alt

মতামত » উপ-সম্পাদকীয়

কলি ফুটিতে চাহে ফোটে না!

আনোয়ারুল হক

: বুধবার, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৫

জুলাই আন্দোলনের পর থেকে আমার আনাড়ি হাতে সংবাদপত্রে কলাম লেখা দেখে অনেকে বিষ্মিত হয়েছিলেন। কেউ কেউ প্রশংসা করছিলেন। তবে লেখাগুলোর বিষয়বস্তুতে বিভিন্নতা ও বৈচিত্র্যের অভাবে ইতোমধ্যে অনেকের কাছেই একঘেয়ে লাগছে। আমার কিছু বামপন্থী বন্ধুরা সাক্ষাতে এই বলে সমালোচনা করছেন যে, লেখা অতীতাশ্রয়ী হয়ে পড়ছে। আর কট্টর আওয়ামী লীগ বিরোধী কিছু পরিচিতজন ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বলতে চান, অন্তর্বর্তী সরকার, উপদেষ্টা পরিষদ, বিদেশী বিশেষজ্ঞ উপদেষ্টাদের এবং জামাত ও এনসিপির সমালোচনা করে আওয়ামী লীগের সুবিধা করে দেওয়া হচ্ছে।

জুলাই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সাধারণের মাঝে এ আকাক্সক্ষা সৃষ্টি হয়েছিল যে, দেশে সুশাসন, গণতন্ত্র ও অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যবস্থা ফিরে আসবে। কিন্তু বাস্তবে চলছে ক্রোধ, প্রতিহিংসা,খুনের মামলা আর ‘মাইনাস প্রকল্পের’ রাজত্ব। সেটাই নাকি ‘নতুন স্বাধীনতা আর আইনের শাসন’। আর তাই তো অনেক স্বপ্ন সাধের, অনেক সাধনার ‘কলি ফুটিতে চাইলেও ফোটেনি’

উত্তরে আমি বলি, চব্বিশের জুলাই আন্দোলনের পরে দেড়টি বছরও পার হয়নি। অথচ সব চলছে আগের মতো। কিছু ক্ষেত্রে আগের চেয়েও খারাপ। সবচেয়ে হতাশা সৃষ্টি হয়েছে মানুষের মধ্যে জুলাই আন্দোলনের সম্মুখ সারিতে নেতৃত্ব দিয়ে যারা পরবর্তীতে উপদেষ্টা হয়েছেন এবং নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেছেন তাদের দ্রত পরিবর্তন দেখে। কতৃত্ববাদী ও ফ্যাসিবাদী যে প্রবণতা বিগত এক যুগেরও বেশি সময় ধরে ক্ষমতার অলিন্দে বিরাজ করছিলো তা সমাজের এতো গভীরে শিকড় গেড়েছে যে সমাজে বসবাসকারী আমরা কেউই তার বাইরে নই। আমাদের মনোজগত কতৃত্ববাদেই আচ্ছন্ন, রাজনীতিবিদদের আরো বেশি। এবং নতুন দলের তরুণ নেতৃত্বের মধ্যে তা আগ্রাসী রূপ নিয়ে উপস্থিত। চব্বিশের ‘জুলাই সুনামি’ও আমাদের বদল করতে পারেনি। আমিও বদল হইনি, চিন্তাধারা আগের মতোই বা তার কাছাকাছিই আছে! লেখাতেও তাই নতুনত্ব নেই।

এতো রক্ত, এতো মৃত্যু, এতো বীরত্বগাথা এবং সেই সাথে অন্তর্ভুক্তিমূলক গনতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও বৈষম্যমুক্ত সমাজের স্বপ্নিল আকাক্সক্ষা - ধীরে ধীরে সব আড়ালে চলে যাচ্ছে। আগে একপক্ষ স্বৈরশাসন ও কতৃত্ববাদী পন্থা অনুসরণ করে প্রতিপক্ষকে নির্যাতন নিপীড়ন করে কোনঠাসা করে রেখেছিল। এখন আবার সেই প্রতিপক্ষ মওকা পেয়ে অপর পক্ষকে একেবারে নির্মূল অভিযানে নেমেছে। এমনকি জুলাই পক্ষের সাথে থাকা বামপন্থীদের তো বটেই, মধ্য ডানপন্থীদেরকেও সুকৌশলে মাইনাস করার একটা প্রচেষ্টা পরিলক্ষিত হচ্ছে। দেশে ফেরা নিয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক জিয়া এবং এ বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম যে বক্তব্য দিয়েছেন উভয়ের বক্তব্যই সঠিক মনে হয়েছে। এ ঘটনা থেকেই বুঝা যায় শক্তিশালী তৃতীয় পক্ষও দেশের রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের সাথে যুক্ত আছে। তা হলে কি দেশী বিদেশী বিশেষ কোনো গোষ্ঠীর কাছে দেশকে জিম্মি করে ফেলা হচ্ছে?

পাঠকদের নিশ্চয়ই স্মরণ আছে, ২৮শে ফেব্রুয়ারি ২০২৫ সালে জাতীয় নাগরিক পার্টি বা এনসিপি প্রতিষ্ঠিত হলেও ৬ মাস আগেই জুলাই আন্দোলন যখন তুঙ্গে সেই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের টাইম টেলিভিশন চ্যানেলকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মোজেনা নতুন দলের উদ্বোধন ঘোষণা করে দেন। অর্থাৎ নতুন দল সৃষ্টির প্রথম ঘোষণা কোনো বাংলাদেশির পক্ষ থেকে নয় একজন ভিনদেশি রাষ্ট্রদূতের মুখ থেকে দল প্রতিষ্ঠার ৬ মাস আগেই আমাদের শুনতে হয়। ওই সময়েই মুহাম্মদ ইউনূস ভারতীয় পত্রিকা ‘দ্য হিন্দুকে’ দেয়া এক সাক্ষাৎকারে অবাধ ও সুষ্ঠু নতুন নির্বাচন দাবি করেন। একই সাথে বার্নিকাট, মিলার, পিটার হাস, ড্যানিলোভিচ প্রমুখ মার্কিন কূটনীতিকদের ভূমিকা এবং বিভিন্ন বক্তব্য থেকে আওয়ামী রাজনীতির বহির্ভূত অনেক প্রগতিমনা রাজনীতিবিদ, শিল্পী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীও এ সিদ্ধান্তে এসেছিলেন পশ্চিমা সমর্থন ও মদতে বাংলাদেশে রেজিম পরিবর্তনের আন্দোলন শুরু হয়েছে, যার সাথে ডিপ স্টেট জড়িত এবং নেতৃত্বের কেন্দ্রীক ভূমিকায় উগ্রবাদী ধর্মান্ধ গোষ্ঠী রয়েছে। তাদের যুক্তি এক কথায় উড়িয়ে দেয়া যায় না। তবে তিন তিনটি সাজানো নির্বাচনের মাধ্যমে জবরদস্তিমূলকভাবে ক্ষমতা আঁকড়ে রাখা জনবিচ্ছিন্ন সরকারের নির্বিচার হত্যাকাণ্ডে নিশ্চুপ থেকে তারাও জনবিচ্ছিন্ন হয়েছেন। আওয়ামী লীগ দল না করলেও ধর্মীয় উগ্রবাদীরা এবং অতি আবেগী তরুণরা তাদের আওয়ামী ট্যাগ লাগিয়ে দিয়েছে। ফলে বর্তমান রাজনৈতিক সন্ধিক্ষণে যে ভূমিকা তারা রাখতে পারতেন তা থেকে গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল শক্তিকে বঞ্চিত হতে হচ্ছে।

জুলাই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সাধারণের মাঝে এ আকাক্সক্ষা সৃষ্টি হয়েছিল যে, দেশে সুশাসন, গণতন্ত্র ও অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যবস্থা ফিরে আসবে। কিন্তু বাস্তবে চলছে ক্রোধ, প্রতিহিংসা,খুনের মামলা আর ‘মাইনাস প্রকল্পের’ রাজত্ব। সেটাই নাকি ‘নতুন স্বাধীনতা আর আইনের শাসন’। আর তাই তো অনেক স্বপ্ন সাধের, অনেক সাধনার ‘কলি ফুটিতে চাইলেও ফোটেনি’।

মানুষ জুলাইয়ের যে ছাত্র নেতৃত্বকে দেখে আশায় বুক বেঁধেছিলো, ছাত্র নেতৃত্বের বীরত্বপূর্ণ লড়াইয়ের পাশে থেকেছিলো, ছাত্র তরুণদের দেয়ালে দেয়ালে আঁকা গ্রাফিতিতে যে স্বপ্ন দেখানো হয়েছিলো - তা অনেক আগেই দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে। তরুণদের রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দের মাঝে যে ক্রোধ হিংসা আর ঔদ্ধত্য, নেতৃত্বের একাংশের মাঝে এই বয়সেই ক্ষমতা, গাড়ি, বাড়ি আর বিলাসী জীবনের প্রতি ভালোবাসা, আর ছলে বলে ২৪-কে দিয়ে ৭১-কে আড়াল করার নিরবিচ্ছিন্ন প্রচেষ্টার কারণেই ‘কলি ফুটিতে চাহে ফোটে না’। বিভাজনের এক শক্তিকে বিদায় করার পর আজ আরো হিংস্র এবং উন্মত্ত চেহারা নিয়ে যে নতুন বিভাজনের শক্তি আবির্ভূত হয়েছে, তরুনদের দল সেই হিংস্র শক্তির পাশে থাকার কারণে ‘কলি ফুটিতে চাহে ফোটে না’। তাইতো শহুরে মধ্যবিত্ত এবং জুলাই জাগরণে শামিল হওয়া লাখো লাখো তরুণের কাছে নতুন দলটি এখন এক স্বপ্নভঙ্গের বেদনা হিসাবেই পরিচিতি অর্জন করেছে।

আওয়ামী লীগ শাসন বিদায়ের দেড় বছর পরে এসে প্রধান দল বিএনপিও কেমন যেন দিশেহারা। জুলাই আন্দোলন সফল হওয়ার পরে ‘এই ক্ষমতায় এসে গেলাম’ মনোভাব নিয়ে গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দেওয়ায় ধীরে ধীরে পরিস্থিতি তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। এখন তাদের হতাশার সুরে বলতে হচ্ছে দেশে উগ্র দক্ষিণপন্থার উত্থান হয়েছে। দল হিসেবে বিএনপির দাবী বা পরামর্শকে সরকার উপেক্ষা করছে, অন্যদিকে খালেদা জিয়া যখন হাসপাতালে জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে এবং সর্বোচ্চ চিকিৎসা সেবাই যেখানে প্রধান বিষয় সেই মূহুর্তে এসএসএফ নিরাপত্তা দেয়ার বিষয়টি কোনো হিসেবে মিলছে না।

বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনা নিয়ে যখন নানামুখী বয়ান তৈরি হলো সেনাবাহিনী প্রধান বললেন নো ইফ, নো বাট, ফুল স্টপ! এই হত্যাকাণ্ডের রাজনৈতিক ব্যবহার নিয়ে একটা পরিস্থিতি সৃষ্টি হোক - সেটা এড়াতে তিনি হয়তো এমন বলেছিলেন। তিনি আরো বলেছিলেন, আমি সতর্ক করে রাখলাম; পরে যাতে না বলতে পারেন আমি সতর্ক করিনি। রিপোর্ট আলোর মুখ দেখুক না দেখুক এটা নিয়ে রাজনৈতিক খেলাধুলা শুরু হয়ে গেছে।

রাজনৈতিক ঐকমত্যবিহীন ‘জুলাই সনদ’ ও তা বাস্তবায়নের নামে বিচিত্র ও বিভ্রান্তিমূলক গণভোটের আয়োজনের ঘোষণা, উপদেষ্টাদের নির্বাচনে অংশগ্রহণের ঘোষণায় এ সংশয় সৃষ্টি হয়েছে যে, জাতীয় নির্বাচনের পরে বিজয়ীদের কাছে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর হবে, নাকি সংবিধান সংশোধনের নামে আরো ৬ মাস অপেক্ষা করে পরিস্থিতিকে আরো জটিল ও নাজুক করে তোলা হবে। আলজাজিরার সাংবাদিক মেহেদী হাসানকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ক্ষমতা হস্তান্তর বিষয়ে প্রশ্নের জবাবে প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ইউনূস বলেছিলেন, ‘নতুন সরকার গঠিত না হওয়া পর্যন্ত অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব পালন করে যাবে’। আবার সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিগণ ৬ মাসের জন্য গণপরিষদ সদস্য হিসাবে দায়িত্ব পালন করার পর তারা জাতীয় পরিষদ সদস্য হিসাবে দায়িত্ব পালন করবেন - এ সব বক্তব্যের নানা ব্যাখ্যা দাঁড় করানো হতে পারে। বিপজ্জনক দেশি-বিদেশি শক্তির নানা খেলায় সব কিছুই এখনো অনিশ্চিত।

এ কথা ঠিক এই জটিল ও সংকটময় পরিস্থিতিতে শুধু ’৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের বা ’২৪-এর জুলাইয়ের প্রকৃত আকাক্সক্ষা জপ করে এ অচলায়তন থেকে বের হওয়া সম্ভব হচ্ছে না, হবে না। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রয়াসে দেশে যে রাজনৈতিক ভারসাম্য সৃষ্টি করা হয়েছে, তাতে মানুষ কোনো আশার আলো দেখতে পারছে না। আমাদের এই ভূখণ্ডে নিকট অতীতে ইতিহাসের বাঁক বদলে দেশের বামপন্থী শক্তি সমূহ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। পাকিস্তান আমলে ভাষা সংগ্রাম থেকে শুরু করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতিটি পর্বেই মিশে আছে কত শত কমিউনিস্ট ও বামপন্থীদের শ্রম, ঘাম আর রক্ত! আশির দশক জুড়েও সামরিক স্বৈরশাসন বিরোধী জাতীয় সংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে বাম আন্দোলন বিস্তৃতি লাভ করেছিল। বামপন্থীদের প্রধান দল কমিউনিস্ট পার্টিতে বিভক্তি, অন্যান্য বাম দলেও বিভক্তি এবং বামপন্থীদের একটি অংশ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোটে শামিল হওয়ায় জাতীয় রাজনীতিতে বামপন্থীদের ভূমিকা দুর্বল হয়ে পড়ে। মেহনতি মানুষের শ্রেণী স্বার্থের সংগ্রামে কিছু কিছু জায়গায় সীমিত উপস্থিতি থাকলেও জাতীয় রাজনৈতিক সংগ্রামে অনেকটা ছোটখাটো ‘অ্যাক্টিভিজিম’ এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ। তথ্য, কুতথ্য প্রবাহের এই যুগে এবং ইলেকট্রনিক ও সোশ্যাল মিডিয়ার আধিপত্যের এই সময়কালে দলীয় এবং ব্যক্তিগত প্রদর্শনবাদে অনেকেই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন।প্রদর্শিত হতে পারলেই সন্তুষ্ট থাকছেন এবং ভাবছেন যে বামপন্থার বা দলীয় রাজনীতির কাজ অগ্রসর হচ্ছে।

অন্যদিকে আমাদের মাতৃভূমি যে ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে, ডানপন্থা বা মধ্য-ডানপন্থা এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে টেকসই কোনো বিকল্প সমাধান বের করতে পারছে না, পারবে বলে মনে হয় না। তারা তো ১৯৯১ সনে অর্জিত ভোটের গণতন্ত্রটুকুই টিকিয়ে রাখতে পারলেন না। বরং তাদের কর্মফলে আজ দেশের বুকে উগ্র ধর্মান্ধ শক্তির এক ভয়াবহ উত্থান ঘটেছে। অতীত অভিজ্ঞতা বলে, নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতায় বামপন্থার উত্তরণই পারে উদ্যত নব্য ফ্যাসিস্ট আক্রমণ রুখে সাম্য, ন্যায়বিচার এবং প্রকৃত গণতন্ত্রের ভিত্তি গড়ে তোলার লড়াইয়ে দেশের সকল গণতান্ত্রিক, প্রগতিশীল দল, সামাজিক শক্তি ও ব্যক্তিবর্গকে এক কাতারে শামিল করার জটিল কাজটি সম্পন্ন করতে। কিন্তু বামপন্থার সেই প্রস্তুতি নেই। রাজনীতির মাঠে বামপন্থীরা জনআস্থা গড়ে তোলার মতো শক্তি সমাবেশ গড়ে তুলতে পারছে না। পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এবং এক নতুন বাস্তবতায় ছাত্র তরুণ এবং মধ্যবিত্তের মাঝে উদার ও মানবিক সমাজ বিনির্মানের যে নতুন ধরনের আকাক্সক্ষা সৃষ্টি হয়েছে তাকে ধারণ করে সাধারণ মানুষের বোধগম্য ভাষায় যুক্তিনির্ভর আকর্ষণীয় বক্তব্য ও যুৎসই কর্মসূচিও অনুপস্থিত। তাই ছাত্র তরুণদেরদের মধ্যে বামপন্থীদের সমর্থনও দুর্বল। এ পরিস্থিতিতে বামপন্থী শক্তির নবায়ন ও পুনর্জাগরণ জরুরি হয়ে পড়েছে। তার জন্য বামপন্থী শক্তিগুলির একযোগে কাজ করা প্রয়োজন।

হয়তোবা সে লক্ষ্যে অতি সম্প্রতি বামপন্থী গণতান্ত্রিক জোট এবং আরো কয়েকটি রাজনৈতিক দল এক কনভেনশনে মিলিত হয়ে চিহ্নিত স্বৈরাচারী ও কতৃত্ববাদী শক্তি এবং মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী ধর্মান্ধ শক্তি ছাড়া সকল রাজনৈতিক দল ও সামাজিক শক্তি সমূহকে একটি ‘গণতান্ত্রিক যুক্তফ্রন্টে’ শামিল হওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। দেশ যখন এক বিশেষ সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে নতুন পথের সন্ধান করছে তখন বামপন্থীরা একত্রিত হয়ে মধ্যবাম, প্রগতিশীল ও উদার গণতন্ত্রীদের সাথে নিয়ে এক গণতান্ত্রিক মহাজোট গঠনে সক্ষম হলে নতুন পথের সন্ধান মিলতে পারে। কিন্তু কনভেনশনটিকে যথেষ্ট প্রতিনিধিত্বশীল মনে হয় নি। প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক প্রস্তুতি ছাড়া তাড়াহুড়োর কনভেনশন মনে হলো। শ্রেণী পেশার দুর্বল প্রতিনিধিত্বে অনুষ্ঠিত বামকর্মীদের সমাবেশে যারা প্রতিনিধিত্ব করেছেন তাদের কারো কারো নিজ নিজ শ্রেণী ও পেশার সংগঠনে গ্রহণযোগ্যতা, রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে দৃঢ়তা, অতি সাম্প্রতিক অতীতে রাজনৈতিক ভূমিকা ইত্যাদি নিয়ে প্রশ্ন আছে।আবার কনভেনশন থেকে মানুষকে বিশেষত তরুণদের আকৃষ্ট করার মতো কোনো ঘোষণাও আসেনি। তাই এক্ষেত্রেও, ‘কলি ফুটিতে চাহে ফোটে না’। তবে এ কনভেনশনকে নিকট ভবিষ্যতের বৃহত্তর ও কার্যকর কনভেনশনের প্রস্তুতিমূলক কর্মসূচি হিসেবে বিবেচনা করে সামনে অগ্রসর হওয়া যেতে পারে।

উগ্র ডানপন্থি শক্তির আস্ফালন প্রতিরোধ ও পুরাতন কর্তৃত্ববাদী দুঃশাসনের পুনরাবৃত্তি রুখতে সমাজের সকল প্রগতিশীল ও উদার গণতন্ত্রীদের এমনকি মুক্তিযুদ্ধের আওয়ামী বয়ানে আচ্ছন্ন বা বিভ্রান্ত মানুষকেও টেনে আনতে হবে জনমুক্তির বয়ানে। জুলাই আন্দোলনে ধর্মীয় উগ্রবাদীদের অংশগ্রহণ আর আন্দোলনের সমাপ্তিতে ক্রমাগত সরাসরি মুক্তিযুদ্ধের উপর হামলা ও মব উল্লম্ফনের সংস্কৃতি দেখে যারা নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছেন বা জুলাই আন্দোলনকে নিয়ে নির্লিপ্ত বা সংশয়ী এমনকি সমালোচক তাদেরকেও টেনে আনতে হবে নতুন রাজনৈতিক বিন্যাসে। তাদের মাঝেও এ বোধ জাগ্রত করতে হবে যে, আমরা আমাদেরকে পতনের মুখোমুখি হতে দেবো না। এ ধরনের রাজনৈতিক পুনর্গঠনের জন্য সংকীর্ণতামুক্ত নতুন বামপন্থি নেতৃত্বের উত্থানও জরুরি, যারা ব্যাপকতর ঐক্যের গুরুত্ব এবং ক্ষমতার লড়াইয়ের জটিলতাগুলোও বুঝে লড়াই করবেন এবং জনগণের বিশেষত বর্তমান যুগের তরুণদের আশা-আকাক্সক্ষারও প্রতিফলন ঘটাবেন।

এমনটা সম্ভব হলে এ স্বপ্ন দেখা অন্যায় হবে না, আগামী দিনের বামপন্থীদের মিছিলে আদর্শিকভাবে প্রতিশ্রুত ও আন্তরিকভাবে পরিবর্তনকামী লড়াকু মানুষ যেমন থাকবে, তেমনি থাকবে দ্বিধায় দোলাচলে থাকা মানুষও। থাকবেন পরমের উপর ভরসা রাখা মানুষ। থাকবেন নিরেট জাগতিক। তেমনি থাকবেন মাওলানা, পুরোহিত, ভিক্ষু, পাদ্রী। সমতার সুরে থাকবেন নারীবাদীরাও। থাকবেন এমন সবাই, মানুষকে যারা মানুষ হিসেবে দেখতে চায়। এমনকি আমার মত দূরে দাঁড়িয়ে থাকা বাক্যবাগিশরাও থাকবেন। আর তেমনটা হলে ‘আছে যারা বোবার মতন/ তারাও কথা কবেই কবে/ এক সাথে সব যাত্রী যত একই রাস্তা লবেই লবে’। বামপন্থার ফুল বিকাশে অলি বার বার ফিরে আসবে। ‘কলি ফুটিতে চাহে ফোটে না’ - তারপরেও লাজ সরিয়ে ফুটবে।

(মতামত লেখকের নিজস্ব)

[লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা]

আলু চাষের আধুনিক প্রযুক্তি

কৃষিতে স্মার্ট প্রযুক্তি

রোহিঙ্গা সংকটের টেকসই সমাধানে লোকালাইজেশন অপরিহার্য

আইসিইউ থেকে বাড়ি ফেরা ও খাদের কিনারায় থাকা দেশ

বিচারবহির্ভূত হত্যার দায় কার?

ছবি

ট্রাম্পের ভেনেজুয়েলা কৌশল

অযৌক্তিক দাবি: পেশাগত নৈতিকতার সংকট ও জনপ্রশাসন

সড়ক দুর্ঘটনা এখন জাতীয় সংকট

কেন বাড়ছে দারিদ্র্য?

তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার পুনর্জন্ম

লবণাক্ততায় ডুবছে উপকূল

বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন ও বাস্তবতা

সড়ক দুর্ঘটনার সমাজতত্ত্ব: আইন প্রয়োগের ব্যর্থতা ও কাঠামোর চক্রাকার পুনরুৎপাদন

ছবি

অস্থির সময় ও অস্থির সমাজের পাঁচালি

ভারতে বামপন্থার পুনর্জাগরণ: ব্যাধি ও প্রতিকার

চিপনির্ভরতা কাটিয়ে চীনের উত্থান

একতার বাতাসে উড়ুক দক্ষিণ এশিয়ার পতাকা

ছবি

স্মরণ: শহীদ ডা. মিলন ও বৈষম্যহীন ব্যবস্থার সংগ্রাম

মনে পুরানো দিনের কথা আসে, মনে আসে, ফিরে আসে...

রাসায়নিক দূষণ ও ক্যান্সারের ঝুঁকি

আছদগঞ্জের শুটকি : অতীতের গৌরব, বর্তমানের দুঃসময়

নবান্নের আনন্দ ও আমনের ফলন

‘প্রশ্ন কোরো না, প্রশ্ন সর্বনাশী’

ভূমিকম্প, অর্থনৈতিক চাপ এবং অনিশ্চয়তা: মানসিকতার নতুন অর্থনীতি

নবম পে স্কেল ও এর আর্থসামাজিক প্রভাব

মৃত্যুদণ্ড, তারপর...

জমির ভুয়া দলিল কীভাবে বাতিল করবেন?

জুলাই সনদ আদিবাসীদের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি

ব্যাংকের দুরবস্থা থামানো যাচ্ছে না কেন

আমন ধানে ব্রাউন প্ল্যান্টহপারের প্রাদুর্ভাব

বৈষম্য, অপচয় ও খাদ্যনিরাপত্তার সংকট

“বাঙালি আমরা, নহিতো...”

নারী নির্যাতন, মানসিক স্বাস্থ্য এবং সমাজের দায়

কাঁপছে ডলারের সিংহাসন

ত্রিশতম জলবায়ু সম্মেলন : প্রতীকী প্রদর্শনী, নাকি বৈশ্বিক জলবায়ু রাজনীতির বাঁক নেওয়ার মুহূর্ত?

অপরিণত নবজাতক : ঝুঁকি, প্রতিরোধ ও যত্নের জরুরি বাস্তবতা

tab

মতামত » উপ-সম্পাদকীয়

কলি ফুটিতে চাহে ফোটে না!

আনোয়ারুল হক

বুধবার, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৫

জুলাই আন্দোলনের পর থেকে আমার আনাড়ি হাতে সংবাদপত্রে কলাম লেখা দেখে অনেকে বিষ্মিত হয়েছিলেন। কেউ কেউ প্রশংসা করছিলেন। তবে লেখাগুলোর বিষয়বস্তুতে বিভিন্নতা ও বৈচিত্র্যের অভাবে ইতোমধ্যে অনেকের কাছেই একঘেয়ে লাগছে। আমার কিছু বামপন্থী বন্ধুরা সাক্ষাতে এই বলে সমালোচনা করছেন যে, লেখা অতীতাশ্রয়ী হয়ে পড়ছে। আর কট্টর আওয়ামী লীগ বিরোধী কিছু পরিচিতজন ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বলতে চান, অন্তর্বর্তী সরকার, উপদেষ্টা পরিষদ, বিদেশী বিশেষজ্ঞ উপদেষ্টাদের এবং জামাত ও এনসিপির সমালোচনা করে আওয়ামী লীগের সুবিধা করে দেওয়া হচ্ছে।

জুলাই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সাধারণের মাঝে এ আকাক্সক্ষা সৃষ্টি হয়েছিল যে, দেশে সুশাসন, গণতন্ত্র ও অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যবস্থা ফিরে আসবে। কিন্তু বাস্তবে চলছে ক্রোধ, প্রতিহিংসা,খুনের মামলা আর ‘মাইনাস প্রকল্পের’ রাজত্ব। সেটাই নাকি ‘নতুন স্বাধীনতা আর আইনের শাসন’। আর তাই তো অনেক স্বপ্ন সাধের, অনেক সাধনার ‘কলি ফুটিতে চাইলেও ফোটেনি’

উত্তরে আমি বলি, চব্বিশের জুলাই আন্দোলনের পরে দেড়টি বছরও পার হয়নি। অথচ সব চলছে আগের মতো। কিছু ক্ষেত্রে আগের চেয়েও খারাপ। সবচেয়ে হতাশা সৃষ্টি হয়েছে মানুষের মধ্যে জুলাই আন্দোলনের সম্মুখ সারিতে নেতৃত্ব দিয়ে যারা পরবর্তীতে উপদেষ্টা হয়েছেন এবং নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেছেন তাদের দ্রত পরিবর্তন দেখে। কতৃত্ববাদী ও ফ্যাসিবাদী যে প্রবণতা বিগত এক যুগেরও বেশি সময় ধরে ক্ষমতার অলিন্দে বিরাজ করছিলো তা সমাজের এতো গভীরে শিকড় গেড়েছে যে সমাজে বসবাসকারী আমরা কেউই তার বাইরে নই। আমাদের মনোজগত কতৃত্ববাদেই আচ্ছন্ন, রাজনীতিবিদদের আরো বেশি। এবং নতুন দলের তরুণ নেতৃত্বের মধ্যে তা আগ্রাসী রূপ নিয়ে উপস্থিত। চব্বিশের ‘জুলাই সুনামি’ও আমাদের বদল করতে পারেনি। আমিও বদল হইনি, চিন্তাধারা আগের মতোই বা তার কাছাকাছিই আছে! লেখাতেও তাই নতুনত্ব নেই।

এতো রক্ত, এতো মৃত্যু, এতো বীরত্বগাথা এবং সেই সাথে অন্তর্ভুক্তিমূলক গনতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও বৈষম্যমুক্ত সমাজের স্বপ্নিল আকাক্সক্ষা - ধীরে ধীরে সব আড়ালে চলে যাচ্ছে। আগে একপক্ষ স্বৈরশাসন ও কতৃত্ববাদী পন্থা অনুসরণ করে প্রতিপক্ষকে নির্যাতন নিপীড়ন করে কোনঠাসা করে রেখেছিল। এখন আবার সেই প্রতিপক্ষ মওকা পেয়ে অপর পক্ষকে একেবারে নির্মূল অভিযানে নেমেছে। এমনকি জুলাই পক্ষের সাথে থাকা বামপন্থীদের তো বটেই, মধ্য ডানপন্থীদেরকেও সুকৌশলে মাইনাস করার একটা প্রচেষ্টা পরিলক্ষিত হচ্ছে। দেশে ফেরা নিয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক জিয়া এবং এ বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম যে বক্তব্য দিয়েছেন উভয়ের বক্তব্যই সঠিক মনে হয়েছে। এ ঘটনা থেকেই বুঝা যায় শক্তিশালী তৃতীয় পক্ষও দেশের রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের সাথে যুক্ত আছে। তা হলে কি দেশী বিদেশী বিশেষ কোনো গোষ্ঠীর কাছে দেশকে জিম্মি করে ফেলা হচ্ছে?

পাঠকদের নিশ্চয়ই স্মরণ আছে, ২৮শে ফেব্রুয়ারি ২০২৫ সালে জাতীয় নাগরিক পার্টি বা এনসিপি প্রতিষ্ঠিত হলেও ৬ মাস আগেই জুলাই আন্দোলন যখন তুঙ্গে সেই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের টাইম টেলিভিশন চ্যানেলকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মোজেনা নতুন দলের উদ্বোধন ঘোষণা করে দেন। অর্থাৎ নতুন দল সৃষ্টির প্রথম ঘোষণা কোনো বাংলাদেশির পক্ষ থেকে নয় একজন ভিনদেশি রাষ্ট্রদূতের মুখ থেকে দল প্রতিষ্ঠার ৬ মাস আগেই আমাদের শুনতে হয়। ওই সময়েই মুহাম্মদ ইউনূস ভারতীয় পত্রিকা ‘দ্য হিন্দুকে’ দেয়া এক সাক্ষাৎকারে অবাধ ও সুষ্ঠু নতুন নির্বাচন দাবি করেন। একই সাথে বার্নিকাট, মিলার, পিটার হাস, ড্যানিলোভিচ প্রমুখ মার্কিন কূটনীতিকদের ভূমিকা এবং বিভিন্ন বক্তব্য থেকে আওয়ামী রাজনীতির বহির্ভূত অনেক প্রগতিমনা রাজনীতিবিদ, শিল্পী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীও এ সিদ্ধান্তে এসেছিলেন পশ্চিমা সমর্থন ও মদতে বাংলাদেশে রেজিম পরিবর্তনের আন্দোলন শুরু হয়েছে, যার সাথে ডিপ স্টেট জড়িত এবং নেতৃত্বের কেন্দ্রীক ভূমিকায় উগ্রবাদী ধর্মান্ধ গোষ্ঠী রয়েছে। তাদের যুক্তি এক কথায় উড়িয়ে দেয়া যায় না। তবে তিন তিনটি সাজানো নির্বাচনের মাধ্যমে জবরদস্তিমূলকভাবে ক্ষমতা আঁকড়ে রাখা জনবিচ্ছিন্ন সরকারের নির্বিচার হত্যাকাণ্ডে নিশ্চুপ থেকে তারাও জনবিচ্ছিন্ন হয়েছেন। আওয়ামী লীগ দল না করলেও ধর্মীয় উগ্রবাদীরা এবং অতি আবেগী তরুণরা তাদের আওয়ামী ট্যাগ লাগিয়ে দিয়েছে। ফলে বর্তমান রাজনৈতিক সন্ধিক্ষণে যে ভূমিকা তারা রাখতে পারতেন তা থেকে গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল শক্তিকে বঞ্চিত হতে হচ্ছে।

জুলাই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সাধারণের মাঝে এ আকাক্সক্ষা সৃষ্টি হয়েছিল যে, দেশে সুশাসন, গণতন্ত্র ও অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যবস্থা ফিরে আসবে। কিন্তু বাস্তবে চলছে ক্রোধ, প্রতিহিংসা,খুনের মামলা আর ‘মাইনাস প্রকল্পের’ রাজত্ব। সেটাই নাকি ‘নতুন স্বাধীনতা আর আইনের শাসন’। আর তাই তো অনেক স্বপ্ন সাধের, অনেক সাধনার ‘কলি ফুটিতে চাইলেও ফোটেনি’।

মানুষ জুলাইয়ের যে ছাত্র নেতৃত্বকে দেখে আশায় বুক বেঁধেছিলো, ছাত্র নেতৃত্বের বীরত্বপূর্ণ লড়াইয়ের পাশে থেকেছিলো, ছাত্র তরুণদের দেয়ালে দেয়ালে আঁকা গ্রাফিতিতে যে স্বপ্ন দেখানো হয়েছিলো - তা অনেক আগেই দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে। তরুণদের রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দের মাঝে যে ক্রোধ হিংসা আর ঔদ্ধত্য, নেতৃত্বের একাংশের মাঝে এই বয়সেই ক্ষমতা, গাড়ি, বাড়ি আর বিলাসী জীবনের প্রতি ভালোবাসা, আর ছলে বলে ২৪-কে দিয়ে ৭১-কে আড়াল করার নিরবিচ্ছিন্ন প্রচেষ্টার কারণেই ‘কলি ফুটিতে চাহে ফোটে না’। বিভাজনের এক শক্তিকে বিদায় করার পর আজ আরো হিংস্র এবং উন্মত্ত চেহারা নিয়ে যে নতুন বিভাজনের শক্তি আবির্ভূত হয়েছে, তরুনদের দল সেই হিংস্র শক্তির পাশে থাকার কারণে ‘কলি ফুটিতে চাহে ফোটে না’। তাইতো শহুরে মধ্যবিত্ত এবং জুলাই জাগরণে শামিল হওয়া লাখো লাখো তরুণের কাছে নতুন দলটি এখন এক স্বপ্নভঙ্গের বেদনা হিসাবেই পরিচিতি অর্জন করেছে।

আওয়ামী লীগ শাসন বিদায়ের দেড় বছর পরে এসে প্রধান দল বিএনপিও কেমন যেন দিশেহারা। জুলাই আন্দোলন সফল হওয়ার পরে ‘এই ক্ষমতায় এসে গেলাম’ মনোভাব নিয়ে গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দেওয়ায় ধীরে ধীরে পরিস্থিতি তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। এখন তাদের হতাশার সুরে বলতে হচ্ছে দেশে উগ্র দক্ষিণপন্থার উত্থান হয়েছে। দল হিসেবে বিএনপির দাবী বা পরামর্শকে সরকার উপেক্ষা করছে, অন্যদিকে খালেদা জিয়া যখন হাসপাতালে জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে এবং সর্বোচ্চ চিকিৎসা সেবাই যেখানে প্রধান বিষয় সেই মূহুর্তে এসএসএফ নিরাপত্তা দেয়ার বিষয়টি কোনো হিসেবে মিলছে না।

বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনা নিয়ে যখন নানামুখী বয়ান তৈরি হলো সেনাবাহিনী প্রধান বললেন নো ইফ, নো বাট, ফুল স্টপ! এই হত্যাকাণ্ডের রাজনৈতিক ব্যবহার নিয়ে একটা পরিস্থিতি সৃষ্টি হোক - সেটা এড়াতে তিনি হয়তো এমন বলেছিলেন। তিনি আরো বলেছিলেন, আমি সতর্ক করে রাখলাম; পরে যাতে না বলতে পারেন আমি সতর্ক করিনি। রিপোর্ট আলোর মুখ দেখুক না দেখুক এটা নিয়ে রাজনৈতিক খেলাধুলা শুরু হয়ে গেছে।

রাজনৈতিক ঐকমত্যবিহীন ‘জুলাই সনদ’ ও তা বাস্তবায়নের নামে বিচিত্র ও বিভ্রান্তিমূলক গণভোটের আয়োজনের ঘোষণা, উপদেষ্টাদের নির্বাচনে অংশগ্রহণের ঘোষণায় এ সংশয় সৃষ্টি হয়েছে যে, জাতীয় নির্বাচনের পরে বিজয়ীদের কাছে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর হবে, নাকি সংবিধান সংশোধনের নামে আরো ৬ মাস অপেক্ষা করে পরিস্থিতিকে আরো জটিল ও নাজুক করে তোলা হবে। আলজাজিরার সাংবাদিক মেহেদী হাসানকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ক্ষমতা হস্তান্তর বিষয়ে প্রশ্নের জবাবে প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ইউনূস বলেছিলেন, ‘নতুন সরকার গঠিত না হওয়া পর্যন্ত অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব পালন করে যাবে’। আবার সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিগণ ৬ মাসের জন্য গণপরিষদ সদস্য হিসাবে দায়িত্ব পালন করার পর তারা জাতীয় পরিষদ সদস্য হিসাবে দায়িত্ব পালন করবেন - এ সব বক্তব্যের নানা ব্যাখ্যা দাঁড় করানো হতে পারে। বিপজ্জনক দেশি-বিদেশি শক্তির নানা খেলায় সব কিছুই এখনো অনিশ্চিত।

এ কথা ঠিক এই জটিল ও সংকটময় পরিস্থিতিতে শুধু ’৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের বা ’২৪-এর জুলাইয়ের প্রকৃত আকাক্সক্ষা জপ করে এ অচলায়তন থেকে বের হওয়া সম্ভব হচ্ছে না, হবে না। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রয়াসে দেশে যে রাজনৈতিক ভারসাম্য সৃষ্টি করা হয়েছে, তাতে মানুষ কোনো আশার আলো দেখতে পারছে না। আমাদের এই ভূখণ্ডে নিকট অতীতে ইতিহাসের বাঁক বদলে দেশের বামপন্থী শক্তি সমূহ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। পাকিস্তান আমলে ভাষা সংগ্রাম থেকে শুরু করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতিটি পর্বেই মিশে আছে কত শত কমিউনিস্ট ও বামপন্থীদের শ্রম, ঘাম আর রক্ত! আশির দশক জুড়েও সামরিক স্বৈরশাসন বিরোধী জাতীয় সংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে বাম আন্দোলন বিস্তৃতি লাভ করেছিল। বামপন্থীদের প্রধান দল কমিউনিস্ট পার্টিতে বিভক্তি, অন্যান্য বাম দলেও বিভক্তি এবং বামপন্থীদের একটি অংশ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোটে শামিল হওয়ায় জাতীয় রাজনীতিতে বামপন্থীদের ভূমিকা দুর্বল হয়ে পড়ে। মেহনতি মানুষের শ্রেণী স্বার্থের সংগ্রামে কিছু কিছু জায়গায় সীমিত উপস্থিতি থাকলেও জাতীয় রাজনৈতিক সংগ্রামে অনেকটা ছোটখাটো ‘অ্যাক্টিভিজিম’ এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ। তথ্য, কুতথ্য প্রবাহের এই যুগে এবং ইলেকট্রনিক ও সোশ্যাল মিডিয়ার আধিপত্যের এই সময়কালে দলীয় এবং ব্যক্তিগত প্রদর্শনবাদে অনেকেই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন।প্রদর্শিত হতে পারলেই সন্তুষ্ট থাকছেন এবং ভাবছেন যে বামপন্থার বা দলীয় রাজনীতির কাজ অগ্রসর হচ্ছে।

অন্যদিকে আমাদের মাতৃভূমি যে ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে, ডানপন্থা বা মধ্য-ডানপন্থা এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে টেকসই কোনো বিকল্প সমাধান বের করতে পারছে না, পারবে বলে মনে হয় না। তারা তো ১৯৯১ সনে অর্জিত ভোটের গণতন্ত্রটুকুই টিকিয়ে রাখতে পারলেন না। বরং তাদের কর্মফলে আজ দেশের বুকে উগ্র ধর্মান্ধ শক্তির এক ভয়াবহ উত্থান ঘটেছে। অতীত অভিজ্ঞতা বলে, নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতায় বামপন্থার উত্তরণই পারে উদ্যত নব্য ফ্যাসিস্ট আক্রমণ রুখে সাম্য, ন্যায়বিচার এবং প্রকৃত গণতন্ত্রের ভিত্তি গড়ে তোলার লড়াইয়ে দেশের সকল গণতান্ত্রিক, প্রগতিশীল দল, সামাজিক শক্তি ও ব্যক্তিবর্গকে এক কাতারে শামিল করার জটিল কাজটি সম্পন্ন করতে। কিন্তু বামপন্থার সেই প্রস্তুতি নেই। রাজনীতির মাঠে বামপন্থীরা জনআস্থা গড়ে তোলার মতো শক্তি সমাবেশ গড়ে তুলতে পারছে না। পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এবং এক নতুন বাস্তবতায় ছাত্র তরুণ এবং মধ্যবিত্তের মাঝে উদার ও মানবিক সমাজ বিনির্মানের যে নতুন ধরনের আকাক্সক্ষা সৃষ্টি হয়েছে তাকে ধারণ করে সাধারণ মানুষের বোধগম্য ভাষায় যুক্তিনির্ভর আকর্ষণীয় বক্তব্য ও যুৎসই কর্মসূচিও অনুপস্থিত। তাই ছাত্র তরুণদেরদের মধ্যে বামপন্থীদের সমর্থনও দুর্বল। এ পরিস্থিতিতে বামপন্থী শক্তির নবায়ন ও পুনর্জাগরণ জরুরি হয়ে পড়েছে। তার জন্য বামপন্থী শক্তিগুলির একযোগে কাজ করা প্রয়োজন।

হয়তোবা সে লক্ষ্যে অতি সম্প্রতি বামপন্থী গণতান্ত্রিক জোট এবং আরো কয়েকটি রাজনৈতিক দল এক কনভেনশনে মিলিত হয়ে চিহ্নিত স্বৈরাচারী ও কতৃত্ববাদী শক্তি এবং মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী ধর্মান্ধ শক্তি ছাড়া সকল রাজনৈতিক দল ও সামাজিক শক্তি সমূহকে একটি ‘গণতান্ত্রিক যুক্তফ্রন্টে’ শামিল হওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। দেশ যখন এক বিশেষ সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে নতুন পথের সন্ধান করছে তখন বামপন্থীরা একত্রিত হয়ে মধ্যবাম, প্রগতিশীল ও উদার গণতন্ত্রীদের সাথে নিয়ে এক গণতান্ত্রিক মহাজোট গঠনে সক্ষম হলে নতুন পথের সন্ধান মিলতে পারে। কিন্তু কনভেনশনটিকে যথেষ্ট প্রতিনিধিত্বশীল মনে হয় নি। প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক প্রস্তুতি ছাড়া তাড়াহুড়োর কনভেনশন মনে হলো। শ্রেণী পেশার দুর্বল প্রতিনিধিত্বে অনুষ্ঠিত বামকর্মীদের সমাবেশে যারা প্রতিনিধিত্ব করেছেন তাদের কারো কারো নিজ নিজ শ্রেণী ও পেশার সংগঠনে গ্রহণযোগ্যতা, রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে দৃঢ়তা, অতি সাম্প্রতিক অতীতে রাজনৈতিক ভূমিকা ইত্যাদি নিয়ে প্রশ্ন আছে।আবার কনভেনশন থেকে মানুষকে বিশেষত তরুণদের আকৃষ্ট করার মতো কোনো ঘোষণাও আসেনি। তাই এক্ষেত্রেও, ‘কলি ফুটিতে চাহে ফোটে না’। তবে এ কনভেনশনকে নিকট ভবিষ্যতের বৃহত্তর ও কার্যকর কনভেনশনের প্রস্তুতিমূলক কর্মসূচি হিসেবে বিবেচনা করে সামনে অগ্রসর হওয়া যেতে পারে।

উগ্র ডানপন্থি শক্তির আস্ফালন প্রতিরোধ ও পুরাতন কর্তৃত্ববাদী দুঃশাসনের পুনরাবৃত্তি রুখতে সমাজের সকল প্রগতিশীল ও উদার গণতন্ত্রীদের এমনকি মুক্তিযুদ্ধের আওয়ামী বয়ানে আচ্ছন্ন বা বিভ্রান্ত মানুষকেও টেনে আনতে হবে জনমুক্তির বয়ানে। জুলাই আন্দোলনে ধর্মীয় উগ্রবাদীদের অংশগ্রহণ আর আন্দোলনের সমাপ্তিতে ক্রমাগত সরাসরি মুক্তিযুদ্ধের উপর হামলা ও মব উল্লম্ফনের সংস্কৃতি দেখে যারা নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছেন বা জুলাই আন্দোলনকে নিয়ে নির্লিপ্ত বা সংশয়ী এমনকি সমালোচক তাদেরকেও টেনে আনতে হবে নতুন রাজনৈতিক বিন্যাসে। তাদের মাঝেও এ বোধ জাগ্রত করতে হবে যে, আমরা আমাদেরকে পতনের মুখোমুখি হতে দেবো না। এ ধরনের রাজনৈতিক পুনর্গঠনের জন্য সংকীর্ণতামুক্ত নতুন বামপন্থি নেতৃত্বের উত্থানও জরুরি, যারা ব্যাপকতর ঐক্যের গুরুত্ব এবং ক্ষমতার লড়াইয়ের জটিলতাগুলোও বুঝে লড়াই করবেন এবং জনগণের বিশেষত বর্তমান যুগের তরুণদের আশা-আকাক্সক্ষারও প্রতিফলন ঘটাবেন।

এমনটা সম্ভব হলে এ স্বপ্ন দেখা অন্যায় হবে না, আগামী দিনের বামপন্থীদের মিছিলে আদর্শিকভাবে প্রতিশ্রুত ও আন্তরিকভাবে পরিবর্তনকামী লড়াকু মানুষ যেমন থাকবে, তেমনি থাকবে দ্বিধায় দোলাচলে থাকা মানুষও। থাকবেন পরমের উপর ভরসা রাখা মানুষ। থাকবেন নিরেট জাগতিক। তেমনি থাকবেন মাওলানা, পুরোহিত, ভিক্ষু, পাদ্রী। সমতার সুরে থাকবেন নারীবাদীরাও। থাকবেন এমন সবাই, মানুষকে যারা মানুষ হিসেবে দেখতে চায়। এমনকি আমার মত দূরে দাঁড়িয়ে থাকা বাক্যবাগিশরাও থাকবেন। আর তেমনটা হলে ‘আছে যারা বোবার মতন/ তারাও কথা কবেই কবে/ এক সাথে সব যাত্রী যত একই রাস্তা লবেই লবে’। বামপন্থার ফুল বিকাশে অলি বার বার ফিরে আসবে। ‘কলি ফুটিতে চাহে ফোটে না’ - তারপরেও লাজ সরিয়ে ফুটবে।

(মতামত লেখকের নিজস্ব)

[লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা]

back to top