্থাৎ কেনাকাটাই হচ্ছে না ঠিকমতো। সাধারণেরও সীমিত আয়ের বিপরীতে উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে পণ্যের চাহিদা ও ভোগ ব্যয় কমে গেছে, যার ফলে কমছে আমদানি। বিশেষ করে শিল্পের কাঁচামাল, যন্ত্রপাতি ও যন্ত্রাংশ আমদানি কমছেই। এ কারণে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়েছে। কিন্তু তা সামগ্রিক অর্থনীতির জন্য কতটা স্বস্তিদায়ক?

অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছরের সাফল্য নিয়ে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ আত্মতুষ্টির এক চমকপ্রদ বাণী দিয়েছিলেন। অর্থনীতি নাকি ‘আইসিইউ থেকে কেবিনে গিয়ে এত দিনে বাড়ি ফিরে আসছে’। এছাড়াও বলেছিলেন, ‘খাদের কিনারা থেকে ঘুরে দাঁড়িয়েছে দেশের অর্থনীতি।’ তিনি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ছিলেন বিধায় তার মতো একজন বিশেষজ্ঞের মন্তব্য গুরুত্বের সঙ্গে মাপা উচিত। আওয়ামী আমলে তিনি অর্থনীতি বিশেষজ্ঞের বাইরেও ‘পলিসি এক্সপার্ট’ হিসেবে অজস্র মন্তব্য রাখলেও তখন যে অর্থনীতি আইসিইউতে, খাদের কিনারে চলে গিয়েছিল, এ রকম কোনো বিশ্লেষণ প্রকাশ করেননি।

সম্পতি পিপিআরসি গবেষণা এসেছে, দেশের ৮০ শতাংশ পরিবার সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছে। ৪০ শতাংশ পরিবারের গড় আয় ১৪,৮৮১ টাকা, যেখানে খরচ ১৭,৩৮৭ টাকা। ঋণের ওপর নির্ভরশীল ৫২ শতাংশ পরিবার, যাদের এক-তৃতীয়াংশ সংসার খরচ মেটাতে ঋণ নেয়। এছাড়া দারিদ্র্যের হার ১৮.৭ শতাংশ থেকে বেড়ে ২২.২ শতাংশে পৌঁছানোর আশঙ্কা তৈরি হওয়ার তথ্যে কী প্রমাণ হয়? অর্থনীতি আর খাদের কিনারে নেই; না এখন খাদেই...। এই হলো আমাদের আইসিইউ থেকে বাড়ি ফেরা ও খাদের কিনারায় থাকা বাংলাদেশ।

যে দেশে বাংক লুট হয় সরকারি মদদে সেখানে কোন বিদেশী ইনভেষ্ট করতে ১০ বার ভেবে নিবে। অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে কেউই বিনিয়োগের ঝুঁকি নিবে না, এটি বুঝতে অর্থনীতির পণ্ডিত হওয়া লাগে কী? কোন উসিলায় যখন বহুজাতিক বা দেশীয় রপ্তানীযোগ্য কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে মব ভায়োলেন্সের রিউমারে দিনের পর দিন ধরে লুটপাট, অগ্নিসংযোগ করা হয়, তখন বিদেশি বিনিয়োগ আশা করা যায় কী? অথচ বাংলাদেশের মতো দেশে বিদেশি বিনিয়োগ অত্যন্ত জরুরি! রাজনীতিবিদরা দেশ নিয়ে কি ভাবছেন এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ! একটি ভালো নির্বাচন আপাতত অনিশ্চিত যাত্রা প্রতিহত করতে পারে! এরপর সরকারের দূরদর্শিতায় অর্থনীতিকে কতটা গতিশীলতায় ফিরিয়ে আনতে পারবে তা নির্ভর করবে!

(মতামত লেখকের নিজস্ব)

[লেখক: প্রাবন্ধিক]

রোহিঙ্গা সংকটের টেকসই সমাধানে লোকালাইজেশন অপরিহার্য

বিচারবহির্ভূত হত্যার দায় কার?

ছবি

ট্রাম্পের ভেনেজুয়েলা কৌশল

অযৌক্তিক দাবি: পেশাগত নৈতিকতার সংকট ও জনপ্রশাসন

সড়ক দুর্ঘটনা এখন জাতীয় সংকট

কেন বাড়ছে দারিদ্র্য?

তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার পুনর্জন্ম

লবণাক্ততায় ডুবছে উপকূল

বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন ও বাস্তবতা

সড়ক দুর্ঘটনার সমাজতত্ত্ব: আইন প্রয়োগের ব্যর্থতা ও কাঠামোর চক্রাকার পুনরুৎপাদন

ছবি

অস্থির সময় ও অস্থির সমাজের পাঁচালি

ভারতে বামপন্থার পুনর্জাগরণ: ব্যাধি ও প্রতিকার

চিপনির্ভরতা কাটিয়ে চীনের উত্থান

একতার বাতাসে উড়ুক দক্ষিণ এশিয়ার পতাকা

ছবি

স্মরণ: শহীদ ডা. মিলন ও বৈষম্যহীন ব্যবস্থার সংগ্রাম

মনে পুরানো দিনের কথা আসে, মনে আসে, ফিরে আসে...

রাসায়নিক দূষণ ও ক্যান্সারের ঝুঁকি

আছদগঞ্জের শুটকি : অতীতের গৌরব, বর্তমানের দুঃসময়

নবান্নের আনন্দ ও আমনের ফলন

‘প্রশ্ন কোরো না, প্রশ্ন সর্বনাশী’

ভূমিকম্প, অর্থনৈতিক চাপ এবং অনিশ্চয়তা: মানসিকতার নতুন অর্থনীতি

নবম পে স্কেল ও এর আর্থসামাজিক প্রভাব

মৃত্যুদণ্ড, তারপর...

জমির ভুয়া দলিল কীভাবে বাতিল করবেন?

জুলাই সনদ আদিবাসীদের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি

ব্যাংকের দুরবস্থা থামানো যাচ্ছে না কেন

আমন ধানে ব্রাউন প্ল্যান্টহপারের প্রাদুর্ভাব

বৈষম্য, অপচয় ও খাদ্যনিরাপত্তার সংকট

“বাঙালি আমরা, নহিতো...”

নারী নির্যাতন, মানসিক স্বাস্থ্য এবং সমাজের দায়

কাঁপছে ডলারের সিংহাসন

ত্রিশতম জলবায়ু সম্মেলন : প্রতীকী প্রদর্শনী, নাকি বৈশ্বিক জলবায়ু রাজনীতির বাঁক নেওয়ার মুহূর্ত?

অপরিণত নবজাতক : ঝুঁকি, প্রতিরোধ ও যত্নের জরুরি বাস্তবতা

বাংলাদেশী উত্তরাধিকার: প্রবাস-জীবন ও আমাদের সংস্কৃতি

রাজনীতিতে ভাষার সহনীয় প্রয়োগ

ভারত : এসআইআর এবং সাম্প্রদায়িক বিভাজন

tab

মতামত » উপ-সম্পাদকীয়

আইসিইউ থেকে বাড়ি ফেরা ও খাদের কিনারায় থাকা দেশ

মোহাম্মদ আবু নোমান

সোমবার, ০১ ডিসেম্বর ২০২৫

চাকরি হারানো কিংবা আয় রোজগার কমে যাওয়ার কারণে দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যায় মানুষ। কিংবা গরিব থেকে আরও গরিব বা ‘অতি গরিব’ হয়ে যায়। বিশ্বব্যাংকের হিসাবটি বিবেচনায় আনলে ২০২৫ সাল শেষে উক্ত ‘অতি গরিব’ মানুষের সংখ্যাই হবে ১ কোটি ৫৮ লাখের মতো। অন্যদিকে জাতীয় দারিদ্র্য হার বা গরিব মানুষের সংখ্যা হবে ৩ কোটি ৯০ লাখ। কি বেদনা ও যন্ত্রণাদায়ক তথ্য, দেশে ‘অতি গরিব’ মানুষের সংখ্যা ১ কোটি ৫৮ লাখ!

সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের ‘বাংলাদেশের দারিদ্র্য ও বৈষম্য মূল্যায়ন ২০২৫’ প্রতিবেদনে যে উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তাজনক তথ্য উঠে এসেছে, যা আমাদের গভীরভাবে ভাবিয়ে তোলার জন্য যথেষ্ট। গবেষণায় এসেছে, দেশের মোট জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশ বা ৬ কোটি ২০ লাখ মানুষ দারিদ্র্যের ঝুঁকিতে রয়েছে। এই পরিসংখ্যান কেবল একটি সংখ্যা জপেই শেষ করার বিষয় কী? বরং এর মধ্যে রয়েছে কোটি মানুষের অতি দারিদ্রতা, ক্ষুধা, দুর্ভিক্ষ, অনাহার, অর্ধাহার, ধুকে-ধুকে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর দুয়ারে চলে যাওয়ার রেকর্ডও। যখন গরীবের কাজ নেই, পেটে ভাত নেই; তখন তাদের জন্য রিজার্ভ, ডলার, জিডিপি এগুলোর মূল্য কত?

যাদের প্রতি মাসের আয়ের পুরোটাই সংসার চালাতে খরচ হয়ে যায়। কিন্তু এর উপর যখন জিনিসপত্রের দাম বাড়ে, অথচ সে অনুযায়ী আয় না বাড়লে তাকে ধারদেনা করে সংসার চালাতে হয়, কিংবা খাবার, কাপড়চোপড়, যাতায়াতসহ বিভিন্ন খাতে কাটছাঁট করতে হবে। এতে সাধারণ মানুষের কষ্ট বাড়ার সাথে দ্রুতই দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যায়। মৌলিক জীবনধারণ অর্থাৎ, অতি প্রয়োজনীয় খাদ্য ও চিকিৎসা মেটাতে তাদের প্রাণ যায়যায় অবস্থা। যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা পরিবারের কেউ অসুস্থ হলে, সে ধাক্কা সামাল দেয়ার মতো সামর্থ থাকে না। বাংলাদেশে এরকম প্রায় ৫০ শতাংশ পরিবার যেকোনো সময় দরিদ্র হওয়ার ঝুঁকিতে থাকে।

মানুষের মধ্যে কখনো দারিদ্র্য বাড়ে, আবার তা কমে। কিন্তু সমস্যা তখনই হয়, যখন তা দীর্ঘমেয়াদী হয়। সাধারণ মানুষ কষ্টের মধ্যেও অনেক সময় পেট বেঁধে সাময়িকভাবে কিছু বিষয় মানিয়ে নেয়। যেমন কম পণ্য কেনা, কম খাওয়া। এ রকমটা চলতে পারে দুই এক মাস। কিন্তু এ অবস্থা যখন দীর্ঘমেয়াদি হয়, তখন মানুষের কষ্টের সীমা থাকে না। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর প্রায় ১৬ মাস অতিবাহিত হয়েছে। দেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর পরিবর্তে আরো বেশি দুর্বল হচ্ছে। শান্তি-স্বস্তির বদলে অস্থিরতা-উত্তেজনা বেড়েই চলেছে।

বিনিয়োগে স্থবিরতা, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, উচ্চ সুদের হারসহ নানা কারণে ধুঁকছে অর্থনীতি, ধুঁকছে শিল্প, ব্যবসা, বিনিয়োগ। এক প্রকার নীরব মন্দায় আক্রান্ত দেশ। অসংখ্য কারখানা এরই মধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে, কাজ হারিয়েছেন বিপুলসংখ্যক কর্মী। নতুন বিনিয়োগ না থাকায় নতুন কর্মসংস্থান হচ্ছে না। দ্রুত বাড়ছে বেকারের সংখ্যা। ব্যবসা-বাণিজ্যের গতি হারানোর প্রভাব সরাসরি পড়েছে সরকারের রাজস্ব আয়ে। চলতি অর্থবছরের চার মাসেই রাজস্ব ঘাটতি ১৭ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। সমস্যাগ্রস্ত করদাতারা ঠিকমতো করও দিতে পারছেন না। সর্বশেষ হিসাবে রিটার্ন জমা দেওয়া করদাতাদের মধ্যে ৮৮ শতাংশই শূন্য রিটার্ন জমা দিয়েছে, অর্থাৎ তারা কোনো কর দেয়নি। ভ্যাট বিভাগের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা গণমাধ্যমকে বলেছেন, মানুষের আয় কমে যাওয়ায় ভোগ কমেছে। প্রতিষ্ঠানগুলো কমিয়েছে উৎপাদন। আগের তুলনায় পণ্যের দাম বাড়লেও বিক্রি কমায় ভ্যাট আদায় কমেছে।

ব্যবসায়ী-অর্থনীতিবিদরা বলছেন, অনিশ্চয়তার কারণে আন্তর্জাতিক ক্রেতারা নতুন অর্ডার দিতে দ্বিধাগ্রস্ত হচ্ছেন। আইন-শৃঙ্খলা ও ব্যবসায় পরিবেশের উন্নতি আর রাজনৈতিক সরকার না আসা পর্যন্ত অর্থনীতিতে গতি ফিরবে না। রাজস্ব আদায় চাঙ্গা করতে গেলে ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগে চাঙ্গাভাব ফিরিয়ে আনতে হবে। অর্থনীতি গতিশীল না হলে রাজস্ব আদায় বাড়বে না।

ঢাকার উপকণ্ঠে শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্যে চাঁদাবাজির ভয়াবহ থাবার কথা গণমাধ্যমে উঠে এসেছে। মিরপুর ১২ নম্বরের একটি পোশাক কারখানার মালিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আমাকে প্রতি মাসে মোটা অঙ্কের চাঁদা দিতে হয়। শীর্ষ সন্ত্রাসীদের পাশাপাশি বর্তমানে স্থানীয় কিছু মাস্তান রাজনৈতিক পরিচয়ে নিয়মিত চাঁদা নিচ্ছে। পুলিশের কাছে অভিযোগ করেও তেমন সহায়তা পাওয়া যায় না। প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন ব্যক্তিদের জানিয়েও সুরাহা পাইনি।’ তিনি জানান, কারখানার কিছু পদে তাদের পছন্দের লোকদের নিয়োগ দিতে হয়েছে। চাঁদার টাকা দিতে দেরি হলেই তারা কারখানার নিচে মহড়া দেয়। প্রাণনাশের হুমকি দেয়। একইভাবে গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ ও সাভার এলাকায় গার্মেন্টসসহ আরো অনেক কারখানা ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে বিপুল চাঁদাবাজির অভিযোগ পাওয়া গেছে।

ইতিপূর্বে বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিশিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) এক গবেষণায় দারিদ্র্য বৃদ্ধির চিত্র প্রকাশ করেছে। সেখানে দেখা গেছে, একটি পরিবারের মাসের মোট খরচের প্রায় ৫৫ শতাংশ চলে যায় শুধু খাবার কেনায়। এর বাইরে শিক্ষা ও চিকিৎসার ব্যয়তো রয়েছেই। দীর্ঘস্থায়ী রোগের কারণে পরিবারগুলোকে চিকিৎসার পেছনে বাড়তি ব্যয় করতে হচ্ছে, যাতে আবার তাদের ঋণের বোঝা বাড়ছে। পিপিআরসির গবেষণায় বলা হয়েছে বর্তমানে দেশের প্রতি ৪ জনের ১ জন গরিব। আরও ব্যাপক মানুষ এমন আর্থিক অবস্থায় রয়েছেন যে, অসুস্থতা বা অন্য কোনো সংকটে তারা গরিব থেকে ‘অতি গরিব’ হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছেন।

পিপিআরসির গবেষণায় দেখা যায়, দেশের সবচেয়ে দরিদ্র অনেক পরিবারের সদস্যরা সপ্তাহে একাধিক বেলা কিংবা মাসে অন্তত একদিন একেবারেই না খেয়ে থাকছেন। দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩২ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। এর সঙ্গে ডলারের দর স্থিতিশীল রাখার গভীর সম্পর্ক আছে। রিজার্ভ বৃদ্ধির পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা ছিল প্রবাসী আয়ের। এছাড়া রপ্তানি আয়ের সাথে আমদানি নিয়ন্ত্রণের কারণে ডলারের চাহিদাও কম ছিল বলে রিজার্ভ বেড়েছে। বিনিয়োগহীন রাষ্ট্রে এই রিজার্ভ নিয়ে আমরা কী করব? রোগী ডাক্তারের কাছে পেট ব্যাথা নিয়ে গেল, ডাক্তার ওষুধ দিল এবং তা খেয়ে রোগী মরে গেল! এখন ডাক্তার যদি বলে, রোগীর পেট ব্যাথা ভাল হয়ে গেছে; এতে খুশি হওয়া আর গরিবের পেটে ক্ষুধার সাথে রিজার্ভ বাড়ছে বলে খুশি হওয়া একই কথা নয় কী? বিনিয়োগ নেই তাই রিজার্ভের স্বাস্থ্য মোটামুটি ভালো! এই রিজার্ভ নি¤œআয়ের মানুষের কী কাজে আসছে।

বেসরকারি খাত স্থবির, কোনো বিনিয়োগ নেই। শিল্পের উৎপাদন সংকুচিত। একে একে কারখানা বন্ধ হচ্ছে। উচ্চ সুদে কেউ ব্যবসার প্রসার ঘটাতে চাচ্ছেন না, আবার নতুন কারখানায়ও বিনিয়োগ করছেন না। অর্থাৎ কেনাকাটাই হচ্ছে না ঠিকমতো। সাধারণেরও সীমিত আয়ের বিপরীতে উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে পণ্যের চাহিদা ও ভোগ ব্যয় কমে গেছে, যার ফলে কমছে আমদানি। বিশেষ করে শিল্পের কাঁচামাল, যন্ত্রপাতি ও যন্ত্রাংশ আমদানি কমছেই। এ কারণে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়েছে। কিন্তু তা সামগ্রিক অর্থনীতির জন্য কতটা স্বস্তিদায়ক?

অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছরের সাফল্য নিয়ে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ আত্মতুষ্টির এক চমকপ্রদ বাণী দিয়েছিলেন। অর্থনীতি নাকি ‘আইসিইউ থেকে কেবিনে গিয়ে এত দিনে বাড়ি ফিরে আসছে’। এছাড়াও বলেছিলেন, ‘খাদের কিনারা থেকে ঘুরে দাঁড়িয়েছে দেশের অর্থনীতি।’ তিনি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ছিলেন বিধায় তার মতো একজন বিশেষজ্ঞের মন্তব্য গুরুত্বের সঙ্গে মাপা উচিত। আওয়ামী আমলে তিনি অর্থনীতি বিশেষজ্ঞের বাইরেও ‘পলিসি এক্সপার্ট’ হিসেবে অজস্র মন্তব্য রাখলেও তখন যে অর্থনীতি আইসিইউতে, খাদের কিনারে চলে গিয়েছিল, এ রকম কোনো বিশ্লেষণ প্রকাশ করেননি।

সম্পতি পিপিআরসি গবেষণা এসেছে, দেশের ৮০ শতাংশ পরিবার সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছে। ৪০ শতাংশ পরিবারের গড় আয় ১৪,৮৮১ টাকা, যেখানে খরচ ১৭,৩৮৭ টাকা। ঋণের ওপর নির্ভরশীল ৫২ শতাংশ পরিবার, যাদের এক-তৃতীয়াংশ সংসার খরচ মেটাতে ঋণ নেয়। এছাড়া দারিদ্র্যের হার ১৮.৭ শতাংশ থেকে বেড়ে ২২.২ শতাংশে পৌঁছানোর আশঙ্কা তৈরি হওয়ার তথ্যে কী প্রমাণ হয়? অর্থনীতি আর খাদের কিনারে নেই; না এখন খাদেই...। এই হলো আমাদের আইসিইউ থেকে বাড়ি ফেরা ও খাদের কিনারায় থাকা বাংলাদেশ।

যে দেশে বাংক লুট হয় সরকারি মদদে সেখানে কোন বিদেশী ইনভেষ্ট করতে ১০ বার ভেবে নিবে। অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে কেউই বিনিয়োগের ঝুঁকি নিবে না, এটি বুঝতে অর্থনীতির পণ্ডিত হওয়া লাগে কী? কোন উসিলায় যখন বহুজাতিক বা দেশীয় রপ্তানীযোগ্য কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে মব ভায়োলেন্সের রিউমারে দিনের পর দিন ধরে লুটপাট, অগ্নিসংযোগ করা হয়, তখন বিদেশি বিনিয়োগ আশা করা যায় কী? অথচ বাংলাদেশের মতো দেশে বিদেশি বিনিয়োগ অত্যন্ত জরুরি! রাজনীতিবিদরা দেশ নিয়ে কি ভাবছেন এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ! একটি ভালো নির্বাচন আপাতত অনিশ্চিত যাত্রা প্রতিহত করতে পারে! এরপর সরকারের দূরদর্শিতায় অর্থনীতিকে কতটা গতিশীলতায় ফিরিয়ে আনতে পারবে তা নির্ভর করবে!

(মতামত লেখকের নিজস্ব)

[লেখক: প্রাবন্ধিক]

back to top